ম্যাগাজিনের ইতিহাস ও বর্তমান হালচাল
‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির কারণে একদা কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল কলকাতার কবি মলয় রায়চৌধুরীকে। তিনি হাংরি আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য। তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্রসহ আরও অনেকেই। সুভাষ ঘোষ তাঁদের নিয়ে বলেছেন, ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা অর্থ সরকার বিরোধীতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধীতা নয়; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসিপাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার।’ কলকাতার হাংরি আন্দোলনের সদস্যরা পত্রিকার নামকরণেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। আগে পত্রিকার নাম হতো কবিতা, কৃত্তিবাস, উত্তরসূরি, পূর্বাশা, শতভিষা প্রভৃতি। তবে এঁরা পত্রিকার নামকরণ করলেন জেব্রা, জিরাফ, ধৃতরাষ্ট্র, উন্মার্গ ইত্যাদি। যদিও এগুলো ছোট কাগজ হিসেবে পরিচিত, তবুও সাহিত্যপত্র হিসেবেও এসব পত্রিকার সুনির্দিষ্ট মর্যাদা রয়েছে।
গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে হাংরি আন্দোলনের পত্রিকাগুলোর আগেও অনেক পত্রিকা প্রকাশ হয়েছে। সেগুলো ছিল কোনো না কোনো দল বা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। তবে ছোট কাগজসহ অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে ধীরে ধীরে এসব পত্রিকা বা সাময়িকী—যার বহুল পরিচিতি ‘ম্যাগাজিন’ হিসেবে—ব্যবসার দিকে ঝুকে পড়ে। এই সাময়িকী বা ম্যাগাজিন সাহিত্যের জগতে নিয়ে আসে নতুন এক মাত্রা। তবে পত্রিকা শব্দটি কীভাবে ‘ম্যাগাজিন’-এ রূপ নিল, তা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে আরও পেছনে।
ম্যাগাজিন প্রকাশের গোড়ার কথা
১৭৩১ সালে এডওয়ার্ড কেভ সম্পাদিত জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রথম চালু হয় ‘ম্যাগাজিন’ শব্দটি। ‘স্টোরহাউজ’ (আড়ৎ) থেকে এর উৎপত্তি। অর্থ হলো, বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেখানে একসঙ্গে রাখা হয়। ম্যাগাজিনের অর্থ তাহলে দাঁড়ায় এই যে—যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের লেখা এক মলাটে পাওয়া যায়।
১৬৬৩ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয় প্রথম ম্যাগাজিন এরবালিশ মোনেস আনটারিতুগেনে। এর বিষয় ছিল সাহিত্য ও দর্শন। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর একই বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক আকারে অনেক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছিল তখন। শুরু থেকেই ম্যাগাজিনের কাটতি ছিল বেশি। তখনকার মেশিনে একবারে দুই হাজার কপির বেশি ছাপানো যেত না। আরও মজার বিষয় হলো, সে সময় এ ধরনের ম্যাগাজিনে লিখতেন মাত্র একজন লেখক! ১৬৭২ সাল নাগাত ম্যাগাজিনগুলোতে একাধিক লেখক লেখা শুরু করলেন। ফরাসি লেখক জিন ডোনিউ ভাইজ এই ধারার প্রবর্তন করেন ডি মার্কিউর গ্যালান্ট নামক ম্যাগাজিন প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এতে দৈনিন্দন খবর, থিয়েটার, সাহিত্য থেকে শুরু করে খেলাধুলাসহ নানা বিষয়বস্তু ছিল। ১৬৯৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন দ্য লেডি’স মার্কিউর, যা মাত্র চার সপ্তাহ চলেছিল।
