রাশিয়ান রুলে ও অন্যান্য গল্প
|| রাশিয়ান রুলে ||
খেলা হচ্ছে, রাশিয়ান রুলে। গোল টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসেছে ধনী মানুষগুলো। তারা সবাই- সপ্রতিভ, উজ্জল।
তুমিও সেজেগুজে বসে আছো বৃত্তাকার টেবিলের একধারে। এইসব ধনীর তুলনায় তুমি একটু যেন আড়ষ্ট, আর পলকা প্রসাধনের অনভ্যস্ততায় সামান্য ম্রিয়মাণ!
খেলার মধ্যমণি হয়ে আছে যে, সে একজন রাজনৈতিক নেত্রী। তার ওপরেই দায়িত্ব পড়েছে খেলা পরিচালনার।
সে তোমার দিকে তাকিয়ে একটু যেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, খেলার নিয়মটা জানো তো?
একটু যেন চমকালে তুমি! এ ধরনের পার্টিতে তুমি ঠিক অভ্যস্ত নও। এর আগে কখনো আসার সুযোগও ঘটে নাই! সঙ্গত কারণেই তুমি নিয়ম জানো না।
সেটা আঁচ করতে নেত্রীর খুব একটা বেগ পেতে হয় না। তাই সে তোমার দিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করেন, ওয়াইনের বোতলটা ঘুরতে ঘুরতে যার দিকে মুখ করে থেমে যাবে—তাকেই বলতে হবে তার গোপন সত্যটা!
টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে থাকা সবার ঠোঁটে চোরা হাসি। তারা সবাই যার যার সত্য গোপন রেখে তোমার সত্যটা জেনে নিতে চায়।
এখনো ততটা মাতাল হওনি তুমি। প্রায় খসে পড়া মব কালার মসলিনের আঁচল সামলাতে সামলাতে বললে, আর যদি সত্য না বলি?
—তাহলে শাস্তি পেতে হবে।
শাস্তিটা কি?
—এই যে, আমাদের বিলিওনিয়র ক্লাবে তোমার সদস্যপদ, ওটা বাতিল হবে। শুধু টাকা না, আভিজাত্যটাকেও আমাদের মাথায় রাখতে হয় এখন।
তুমি কি একটু ভড়কে গেলে! তোমার অতীত কি এদের চেয়ে কম উজ্জ্বল! নাহ্, হতেই পারে না। যদিও এই সদস্যপদ পেতে তোমাকে কম ত্যাগ করতে হয় নাই। তুমি সৎ থেকে, ক্ষমতাবানদের লেজুড়বৃত্তি না করে ব্যবসা করতে চেয়েছিলে৷ কিন্তু পদে পদে চাঁদাবাজি, মাস্তানি আর হয়রানির শিকার হয়ে তুমি যখন পর্যদস্তু, তবু ব্যবসাটা টেনে নিতে চাচ্ছো প্রাণপণে—এমন সময়ে একটা অদৃশ্য হাত তোমার ওপরে সওয়ার হয়। সে তোমাকে ও তোমার কোম্পানিকে টুলস হিসেবে ব্যবহার করে। একদিকে তোমার নেম, তোমার ফেম, তোমার খালি তেজুরি। অপরদিকে তোমার বদনাম, তোমার দুর্নাম তার ভরা সিন্দুক।
বর্তমানের তুমি ‘তোমাকে’ অনেক পেছনে ফেলে এসে আজ এখানে এদের কাতারে শামিল হয়েছো, নিশ্চয়ই আর পেছনে ফিরে যাওয়ার জন্য নয়! তাই ঝটিতে তুমি পার্স থেকে পিস্তলটা বের করে বললে, শুধু আমি না, আজ সবাইকেই সত্যিটা বলতে হবে সোনা!
তোমরা আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো আমি জানি, কিন্তু তোমরা কেউ ধোয়া তুলসিপাতা নও! তোমাদের কোটি টাকার গাড়ি, মিলিয়ন ডলারের বাড়ি, বিদেশে সম্পদ এগুলো সব কোন লটারিতে পেয়েছো একে একে বলো আজ!
