বর্তমানময় আধুনিক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

অ+ অ-

 

কবি হিসেবে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ [১৯৩৪-২০০১] খুব গভীরভাবে সমকালীন কাব্যবলয়ের সাথে সম্পর্কিত, অথচ প্রথম থেকেই তিনি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা, ভঙ্গি ও স্বরের চর্চা করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের বিখ্যাত কোনো এক মাকে কবিতাই তাঁকে চিনিয়ে দেয় পূর্বাপরপরিষ্কার দেখিয়ে দেয়, তিনি সম্পর্কিত ছিলেন এবং থাকবেন নব-উদ্ভূত দেশ-চেতনার খুব গভীর উপলব্ধির মধ্যে, অথচ তাঁর দেখার চোখ ও প্রকাশভঙ্গি হবে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।

 

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল চর্চায় বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকটি উজ্জ্বল মহিমা নিয়ে বর্তমান। দেশের বেশ কয়েকজন প্রধান সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছেন এ দশকে, এবং পরবর্তী কয়েক দশক তাঁদের অনেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। কবিতার ক্ষেত্রে কথাটা আরো বেশি সত্য। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতা আধুনিক বাংলা কাব্যের সমান্তরালে চলতে শুরু করে। পূর্ববর্তী দশকের কাব্য-সাধনার স্বাতন্ত্র্যবাদী চর্চার বদলে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের ধ্যান-ধারণা ও জীবন-যাপনের ভিতর থেকে রচিত হতে থাকে নতুন ধরনের কবিতা। রাজনৈতিক দিক থেকে দশকটি ছিল ঘটনাবহুল এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী চৈতন্যের উদ্ভবের কাল। ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে নাগরিক মধ্যবিত্তের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল। আধুনিক জীবনদৃষ্টির নানামাত্রিক উৎসারণ ঘটছিল এই নববিকশিত নাগরিক মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে। নতুন কবিদের রচনায় দেখা যায় এর গভীর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিফলন। সামগ্রিকভাবে পঞ্চাশের দশকের কবিতা বাংলাদেশের উদ্দীপ্ত মধ্যবিত্তের সজীব উদযাপন, আধুনিকতার বহুমাত্রিক উদ্দীপনায় মুখর এবং জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার বিচিত্র অভিক্ষেপে সমৃদ্ধ।

পূর্ববর্তী দশকের সাহিত্যিকরা বিকশিত হয়েছিলেন সামাজিক-রাজনৈতিক দিক থেকে উপমহাদেশের সবচেয়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়কালে। রাজনীতির পট-পরিবর্তন, নির্বাচন ও ক্ষমতা-সম্পর্কের নতুন বিন্যাস, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও দাঙ্গার প্রকোপ, মন্বন্তর, ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ওই দশকের সাহিত্যিকদের মনোগঠন এবং সাহিত্যিক অভিমুখ নির্ধারণ করেছিলতাঁদের সাহিত্যকর্মে প্রত্যক্ষভাবে তার নজির পাওয়া যায়। পঞ্চাশের দশকের কবিরাও ওই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন। কিন্তু যৌবনের শুরুতেই বা কিশোরকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই তাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন এক নতুন প্রবলতর বাস্তবতায়। সাতচল্লিশের আজাদি তাঁদের সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছিল।

সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন যেসব বাস্তবতার জন্ম দিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকার প্রতিষ্ঠা। ঢাকাকেন্দ্রিক একটি মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর বিকাশ এর ফলে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। আজাদির আগে বিকশিত হিন্দু মধ্যবিত্তের প্রবল প্রতাপের মধ্যে আত্মবিকাশের যে বাধা মুসলমান মধ্যবিত্ত বোধ করছিল, এর ফলে তার অবসান ঘটে। মধ্যবিত্তের বিকাশ ত্বরান্বিত হওয়া এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাকরণে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়া এ বাস্তবতার প্রমাণ দেয়। কিন্তু একইসাথে বিকাশমান এ মধ্যবিত্ত নতুন সংকটেরও মুখোমুখি হয়। আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে পাকিস্তানবাদী মুসলমান পরিচয় এবং বাংলাদেশের বাংলাভাষী তথা বাঙালি পরিচয়ের মধ্যে নতুন দ্বন্দ্বের পথ উন্মুক্ত হয়।

পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় দেশকাললগ্ন রাজনৈতিক চৈতন্যের যে নবতর বিকাশ ঘটেছিল, ষাটের দশকে তা আরো ঘনীভূত হয়। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা-কাঠামোর যে ধরনের রূপায়ণ ঘটেছিল, তাতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিকাশ ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে থাকে। বিশেষত, বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি কেন্দ্রীয় ক্ষমতাতন্ত্রের মনোভাব ছিল স্পষ্টতই বর্ণবাদী এবং আধা-ঔপনিবেশিক।

এ দ্বন্দ্বের ব্যাপক প্রকাশ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের ভাষাপ্রশ্নটি সাতচল্লিশের আগে থেকেই আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের উৎস হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে ক্রমাগত উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রেক্ষাপটে ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত-সমাজের আপত্তি আর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ক্রমাগত জোরালো হতে থাকে। উনিশশ আটচল্লিশ সালেই এ দাবি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করে, এবং প্রতিরোধ-সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। নবগঠিত রাষ্ট্রটি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য যে বিপুল স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার বার্তা ঘোষণা করেছিল, তা অবসিত হয়ে বিরূপতায় উপনীত হতে সময় লাগেনি। বস্তুত জনজীবনের সংকট বাড়ছিল। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীনতা, রাজনৈতিক নিপীড়নের আধিক্য, কর্মহীনতা আর জীবনের সার্বিক অনিশ্চয়তা অতি দ্রুতই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র-কাঠামোর প্রতি ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দেয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল এসব বিচিত্র অসন্তোষের সমন্বিত প্রতিফলনআর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নতুন সব দৃষ্টিভঙ্গির যৌথ প্রকাশ, যার চূড়ান্ত মুহূর্ত ঘোষিত হয়েছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে।

সামগ্রিক অংশগ্রহণের দিক থেকে ভাষা আন্দোলন ছিল এক ব্যাপক-গভীর তৎপরতা। পরবর্তীকালেষাটের দশকেএ আন্দোলন জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও চৈতন্যের বিকাশে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। বাঙালি পরিচয়ের রাজনীতি এর মধ্যেই জোরালো ভিত্তি পেয়েছিল। কিন্তু তার আগেইপঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেইপূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজকে নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও নাগরিক অধিকারের এক সর্বব্যাপী ধারণায় স্নাত করছিল ভাষা আন্দোলন। তার প্রত্যক্ষ ও কার্যকর প্রমাণ মেলে চুয়ান্নের নির্বাচনে। এসময় যুক্তফ্রন্ট তাদের যে বিখ্যাত নির্বাচনী ইশতেহার রচনা করেছিল, তার মধ্যেই ভাষা আন্দোলনের নতুন চৈতন্য এবং নতুন রাজনীতির প্রতাপ ঘোষিত হয়েছে। ভাবগতভাবে পঞ্চাশের দশকের কবিদের পক্ষে এর বাইরে থাকা সম্ভব ছিল না; এবং তাঁদের কাব্য নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে, তাঁরা বাইরে ছিলেন না।

পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় দেশকাললগ্ন রাজনৈতিক চৈতন্যের যে নবতর বিকাশ ঘটেছিল, ষাটের দশকে তা আরো ঘনীভূত হয়। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা-কাঠামোর যে ধরনের রূপায়ণ ঘটেছিল, তাতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিকাশ ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে থাকে। বিশেষত, বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি কেন্দ্রীয় ক্ষমতাতন্ত্রের মনোভাব ছিল স্পষ্টতই বর্ণবাদী এবং আধা-ঔপনিবেশিক। এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার পাকিস্তান-বিরোধী মনোভাব ক্রমশ চাঙা হতে থাকে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে এই বিরূপতা ক্রমে জোরদার হয়ে ষাটের দশকের শেষভাগে প্রতিরোধ-সংগ্রামের রূপ নেয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফাকে বলা যায় রাজনৈতিকভাবে এ দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নায়ক, আর ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে বলতে পারি এর উত্তুঙ্গ প্রকাশ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ তার পরিণতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক-মতাদর্শিক দিক থেকে চরম বিরোধপূর্ণ দশকটিকেও এ তালিকায় আনতে হবে।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রথম কাব্য সাতনরী হার প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। প্রথম থেকেই তিনি ছড়া লিখতেন; আর ছড়ার আঙ্গিকগত ও উচ্চারণগত বিশিষ্টতাকে অনাহত রেখেই তিনি তাঁর কবিতার জন্য এক অনন্য আঙ্গিক তৈরি করে নেন। ছড়া শুধু ছন্দের ব্যাপার নয়উপকরণগত ও শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে ছড়ার স্বতন্ত্র ধারাবাহিকতা আছে। চর্চাগত ঐতিহ্য আছে। লোককথা, জনজীবনের অন্তরঙ্গ অলঙ্কার এবং গ্রামীণ জীবন ছড়ার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।

পঞ্চাশের দশকের কাব্যালোচনায় এ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রত্যক্ষ তাৎপর্য হল, সামষ্টিকভাবে এ দশকের কবিদের রচনায় এর গভীর প্রতিফলন শনাক্ত করা যায়। পূর্ববর্তী দশকের কবিরাও এসব ঘটনা-পরম্পরায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। আর ষাটের দশকের নতুন-আবির্ভূত কবিরা তো বেড়েই উঠেছেন ওই বাস্তবতার মধ্যে। কাজেই তাঁদের কাব্যেও এসব জাতীয় বাস্তবতার গভীর প্রতিফলন আছে। কিন্তু দুই কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বাস্তবতার উক্ত ইতিহাসের সাথে পঞ্চাশের দশকের কবিদের কাব্যিক সংযোগ গভীরতর। প্রথমত, চল্লিশের দশকের কবিরা কাব্যযাত্রা শুরু করেছিলেন জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চৈতন্যের পূর্ববর্তী স্তরে। আর ষাটের দশকের কবিরা কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন দেশকালের ব্যাপারে তুলনামূলক নির্লিপ্ত আধুনিক নন্দনচেতনার আবহে। কাজেই চল্লিশ ও ষাটের দশকের কবিদের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার বিকাশের সমান্তরালে তাঁদের কাব্যধারার বিকাশ ঘটেনি। এটা ঘটেছে পঞ্চাশের দশকের কবিদের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয়ত, পঞ্চাশের দশকের সামগ্রিক কবিভাষায় ও কাব্যস্বভাবে দেশকাল ও প্রতিবেশের পূর্ববর্ণিত উপাদানগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব প্রধানভাবে শনাক্ত করা যায়। চল্লিশ ও ষাটের দশকের কবিদের সামষ্টিক কাব্যভাষায় এ প্রভাব তুলনামূলক কম।

জাতীয় রাজনীতির প্রবল বাস্তবতা পঞ্চাশের কবিতায় প্রধান যে চৈতন্যের সঞ্চার করেছিল, তাকে বলা যায় দেশ-জাতি-চেতনা। পূর্ব বাংলার জনসমাজকে গভীরভাবে বুঝতে চাওয়ার নানা আয়োজনে এ সময়ের কবিতা বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। কবিদের একাংশ বিপুল গ্রামীণ জীবন ও জনগোষ্ঠীকে কবিতার বিষয় করেছিলেন। অন্য অংশ গ্রামীণ লোকসাহিত্য ও লোকপুরাণকে বিষয় ও শিল্পরূপ উভয় দিক থেকে সাফল্যের সাথে কাব্যচর্চায় অঙ্গীভূত করেছিলেন। পূর্ব বাংলা লোকসাহিত্যে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এবং বিশেষত কৃষক-সমাজ এ লোকালয়ের মূল জনসমাজ। কাজেই নাগরিক মধ্যবিত্তের শিল্পসাহিত্য-চর্চায় এ জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি সবসময়ই ছিল। এমনকি চল্লিশের দশকের পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিকরাও পুথিসাহিত্যের পাশাপাশি লোকসাহিত্যকে নিজেদের সাহিত্যচর্চার অন্যতম অবলম্বন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের হাতে এ চর্চা বিকশিত হয়নি। লোক-উপকরণকে আধুনিক সাহিত্যের বিষয় হিসেবে অঙ্গীভূত করার ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে মূলত পঞ্চাশের কবিদের চর্চায়। বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে উত্তর-আধুনিক কাব্যচর্চার ধারায় গ্রামীণ ও লোক-উপকরণের ব্যাপক কাব্যিক চর্চা সত্ত্বেও এ কথা বলা যাবে যে, পঞ্চাশের কবিরাই এদিক থেকে বাংলাদেশের কবিতার সফলতম প্রজন্ম। নিঃসন্দেহে জাতীয়তাবাদী চৈতন্যের অংশ হিসেবে দেশকাললগ্ন হয়ে ওঠার অন্তর্গত ও সামষ্টিক তাগিদই তাঁদের এই যৌথ সাফল্যের উৎস।