প্রথম রাজনৈতিক ম্যাগাজিন রিভিউ প্রকাশিত হয় ১৭০৪ সালে। সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক ডেনিয়েল ডেফো (রবিনসন ক্রুসোর লেখক)। এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৭১৩ পর্যন্ত। এছাড়াও একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অনেক ম্যাগাজিন বের হতে থাকে। সেগুলো বেশ জনপ্রিয়ও হয়। যেমন দ্য স্যাটারডে ইভেনিং পোস্ট। যুক্তরাষ্ট্রে এই ম্যাগাজিনই সর্বপ্রথম জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে। ১৮২১ সালে বেরোনোর পর থেকে একটানা এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। উনিশ শতকের শুরু থেকে দ্য স্যাটারডে ইভেনিং পোস্ট–এর জনপ্রিয়তা বাড়তে বাড়তে প্রতিবছর ৯০ হাজার কপি ছাপা হতে থাকে। এ সময় দ্য আমেরিকান বয় ম্যাগাজিনটিও বেশ জনপ্রিয় হয়। পরে এই ম্যাগাজিনটি নাম পাল্টে ইয়ুথ কমপানিয়ন নাম ধারণ করে। এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৮২৭ থেকে ১৯২৯ সাল অব্দি।
কম দামে বেশি পাঠক
দ্য স্যাটারডে ইভেনিং পোস্ট ও ইয়ুথ কমপানিয়ন জনপ্রিয় হলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তখনো তারা পৌঁছাতে পারেনি। কারণ খরচ বেশি হওয়ার কারণে ম্যাগাজিনের দামও ছিল বেশি। প্রতি সংখ্যা ২৫ থেকে ৩৫ সেন্ট ডলার। তাই তাদের পাঠক একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীতেই আবদ্ধ ছিল।
১৮৯৩ সালে এই ধারা বদলে গেল। স্যামুয়েল সিডনি ম্যাকক্লার নামে একজন ম্যাকক্লার শিরোনামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করলেন। আর এটি তিনি বিক্রি করতে শুরু করলেন মাত্র ১৫ সেন্টে। ফলে রাতারাতি বিশাল পাঠক গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে গেল ম্যাগাজিনটি। তাঁর দেখাদেখি অনান্য ম্যাগাজিনগুলোও একই পন্থা অবলম্বন করল। এর মধ্যে কসমোপলিটন (১৮৮৬) ও মানসে ম্যাগাজিন (১৮৮৬-০১৯২৯) বিক্রি করা শুরু করল যথাক্রমে ১২.৫ ও ১০ সেন্টে। এই তিনটি ম্যাগাজিনই তখন সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করছিল। মাত্র ১০ সেন্টের কারণে আড়াই লাখ থেকে সাড়ে সাত লাখ পাঠকের কাছে পৌঁছে গেল ম্যাগাজিনগুলো। সেই প্রথম প্রতি সংখ্যা ম্যাগাজিনে যে টাকা খরচ হতো, তারচেয়ে কমদামে বিক্রি শুরু হলো প্রতিটি ম্যাগাজিন। আর এ সময় বিপণন বাড়ানোর জন্য ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপনের জায়গাও বাড়ানো হলো, যাতে সেগুলো পাঠকদের কাছে আরও কম দামে বিক্রি করা যায়।
উনিশ শতকের শুরুতে ম্যাগাজিন প্রকাশনা জগতে বিজ্ঞাপন একটি বড় ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় বিশ শতকে বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিনের প্রকাশনা শুরু হয়। ম্যাগাজিনগুলোর ক্ষেত্রে আগে যেখানে সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ—এই বিষয়গুলোর প্রধান্য ছিল, ১৯০০ সাল থেকে এই ধারায় বড় ধরনের বদল ঘটতে শুরু করে। খবর, ব্যবসা, ছবির ম্যাগাজিন ইত্যাদি বাজারে জায়গা করে নেয়।
বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিনগুলো
সারাবিশ্বের খবরাখবর নিয়ে ১৯২৩ সালে প্রথম শুরু হয় বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের প্রকাশনা। ১৯২৮ সাল থেকে প্রচুর পাঠক পাওয়া শুরু করে টাইম। এ সময় বিশ্লেষণাত্মক খবরে সাধারণ মানুষ যেমন চমকৃত হয়, তেমনি এই ম্যাগাজিনের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে তাদের। অন্যদিকে বিশ্ববাজার নিয়ে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় বিজনেস উইক। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয় ফোর্বস। এই পত্রিকার বিষয় অর্থনীতি। এই দুটি পত্রিকা বর্তমানেও খুব জনপ্রিয়। পরে টাইম-এর বিদেশি সম্পাদক নিউজউইক নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন, যার কাটতি সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ লাখ। বর্তমানে টাইম ও নিউজউইক-এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে, কার প্রচার সংখ্যা কত বেশি, তা নিয়ে। এই বিশ্বখ্যাত সাময়িকীগুলো নিয়ে মানুষের এখনো সমান আগ্রহ রয়েছে।
ভারত উপমহাদেশে প্রথম ম্যাগাজিন
২৯ জানুয়ারি ১৭৮০। ব্রিটিশ নাগরিক জেমস অগাস্টাস হিকি বেঙ্গল গেজেট নামে একটি দুই পাতার পত্রিকায় বের করেন। ইংরেজিতে প্রকাশিত এই সাপ্তাহিক পত্রিকাই ছিল ভারতবর্ষ থেকে প্রকাশিত প্রথম সাময়িকী। এর প্রথম পৃষ্ঠায় থাকত বিজ্ঞাপন আর ভেতরে বিষয়ভিত্তিক লেখা। হিকিই ছিলেন পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক। কিন্তু এই পত্রিকা ভারত সম্পর্কে কোনো খবরই ছাপতো না। এই পত্রিকায় যাঁরা লিখতেন বা সাংবাদিকতা করতেন, সবাই ছিলেন শাসকদের পক্ষে। বেঙ্গল গেজেট–এ অনেক রং চড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হতো বলে অনেকেই হিকিকে ভারতবর্ষের প্রথম ‘হলুদ সাংবাদিক’ হিসেবে অভিহিত করেন।
বেঙ্গল গেজেট–এর পর ১৮১৮ সালের ২ অক্টোবর স্যার জেমস সিল্ক বাকিংহামের হাত ধরে প্রকাশ হয় কলকাটা জার্নাল। এটি ছিল ৮ পৃষ্ঠার এই পত্রিকায় স্থান পেয়েছিল রাজনীতি, ব্যবসা, সমাজ, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়। আর ১৮২৬ সালের ৩০ মে প্রকাশিত হয় পণ্ডিত জুগাল কিশোর শুকলার ভাষা-বিষয়ক সাময়িকী উদান্ত মারতানরা। প্রথম হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত এ পত্রিকা ৫০০ কপি ছাপা হয়; এবং এর কাটতিও ছিল বেশ। তা ছাড়া প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভারত উপমহাদেশ থেকে আরও কয়েকটি পত্রিকা বের হয়, এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এলাহবাদ থেকে প্রকাশিত সরস্বতী ও উর্দু সাময়িকী দিল্লি উর্দু আকবার (১৮৩৬)।
বাংলায় ম্যাগাজিন
বাংলাতেও ম্যাগাজিনের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। গবেষকদের মতে, ‘ঐতিহাসিক সূত্রে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র–এর হাত ধরে এই অঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হলেও আক্ষরিক অর্থে বুদ্ধদেব বসুর প্রগতি ও কবিতা পত্রিকার হাত ধরে ইউরোপ ও বহির্বিশ্বের অন্যান্য শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন ফর্ম ও ধারার মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রীক লিটল ম্যাগাজিন ধারনার বিকাশ ঘটে। বাংলা কবিতা, গল্প এবং সাহিত্যের অন্যান্য ধারার আধুনিক রিফরমেশন ও ঢং-ঢাং-সজ্জার প্রধান পরিবর্তনও ঘটে লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করেই।’
পরবর্তীকালে অনেক পত্রিকা/ম্যাগাজিন বাণিজ্যিকভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। যেমন—ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১), অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩), প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার সম্পাদিত মাসিক (১৮৫৪), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন (১৮৭২), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ভারতী (১৮৭৭), সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত সাধনা (১৮৯১), রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী (১৯০১) ইত্যাদি।