আয়-হায়, তুমি আমাদেরকে খুন করবে নাকি? আঁতকে ওঠেন তিন ক্লিনিক, চার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালকিন, রাতদিন ব্যস্ত ডাক্তার আজমেরী।
ঘটনার আকস্মিকতায় রাজনৈতিক নেত্রী আর পত্রিকার সম্পাদক সাহেবও নড়েচড়ে বসেন, যদিও তারা নিজেদের অন্যদের চেয়ে ক্ষমতাধর ভাবেন! তাই সামান্য একটা পিস্তলের সামনে গোপন সত্যটা বলবেন কি-না দ্বিধায় পড়ে যান।
ইঞ্জিনিয়ার শাকিলের গলা শুকিয়ে আসতে থাকে, রডের বদলে বাঁশ বা টেন্ডারের গোপন পার্সেন্টেজগুলোর সঠিক হিসাব ওই মুহূর্তে গুলিয়ে যাওয়ার জন্য।
সাবেক আমলা ই. এম. হুদা ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিব্রত! যা করেছেন, তা কি সত্যিই বলতে হবে! মেয়েটার কাছে কি প্রমাণ আছে কোনো? মিথ্যা বললেই বা সে ধরবে কীভাবে? তার কাছে কি মিথ্যা মাপার ব্যারোমিটার আছে?
এফবিসিসিআইর সদস্য রুজাইনা নাসের তড়িঘড়ি ইনভয়েসের গোঁজামিল, শ্রমিকের অন্যাজ্য মজুরি বা কর ফাঁকির মতো বিষয়গুলোর কোনটা রেখে কোনটা বলবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না।
ওদিকে ঘূর্ণায়মান ওয়াইনের বোতলের গতি ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে; কার দিকে মুখ করে যে থেমে যায়, কে জানে!
|| তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা ||
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
‘মন’। এই জিনিসটা নিয়ে রবি এতো নাড়াচাড়া করেছে। এতো এতো কাব্যে, গানে, গদ্যে-নাটকের শরীরে এর বিস্তার ঘটিয়েছে, অথচ তুমি এখনো এর নাগাল পেলে না কাদম্বরী! তুমি তত্ত্ব খুঁজতে গিয়ে জানলে, মন এক আধ্যাত্মিক ধারণা। যা মানুষ কল্পনা করতে পারে শুধু, যাকে স্পর্শ করা যায় না। অথচ কেউ যখন কাউকে উপলব্ধি করতে চায় তখন সে ভাবে এটা সে মন থেকেই করছে। সেই মন আসলে কি? আমাদের এই শরীরে দৃশ্যমান অবস্থান নাই যে অস্তিত্বের, অথচ আমরা সারাক্ষণ যার উপস্থিতি উপলব্ধি করি, সেই কি মন? তুমি কিছু ঠাউরে উঠতে পারো না। আজ তোমার ভিতরে এক দারুণ আলোড়ন। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। সব যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গেল এক চেনা ঝড়। এ তো অজানা কিছু নয়! এ তো ঘটবারই ছিল, তবে কেন মন মানে না!
শুধুমাত্র টুকরো কাগজে পড়ে থাকা দুটো পঙক্তি তোমার সব বিশ্বাস সব ধারণাকে এক মুহূর্তে ভেঙেচুরে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল!
তুমি যখন ঠাকুর বাড়িতে এলে তখন তোমার বয়স নয়, রবির সাত। মেয়ে মহলে তুমি গোত্রহীন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নতুন বৌ হলেও রবির তোমার প্রতি কি অদম্য কৌতুহল! একদিন তো বলেই দিলো, ‘দূরে দূরে ঘুরে বেড়াই, সাহস হয় না কাছে আসতে। ও এসে বসেছে আদরের আসনে, আমি হেলাফেলার ছেলেমানুষ।’ সেই ছেলেমানুষটাই একসময় হয়ে উঠেছিল তোমার সব ছোটখাটো কাজের সাথী। বাড়িতে সে একমাত্র দেওর। আমসত্ত্ব পাহারা দেওয়া, ‘গঙ্গাধিপ পরাজয়’ পড়ে শোনানো, ইত্যাদি কাজ হামেশাই করছে নতুন বৌঠানের জন্য। তারপরও রবীর যে কোনো গুণ আছে এটা তুমি একবারও বলবে না! এমনকি অমন নিখুঁত চেহারারও নানা খুঁত খুঁজে বের করে বিধাতার ওপর রবির একেবারে রাগ ধরিয়ে দিতে ছাড়ো নাই! অথচ দেখো, সময় সব কীভাবে বদলে দিল! নিত্য খুনসুটির সেই দেওর এক সময়ে হয়ে উঠল তার নতুন বৌঠানের জানালা। বিকেলের সাহিত্যসভা, ছাদের নন্দনকাননে গানের আসর ছুঁয়ে ময়দানে ঘোড়া ছুটিয়ে চলা নারীর মনের গভীরেও যে এক গভীর বিষাদ আর শূন্যতার বোধ জেগে থাকে, সেই আপাত স্বাধীন মনে হওয়া হাসফাস করা মানবীর বদ্ধ প্রকোষ্ঠে দক্ষিণের জানালা ছিল যেন রবি। সেই জানালা ছুঁয়ে মন ও মননের নিত্য আসা যাওয়া।
রবির গান, রবির কবিতা তোমার সবকিছু এলোমেলো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রকাশ্যে তুমি একথা স্বীকার না করলেও ওই গান, ওই কবিতাগুলোই ছিল তোমার সব সর্বনাশের মূল। যেন মনে হয়, এমন করে প্রণের পরে পরশ বোলাতে কে পারে আর! কে পারে ভাসাতে, কে পারে ডোবাতে!