পুরো ব্যাপারটা সম্ভবপর হয়েছে আদতে আধুনিক কাব্যচর্চার দূতিয়ালিতে। পঞ্চাশের দশকের কবিরা কাব্যজগতে প্রবেশের আগেই বাংলা কবিতার বৃহত্তর অঙ্গনে, প্রধানত তিরিশের কবিদের প্রবল প্রতিপত্তির মধ্য দিয়ে, আধুনিকতার চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। পুরনো কাব্যচর্চায়, বিশেষত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও তার পরবর্তী চর্চায়, পশ্চিমা প্রভাবের আধুনিক কবিতাই বাংলা কাব্যচর্চার মূলধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তিরিশের কবিরা যেভাবে আধুনিকতাকেই কাব্যচর্চার প্রধান মাত্রা ও লক্ষ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, তার তুলনীয় কিছু আমরা আগের কাব্যধারায় দেখি না। তিরিশের ওই পশ্চিম-বাহিত আধুনিকায়ন এতটাই প্রতাপশালী ছিল যে, এমনকি চল্লিশের দশকের স্বাতন্ত্র্যবাদ এবং ইসলামি কাব্যধারাও তার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি। ফররুখ আহমদ বা সৈয়দ আলী আহসানের মতো কবিরা পুথির জগৎকে বর্তমান জগতের কাব্য-ভাষায় অনুবাদের জন্য পশ্চিমা উচ্চ-আধুনিকতার প্রধান কবিদের শৈলী ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ইসলামিমুসলমানি ভাবাদর্শের চাপে চল্লিশের কাব্যধারায় আধুনিকতার দিকগুলো অত প্রাধান্য লাভ করতে পারেনি। পঞ্চাশের দশকের পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক ও কাব্যিক আবহের মধ্যে এ সংকট ছিল না। দু-একজন ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাঁরা প্রায় সামষ্টিকভাবেই বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতা সঞ্চারের সাধনা করেছিলেন।

১৯৮০-র দশকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রবেশ করেছেন একেবারেই নতুন কাব্যপর্বে। পূর্বতন ভাব-ভঙ্গি ও ছন্দ-অলঙ্কারকে পেছনে ফেলে কবিতায় এক সামষ্টিক ও মহাকাব্যিক প্রতীতি নির্মাণ এসময় তাঁর মুখ্য প্রবণতা হয়ে ওঠে। আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি [১৯৮১] এবং বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা [১৯৮৩] কাব্যদ্বয়ে এ প্রবণতার সফল প্রকাশ ঘটেছে।

কিন্তু কোনোপ্রকার ব্যাখ্যামূলক প্রত্যয় ও প্রতীতি যোগ না করে পঞ্চাশের দশকের কবিদের বর্ণনা করার জন্য আধুনিকতা বা আধুনিকায়ন আখ্যা ব্যবহার খুব একটা সুফলদায়ী নয়। এ সময়ের কবিরা কলকাতার কবিতার সাথে নিজেদের যোগ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় লেখা প্রকাশের আকুতি এবং লেখা প্রকাশ হওয়ার পরে ব্যক্ত আবেগের অতিরেক সে কথাই বলে। তদুপরি, পশ্চিমা তথা বিশ্বজনীন আধুনিক কবিতার সাথে সম্পর্কিত হওয়ার ব্যাপারেও এ সময়ের কবিদের যথেষ্ট আগ্রহ দেখা গেছে। তা সত্ত্বেও নিছক আধুনিকতা শব্দের বরাতে এ সময়ের কবিদের সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা বোঝা যাবে না। কারণ, সময়ের প্রচণ্ডতার চাপে ও টানাপড়েনেযার কিছু পরিচয় আমরা আগেই দিয়েছিদেশজ বাস্তবতা ও উপাদানের নিরঙ্কুশ ছাপ এ সময়ের কবিদের রচনায় এতটাই প্রধান হয়ে উঠেছে যে, খোদ আধুনিকতার ধারণাগুলোই এ কাব্যধারায় নতুন মূর্তি পরিগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চাশের দশকের কবিদের পরিচয় জ্ঞাপনার্থে কখনো কখনো দেশজ আধুনিকতা প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের ওই দশকের কবিদের ক্ষেত্রেও অভিধাটি হুবহু প্রযোজ্য হতে পারেযদিও খুবই ভিন্ন মাত্রায় এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে।

কবি হিসেবে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ [১৯৩৪-২০০১] খুব গভীরভাবে সমকালীন কাব্যবলয়ের সাথে সম্পর্কিত, অথচ প্রথম থেকেই তিনি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা, ভঙ্গি ও স্বরের চর্চা করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের বিখ্যাত কোনো এক মাকে কবিতাই তাঁকে চিনিয়ে দেয় পূর্বাপরপরিষ্কার দেখিয়ে দেয়, তিনি সম্পর্কিত ছিলেন এবং থাকবেন নব-উদ্ভূত দেশ-চেতনার খুব গভীর উপলব্ধির মধ্যে, অথচ তাঁর দেখার চোখ ও প্রকাশভঙ্গি হবে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। ওই কবিতা তাঁর নাগরিক অবস্থানের চিহ্ন বহন করে, একই সাথে বৃহত্তর জনমানুষের যাপিত জীবনকে তিনি-যে যাপিত জীবনের নিরিখেই নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে আনবেন, তার কথাও বলে। কোনো এক মাকে কবিতার বর্ণনামূলক দীপ্তি অবশ্য তাঁর প্রথম পর্যায়ের দীর্ঘ পরিসরের প্রধান কাব্য-বৈশিষ্ট্য নয়। এ রীতি ফিরে আসবে তাঁর অনেক পরের দ্বিতীয় পর্বে, যখন তিনি এক ধরনের জাতীয়তাবাদী উচ্চারণ-ভঙ্গিতে সামষ্টিক কথকতার বলিষ্ঠ প্রকাশে নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় উন্নীত করবেন। কিন্তু তাঁর প্রথম পর্বের অন্যকিছু বৈশিষ্ট্য, যেমন নাগরিক বর্তমানের উপলব্ধিগত সচেতনতা, উচ্চারণের স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতা, গ্রাম ও লোকজ ঐতিহ্য-নির্ভরতা ইত্যাদি ওই ধ্রুপদি কবিতায় প্রবলভাবেই ছিল, যেমন ছিল তাঁর প্রথম পর্বের অন্যসব কবিতায়।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রথম কাব্য সাতনরী হার প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। প্রথম থেকেই তিনি ছড়া লিখতেন; আর ছড়ার আঙ্গিকগত ও উচ্চারণগত বিশিষ্টতাকে অনাহত রেখেই তিনি তাঁর কবিতার জন্য এক অনন্য আঙ্গিক তৈরি করে নেন। ছড়া শুধু ছন্দের ব্যাপার নয়উপকরণগত ও শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে ছড়ার স্বতন্ত্র ধারাবাহিকতা আছে। চর্চাগত ঐতিহ্য আছে। লোককথা, জনজীবনের অন্তরঙ্গ অলঙ্কার এবং গ্রামীণ জীবন ছড়ার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে আত্মসাৎ করে বৃহত্তর লোকজীবন ও গ্রামীণ জীবনের উপকরণ মিশিয়ে সমকালীন উপলব্ধি প্রকাশের পথ তৈরি করে নিলেন তাঁর কবিতায়। তাতে একদিকে গল্পে বর্ণিত পূর্বতন জীবনের ঐশ্বর্য যেমন কবিতায় বাণীবদ্ধ হল, তেমনি বর্তমানের বিবর্ণ ছবিগুলোও বিশ্লেষণাত্মক ও মননশীল কায়দায় প্রকাশিত হল।

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর অপর তাৎপর্যপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ আমার সময়। বৃহত্তর সময় ও বাস্তবতার সাথে বর্তমানের সম্পর্ককে দ্বান্দ্বিক পটভূতিতে উপস্থাপন করা এ কাব্যের মূল সুর। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর কবিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রত্যয়ী উচ্চারণ। সরলতা ও স্পষ্টতা বরাবরই তাঁর কাব্যসঙ্গী।

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় কখনো রং কখনো সুর, আর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় কমলের চোখ। এ দু-কাব্যেও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর প্রথম কাব্যের উচ্চারণভঙ্গি অব্যাহত রেখেছেন। দেশ ও জনগোষ্ঠীর সাথে কাব্যভাষার মধ্য দিয়ে সম্পর্কিত হওয়ার একেবারেই নিজস্ব যে তরিকা এই কবি উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং আন্তরিকভাবে চর্চা করেছিলেন, তার কোনো পূর্বসূরি ও উত্তরসূরি বাংলা কবিতায় পাওয়া যায় না। এ ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, কবিতায় গ্রামীণ জীবন উপস্থাপনের বা প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করার যেসব নজির আমরা দেখি, তার সাথে এর কোনো মিল নেই। ওবায়দুল্লাহ প্রকৃতি, গ্রাম ও লোকজীবন কিছুতেই বাস্তব জীবনধারার প্রতিনিধিত্ব করে না। আসলে তা কোনো বাস্তববাদী উপস্থাপনাই নয়। বরং ছড়ার ভঙ্গিকে অবলম্বন করে তিনি সামষ্টিক অচেতনে প্রবলভাবে উপস্থিত রূপকল্পগুলোকে বক্তব্যপ্রকাশের বাহন করেছেন; আর সেইসূত্রে বৃহত্তর সময় ও সমাজের সাথে গভীরভাবে লগ্ন থাকার কেতা আবিষ্কার করেছেন। পুরো প্রক্রিয়াটাকে আমরা বলতে পারি অনুমিত বিপুল কালপরিধির পুনর্নির্মাণ, এবং ঐতিহ্যের আধুনিক পুনর্নির্মাণ। তাতে বর্তমানময়তাই প্রধান সুর। সে কারণেই আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রথম দীর্ঘ পর্বের কবিতাগুলোতে সমকালীন উপলব্ধি, নাস্তি ও সমালোচনাপ্রবণ শ্লেষাত্মক প্রবণতা খুব জোরালোভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৮০-র দশকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রবেশ করেছেন একেবারেই নতুন কাব্যপর্বে। পূর্বতন ভাব-ভঙ্গি ও ছন্দ-অলঙ্কারকে পেছনে ফেলে কবিতায় এক সামষ্টিক ও মহাকাব্যিক প্রতীতি নির্মাণ এসময় তাঁর মুখ্য প্রবণতা হয়ে ওঠে। আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি [১৯৮১] এবং বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা [১৯৮৩] কাব্যদ্বয়ে এ প্রবণতার সফল প্রকাশ ঘটেছে। এ পর্বেওপ্রথম পর্বের মতোইকবির লক্ষ্য ছিল বিপুল সময়ের আবর্তনে জনজীবনের বিচিত্র উত্থান-পতন ও অর্জনকে কেলাসিত করে ঐতিহ্য প্রস্তাব করা, এবং তার সাথে আকাঙ্ক্ষার বেশে বর্তমানের তির্যক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ধরন-ধারণে এ উচ্চারণ এতই আলাদা যে, একে প্রথম পর্বের সাথে সম্পর্কহীন বলেই মনে হয়। স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ উচ্চারণে প্রজ্ঞাশাসিত সত্যের মতো কবি তাঁর সিদ্ধান্তগুলো জানিয়ে গেছেন। সেখানে অতীত বা ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণই মুখ্য হয়ে উঠেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, ঐতিহ্যের নির্মাণে নানা আপাতবিরোধী উপাদান গৃহীত হয়েছে, এবং উপাদানগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবরণীতে রূপান্তরিত করার কোনো চেষ্টা কবি করেননি। তার মানেই হল, কোনো একরৈখিক ঐতিহ্য প্রস্তাব করার পরিবর্তে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার কথাই কবি বলেছেন। একমাত্র উপলব্ধিগত সক্রিয়তাই এসব উপকরণের মধ্য থেকে সামষ্টিকতার শিথিল কোনো সূত্র আবিষ্কার করতে পারবে। কবিতাগুলোতে কবিত্বের উপর যে প্রবল গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এবং কবিতা-পাঠকের সক্রিয়তা ও প্রস্তুতিকে বারবার সামনে আনা হয়েছে, উপলব্ধিগত চৈতন্যকে আবাহন করাই হয়ত তার প্রধান কারণ।

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর অপর তাৎপর্যপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ আমার সময়। বৃহত্তর সময় ও বাস্তবতার সাথে বর্তমানের সম্পর্ককে দ্বান্দ্বিক পটভূতিতে উপস্থাপন করা এ কাব্যের মূল সুর। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর কবিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রত্যয়ী উচ্চারণ। সরলতা ও স্পষ্টতা বরাবরই তাঁর কাব্যসঙ্গী। আধুনিকতাবাদী পশ্চিমা ও দেশজ উচ্চারণভঙ্গির সাথে কোনোরূপ আপস না করেই তিনি বর্তমানময় আধুনিকতার একটা নিজস্ব ছাঁচ হাজির করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের কাব্যজগতে তাঁর সে কীর্তির সবিশেষ মূল্য আছে।