বাংলায় অনেক ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজ বের হলেও এরা অস্তিত্বের লড়াইয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি। যদি কিছু কিছু ম্যাগাজিন টিকে ছিল বহুদিন। তবে বিক্রির দিক দিয়েও খুব বেশি এগোতে পারেনি। তবে দেশ পত্রিকা এখনও ধরে রেখেছে তার জনপ্রিয়তা। ১৯৩৩ সালের নভেম্বর মাসের ২৪ তারিখ থেকে প্রতি মাসের ২ ও ১৭ তারিখে প্রকাশিত হয় এটি। প্রথম সম্পাদক ছিলেন সতেন্দ্রনাথ মজুমদার। বঙ্কিমচন্দ্র সেন ছিলেন দ্বিতীয় সম্পাদক। এরপরে সম্পাদক হন সাগরময় ঘোষ। তিনি দীর্ঘকাল দেশ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। আর বর্তমানে এই পত্রিকার সম্পাদক সুমন সেনগুপ্ত। দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় এই পত্রিকার আরেকটি উপ-প্রকাশনা হচ্ছে বইয়ের দেশ। ২০০৩ সাল থেকে এটি প্রকাশ হয়ে আসছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিন ছাপা হয়। যেমন: রহস্য পত্রিকা, কিশোরআলো, বিজ্ঞানচিন্তা, কালি ও কলম, শব্দঘর ইত্যাদি। এসব ম্যাগাজিন বা পত্রিকা বাংলাদেশে কম জনপ্রিয় নয়। এদের যথেষ্ট পাঠকগোষ্ঠীও রয়েছে।
বর্তমানে সারাবিশ্বের ম্যাগাজিনের চিত্র
যদিও ম্যাগাজিনের সংখ্যা দিনকে দিন কমেই যাচ্ছে, তাই এই ইন্ড্রাস্ট্রি ধীরে ধীরে ডিজিটালের দিকে চলে যাচ্ছে। আধুনিক যুগে সবাই যেখানে কিন্ডেল, ওয়েবসিরিজের দিকে ঝুকছেন, তখন ছাপা সাময়িকীর দিকে কিছু অনীহা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তার উপর আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থান। এই মাধ্যমের দিকে প্রায় সবাই চলে যাচ্ছে। ছোট থেকে বুড়ো সবার আগ্রহের জায়গা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় কোম্পানির নাম না বলে একটি ম্যাগাজিন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী বলেছেন, সবাই যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলছে, তখন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেউ যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তা কেউ লক্ষ্য করছে না।
ইতিমধ্যে ২০২৫ সাল নাগাদ, ইনসাইডার ইন্টেলিজেন্স অনুসারে, গুগল (ইউটিউবসহ), মেটা (ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামসহ) এবং টিকটক যুক্তরাজ্যে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের আয়ে বার্ষিক ২০ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি আয় করবে।
অথচ এক সময় ম্যাগাজিনের ছিল রমরমা ব্যবসা। সেই জায়গাটা দখল করে ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যেখানে বর্তমানে চ্যাটজিপিটসহ অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লেখকদের আদলে প্রায় হুবহু সবকিছু লিখে দিতে পারছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ছাপা কাগজের প্রতি আগ্রহ কমা অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন পত্রিকার ঘেটে নিচে ম্যাগাজিনের বাজার সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হলো:
ডিন তালবুটের এ বছরের মার্চ মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারাবিশ্বে ম্যাগাজিন থেকে আয় (ছাপা ও ডিজিটাল) ১৬৫.৮০ বিলিয়ন ডলার। যেখানে ছাপা থেকেই ১২৭.২০ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে যা মোটের শতকরা ৭৬.৭২ ভাগ। ২০২৭ সাল নাগাদ যা কমে ১১০.৬০ বিলিয়ন ডলার হবে। অন্যদিকে ডিজিটাল আয় ৩৮.৬০ বিলিয়ন ডলার যা মোটের শতকরা ২৩.২৮ ভাগ। ২০২৭ সাল নাগাদ যা শতকরা ১১.৩৭ ভাগ বেড়ে দাঁড়াবে ৪২.৯৯ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এএআরপি দ্য ম্যাগাজিনের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। ২২.৬৮ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় এই ম্যাগাজিন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে এর বিক্রি শতকরা ৬.৩৬ ভাগ কমে গিয়েছে। এরপরেই আছে এএআরপি বুলেটিন। ২২.৫৬ মিলিয়ন। কমেছে শতকরা ৩.৫৫ ভাগ। তৃতীয় অবস্থানে আছে কসকো কানেকশন। ১৫.৬৮ মিলিয়ন। চতুর্থ আমেরিকান মেইনস্ট্রিম এবং পঞ্চম অবস্থানে আছে বেটার হোমস অ্যান্ড গার্ডেনস।
ইউএস–এ সাবস্ক্রিপশনবেইজ ম্যাগাজিনগুলোর মোট ১২৩.৬৭ মিলিয়ন সাবস্ক্রিপশন রয়েছে। এরমধ্যে প্রিন্ট শতকরা ৯৪.০৮ ভাগ। শতকরা ৬.৯৯ ভাগ কমেছে। অন্যদিকে ডিজিটাল শতকরা ৬৯.৮৪ ভাগ বেড়েছে।
২০১৯ থেকে ২০২২ এর মধ্যে ম্যাগাজিনের পাঠক কমেছে শতকরা ৩৮.৫৬ ভাগ। ২০২১-এ অনুযায়ী, প্রাপ্ত বয়স্ক পাঠক (প্রিন্ট ও ডিজিটাল) রয়েছে ২২২.২ মিলিয়ন। ২০১২ থেকে যা শতকরা ৫.৪৬ ভাগ বেশি।
ইউএস–এ মোট ম্যাগাজিনের সংখ্যা ৪,৫১৯। ২০১৯–এ ছিল ৪,৭৬৫। বর্তমানে শতকরা ৫.১৬ ভাগ কমেছে। প্রতি বছরই ম্যাগাজিনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ২০১২ থেকে এখন পর্যন্ত শতকরা ৩০.৩৩ ভাগ কমেছে। প্রতি বছর কমার হার শতকরা ৩০.৩৩ ভাগ।
২০২০–এর রিপোর্ট অনুযায়ী, শতকরা ৫৮.৩১ ভাগ ম্যাগাজিন কোম্পানিতে ১–৪ জন কর্মী কাজ করে। শতকরা ১৬.৬৬ ভাগ কোম্পানিতে শতকরা ১৬.৬৬ ভাগ। শতকরা ১১.৬২ ভাগ কোম্পানিতে কাজ করে ১০–১৯ জন। শতকরা ৭.৬৩ ভাগ কোম্পানিতে ২০–৪৯ জন এবং শতকরা ৫.৭৮ ভাগ কোম্পানিতে কাজ করে ৫০ জনেরও অধিক কর্মী। একই রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউএস-তে ম্যাগাজিনের মোট কর্মী সংখ্যা ৭৩,৭৮১ জন। তাদের মোট বেতন ৬.৪৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার। গড়ে একটি কোম্পানিতে বেতন ৮৭,৬৯২ ইউএস ডলার। ২০২২-এর তথ্যানুযায়ী, শতকরা ৫৫.৮০ ভাগ নারী এসব ম্যাগাজিনে কাজ করে। গড় বয়স ৪৮।
যেসব ম্যাগাজিন বন্ধ হয়ে গেছে:
১. আমেরিকান হ্যারিটেজ
২. অটোউইক
৩. কনজুমারস ডাইজেস্ট
৪. ইএসপিএন দ্য ম্যাগাজিন
৫. মানি
৬. প্লেবয়
৭. প্লেগার্ল
৮. স্পোটিং নিউজ
অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন ইউরোপে ম্যাগাজিনের গ্রাহক ও সাকুর্লেশন দুটোই কমেছে। যেখানে ২০১১ সালে ছিল ১৭.৪ বিলিয়ন, ২০১৬–তে এসে তা দাড়ায় ১৪ বিলিয়নে। ২০১৭’র রিপোর্ট অনুযায়ী ইউকেতে প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ/নারী সপ্তাহে একবার প্রিন্ট ম্যাগাজিন পড়েন। এরমধ্যে শতকরা ১৯ ভাগই ডিজিটাল ম্যাগাজিন। স্পেনে ২০২১ এর চেয়ে ২০২৩ এসে শতকরা ২২–৫০ ভাগ গ্রাহক কমে গিয়েছে। ২০১০ সালে ফ্রান্সে প্রতিদিন গড়ে মানুষ ২৬ মিনিট ম্যাগাজিন পড়তো। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে তা দাঁড়ায় ২৩.৮ মিনিট। আর জার্মানিতে মোট ৪ মিলিয়ন পাঠক কমে গিয়েছে।
ইউরোপ–আমেরিকার তথ্য তো আমরা জানলাম। কিন্তু বাংলাদেশের? লেখালেখি ও পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকায় আমাদের কাছে অনেক তথ্য আসে। কিন্তু বাংলাদেশে কতজন ম্যাগাজিন পড়েন, কতজন কেনেন, ম্যাগাজিনের বিক্রি বাড়ল নাকি কমল, সেইরকম তথ্য এখন অব্দি আমার চোখে পড়েনি। আদৌ কি এইরকম গবেষণা আমাদের দেশে হয়? যদি হয়েই থাকে সেগুলো কোথায়? বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেও এর সুরাহা করা গেল না। তাহলে নিশ্চয় সেই তথ্য–উপাত্ত দিয়ে লেখাটার সমাপ্তি টানা যেত। তবে আশা করি ভবিষ্যতে কেউ ম্যাগাজিন নিয়ে গবেষণা করবেন। গবেষণালব্ধ ফল আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজে লাগবে খুব। আর একটি প্রশ্ন রেখেই শেষ করছি—বাংলাদেশে কতজন বই পড়েন, সেই হিসেবও কি আমরা রাখি? এই নিয়েও তো গবেষণা হতে পারে। টুকটাক যা হয়েছে, তাও খুব কাজের কিছু না। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম ভবিষ্যতের দিকে!
তথ্যসূত্র
১. বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব: অভিজিৎ পাল, একাডেমিয়া
২. ফ্রন্টলিস্ট ডট ইন
৩. ম্যাকমিলানহায়ারড ডট কম
৪. ব্রিটানিকা
৫. ওপেন ডট লিব ডট ইউডিইউ
৬. শুদ্ধস্বর ডট কম
৭. বাংলাপিডিয়া
৮. ওয়ার্ডসরেটেড ডট কম
৯. দ্য গার্ডিয়ান
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন