বামপন্থি বুদ্ধিজীবী নওমি ক্লেইনের ‘ছায়া মানুষ’

অ+ অ-

 

‘Doppelganger’ জার্মান শব্দ। আমি এর বাংলা তর্জমা করেছি ছায়া মানুষ। শুরুর প্যারাটা পড়ে হয়তো ভাবছেন এটা বুঝি একটা ফ্যান্টাসি ফিকশনের বই। না। একদমই না। ছায়া মানুষ আমাদের বর্তমান সময়ের নিদারুণ বাস্তবতা। এমন এক সময়ে আমরা ঢুকে পড়েছি যখন নন-ফিকশন আর ফ্যান্টাসির মধ্যে পার্থক্যগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।

একটা মানুষের মতো আরেকটা মানুষ কোথায়?
একটা কবিতার মতো আর একটা কবিতা?

কবি কাজল শাহনেওয়াজের এই সুন্দর ইউফোরিক পঙ্‌ক্তিদ্বয় বাস্তব জীবনে কখনও কখনও ভয়ংকর মিথ্যে হয়ে দেখা দিতে পারে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হয়তো আপনি দেখলেন, আপনাকে নিয়ে চারিদিকে আলাপ হচ্ছে। আপনার লেখা নিয়ে চর্চা হচ্ছে আকাশ দুনিয়ায়। কিন্তু যাকে নিয়ে আলাপ হচ্ছে সে আপনার মতো হলেও আপনি নন। যে লেখা নিয়ে চর্চা হচ্ছে তা আপনার লেখা নয়। আপনি ক্রমেই আবিষ্কার করলেন আপনার একজন ডাবল আছে দুনিয়াতে। দুনিয়া সেই ডাবলকে আপনি ভেবে ভুল করছে। আপনার অর্জিত পাবলিক পার্সোনা, ইমেজ, লেখালেখি, এক্টিভিজম সব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। কী করবেন আপনি এখন?

কানাডিয়ান পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল নওমি ক্লেইনের নতুন বই ‘Doppelganger’-এর বিষয় নিয়েই লেখা। বইটি বাজারে আসে মাস চারেক আগে। সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ। চার মাসেই পশ্চিমা বই আর বুদ্ধির বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমি বইটা বক্সিং ডেতে ২৫% ছাড়ে ২৮ ডলার দিয়ে কিনেছি। পেপারব্যাক স্টক আউট। তাই হার্ডকভারই কিনতে হয়েছে। বই ভাল হলে তাতে অফার দেওয়া যাবে না এটা একটা ভিত্তিহীন ফালতু লজিক। বরং দেখলাম বক্সিং ডেতে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় শপিংমল ওয়েস্ট এডমন্টন মলে অন্য সব দামি ব্র্যান্ডের সাথে মানুষ সমানে বই কিনছে, শুধু মাত্র এই অফারের কারণে।

যাহোক ‘Doppelganger’-এ ফেরত আসি। ‘Doppelganger’ জার্মান শব্দ। আমি এর বাংলা তর্জমা করেছি ছায়া মানুষ। শুরুর প্যারাটা পড়ে হয়তো ভাবছেন এটা বুঝি একটা ফ্যান্টাসি ফিকশনের বই। না। একদমই না। ছায়া মানুষ আমাদের বর্তমান সময়ের নিদারুণ বাস্তবতা। এমন এক সময়ে আমরা ঢুকে পড়েছি যখন নন-ফিকশন আর ফ্যান্টাসির মধ্যে পার্থক্যগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। ছায়া মানুষ এই এলোমেলো সময়ের এমন এক হার্ডকোর নন-ফিকশন বই যা যেকোন ফ্যান্টাসি উপন্যাসের কাল্পনিক জগতকেও ম্লান করে দেয়। ও আচ্ছা, ছায়া মানুষের রাজনীতির মধ্যে ঢোকার আগে নওমি ক্লেইন সম্পর্কে একটু আলাপ করে নিই।

