মারলু ক্যানে

অ+ অ-

 

|| এক ||

ও রাজুর মা। শুনছ নাকি? সরকার বলে আমাগেরে ডাকছে।

রাজুর মা ঘরের উঠানে গোবর শুকাতে দিচ্ছিল। আজকাল কথাবার্তা তেমন বলে না কারও সাথে। ঝড় আসার আগ মুহূর্তের আকাশের মত কেমন যেন ঝিম মেরে গেছে সে। সেই ফজরের সময় উঠে উঠান ঝাঁট দিয়ে মুরগিগুলাকে ছেড়ে দিয়েছিল। মা মুরগির পেছন পেছন বাচ্চাগুলা পিল পিল করে খাবার টুকাতে যাচ্ছিল যখন-রাজুর মা তখন পলক না ফেলা চোখে সেদিকে চেয়েছিল অনেকক্ষণ। একদিন তার বাচ্চারাও এমন ছোট্টটি ছিল, মায়ের পিছু পিছু মুরগির বাচ্চার মতই ঘুর ঘুর করত, একটু ভাত, একটু মুড়ি কি এক টুকরো গুড়ের আশায়, আহা সেই দিনগুলো কোথায় চলে গেল! সেই বাচ্চাগুলাও বা কোথায় চলে গেল! একটা দুধেল গাই আছে তাদের, রাজুই  টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনে দিয়েছিল গতবার, ছোট ভাইবোনগুলা দুধ খাবে বলে। হেসে বলেছিল, রাজু-ওগোরে রোজ দুধ দিবা মা, নাইলে মাথা খুলব না। খাড়াও, সামনের বছর জিতুরে ঢাকাত লয়া যামু, আমার কাছে থাইকা পড়ব।

জিতু এর আগে জীবনে ঢাকা যায় নাই। শেষ পর্যন্ত রাজুর জন্যই তাকে ঢাকায় যেতে হল। আর এখন তার বাপও বলে জীবনে প্রথমবারের মত ঢাকায় যাবে। সেও তো রাজুর সুবাদেই। রাজুর মা কথাটা শুনেও জবাব না দিয়ে গোবর ঘুঁটি করতে থাকে। তার আজকাল কথা বলতে ইচ্ছে করে না আর। কথা তার সব ফুরায়ে গেছে।

একটা ভাল শার্ট নাই যা গায়ে দিয়ে ঢাকায় যাওয়া যায়। রাজুর কাপড় চোপড়ের ব্যাগ জিতু ঢাকা থেকে আনতে পারে নাই। ইউনিভার্সিটির হল বন্ধ হয়ে গেছে, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অনেক রুম। ভার্সিটির চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া, আর্মির ট্যাংক, পুলিশ ভ্যান। যেন যুদ্ধ চলতেছে সেইখানে। জিতু ঢুকতেই পারে নাই ক্যাম্পাসে। নয়তো রাজুর স্মৃতিচিহ্ণ কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা খুজেঁ দেখা যেত। কিন্তু তখন আর সময় ছিল না হাতে। ঢাকা মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে রওনা হতে হতে রাত নয়টা বেজে গেছিল। কারা যেন লাশের জন্য পিক আপ ভ্যান ঠিক করে দিছিল, জিতুর মনে নাই। পিক আপ ভ্যানের ড্রাইভার ভাড়া নেয় নাই তার কাছ থেকে। বরং গাড়ি রেখে রাজুর জানাজায় শরিক হইছিল। তো রাজুর ব্যাগটা পাওয়া গেলে তার কোন একটা শার্ট হয়তো গায়ে দেয়া যেত, রাজুর বাপ ভাবে। একটা ময়লা সাদা পাঞ্জাবী আছে বটে তার, গত ইদে রাজুই কিনে দিয়েছিল বাপকে। ওটা এখন পরার অযোগ্য হয়ে গেছে। এখন সে কি গায়ে দিয়ে সরকারের সাথে দেখা করতে যাবে? এই রকম নানা দুশ্চিন্তা রাজুর বাপকে অস্থির করে তুলছিল। জেলা প্রশাসন থেকে লোক আসছিল বাড়িতে, তারা নাকি জিপ গাড়ি পাঠাবে সকালে। ঢাকায় একদিন থাকার ব্যবস্থাও করবে। সরকারের সাথে দেখা সাক্ষাত হলে পর আবার বাড়ি পৌঁছে দেবে গাড়িতে করেই। কিন্তু এত দূর পথ! রাজুর বাপ জীবনে কখনো বাড়ি ছেড়ে এত দূর যায় নাই। বমি-টমি হবে না তো আবার? অসুস্থ বোধ করবে না তো? তাছাড়া ঢাকায় গিয়ে সে করবেইটা বা কি? কি কথা বলবে সরকারের সাথে? সে তো শুদ্ধ বাংলায় কথাও বলতে জানে না। তারা কি তার ভাষা বুঝবে? আর এই যে সরকার নাকি তাকে ডেকেছে, কথা বলতে চায় তার সাথে, সেই সরকার দেখতেই বা কেমন, কোথায় থাকে, কিভাবে কথা বলে তাও তো সে ছাই ভাল করে বোঝে না। কিন্তু এই সব দুশ্চিন্তার কথা ওঠালেও বউ তার কথায় কর্ণপাত করে না। কেমন পাষাণের মতো হয়ে গেছে তার বউ, কোন কথায় কোন রা নাই। সারাক্ষণ থম মেরে থাকে। রাজুর বাপ সোজা সরল মানুষ, সে বুঝি এত ভাবনা চিন্তার ভার তার অশিক্ষিত মাথায় নিতে পারে?

তো ঢাকা যাবার আগের রাতে চাটাই বিছায়ে মেঝেতে ঘুমাতে এসে হঠাৎ অনেক দিন পর কথা বলে উঠল তার বউ। শেষ পর্যন্ত রাজুর বাপের জামাকাপড়ের সমস্যার সমাধান হয়েছে। মেম্বার সাহেব এক সেট নতুন পাজামা-পাঞ্জাবী আর এক জোড়া বাটার পাম্প সু কিনে দিয়েছে তাকে। ও পাড়ার মজুমদার কাকা একটা ট্রাভেল ব্যাগও দিয়েছেন যাতে জরুরি জিনিসপত্র দিব্যি এঁটে যাবে। রাজুর বাপ সেই ব্যাগ গুছিয়ে মাত্র শুতে এসেছে তখন, আজ রাতে ঘুম হবে বলে মনে হচ্ছে না, ভোরবেলা জেলা প্রশাসনের গাড়ি আসবে তাকে নিতে, কী যে হয় পথে ঘাটে ঠিক নাইসেই সময় তার বউ বহু দিন পর কথা বলে উঠলকী করবেন ঢাকাত গিয়া আপনে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজুর বাপ বলেকেমনে কইতাম? সরকার বলে ডাকিছে।

কি কবেন সরকাররে?

কী আর কমো! আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজুর বাপ। সত্যি কী ই বা বলার আছে তার! একটা তরতাজা ছেলে তার। এই বংশের প্রথম লেখাপড়া জানা ছেলে।  এই ছেলে কি আর ফিরে আসবে? সে ছেঁড়া গেঞ্জির কোণা দিয়ে চোখ মুছে বলেবিচার চামো! আর কি!

রাজুর মায়ের চোখ দুটো খটখটে শুকনো। তার চোখে পানি আসে না। ছেলেটা গেছে সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, এখনও তাকে কেউ কাঁদতে দেখে নাই। পাষাণী একেবারে! সে ফণা তোলা সাপের মত হিসহিস করে বললবিচার চায়া কি অইব?

তালি পর কি কমো? অবাক হয়ে রাজুর বাপ জিজ্ঞেস করে। সবাই তো বরং তাকে এই কথাই শিখিয়ে দিয়েছে। বিচার চাবি রাজুর বাপ, বিচার চাবি।  

জিগাবা, তুমি সরকাররে জিগাবা।

কি জিগামু?

জিগাবা, চাকরি না দিক, আমার পোলাক মারলু ক্যানে? ক্যান মারলু? তুমি জিগাবা এই কতা।   

 

|| দুই ||

পোলাও নেবেন একটু? আরেকটা রোস্ট নেন, এই যে!

অফিসারটা একটা বড় রানের পিস তুলে দেয় রাজুর বাপের প্লেটে। সেই মুরগির পিসের দিকে তাকায়ে সে ভাবে, আহা, ছেলেটাকে কোন দিন এই রকম বড় মুরগির পিস খাইতে দিতে পারে নাই সে জীবনে। অভাবের সংসার, চারটে ছেলেমেয়ে, বউ, বুড়ি মা। ভাতই জোটে না রোজ আর পোলাও রোস্ট। তবে তা নিয়ে রাজুর কোন অভিযোগ ছিল না। বরং একবার ছুটিতে এসে ফিরে যাবার সময় বাসে তুলে দিতে গেলে ছেলেই তাকে রাস্তার ধারের হোটেলে বসে পেট পুরে ভাত আর মাংস খাইয়েছিল। এ কথা শুনে রাজুর মা ঠান্ডা চোখে চেয়ে ভর্ৎসনা করেছিল তাকেপোলার টেকায় খাইয়া আইছেন পেটটা ভইরা, শরম করে না আপনের? একটা টেকাও তো পোলার হাতোত দিতে পারেন নাই!

এখন তার দুই চোখ ভরে পানি আসে। আহারে, রাজু, বাপ আমার, তুই আমারে মাপ কইরে দিস, তোর উসিলায় ঢাকাত আইসে তোর বাপ এই এত্ত ভাল ভাল খানা খাইতেছে! কিন্তু তার গলা দিয়ে আর খাবার নামতে চায় না। সে মাথাটা প্লেটের একেবারে কাছে নামিয়ে আনে।

এই ওনাকে একটা বড় মাছের পিস দাও। অফিসার তার আর্দালিকে ডেকে বলে। রাজুর বাপ না না করতে গিয়েও পারে না। আর্দালি এসে তার প্লেটে আরও পোলাও, আরও মাছ, আরও খাবার তুলে দিতে থাকে। তার গলা দিয়ে কেবল চিঁ চিঁ আওয়াজ বের হয়। এই এত্ত বড় খাবার ঘর এখানে, এত বড় টেবিল। এত সব খানাপিনা। কত শত আইটেম। কত আলো। সব দেখেশুনে সে কেমন তব্দা মেরে গেছে। কেন এত খাতির যত্ন করে তাকে খাওয়ানো হচ্ছে তাও সে বুঝতে পারে না। তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে অপরাধ করেছে বটে, তা সে অপরাধটা যে কি সে এখনও বুঝতে পারে নাই, তবে নিশ্চয় তা বড় রকমের অপরাধই হবে নয়তো পুলিশ কেন তাকে গুলি করবে? এখন সন্তানের অপরাধে পিতাকে কোন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না তো? রাজুর বাপের এখন একটু ভয় ভয়ই করতে থাকে। ইসকুলের হেডমাস্টার সাহেব ঠিকই বলেছিলেন আসার আগে। আপনের যাবার দরকার নাই ভাইসাব, কী হইতে কী হবে নে, আপনে যায়েন না।

পোলাও মাছ মাংসের পর এল হরেক রকমের দই মিষ্টি। এত পদ খাবার জীবনে কখনো খায়নি রাজুর বাপ। শেষে এক খিলি পান হলে আরও জমত, কিন্তু এদের এখানে মনে হয় পানের ব্যবস্থা নাই। খাবার সময় নানা কোণ থেকে ছবি তোলা হল তাদের। মানে সে ছাড়াও আরও তিনজন হতভাগা বাপ-মা ছিল খাবার টেবিলে। তার মতো তারাও এসেছে দেশের বিভিন্ন কোণ থেকে, হতচকিত, বিস্মিত, ভীত তারাও। এই মহাখানাপিনার পরে কি হতে যাচ্ছে তা কেউই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কোণের চেয়ারের বোরখা আবৃত নারীটি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলে ক্যামেরা সব পটাপট বন্ধ হয়ে গেল। তারা কান্নার ছবি চায় না, তারা চায় হাসিখুশি ছবি, গদগদ কৃতজ্ঞতার ছবি। রাজুর বাপের এখন পেটটা কেমন গুলিয়ে উঠছে। নারীটির ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না আর বিলাপের সূর এই এত্ত বড় ভবনের ছাদে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসে তার বুকের কোথায় যেন ধাক্কা দিচ্ছে বার বার। সে ঠিক বুঝতে পারছে না বুকের ঠিক কোথায় ব্যথা করছে তার। তার জোয়ান ব্যাটারও তো বুকেই গুলি লাগছিল, নাকি? তেমনটাই তো বলেছে সবাই। এরা কি তাকেও গোপনে বুকে গুলি করে দিয়েছে নাকি? গুলি খেলে কেমন লাগে রে বাপ? কেমন বড্ড ব্যথা ব্যথা করছে যে বুকটা!

 

|| তিন ||

রাজুর বাপকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেও তার বউ এর কোন নড়াচড়া দেখা গেল না। সে দাওয়ায় শূন্য চোখে বসে রইল আগের মতই। পশ্চিমের আকাশে সূর্য ডুবছে, আকাশ লালে লাল। সন্ধ্যেবেলা বাতি জ্বালাতেও যেন ভুলে গেছে রাজুর মা। অথচ পাড়ার লোক ততক্ষণে বাড়িতে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে।

তোমারে টেলিভিশনে দেখছি গো রাজুর বাপ। এক্কেবারে স্পষ্ট দেখা গেছে চেহারাখান।

বাপরে, সরকার একেবারে তুমার হাত ধইরে রাখছিল অনেকক্ষণ। সাহস তো কম নয় তুমার? ডর করে নাই?  

তুমাগেরে বলে পাঁচ লাখ টাকা দিছে সরকার, সত্য নাকি রাজুর বাপ? পত্র-পত্রিকায় কচ্ছে। জিতুরেও নাকি সরকারি চাকরি দিবি একখান? তুমাগের আর দুস্ক থাকবে না গো। পোলাডা তুমাগের কপাল খুইলে দিয়ে গেল।   

তো লোকজন হই হল্লা করে চলে গেলে পর রাজুর বাপ বিধ্বস্ত শরীরে এসে ঘরের ভেতর চৌকিতে বসে। এতটা রাস্তা সে জীবনে কখনো পাড়ি দেয় নাই। দ্যাশের রাস্তা ঘাট যে এত উন্নত আর এত সুন্দর হয়ে গেছে তাও তার ধারণায় ছিল না। কী সুন্দর সুন্দর ব্রিজ, কী প্রশস্ত আলো ঝলমলে হাইওয়ে। আর ঢাকা শহরটাও কত সুন্দর।  কিন্তু এই সব কিছুই কাউকে গল্প করবার উপায় নাই। বউটা তো সারাক্ষণ অসুস্থ মুরগির মতো ঝিম মেরেই আছে। কোন কথা বলে না, কোন কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেও না। এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলে না। এই যে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত শরিরে ফিরেছে রাজুর বাপ, সেই বুকের চিনচিনে ব্যথাটা সঙ্গে নিয়েই, একবার ফিরেও তো তাকাল না তো স্বামীর দিকে! সে নতুন পাঞ্জাবিটা খুলে উদোম গায়ে এসে বসে বউয়ের পাশে। ভাঙা গলায় বলেবুকটাতে বড় ব্যথা করতিছে রাজুর মা। এট্টু সরিষার তেল আনি দেও দেকি।

রাজুর মা নিঃশব্দে উঠে গিয়ে সরষের তেলের শিশি এনে দেয়। তেল মালিশ করেও অস্বস্তিটা যায় না রাজুর বাপের। সে এপাশ-ওপাশ করতে থাকে বিছানায়। তারপর এক সময় হঠাৎ উঠে এসে দাওয়ায় বসে হড় হড় করে বমি করে উগরে দেয় সব ভাল খানাপিনা। জীবনে কখনো এত সব নাম না জানা ভাল খাবার দাবার খায়নি, ও কি আর সহ্য হবে তার মতো গরিবের পেটে?

উঠান ভর্তি হলদে কমলা রঙের বমির দিকে চেয়ে রাজুর মা তখন তীব্র কণ্ঠে তাকে প্রশ্ন করেজিগায়েছিলেন আপনে? ক্যান মারলু আমার পোলাক? চাকরি না হয় না দিবি, মারলু ক্যান তারে? জিগায়েছিলেন আপনে? জিগায়েছিলেন?

রাজুর মায়ের উপুর্যপুরি প্রশ্ন তাদের জীর্ণ ভিটেবাড়ি ছাড়িয়ে ওই দূরের খাল, আলু  ক্ষেত, জংলা, বাঁশঝাড় পেরিয়ে যমুনার কালো জলে আছড়ে পড়ে, তারপর আবার বাষ্প হয়ে মেঘের মত আকাশে বাতাসে ভাসতে থাকে, আশপাশের সকলে স্তম্ভিত হয়ে উঠানে জড়ো হয়ে তার চিৎকার শুনে যায়, তবু কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না।