হান কাংয়ের ‘দি হোয়াইট বুক’ থেকে নির্বাচিত অংশ

অ+ অ-

 

|| ভূমিকার বদলে ||

২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখিকা হান কাংয়ের দি হোয়াইট বুক বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালের ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারের জন্য মনোনীত শর্ট লিস্টে ছিল বইটি। শুরু থেকেই বইটি মূলত একটি উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসলেও বইটির মূল আবেদন সম্ভবত এর দুঃখভারাতুর, কাব্যময় গদ্য। পড়তা উপন্যাসের বিবেচনায় পড়তে কিছুটা খাপছাড়া মনে হলেও এ বইয়ের যত ভেতরে ঢুকব, ততই দেখব পুরো বইটি আবর্তিত হচ্ছে জন্মের দুঘণ্টার মধ্যেই মারা যাওয়া একটি বাচ্চা মেয়েকে ঘিরে। উপন্যাসের কথক হচ্ছেন ওই বাচ্চারই বোন এবং বাচ্চাটার মৃত্যু যে তার পৃথিবী দেখার চোখকেই বদলে দিয়েছে, তারই একটা প্রমাণ এই বইয়ের কাব্যময়, টুকরো টুকরো গল্পগুলো। ফলে আত্মজৈবনিক উপাদানে সমৃদ্ধ এই বইটিকে উপন্যাস হিসেবে যেমন পড়া যায়, তেমনি টুকরো টুকরো কাহিনিগুলোকে আলাদা আলাদা কবিতা, তথা গদ্য কবিতা হিসেবেও পড়তে অসুবিধা হয় না। আমরা প্রতিধ্বনিতে দি হোয়াইট বুক-এর কিয়দংশ হাজির করেছি মাত্র। বইটি কোরিয়ান থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডেবোরাহ স্মিথ

 

দি হোয়াইট বুক || হান কাং || অনুবাদ: অরিত্র আহমেদ

 

|| নবজাতকের গাউন ||

আমাকে বলা হয়েছিল যে, আমার মায়ের প্রথম বাচ্চাটা মারা গিয়েছিল জন্মের দুঘণ্টার মধ্যেই।

আমাকে বলা হয়েছিল যে, বাচ্চাটা ছিল একটা মেয়ে, দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো দেখতে চালের পিঠার মতো সাদা তার মুখ। যদিও সে ছিল খুব ছোট্ট একটা জীব, কেননা যথাসময়ের দু’মাস আগেই পৃথিবীতে এসেছিল সে, তবু তার গড়নগাড়ন সবই আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল। একবার মা আমাকে বলেছিল, ওই মুহূর্তটার কথা আমি কখনো ভুলবো না, যখন বাচ্চাটা প্রথম তার কালো কালো চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।

সে সময় আমার বাবা মা থাকতো নির্জন একটা বাড়িতে, একটা প্রাথমিক স্কুলের পাশেই, যে স্কুলে আমার বাবা পড়াতো। আমার মায়ের প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ তখনো অনেক দূরে, তাই হঠাৎ সেই সকালবেলায় যখন পানি ঝরা শুরু করলো, মা তখনই একদমই অপ্রস্তুত। তার চারপাশে কেউ নেই তখন। সারা গ্রামে একটাই টেলিফোন- তা-ও আবার বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা ছোটো দোকান পর্যন্ত না গেলে মিলবে না, কুড়ি মিনিটের পথ সেটা। কাজ সেরে আমার বাবার বাড়িতে ফেরার তখনো ছ'ঘণ্টা বাকি।

শীতের সবে শুরু তখন, বৎসরের প্রথম তুষার মাত্র ঝরেছে। বাইশ বছর বয়সী মা আমার হামাগুড়ি দিয়ে রান্নাঘরে গেলো কোনোরকমে, একটা কাঁচিকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য পানি গরম করলো খানিকটা। সেলাইয়ের বাক্স হাতড়ে মা কিছু শাদা কাপড় পেলো, তা দিয়ে বাচ্চাটার জন্য একটা গাউন বানিয়ে ফেলা যাবে সহজেই। ভীতসন্ত্রস্ত, প্রসবযন্ত্রণায় কাতর আমার মা তড়িঘড়ি সুঁই-সুতো চালাতে লাগলো, দরদর করে পানি পড়তে লাগলো তার চোখ বেয়ে। গাউন বানানো শেষ হলে মা একটা কাঁথা খুঁজে বের করলো বাচ্চা ধরার ন্যাকড়া হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। উত্তরোত্তর তীব্র হয়ে ফিরে ফিরে আসছিল প্রসব-বেদনা, আর আমার মা দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছিল।