নওমি ক্লেইন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার জিওগ্রাফি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। সাংবাদিকতা করেছেন। আরাম কেদারার তাত্ত্বিক নন। বর্তমান দুনিয়ার লিডিং বামপন্থি চিন্তাবিদ এক্টিভিস্টদের একজন। তার নো লোগো [১৯৯৯]  এবং দ্য শক ডক্ট্রিনের [২০০৭] মতো বইগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত দুনিয়ায়। ক্লেইন ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমের প্রচলিত নব্য উদারবাদী মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছেন। কর্পোরেট শক্তি কেমন করে সরকারকে কব্জা করে দুনিয়ায় নানা রকম ইনজাস্টিস উৎপাদন করছে নানা ছলে-বলে তা তুলে ধরছেন। তবে তার মূল কাজের জায়গা জলবায়ু পরিবর্তন।

তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং একটি টেকসই অর্থনীতি কেন দরকার তার পক্ষে ওকালতি করার জন্য তার পুরো ইন্টেলেকচুয়াল ক্যারিয়ার উজাড় করে দিয়েছেন। এই বিষয়ে তার জরুরি কাজ ‘This Changes Everything: Capitalism vs. the Climate’ [২০১৪]।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর একটা নোক্তা দিয়ে রাখি। যেসব ইহুদি চিন্তাবিদ গাজায় সংঘটিত গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নৃশংসতার উপর আলোকপাত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন তাদের মধ্য ক্লেইন অন্যতম। তার টুইটারে গেলেই দেখতে পাবেন, কী করছেন তিনি কানাডায় বসে। ইসরায়েলি সরকারের পদক্ষেপ এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে তার সোচ্চার সমালোচনার আলাদা গুরুত্ব আছে ওয়েস্টে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা অধিকারের লড়াইয়ে নওমি ক্লেইনকে আলাদাভাবে পড়া জরুরি। ক্লেইনের সাথে আমি ইয়ানিস ভারোফাকিসকেও আলাদা করে অবজার্ভ করছি। এসব নিয়ে সামনে বিস্তারিত লেখার পরিকল্পনা আছে।

নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে ক্লেইন আবিষ্কার করে, এটা শুধু তার একার সমস্যা না। এই ছায়া মানব তৈরি মূলত পপুলিস্ট ফ্যাসিস্ট দুনিয়ায় সোচ্চার কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কার্যকরি হাতিয়ার। ডিজিটাল ছায়া মানব দিয়ে পপুলিস্ট ফ্যাসিস্টরা একটা মিরর ওয়ার্ল্ড নির্মাণ করেছে যেখানে প্রোপাগান্ডাই সত্য। কপি এখানে অরিজিনালকে নাই করে দেয়।

ছবি © লেখক

এখন ‘Doppelganger’ নিয়ে একটু আলাপে ফিরি। আমেরিকায় একজন চরম ডানপন্থি নারীবাদী আছেন। তার নাম নওমি উলফ। ‘Beauty Myth: How Images of Beauty Are Used Against Women’ [১৯৯০] তার লেখা বিখ্যাত বই। কিন্তু কোভিডের সময় থেকে তিনি পরিচিত হয়েছেন একজন ভ্যাক্সিন বিরোধী কন্সপাইরেসি তাত্ত্বিক হিসেবে। ইন্টারেস্টিংলি এই নওমি উলফ বামপন্থি নওমি ক্লেইনের পার্সোনাকে এমন ভাবে ইমিটেট করা শুরু করে যে ডিজিটাল দুনিয়ায় হাজার হাজার মানুষ দুই নওমিকে গুলিয়ে ফেলে। বহু মানুষ ক্লেইনকে কোভিডের সময় নোংরা উগ্র রেসিস্ট ষড়যন্ত্রকারী ভাবতে থাকে। শক ড্রকটিনের লেখিকা কিভাবে এতটা নিচে নামতে পারে! এসব লিখে টুইট করতে থাকে। এসব দেখে ক্লেইনের তো মাথা নষ্ট হবার যোগাড়। কারণ ক্লেইন টুইটারে তার এক্টিভিজমের জন্য নিবেদিতভাবে সক্রিয়।

এই ‘Doppelganger Trouble’ কেন হচ্ছে কিভাবে হচ্ছে তা বুঝতে গভীরে ঢোকে ক্লেইন। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে ক্লেইন আবিষ্কার করে, এটা শুধু তার একার সমস্যা না। এই ছায়া মানব তৈরি মূলত পপুলিস্ট ফ্যাসিস্ট দুনিয়ায় সোচ্চার কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কার্যকরি হাতিয়ার। ডিজিটাল ছায়া মানব দিয়ে পপুলিস্ট ফ্যাসিস্টরা একটা মিরর ওয়ার্ল্ড নির্মাণ করেছে যেখানে প্রোপাগান্ডাই সত্য। কপি এখানে অরিজিনালকে নাই করে দেয়। এই প্রোপাগান্ডিক মিরর ওয়ার্ল্ড বলতে মানুষ সবার প্রথমে হিটলার, নাজি পার্টি এবং গোয়েবলসকে স্মরণ করে। কিন্তু নাজিরা এসব কোথায় শিখেছিল? কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প কি হিটলারের আবিষ্কার? মোটেই না। দুনিয়া হলোকাস্টের কপিবাজ হিটলারকে মনে রেখেছে। কিন্তু এর আসল নির্মাতা ব্রিটেন-আমেরিকা-ইউরোপকে ভুলে গেছে। দুনিয়ার ইতিহাস মূলত ক্ষমতা দিয়ে ছায়াকে সত্য বানিয়ে রেখেছে। মূল নির্মাতাকে মুছে দিয়েছে।

নওমি ক্লেইনের ‘Doppelganger’ বই থেকে আমি কি নিলাম? বাংলাদেশে বসে আমরা হয়তো ভাবছি রাইট উইং পপুলিস্ট ফ্যাসিজম বোধহয় শুধু আমাদের মত গ্লোবাল সাউথের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মোটেও তা নয়। নওমি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন আমেরিকা-কানাডার লিবারেল রাজনীতির অঙ্গে অঙ্গে কিভাবে প্রচ্ছন্ন এবং স্পষ্ট ভাবে পপুলিস্ট ফ্যাসিজম ছড়িয়ে আছে। কতটা নির্লজ্জ কায়দায় বামপন্থি চিন্তা আন্দোলন সংগ্রামকে বিকৃত এবং বিভ্রান্তকর চেহারা দিয়ে ডিজিটাল দুনিয়ায় হাজির করা হচ্ছে। ওয়েস্টে বামধারার চিন্তা এবং এক্টিভিজম করা কতটা কঠিন তা নিয়ে ভাসা ভাসা আইডিয়া ছিল আমার। সেই অস্পষ্টতা কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে ক্লেইনের ক্ষুরধার লেখার এই বইটি আমার কাছে জীবন ও রাজনীতি বোঝাবুঝির জন্য একটা অসামান্য দর্পণ হয়ে থাকবে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আমি পেয়েছি ক্লেইনের কাছ থেকে। পপুলিস্ট ফ্যাসিজমকে ডিল করার জন্য আপনার লেখালেখির ভাষা পুতুপুতু হলে হবে না। তাহলে কি আপনি এক্সট্রিম হবেন ওদের মতই? না, তাও না। যে পন্থা ক্লেইন অবলম্বন করেছেন তা জুডিথ বাটলারকেও বিমোহিত করেছে। বাটলার এর নাম দিয়েছেন ‘Militant Humility and connection’। নিজের এবং দুনিয়ার ভালনেরাবিলিটিগুলোকে কানেক্ট করে কিভাবে মিলিট্যান্ট হিউমিলিটির টোনে লেখা যায় সেটাও নতুনভাবে শিখলাম ক্লেইনের কাছ থেকে।

এই যে কথায় কথায় এখন আমরা নিজেদের এআই প্রজন্মের মানুষ বলছি, এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কার ছবি, কার কবিতা, কার তত্ত্ব, কার গান কার বানিয়ে দিচ্ছে তা আমাদের শেষমেশ কোথায় নিয়ে যাবে? পপুলিস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারপাল আর কর্পোরেটদের যূথবদ্ধ প্রযোজনায় কী ভয়ংকর মিরর ওয়ার্ল্ড ট্রিপে আমরা ঢুকে পড়েছি আমরা তা জানি কি? নওমি ক্লেইন না হয় তার ডাবলকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে। মোকাবিলা করে যাচ্ছে। আপনি, আমি কি জানি ‘Who is the Double?’