মানুষ আমারে ধইরা থাকতো চায়: শাহ সাবুল

অ+ অ-

 

...আমার নাম শাহ মোহাম্মদ সাবুল। বাবার নাম শাহ মোহাম্মদ আমির উদ্দীন। মায়ের নাম জাবেদা বেগম। বর্তমানে আমার বয়স একচল্লিশ। বাবা নাই। মা আছে। আমি মাছ ধরা কিংবা কামে যাওয়ার সময় মাকে সালাম দিয়া, অনুমতি লই। স্ত্রীও হাসি মুখে অনুমতি দেয়...

 

শেখ লুৎফর: আপনার নিজের বিষয়ে একটু বলবেন কী?

এই কথা বলে স্মার্টফোনের রেকর্ডার চালু করলাম। আশ্বস্ত করার জন্য বলি, এটা কিছু না। আমাদের আলোচনাটা রেকর্ড হবে। ছবি উঠবে না। তিনি একটু হাসেন। এর আগে তাঁর সাথে আমার আরো কয়েকবার দেখা ও আলাপ হয়েছে। সেই সুবাদে আমাদের কিছুটা জানাজানি আছে। বাউল জগতে তিনি যাঁদের সাথে মিল-মহ্বত রাখেন, তাঁদের সাথে আমারও দোস্তি আছে। অতএব আমার কথায় ভরসা করে তাঁর নীরব হাসিটা অনেকক্ষণ ঠোঁটে ধরে রাখেন। আর আমি দেখতে পাই, তাঁর হাবশি-কালো ঠোঁটের ফাঁকে ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের সরল হাসি।

সালু কাপড়ের পাগড়িসহ মাথাটা একটু নত হয়। হয়তো তিনি চোখ বন্ধ করে তাঁর মুর্শিদের মুখটা দেখতে চাইছেন। বিশাল হাওরের নির্জনতায়, গভীর চেতনা আর আত্মজ্ঞানে স্তব্ধ হয়ে মুহূর্তগুলো থমকে দাঁড়ায়। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি গফাইকালীর ডহর থেকে, খেওলা-হাওর পেরিয়ে রাণীগঞ্জের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তারপর হুছ...হুছ...করে শব্দ ওঠে। শিবের ভঙ্গিতে বসে তিনি বলতে শুরু করেন।

শাহ সাবুল: আমরার চার ভাই-বোন। আমি সবার বড়। আমার নাম শাহ মোহাম্মদ সাবুল। বাবার নাম শাহ মোহাম্মদ আমির উদ্দীন। মায়ের নাম জাবেদা বেগম। বর্তমানে আমার বয়স একচল্লিশ। বাবা নাই। মা আছে। আমি মাছ ধরা কিংবা কামে যাওয়ার সময় মাকে সালাম দিয়া, অনুমতি লই। স্ত্রীও হাসি মুখে অনুমতি দেয়।

তেরো বছরের সময় আমি ইস্কুল ছাইড়া চাকরিতে যাই। ঘরে খুব অভাব। মা খুব অসুস্থ। বাবারও অসুখ। ঘরে ভাত নাই। দিনে একবার আটার রুটি খাই। বইটই রাইখ্যা গিরস্তর বাড়ি গেলাম কামের খোঁজে। ক্ষেত-গিরস্তি-কাম করি। বড় বড় কামলাগর বেতন দুই হাজার। আমার বেতন মাসিক এক হাজার হওয়া উচিৎ। গিরস্ত-মানুষটা আমারে খুব মায়া করত। সে আমার বেতন ধরছুইন, পনেরোশ টাকা। হাওরে বোরো ধান চাষের সময়, আপনেরা কথটা বুঝবাইন কী না জানি না। তহনও দেশে ট্রাকটর আইছে না। ধনী কৃষক। অনেক জমি। রাইত দুইটা-তিনটার সময় চাইর-পাঁচটা হাল-গরু লইয়া ক্ষেতে নামি। কী শীত!

