প্রত্যেক লেখকই একরকম সংশয়বাদী: ইয়োন ফসে

অ+ অ-

 

|| ইয়োন ফসে ||

ইয়োন ফসে ১৯৫৯ সালে নরওয়ের পশ্চিম উপকূলের হাউগুসুন্দ শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার সুবিশাল সাহিত্যকর্মের সমস্তটাই নির্নস্ক ভাষায় রচিতযেমন: নাটক, উপন্যাস, কবিতা সংকলন, শিশুতোষ গ্রন্থ ও অনুবাদ কর্ম। বর্তমান পৃথিবীতে তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত নাট্যকার। গদ্য সাহিত্যেও তিনি সমানভাবে স্বীকৃত। তার প্রথম উপন্যাস রেড ব্ল্যাক  (১৯৮৩) খুবই বিদ্রোহমূলক। এটি তার পরবর্তী উপন্যাসের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ক্লোজ গিটার (১৯৮৫) তিনি প্রাত্যহিক ঘটনাকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যা পড়ে আমরা সহজেই আমাদের নিজেদের জীবনের সাথে মেলাতে পারি।

১৯৯৯ সালে ফ্রান্সেসামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম ( প্রথম প্রকাশ ১৯৯৬, পরে ২০২০ সালে) নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তিনি ইউরোপ মহাদেশে জুড়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ফসের সাহিত্যিক স্বতন্ত্রতা খুবই চমকপ্রদ। পরিমিতভাবে ভাষাকে ব্যবহার করার তার নিজস্বতা এবং নাটকীয় ঘটনার বুননের মাধ্যমে তিনি উৎকণ্ঠা ও অক্ষমতার মতো সবচেয়ে শক্তিশালী মানব আবেগগুলোকে সবচেয়ে সরল শব্দে প্রকাশ করেছেন। যা তাকে সমকালীন মঞ্চনাটকের একজন মহীরুহ হিসাবে পরিচিতি দিয়েছে। দ্য নেইম (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫, পরে ২০০২ সালে) নাটকের শুরু থেকে তিনি আমাদের দৈনিক বাস্তব পরিস্থিতির বর্ননা দিয়েছেন। একই রকমভাবে তিনি এক অংক বিশিষ্ট ড্যাথ ভ্যারিয়েশন (প্রথম প্রকাশ ২০০২, পরে ২০০৪ সালে) নাটকে তিনি জীবনকে শেষ থেকে শুরুতে অবলোকন করেছেন। নাট্যকার হিসাবে তিনি স্থানের ঐক্য যেমন মেনে চলেন তেমনি সময়ের ঐক্যকে লঙ্ঘন করেন। তার অন্যতম সৃষ্টি হলো ট্রিলজি (২০১৬) যেখানে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে ভালোবাসা ও সংঘাতের একটি নিষ্ঠুর বীরগাথা রচনা করেন। তার উচ্চমানের নাটকীয় গল্পগাথার নিখুঁত রচনাশৈলীর জন্য ২০১৫ সালে নরডিক কাউন্সিল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার কবিতা মানুষের গভীরতর অনুভূতি প্রকাশের এক মৌলিক শব্দবন্ধের আধার এবং ভাষার সীমাবদ্ধতার চিত্রাংঙ্কন করে।

ফসের সর্বৃবহৎ ও মহৎ গদ্য সাহিত্যকর্ম হলো সেপ্টোলজি যা দ্য আদার নেইম (২০১৯), আই ইজ অ্যনাদার (২০২০) এবং আ নিউ নেইম (২০২১)-এর সন্নিবেশে সৃষ্ট। ১২০০ পৃষ্ঠার তিন খণ্ডের এই উপন্যাস একটি একক ও দীর্ঘ স্বগতোক্তি দিয়ে গঠিত। উপন্যাসের কাহিনির স্রোত কোনো বাক্য বিরতি ছাড়া সীমাহীনভাবে এগিয়ে যেতে থাকে। উপন্যাসের প্রতিটি খণ্ড একই পদাংশ দিয়ে শুরু হয় এবং সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য একই প্রার্থনা দিয়ে শেষ হয়। ফসের অভিনব নাট্যশৈলী ও গদ্য সাহিত্যের মাধ্যমে অব্যক্ত কথাকে যুতসই কণ্ঠ প্রদান করার কৃতিত্বের জন্য ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ভাষার অপূর্ব প্রয়োগ ও কাহিনির এমন সুনিপুণ বুনটের জন্য বিশ্বসাহিত্যের পাদপ্রদীপে তিনি চির ভাস্বর হয়ে আছেন।

 

|| সম্পাদকীয় নোট ||

নরওয়েজিয়ান ঔপন্যাসিক ইয়োন ফসের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে দি নোবেল প্রাইজ। সম্প্রতি নোবেল প্রাইজ আউটরিচ প্রতিধ্বনি পত্রিকাকে সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশের কপিরাইট প্রদান করেছে। আমরা নোবেল প্রাইজ আউটরিচ ও ইয়োন ফসের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। প্রতিধ্বনির জন্য এটি অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ। 

 

নির্নস্ক মূলত সংখ্যালঘুদের ভাষা। নরওয়ের মাত্র ১০ ভাগ লোক এই ভাষায় লেখে। সংখ্যালঘুদের ভাষা হওয়ার ফলে এই ভাষার সাথে সহজেই একটা বন্ধন তৈরি হয়। যেকোন আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সবাই তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা প্রদান করে। আমার মনে আছে, ছাত্রাবস্থায় আমি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, যদি কেউ আমার ভাষাকে আক্রমণ করে তাহলে শুধু একটা কাজই করতে পারেন তা হলো একটা জোরে ধাক্কা মারো অথবা নীরবে স্থান ত্যাগ করো। এই বিষয় নিয়ে কখনো তর্কে জড়িয়ে না। এটা অনেকটা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাকবিতন্ডাতে জড়ানোর মতো। হয় যুদ্ধ করো, না হয় সরে যাও।

 

প্রশ্ন: আপনার লেখালেখি জীবন শুরু হয়েছে কিভাবে?

ইয়োন ফসে: সত্যি বলতে আমি স্কুল জীবনকে তেমন একটা পছন্দ করতাম না। আমার খুব কম ছিল, আপনারা এটাকে কি বলেন? আমরা নরওয়েজিয়ান ভাষায় গ্রেড বলি। শিক্ষকরা বলতেন, আমি তেমন ভালো লিখতে জানি না। কিন্তু আমি নিজের আনন্দের জন্য লিখতাম। খুব অল্প বয়স থেকেই লিখতাম। আমার যতটুকু মনে পড়ে সর্বপ্রথম আমি কোনো গানের স্বরলিপি লিখেছিলাম। তারপর আমি ছোটকবিতা ও ছোটগল্প লেখা শুরু করেছিলাম। এই লেখার কাজটা আমাকে একধরনের আনন্দ দিত। মনের মধ্যে কেমন একটা প্রশান্তি এনে দিত। নিজেকে নিরাপদ মনে হতো। লেখার মাঝে নিজেকে খুঁজে পেতাম। কল্পনার যে কোনো কিছু প্রকাশ করতে পারতাম। প্রকাশ শব্দটা ঠিক মানানসই হলো না। বরং বলা যায় যে কোন কিছু লিখতে পারতাম। এটা খুব খারাপ ব্যাপার ছিল। পরে আমি কিছু লেখা পড়েছিলাম এবং কিছু লেখা খুব নিম্নমানের ছিল। যদিও লেখাগুলো তেমন উন্নত ছিল না, তবুও লেখাগুলো আমাকে একটা স্বস্তির অনুভূতি দিত। মনে হতো লেখাগুলো একান্তই আমার নিজস্ব। আমার প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসা। আমি জানি না ঠিক কোথা থেকে আসত। বুঝতাম প্রাণের ভেতরের কোন এক জায়গা থেকে উঠে আসত। তবে মস্তিষ্ক থেকে নয়। এখনো আমি, এই ৫০ বছর পরেও আবিষ্কার করতে পারিনি ঠিক কোথা থেকে লেখাগুলো আসে। এখনো আমি বিশ্বাস করি, আমার লেখাগুলো আমার প্রাণের সেই গোপন জায়গা থেকে উঠে আসে। মনে হয় সেই গোপন কুটির সম্পর্কে বেশি কিছু না জানাই ভালো। সত্যিকারের ঠিকানাটা খুঁজে বের করে ফেলা উচিৎ নয়। কিন্তু জায়গাটা ঠিকঠিক আছে। 

প্রশ্ন: আপনার লেখালেখি শুরু করার পিছনে প্রেরণা কি ছিল? 

ইয়োন ফসে: আমি খুব অল্প বয়সে গিটার বাজানো শুরু করেছিলাম। খুব বেশি করে বাজাতাম। এমনকি ভায়োলিন বাজানো চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তেমন ভালো শিখতে পারিনি। সেদিক থেকে গিটার একটু বেশি ভালো বাজাতে পারতাম। এমনকি আমি ব্যান্ডের দলে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা এতটাই ভালো বাজাতাম যে একটা সময় আমরা এলাকা নাচের প্রোগ্রামগুলোতে বাজাতে শুরু করলাম। মনে হয় আমি যখন বাজাতে শুরু করলাম তখন আমার বয়স ১৪ বছর ছিল, যদিও এমন জায়গায় বাজানোর জন্য কমপক্ষে ১৬ বছর হতে হয়। তার মানে আমি খুব অল্প বয়সেই সুযোগটা পেয়েছিলাম। কিন্ত আমার কিশোরবেলার শুরু থেকেই সঙ্গীতের প্রতি একটা তীব্র ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ঠিক কি কারণে তা বলা মুশকিল। আমি লেখালেখি বন্ধ করে সঙ্গীত চর্চা শুরু করেছিলাম এবং পরে আবার লেখালেখি আরম্ভ করেছিলাম। আমার কেন জানি মনে হয়, আমি যখন পুরাতন টাইপরাইটার নিয়ে বসে লিখতে শুরু করেছিলাম তখন এমন একটা ভাব, একটা আবহ অথবা একটা অনুভূতি তৈরি করতে চেয়েছিলাম যেটা সঙ্গীতের সুর বাজানোর সময় তৈরি হয়। আমার লেখার যত পুনরাবৃত্তি যার জন্য আমি কিছুটা প্রশংসিত কিছুটা নিন্দিত তার সবকিছুর মূলে রয়েছে আমার সঙ্গীত প্রেম। 

আমি ওই ব্যান্ডে থাকার সময় ইলেকট্রিক গিটার যেমন বাজিয়েছি তেমনি ধ্রুপদী গিটার বাজানো শিখেছিলাম। বাখের কিছু সুরও শিখেছিলাম এবং বাজাতেও পারতাম। কিন্তু তারপর, সবকিছুকে ছাপিয়ে। আপনি জানতে চেয়েছেন আমি কেন একজন ভালো সঙ্গীতজ্ঞ হতে পারিনি। আমি প্রচুর অনুশীলন করেছি, অনুশীলন করছি এবং অনুশীলন করেছি। কিন্তু আমি তেমন উচ্চমাত্রায় পৌঁছাতে পারিনি। যদি অন্যদের সাথে তুলনা করি তাহলে পরিস্কার দেখতে পাই তারা আমার থেকে অনেক ভালো শিল্পী হয়ে উঠেছেন। হয়তো সেই কারণেই খুব সহজে বলা যায় যে আমি সুর বাজানো ছেড়ে দিয়ে লেখালেখিতে স্থির হয়েছিলাম।

প্রশ্ন: আপনি আপনার লেখালেখির মাধ্যম নির্নস্ক ভাষা সম্পর্কে কি ব্যাখ্যা করবেন? 

ইয়োন ফসে: আমার কাছে বিষয়টি খুব খুব সহজ ও সরল। আমি যখন স্কুলে প্রথম গ্রেডে নির্নস্ক ভাষাটা শিখতে শুরু করি, বলা যায়, আমি নরওয়ের সঠিক ভাষা, আসল ভাষাটা শিখতে আরম্ভ করেছিলাম। আমি এই শেখাটা স্কুলের শেষ পর্যন্ত চলমান রেখেছিলাম। আমাদের সময়ে জিমনেশিয়াম বলতাম মানে স্কুলের শেষ গ্রেড, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত। আমার সকল শিক্ষক নির্নস্ক ভাষাতেই লিখতেন। এমনকি আমরা সবাই এই ভাষাতেই লিখতাম। সহজভাবে বললে এটা তো আমারই ভাষা। আমি জীবনে অনেক কিছু করতে পারি কিন্তু আমার ভাষাকে আমি ত্যাগ করতে পারি না, এটা করার কোন অধিকার আমার নেই। সত্যিকার অর্থে এটা আমি করতেও চাই না। এই যে আমি কথা বলছি, এই শব্দের ধ্বনি, আমার কথার আঞ্চলিকতা সবকিছু আসলে নির্নস্ক ভাষার লিখিতরূপের খুবই কাছের, প্রচণ্ডরকম মিল রয়েছে। আমি যখন আমার দাদীর কণ্ঠ শুনি তখন স্বভাবতই এটার টান আমার কানে নির্নস্কের মতো শোনায়। কিন্তু বুকমালে এই টান শুনতে পাওয়া একরকম অসম্ভব, দুর্লভ। বুকমাল ভাষাটা শুনলে মনে হয় ভিন্ন কোন মানুষ কথা বলছে। তাই নির্নস্কের মূল অভিজ্ঞতাটা এই নরওয়ের ভূমির সাথে আর এই ভূভাগের ধ্বনির খুব কাছাকাছি, খুব আষ্টেপিষ্টে বাধা। এক কথায় নির্নস্ক সমগ্র নরওয়ের একক ভাষা হওয়ার কথা। দুঃখের বিষয় হলো, নির্নস্ক মূলত পশ্চিম নরওয়ের মানে আমার শহর ভেস্টল্যান্ডে সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। 

এটার বড় একটা কারণ হলো পশ্চিম নরওয়ের কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষার সাথে এর একটা সাদৃশ্য বা মিল আছে।  কথ্য নরওয়েজিয়ান ভাষার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্নস্ক ভাষার মধ্যেও বিরাজমান, যা আবার বুকমাল ভাষাতে নেই। তাই আপনি চাইলে দুটি ভাষার এই দিকটা কে আরো বেশি বিস্তৃত করে দেখতে পারেন। অবশ্য এমনটি করার যথাযথ কারণও রয়েছে। কিন্তু মানুষ নির্নস্কে তাদের নিজের ভাষা হিসাবেই গ্রহণ করে। অথবা তারা যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষার খুব নিকট আত্মীয় বলে মনে করে। বিশেষ করে পশ্চিম নরওয়েতে। অন্যদিকে পূর্ব নরওয়ের তেলিমার্ক অঞ্চল যেটি পশ্চিম নরওয়ের সন্নিকটে অবস্থিত। যেখানে টেরাই ভেসাস জন্মেছেন। নির্নস্ক মূলত সংখ্যালঘুদের ভাষা। নরওয়ের মাত্র ১০ ভাগ লোক এই ভাষায় লেখে। সংখ্যালঘুদের ভাষা হওয়ার ফলে এই ভাষার সাথে সহজেই একটা বন্ধন তৈরি হয়। যেকোন আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সবাই তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা প্রদান করে। আমার মনে আছে, ছাত্রাবস্থায় আমি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, যদি কেউ আমার ভাষাকে আক্রমণ করে তাহলে শুধু একটা কাজই করতে পারেন তা হলো একটা জোরে ধাক্কা মারো অথবা নীরবে স্থান ত্যাগ করো। এই বিষয় নিয়ে কখনো তর্কে জড়িয়ে না। এটা অনেকটা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাকবিতন্ডাতে জড়ানোর মতো। হয় যুদ্ধ করো, না হয় সরে যাও। 

 

ভালোবাসা শব্দের পরিবর্তে আপনি অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করতে পারেন। এমন শব্দ যা ভালোবাসার মতো মূল্যের সমান অর্থ বহন করে। ভালোবাসা শব্দটি অনেক প্রায়োগিক পরিস্থিতিতে ভালোই কাজ করে। কিন্তু বাস্তবিক বিষয়ে তেমনভাবে কাজ করে না। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই একরকম সংশয়বাদী। আপনি যদি ভাষার বিষয়ে সংশয়ী হয়ে থাকেন। আপনি ভালো করেই জানেন যে একটি সহজ শব্দ যেকোন সাধারণ পদবিন্যাসে বসাতে পারেন। তারা হয়তো খুব বেশি গভীর কিছু বোঝাবে না কিন্তু যাপিত জীবনের প্রাত্যহিক যোগাযোগের জন্য শব্দগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন জীবনকে খুব গভীর থেকে বোঝতে চান। আপনি যদি খুব সাধারণভাবে শব্দকে ব্যবহার করেন আপনি যা বলতে চান তার বাইরে গিয়ে তেমন গভীর কিছু বলতে পারেন না। শুধু কথা বলে জীবনের গভীরে যাওয়া যায় না। 

 

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন পুরস্কারের প্রেরণা আপনার জীবনকে কোন অর্থ দিয়েছে? 

ইয়োন ফসে: হ্যাঁ, পুরোপুরি। যদি খুব সহজ করে বলতে হয়, তাহলে আপনি বলতে পারেনকেন আসলে একটা কবিতা বা একটা উপন্যাস লেখা হয়? জীবনে কিছু বিষয় থাকে যা সরাসরি বলা যায় না। সেই বিষয়টা প্রকাশ করার জন্য, বলার জন্য আপনাকে সাহিত্যকে অবলম্বন করতে হয়। আমি মনে করি, জাক দেরিদা অনেকটা ঠিক ছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন, আপনি যখন কিছু মুখে বলতে পারবেন না তখন সেটা লিখে ফেলাই ভালো। অথবা লেখার কাছাকাছি কিছু করতে পারেন। আমার অভিজ্ঞতায় এটা সবচেয়ে সহজ সত্য। আপনি আপনার ভেতরের সবচেয়ে জটিল অনুভূতিগুলো বা জীবনের সেই অভিজ্ঞতাগুলো লিখে প্রকাশ করতে পারেন যা মুখে বলা অসম্ভব। আমি মনে করি এই অব্যক্ত কথাগুলো লিখে প্রকাশ করতে পারাটা সতিকারে লেখকের একটা প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতা. একটা উপহার। যদি জীবন ও জগতের বাইরে কি ঘটছে শুধু তাকেই প্রকাশ করা হয় বা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকেই প্রকাশ করা হয় তাহলে ব্যাপারটা খুব হালকা লাগে। কারণ সবাই এই কাজটা করতে পারে। আপনি যদি ঠিক এইভাবে একটা বাক্য লেখেন তাহলে ব্যাপারটা খুব স্থুল ও সাদাসিদে লাগে। লেখালেখির এই মাত্রাটার জন্য হলেও আমি মনে করি জীবনে সাহিত্যের প্রয়োজন আছে, অথবা আরো বিস্তৃত করে বললে জীবনে শিল্প আবশ্যক। সাহিত্যের মাধ্যমে আপনি এমন কিছু বলতে পারেন যা অন্য কোন মাধ্যমে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারবেন না। ঠিক একই কারণে সাহিত্য লেখা হয়। 

প্রশ্ন: আপনার লেখায় নীরবতা ও বিরতি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ কেন?  

ইয়োন ফসে: এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় হলো আমার নাটকগুলোতে দৃষ্টি দেওয়া। আমি অসংখ্য নাটক লিখেছি, বেশ কিছু উপন্যাস এবং কিছু কবিতাও লিখেছি। আমার যতদূর মনে পড়ে আমি প্রায় সাতটা কবিতার বই প্রকাশ করেছি। তবে চলুন আমরা একটা নাটকের প্রসঙ্গে কথা বলি। আমি যখন আমার প্রথম নাটক লিখেছিলাম, কেউ একজন আসছে বা কেউ একজন আসবে’—যদিও এটি একই নাটকের দুটি আলাদা অনুবাদ। আমার মনে হয়েছে, আপনি যখন এই রকম বাক্য লিখবেন আর হঠাৎ করেই থেমে যাবেন, নীরবতায় ডুবে যাবেন আর ছোট করে লিখবেন বিরতি অথবা কোন সংলাপ লেখার মাঝখানেও আপনি বিরতি শব্দটা লিখতে পারেন। যদি নীরবতার মুহূর্তটা ছোট হয় তাহলে লিখতে পারেন অল্প বিরতি। যদি নীরবতার সময়কালটা বেশি হয় তাহলে আমি লিখি দীর্ঘ বিরতি। আর আমি এটা করি লেখার মধ্যে একটা ছন্দ তৈরি করার জন্য। সহজ কথায়, লেখালেখি আমার কাছের একটা ছন্দের মতো। লেখায় সঠিক ছন্দ আনার জন্য আপনাকে মাঝে মাঝে বিরতি নেয়ার প্রয়োজন। লেখার গতি পরিবর্তন করতে কিংবা কোন অনুভূতি যা খোলাখুলি লেখা যাচ্ছে না। আপনি হয়তো সরাসরি লিখতে পারছেন না। তখন আপনি থেমে যাবেন। একটা বিরতি নেবেন। এই বিরতিতেই পাঠককে বুঝিয়ে দেবেন আপনি আসলে কি বলতে চেয়েছেন কিন্তু বলেননি। আমার মনে পড়ে, হ্যারল্ড পিন্টারকে তার নাটকের বসদের সম্পর্কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, তারা সবসময় যোগাযোগ স্বল্পতার কথা বলে। কিন্তু পিন্টার বলেছিলেননা, আমার নাটকে যোগাযোগের কোন অভাব নাই। বরং এখানে অধিক যোগাযোগ উদাহরণ আছে। 

ব্যাপকার্থে, আমি পিন্টারের সাথে একমত। এটার কোন বলার বিষয় না বরং বোঝার বিষয়। নাটকে বিরতি ব্যবহার করার অনেক সূক্ষ্ম কারণ আছে। লেখার শেষে আপনি যখন সব বিরতি একত্রিত করবেন তখন একটা নীরবতার গুঞ্জন শুনতে পারবেন। হ্যাঁ, আমি আমার উপন্যাসগুলোতে বারবার বিরতি ব্যবহার করে এই নীরবতার স্বর শুনতে চেয়েছি। এটা আমি সঙ্গীত থেকে পেয়েছি। আমার উপন্যাসের নীরবতার আঙ্গিকটা অনেকটা আমার নাটকের বিরতির আঙ্গিকের সমতূল্য। আমি যখনই সঙ্গীত, নাটক বা উপন্যাস নিয়ে কথা বলি না কেন আমি মূলত নীরবতা নিয়ে কথা বলি। আমার সবসময় মনে হয় আমার লেখায় দুটো ভাষা আছে। একটা হচ্ছে যে শব্দ দিয়ে আমি লিখি। আরেকটা হলো এই শব্দের আড়ালে একটা নীরবতার ভাষা। এই নীরবতার ভাষা দিয়ে আসলে কি বলা হয় যা শব্দ দিয়ে বলা কঠিন। আপনি যা বলতে চাচ্ছেন তা হয়তো কয়েকটি শব্দ দিয়ে বলা যাবে না অথবা বললে যা বলতে চেয়েছেন তা বোঝা যাবে না। কিন্তু শব্দের মাঝে নীরবতা থাকলে আপনি ঠিই তা পড়তে না পারলেও শুনতে পাবেন। বুঝতে পারবেন যা না বলে বলে দিয়েছি। আমি বলব বিষয়টা অনেকটা মহৎ চিত্রকর্মের মতো। মার্ক রথকোর সব চিত্রকর্মের মতো। তার চিত্রগুলো আমার সাথে অনেক কথা বলতে পারে, অনেক, অনেক। সত্যিই কি শব্দ দিয়ে কথা বলে? না, তারা শব্দের কথা বলে না। তারা আপাদমস্তক নীরব। কিন্তু তারা কথা বলে। আমার তিনটা কুকুর আছে তারাও অনেকটা একই রকম। যদিও তারা কথা বলে না কিন্তু আপনি বুঝতে পারেন তাদের অনুভূতি। তারাও আপনার কথা না শুনেই আপনাকে বুঝতে পারে। এটা একটা চরম সত্য। তারা কোন ভাবের অনুপস্থিতেই তার উপস্থিতি অনুমান করতে পারে। কুকুর ও দেবদূত নামে আমার একটা কবিতার সংকলন আছে। আমার মনে যে কোন শিল্প কিছু না কিছু বলে যেমন করে একটা বোবা কুকুর কিংবা একটা নীরব চিত্র কথা বলে। আমি বলবো শব্দ কখনো কখনো খুব কঠিন মাধ্যম, খুব অমসৃন। তারা নিজেদের ব্যাপারে খুব কমই বলে। আচ্ছা, নরওয়েজিয়ান শারেস্তে শব্দটি ধরি যাকে সুইডিশ ভাষায় শারলেকবলে যা দিয়ে সামান্য কিছু বোঝায়। কিন্তু একই অর্থের ইংরেজি লাভ শব্দ দিয়ে তেমন কিছুই বোঝায় না। 

বিষয়টা বোঝানোর জন্য আরেকটু বলি, ভালোবাসা শব্দের পরিবর্তে আপনি অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করতে পারেন। এমন শব্দ যা ভালোবাসার মতো মূল্যের সমান অর্থ বহন করে। ভালোবাসা শব্দটি অনেক প্রায়োগিক পরিস্থিতিতে ভালোই কাজ করে। কিন্তু বাস্তবিক বিষয়ে তেমনভাবে কাজ করে না। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই একরকম সংশয়বাদী। আপনি যদি ভাষার বিষয়ে সংশয়ী হয়ে থাকেন। আপনি ভালো করেই জানেন যে একটি সহজ শব্দ যেকোন সাধারণ পদবিন্যাসে বসাতে পারেন। তারা হয়তো খুব বেশি গভীর কিছু বোঝাবে না কিন্তু যাপিত জীবনের প্রাত্যহিক যোগাযোগের জন্য শব্দগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন জীবনকে খুব গভীর থেকে বোঝতে চান। আপনি যদি খুব সাধারণভাবে শব্দকে ব্যবহার করেন আপনি যা বলতে চান তার বাইরে গিয়ে তেমন গভীর কিছু বলতে পারেন না। শুধু কথা বলে জীবনের গভীরে যাওয়া যায় না। 

কপিরাইট © Nobel Prize Outreach AB 2023
সাক্ষাৎকারটির লিংক: Jon Fosse–Interview-NobelPrize.org
বাংলা কপিরাইট © প্রতিধ্বনি [pratidhwanibd.com]