আমি একজন বুর্জোয়া মুভিমেকার: গদার
অনুবাদকের নোট
জ্যঁ-লুক গদার [৩ ডিসেম্বর ১৯৩০-১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২]। সদ্যপ্রয়াত মাস্টার ফিল্মমেকার। ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ ফিল্ম মুভমেন্টের অন্যতম প্রধান যোদ্ধা। আমৃত্যু বিপ্লবী; তবে নিজের মতো। বানিয়েছেন শতাধিক সিনেমা। এর মধ্যে গুটিকয়েক বানিয়েছেন যৌথভাবেও। তেমনই একটি সিনেমা, ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা যৌথভাবে বানিয়েছিলেন সহযোদ্ধা জ্যঁ-পিয়েরে গোরাঁর সঙ্গে। সিনেমাটি নিয়ে তারা দুজন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে, তাদের সাক্ষাৎকার নেন আমেরিকান সিনে-ইতিহাসবিদ, তাত্ত্বিক ও সমালোচক রবার্ট ফিলিপ কলকার। পরের বছর [১৯৭৩] ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সিনে-ম্যাগাজিন ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এ প্রকাশ পায় সেটি, ‘অ্যাঙ্গেল অ্যান্ড রিয়েলিটি: গদার অন গোরাঁ ইন আমেরিকা’ শিরোনামে। তারই বাংলা ভাষান্তর হাজির করা হলো।
রবার্ট ফিলিপ কলকার: নিজের অতীতের সিনেমাগুলো প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আপনি ছিলেন একজন বুর্জোয়া ফিল্মমেকার এবং ওগুলো ছিল বুর্জোয়া ফিল্ম।
জ্যঁ-লুক গদার: ভুল বলেছিলাম। এখন অবশ্যই স্বীকার করছি, আমি এখনো একজন বুর্জোয়া মুভিমেকার, এখনো একজন তারকা; তবে ভিন্ন ধরনের তারকা হতে চাই...
জ্যঁ-পিয়েরে গোরাঁ: তবে একটি ব্যাপার, জ্যঁ-লুকই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি গত ২০ বছরে সিনেমাকে পাল্টে দিয়েছেন। একমাত্র তিনিই তার শুরুর দিকের সিনেমাগুলোর মধ্য দিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া হাজির করেছেন। আমাদের দুজনের কর্মসম্পর্ক বেশ কাজে দিয়েছে। কেননা, তার পক্ষে আমি দাঁড়াতে পেরেছি এবং তার অতীতের সিনেমাগুলোর প্রশ্নে আমার ভাষ্য, সেগুলোতে এমন কিছুর দেখা পেয়েছি, যা আমাদেরকে খানিকটা সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে সক্ষম। ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’ তো গোদারের আগের সিনেমাগুলো থেকে আসা প্রশ্নবাণে ভরা। এটি [‘ত্যু ভা বিয়াঁ’] একটি ভীষণ রকমের গদারধর্মী সিনেমা। আসলে, ‘গদারধর্মী’—ব্যাপারটি আমারই সৃষ্টি। এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়; কেননা, নতুন কোনো কিছুর আবির্ভাব সব সময় পুরনোর কাছ থেকেই ঘটে।
আমরা মনে করি, ডকুমেন্টারি ও ফিকশনের মধ্যকার পার্থক্য আসলে বানোয়াট। সিনেমার পর্দায় যা কিছু দেখানো হয়, সবই ফিকশন। আর তা বলশেভিক বিপ্লবের নিউজরিলগুলোর মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন জিগা ভের্তভ। ‘সিনেমা-ভেরিতে’র আবির্ভাব ঘটেছে সরাসরি ভের্তভের কাছ থেকে। কিন্তু তাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি যে টার্ম ব্যবহার করেছিলেন, সেটি ‘কিনো প্রাভদা’। রুশ ‘প্রাভদা’ শব্দের অর্থ ‘সত্য’; একইসঙ্গে এটি একটি বলশেভিক পত্রিকার নামও। ‘কিনো প্রাভদা’ বলতে ভের্তভ ‘কিনো বি.’র কথা বুঝিয়েছিলেন। ‘বি.’ হলো ‘বলশেভিক’ শব্দের প্রথম অক্ষর। ভের্তভ আসলেই ফিকশন মুভি বানিয়েছিলেন—বাস্তব অনুষঙ্গ ব্যবহার করে, যা প্রত্যেকেই করেন। টিভিতে নিক্সনের [তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট] দেওয়া কোনো ভাষণের চেয়ে ঘনিষ্ঠ কোনো ফিকশন নেই। এ এক ভয়াবহ ফিকশন; তবে এমনই ফিকশন, যার মধ্যে এক ধরনের বাস্তবতা উপস্থিত।
গদার: আর, এই ফিকশনের সঙ্গে আপনার যে সম্পর্ক, তা বাস্তব। এ কারণেই আজকাল আমরা আইডিয়ালিস্ট ফিকশনের ঠিক উল্টো হিসেবে, ম্যাটেরিয়ালিস্ট ফিকশনের পক্ষপাতী। তবে ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’কে আমরা এমন একটি প্রেমকাহিনি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম—যা গত বছর আপনি হয়তো পর্দায় যে আইডিয়ালিস্ট ‘প্রেমকাহিনি’ দেখেছেন, তার বিরোধিতা করবে।
গোরাঁ: বর্তমান আমেরিকান সিনেমা সম্পর্কে আমাদের অভিমত জানতে চাওয়া হয়েছিল। নিউইয়র্ক সম্পর্কে আমাদের কী অনুভূতি—এ যেন এমনতরই প্রশ্ন। আমরা দুটি (আমেরিকান) সিনেমা দেখেছি—‘দ্য নিউ সেঞ্চুরিয়ানস’ [রিচার্ড ফ্লিশার; ১৯৭২]—যেটি একটি নৈমত্তিক ফ্যাসিবাদী শ্বেতাঙ্গ সিনেমা; এবং ‘সুপারফ্লাই’ [গর্ডন পার্কস জুনিয়ার; ১৯৭২]—যেটি একটি নৈমত্তিক ফ্যাসিবাদী কৃষ্ণাঙ্গ সিনেমা। (সিনেমা দুটি দেখে) আমাদের আসলেই মৃত্যুভয় ধরে গিয়েছিল এবং সত্যি মুগ্ধ হয়েছি। আমেরিকায় থাকা, এবং স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে ‘সুপারফ্লাই’য়ের প্রতি একজন কৃষ্ণাঙ্গ দর্শক কিংবা ‘দ্য নিউ সেঞ্চুরিয়ানস’-এর প্রতি কোনো শ্বেতাঙ্গ দর্শক যে প্রতিক্রিয়া দেখান—তা দেখাটা বোধহয় বেশ আতঙ্কেরই। ফ্রান্স যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের একটি কলোনি, তাই আমাদের দেশে কী আসতে যাচ্ছে—তা নিয়ে আমরা আসলেই আতঙ্কগ্রস্ত।
ত্যু ভা বিয়াঁর সিনেমার একটি দৃশ্য
প্রসঙ্গ: ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’
গদার: ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’ থেকে আপনি কী শিখবেন, তা আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড ও জীবন-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। সিনেমার পর্দাকে আমরা একটি ব্ল্যাকবোর্ড, একটি সাদা ব্ল্যাকবোর্ড হিসেবে গণ্য করতে পছন্দ করি। এই ব্ল্যাকবোর্ডে আমরা তিনটি অনুষঙ্গ, তিনটি সামাজিক শক্তি জুড়ে দিয়েছি, যেগুলো তিনটি ‘নয়েজে’র প্রতিনিধিত্ব করে। ম্যানেজমেন্ট, মানে বসের ভয়েস; সিপি’র [ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টি] ভয়েস; এবং বামপন্থী ভয়েস—আমি অবশ্য এটিকে এ নামে নয়, বরং ‘দুরান্তের মানুষের কণ্ঠস্বর’ বলতে চাই। ফ্রান্সে বর্তমানে এই তিনটি সামাজিক শক্তিই কাজের ক্ষেত্রে কাজ করে। আমরা এই তিন নয়েজকে বেছে নিয়েছি বাস্তবতা থেকে। এগুলোকে উদ্ভাবন করিনি; বরং একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলায় সাজিয়ে নিয়েছি শুধু। সত্যি কথা বলতে, এই সিনেমা কেবলই একটি নিউজরিল। আমরা এখানে আসলে একদিক থেকে গত দুই বছরে ফ্রান্সে ঘটা ঘটনাবলিকে দেড় ঘণ্টায় সারসংক্ষেপ করেছি।
গোরাঁ: ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’ খুব সহজেই বানানো হয়েছে; যদিও এটি স্পষ্টভাষিত নয়। সুপারমার্কেট সিকুয়েন্সটিতে যা দেখানো হয়েছে, সেই ঘটনা আসলে বাস্তবেও ঘটেছিল। আমরা সুপারমার্কেট সিকুয়েন্সটির শুটিং করার এক সপ্তাহ আছে সিপি ঠিক ওই মার্কেটেই নিজের প্রোগ্রাম বিক্রি করেছিল। আমরা ওই সিকুয়েন্সের শুট করার তিন মাস আগে বামপন্থীরা ঠিক ওই ফ্যাশনেবল স্টোর লুট করে মালামাল প্যারিসের শহরতলিতে বিলিয়ে দিয়েছিল। অনুষঙ্গ এগুলোই। আমরা এই প্রথমবারের মতো একটি একেবারেই বাস্তবধর্মী সিনেমা বানিয়েছি। কিন্তু সেটি কোন ধরনের বাস্তববাদ, এবং তা আমরা কীভাবে অর্জন করলাম? আমরা একটি সুনির্দিষ্ট ‘ডিসরিয়ালাইজেশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি অর্জন করেছিলাম। এ কারণে এই সিনেমা এত বেশি থিয়েট্রিক্যাল মেটাফরে ভরা। সেদিক থেকে এটি একটি ভীষণ রকমের ব্রেশটধর্মী সিনেমা। বলা ভালো, এটি ‘সল্ট অব দ্য আর্থ’-এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার একটি পন্থা—সামাজিক দুষ্টপ্রকৃতি দেখানোর ক্ষেত্রে বেসিক ট্র্যাডিশনাল ফিল্মমেকারেরা ঠিক যেটির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চান। কিন্তু সহজ হয়ে ওঠা মানে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠা নয়। যেমন ধরুন, সারাক্ষণ যে ধরনের নয়েজ শুনি, সেগুলোকে একত্রিত করা আমাদের ওভারক্রাউডেড সাউন্ডট্র্যাকগুলোকে আমরা সোশ্যাল মিউজিকের প্রশ্নে টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণত যেগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হই—সেগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালিয়েছি।
পুরো সিনেমাটি বানানো হয়েছে স্ববিরোধিতা, অভিনয়ের স্ববিরোধী ট্র্যাডিশনের মাধ্যমে। সত্যিকারের তারকা আসলে জেন ফন্ডা ও ইভ্যে মোঁত্যঁ নন; বরং সেই বিশজন এক্সটা—যারা ফ্যাক্টরি সিকুয়েন্সটিতে শ্রমিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তারা অভিনয়ের এমন একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্য আবিষ্কার করেছিলেন, যেটি ফ্রান্সে ১৯৩০-এর দশকের জনপ্রিয় সিনেমায় গড়ে উঠেছে। আপনি তাই (এই সিনেমায়) একটি ছেলেকে (জ্যঁ) গ্যাবার মতো, একটি মেয়েকে আর্লেতির মতো অভিনয় করতে দেখবেন। একজন লোককে দেখবেন জ্যঁ ভিগোর প্রথম সিনেমাটির একটি চরিত্রের মতো অভিনয় করতে। বসের চরিত্রে অভিনয় করা লোকটির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। তিনি একজন ফিল্মমেকার এবং একজন ব্রেশটধর্মী অভিনেতা। তার কাছ থেকে বাড়তি কিছু নিংড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না। আমরা শুধু একটি জিনিসই দেখাতে চেয়েছিলাম, এই যে প্রতিদিন টেলিভিশনে যে ধরনের ভাষণ দেখি—তাতে নিক্সন অনেকটাই এই বস চরিত্রটির মতো অভিনয় করেন—তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। হুট করেই একটি সিনেমায় আপনি উপলব্ধি করবেন, আমরা আমজনতা আসলে ছাইপাশ গিলছি।
কলকার: ইভ্যে মোঁত্যঁ অভিনীত চরিত্রটিকে গদার বলে মনে হয় না?
গদার: আপনার মাথায় এখনো ‘অথর ফিল্মমেকার’ মিথটি রয়ে গেছে। আমি যেহেতু একজন তারকা, তাই লোকে সব সময়ই ইভ্যে মোঁত্যঁর মনোলগকে আমার বলে মনে করে। একজন ফিল্মমেকার হিসেবে আমার জীবনে আমি আসলে নিজেকে বরং জেন ফন্ডার মনোলগের সঙ্গেই বেশি সম্পৃক্ত মনে করি, যখন তিনি [চরিত্রটি] বলেন—পত্রিকার জন্য এ ধরনের আর কোনো ছাইপাশ লিখতে পারবেন না; এই বিবৃতি আসলে এসেছে সাংবাদিক হিসেবে জ্যঁ-পিয়েরের [গোরাঁ] জীবন থেকে।
‘ত্যু ভা বিয়াঁ’র ক্ষেত্রে অর্থলগ্নির প্রশ্নে জেন ফন্ডা ও ইভ্যে মোঁত্যঁ আমাদের জোরালভাবে সমর্থন দিয়েছেন। তাদের নাম আর আমার নাম—সব মিলিয়ে আড়াই লাখ ডলার উঠাতে পেরেছিলাম, যা কি না এ পর্যন্ত আমাদের জন্য সর্বোচ্চ বাজেট। ‘বৃহত্তর দর্শক’দের উদ্দেশ্য করে একটি সিনেমা বানাতে এ টাকার দরকার ছিলই আমাদের। কিন্তু ফ্রান্সে সিনেমাটির ডিস্ট্রিবিউশন করতে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি; আর এ কারণেই এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছি। (সিনেমাটি দেখানোর জন্য) অন্তত দশটি শহরে দশজন লোকের দেখা পাব আমরা।
লেটার টু জেন সিনেমার একটি দৃশ্য
প্রসঙ্গ: ‘লেটার টু জেন’
গোরাঁ: আমাদের জন্য এই সিনেমায় সম্ভবত ইন্টারেস্টিং দশটি মিনিট রয়েছে, যা রুশ বিপ্লবের একদম গোড়ার দিকে (লেভ) কুলেশভের বানানো একটি একেবারেই পুরনো নিরীক্ষার নির্যাস। আমাদের কাছে এটি ছিল ফ্রেমিং সম্পর্কে, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল সম্পর্কে, সিনেমা থেকে আজকের দিনে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে—এমনসব জিনিস সম্পর্কে প্রতিফলন ঘটানোর একটি পন্থা। আমরা সারাক্ষণই প্রশ্ন করছিলাম—জেনকে এবং নিজেদেরকেও। সেইসব প্রশ্নের কম-বেশি জবাব দিয়েছে ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’। জেনের উদ্দেশ্যে করা প্রশ্নগুলোর একটি ছিল: আপনি আমাদের সঙ্গে ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’ বানাতে ফ্রান্সে আসছেন; মাত্রই ‘ক্লুইট’-এর [অ্যালান জে. প্যাকুলা; ১৯৭১] কাজ শেষ করেছেন; ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’র পর আরেকটি ‘ক্লুইট’ বানাতে যাচ্ছেন; তা ছাড়া আপনি সম্ভবত হ্যানয়ে [ভিয়েতনাম] যাবেন। আরও অনেক ফিল্মমেকার ও মিডিয়ার লোকজনের মতো আমরাও অবাক হয়ে ভাবছি, আপনার ওপর হ্যানয়ে গিয়ে ‘ক্লুইট’ বানানোর নির্দেশ জারি হলে কেমন হবে। ‘ক্লুইট’ বানানোর জন্য হ্যানয় যাওয়া বোধহয় ভুল সিদ্ধান্তই। সেই সমস্যারই বোঝাপড়ার চেষ্টা আমরা করছি ‘লেটার টু জেন’-এ।
কলকার: জেন ফন্ডার জায়গায় অচেনা কারও ছবি বসিয়ে দেওয়া আপনাদের পক্ষে সম্ভব?
গদার: একদমই না। কোনো অপরিচিত আমেরিকানের কাছ থেকে ‘ভিয়েতনামে শান্তি চাই’ শোনার দরকার নেই নর্থ ভিয়েতনামিদের। তাদের বরং খুবই সুপরিচিত কাউকে দরকার; কেননা, নিক্সন কোনো অখ্যাত আমেরিকান নন। স্টার সিস্টেম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি আপনাকে নিজ জীবনে তারকা হিসেবেই ভাবেন। প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য ল্যাবে পাঠানো হলো—এটি সম্ভবত এমন ধরনের সিনেমা নয়; বরং প্রতিদিনই আপনি কিছু না কিছু গড়ে তুলছেন, আপনার নিজের মধ্যে নিজের জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম রয়েছে, আপনি হলেন আপনার নিজের কম্পিউটার, এক ধরনের মার্শমেলো মেশিন। প্রতিটি সকালেই নিজেকে ‘কোড’ করেন; নিজেকে প্রোগ্রাম ও কম্পিউটারাইজড করেন। আপনি আপনার নিজস্ব সিনেমায় নিজেই তারকা। একইসঙ্গে সেখানে আপনি একজন ফটোগ্রাফার, অভিনেতা, এক্সট্রা, ল্যাব... সবই।
কলকার: জেন ফন্ডার চেহারার এক্সপ্রেশন নিয়ে আপনি সমালোচনা করেন। এর বদলে তাকে দিয়ে আসলে কী করাতে চান?
গদার: হ্যানয় অংশের ডিরেক্টর আমি নই। আমাদের পক্ষে তাকে শুধু প্যারিসেই নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব। আমরা সাজিয়ে রেখেছি—এমন কিছুতে অভিনয় করার জন্য জেনকে ফ্রান্সে আসার আহ্বান জানিয়েছিলাম; সেই মঞ্চনাটকের শিরোনাম ছিল, ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’। দুই মাস পরে নর্থ ভিয়েতনামিরা তাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে গিয়ে তার জন্য প্রস্তুত রাখা নাটকে অভিনয়ের জন্য; সেটির শিরোনাম ছিল, ‘ভিক্টরি ওভার আমেরিকা’। ‘লেটার টু জেন’-এ ছবি আছে দুটি: পুরনো জেন ফোন্ডার এবং নতুন জেন ফোন্ডার। সেই পুরনো ও নতুনের মধ্যে পার্থক্যগুলো দেখার দরকার ছিলই আমাদের। কেননা, ভিন্নতার প্রতিই আমরা কৌতুহলী। পুরনো ও নতুন ছবি একসঙ্গে রেখে দেখেছি, দুটোর মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। এটি একটি নান্দনিকতা, এটি একটি সিনেমা—যা রাজনৈতিক ক্যাটাগরি হিসেবে নান্দনিকতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায়। আমরা রাজনীতি নিয়ে আর কথা বলতে চাই না; বরং নান্দনিকতাই আমাদের পছন্দের বিষয়। আমরা শুধু এক ধরনের এক্সপ্রেশনের প্রতি আগ্রহী। আমি যদি ভিয়েতনামে থাকতাম, ভিয়েতনামি কোনো মৃত শিশুকে খুঁজতাম, তাহলে আমার চেহারায়ও সেই একই ধরনের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠত—যেমনটা দেখা যেত নিক্সন ও জন ওয়েনের চেহারায়।
আজকের দিনে দেখার ক্ষমতা একেবারেই হারিয়ে গেছে—এ কথা আমরা ভীষণভাবে অনুভব করি। আমরা শুধুই পড়ি; ইমেজকে কিছুতেই দেখি না একদম। জিগা ভের্তভ বলেছিলেন, দুনিয়া কীভাবে দেখতে হয়—সেটি মানুষকে শেখানোর জন্য দুনিয়াকে আবার নতুন করে দেখতে হবে আমাদের। তিনি বলেছিলেন, দুনিয়াকে আমাদের দেখতে হবে সর্বহারা বিপ্লবের দোহাইয়ে। আজকের দিনে এসে সেভাবে দেখা উচিত নয় আমাদের। ‘প্রলেতারিয়ান রেভুলুশন’ বা ‘সর্বহারা বিপ্লব’ টার্মটি আমাদের দেশে এত বেশি ভুল প্রয়োগ হয়েছে, যে, বরং বলতে পছন্দ করি, আমরা নন্দনতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী। নতুন কনটেন্টের সঙ্গে মানানসই—এমন একটি নতুন ফর্ম উদ্ভাবনের, অন্বেষণের চেষ্টা চালাচ্ছি আমরা। কিন্তু নতুন কনটেন্ট ও নতুন ফর্ম বলতে আপনাকে সেই পুরনো সম্পর্কের ব্যাপারে ভাবতে হবে, যেটি নিয়ে এখনো আমরা ফর্ম ও কনটেন্টের বোঝাপড়া করছি।
আমরা সংযোগ তৈরি করতে চাই। এখন প্রশ্ন হলো, কীসের সঙ্গে যোগাযোগস্থাপন করতে চাই, কীসের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা আমাদের জন্য আবশ্যক, কোনো একটি যোগাযোগস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের অর্জন কী? দুটি স্টিল ছবির মাধ্যমে একটি সিনেমা বানানোর মধ্য দিয়ে আমাদের পক্ষে মিলিয়ন-ডলার বাজেটের কোনো সিনেমার সঙ্গে বোঝাপড়া করা সম্ভব। বহু বছর ধরে আমাদের বলা হয়েছে, সামান্য কয়েকটি জিনিস দিয়েই, যেমন স্রেফ দুই-তিনটি স্টিল ও একটি ক্যাসেট সম্বল করে সিনেমা বানানো সম্ভব। ফলে ভেবেছিলাম, ভিয়েতনাম যুদ্ধকে দেখিয়ে, জেনকে দেখিয়ে নর্থ ভিয়েতনামিদের দেখিয়ে, এসব ব্যাপারে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে দেখিয়ে একটি ফিচার দৈর্ঘ্যরে ফিল্ম যে বানানো সম্ভব, সেটি আমাদের জন্য একটি ভালো সুযোগ। এটি একদিনেই করা হয়েছে, যদিও স্ক্রিপ্ট লিখতে লেগে গিয়েছিল দুই সপ্তাহ; তবে শুটিং করা হয়েছে মাত্র একদিনে, আর এডিটিংয়ের জন্য লেগেছে আরও একদিন, প্রসেসিংয়ের জন্য আরও একদিন, আর টাকা উঠে এসেছে একদিনেই। ছবিটি বানতে খরচ পড়েছে ৫০০ ডলার; আর এখান [যুক্তরাষ্ট্র] থেকে আমরা পেয়েছি ১০০০ ডলার।
গোরাঁ: এটি ব্যাপকভাবে একটি বাণিজ্যিক ছবি! এর ডিস্ট্রিবিউশন করেছি আমরাই। ফিলিস্তিনে আমরা ফিল্মটির শুটিং করেছি দুই বছর আগে। সেখানে একজন চিকিৎসকের দেখা পেয়েছিলাম, জর্ডানের দক্ষিণাঞ্চলের লোক, যিনি স্টিল পিকচার দিয়ে ফিল্ম বানাচ্ছিলেন। প্রতি সপ্তাহেই তার কাছে আম্মান থেকে, এল ফাতে থেকে কিছু স্টিল আসে। তিনি সেগুলো এডিট করেন, সেগুলোতে ব্ল্যাক স্পেস যোগ করেন, আর লোকজনের সামনে সেগুলো সম্পর্কে নিজের বিবৃতি তৈরি করেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ফিল্মমেকার। আমরাও সেই সুযোগ পেয়েছি।
একটি স্টিল দিয়ে বানানো এক ফিল্মের দিকে তাকিয়ে আমরা এক ঘণ্টা ব্যয় করেছি, যেটির জন্য সাধারণত দুই সেকেন্ডেই যথেষ্ট। আমার ধারণা, ওই স্টিলের দিকে তাকিয়ে দশ ঘণ্টাও কাটিয়ে দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব। ওই স্টিলের দিকে দুই সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে লাখও জিনিসের দেখা পাওয়া সম্ভব। মিডিয়া, তথ্য—এসব খুবই কাজের। এ আপনাকে এমন এক রাস্তায় ঠেলে দেবে, যে রাস্তা আপনার জীবনের, যে রাস্তা আমার জীবনের। এমন এক দুনিয়ায় বাস করি, যেখানে এক সেকেন্ডেই আমি হাজারও সাউন্ড ও ইমেজের বিষয়বস্তু। এটা কীভাবে কাজ করে, আমি তা দেখতে চাই। ‘লেটার টু জেন’-এ এই প্রশ্নকেই জোরাল করে তোলা হয়েছে। একটি বিজ্ঞাপনের ওপর বানানো এক সিনেমার কাজ করতে গিয়ে সময় ব্যয় করতে আমি সক্ষম।
গদার: ...একটি এক ডলার বিলের...
গোরাঁ: লোকে বলে, সিনেমা হলো আবেগ কিংবা আবেগাত্মক সম্পৃক্ততা। কোন ধরনের আবেগাত্মক সম্পৃক্ততা? সিনেমা-হলের পর্দায় আপনি আচমকাই এমন কাউকে দেখতে পাবেন, যে সেই একই ধরনের ধাঁধায় পড়ে গেছে, যেমনটা পড়ে থাকেন আপনি নিজে সব সময়। আমরা বিষয়বস্তুগত হয়ে পড়েছি—এমন বাস্তবতা থেকে স্বাভাবিক সংযোগগুলোকে কেটে দেওয়ার একটি উপায় হলো সিনেমা। এখানে কোনো ইমেজ কিংবা সাউন্ডের চেয়ে বিমূর্ত কিছু আর নেই; তবে এই বিমূর্ততার আবির্ভাব ঘটে একটি নির্দিষ্ট বাস্তবতা থেকে, এবং এই বিমূর্ততা হয়তো আপনাকে নিজের বাস্তবতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ কারণেই আমরা এমনসব সিনেমা বানাই, যেন দর্শক সেই বাস্তবতার কাছে ফিরে যান, এবং সিনেমাটিকে দেখেন যেন সিনেমাটি থেকে দুই-তিনটি অনুষঙ্গ সংগ্রহ করে সেগুলোকে নিজ জীবনের বোঝাপড়ায় কাজে লাগাতে পারেন। এ হলো ফিডব্যাক ইফেক্ট।
প্রসঙ্গ: ভিডিওটেপ
কলকার: ভিডিওটেপে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনার?
গোরাঁ: এটা আমাদের গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা লোকদের ভিডিও নিয়ে রোমাঞ্চিত হতে দেখেছি। আমরা জোরালভাবে মনে করি, ফিল্মের সঙ্গে ভিডিওর কোনো লেনদেন নেই। এটি একেবারেই সুনির্দিষ্ট জিনিস; এবং সেই সুনির্দিষ্টতা সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। এই মুহূর্তে যারা ভিডিও ব্যবহার করছেন, তারা আসলে ফিল্মমেকিংয়ের জঘন্য জিনিসপত্র জাহির করছেন। এই যে (সামনে থাকা) এই লোক এই মুহূর্তে আমাকে ভিডিও করছেন; আমার ধারণা, তার কাছে একটি বড় ধরনের ‘সিবিএস’ [টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং কোম্পানি; যুক্তরাষ্ট্র] ট্রিপ রয়েছে, এর বেশি কিছু নয়। তিনি একটি সিবিএস মুভি বানাচ্ছেন। তার ধারণা, কেউ যখন কথা বলে, তাকে ক্যামেরাবন্দি করা উচিত তার।
কলকার: আপনার কী অভিমত, গদার?
গদার: থামুন!
কলকার: আমাদের ধারণা, লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে ভিডিও টেপ ব্যবহার করতে পারব আমরা।
গদার: কোন ব্যাপারে যোগাযোগ স্থাপনে? কোন ধরনের তথ্য দিতে? দোহাই লাগে, স্বয়ং তথ্য নিয়ে কথা বলতে পারব না আমরা! জেন ফন্ডার যে স্টিল দেখিয়েছি, তাতে আমরা একটি প্রক্রিয়ায় দেখতে পাই, সেখানে কী তথ্য রয়েছে। তথ্য কত সস্তা ও দামি—এ দুটোর মধ্যে এখানে একটি জোরাল সম্পর্ক রয়েছে। এটি সাইবারনেটিকস। মুভি টার্মে অন্যগুলোর তুলনায় ভিডিওতে কাজ করার পক্ষে আপনার কাছে উপায় রয়েছে খুব সামান্যই; আর আপনার খেয়াল রাখা উচিত, টিভি টার্মের তুলনায়, লাখ লাখ টিভি সেটের মধ্যকার সম্পর্কের তুলনায় মুভি টার্ম খুবই সুনির্দিষ্ট। ক্লাউড শ্যানন নামে আমেরিকান একজন বিজ্ঞানী ৩০ বছর আগে তথ্য সম্পর্কে সার্বিক ধারণা জাহির করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই হলো একটি ট্রান্সমিটার ও একটি চ্যানেল, এবং তারপর আরেকটি ট্রান্সমিটার ও তারপর একটি রিসিভার। চ্যানেল প্রশ্নে উদাহরণস্বরূপ একটি ক্যাবলের কথা যদি ধরি, সেখানে নয়েজ রয়েছে। নয়েজটির ব্যাপারে আমরা অবগত। ফিল্মমেকার হিসেবে আমাদের কাছে নয়েজ স্রেফ কোনো কারিগরি বিষয় নয়; বরং এটি সমাজসংক্রান্ত জিনিস। ২০ বছর ধরে নর্থ ভিয়েতনাম থেকে যে সোশ্যাল নয়েজ আসছে, সেটি এখানে, আপনার নিজের জীবনে রিসিভ করার পন্থায় পাল্টে যাচ্ছে। এটি আলাদারূপে চ্যানেলকৃত হচ্ছে।
গোরাঁ: আমরা একটি ইন্টারেস্টিং ভিডিওটেপ দেখেছি। নিউইয়র্কের একটি লোয়ার ইস্ট সাইড স্কুলে এটি বানিয়েছেন আমাদেরই এক বন্ধু। ভিডিওটেপের নাম, ‘দ্য ভিজিট অব দ্য চায়নিজ পিং-পং টিম টু নিউইয়র্ক’। এই লোক সনি ইক্যুপমেন্ট তুলে দিয়েছিলেন শিশুদের হাতে। ওরা অনেক উঁচুতে ছিল বলে ভিডিওতে আপনি শুধু ওদের প্যান্টগুলো দেখতে পাবেন। ‘সিবিএস’, ‘এনবিসি’—সব মিডিয়াই ছিল সেখানে। সাউন্ডট্র্যাকে আপনি লোকজনকে বলতে শুনবেন, ‘ওই শিশুগুলো পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে কেন?’ এই হলো মিডিয়া।
গদার: এই ভিডিওর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জিনিস সম্ভবত, ক্যামেরাটি আপনি খুব সহজেই বশে রাখতে পারবেন। তবে আপনি যদি একে খুবই আলতো করে ধরে রাখেন, তাহলে আপনার হাত থেকেও খুব সহজেই পড়ে যেতে পারে; তাই সাবধান।
ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল নিয়ে জ্যঁ-লুক গদার
প্রসঙ্গ: ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল
গোরাঁ: আমরা নির্দিষ্ট ফর্মগুলো কেন ব্যবহার করছি, এর কারণ জানা নেই কারও। জিগা ভের্তভ যেখানে অনেকটাই অখ্যাত, সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কেন তার নাম নিচ্ছি? আইজেনস্টেইনের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন তিনি। যেমন ধরুন, আইজেনস্টেইন নিজেকে মন্তাজের উদ্ভাবক মনে করতেন; অথচ তিনি আসলে উদ্ভাবন করছিলেন ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল। একই সময়ে ভের্তভ উদ্ভাবন করছিলেন এডিটিং। তারা ঘটনাচক্রে মন্তাজ ও এডিটিং উদ্ভাবন করছিলেন না। এগুলো উদ্ভাবন করেছিলেন; কেননা, তারা কিছু একটার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন—যা ছিল সামাজিক হাঙ্গামা, যা ছিল রুশ বিপ্লব। গ্রিফিথের তথাকথিত উদ্ভাবনগুলো, যেমন ধরুন ক্লোজআপ—এ ছিল বাস্তবের প্রতি কেবলই একটি ভীষণ রকমের প্রচলিত, মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগাত্মক মনোভাব। সেদিক থেকে এ আদৌ কোনো উদ্ভাবন নয়। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের ধারণা সিনেমা থেকে পুরোদস্তুর উধাও হয়ে গেছে। আমাদের কাছে আছে শুধুই ক্যামেরা পজিশন; ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল নয়। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল হলো সত্যিকার অর্থেই বাস্তবতার প্রতি (ফিরে তাকানোর) একটি কাট।
গদার: অ্যাঙ্গেল হলো চৌরাস্তার মতো। এটি একটি পয়েন্ট। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের কথা আপনি ভাবেন শুধুই একটি ওপেনিংয়ের প্রশ্নে। সূচনা ঘটানোর জন্য আপনাকে একটি সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে, একটি চৌরাস্তায় হাজির হতেই হবে। তারপর একটি নতুন রাস্তা বেছে নিতে হবে। বিষয়টিকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে তুলনামূলক সহজ: ধরুন একটি স্রোত, একটি অভিমুখ রয়েছে। ওই স্রোতের একটি পয়েন্টে আপনাকে থামতে হবে; কেননা, আপনি ক্লান্ত। আপনি অভিমুখ পাল্টে ফেলতে চান। অ্যাঙ্গেল হলো বাস্তবতার প্রতি একটি কাট; ঠিক যেন সাগরে কোনো নৌকার মতো। সমাজের প্রশ্নে, একটি বিপ্লব মানে হলো বাস্তবতার দিকে ধাবিত হওয়ার একটি নতুন কাট তৈরি করা, একটি নতুন রাস্তা বের করা। বলশেভিক বিপ্লবটি জীবনকে গোছানোর একটি নতুন অ্যাঙ্গেল, একটি নতুন রাস্তার উদ্ভাবন করেছিল।
গ্রিফিথের ইতিহাস পাঠ করে আমরা দেখতে পাই, তিনি যখন ক্লোজআপ উদ্ভাবন করছিলেন, তখন আসলে নতুন কিছুর সন্ধানরত ছিলেন। যে মেয়ের প্রতি তার মুগ্ধতা, সেই মেয়ের কাছাকাছি পৌঁছানোর কিংবা এ রকম কিছু করার মতো ব্যাপার ছিল না এটি; বরং এর কারণ, লুমিয়্যেরের ১৫ বছর পর বাস্তবতায় পৌঁছানোর ‘কাট’ খুঁজে নেওয়ার একটি রাস্তা দরকার ছিলই তার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু কোনো বিপ্লব হয়নি, তাই তিনি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আসলে একজন প্রতিক্রিয়াশীল। তার পক্ষে ক্যামেরা পজিশনের কোনো পরিবর্তন উদ্ভাবন করাই শুধু সম্ভব। এডিটিং দরকার ছিলই তার। কেননা, ক্যামেরা পজিশনের পরিবর্তন উদ্ভাবনের পর তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তার কাছে একটি শটের বদলে আসলে শট রয়েছে দুটি। এই শট দুটিকে একত্রিত করার দরকার ছিলই তার। তবে তার এডিটিং ছিল শুধুই সমান্তরাল; দুটি অ্যাকশনকে একইসঙ্গে করার ব্যাপার। সমান্তরাল আর চৌরাস্তা এক জিনিস নয়; সমান্তরালে একটি রেখা অন্যটিকে ছেদ করে যায় না, সেখানে কোনো অ্যাঙ্গেল থাকে না।
আইজেনস্টেইন এডিটিং নিয়ে কাজ করেননি; তিনি স্রেফ একটি অ্যাঙ্গেলের সঙ্গে আরেকটি জুড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে, ভের্তভ আসলেই এডিটিং নিয়ে কাজ করেছেন—সেটিকে সমান্তরাল বা প্যারালাল না বলে বরং পারপেনডিকুলার এডিটিং, চৌরাস্তা বা ক্রসরোড, বাস্তবের টুকরোগুলোর পরস্পর ছেদ করে যাওয়া বলাই শ্রেয়। দুটি ইমেজ পরস্পর ছেদ করে যাচ্ছে পরস্পরকে অনুসরণ করতে নয়; বরং তৃতীয় একটি ইমেজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বলশেভিক বিপ্লবের অসুবিধার কারণে, এবং রাশিয়ায় যা কিছু ঘটতে দেখেছি আমরা—সেইসব বিচারে, ভের্তভ ও আইজেনস্টেইন ছিলেন পরস্পর বিপরীত। ভের্তভ সেই জিনিসের প্রশংসা করেছেন, যেটিকে নিজে ‘ক্যামেরা আই’ [ক্যামেরার চোখ] বলে ডাকতেন; আইজেনস্টেইন সেই জিনিসের প্রশংসা করেছেন, যেটিকে নিজে ‘ক্যামেরা ফিস্ট’ [ক্যামেরার মুষ্ঠি] বলে ডাকতেন। একটি অপরটির গুরুত্বকে অস্বীকার করে। চার বছর আগেও পাশ্চাত্যে আইজেনস্টেইনের সুনাম বেশ উঁচুতে ছিল; ফলে ভের্তভকে সেই উঁচুতে জায়গা করে দেওয়ার জন্য আমাদের ভীষণ গোঁড়ামি করতেই হয়েছে। এখন আমরা দেখতে পাই, বাস্তবে এই দুজন আসলে ছিলেন একজন অভিন্ন মানুষেরই দুটি হাতের সমতুল্য। কিন্তু তাদের শরীরটাকে কেটে ফেলা হয়েছে; ফলে হাত দুটি কখনোই একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না।
গোরাঁ: আপনার কাছে ব্যাপারটা হয়তো খুবই বিমূর্ত লাগবে, তবে আমাদের কাছে এটি প্রাত্যহিক প্রশ্নের নামান্তর। চার বছর ধরে আমরা ধৈর্যশীল থাকার, ধীরে আগানোর সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম শুধুই স্টেশনারি শট নিয়ে, ফ্ল্যাট ফিল্ম বানানোর, এবং সাদা পর্দাকে একটি ব্ল্যাকবোর্ড, একটি হোয়াইট বোর্ড হিসেবে জাহিরের প্রচেষ্টার ব্যাপারে। ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’য় আমরা প্রথমবারের মতো সক্ষম হয়েছিলাম কোনো ট্র্যাকিং শট ব্যবহার করতে। ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’ মাত্র দুটি ফর্ম ব্যবহার করে নির্মিত: স্টেশনারি শট ও ট্র্যাকিং শট। এই সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে কেন ট্র্যাকিং শট ব্যবহার করেছি—সে ব্যাপারে আমাদের ধারণা একেবারেই সুস্পষ্ট। আমাদের পক্ষে নিজেদের সিনেমাগুলো নিয়ে কথা বলা সম্ভব এবং এগুলো কীভাবে বানানো হয়েছে, ‘ওই’ ইমেজ কেন ব্যবহার করেছি, ‘ওটা’ কেন ‘ওভাবে’ ফ্রেম করেছি, ‘এই’ ফর্মের পর ‘ওই’ ফর্ম কেন, কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছি—সেই ব্যাখ্যাও দিতে পারব। এগুলো বেসিক, বাস্তবিক প্রশ্ন। তিন বছর ফ্ল্যাট ফিল্ম বানানোর চেষ্টা চালানোর পরে আমরা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল নিয়ে কাজ শুরু করছি। এ কারণেই এ প্রসঙ্গে কথা বলছি আমরা।
গদার: শ্রমিকদের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা কতটুকু—এই প্রথমবার আমরা এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। মে-জুন ইভেন্টগুলোর সময়ে যদি কোনো সিনেমা বানাতাম, তাহলে তাতে সাধারণত মানুষের সঙ্গে, তথাকথিত গণমানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা ঘটত, যা গিয়ে দাঁড়াত শূন্যে ফেরার, ফিল্মমেকিংয়ের একেবারেই শূন্যবিন্দুতে পৌঁছানোর ঘটনা: কোনো প্যান নেই, কোনো ট্র্যাক নেই, কিংবা জুম নেই একদমই—যা আমি বহুবার করেছি, এবং আমার ধারণা অন্য অনেকের চেয়ে বেশ ভালোভাবেই করেছি। এইসব টেকনিক আমাকে আর আনন্দ দিচ্ছিল না। কেননা, বুঝে গিয়েছিলাম, এগুলো বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্কেরই ইঙ্গিত করে না। ফলে স্টিডি পজিশনের কাছে, মিডিয়াম ও স্টিডি শটের কাছে ফেরার বাধ্যবাধকতা অনুভব করলাম আমি। কেননা, ছুটির দিনে পারিবারিক ছবি তোলার সময় সাধারণ মানুষ যেরকম ইনস্টাম্যাটিক শট নেয়, এটা সেরকমই। এখন আমরা বুঝতে পেরেছি, এইসব সাধারণ মানুষ, এইসব বাস্তব মানুষ আসলে চলমান; তারা যে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, সেই দেয়ালের বিরুদ্ধে, সেইসব মনিবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নতুন ফর্ম উদ্ভাবন করে নিচ্ছে; হোক তারা শ্রমিক, শত শত নারী, কিংবা কোনো আমেরিকান—তারা সবাই একেকজন ভিয়েতনামিই আসলে। তাই স্টিডি শট ব্যবহার করা আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। ট্র্যাকিং শট নেওয়ার একটি নতুন টেকনিক আমাদের উদ্ভাবন করতেই হবে, এমনকি টেকনিক্যালি দেখতে তা এক রকম মনে হলেও। কিন্তু আমরা যেহেতু মার্কসবাদী কিংবা মাওবাদী, আমাদের জন্য দৈবক্রমে নয়, বরং সামাজিক অস্ত্র হিসেবেই টেকনিক ব্যবহার করা উচিত। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার ‘অ্যাঙ্গেল’ দরকার। এরপর আবিষ্কার করলাম, অ্যাঙ্গেল কাকে বলে—জানা নেই আমার। আমি যতটা করেছি, জ্যঁ পিয়েরে নিজের প্রয়োজনীয় অ্যাঙ্গেল আবিষ্কার করেছেন তারচেয়েও বেশি; কেননা, তিনি আমার চেয়ে বেশি তরুণ ও বেশি নিপীড়িত।
‘ত্যু ভা বিয়াঁ’য় ট্র্যাকিং শট মাত্র তিনটি—বস নয়েজ, সিপি নয়েজ ও বামপন্থী নয়েজ। এই তিন নয়েজের ব্যাকগ্রাউন্ডের সমান্তরালে কাজ করে—এমন একটি ট্র্যাকিং শটের দরকার ছিলই আমাদের। এগুলো একসঙ্গে মিশে গেছে; আর এভাবেই তৈরি হয়েছে আজকের দিনের ফ্রান্স। ফলে সামাজিক মন্দের দিকে তাকানোর জন্য একটি ট্র্যাকিং শট রেখেছি আমরা। সিনেমাটির শুরুতে আমরা এমন একটি কারখানায় রয়েছি, যেখানে মালামাল উৎপাদন হয়। সিনেমাটির সমাপ্তিতে আমরা রয়েছি একটি সুপারমার্কেটে, যেখানে মালামাল বিক্রি হয়। আসলে পুরো সিনেমাটিকে স্পেস নয়, বরং একটি ট্র্যাকিং শট হিসেবে গণ্য করা সম্ভব। এর সূচনা ঘটে মালামাল উৎপাদনের মধ্য দিয়ে, আর সমাপ্তি ঘটে মালামাল খরচের মধ্য দিয়ে। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে মিডিয়া, ডিস্ট্রিবিউশন। পত্রিকার এক নারী, একজন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেন, যে আইডিয়া বিক্রি করে। ইভ্যে অভিনয় করেছেন একজন বিজ্ঞাপনী সংস্থার লোক হিসেবে, যার কাজ মালামাল সরাসরি বিক্রি করা। সিনেমাটির সমাপ্তি অংশে দেখা মেলা সর্বশেষ ট্র্যাকিং শটটি আসলে পুরো বিষয়টির সারসংক্ষেপ। এ বেলা আপনি আরও দূর থেকে সেই তিনটি নয়েজ শুনতে পাবেন, আর শুনবেন মিউজিক: সে সময়ে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত এক বিরাট প্যারেডের। ওই কথাগুলো সম্ভবত (জর্জ) পম্পিদুর মতো কারও লেখা; সুরটা সম্ভবত নিক্সন ও (স্পিরো) অ্যাগনিউর মতো কারও।
গোরাঁ: সমস্যাটি আশাবাদী কিংবা নৈরাশ্যবাদী হওয়ার নয়। ‘ত্যু ভা বিয়াঁ’ একটি আনন্দমুখর ও শ্লেষাত্মক সিনেমা। আর এই সিনেমার তা-ই আমাদের পছন্দ। সিনেমা কেন বানাচ্ছি— জানি আমরা। সিনেমা বানাই যেন সেগুলো অন্য সিনেমাগুলোকে বানিয়ে তুলতে পারে। ফলে প্যারামাউন্টের [স্টুডিও] সঙ্গে আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই। পার্থক্য খুবই সামান্য। তারা বলে, ‘আমরা একটি সিনেমা বানাব যেন সেটি ঠিক এ রকমই আরেকটি সিনেমা বানিয়ে তুলতে পারে।’ আর আমরা বলি, আমরা একটি সিনেমা বানাব যেন সেটি ভিন্ন আরেকটি সিনেমা বানিয়ে তুলতে পারে। তার মানে, আমাদের পরের সিনেমাটি হতে যাচ্ছে ভিন্ন কিছু।
বেশ পরিশীলিত মনে হয়েছে । অনলাইন এ হঠাৎ চোখে পড়লো । এই পোর্টাল এর সম্পাদক এর নাম কি ? লেখক দের কি সম্মানী দেয়া হয় ?
মোস্তাকিম স্বাধীন
মার্চ ১৫, ২০২৩ ১৬:১২