বড় বড় কামলাগর সমান হাল-মই দেই। ধান রোই। গিরস্ত সব দ্যাখে পরের মাসেই আমার বেতন ধরল দুই হাজার। তাইনের ঘরে আমি পাঁচ বছর চাকরি করছি। তাইন মাসে মাসে আমার বেতন বাড়াইতেন। শেষে আইবার সময় বেতন দিত সাত-আট হাজার।

আমার বয়স তখন বিশ-বাইশ। মনে কত আশা। টাকা হইবো, বাড়িতে দালান দিমু। কিন্তু গান আমার পরানের পক্ষী। গানের লগে ধরালাম সিদ্ধি। প্রত্যেক বিষুদবার দিন শাহ গালিম শাহর মাজারে যাই। বাউল জগতের আলাপ শুনি, গান করি, হালকা জিকিরের পরে রাইত একটা দুইটার সময় বাড়িত আই। বছরখানেক পরে দ্যাখি মনটা ঠাণ্ডা হইতে হইতে জমিনে নামতেছে।

শেখ লুৎফর: কত বছর বয়স থেকে বাউল-সঙ্গ করেন?

শাহ সাবুল: বারো-তেরো বছর থাইকা।

শেখ লুৎফর: কেন বাউলদেরকে আপনার ভালো লাগত?

শাহ সাবুল: আমার বাবা বাউল জগতের মানুষ ছিলাইন। সব সময় গান গাইতাইন। বাবার মুর্শিদ ছিলাইন ইউসুফপুরের শাহ ফয়জুর রহমান। সিলেটের বিশ্বনাথ থানায়।

শেখ লুৎফর: আপনার বাবার কথা বলেন।

শাহ সাবুল: এক বিষুদবারে শাহ গালিম শাহের মাজারে গেছি। আমার মন টিকে না। ঘরে বাবারে খুব অসুস্থ রাইখা গেছি। গানে মন বয় না। খালি বাবার কথা মনে পড়ছে। অই দিন বারোটার পড়ে আমার সঙ্গের জনরে কইলাম, আমার কোনতা ভালা লাগে না। মনে কয় বাড়িত কোনতা অসুবিধা আছে।

বাড়িত আইয়া দ্যাহি বাবা ধাইরে [বারান্দা] একটা চেয়ারে বইয়া আমার অপেক্ষা করে। আমার লগে যে গালিম শাহর মাজারে গেছুইন তাইন আমার মামা। তাইন বাবারে সালাম দিয়া কইন, ভাইসাব, অত রাইতে বইয়া রইছুন?

বাবা: হ। আামার সাবুলের লাইগ্যা খুব চিন্তা করি। আজকে আমার বিদায়ের পালা।

আমি দুপুরে খেওলা হাওর থাইকা বড় বড় অনেক কই মাছ ধরছিলাম। এই লাম্বা লাম্বা। মামা আমার লগে আইছে মাছ খাইতে। আমরা ভাবছি না যে, আব্বা যাইবাগা। অত সুন্দর মাত [আলাপ] মাতরা। আমরা ভাত খাইলাম। বাবা মামারে ডাক দ্যায়া কইলো, তুমিতো কোরআন পড়তা পাড়ো। দ্যাহছা আমার সুরা-কালাম ছহি হয় কী না?

আমি কাছে গ্যায়া বাবার মাথায় হাত রাখি। দ্যাখি, তালু দ্যায়া আগুন বার হইতাছে। আর আব্বা খালি একলা একলা কানরা [কাঁদে]। বাবা আমারে কইলা, আল্লায় মায়া করুইন গরিবরে। যদি গরিবির মতন গরিবি করতা পারো। তোমার শ্রম। তোমার হালাল ভাত-কাপড়। গরিব থাকা সবচে ভালা। আমার আর টাইম নাই। বিদায়ের পালা। মাটিত চাটি বিছায়া আমারে হুতাও। বালিশ-ওলিশ লাগত না।

মুখে-জবানে কলেমা পড়তে পড়তে দুই মিনিটের মাঝে বাবার রুহু গেলোগা। আমি একলা একলা মানুষের চাকরি করি। সংসার চালাই। বোনরা বড় হয়। বিয়ার প্রস্তাব আসে। দামান হগল [পাত্ররা] আসে। পছন্দ হয়। কোনো যৌতুক লাগে না। সবাই মিইল্যা-জিইল্ল্যা বিয়া দেই। মুর্শিদের দোয়া আর আল্লার দয়ায় আমার কোনো দেনা নাই। আমি ঋণ করি না, কেউরে ঋণ দেই না। আমার অভাব হইলে কামের খোঁজে গ্রামে গ্রামে ঘুরি। মুর্শিদের দোয়ায় পাঁচ বছরের ভিতরে আমি সব বুনেগরে বিয়া দিছি। ছয় মাস মাছ ধরি, ছয় মাস মানুষের বাড়িতে চাকরি করি। আমার মতে গরিব থাকাটা সবচে ভালা।

শেখ লুৎফর: মুর্শিদ ধরছেন কত বছর আগে?

শাহ সাবুল: মুর্শিদ ধরছি আজ এগারো বছর। তার অনেক আগে থাইকা মনে মনে আমি মুর্শিদ খুঁজতে ছিলাম। একদিন স্বপ্নে দ্যাহি কাইয়ূম শাহ মস্তানরে। আশার কান্দি গ্রামে উনার আসন। আমার পাশের বাড়ির এখলাসুর রহমান উনারে মুর্শিদ ধরছুইন। তাইনেরে কইলাম, আমার গ্যা দ্যাখতে অইবো বা, যাঁরে স্বপ্নে দ্যাখছি, এইন কী তাইন?

মা হুকুম দিলেন। গিয়া দ্যাখি, তাইনই আমার স্বপ্নে-দ্যাখার জন। পরের বিষুদবারে মায়রে সাথে করি গিয়া বয়েত হইলাম। তাইন আমারে খুব মায়া করুইন। হাজার মানুষ থাকলেও মুর্শিদ বাবা ডাক দেন, আমার সাবুল। আমি জীবনে যে কষ্ট করছি। এখন আর কষ্ট লাগে না। প্রত্যেকটা মানুষ আমারে মায়া করে।

শেখ লুৎফর: একটা গান শোনাবেন?

শাহ সাবুল:

আমি পাপি অপরাধি ডাকি তোমায় কাতরে,
হায় খাজা গালিবের নেওয়াজ, সালাম পীরের দরবারে। [২]
খাজা বাবা গরিবের বন্ধু, ইসলাম-হারুন জ্ঞানের সিন্দু,
দান করিলেরন এক বিন্দু চিশতিয়া যত তরিকি করে,
হায় খাজা গালিবের নেওয়াজ, সালাম পীরের দরবারে।
খাজা বাবা মুরিদ হইয়া, মদিনাতে যান চলিয়া,
আত্মা হে রাসুল বলিয়া, ডাকছেন নবী অই খাজারে।
হায় খাজা গালিবের নেওয়াজ, সালাম পীরের দরবারে।
গান-বাজনা আশিকের কাজা, চালু করলেন দয়াল খাজা,
বড় পীরে পাইয়া মজা, গান-বাজনা দেন জায়েজ কইরা।
হায় খাজা গালিবের নেওয়াজ, সালাম পীরের দরবারে,
আমি পাপি অপরাধি ডাকি তোমায় কাতরে।

বাউল শাহ মোহাম্মদ সাবুল

শেখ লুৎফর: স্ত্রী-সন্তান এইসব বিষয়ে বাউলরা কী চিন্তা করেন?

শাহ সাবুল: আমার পরিবার [স্ত্রী] আমার সাথে চলাফিরা কইরা আমারে খুবই ভালা পাইছে। তহন কইছে যে, চলেন আপনার মুর্শিদের কাছে আমিও বয়েত হইতাম। আমার পরিবার মাঝে-মইধ্যে আমারেও এই বাউল জগতের গান শোনায়।

শেখ লুৎফর: কোন সময়?

শাহ সাবুল: যখন সবাই ঘুমাই পড়ে। সে আমার ঘরে আসে। দুইজনে বসে বসে পীর-মুর্শিদের কথা হয়। বাউল জগতের চর্চা হয়। গানের জগতের, মারফতের জগতের নানা আলাপ হয়। আমি তারে বুঝাই, সে আমারে বুঝায়া দ্যায়। আমার পরিবারে গানের কিছু কিছু জিনিস ভালা বুঝাইতা পাড়ে। সে লেখাপড়া করছে। কোরআন শরিফ পড়ে। পাঁচবার নামাজ পড়ে।

শেখ লুৎফর: অভাবে পড়লে আপনার পরিবার আপনাকে কীভাবে সহযোগিতা করেন?

শাহ সাবুল: আমরার কীসের অভাব? আমরার যে বাচ্চাকাচ্চা আছে, আমি মুর্শিদ ধরার পর থাইকা দ্যাখা যায় যে কাইল-পরু [আগামীকাল ও পরশু] কী খাইমু? ঘরে চাউল, টাকা কিছুই নাই। দ্যাখা যায় যে আমি কাম পাইলাইছি। যখন আমি মোড়ারবন [মোড়ারবন হলো হযরত শাহজালাল-এর প্রধান সিপাহশালার শেখ নাসিরউদ্দীন শাহ আউলিয়ার মাজার] থাইকা আইলাম। ছয় দিনের খাবার রাইখা গেছিলাম। ছয় দিন পরেই আইছি। পরের দিনই কাম পাইলাম।

শেখ লুৎফর: শেখ নাছিরউদ্দীন শাহ-এর ওরসে যাওয়ার টাকা ছিল?

শাহ সাবুল: না। তিন দিন রইছে বাকি। আমি অহন টাকা

 কই পাইমু! রাত্রে আইয়া একজনে আমারে বললো, অ-বা, কালকে আমারে কামলা দিবা?

হ। যামু। যদি সবার থাকে পাঁচশ টাকা বেতন, আমারে দিবা পাঁচশ পঞ্চাশ।

ঠিক আছে। কিন্তু টাকা লইয়া কই যাইতা?

আমি যামু শেখ নাছিরউদ্দীন বাবার ওরসে।

আমারে দুই-তিন দিন দিয়া যাও। একশ টাকা বারাইয়া দিমু।

আমি তারে তিন দিন দিলাম। হে আমারে দিল দুই হাজার টাকা। আমি কইলাম যে, আমার বেতনতো পনরোশ টাকা। দুই হাজার ক্যানে দ্যাও?

তুমি মোড়ারবন যাইবা, আমি পাঁচশ টাকা দিলাম বলাইয়া [বেশি]। যাওয়া-আওয়ার খরচ আর থুরাকিছু মোমবাতি জ্বালায়া দিবা।

আমার মুর্শিদ বাবা কাইয়ূম শাহ মস্তান আমার সাথে। রাণীগঞ্জ বাজার থাইকা দুইশ টাকার মোম কিনলাম। শেখ নাছিরউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে গিয়া দাঁড়াইলাম:

বাবা আউলিয়া, আসসালামু আলাইকুম ইয়া অলি-আউলিয়া।

আল্লা-আল্লার জিকির করলাম। গভীর রাইত। জিকির চলতাছে। আমারচে বড় চুল-দাড়ির এক পাগল। ভিড়ের মাঝে মানুষরে খালি ঠ্যালা দিয়া যায়। আমি অবাক হইলাম, পাগলাতো আতড়া আতড়া [একা একা] থাকতো। মিশার কথা না! তহন তারে ফলো করলাম। হঠাৎ দ্যাহি এক ভদ্রলোকের পকেট থাইকা দামি একটা ফোন তার হাতে লইয়ালছে। আমি খপ কইরা ধরলাম। হট্টগোল শুরু হইল। ভদ্রলোক কইলো, পাগল মানুষ তার লগে ঝামেলা করেন কেন?

আমি কইলাম, এই দ্যাখেন আপনের ফোন।

চোর চোর রব উঠলো। শেখ নাছিরউদ্দীন শাহ আউলিয়ার মাজারের খাদেম আলমগীর শাহ আইয়া আরেক জনরে দ্যায়া চোররে গালে একটা থাপ্পর দ্যাওয়াইলা। দ্যায়া চোররে বাইর কইরা দিলা। আর আমারে কইলা, সাবুল শাহ তোমার দাওয়াত। আজ আমার সাথে খানা খাইবা। আর যাওয়ার সময় তোমার বালবাচ্চার জন্য সিন্নি লইয়া যাইবা।

শেখ লুৎফর: মানুষের বাড়িতে কাজ করা ছাড়া রোজগারের আর কোনো উপায় আছে?

শাহ সাবুল: আমার একটা মেশিন আছে।

শেখ লুৎফর: মেশিন কেনার টাকা কীভাবে জমালেন?

শাহ সাবুল: দশ বছর আগের কথা। একজনে নতুন একটা মেশিন আনছিন। কোন অভাবে পইরা বেচতে চায়। আমি নয় হাজার টাকায় জবানে কিনে সাত দিনের সময় নিলাম। গ্রামের আরেকজন ফিশার ম্যান আমার কাছে একটা পুস্কুনি বেচছে দশ হাজার টাকায়। আমি পাঁচ হাজার টাকা নগদ দ্যায়া পাঁচ হাজার বাকিতে কিনলাম। আমার মুর্শিদের দোয়ায়, মাছ বেচলাম দুই হাজার কম চল্লিশ হাজার টাকা। আর বড় বড় মাছ খাইছি। বড় বড় বাইন খাইছি। আমার বাবাছাবের [মুর্শিদ] বাড়ি বড় বড় মাছ লইয়া গেছি। মুর্শিদের দোয়ায় আমার আল্লা আমারে লাভ দিলো আটাইশ হাজার টাকা।

শেখ লুৎফর: মেশিনের আয় কেমন হয়?

শাহ সাবুল: খাল-বিল শুকাইতে, জমিনে পানি দিতে মানুষ ভাড়া নেয়। সারা বছরই কিছু না কিছু আসে।

শেখ লুৎফর: আর কোনো রুজি?

শাহ সাবুল: বর্ষায় মাছ মারি।

শেখ লুৎফর: মাছ ধরার সারা সিজনে কেমন আয় হয়?

শাহ সাবুল: বর্ষার ছয় মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা আয়। আমার মুর্শিদের দোয়া আর আল্লার দয়ায় মাছ ধরার সবরকম যন্ত্র, জাল আমার আছে। বড় বড় বাইন, বোয়াল, আইড়-গোজি সব বাছা বাছা মাছ। আরেকজন মানুষ রাখি সাথে। তারে বেতন দেই।

শেখ লুৎফর: আপনার ঘর কী দালান?

শাহ সাবুল: না। ভিটি পাকা টিনের ঘর। আসলে আমার মা-ই সব। মারে একটু শান্তি দিবার জন্য সারা জীবন মুর্শিদের দোয়া চাইছি। সবখানে যাইবার আগে মায়ের পায়ে ধইরা সালাম কইরা যাইমু। এর বাদে পরিবাররে কইমু। পরিবারে অনুমতি দিলে মুর্শিদের নামে চলি।

শেখ লুৎফর: কারেন্ট, টেলিভিশন আছে?

শাহ সাবুল: কারেন্ট আছে। টিভির দরকার নাই।

শেখ লুৎফর: মাছ মারার সময় গান করেন?

শাহ সাবুল: হ্যাঁ।

শেখ লুৎফর: একটা গান শোনান।

শাহ সাবুল: বাউল আবদুল করিমের একটা গান।

মানুষের ভিতরে মানুষ, সহজেতে ধরা দেয় না,
মানুষ হইলে মানুষ মিলে, নইলে রে মানুষ মিলে না।...

বাউল শাহ মোহাম্মদ সাবুল ও শেখ লুৎফর

শেখ লুৎফর: কী করলে আপনার সব চেয়ে ভালোলাগে?

শাহ সাবুল: আমি সব সময় একা থাকতে ভালোবাসি। মানুষ আমারে ধইরা থাকতো চায়। কিন্তু মানুষের সঙ্গ আমার ভালা লাগে না।

শেখ লুৎফর: স্ত্রীসঙ্গ?

শাহ সাবুল: হ্যাঁ। স্ত্রীসঙ্গ। আমি কোনো মিল-যোগ করতে অইলে আমি উনিরে কইয়া...। দুই মাস যাইতা পারে। তিন মাস যাইতা পারে। সে বলে এইটাতো ভালা। দ্যাহ তুমি কত দিন থাকতা পারো?

আমি বলি না হইলেও চলবে।

মায়া-মহ্বত আছে। রাইত নিবির হইলে সে আসে। দুইজনে বাউল জগতের আলাপ করি। জিকির করি। মাঝে মাঝে সে আমারে গান শুনায়। আমি তারে শুনাই। এইটাই সন্তুষ্ট।

শেখ লুৎফর: আপনারা স্বামী-স্ত্রীর একটা কষ্টের কথা বলবেন? যেটা আর কেউ জানে না।

শাহ সাবুল: আমার চার ছেলেমেয়ে। আমি কইলাম, আলহামদুলিল্লাহ। সে কইলো, তাইলে তো এইটারও [সহবাস] দরকার নাই। ত্যাও সে মাঝে মাঝে আমার কান্দা [কাছে] ভিড়ে। সাত মাস পরে এক বর্ষা রাইতে আমাদের মিল-যোগ হইয়া গেল। পরে তার গর্ভ হইল। সে অষুধ খাইয়া এইটা-সেইটা কইরালাইতো চায়। আমি কইলাম, এই পাপে আমি নাই। সে বিরক্ত হয়। কান্দে, আল্লা আমিতো এই বাচ্চা চাইছি না। আমার চাইটা ছেলেমেয়ে আছে।

দশ মাস পরে এই বাচ্চাটা মরা হয়। আমার পরিবার যে কাইন্দ্যা কাইন্দ্যা কইতা, আল্লা আমরারতো চাইজন আছে, তাইলে এইডারে ক্যানে দিলা? এই যে ক্যানে দিলা, এইলিগ্যা আল্লা নিছে। নাইলে আমার বাচ্চা মরতো না। আমরার কোনো অসুখ নাই। আমার পরিবার, বাচ্চাগর কোনোদিন এক টাকার অষুধ লাগে না।

শেখ লুৎফর: তাইলে কী এখন আপনাদের মিল-যোগ বন্ধ?

শাহ সাবুল: বন্ধ। এমনেতো সে আমার পাশে থাকে। সে-ও চায় না।

শেখ লুৎফর: আপনারা তো চাইলে কনডম ব্যবহার করতে পারেন।

শাহ সাবুল: এই জিনিস আমি দোকান থাইকা কিনতারতাম না। তাবাদে বীর্য্য শাসন করতা না পারলে ক্যার বাউল। এক ফোঁটা মণির মাঝে কতকত প্রাণ! আমার পরিবার কইলাযে, এই জিনিস না করলে মুর্শিদের দোয়ায় আল্লা তোমার হায়াৎ বারাইয়া দিতারে।

শেখ লুৎফর: আপনার ছেলেমেয়েরা বড় হইছে?

শাহ সাবুল: হ্যাঁ। আমার বড় ছেলে ফাইভ পাশ করছে। কোরআন শরিফ ছবক লইছে।

শেখ লুৎফর: বড় ছেলে কী গান পছন্দ করে?

শাহ সাবুল: হ্যাঁ।

শেখ লুৎফর: সে গান গায়?

শাহ সাবুল: হেসে হেসে বললেন, হ্যাঁ।

শেখ লুৎফর: কার গান?

শাহ সাবুল:

তুমি দয়াল আমি কাঙ্গাল কইর না গো নৈরাশা,
দয়াল মুর্শীদ কাইয়ূম শাহ।
আমার নিদানের ভরসা গো, দয়াল মুর্শিদ কাইয়ূম শাহ।

শেখ লুৎফর: এই গানটা কার লেখা?

শাহ সাবুল: এখলাসের।

শেখ লুৎফর: আপনার প্রতিবেশী এখলাস ভাইয়ের?

শাহ সাবুল: হ্যাঁ।

শেখ লুৎফর: আপনার ছেলে কী আপনার সাথে গান শুনতে যায়?

শাহ সাবুল: হ্যাঁ।

শেখ লুৎফর: আপনার মতো যাঁর বাপ-দাদা তরিকা পন্থী বাউল, এইরকম পরিবার সুনামগঞ্জে কেমন আছে?

শাহ সাবুল: টাকার মইধ্যে চাইর আনা।

শেখ লুৎফর: আপনার স্বপ্ন কী?

শাহ সাবুল: আমার স্বপ্ন, আমার বাচ্চারা কিছু লেহাপড়া করুক। আর কোরআন শরিফ পড়ুক। আর আমি যাইমু মুর্শিদ-বাড়ি। আমার বাচ্চাকাচ্চা যাইব সাথে। গিয়া আমার মুর্শিদের চরণ ধূলা আনবো। ওরা বুঝবো যে আমরা এই লাইনে থাকলে, আমার বাবাও আছলা এই লাইনে। আমার দাদা-পরদাদা আছলা এই লাইনে। এই লাইনে থাহা সবচে ভালা অইবো। আমার বড় ছেলে গিয়া আমার বাবার [মুর্শিদ] কোলে উঠি যায়। সে জিকির করতো। আমার সাথেও আইয়া কয়, আব্বু আও আমরা জিকির করি। তখন আমার মা, বাচ্চাকাচ্চা, পরিবার নিয়া আমরা মোমবাতি ধরাই পাকপাঞ্জাতনে। জিকির করি।

শেখ লুৎফর: কী জিকির?

শাহ সাবুল:

হক লা ইলাহা ইল্লাহ
মোহাম্মদ রাসুল আল্লাহ।
জিকির করো মোমিনগণ,
জিকিরে মজাইয়া মন।
জিকিরে তে দিল রওশন।
ঈমানের সঙ্গে হয় মরণ।
পড়ো লা ইলাহা ইল্লাহ
মোহাম্মদ রাসুল উল্লাহ।

বিকালের লাল রোদে চারপাশ রঙিন হয়ে উঠছে। বিশাল খেওলার হাওরের মাঝে গফাইখালীর ডহরের ছোট্ট একটা দ্বীপে আমরা বসে আছি। আমাদের তিন পাশে ইটাখলা নদী। এক পাশে একটা বিশাল ডহর। ডহরের নীল পানি শীতের রোদে চকচক করছে। চারপাশে হিজল-করচ গাছের ভিড়। ঝকঝকে সবুজে গোটা পৃথিবীটা পরমাত্মার মতো সুন্দর আর পবিত্র লাগছে। আমি ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে পড়ি। শাহ সাবুলের জিকিরের সুরে নিজের আত্মার মাঝে শুধু নিজেকে না, দুনিয়ার সব মানুষকে বুঝি দেখতে পাই। আমাদের ভেতরটা কত কুৎসিত! লোভ, কাম-কলহের কালিতে আমরা নিজেদেরকে কী ভয়ানক রকম ভাবে ডুবিয়ে ফেলছি, হরদম!