সাবদার সিদ্দিকী: প্রথা বিরোধী এক কবি
কবিতাই একজন কবির ঠিকানা, তার আত্মপরিচয়। একজন সাবদার সিদ্দিকীকে যতবার পাঠ করি ততবার তাই মনে হয়। মনে হয়, যে জীবনই তিনি যাপন করে যান না কেন কবিতাই ছিল তাঁর জীবন বাতিঘর, যা আমাদের পথ নির্দেশ করে, প্রেরণা জাগায় বিপ্লবী চেতনায় ও শোষণমুক্ত সমাজ ভাবনায়। জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বশিরহাটে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। কিন্তু এপার-ওপার দুইপারেই ভেসেছে চির ভ্রামণিক কবি সাবদারের জীবন নৌকা। নিজেও বিশ্বাস করতেন তিনি দেশকালের উর্ধ্বে। নইলে কেন বলবেন:
যেখানে পা রাখি
ভিন গ্রহে কিংবা ভিন গাঁয়ে দেখি
পায়ের নিচে টুকরো দুই জমি
হয়ে যায় আপন মাতৃভূমি
দেশভাগের নেপথ্যে একটা প্রহসন ছিলো। আমি সেই প্রসঙ্গে যাবো না। তবে আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কবি সাবদার সিদ্দিকী।
জীবন থেকে জীবনের দিকে ছুটে গেছেন তিনি। এই ভ্রমণ তৃষ্ণাকে তিনি একই সঙ্গে গেরিলা ও সন্যাসীর মতো মৌলিক ও অভিন্ন বলে ভাবতেন। সেজন্যেই বোধহয় তাঁর অকপট এই স্বীকারোক্তি:
একজন গেরিলা ও সন্যাসীর
মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই
যেহেতু উভয়েই
মূলত ভ্রাম্যমাণ
আজন্ম দ্রোহী, স্বেচ্ছাচারি এবং নির্বিকার এক জীবন-বিহারি কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকী [১৯৫০-১৯৯৪] ভেতরে ছিলেন বিপ্লবী চেতনায় একজন গেরিলার মতোই অকুতোভয় কিন্তু আবার সন্যাসীর মতোই নিঃসঙ্গ। সন্ন্যাসীর মতো নিঃসঙ্গ এক জীবন পর্যটকই ছিলেন তিনি। যদিও কখনোই বলতে শুনিনি 'আমি একা, অনাহারী জীবনতৃষ্ণা ছিলো তাঁর আরও গভীরে, আরও দূর লক্ষ্যাভিমুখি। আমরা হয়তো তার ভেতরে ঢুকিনি। তবে টের পেয়েছি এ সবই তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার জবানি। ফলে তিনি বলতেই পারেন তাঁরও জীবন গেরিলা ও সন্ন্যাসীর মতো চির ভ্রাম্যমাণ। আর যদি স্বপ্নবাজ ও দ্রোহীর কথা বলি তবে সেটার উৎস যে ১৯৬৪ সালে কোলকাতায় সংঘটিত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ফলশ্রুতি বলাই বাহুল্য। ১৯৫০-এ জন্ম নেয়া সাবদার তখন চৌদ্দ বছরের কিশোর। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ঐ দাঙ্গার নগ্ন নৃশংসতার ক্ষত তাঁর মধ্যে যে প্রভাব ফেলেছে এবং নতুন স্বপ্ন অভিসারি হতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাঁর আলোচিত ‘কোলকাতা আমি এক কিশোর মহাপুরুষ’ কবিতার মধ্যে খুঁজে পাই আমরা সেই স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ছবি এবং তাঁর জীবনের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। কারণ সাবদার ঐ দাঙ্গাকে আখ্যা দিয়েছেন ‘বিভক্ত স্বদেশ’। এই দাঙ্গায় তাঁর পিতা বিশিষ্ট আইনজীবী গোলাম মাওলা সিদ্দিকীর কোলকাতা মহানগরে সাজানো সংসার হয়েছে তছনছ। পরিবার নিয়ে চলে আসতে হয়েছে সাতক্ষীরায়। যদিও পাঁচ বছর পর ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার ফিরে যান কোলকাতায়। থেকে যান সাবদার। আর্ট নম্বর সেক্টরে কিছুদিন যুদ্ধ করে তিনিও পরে ফিরে গিয়েছিলেন সেখানে। সাবদারের পরিবার সম্পর্কে আমরা আর কিছু জানি না। সাবদারই শুধু এপার-ওপার দু’পারেই ছিলেন চলমান। উধাও হয়ে যেতেন আবার হঠাৎই ফিরে আসতেন। এ ছিলো তাঁর রুটিন বাস্তবতা। তিনি স্বপ্নবাজ তো বটেই। তবে স্বপ্ন দেখছিলেন সমাজ বদলের, মধ্যবিত্তের মুখোশ উন্মোচনের এবং কল্যাণ ও মানবিক এক রাষ্ট্র কায়েমের। তিনি তাই আমাদের এই বলে সতর্ক করতেই পারেন:
কলম ও বন্দুক সমমন
কানের ও মনের রাখিও যতন
যেহেতু সমাজ ও রাষ্ট্রকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে যেমন শিক্ষিত আমলা সমাজ, তেমনি বন্দুকের নল তথা সামরিক যাতাকল। যে কারণে তিনি ছিলেন আজীবন প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী এক কবি। সেই বিরোধিতার আগুন ঝরতো তাঁর ছোট ছোট বিক্ষিপ্ত কবিতায়। তাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন গ্রহণযোগ্য এক কবি। ‘পা, গুটিবসন্তের সংবাদ ও সোনার হরিণ’-এ ধরনের ছোট আকারের সংকলনেই তিনি তাঁর কবিতার বীজ রোপণ করেন যা সুধি মহলে তাঁর জীবনের মতোই ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি করে। কোনো বিশিষ্ট কিংবা উল্লেখযোগ্য না হয়েও তিনি দখল করেন আমাদের চিত্ত এবং মন ও প্রাণ। যদিও তাঁর কাছে কবিতা চিত্ত বিনোদন নয়, জীবনে অমোঘ এক অঙ্গীকার। যে কারণে তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে ঝাঁঝালো এই পঙক্তিমালা:
জীবনের ঝকঝকে আগুন থেকে ঝলসে বেরিয়ে আসে কবিতা ইতিহাস
রুটি মাটি থেকে জন্ম নেয় কবিতা ইতিহাস।
এই পঙ্ক্তি থেকেই আমরা টের পাই তাঁর কবিতার নিশানা কতদূর। জীবন থেকে ছিটকে জীবনেরই সন্ধানে কবিতাই হয়ে উঠেছে তাঁর স্বপ্নের ইশতেহার। কবিতার জন্যই বিনয়ের মতো তাঁকেও বলা হয় ‘কবিতার শহীদ’। যদিও বিনয় মজুমদারের মতো তিনি বিখ্যাত নন, নন এপার-ওপার দু’পারের বিশিষ্ট ও উল্লেখযোগ্য কোন ‘কবি’। তা সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে আমাদের কৌতুহলের অন্ত নেই। এর কারণ তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ও দর্শন। তিনি সস্তা আবেগে প্রেমের পৃথিবী রচনা করার চেষ্টা করেননি। কবিতার মধ্যদিয়েই জানিয়ে দিয়ে গেছেন বুকের ভিতর কী আগুন তিনি বয়ে বেরিয়েছেন। কাকপক্ষীর মতো মৌন হয়ে থাকতেন বটে কেউ জানতেও চায়নি তাঁর ভেতরের একাকীত্ব। ময়লা-জীর্ণ পোশাকে তাঁকে হয়তো অবজ্ঞার অবকাশ ছিলো কিন্তু চিন্তায় ও মননে তাঁর উচ্চতা পরিমাপের সাধ্য আমাদের সামান্যই ছিলো, যে কারণে সে ছিলো আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যারা তাঁর সান্নিধ্যে গেছেন অকপটেই তা স্বীকার করবেন। তাঁর সঙ্গে আমারও কিছু টুকরো অধ্যায় ছিলো। কিন্তু আমি স্মৃতির ভিতর ঢুকতে চাই না। ১৯৯৪ সালে মৃত্যুর সংবাদটা পেয়ে তাঁর উপর আমিই প্রথম দীর্ঘ লেখাটি লিখেছিলাম। শিরোনাম ‘কবি সাবদার সিদ্দিকীর মৃত্যু: এক নগর বাউলের প্রস্থান’। ১৯৯৫ সালে একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী পাতায় প্রকাশিত হয়। পরে এই লেখাটি নিয়েই বহুমাত্রিক লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দকে দিয়ে ঘাস ফুল নদী থেকে ‘সাবদার সিদ্দিকীর কবিতা সংগ্রহ’ বইয়ের মুখবন্ধ লিখিয়ে নিয়েছিলেন মুনীর মোরশেদ ভাই। লেখাটি আর ফেরত পাইনি। যে কারণে অন্য একটি অনলাইন পোর্টালের জন্য আমাকে ‘সাবদার সিদ্দিকী: পুনপাঠ’ শিরোনামে আরেকটি লেখা আমাকে লিখতে হয়েছিল। যা আমার বেহুলা বাংলা থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় গদ্যগ্রন্থ কবিতা সহজ করে বলা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
তিনি সস্তা আবেগে প্রেমের পৃথিবী রচনা করার চেষ্টা করেননি। কবিতার মধ্যদিয়েই জানিয়ে দিয়ে গেছেন বুকের ভিতর কী আগুন তিনি বয়ে বেরিয়েছেন। কাকপক্ষীর মতো মৌন হয়ে থাকতেন বটে কেউ জানতেও চায়নি তাঁর ভেতরের একাকীত্ব। ময়লা-জীর্ণ পোশাকে তাঁকে হয়তো অবজ্ঞার অবকাশ ছিলো কিন্তু চিন্তায় ও মননে তাঁর উচ্চতা পরিমাপের সাধ্য আমাদের সামান্যই ছিলো, যে কারণে সে ছিলো আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যারা তাঁর সান্নিধ্যে গেছেন অকপটেই তা স্বীকার করবেন।
কবিতায় তিনি ছিলেন খুবই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। তাই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন, নাগরিক ভণ্ডামি, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যন্ত্র সভ্যতার ফানুস কিছুই বাদ পড়েনি তাঁর কবিতার বিষয় তালিকায়। বরং প্রতিটি কোণ ধরে শ্লেষমাখা বাক্যবাণে তা হীরক-দ্যুতির মতো খুলে দিয়ে গেছে ব্যক্তির অন্ধত্ব, জাগ্রত করে গেছে বিবেক। তাঁর কবিতার তীর্যক পক্তিগুচ্ছে আমরা উজ্জীবিত। আজন্ম সংগ্রামী সারদারের আদর্শ পুরুষ ছিলেন দু’জন। কবিতায় পাবলো নেরুদা তাঁর বৈপ্লবিক আদর্শ। আর মুক্তির উন্মাদনায় চে গুয়েভারা। এই দু'জনকেই তিনি মনে করতেন তাঁর চিন্তা ও চেতনার প্রেরণাদাতা। সেই প্রেরণা থেকেই ‘ওয়াকিটকি’ কবিতায় তিনি একজন কমরেডের মতোই উচ্চারণ করেন, ‘আলো জ্বালতে এসে ভুলে/ আগুন ফেলেছি জ্বেলে।’ তাঁর কবিতায় তখন মুক্তি সংগ্রামে লড়াকু কোনো গেরিলার ছবিটি যে এভাবেই জীবন্ত ফুটে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। ‘শিরোনামহীন’ কবিতার পঞ্চম ছত্রে তাই দেখি:
পরিণত হাত যখন হাতিয়ারে
সময়ের ধার তখন কে রে ধারে
এ ধারে ও ধারে
ঘুমায়ে পড়েছে কে রে?
রেখে মাথা ঘাস বাংকারে
তর্জনী রেখে ট্রিগারে?
যে জীবনই সাবদার যাপন করে যান না কেন তাঁর ভেতরে ছিল বিপ্লবের স্পন্দন, ছিল চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন। তাই তিনি কবিতায় সঞ্চারিত করেন এই বোধ:
প্রত্যেকটি কবিতাই যেন
এক একটি স্বাধীনতার সনদ।
প্রত্যেকটা কবিতাই যেন
পোস্টারে উৎকীর্ণ
আগ্নেয় ভাষা।
প্রত্যেকটা কবিতাই যেন
মিছিলে উচ্চারিত
প্রতিবাদের ভাষা
প্রতিরোধের ভাষা।
প্রত্যেকটা কবিতাই যেন
স্বাধীনতার ভাষা।
[প্রত্যেকটা কবিতাই যেন]
তাঁর ‘টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম’ শিরোনামের কবিতায় সেই আহ্বান আরও উচ্চকিত:
টেলিগ্রাফের তার
যেন রবিশংকরের সেতার
সুরের মুর্চ্ছনায় মুর্চ্ছনায়
টক্কা টরে টক্কায়
টরে টক্কায় বলে যায়
ডাক দিয়ে যায়,
আয় ওরে আয় আয়
আয় নারী
আয় বিপ্লবের ব্রহ্মচারী।
বিপ্লবী না ব্রহ্মচারি এ দু’য়ে বিভক্ত হয়ে গেছে তাঁর কবিসত্তা। নইলে বিপ্লবী চেতনা থেকে সরে এসে অনিশ্চিত জীবনযাত্রায় তাঁর কবিতায় কেন উচ্চারিত হবে এই চরণ:
মনটারে তুই কর পাথর
দেহটারে মাটি
চোখে চোখে সরোবর।
ফলে তাঁর মাত্র চুয়াল্লিশ বছরের উদ্বাস্তু উন্মুল জীবনাবসানকে আমরা বলতেই পারি এক নগর বাউলের প্রস্থান। কিন্তু প্রস্থান হলেও তিনি আমাদের মন থেকে মুছে যাননি। মুছে যেতে দেবে না তাঁর কবিতার অমর পঙ্ক্তিগুচ্ছ। যেখানে তিনি সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন