রেবেল: কাম্যুর অ্যাবসার্ড নায়ক—স্রেফ মধ্যপন্থী মানবতাবাদী?

অ+ অ-

 

আলবেয়ার কাম্যু সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন দর্শনে [শাস্ত্রে] এ পুরস্কার  দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না বলে। মূলত দার্শনিক কাম্যু দ্য মিথ অফ সিসিপাস বা দ্য রেবেল-এ যে দার্শনিক ভাবনার আলোকে মানুষের অস্তিত্বিক সমস্যাকে ব্যাখ্যা করেছেন ও মোকাবিলার পথ খুঁজেছেন তারই বিবরণ পাই দুটি উপন্যাসআউটসাইডারপ্লেগ-এ। কিন্তু উপন্যাস দুটি পাঠের সহায়ক হিসাবে দ্য রেবেল পাঠ এক দিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কাম্যুর অ্যাবসার্ড নায়কের প্রতিভূ এই রেবেলকে তিনি কিভাবে দেখেন, বিচার করেন ও ব্যাখ্যাতীত সমস্যার মধ্যে তাকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলেন সে সম্বন্ধে জানাও কৌতূহলকর বৈকি।

রেবেল-এর গোড়ার কথা তালাশ। কিসের তালাশ? একদিকে অবশ্যই আত্মতালাশ, আর পরপরই সেই তালাশের প্রেরণায় ও প্ররোচনায় ব্যাখ্যারহিত, উদ্ভট [অ্যাবসার্ড] পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়া। এই মুখোমুখি হওয়া স্রেফ আয়নার সামনে দাঁড়ানো নয়, বরং পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজেকে প্রস্তুত করা। এ কাজটি করতে যে প্রস্তুত সে রেবেল, কাম্যুর অ্যাবসার্ড হিরো।

সত্য ও বাস্তবের সন্ধানে মানুষযাকে বলা চলে এভরিম্যান, সে-ই কাম্যুর রেবেল। দ্য রেবেল-এ কাম্যুর সারকথা হলো মানুষকে তার চারপাশের জগতের অযৌক্তিকতার [অ্যাবসার্ডিটির] মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যের খোঁজ করতে হবে, আর তা হবে সেই সত্য যা সে ব্যাখ্যা করতে ও নিজের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করতে পারে। অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে আষ্ফালন নয়, বরং পরিস্থিতি যাচাই, পরিস্থিতির মধ্যে নিজের অবস্থান পর্যালোচনা ও এর মধ্যে জীবনের মানে ও মূল্য খোঁজাই তার একান্ত কাঙ্ক্ষিত। এই মানে খোঁজা কোনো জটিল দার্শনিক অনুসন্ধানপ্রয়াসী বলা যাবে না। এর মধ্যে রয়েছে মানবতাবোধ ও মানবিক সংহতি যা কাম্যুর মতে তাঁর রেবেলের কাজকে বৈশিষ্ট্যময় করে।

ব্যাপারটাকে সোজা কথায় এভাবে বলা যায়: উদ্ভট, অযৌক্তিক পরিস্থিতির মুখোমুখি মানুষ যখন অনুভব করবে তার কষ্ট তার একার নয়, বরং গোটা মানবজাতির, সে তখন সেই বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর একজন হিসাবে সহমর্মিতা ও সংহতির বোধে নিজের কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আশা করতে পারে। সেই নিষ্কৃতি ব্যক্তিস্বার্থবিবর্জিত, আর তাই তা মানবতাবাদের এক অনন্য নিদর্শনও।

এ কাজে কাম্যু তাঁর রেবেলের মধ্যে কী দেখতে চান?

প্রথমত রেবেলের কাছে কাম্যু যা চান তা জীবনের প্রতিটি পদে অর্থ বা মানে [meaning] খোঁজার তাড়না। এই মানে খোঁজার প্রয়াসের পেছনে রয়েছে মানসিক শক্তি ও ধৈর্য যার মাধ্যমে যাবতীয় অযৌক্তিকতার বিচার-বিশ্লেষণ ও মুখোমুখি হওয়ার সাহস সঞ্চয় সম্ভব। এটাই রেবেলের প্রাথমিক প্রস্তুতিপর্বHe must accept and seek to encounter the universe as it presents itself in absurdity.

কাম্যুর দ্বিতীয় চাওয়া হলো রেবেল বা বিদ্রোহীকে হতে হবে একাধারে যোদ্ধা ও শিল্পী। যোদ্ধা হিসাবে সে তার সামার্থ্যর মধ্যে মানব জীবনের মর্যাদা রক্ষার্থে মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবে। আর শিল্পী হিসাবে তার লক্ষ্য হবে মানুষের মর্যাদার সৌন্দর্যকে ঐক্য ও সংহতি দিয়ে এমন এক ক্যানভাসে চিত্রিত করা যা তার গ্রহণযোগ্যতা ও সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।

মানুষ জীবন যাপনের জটিলতায় ও প্রকৃতিগতভাবে নানা সীমাবদ্ধতায় বন্দী। আর এখান থেকেই তার সংগ্রামের সূত্রপাতযা কাম্যুর ভাষায় বিদ্রোহ। তাই তাঁর মতে রেবেল বা বিদ্রোহীর কাজ হলো এই সীমাবদ্ধতাকে একটা বোঝাপড়ার [understanding] মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে মেনে নেওয়া, কিন্তু তা অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত, আর তারপরই একে অস্বীকার করা বা না বলাযা হতে পারে দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রাম। তার মানে, কাম্যুর রেবেল পরিস্থিতি বিবেচনায় হ্যাঁনা দুটোই বলে। হ্যাঁ বলার মানে পরিস্থিতিকে স্বাগত জানানো নয়, বরং পরিস্থিতির বাস্তবতাকে স্বীকার করা, আর তাই যখন সে না বলে, সে পরিস্থিতির অযৌক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যানই করে না, এর বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়ায়। বিদ্রোহী বলতে তাই কাম্যুর ভাষ্যA man who says no, but whose refusal does not imply a renunciation. He is also a man who says yes, from the moment he makes his first gesture of rebellion.

সেই সঙ্গে আরও যোগ করেনAn act of rebellion is not, essentially, an egoistic act. Of course, it can have egoistic motives…The rebel…demands respect for himself, of course, but only in so far as he identifies himself with a natural communityWhen he rebels, a man identifies himself with other men and so surpasses himself, and from this point of view human solidarity is metaphysical.

বিদ্রোহ মানব চরিত্রের স্বাভাবিক প্রবণতা, যে কারণে তা গোটা মানবজাতির এক অন্তর্নিহিত ও আত্মিক প্রবণতাও বটে। ফলে যে বিদ্রোহী, সে তার কাজে মানবজাতির প্রতি যেমন সংহতি প্রকাশ করে, তেমনি তার বিদ্রোহে সে মানবজাতিকে একত্রিত করার ক্ষমতাও রাখে। এখানে কাম্যু তাঁর মানবতাবাদের পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি সংযম ও মিতাচার[moderation]-এর সপক্ষে জোরালো যুক্তি দেখান যা তাঁর সমকালে বিস্তর বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দ্য রেবেল বইটিতে তাঁর কিছু মতামত ও পর্যবেক্ষণ সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যায়।

দ্য রেবেল-এ কাম্যু যে কয়েকটি বিষয়কে তাঁর মতামত প্রকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন তার মধ্যে রয়েছে বিদ্রোহ ও বিপ্লব [rebellion and revolution], অধিবিদ্যক বিদ্রোহ ও ঐতিহাসিক বিদ্রোহ [metaphysical rebellion and historical rebellion]। বিদ্রোহ ও বিপ্লব কিসের প্রেরণা-উদ্ভুতএ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর কাম্যু যে ধারণায় পৌঁছান তা হলো যদিও দুটি বিষয়ই মানুষের সত্তার অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে, এবং উভয়েই ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি থেকে উদ্ভুত, আদতে তারা একে অন্য থেকে আমূল ভিন্ন। বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করেন মেটাফিজিক্যাল ও হিস্টোরিক্যাল বিদ্রোহ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে।

মেটাফিজিক্যাল বিদ্রোহ বলতে কাম্যুর বক্তব্যযে বিদ্রোহী এর আওতায় পড়ে সে তার নিজের জন্য বিদ্রোহ করে না, বরং তার সংগ্রাম তাদের জন্য যারা তার মতো ভুক্তভোগী। যদিও অ্যাবসার্ড পরিস্থিতিতে কষ্ট ভোগ করা এক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কিন্তু অধিবিদ্যক বিবেচনায় এটি এক সম্মিলিত অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ অযৌক্তিক, উদ্ভট পরিস্থিতি যতই ব্যক্তিকে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন করতে তৎপর থাকুক, তাকে বিশ্বাস করতে হবে সে একা নয়, তার অভিজ্ঞতাও শুধু তার নিজের নয়।

আলবেয়ার কাম্যুর ছবি: উইকিপিডিয়া © আমেরিকান লাইব্রেরি অব কংগ্রেস

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিদ্রোহের ধারণাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কাম্যু যে প্রশ্নটির জবাব খুঁজেছেন তা আধুনিক জীবনে বিদ্রোহের [rebellion] কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে। এটা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সমাজে, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যালোচনা করেছেন। কাম্যু বিভিন্ন ঘরাণা ও সময়ের লেখক, শিল্পী, দার্শনিক যেমন এপিক্যুরাস, লুক্রেটিয়াস, মার্কুইস ডি সাদ, হেগেল, দস্তয়েভস্কি, নিৎসে, ম্যাক্স স্টির্নার, আন্দ্রে ব্রেটন ও অন্যান্যদের চিন্তা-ভাবনার বিশ্লেষণে বিদ্রোহে নিয়োজিত ব্যক্তির [man in revolt] প্রতিকৃতি নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। বিদ্রোহ ও বিপ্লবকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে কাম্যু পশ্চিমা দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পের ইতিহাস ঘেঁটে যে বিভিন্নধর্মী [বিপরীতধর্মীও] চিত্র পেয়েছেন তাতে তাঁর উপলব্ধিবিপ্লবী দর্শন বিচারে প্রতিটি চিন্তা-ভাবনার সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মূলত যে তাড়না কাম্যুকে এ বিষয়ে অন্বেষনে প্রেরণা জুগিয়েছে তা তার ভাষায়মানুষ কেন ইতিহাস জুড়ে ক্রমাগত বিদ্রোহ করে আসছে তা বুঝতে চেষ্টা করা।

ঐতিহাসিক বিদ্রোহের কথা বলতে গিয়ে কাম্যু বিদ্রোহ ও এর পরিণতিগত বিষয়াদির ওপর জোর দিয়েছেন। পরিণতির প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যঐতিহাসিকভাবে এটা প্রায়ই দেখা যায় যে একটি অন্যায্য পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে ততোধিক অন্যায্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। এর অন্যতম প্রমাণস্বরূপ তিনি ফরাসি বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর সন্ত্রাসের রাজত্বের উদাহরণ দেন। বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্র ও এর ডিভাইন রাইট-কে উৎখাত করা, যে কারণে সাধারণ মানুষের আশা ছিল একটি ন্যায়ধর্মী সামাজিক চুক্তি তাদের জীবনকে অনেকটা বদলে দেবে। কিন্তু বাস্তবে যা হলো তা জেকোবিনদের পরিচালিত এক চরম গোড়ামি আক্রান্ত সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক চুক্তি যেখানে ন্যায়পরায়ণতার কোনো বিবেচনা কাজ করেনি। জেকোবিনদের মদত জুগিয়েছিল রুশোর সামাজিক চুক্তি [social contract]। কাম্যু একে কট্টর ভাষায় নিন্দা জানান: The Social Contract... terminates with a description of a civil religion and makes of Rousseau a harbinger of contemporary forms of society which exclude not only opposition but even neutrality.”

একই প্রসঙ্গে তিনি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় স্টালিনিষ্ট আমলের চিত্রও তুলে ধরেন ঐতিহাসিক রেবেলিয়নের ধারাবাহিক চিত্র হিসাবে। ঐতিহাসিক বিদ্রোহ সম্পর্কে কাম্যুর মতামতে হতাশা থাকলেও, এ কথা ঠিক তাঁর ন্যায্য ও ন্যায়পরায়ন সমাজব্যবস্থার প্রস্তাবনা অনেকটাই কল্পিত, যাকে ইউটোপিয়া বলতে দ্বিধা না করাই সঙ্গত। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে উপলব্ধি একজন ব্যক্তিকে বিদ্রোহী করে তুলতে পারে, তাকে কাম্যু যেভাবে দেখতে চান তাকে এক ধরনের অবাস্তব আশাবাদ বললে ভুল হবে না। কাম্যুর ধারণা, বিদ্রোহীকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বিদ্রোহের নিয়মতান্ত্রিক সহিংসতা তাঁর বিবেচনায় অযৌক্তিক। ভেঙে বললে এর মানে দাঁড়ায়বিদ্রোহের চেতনা থাকা অতি অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তার প্রকাশ হবে সংযত, যা তাঁর ভাষায় moderation-প্রবণ হওয়াই যৌক্তিক। এখানে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিকঅযৌক্তিক ও উদ্ভট পরিস্থিতির মোকাবিলায় এই moderation কি আদৌ কোনো যুক্তি?         

এ প্রসঙ্গে আমরা যদি সিসিপাসের ঘটনা বিচার করি, মেটাফিজিক্যাল রেবেলিয়নের একটা নমুনা পেতে পারি। সেই সঙ্গে আত্মহত্যার বিপক্ষে একটি প্রতিবেদনও।  সিসিপাস যে উদ্ভট অবস্থায় পতিত হয়েছিল, সেখানে পরিণতিহীন পুনরাবৃত্তি ছাড়া তার সামনে কিছু ছিল না। সেই অবস্থায় সে সিদ্ধান্ত নিল পুনরাবৃত্তিময় অর্থহীন কর্মকাণ্ডকেই বেছে নেবে। সিসিপাস পরিস্থিতি যাচাই করেছিল এবং অযৌক্তিক, অ্যাবসার্ড পরিস্থিতির অন্যায্যতা সত্ত্বেও উপায়হীন নিজের ভবিতব্যকে মেনে নিয়েছিল, অর্থাৎ কাম্যুর বিদ্রোহীর ভাষায় হ্যা বলেছিল। তবে মেনে নেওয়ার পর যা গুরুত্বপূর্ণ তা এইপুনরাবৃত্তির ভবিতব্য মেনে নিতে গিয়ে সে তার ভবিতব্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, সেই সঙ্গে মৃত্যু বা আত্মহত্যাকেও, অর্থাৎ না বলেছিল যা তার মনোবল ও নতি স্বীকারে অস্বীকৃতির পরিচায়ক। আর এর মাধ্যমেই পেয়েছিল মুক্তি, যাকে আমরা বলতে পারি মেটাফিজিক্যাল মুক্তি।

পুরাকালের একটা মিথকে এভাবে ভেঙে দেখা যেতেই পারে, আর তার ভিত্তিতে একটা দার্শনিক মতবাদের যুক্তিগ্রাহ্যতা প্রতিষ্ঠা করাও অসঙ্গত নয়; যদিও গোটা ব্যাপারটা মেটাফিজিক্সের সীমানায় আটকে থাকতে বাধ্য। সেদিক থেকে মেটাফিজিক্যাল রেবেলিয়নের তাত্ত্বিক ভিত অবশ্যই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কাম্যুর উপন্যাস দ্য আউটসাইডার-এর র্মাসো  বা দ্য প্লেগ-এর ডাক্তার রিউ এর উপলব্ধি ও নিজেদের সঙ্গে তাদের সংগ্রাম ও বোঝাপড়া মোটামুটি একই ধরনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়। মার্সোর সমস্যা একান্ত ব্যক্তিগত হলেও সে যখন বুঝতে পারে খুনের কারণে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি মায়ের মৃত্যুতে নিষ্পৃহতাই তার অপরাধ, তখন কোর্টের মৃত্যুদণ্ডসহ যাবতীয় অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে তার উপলব্ধি: তার কোনো অনুতাপ নেই। সময় যত যায়, এই উপলব্ধি ধীরে ধীরে তাকে রাগ-ক্ষোভ-হতাশা থেকে এক ধরনের মুক্তি দেয়। মৃত্যুই যখন মানুষের চুড়ান্ত পরিণতিতা যেভাবেই হোক, সে কেন মৃত্যুভয়ে ভুগবে? মুক্তি তাকে এক সময় নির্ভার করে তোলে।

মেটাফিজিক্যাল রেবেলিয়ন তত্ত্ব হিসাবে ঠিক আছে। কিন্তু কাম্যু তো বাস্তব জীবনে একজন রেবেল বা বিদ্র্হেীর কথা বলতে চেয়েছেন। তার বিদ্রোহীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে তিনি যা বলেছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই আশাবাদের স্বেচ্ছাচারিতা বললে অত্যুক্তি হবে না।

ঐতিহাসিক বিদ্রোহের সহিংস নির্মমতাকে খারিজ করতে গিয়ে কাম্যু ঘুরেফিরে তাঁর বিদ্রোহীর মধ্যে যে সংযম ও সমন্বয়বাদী মিতাচারিতার কথা বলেছেন তা তাঁকে শুধু বিতর্কের মুখেই ঠেলে দেয়নি, বরং বিদ্রোহী বা রেবেলকে নিয়ে তাঁর চিস্তার একপেশে মনোভাব জ্যঁ পল সার্ত্রেসহ সমকালীন অনেকের বিরাগের কারণ হয়েছিল। একে বলা যেতে পারে মধ্যপন্থার পক্ষে চুড়ান্তপন্থাকে প্রত্যাখ্যান। কাম্যুর মতে, চূড়ান্ত মুক্তি বলে কিছু নেই, কারণ তা শক্তিধরদের কব্জায়‘Absolute freedom is the right of the strongest to dominate, while absolute justice is achieved by the suppression of all contradiction: therefore it destroys freedom.’ 

তাহলে কী দাঁড়াল? তাঁর বিবেচনায় মুক্তি ও ন্যায়বিচারের দ্বন্দ্বের সুরাহা হতে পারে রাজনীতিক প্রজ্ঞার সমন্বয়ে এক সার্বক্ষণিক ভারসাম্য টিকিয়ে রাখায়, আর সেই সঙ্গে প্রয়োজন মানুষ হিসাবে নিজের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন হওয়া ও এই অমোঘ সত্যকে নিয়ে তুষ্ট থাকা‘To live and let live in order to create what we are’ কাম্যুর শেষ কথা।

নোবেল প্রাইজ পাওয়ার তিনদিন পর আলবেয়ার কাম্যু্, ছবি: উইকিপিডিয়া © লানজ গানের

এই যে মনোভাব তা কাম্যুকে বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছিল যার মীমাংসা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর পর তিনি তাঁর বামপন্থি বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল তাদের চিন্তাভাবনার গোড়ামি ও নির্মমতা খারাপ বৈ ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এ থেকে এ কথা পরিষ্কার, কাম্যু ছিলেন মূলত নৈতিকতাবাদী। নৈতিকতাকে রাজনীতির পথনির্দেশক বিবেচনায় তিনি ক্লাসিক্যাল মাক্সীয় তত্ত্ব ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যা নৈতিকতাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করে, তাও প্রত্যাখ্যান করেন। কাম্যু যেখানে নৈতিকতাকে রাজনীতির উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন, সার্ত্রে ঠিক এর উল্টেটাই বিশ্বাস করেছেন আজীবন। কাম্যুর সঙ্গে সার্ত্রের সম্পর্কের অবনতি এখান থেকেই শুরু। অথচ এ তো সত্য যে, অ্যাবসার্ড পরিস্থিতিতে মানুষের অবস্থান ও করণীয় সম্বন্ধে কাম্যু ও সার্ত্রে উভয়ের মতানৈক্যই ছিল না, এই অভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। Man is condemned to be freeএ তো দুজনেরই কথা। গোল বাঁধল ১৯৫১ সালে দ্য রেবেল প্রকাশিত হওয়ার পরে। সার্ত্র  বইটি পড়ে বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর বিবেচনায় মুক্তি ও ন্যায়পরায়নতা অর্জন অবশ্যই সম্ভব যা কমিউনিজমের সারকথা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অসাম্য ও নিপীড়ন কখনোই শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি আনতে পারে না। কেবলমাত্র নিপীড়কদের অপসারণ ও ব্যাপকভাবে শ্রমিকদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের মাধ্যমেই সম্ভব বস্তুগত অভাব ও দারিদ্র থেকে তাদের মুক্ত করা। সার্ত্রে ও তাঁর সহগামী অনেকের জন্য বিপ্লবী সহিংসতা প্রাসঙ্গিকই নয়, জরুরিওবিদ্যমান পরিস্থিতিকে ভেঙে দিতে, প্রয়োজনে ইতিহাস পাল্টাতে। দ্য রেবেল-এর কাম্যু এখানে সার্ত্র থেকে যোজন যোজন দূরে।

কাম্যু বিদ্রোহের কথা বলেন বটে, তবে এর সীমারেখাও তিনি টেনে দেন। হত্যা করার স্বাধীনতা তাঁর বিদ্রোহের দর্শন অনুমোদন করে নাFreedom to kill is not compatible with the sense of rebellion...The rebel wants it to be recognized that freedom has its limits...the limit being precisely the human beings’ power to rebel...the freedom he claims, he claims for all; the freedom he refuses, he forbids everyone to enjoy.

এ বক্তব্য থেকে তিনি যে ধারণায় উপনীত হন তাস্বাধীনতা পরম/ চূড়ান্ত [absolute] নয়। মানুষের সহজাত সীমাবদ্ধতার মধ্যে তার প্রকাশ ও এই সীমাবদ্ধতাই ধ্রুব। ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিপ্লব যা সাধন করে তা জীবন রক্ষাকারী বিদ্রোহীর দায়িত্বের পরিপন্থীTo annihilate and live in excess would be to give in to revolution and contrary to his responsibility as the rebel to preserve life.

কাম্যু সহিংসতা, বিশেষত বিপ্লবের নামে সহিংসতার প্রতি এতটাই বিমুখ ছিলেন, নিজ জন্মভূমি আলজেরিয়ায় ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের [এনএলএফ] ফরাসি উপনিবেশ বিরোধী বিপ্লবের সঙ্গেও নিজেকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। কাম্যুর এই নীরবতা ও নিস্পৃহ মনোভাব সমকালে তাঁর দেশবাসীকে কঠোর সমালোচনামুখর করে তুলেছিল। অন্যদিকে সার্ত্রে ফরাসি নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আলজেরিয়ার স্বাধীনতাকামী বিপ্লবকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেছিলেন। তাঁর কাছে এনএলএফ-এর সহিংসতা নয়, উপনিবেশায়নমুক্ত আলজেরিয়ার স্বাধীনতাই বড় কথা, অর্থাৎ তিনি যে-কথা বরাবর বলতেনend justifies the means। যদিও একথা ঠিক যে ১৯৫৪ সাল থেকে প্রায় আট বছরব্যাপী বিপ্লব ও স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে আলজেরিয়াকে সীমাহীন দুর্ভোগ ও অরাজক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা আধুনিককালে কাম্যুর হিস্টোরিক্যাল রেবেলিয়নের থিসিসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। কাম্যু অবশ্য সবটা দেখে যেতে পারেননি।

আসলে অ্যাবসার্ডের প্রবক্তা হিসাবে কাম্যু অ্যাবসার্ড পরিস্থিতিতে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্ঠিক অবস্থান এবং মৃত্যু ও আত্মহত্যার বিপরীতে জীবনকে অর্থময় করার ভাবনা থেকেই দ্য রেবেল লিখেছিলেন। জীবনের অযৌক্তিকতা বা অর্থহীনতা মেনে নিয়েও এর মধ্যে বেঁচে থাকা অর্থময়আর এখানেই কাম্যুর অবস্থান নিহিলিস্টদের থেকে দূরে। নিহিলিজমের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করার মূলমন্ত্র কাম্যু খুঁজেছেন তাঁর রেবেল চারিত্রে। একই লক্ষ্য ছিল তাঁর যুগান্তকারী দুটি উপন্যাস রচনায়ও। এসবই ছিল তাৎপর্যপূর্ণ দার্শনিক চিন্তাপ্রসূত। ঈশ্বরের মৃত্যু-সংক্রান্ত নিৎশের নিহিলিজম তাঁর বিবেচনায় নৈতিকতাকে বিপন্ন করে। কাম্যু তাঁর মতামতকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে যথেষ্ট জোর দেন এই বলে যে, যদি নিহিলিজম বা শূন্যবাদ বিশ্বাসের অক্ষমতা বোঝায়, তাহলে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ নাস্তিকতায় মিলবে না, বরং যা আছে বা যা ঘটছে তা দেখতে না পারার অক্ষমতা এবং জীবন যেরকম সেরকম যাপন করতে না পারার অক্ষমতাকেও বোঝায়If nihilism is the inability to believe, then its most serious symptom is not found in atheism, but in the inability to believe in what is, to see what is happening, and to live life as it is offered. 

মূল কথাটা যার ওপর কাম্যু জোর দিয়েছেন তা হলো বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি অযৌক্তিকতার মধ্যে অর্থহীনতাকে মেনে নেওয়া নয়। বেঁচে থাকার মানে খুঁজে বের করাই বিদ্রোহীর কাজ, আর তা করতে গিয়ে অবাস্তব, অলৌকিক কোনো সমাধানের অপেক্ষায় না থেকে মৃত্যুর স্বাভাবিক অনিবার্যতাকে স্বীকার করা এবং যুক্তিযুক্তভাবে মেনে নেওয়া।

দ্য রেবেল-এর অ্যাবসার্ড নায়ককে বাস্তবের প্রেক্ষাপটে আমরা কোথায় রাখব? কাম্যু এমন এক বিদ্রোহীর অবয়ব আঁকতে চেয়েছেন যার প্রকৃত চেহারা বা তার কর্মপন্থা কি আদৌ পরিষ্ফুট হয়? এ প্রশ্নটা যখন দেখা দেয়, তখন অন্য যে বিষয়টি পাশাপাশি দাঁড়ায় তা হলো কাম্যু অধিবিদ্যক ও ঐতিহাসিক বিদ্রোহ দুটোর কোনোটাকেই গ্রহণ করেননি এবং বিদ্রোহের ব্যাপারটাকে দেখেছেন মানুষের আত্মবলম্বী ও সচেতন, স্বাধীন উপলব্ধির প্রকাশ হিসাবে।

এ কথা বলা সম্ভবত অসঙ্গত হবে না, দ্য রেবেল রচনার সময় কাম্যু যে তর্কগুলো টেনে এনেছেন তা বিদ্রোহীর চরিত্র উপস্থাপনের চেয়ে সেইসব তর্কের দার্শনিক ভিত্তি খণ্ডনই ছিল তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক বিদ্রোহের বিপক্ষে তাঁর মতামত সোজাসাপটা। বিদ্রোহের পরিণতি নিয়ে সার্ত্রে ও মার্ক্স যেহেতু ন্যায্যতাকেই শেষ পন্থা বলে মানেন, দুজনই তাঁর কাছে রেডিক্যাল। বিদ্রোহজনিত অপরিহার্য সহিংসতার বিরেুদ্ধেও তাঁর জবাব সাফ। আর নিৎশের নিহিলিজম নৈতিকতার দায় মেটাতে অক্ষম বলে তিনিও তাঁর কাছে পরিত্যাজ্য।

তথ্যসূত্র

► Camus, Albert. The Myth of Sisyphus, and Other Essays. New York: Vintage Books, 1995.

► Camus, Albert: The Rebel: An Essay on Man in Revolt. New York: Vintage Books, 1956.

► Jean Paul Sartre: Existentialism and Humanism. Methuen & Co LTD, London, 1970

► Lubac, Henri De: The Drama of Atheist Humanism. San Francisco: Ignatius Press, 1995