শেষ পর্যন্ত একটা বাচ্চা হলো। তখনো মার পাশে কেউ নেই, নিজের হাতে মা বাচ্চার নাভিরজ্জু ছিন্ন করলো। রক্তমাখা বাচ্চাটাকে মা একটু আগেই বানানো গাউনটা পরিয়ে দিলো, আর কোলে তুলে নিলো কান্নারত ছোট্ট প্রাণীটাকে। আল্লার দোহাই লাগে, মরিস না তুই'- ক্ষীণ গলায় মা খালি এই কথাটাই মন্ত্রের মতো বলতে লাগলো বারবার। এক ঘণ্টা বাদে বাচ্চাটার শক্ত করে আঁটা চোখের পাতা সহসা খুলে গেলো। মায়ের চোখে তার চোখ পড়তেই মার ঠোঁট নড়ে উঠলো আবার। আল্লার দোহাই লাগে, মরিস না তুই। ঘণ্টাখানেক পরে বাচ্চাটা মারা গেলো। রান্নাঘরের মেঝেতে তখন শুয়ে আছে দুইটি মানুষ। আমার মা, তার বুকে জাপটে ধরা মরা বাচ্চাটা, টের পাচ্ছে বাচ্চাটার মাংসে ধীরে ধীরে শীতের হিম ছড়িয়ে পড়া, শীতের হিম পৌঁছে যাওয়া তার হাড়গোড় অব্দি। ততক্ষণে কান্না থেমে গেছে।

 

|| বুকের দুধ ||

বাইশ বছর বয়সী নারীটি বাড়িতে শুয়ে আছে একা একা। শনিবারের সকাল, ঘাসের গায়ে তুষারের প্রথম ফোঁটাটা তখনো লেগে আছে, তার পঁচিশ বছর বয়সী স্বামী একটা কোদাল নিয়ে পাহাড়ের উপরে গেছে গতকালই জন্ম নেওয়া শিশুটিকে কবর দিতে। নারীটির ফোলা ফোলা চোখ ঠিকমতো খুলতে চাইছে না। তার শরীরের বিভিন্ন সন্ধিতে ব্যথা, আঙুলের ফোলা গিটগুলো যন্ত্রণায় ফেটে যাওয়ার যোগাড়। আর তখনই, প্রথমবারের মতো, সে বুকে অনুভব করলো উষ্ণতার উপচে-পড়া প্লাবন। উঠে বসে, হাত দিয়ে উদভ্রান্তের মতো সে তার বুক কচলালো। পানি পানি, হলদেটে এক তরল বেরিয়ে আসলো প্রথমে, তারপর চুয়ে পড়তে থাকলো মসৃণ, শাদা শালদুধ।

 

|| সে ||

ভাবি এই শালদুধ খাওয়ার জন্য বাচ্চা মেয়েটার বেঁচে থাকার কথা।

ভাবি তার জেদী নিঃশ্বাস আর স্তনের বোটায় মুখ রেখে তার অস্ফুট আওয়াজের কথা।

ভাবি মাই-ছাড়ানোর পর তার জাউ ভাত খেতে বসা, তার বেড়ে ওঠা, নারী হয়ে ওঠা আর সকল বাঁধা সামলিয়ে তার বেঁচে থাকার কথা।

ভাবি প্রতি বারেই লক্ষ্যচ্যুত মৃত্যুর কথা, মৃত্যুর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দৃঢ় পায়ে তার এগিয়ে যাওয়ার কথা।

মরিস না তুই। খোদার দোহাই লাগে, মরিস না।

ভাবি, এই কথাগুলো তার শরীরে বেঁধে রাখার জন্য একটা মাদুলি দেওয়ার কথা।

ভাবি, আমার বদলে তার এইখানে আসার কথা।

এই চিরচেনা শহরে, যার জন্ম ও মৃত্যু আসলে তারই জন্ম ও মৃত্যুর সাথে মিলে যায়।

 

|| শাদা পাথর ||

অনেক অনেক দিন আগে সাগরপাড়ে সে খুঁজে পেয়েছিল ছোট্ট একটা পাথর। পাথরের গা থেকে বালি ঝেড়ে ফেলে সেটা পকেটে করে বাড়িতে এনে একটা ড্রয়ারে চালান করে দিয়েছিল। ঢেউয়ের অনবরত আদর-স্পর্শ পেয়ে পেয়ে গোল আর মসৃণ হয়ে যাওয়া একটা পাথর। পাথরটার শুভ্রতা তার কাছে মনে হতো কাচের মতো স্বচ্ছ; কিন্তু এর ভেতর দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করা মাত্রই সে বুঝতো যে সে আসলে ভুল ভেবেছে। (আসলে এটা ছিল খুব সাধারণ, শাদা একটা পাথর মাত্র।) মাঝেমাঝে পাথরটা বের করে সে হাতের ওপর রাখতো। তার মনে হতো, নীরবতাকে ঘনীভূত করে যদি শক্ততম এবং ক্ষুদ্রতম একটা কঠিন বস্তুতে পরিণত করা যেতো, তো এই পাথরের মতোই তাকে দেখতে লাগতো বোধ হয়।

 

|| শাদা কাগজে কালো লেখা ||

যখনই সে অনেক কষ্টে একটু সুস্থ হয়ে উঠতো, তখনই তার মনে হতো এক হিমশীতল অনুভব ছড়িয়ে পড়ছে তার জীবন থেকে। এমন একটা অনুভূতি, যাকে তিক্ততা বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না, আবার বিদ্বেষ' বললেও একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। তার যেনো মনে হতো, এই যে, আজ প্রতি রাতে যে তার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিচ্ছে আর আদর করে চুমো খাচ্ছে কপালে, একদিন সেই আবার খেপে যাবে তার উপর, তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে বের করে দেবে বাসা থেকে, আর তাকে নিশ্চিত করে ছাড়বে যে, ওই সমস্ত সূর্যস্নাত হাসি-আনন্দ ছিল নেহাতই উপরি উপরি।

আয়নায় নিজেকে দেখার সময় একটা বারের জন্যও সে ভুলতে পারেনি যে তার মুখের আড়ালে খেলা করছে স্বয়ং মৃত্যু। ক্ষীণ, অথচ নাছোড়বান্দা এই অনুভূতি, যেনো পাতলা কাগজের উপর কালো লেখার রক্তের মতো ঝরে পড়া।

জীবনকে আবার ভালোবাসতে শেখা এক সুদীর্ঘ আর জটিল প্রক্রিয়া।

কেননা একটা পর্যায়ে তুমি অনিবার্যভাবেই একপাশে সরায়ে দেবে আমাকে,

যখন আমি সবচেয়ে দুর্বল, যখন সাহায্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি,

আমার থেকে মু্খ ফিরায়ে নিবা তুমি, শীতল আর অনড়,

আর এটা যে হবেই, সেটা আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার,

আর আজ আমি ফিরে যেতে পারবো না এই বোধ জন্মানোর আগের সময়ে।

 

|| ছড়িয়ে পড়া ||

দিন শেষ হবার আগেই ঝরা শুরু হয়েছিল পঙ্কিল তুষার।

চোখের পলকে পুরনো শহরের ছাইয়ের মতো ধূসর রাস্তাগুলো ধুয়েমুছে ধবধবে শাদা হয়ে গেলো। এমনই নিখুঁত সেই শুভ্রতা যে তাকে প্রায় অবাস্তব মনে হচ্ছিল, আর শাদা ক্যানভাসে তাকালেই দেখা যাচ্ছিল সামনে চলমান জীর্ণ সব মানবমূর্তি আর কর্মকালীন সময়ে পরা তাদের মামুলি আলখাল্লা। তাদের মতোই সে হেঁটে চলেছিল না থেমে। সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে মুছে যাবে এইসবমুছে যেতে শুরু করেছিল ইতোমধ্যেই। চুপি চুপি।

 

|| সীমানা ||

সে বেড়ে উঠেছিল এই গল্পের মধ্যে।

তার জন্ম হয়েছিল সময়ের আগেই, সাত মাসের মাথায়। প্রসবযন্ত্রণা যখন শুরু হলো, তখন তার বাইশ বছর বয়সী মা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সে বছর প্রথম তুষার পড়েছিল বেশ আগে। বাসায় একা একা শুয়ে ছিল তার মা। পৃথিবীতে আসার পর বাচ্চাটা খুব অল্প সময়ের জন্য একটু কেঁদেছিল; ক্ষীণ, থরোথরো সেই কান্না, নিভে গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। ছোট্ট, রক্তমাখা শিশুটিকে তার মা একটা বেবি গাউন পরিয়ে দিয়েছিল, আর জড়িয়ে রেখেছিল তুলোভরা নরম একটা লেপে, যেনো কোনো মতেই শিশুটার দম বন্ধ হয়ে না আসে। প্রথমে যখন মায়ের শূন্য স্তনের বোঁটা তার গালে রাখা হয়েছিল, তখন সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই সে বোঁটাটা চুষতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু সে-ও চললো না বেশিক্ষণ। গরম মেঝের সবচেয়ে গরম জায়গাটায় আস্তে করে শুইয়ে দেওয়া হলো শিশুটাকে, কিন্তু ততক্ষণে তার কান্না থেমে গেছে, তার চোখ গেছে বন্ধ হয়ে। মাঝেমাঝে নানারকম অলক্ষুণে চিন্তা আসছিল তার মায়ের মাথায়, মা তখন লেপের এক কোণা ধরে ঝাকা দিচ্ছিল, কিন্তু বাচ্চাটার চোখ খুব অল্পক্ষণের জন্য খুলছিল, ঘোলা হয়ে যাচ্ছিল, আর তারপরই যাচ্ছিল বন্ধ হয়ে। একটা পর্যায়ে, এই সামান্য প্রতিক্রিয়াও থেমে গেলো। কিন্তু তারপরও ভোরের আগে যখন অবশেষে মায়ের বুকে প্রথম দুধের ধারা এলো, আর বাচ্চাটার ছোট্ট দুই ঠোঁটের ফাঁকে মা তুলে দিলো তার স্তন, তখনও দেখা গেলো, সবকিছু সত্ত্বেও, বাচ্চাটা তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। যদিও বাচ্চাটার আর হুশ নেই তখন, তবু তার গালের স্তনের বোঁটাটার প্রভাবেই যেনো সে দুধ খেতে লাগলো চুষে চুষে, ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো তার দুধ খাওয়া। অথচ তখনও, পুরোটা সময় জুড়েই, তার চোখ বোজা। বাচ্চাটা জানতো না সে তখন আসলে কোন সীমানা পাড়ি দিচ্ছে।

 

|| নলখাগড়ার বন ||

রাত্রিভর তুষারপাতের পর এক সকালে সে হেঁটে গেলো এক নলখাগড়ার বনে। নলখাগড়া চিরে চিরে দুভাগ করছিল সে, শুভ্র তুষারে ভারানত সরু, শাদা একেকটা ডাঁটা। বনের মাঝখানে ছোট্ট একটা জলা, এক জোড়া বুনোহাঁস সেখানে বাস করে। জলার মাঝখানে, যেখানে তুষারের হালকা আস্তরের সঙ্গে হয়ে যায় শান্ত জলের, ধূসরাভ-নীল জলের উপর ঘুরে বেড়ায় পাশাপাশি ভেসে বেড়ায় তারা, পানি খায় ঘাড় নিচু করে।

ফিরে আসবার সময় সে জিজ্ঞেস করে নিজেকে, আরো দূরে যেতে চাও তুমি? আরো সামনে? পোষাবে তো?

একটা সময় ছিল, যখন সে কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিতো, না।

কিন্তু এখন সে হেঁটে চলে যায়, সব উত্তর জমা করে রাখে ভবিষ্যতের জন্য। আধো-হিমায়িত জলা ছেড়ে চলে যায় সে, লাবণ্য আর বিষণ্নতায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে।

 

|| চকচকে ||

সোনা, রূপা, হীরা, প্রভৃতি চকচকে ধাতুগুলোতে কী এমন জিনিস আছে যে মানুষ ওগুলোকে এতো অভিজাত মনে করে? একটা তত্ত্ব আমাদেরকে বলছে, আদিম মানুষের কাছে জলের ঝিকিমিকি ছিল প্রাণের লক্ষণ। উজ্জ্বল জল মানেই ছিল পরিষ্কার জল। একমাত্র সুপেয় পানিইযা আমাদের জীবন দেয়দেখতে স্বচ্ছ। তাই যখনই মরুভূমি, জঙ্গল আর পুঁতিগন্ধময় জলাভূমি পাড়ি দিয়ে এক দল মানুষ দূরে শাদা জলের ঝিকিমিকি দেখতে পেতো, তখন সুখে তাদের বুক ফেটে যেতো মনে হয়। সেটাই হয়তো ছিল জীবন। সেটাই ছিল সৌন্দর্য।

 

|| তুষারবৃষ্টি ||

আমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই, জীবন যার প্রতি পক্ষপাত করে। এইসব রাস্তা দিয়ে সে যখন হেঁটে যায়, তখন তার মাথার উপরে ঝরে পড়ে তুষারবৃষ্টি। তুষারবৃষ্টিতে আদ্র হয়ে ওঠে তার গাল আর ভুরু। সবকিছু চলে যায়। এই কথাটা সে ভোলে না কখনো- এই যে, যা কিছু সে এতো আপন মনে করে আঁকড়ে ধরে আছে, সব, সব একদিন তার হাতছাড়া হয়ে যাবে, আর ভস্ম হয়ে যাবে তারপরএইসব রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়, যেখানে তুষারবৃষ্টি নেমে আসে, যা বৃষ্টিও না, আবার তুষারও না, বরফও না, আবার পানিও না, যাতে সিক্ত হয়ে ওঠে তার ভুরু, আর সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকুক বা না থাকুক, জোরে হাঁটুক বা না হাঁটুক, তার চোখ বন্ধ হোক বা না হোক, এই তুষারবৃষ্টি তার কপাল বেয়ে নেমে আসে অনবরত।

 

|| তুষারঝড় ||

বছরকয়েক আগে এক ভারি তুষারঝড়ের সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছিল। পাহাড়ি পথ ধরে একা একা হেঁটে আসার সময় সিউল তুষারঝড়ের কবলে পড়লো। তার ছাতা বলতে গেলে কোনো কাজেই আসলো না। অগত্যা সে হাঁটতেই থাকলো, বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে থোকা থোকা তুষার এসে জমতে লাগলো আর মুখে আর সারা গায়ে। ভাবা যায়? এমন ভয়ানক ঠাণ্ডা আর বৈরী একটা জিনিস দুনিয়ায় আদৌ কেনো আছে? এই অদৃশ্য ভঙ্গুরতা, সৌন্দর্যের এই গুরুভার, অর্থ কী এর?

 

|| রুমাল ||

গ্রীষ্মের শেষের দিকে এক নির্জন ভাড়াবাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার এটা চোখে পড়েছিল। দ্বিতীয় তলার ব্যালকনিতে কাপড় নেড়ে দিচ্ছিলেন এক মহিলা, হঠাৎ তার হাত ফসকে কিছু কাপড় নিচে পড়ে গেল। সবার চেয়ে ধীরে, বাতাসে ভাসতে ভাসতে, অবশেষে মাটিতে নামল একাকী একটি রুমাল। ডানা অর্ধেক গুটানো একটা পাখির মত। উদভ্রান্তের মত অবতরণের জায়গা খুঁজে বেড়ানো একটা আত্মার মতো।

 

|| আকাশগঙ্গা ||

শীত একবার জেঁকে বসার পর প্রায় প্রতিদিনই শহরের আকাশ মেঘে ঢাকা থাকতো, আর রাতের আকাশের দিকে তাকালে কোনো তারা-ফারা সে আর দেখতে পেতো না। বাতাসের তাপমাত্রা নামতে নামতে নেমে গেলো শূন্যের নিচে আর শুরু হলো নতুন একটা প্যাটার্ন যার ফলে পালাক্রমে কদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি আর কদিন ধরে তুষার ঝরতে থাকলো। বাতাসের নিম্নচাপের কারণে তার মাথা যন্ত্রণা হতো। পাখিরা আকাশে উড়ে যাওয়ার সময় আলিঙ্গন করে যেতো মাটিকে। বেলা তিনটা বাজতে না বাজতেই সূর্যমামা অস্ত যেতেন, আর বেলা চারটা নাগাদ তো চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় বিকেল বেলার আকাশের দিকে তাকালে সে এমন একটা কালো কালো ভাব দেখতে পেতো, যেটা তার মাতৃভূমিতে কেবল রাতের বেলায়ই দেখা যায়, আর মনে পড়ে যেত আকাশের অজস্র নীহারিকার কথা। মনে পড়ে যেত লবণের দানার মত হাজার হাজার নক্ষত্রের কথা যাদের আলো ঝরে পড়তো তার উপর, মনে পড়ে যেত বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে কাটানো সেই রাতগুলোর কথা। পরিষ্কার ঠাণ্ডা আলোয় স্নান করেছিল তার দুটি চোখ আর তার মন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল যাবতীয় স্মৃতি।

 

|| শাদাভাবে হাসা ||

শাদাভাবে হাসা এই এক্সপ্রেশনটা (সম্ভবত) খালি তার মাতৃভাষাতেই পাওয়া যায়। যে হাসি মলিন, আনন্দহীন, সহজেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় যার অনাবিলতা, এবং যে মুখ এই হাসিটাকে গড়ে তোলে।

তুমি শাদাভাবে হাসছিলা, জানো এটা?

এখানে, তুমিটা হচ্ছে (সম্ভবত) এমন কেউ যে জোর করে কোনোরকমে একটা হাসি দেয় বটে, কিন্তু নীরবে নিভৃতে হয়তো সহ্য করে অন্তর্গত কোনো যুদ্ধের যন্ত্রণা।

সে শাদাভাবে হাসছিল

এখানে, সে হচ্ছে (সম্ভবত) এমন কেউ, যে তার নিজের ভেতরেরই কোনো একটা জিনিস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছে।

 

|| পাকা চুল ||

এক বসের কথা মনে পড়ে যায় তার, মনে পড়ে কিভাবে এই মধ্যবয়স্ক লোকটি সবসময় বলতেন যে, বুড়ো বয়সে তিনি তার সাবেক এক প্রেমিকাকে আবার দেখতে চান, যখন সেই প্রেমিকার চুল পেকে পালকের মতো শাদা হয়ে যাবে। যখন বুড়ো হয়ে যাবো সত্যি সত্যি, আমাদের প্রত্যেকটা চুল পেকে শাদা হয়ে যাবে যখন, ঠিক তখনই আমি দেখা তার পেতে চাই আবার, ঠিক তখনই।

জীবনে যদি আর কখনো তিনি তার প্রেমিকার দেখা পেতে চান, তবে ঠিক তখনই।

যখন ঝরে পড়ে গেছে মাংস আর যৌবন,

যখন কামনা-বাসনার কথা ভাববার সময় আর নেই,

যখন সাক্ষাৎ শেষে বাকি থাকবে কেবল একটি কাজ: যে যার পথে চলে যাওয়া। চলে যাওয়া নিজেদেরই দেহ ছেড়ে, অর্থাৎ চিরকালের জন্য চলে যাওয়া।

 

|| মেঘমালা ||

সেই গ্রীষ্মে, আমরা বসে ছিলাম উনজু মন্দিরের সামনে, দেখেছিলাম মাঠের উপর দিয়ে মেঘমালার উড়ে যাওয়া, মনে আছে? জড়াজড়ি হয়ে বসে, তাকিয়ে ছিলাম সমতল পাথরের উপর খোদাই করা বুদ্ধের দিকে। বিশাল বিশাল মেঘের ছায়া, একটার পাশে আরেকটা, দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছিল আকাশ আর মাটির মাঝখান দিয়ে।

 

|| বালি ||

আর সে প্রায়ই ভুলে যেতো যে,

তার দেহ (আমাদের সবার দেহই) হলো বালুঘর,

যা একদম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে,

গড়িয়ে পড়ছে গোঁয়ারের মতো আঙুলের ফাঁক দিয়ে।

 

|| নিঃস্তব্ধতার উদ্দেশে ||

যখন ঘনিয়ে আসে তার বিদায়ের দিন,

আর বাড়ির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে সে, তখন অনেক কথা থাকে

যা সে বলতে চায় এই বাড়ির নিঃস্তব্ধতার উদ্দেশে,

যার ভিতরে বাস করার অনুমতি তার আজ আর নেই;

 

যখন অন্তহীন মনে হতে থাকা রাত শেষ হয়ে যায়,

আর উত্তর-পূর্বের জানালাকে মনে হয় ঘন নীল ঊষারই একটি টুকরো,

আর যখন উজ্জ্বল হতে হতে আকাশ ক্রমশ নীলে নীল হয়ে ওঠে,

আর পপলারের অনাবিল অস্থিগুলো চেনা যেতে থাকে ধীরে ধীরে,

 

তখন কিছু কথা সে বলতে চাইবে এই নিঃস্তব্ধতার উদ্দেশে,

রবিবার সকালের শুরুর দিকটায়, যখন তার বিল্ডিংয়ের অন্যান্য বাসিন্দারা

 

তখনো ঘুম থেকেই জাগেনি,

প্লিজ, আরো কিছুক্ষণ এমনই থাকুক,

যাতে আমাকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়ে যেতে পারে এই নিঃস্তব্ধতা...

 

|| নীরবতা ||

অবশেষে যখন অবসান হয় দীর্ঘ দিনের, তখন দরকার হয় প্রশান্ত হয়ে ওঠার মতো একটু সময়। আর যখন, মনের অজান্তে স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে আমি আমার জমাটবদ্ধ, শক্ত হাত বাড়িয়ে দিই নীরবতার দিকে, তার মৃদু আঁচে আমার আঙুলগুলো আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করে।

 

|| কাফন ||

বাচ্চাটাকে কী করেছো তুমি, বলো, কী করেছো?

যে রাতে আমি আমার বাবাকে প্রথম এই প্রশ্ন করেছিলাম, তখন সদ্য কৈশোর পেরোচ্ছি আমি, আর বাবা তখনো পা দেননি পঞ্চাশে, আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বাবা খানিকক্ষণ চুপ করে ছিলেন।

শাদা কাফনের কাপড়ে মুড়িয়েছি প্রথমে, তারপর পাহাড়ের উপরে নিয়ে গিয়ে কবর দিয়েছি।

একা?

হ্যাঁ। একাই।

অতঃপর মেয়েটার বেবি গাউন হয়ে গেলো কাফনের কাপড়। আর বাচ্চা ধরার ন্যাকড়াটা হয়ে গেলো কফিন।

বাবা শুতে চলে যাওয়ার পর আমি একবার পানি খেতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেলাম, আর আমার শক্ত, কুঁজো হয়ে যাওয়া কাঁধ সোজা করলাম। আমার বুকের অস্থির উপর হাত চেপে ধরে আমি কিছুটা বাতাস টেনে নিলাম নিজের ভেতরে।

 

|| বিচ্ছেদ ||

মরিস না তুই। আল্লার দোহাই লাগে, মরিস না।

আমি মুখ খুললাম, আর বিড়বিড় করে এই কথাগুলো, যা তুই শুনতে পেয়েছিলি তোর কালো কালো চোখ দুটো খোলার পরে, যখন ভাষা কী, সেটাই তুই জানতি না। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে শাদা কাগজটা ঠেসে ধরি। আমার বিশ্বাস, চিরবিদায়ের আগে এর চেয়ে ভালো কথা কারো মুখে কখনো আসে না: মরিস না তুই। বেঁচে থাক।