মুদ্রণ প্রযুক্তির ঝাঁকিদর্শন ও অ-আ-ক-খ’র বই

অ+ অ-

 

আমাদের মানতেই হবে সিসার টাইপের দিন শেষ। সিসার হরফ দিয়ে সাজানো চেজ থেকে ট্রেডল মেশিনে ছাপানোর দিনও শেষ। ১৭৭৮-এ চালু হওয়া বিচল সিসার হরফে বাংলা ছাপানোর এই পদ্ধতি বিশ শতক পেরুনোর আগেই কম্পিউটার প্রযুক্তির কাছে হার মেনে গিয়েছে। সিসার হরফের ঢালাইখানাও পাততাড়ি গুটিয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। প্রযুক্তি পুরানো হয় নতুন প্রযুক্তির আগমনে। শত চেষ্টাতেও পুরানো প্রযুক্তিকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না।

সন্দেহাতীতভাবে বলা যাচ্ছে না; তবে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশে বছর ত্রিশেক আগে চালু থাকা ডজন ডজন ট্রেডল প্রেস, সেই প্রেসের জন্য সিসার টাইপের ঢালাইখানা এবং সেই টাইপ সাজিয়ে ছেপে নেওয়ার ব্যাপারটা আমাদের স্মৃতিতেও আর তেমনভাবে নেই। এই বিস্মৃতির একটা ছবি মেলে সব্যসাচী হাজরার প্রদর্শনী প্রাইমার টু প্রেস-এ।

সব্যসাচী হাজরা-সম্পাদিত বাংলা বর্ণমালার বইয়ের একটা সংকলনের মোড়ক উন্মোচন হয় প্রদর্শনীর শুরুর দিনে, ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে, মে মাসের তিন তারিখে। প্রদর্শনীটি চলেছে মাসের আঠার তারিখ পর্যন্ত। লা গালেরি প্রদর্শনী কক্ষে রাখা ধুঁকে-ধুঁকে চলতে থাকা শহর ঢাকার একটি ট্রেডল প্রেস। সম্ভবত এইটেই ঢাকার একমাত্র ট্রেডল প্রেস বর্তমান। কিন্তু ছাপার যন্ত্রটির পাশে টাইপের কেস কেবল দুটো।

বাংলা সিসার টাইপের ছাপার শুরু থেকেই চারটি কেসের ব্যবহার হয়ে এসেছে। ইংরেজিতে সাধারণত দুটো কেসওপরের এবং নিচের। ওপরের কেসে বড় হাতের হরফ আর নিচের কেসে ছোট হাতের হরফ। এ থেকেই ইংরেজির বড় হাতের হরফের জন্য আপার কেস আর ছোট হাতের হরফের জন্য লোয়ার কেস শব্দবন্ধের ব্যবহার, কম্পিউটারে ছাপার যুগেও। বাংলায় সিসার হরফের সংখ্যা ইংরেজির তুলনায় অনেক বেশি এবং সে কারণে ডান এবং বাঁয়েও দুটো বাড়তি কেস আছে, অর্থাৎ ছিল।

কেবল দুটো কেস কেন জিজ্ঞেস করায় প্রেসম্যানের উত্তরটাইপই নেই! কেস দিয়ে কি করব? কেসে সেই নয়ের দশকের শেষদিক থেকে বাংলার একমাত্র যে টাইপফেসের দেখা মেলে সেই সুশ্রী। খানিকটা লাইনোটাইপের আদলে জোড়া-হরফ ভাঙ্গা টাইপ। সে কারণেই বোধ করি প্রেসম্যান দুটো কেসেই নিজের মত সাজিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। এতে করে ছাপার ইতিহাসের ভেতর খানিকটা উঁকি মারা যায়, ইতিহাসের পুরোটা জানা যায় না। কেসে টাইপ রাখারও যে রকমফের সেটা সম্পর্কে আমরা কতটাই বা জানি? কিন্তু, সেটাও তো বাংলা মুদ্রণের অংশ।

আমাদের সহজে ভুলে যাবার প্রবণতা না থাকলে, অন্তত দেখার বা দেখানোর জন্য হলেও আরও কিছু ছাপাখানা যন্ত্র টিকে থাকত। প্রদর্শনীতে কিছু কাঠের ব্লক, হাতে গোনা কয়েকটি বড় আকারের সিসার হরফ, স্পেসিং রুল, কম্পোজিং স্টিক, কোইন, ফার্নিচার, কালি লাগানোর রোলার, কয়েকটি জিংক ব্লক আর সে থেকে ছাপানো কাগজ। আরও দুয়েকটা জিনিস। এর বাইরে বেশি কিছু জোগাড় করা যায়নি। এবং, সে থেকে মোটেই বোঝা যায় না সিসার হরফ কি করে ঢালাই হতো, হরফগুলো কি করে কেসে সাজানো হতো, হরফগুলো কম্পোজিং স্টিকে কি করে সাজিয়ে লাইন এবং পৃষ্ঠা গাঁথা হতো। হরফের নকশা ও ঢালাই এবং হরফের সাজানোটাই বিচল হরফে মুদ্রণের আসল কথা।

তবে যন্ত্রে কি করে ছাপানো হতো চলতে থাকা মহড়া থেকে তার একটা ধারণা অবশ্য হয়। প্রদর্শনীতে আমরা দেখতে পেয়েছি ছাপার পদ্ধতির শেষাংশের কাজটা কি করে হয়। কিন্ত এটা একজন প্রেসম্যান বা যন্ত্র চালকের কাজ। মুদ্রণ কাজের পুরোটার কয়েক শতাংশ। মুদ্রাকরের কাজ অর্থাৎ হরফ সাজানো এবং সে থেকে বই ছেপে নেওয়ার খুঁটিনাটি কিংবা হরফ কি করে ঢালাই হয় তা জানাটা খুব জরুরি; কিন্তু জানার বা জানানোর এই কাজটি খুব কঠিন। বিশেষত লোকেদের আগ্রহ যখন বছর বিশেক আগে পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাওয়া প্রযুক্তির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় কিংবা সেই প্রযুক্তির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার ছবি তোলায়।

২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে একটি ট্রেডল প্রেস, পুরো চার কেস টাইপ এবং কিছু জিংক ব্লক নিয়ে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগের এক শিক্ষককে বলতে শুনেছিলাম যে তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের এই প্রাচীন ছাপার যন্ত্র দেখাতে নিয়ে আসবেন। শিক্ষক মহাশয় যতটা আপ্লুত ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল যে তিনিও ছাপার এই প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব বেশি ওয়াকিবহাল নন। বলা হয় যে ১৪৪০ সালে ছাপাখানা প্রথম তৈরি হয়। সেটা দেখতে অন্য রকম হলেও, প্রযুক্তি হিসেবে এটা অবশ্যই প্রাচীন। কিন্তু যে যন্ত্র গেল শতকের শেষ পর্যন্ত মোটামুটি প্রতাপের সঙ্গে কাগজ ছেপে এসেছে তাকে প্রাচীন বলতে একটু বাধে। পিতার পিতা পিতামহ হয়, পূর্বপুরুষ হয় না।

আমরা যারা সাবেকি ছাপাখানা দেখেছি, ছোটবেলায় হলেও, এরকম একটি যন্ত্র হয়ত তাদের স্মৃতিমেদুর করে তোলে। যাঁরা দেখেননি, কেবল শুনেছেন, তাঁদের একটা কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। শুঁড় দেখে হাতির কল্পনা করার মত ব্যাপার। কিন্তু এতে ইতিহাসটা জানা যায় না। কারণ সেই ইতিহাসটা আমরা লিখে রাখিনি। মুদ্রাকরদের হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে হারিয়ে গেছে প্রযুক্তির খুঁটিনাটি। এখানেই ইউরোপীয়দের থেকে আমাদের পার্থক্য। সেই কাজটি বরং বেশি জরুরি। কেউ হয়ত ইতিহাসটা কখনও পুরো লিপিবদ্ধ করে ফেলবে আর আমরাও ততটা খাটনি ছাড়াই ব্যাপারটি সম্পর্কে জেনে যাব।

এ তো গেল প্রদর্শনীর ব্যাপার। তবে প্রেস অর্থাৎ ছাপাখানার যন্ত্রই আগে, পরে প্রাইমার অর্থাৎ অ-আ-ক-খর বই। তাই প্রদর্শনীর নাম প্রেস টু প্রাইমার হলে যৌক্তিক হতো। কারণ, যাত্রার অভিমুখ সে-দিকেই। সে কারণেই হয়ত অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর সঙ্গে যে প্রাইমার সংগ্রহের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে তার সম্পর্ক একটু খাপছাড়া। কিন্তু বর্ণমালার বইয়ের সংকলনটি আমাদের বড় পাওয়া। বইটির পুরো নাম বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় সংকলন। ঢাকার কবি প্রকাশনীর ছাপানো, ২০২৪ সালে। ১৮৪৯ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত প্রকাশিত আটটি বর্ণমালার বইয়ের সংকলন। ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে আশিস খাস্তগীরের বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ বেরিয়েছিল ১৮৪০ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত বের হওয়া ১৪টি অ-আ-ক-খর বই নিয়ে।

আশিস খাস্তগীরের বইয়ের বাইরে আরও ছয়টি অ-আ-ক-খর বই ছাপানো আছে সব্যসাচী হাজরার বইয়ে এবং এর মাঝে দুটোর প্রকাশ ঢাকা থেকে। বই আটটি হল মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়-এর প্রথম ভাগ, রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা, সীতানাথ বসাকের আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয়, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুসি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাক্ষর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ-এর প্রথম ভাগ যেখানে আঁকা হল নন্দলাল বসুর এবং বিমলচন্দ্র ঘোষের হাতে খড়ি যেখানে আঁকা হল সত্যজিৎ রায়ের।

যাঁরা এই আটটি বইয়ের এক কিংবা একাধিক ছোটবেলায় দেখলেও ভুলে গেছেন, এই বর্ণমালা বই তাঁদের কাছে স্মৃতিমেদুরতার বিষয়। যাঁরা একদমই দেখেননি তাঁদের কাছেও দেখবার বিষয়। যাঁরা সমাজভাষাবিজ্ঞানে অনুসন্ধৎসী, তাঁদের কাছেও এ-ধরনের বই খুব কাজের হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। এই বই দেখলে বোঝা যায় যে বাংলা বর্ণমালায় হরফের সংখ্যা কখন এবং কিভাবে কমেছে, অন্তত এই এক-শ বছরের মধ্যে।

এর বাইরে বিশদ কিছু জানা যায় না। কারণ কালের ধারায় শব্দ এমনকি শব্দবন্ধও পালটেছে বইগুলোয়। সেগুলো নিয়ে আলোচনা নেই; কিন্তু, আমাদের আশা ছিল থাকবে। যেহেতু ছাপা বইয়ের কোনটা কোন সালের তা দেওয়া নেই, তাই কালানুক্রমিক পার্থক্য করা যাবে না। আর এই আটটি বই থেকে হরফের চেহারা কিভাবে পালটেছে তা বোঝা যায় না। প্রতিটিতেই হরফের চেহারা কাছাকাছি। এর একটা প্রধান কারণ ১৭৭৮ সালে শুরু হওয়া হরফের চেহারা ১৮৪৫ নাগাদ অনেকটা থিতু হয়ে গেছে। আর বর্ণমালা বইটিতে পুরানো বইয়ের যে ছাপা তা মোটাদাগে আধুনিক কোনও সংস্করণ থেকে নেওয়া।

এই আটটি বইই প্রধান এবং বহুল বিক্রীত ও ব্যবহৃত। এর বাইরেও অ-আ-ক-খর অনেক বই ছাপা হয়েছে এই সময়কালে। এর আগে ছাপা হয়েছে বেশ কয়েকটি বর্ণমালার বই। সে-রকম অন্তত আট-দশটি বইয়ের হিসেব পাওয়া যায়। এক হিসেব মতে, পুরো উনিশ শতকে ছাপানো বর্ণমালার বইয়ের সংখ্যা পাঁচ-শর মত। এবং এর পাঁচ ভাগের চার ভাগই ১৮৫৫ সালের পরে প্রকাশিত। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বভাবসুলভ বর্ণনায় দাবি এই যে বইটি হরফের বিবর্তন তুলে ধরেছে কিংবা এই এক-শ বছরে এ-কটা বর্ণমালার বই ছাপা হয়েছে; সেটা একদমই ঠিক নয়। বিজ্ঞাপনে ভুলতে নেই। তবে বইটির ছাপা পরিচ্ছন্ন এবং বাঁধাই চমৎকার। এত ভাল মানের ছাপা এবং বাঁধাইয়ের বই খুব কমই দেখা যায়। দুয়েকটি কপির ছাপানোতে মিসরেজিস্ট্রেশনের কথা অবশ্য শোনা গেছে। ভেতরের পাতায় চাঁদের কলঙ্কের মত দুয়েকটি ভুল বানান যে নেই তা নয়।

এবার, এই বই সম্পর্কে আরও দুয়েকটি কথা না বললেই নয়। সম্পাদিত বইটিতে পাঠের সম্পাদনার কোনও প্রতিফলন নেই। একটি দ্বিভাষিক ভূমিকা আছে; বাংলায় সম্পাদকীয় এবং ইংরেজিতে Editorial শিরোনামায়। আমরা সম্পাদকীয় সাধারণত খবরের কাগজে বা পত্রিকায় দেখে থাকি, বইয়ে নয়। দৃশ্যগত সম্পাদনার ছাপ অবশ্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। এবং এই ব্যাপারটা অনেক সময়ে ভুল ধারণা তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। পাঠকের অনেকেই মনে করতেই পারেন আদি বইয়ের চেহারা কিংবা পৃষ্ঠার আকারও বোধ হয় একই রকমের ছিল। আদতেই তা নয়। আরেকটি সমস্যা হল এই যে প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে যে সাল দেওয়া তা বইগুলোর প্রথম প্রকাশের। এ থেকেও মনে হতেই পারে যে বইটিতে বর্ণমালার বইগুলোর আপাত প্রতিলিপি ছাপা (facsimile print) বোধ হয় সে সালেরই। ভূমিকাতে অবশ্য এই ভ্রান্তি-নিরসনের ঘোষণা আছে। কিন্তু, লোকে আর ভূমিকা পড়ে কোথায়?

শিশুশিক্ষার (প্রথম প্রকাশ ১৮৪৯) যে সংস্করণটির প্রতিলিপি এই বর্ণমালা বইটিতে ছাপা হয়েছে সেটি প্রতিলিপি হিসেবে সবচেয়ে দুর্বল। আশিস খাস্তগীরের শিশুশিক্ষা বা বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ-এ যে সংস্করণটি ছাপা আছে সেটি বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৮৫০ সালের। শিশুশিক্ষার অন্তত ১৮৭৭ সালের সংস্করণ পর্যন্তু জে. ই. ডি. বীটন সাহেবকে লেখা মদনমোহনের একটি চিঠি ইংরেজি এবং বাংলায় ছাপা হয়ে এসেছে। বর্ণমালা বইটিতে ছাপানো শিশুশিক্ষায় এই চিঠিটি নেই। স্পষ্টতই ছাপাটি আরও পরের কোনও সংস্করণের।

বর্ণমালা বইটির ১৯-র পৃষ্ঠায় ছাপানো শিশুশিক্ষার শিরোনামায় ছাপা আছে ব্যাঞ্জন বর্ণ। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত এ কারণে যে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে পাতার শিরোনামায় এ-রকম একটা ভুল বানান বেরিয়ে যাবে এটা ভাবা যায় না, বিশেষত ১৮৫০-এর দ্বিতীয় মুদ্রণে এবং ১৮৭৭-এর ৩৩শ মুদ্রণে বানানটি যখন ব্যঞ্জন। আরেকটি অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে। প্রতিলিপি ছাপায় পাতায় শিরোনামা যে দেবশ্রী-রূপশ্রী ধরনের টাইপফেসে ছাপানো আদি প্রকাশনায় তা অনুপস্থিত। হয়ত বর্ণমালা বইটিতে ছাপানো শিশুশিক্ষা কোনও অননুমোদিত অর্থাৎ নকল সংস্করণের। ৩৪-এর পৃষ্ঠায় হরফ ও ছবি মিলিয়ে একটি ছাপা দেখতে পাওয়া যায়। নিচে লেখা শিশুশিক্ষা বইয়ের পূর্বের কোনো একটি সংস্করণের ভিতরের পৃষ্ঠা। কাঠখোদাই ছাপচিত্র। এই দাবির বিশ্বাসযোগ্য কোনও সূত্র পাওয়া যায় না। এই ধারণার জন্য দায়ী সম্ভবত ১৯৮১ সালে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্সের ছাপানো চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন বইটি।

দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন বইয়ের ১৭৩-এর পৃষ্ঠায় ছবিটি দেখতে পাওয়া যায়। নিচে বর্ণনায় লেখামদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষার (১৮৪৯) একটি পৃষ্ঠা। প্রায় একশ বছর আগেকার একটি কাঠের ব্লক থেকে ছাপা। এর বাইরে আর কোনও সূত্র চোখে পড়েনি। এখনও পর্যন্ত এটি লোক-সূত্র হিসেবেই থেকে গেছে। এর থেকে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় না যে পৃষ্ঠাটি শিশুশিক্ষার পুরানো কোনও সংস্করণে থেকে নেওয়া। এই ধারণার আরও দুটো কারণ আছে। শিশুশিক্ষার দ্বিতীয় মুদ্রণে পৃষ্ঠাটি নেই; ১৮৭৭ সালের সংস্করণেও নেই। তাছাড়া, এই পৃষ্ঠাটির যে আকার সেটা শিশুশিক্ষার পাতার মাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বর্ণপরিচয়-এর (প্রথম প্রকাশ ১৮৫৫) যে সংস্করণটির প্রতিলিপি বর্ণমালা বইটিতে ছাপা হয়েছে বর্ণপরিচয়-এর প্রচ্ছদের হিসেবে সেটি ৫৩তম মুদ্রণ, ১৮৭৪ সালের। প্রথম ছেপে বেরুনোর বিশ বছর পর ১৮৭৫ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। এটি বইটির ৬০তম মুদ্রণ। এবং, প্রথম সংস্করণের নিচে ষষ্টিতম সংস্করণের বিজ্ঞাপন জুড়ে দেওয়া হয়। তখন মুদ্রণ এবং সংস্করণ শব্দদুটো একই অর্থে ব্যবহৃত হতো। বলা হয় যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুকাল অবধি এই দ্বিতীয় সংস্করণই ছাপা হয়েছে।

বাল্যশিক্ষার (প্রথম প্রকাশ ১৮৭৭) যে সংস্করণটির প্রতিলিপি বর্ণমালা বইটিতে ছাপা হয়েছে সেটি কোন সংস্করণ, কোথাকার মুদ্রণ সেটা ঠিক বোঝা না গেলেও, অন্তত বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী কোনও সময়ের তা বইটির শেষ পৃষ্ঠা দেখলেই বোঝা যায়। পাঠের অংশ হিসেবে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবির নিচে (এর উল্লেখ বইটির সম্পাদকীয়তেও আছে) লেখা আছে যে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে (খ্রীষ্টাব্দ নয়; অর্থাৎ অনেকটা আধুনিক বানান) ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। অবশেষে ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বইটির প্রতিলিপি ছাপ নিয়ে সন্দেহ এ কারণে যে বর্ণমালা বইটির ৬৬-র পৃষ্ঠার নিচে লেখা আছেএই অধ্যায়ে (বাল্যশিক্ষা) ব্যবহৃত টাইপফেস শুভ লেটারপ্রেস। ডিজিটাল ফন্টটি বাজারে আসে ২০২৩-এর মে মাসে। নিশ্চিত না হলেও বোঝা যায় যে বাল্যশিক্ষার কোনও একটি সংস্করণ বা মুদ্রণকে (যা যৌক্তিকভাবে এখনও বাজারে কিনতে পাওয়া যায়) শুভ লেটারপ্রেস ফন্টটি দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে।

আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয়-এর যে সংস্করণটির প্রতিলিপি বর্ণমালা বইটিতে ছাপা হয়েছে সেটিও অনেক পরের কোনও সংস্করণ। বইটির প্রথম প্রকাশকাল দেওয়া নেই। প্রথম প্রকাশের সালটি দেওয়া না থাকলে, ১৮৪ থেকে ১৯৪৮-এর মধ্যে কোন ক্রমে এর অবস্থান তা নিশ্চিত হওয়াটা একটু কঠিন। বইটির শেষে হিন্দী, উর্দ্দূ এবং ইংরেজি বর্ণমালা দেওয়া আছে। বাল্যশিক্ষা-র অনুকরণেই আদর্শলিপি লেখা হয়। এর আধুনিক ছাপা এখনও বাজারে মেলে।

কলকাতা উচ্চ আদালতের ১৯২৩ সালের গ্রন্থসত্ত্বের মামলার একটি নথি থেকে জানা যায় যে আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয় বইটি প্রথম ছাপা হয় ৩রা নভেম্বর ১৯০২ তারিখে। এবং পরে এর অনেক সংস্করণ ছাপা হয়। ১৯১৯ সালে নূতন পাঠশালা আদর্শলিপি এবং নূতন মক্তব আদর্শলিপি নামে দুটি বই প্রকাশিত হলে, ১৯২০ সালে ক্ষতিপূরণের এই মামলাটি হয়। এবং মামলাটি ১৯৩০ সাল পর্যন্ত চলে। সে যাই হোক! অন্তত এটা নিশ্চিত যে বর্ণমালা বইটিতে আদর্শলিপির ক্রম ঠিক নেই। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুসি বইয়ের পরেই তার অবস্থান হওয়ার কথা, আগে নয়।

হাসিখুসির (প্রথম প্রকাশ ১৮৯৭) কোন সংস্করণের প্রতিলিপি ছাপা বইটিতে রাখা হয়েছে তার কোনও উল্লেখ নেই। এটা ঠিক যে বর্ণমালার বইয়ের অনেক সংস্করণ হয়, আইনি এবং বেআইনি। এবং, সে-সব সংস্করণের কোনও হিসেব পাওয়া যায় না। কিন্তু কোন সংস্করণের প্রতিলিপি বর্ণমালা বইটিতে ছাপা হল সেটার উল্লেখ থাকলে পাঠকের সময়ের ক্রম বুঝতে এবং সে থেকে সেই সময়ের হরফের চেহারার ধারণা করার সুবিধে হয়। বর্ণপরিচয় এখনও ছাপা হয়, বিক্রি হয় এবং পড়া ও পড়ানো হয়। যদি বলেও নেওয়া হয় যে এর প্রথম প্রকাশ ১৮৫৫ সালে এবং সঙ্গে সাল উল্লেখ না করে একটি আধুনিক সংস্করণের প্রতিলিপি ছেপে দেওয়া হয়, তাতে পাঠককে কেবল বিভ্রান্তই করা হয়।

চিত্রাক্ষর-এর (প্রথম প্রকাশ ১৯২৯) যে সংস্করণটির প্রতিলিপি বর্ণমালা বইটিতে ছাপা হয়েছে সেটি আদপেই মূল সংস্করণ নয়। কারণ, প্রতিলিপি ছাপের প্রথমেই, বর্ণমালা বইটির ১৭৯-এর পৃষ্ঠায় একটি ভূমিকা ছাপা আছে; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। বর্ণমালা বইটির পৃষ্ঠার নিচের বর্ণনায়, মূল সংস্করণের ভূমিকা। কিন্তু ভূমিকাটির প্রথমেই বলা আছে যে আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর আগে অবনীন্দ্রনাথের চিত্রাক্ষর ছাপা হয়েছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, দাবিকৃত মূল সংস্করণ বলতে কি বোঝানো হচ্ছে সে ব্যাপারে। স্পষ্টতই, প্রথম প্রকাশের অন্তত পঁয়ষট্টি বছর পরের কোনও সংস্করণ বা মুদ্রণ থেকে এই প্রতিলিপি ছাপ।

আবার, যেখানে শিশুশিক্ষার প্রথম মুদ্রণে ৩,০০০ কপি ছাপা হয়ছিল, সেখানে চিত্রাক্ষর-এর প্রথম সংস্করণে মাত্র দুশ কপি ছাপানোর ব্যাপার থেকে বোঝা যায় যে এই বইটি নিরীক্ষাধর্মী কাজ, বই-সংগ্রাহকের জন্য মুদ্রণ, মোটেই শিশুদের বর্ণ শেখানোর বই নয়। অর্থাৎ, শিল্পের জন্য হরফ, হরফের জন্য শিল্প নয়। উজ্জ্বলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভূমিকায় সংশয়টি যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন।

১৯৩০ সালে প্রথম প্রকাশের সহজ পাঠ এবং ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশের হাতে খড়ির ক্ষেত্রেও বর্ণমালা বইয়ে ছাপানো সংস্করণের সাল নেই। প্রথম বইটির অনেক সংস্করণ তো হয়েছে বটেই, দ্বিতীয় বইটিরও দুয়েকটি সংস্করণ হয়েছে। এ অবস্থায় গবেষকদের পাঠ নিয়ে আলোচনা করাটাও দুরূহ কারণ প্রথম সংস্করণ থেকে পরের সংস্করণগুলোয় পাঠের পরিবর্তন ঘটে থাকতেই পারে। শিশুশিক্ষা এবং বর্ণপরিচয়-এর ক্ষেত্রে এ-রকম পাঠের পরিবর্তন নিয়ে লেখালেখি খুঁজে পাওয়া যায়।

আটটি বইয়ের প্রতিলিপি মুদ্রণে সবচেয়ে ঝামেলাকর ব্যাপার হল লেখা, পাঠ এবং ছবি হয়ত ঠিকই আছে, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেখা, পাঠ এবং ছবিকে নতুনভাবে বানানো জমিনের ওপর বসানো হয়েছে। এইখানেই সম্পাদনার দক্ষ হাতের ব্যাপারটা নজরে পড়বার মত। ২০২২ সালে ছাপানো সব্যসাচী হাজরা অ: In the Quest of Bangla Typography’ বইটিতেও পুরানো বইয়ের ছাপায় পাতার জমিনের সম্পাদনা উচ্চকিত। এতে দেখতে হয়ত ভাল দেখায়; কিন্তু পাঠের ঐতিহাসিকতা খেলো হয়ে পড়ে।

আটটি অ-আ-ক-খর বই-সমেত বর্ণমালা বই হিসেবে হাতে নিতে ভাল লাগে; দেখতেও চমৎকার। সম্পাদক এবং প্রকাশকের ধন্যবাদ প্রাপ্য এ কারণে। কিন্তু কেবল নান্দনিকতা দিয়ে মুদ্রণ হয়; লিপিকৌশল হয় না, সারস্বত চর্চাও নয়। জোর কিছু খামতি বইটিতে রয়েই গিয়েছে। সে থাকতেই পারে। আগামী কোনও সংস্করণে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা হয়ত করা যাবে। কিন্তু ভয় অন্যত্র। এই খামতিগুলো অন্যের জন্য রেফারেন্স পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াতে পারে যা সারস্বতের জন্যে ক্ষতিকর। গবেষকদের এ-ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয়।

কৃতজ্ঞতা: ছবি শিল্পী সব্যসাচী হাজরার ফেসবুক থেকে নেওয়া।