সবার মাঝে থেকেও যখন তুমি একা! তুমুল কোলাহলে সেই একাকীত্ব যেমন ঘুচিয়ে দেয় সে। আবার বিরান এক ধূ ধূ মরুভূমিতে নিঃসঙ্গ একা পৌঁছে দিতেও এতটুকু দ্বিধা নাই তার!
মাঝে মাঝে খুব বিদ্রোহী হয়ে উঠতে মন চায় তোমার! গত কয়েকদিন থেকেই তুমি ভাবছিলে, নিজের ভেতরে জমে থাকা সব প্রেম, সব ভালোলাগা বিনাশ করে দেবে। ভালোবাসার একটা ভার আছে, সেই ভার আর বহন করবে না তুমি। কেন তুমি রবির পাশে অন্য কারো অস্তিত্ব সহ্য করতে পারছো না! আনা তড়খড় বা স্কট তনয়া তো এই ঈর্ষা জাগাতে পারে নাই, যা এখন জাগছে! তোমার তরুণী হৃদয় কেন মানতে চায় না যে, দাম্পত্য সম্পর্কে জোড় টিকে থাকলেও জোর আর ততটা থাকে না! অকারণ কেন এতো যন্ত্রণা হয় তোমার ভেতরে? এই যে অসম্ভব অধিকারবোধ আর অভিমান রবির প্রতি তোমার। শুধুমাত্র রবিরই প্রতি, অন্য কেউ নয়। কিন্তু এ সবই তো মোহ আর মায়ার ছলনা! এ কিছুই সত্য নয়! তবে কেন এইসব অভিমান-টভিমানের জ্বালা সইবে তুমি? শুধুমাত্র কারো কামনায় থাকার সুখ নেবার জন্য এত যন্ত্রণা সইতে হবে!
কেনরে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারিদিকে তার বাঁধন কেন!
যে বাঁধন ছেড়ার নয়, সে বাঁধনে আটকে রাখবে নিজেকে কোন সুখে? আর তাই কি আফিং-এর নেশায় লীন হতে চেয়েছিলে? অথচ সেই গভীর ঘোরেও, কেউ কি গেয়ে ওঠেনি…
সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার ’পরে
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে
সকল অঙ্গ ভরে।
এ যেন শুধু গান নয়, গঙ্গার বুকে খোলা হাওয়ায় উথলে ওঠা তুমুল ঢেউ! সেই ঝড়ো হাওয়ায় পাল ছিড়ে ডুবতে তোমার কোনো দ্বিধা থাকে না আর। আপন বিনাশে সব বাঁধন ছিন্ন করার পথ বেছে নাও তুমি!
|| অনন্ত ভাগ ||
অমল পুকুর খুঁড়তে গিয়ে পেলো ছোট্ট বাটিটা। বাটিটা হয়তো সোনার। বাবার কাছে শুনেছে পুজোর প্রসাদ দেয়া হতো এই রকম সোনার বাটিতে। সন্ধ্যাবেলা রাধাগোবিন্দর ভোগ দিত ঠাকুরণরা।
এখানে ছিলো ঠাকুরণদের মহল। দুই ঠাকুরণ পরীর মতো সুন্দর! বিকেলবেলা কালো দীঘল কেশ ছড়িয়ে বসতেন দোতলার ওই খোলা বারান্দাতে। সেখানে তাদের কেশসজ্জা হতো তখন। সেই সময়ে দু-একজন কৌতুহলী মানুষ উঁকি দিয়ে যা এক আধটু দেখতে পেত তাদের।
জমিদার বাবু তাদের এনেছিলেন লক্ষ্ণৌ থেকে। যেমন তাদের রূপ তেমন গানের গলা।
এরপর একদিন দেশভাগ হলো। বাবু স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজনসহ চলে গেলেন।
দুই ঠাকুরণ দাসদাসী আর জৌলুসহীন মহলে না পাওয়ার গোপন হাহাকার আর নিঃসঙ্গতা নিয়ে কাটিয়ে দিলেন এক অনন্ত জীবন! কারণ, তাদের কোথাও যাওয়ার ছিল না!
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন