আত্মবাদের পর

অ+ অ-

 

বাইরে প্রায়ান্ধকারে খাপছাড়া রোদ এসেছিল, রবিবারে যেদিন মাথার ভেতর সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল কেননা, এমন কথা বলা হয়েছিলখোঁজো, তবেই তো কিছু! তখনও জীবনের গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে নিয়মিত বেতন না-পাওয়া চাকরি, গত মাসের বাড়িভাড়ার তলায় রাখা মুদি দোকানের জিনিসপাতির তালিকা দ্ব্যার্থকভাবেই প্রায় অর্থহীন জীবনে চাওয়ার জন্য কিছু একটা হয়তো-বা জরুরি হয়ে পড়েছিল, যার বিশেষ মানে আছে সেটা কী হতে পারেভাবতে ভাবতে সন্ধানী মনে পাতলা ঠোঁট চুমুক দেয় বরফসমেত লেবুর শরবতে শরীর-মন সতেজ হয় দু-তিন ঢোঁকে  

সে হয় মালিয়া লেবুর খোসা বিনে ফেলতে গিয়ে মায়ের গলা শোনে। এক তরফা বলেই যাচ্ছেনএই পর্যন্তও ওর আসার কথা না... এইসব চাকরি... তারপর ব্যাংক থেকে পার্সোনাল লোন পাওয়া এতো সহজ না! খোসা ফেলে দিয়ে টেবিলের ওপর ঢেকে রাখা লেবুর দুই টুকরা হাতে নেয় মালিয়া ডেঙ্গু জ্বরের নীরব মহামারি চলছে দোকানে গিয়ে সে অডোমস পায়নি লেবুর ঝাঁঝালো গন্ধ নাকি প্রাকৃতিক রিপিলেন্ট হিসেবে মশা দূর করে প্রতিদিন ডেঙ্গু জ্বরে অন্তত ২০ জন করে মরছে কিন্তু সবার এমন এক ভঙ্গি যেন কোথাও কিছু হয়নি বেশিরভাগ মানুষ মনে করে ডেঙ্গু-আক্রান্তরা যেসব বিপর্যয় অতিক্রম করছে, সেসব থেকে তারা অনেকটাই দূরে কাজেই বারান্দার টবের পানির দিকে নজর রাখা আর ঘরের ভেতর বোতলের পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানিপ্ল্যান্টগুলো সরিয়ে ফেলাই তাদের কাছে যথেষ্ট সচেতনা অথচ দূরত্ব অনেক হলেই সেটা নিরাপত্তা দেবে এমন কোনো কথা নেই লেবুর টুকরা বিছানার কাছে রেখে হয়তো নির্বিঘ্নে ঘুমানো যাবেএমনই মনে হয় মালিয়ার বছর দুয়েক হলো ওর টানা ঘুম উধাওতিন-চার ঘণ্টা বড়জোর ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে ওই ছেঁড়াখোঁড়া তন্দ্রায় রাত কিছুটা বয়ে যায় ধীরে ধীরে প্যালপিটিশানও স্বাভাবিক হয়ে আসে কখনো আবার কাটেও না ওই রাত থমকে দাঁড়ায় তখন চোখ বুজে অগাধ ঘুম খোঁজে মালিয়া অঘুমের সেই সময়ে লেবুর গন্ধ মশা তাড়ানোর পাশাপাশি উদ্বেগ-ক্লান্তি শুষে নিতে পারে  

কোনো লক্ষণ ছিল না, আধ-শোওয়া হয়ে মালিয়ার মা আরেকদিন পাশের বাসার ভাবিকে বলেছিলেন, টিভি-সিরিয়াল থেকে চোখ না সরিয়ে, ছোটোবেলায়ও চুপচাপ-শান্ত ছিল কিন্তু এখন কেমন জানি একদিকে তাকায় থাকে তো থাকেই! মনে হয় যেন ভূতে ধরছে! বহুকাল আগে খাটের ওপর মালিয়ার হাতে পুরনো খবরের কাগজ ধরিয়ে দিয়ে তিনি রান্নাঘরে যেতেন নিশ্চিন্ত মনে চুলা নিভিয়ে, চচ্চড়ি বাটিতে বেড়ে, ভাতের পাতিল ঠিকায় দিয়ে, ফিরে এসে দেখতেন বাচ্চাটা একমনে চুপচাপ খবরের কাগজ ছিঁড়েই যাচ্ছে ক্ষুধা নেই, কান্নাকাটি নেই রান্নার পুরো সময় জুড়ে মালিয়ার কাগজ ছেঁড়া কাগজের টুকরাগুলো ফেলে দিয়ে সাবান ডোলে মালিয়াকে গোসল করাতেন। সারা গায়ে বুলিয়ে দিতো পাউডারের নরম পাফ ঘরেই কাজল তুলতেন দিনভর সলতে বেয়ে আগুনশিখার কালো ধোঁয়া জমতো পিতলের কাজলদানিতে পাতলা কাজলে আঙুল ছুঁইয়ে মেয়ের চোখে কাজল পরিয়ে তর্জনির ডগাটা মুছে নিতেন সিঁথির ডানপাশে চুল বরাবর বহুদিন পর মালিয়া অভিধানে দেখেছিল কাজলের আরেক নাম অঞ্জন শুনেছিলতোমার চোখ তো  সুন্দর না কাজল মানায় না। সেদিনই সংসদ বাংলা অভিধানের পাতা উল্টে, কী আশ্চর্য, কাজল শব্দটাই চোখে ঠেকেছিল আর মালিয়া ভেবেছিল কালিমা মালিন্য না দিয়ে বরং চোখের উজ্জ্বলতা বাড়ায় আর এভাবেই প্রসাধনী হয়ে যায়!   

ভাতের পাতে মাছের কাঁটা বেছে মালিয়ার গালের ভেতর একেক নলা বুড়া আঙুলে আলতো করে ঠেলে দিতেন তিনিযেমনটা সব মা- করে প্রতিবার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দেওয়ার সময় তার নিজের মুখটাও হাঁ ওই হাঁ ছিল এক নীরব ইনডিকেটর যা দেখে মালিয়ার ছোট্ট মুখটা একইভাবে খুলে যেতো পরীক্ষার খাতায়, এইট-নাইন-টেনে, বেশির ভাগ সময় পাঁচটি উত্তরের বদলে তিনটি কিংবা তিনটি লিখতে বললে পাঁচটি লিখে, কান ডলতে ডলতে আর হাতে পাহাড়ি বেতের ফুলে ওঠা লালচে ছোপছাপ নিয়ে মালিয়ার বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে যায় কলেজে পা রেখে অনেকটা ফুরফুরে, অনেকটাই আর্দ্র সবই নতুন লাগে মালিয়ার গরমে ঝিমধরা দীর্ঘদুপুর। চাইনিজ নিউজপ্রিন্টের সেলাই করা খাতার ওপর জাবেদা আর রেওয়ামিলের দাগ টানতে টানতে ওর মনে পড়ে যায় রাবণ আপার কপালে উঁচু করে আঁকা দুই ভুরুর কথা লঙ্কাধিপতি ভীষণ-এক-রাক্ষস যে আদপে মানুষপিতা এবং পুত্রদুঃখে দুখীএই সত্য জেনে রাবণের সঙ্গে মালিয়াও কাঁদে গাল গড়িয়ে এক ফোঁটা পড়ে জাবেদার এন্ট্রির ওপর ক্রেডিট করা টাকা লেপ্টে গেলে সংখ্যাটা ছড়িয়ে যায়। আর বোঝা যায় না মালিয়ার হিসাবে বারবার ভুল তো হওয়ারই কথা

মধ্যত্রিশে এসে দেখা গেলো, ধীরগতি হলেও, মালিয়ার যতোটা সামর্থ্য সেটার গ্রহণযোগ্যতা আছে কিছুটা ভালোভাবে থাকা যায় তবুও, জীবন এমনইবাথরুমে কল সারাইয়ের পর বাল্বের ফিউজ কেটে যায় কিংবা টোম্যাটোর সস আনতে নুডলস ফুরায় আর এসব দুরবস্থা তিক্ততা বাড়ায় অথচ সোনায় মোড়া আইসক্রিমের দাম ৯৯ হাজার ৯৯৯টাকা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ২৪ ক্যারেটের এই সোনা খাওয়ার যোগ্য মালিয়া ভাবে শহরের সবচেয়ে দামি আইসক্রিম কারা খায়? অবাক ব্যাপার এই যে অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে হোটেল সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না নিমগ্ন মালিয়া শুধু খবরের কাগজ ছেঁড়ে  মনে মনে এই অদৃশ্য কাগজের টুকরা কেউ দেখতে পায় না ম্যাক্সি ডান হাঁটু অব্দি তুলে একটু ঝুঁকে মালিয়ার মা কালিজিরার তেল মালিশ করেন কী ফর্শা রোমহীন পা! যেন মধু দিয়ে ওয়্যাক্স করা আগে নাকি মিহি পশম ছিল তাঁর ধারণা, যেদিন থেকে শাড়ি পরা শুরু করেন সেদিন থেকে এতো কাল ধরে পেটিকোটের ঘষায় ঘষায় সব ঝরে গেছে শীর্ণ হাঁটুতে তেল মালিশ করতে করতে বলেনবুড়িধাড়ি মেয়ের আর কবে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে? অন্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করলে ভালো হইতো

ভালোই ছিল মালিয়া যদিও খাপছাড়া রোদের কোনো এক রবিবারে ভালোবোধটুকু তার নিজের কাছে আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না কম্পালসিভ বাস্তবতার ফাঁকফোকর দিয়ে ছেয়ে যাওয়া অনুভব স্থিরতা দেয় না মালিয়ার ভাবনার গতি বাড়ে আর কমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসা নিজের ভেতর যারা এঁটে উঠতে পারে না, তাদের মতো হয়ে ওঠার বাসনা ছাড়াই মালিয়ার মনে হয়, এই শরীর তাকে আর ধরে রাখতে পারছে না ক্রমশ ফেঁপে উঠছে ভেতরটা। অতিকায় দেহ প্রকাণ্ড হতে হতে নিঃশব্দ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে ঘর থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে মহাবিশ্বে এর কিচ্ছুটি কেউ টের পায় না আপনাআপনি কোথায় কী যে ঘটে যায়গুমোটভাঙ্গা হাওয়া নেমেছিল যেদিন, অজ্ঞাত কোনো কারণে, রতন জেনারেল স্টোরের ফ্রিজে কোকাকোলার সাপ্লাই ছিল না তাই বিকল্প শরবতে পড়েছিল তিন পিস বরফ আর কাগজি লেবুর ফোঁটা ফোঁটা ঘ্রাণ দুই ফিতার ফ্ল্যাট স্যান্ডেলে পায়ের আঙুল ঢুকিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল মালিয়া, গ্লাসে পানির জমাটবাঁধা টুকরা গলে যাওয়ার আগেই বেরিয়ে যাওয়ার সময় নোটবুকে লিখেছিল—‘এই গৎবাঁধা জীবন টুকরা হওয়া দরকার

আসরের আজানের আগেই জি-বাংলার সিরিয়াল শেষ এক ঘণ্টা পর শুরু হবে বাংলায় ডাবিং করা টার্কিশ সিরিজসুলতান সুলেমান কালিজিরার তেল ফুরিয়ে গেছে, মালিয়াকে বলতে হবে অথচ মালিয়া নেই ওজু করতে গিয়ে বিড়বিড় করেন মালিয়ার মাস্বার্থপর মেয়ে! এই দিন দেখার জন্য এতো কষ্ট করে মানুষ করছিলাম?! একটা ফোন পর্যন্ত করে না! দুঃখে তার গলা বুজে আসে

 

বিকালের ইশারা ছিল দক্ষিণেশহরের শেষ প্রান্তে ওদিকে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না, মালিয়া তাই কখনো যায়নি আসলে কী হয়, ভবিতব্যের মতো পথই কখনো টেনে নেয় নির্ধারিত পথিককে পথচারীর মনে হয় শুধু পথভ্রম, ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যা এক অমোঘতা হাঁটতে হাঁটতে কিংবা খুঁজতে খুঁজতে পাগল-পাগল ভাবটা কমে গিয়েছিল মালিয়ার বাস স্টেশানে এসে নেমেছিল দুপুরের পর সারা শরীর তখনও ধূলিধূসরিত কপাল, নাক আর চিবুক তেলাভ চিকচিকে চায়ের তৃষ্ণা ঠোঁটে টঙ দোকানের পরপর দুই কাপ চা ওর নার্ভ শান্ত করেছিল দুধারে খোলা প্রান্তর এতোটা দূর থেকেও হাইওয়ে ধরে ছোটা দূরাগত বাস দেখা যায় গরম গরম মশলা চা খেলে শীত-শীতভাবটাকে দৌড়ানি দেয়া যায় শব্দগুলো কানে না গেলে হয়তো বাসগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকত মালিয়া তাকে উদ্দেশ্য করে বলা কি না সেটা বুঝতে খানিকটা সময় বয়ে গেলো শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গীতে সে তাকিয়েই থাকে দূরপাল্লার দিকে অক্টোবরের হেমন্তগন্ধী হালকা হাওয়ায় হাইড্রোলিক হর্নে প্যাঁ-পু-প্যাঁ-পু নানান সুর বাতাসে ভাসছে ভেঁপু চেপে দীর্ঘ-হ্রস্ব স্বরের এই তারতম্য ড্রাইভারদের নিজস্ব কোড হবে  

কবিতা লিখতে এতো দূর এসেছেন? দ্বিতীয় বাক্য শুনে মালিয়া দুসেকেন্ড সময় নিয়ে ডানপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আর লোকটা দ্যাখে কেমন করে ৪৫ ডিগ্রি কোণে মরাল গ্রীবা বেঁকে গেলো মালিয়া আগে কখনো লোকটাকে দেখেছেএমন মনে করতে পারে না দুজন পরস্পরের চেনা কিংবা অচেনা হলে কথাবার্তায় ভারসাম্য থাকে এই লোকটা তাকে চেনে অথচ লোকটাকে সে চেনে নাবিষয়টা একদিকে হেলে আছে তাই যথেষ্ট অস্বস্তির আমাকে চেনেন’—মালিয়ার বাক্যটা ঠিক প্রশ্নবোধক না, নিস্পৃহতায় দুটি শব্দ বেরিয়ে এলো শুধু চিনি তো, আপনি মন মালিয়া, কবিতা লেখেন শুনে ভেতরে কুঁকড়ে যায় মালিয়া কাঁপুনিটা সামলাতে চোখ নামিয়ে ঘাসের ডগা দ্যাখে যেন এই জগতে দর্শনযোগ্য এতো সবুজ আর নেই ওর গালের ওপর ভেসে থাকা কেশচূর্ণ তিরতিরিয়ে কাঁপে মাঠের উঁচু-নিচু ঘাসের ডগাও একই লয়ে দোলে কবিতা লিখতো সাফোকেটিং সেই দিনগুলোর একমাত্র উপশম হিসেবে কবি সে কখনোই ছিল না পরেও আর লেখেনি লিখতাম…’ অনেকটা সময় নিয়ে বলে তারপর ঘাসের ওপর তেরছা হয়ে পড়ে থাকা বাদামের খোসাগুলোকে পা দিয়ে উপুড় করে দিয়ে আলগোছে জিজ্ঞেস করেআপনি লেখেন? এই প্রশ্ন শুনে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে লোকটাএইসব ছাইভস্মকে যদি কবিতা বলা যায় বেশ সপ্রতিভ কিন্তু হাবভাবে গায়ে-পড়া বলা যায় না মালিয়ার চেনা-জানার গণ্ডীটা সীমিতই শরিফ আল-শাবাব নিজের নাম বলে কথাটা শেষ করে এভাবেনামটা একদমই কবিসুলভ না পাশে ঝালমুড়িওয়ালা তেলের বোতলধরা ডানহাত অনেকটা ওপরে তুলে চাপ দিয়ে তিন সেকেন্ড ধরে রাখে মিহি তেলের ধারা সেই উঁচু থেকে ঝালমুড়ির কৌটায় নেমে আসে হাতও নেমে আসে পরক্ষণে ছন্দময় হাতের ওঠানামায় সাদা ঠোঙা ভরে যায় মাখানো মুড়িতে আল-শাবাবের ধারণা আড়ালে থাকে বলেই মালিয়ার কবিতা অনেকটাই অন্যরকম, সুন্দর মৃদু হেসে বলেআমরা কয়েকজন কিন্তু আপনার কবিতা পড়তাম

‘এই শীতে জমে আছি
দুটো হাত পকেটে নিথর
মাথা তুললেই বরফের চাইয়ে ঠোক্কর
বামন থেকে ক্রমশ বামনতর…’

স্বোপার্জিত স্বাধীনতার ওখানেই; আকাশখোলা রোদের তলে, ফুটপাথে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে, মালিয়া লিখেছিলশীতার্ত কারণ, গরমেও মালিয়াকে শীতে ধরে, চামড়ার ওপর শিরশিরিয়ে কাঁটা দেয় হিমবাহ ভেসে আসে ডাসের সামনে সে কাচের আলমারির ভেতর বাসি-নেতানো সিঙ্গাড়া এড়িয়ে চিনচিনে খিদেপেটে এই কবিতা লিখেছিল মালিয়া ক্যাম্পাসে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের করতো সাহিত্য সংসদের ছেলেমেয়েরা জলফড়িং কয়েকটি সংখ্যায় পাঁচ বছর আগে মালিয়ার লেখা কবিতা পড়েছিল আল-শাবাব হুম থ্যাংকিয়ু! মনে রেখেছেন, বলে আল-শাবাবের বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে আনমনে বাদাম নেয় মালিয়া টুস করে খোসা দুভাগ করে এক ফুঁয়ে পাতলা লাল আস্তর ওড়ায় দাঁতের নিচে বাদাম রেখে ওড়নাটা গলার বাঁ দিকে টেনে ঠিকঠাক করে অভ্যাসবশত এই ঠিক করাটা আল-শাবাবকে দ্বিধায় ফেলে দেয়, সে তাকিয়ে ছিল বলেই যেন মালিয়ার এই ওড়নাটানা

মালিয়া ম্যাসেঞ্জারে ইনবক্সে সার্চ অপশানে যায় ওয়েটিং ফর নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে চিরদিন কানেক্টেড থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ নেটওয়ার্কের এমন উধাও হয়ে যাওয়ার কারণ মালিয়ার জানা নেই মাঠে সবুজের বিস্তার দুএক জায়গায় এসে থমকে গেছে যেন বিশাল খাতার পাতায় এক অদৃশ্য রবার এখানে-ওখানে ঘষে ঘষে লেখা মুছে ফেলেছে খালের পাড় ঘেঁষে হাঁটে ওরা মালিয়াকে বাহুলগ্না করার ইচ্ছেটা মনচাপা দেয় আল-শাবাব ঝকঝকে আয়নার মতো প্রায় ঢেউহীন পানিতে পুরো আকাশ উপুড় হয়ে মুখ দেখছে মালিয়া সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে ঘননীল বাতাস টেনে ভেতরের শূন্যতাকে ভরে দিতে চায় অক্ষমতা পেরে ওঠে না কী যেন হতে পারতো হয় না বাঁশের কম্পিত সাঁকো পেরিয়ে ওই যে আরেকপ্রান্ত; আজীবন কুয়াশামোড়া মালিয়া স্বগতোক্তি করেআন্ধেলা পুকুরডার্ক পন্ডআল-শাবাব বলেখালপাড় জুড়ে শীতকালে সার্কাস পার্টির সারি সারি তাঁবু পড়বেতাই নাকি?...সার্কাসের খাঁচা থেকে আচমকাই একটা বাঘ বেরিয়ে গিয়েছিলবাঘ! সত্যিকারের?... হুঁগুল মারছেন না তো?...ঘাড়ে আমার কয়টা মাথা?...হুম, দশানন মনে হচ্ছে না আপনাকেআপনার গ্রীবাভঙ্গিটা সুচিত্রা সেনের মতো, চাহনিটা নাহবে হয়তোআল-শাবাবের কথা শুনে মালিয়া বুঝতে পারে না এটা কি প্রশংসা না প্রত্যাশা

টোকেন হাতে নিয়ে খাবারের লাইনে দাঁড়ায় মালিয়া ভিড় আছে কিন্তু ধাক্কাধাক্কি নেই দেয়ালে ঝোলানো মেন্যুকার্ডে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সয়াসসের গন্ধ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে অ্যাকুরিয়ামের ভেতর সাঁতার কাটা মাছের মতো কাছে চলে আসে মায়ের জন্মদিনে সেই প্রথম টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে বেইলি রোড থেকে তাঁতের শাড়ি কেনে মালিয়া কলেজের ক্লাস শেষ করে একাই যায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরে মেরুন জমিনে পেটানো সোনালি পাড় কোনো দিন উপহার না-পাওয়া মালিয়ার মায়ের দুটো চোখে সোনালি রঙের সে কী বিস্ময়ঝিলিক! স্টিলের আলমারী খুলে সামান্য টাকা বার-বার গুনে এক পর্যায়ে থেমে যান—‘চাইনিজ খাবে, মালি? তারপর এক ছুটির দিনে জরিপাড় শাড়ি পরেন, পাউডারের বাটিতে কিউটিকুরা পাউডার ঢেলে পাফ বুলিয়ে নেন গালে-গলায় সেই প্রথম স্বল্প আলোয় থাই স্যুপ, ফ্রাইড রাইস, আর চিলি-চিকেন জিভে টেস্টিং সল্টের স্বাদ অনুমান করে নেয় মালিয়া মৌচাক মার্কেটের কাছাকাছি, কবেকার সেই চাং পাই পাউডারের ঘ্রাণ সয়াসসের মৃদুগন্ধে মিশে যায় মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে না মালিয়াফোন ডেড         

অক্টোবরে বিকালের দৈর্ঘ্য কমে যায় সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়ছে, গাছের বয়স্ক শেকড় মাটির তলা দিয়ে পাতালে পৌঁছে গেছে নিশ্চিত পল্লবিত দীর্ঘ ডালপালার নিচে পাঁচটা চটপটির ভ্যান কাচের বাক্সোর ভেতর মটরসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ, ফুচকা, টকদই, ডিম সাজিয়ে রাখা ভাজা মশলাগুঁড়ার খুশবু বেরিয়ে গেছে কাচের বাইরে কাচের বাক্সোর চারদিকে কালারিং লাইটের গতিশীল বর্ডার লাল-নীল-সবুজ আলোর উজ্জ্বলতা বহুদূরের ক্রেতাদের নজর কাড়ে সামনে অর্ধবৃত্তাকারে সাজিয়ে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ার দেদার কাস্টোমারের আনাগোনা দেখে আল-শাবাব জিজ্ঞেস করেবলেন তো, একেকটা দোকানে প্রতিদিন আনুমানিক কতজন কাস্টমার আসে? যা দেখেছে মালিয়া, এ্যাদ্দিনে চোখের আন্দাজ লাগিয়েকমসে কম পঞ্চাশ জন তো হবেই    

প্যান্ডেমিকের দিন শেষ হয়ে গেলো এমন শেষের পর কত কিছুই শুরু করতে হয় আর কঠিন-তরল-বায়বীয় সে যেমনই হোক, ভৌত অবস্থাগুলো বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে ক্রমশ ভৌতিক হয়ে যায় ভারসাম্য বিন্দুতে পৌঁছতে না পারা একান্তভাবে মালিয়ারই অপারগতা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে দেশে দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি হলো, ল্যাটিন আমেরিকায় বামেদের জয়ে পণ্যদ্রব্যের দাম এক আনাও কমবে না কেউ অপরের ক্ষতির জন্য খেসারত দেয় না। এ শুধুই কালক্ষেপণ; ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ কোনো দিন সুগম হয় না কারণ কুফলের প্রাদুর্ভাব সুফলের আবির্ভাবের চেয়ে দ্রুতগামী জীবনের সুষমবিন্দু খুঁজতে খুঁজতে মালিয়ার মন বলেপৃথিবী একটা উন্মুক্ত কনসেনট্রেশান ক্যাম্প বের হওয়ার পথ নেই যেখানেই যাবে ভারবাহী হয়ে থাকবে আশ্চর্য! সে বাস স্টেশানে ফেলে আসতে পারেনি কিছুই এখনো ইউক্রেন-রাশিয়ার হামলা আর সিওমারা কাস্ত্রোকে স্নায়ুতে বহন করছে এই মেঠোভূমিতে কেউই অনাকাঙ্ক্ষিত নয় যার ইচ্ছা আসবে, যাবে থেকেও যেতে পারে সামান্য ভাড়ার বিনিময়ে কুঁড়েঘর মতো রেস্টহাউজ একেকটি কুঁড়ে ঘিরে থাকা দীর্ঘ গাছগুলোকে দেখে মালিয়ার ঘরমুখো মনে হয় এমনভাবে কুঁড়ের দিকে ঝুঁকে আছে, যেন ফিরতে চায় বিকাল তাপ শুষে নিলে মালিয়ার হেয়ার লাইন বরাবর ঘাম শুকিয়ে যায় আকাশের রঙ ঘন হয়ে আসে আল-শাবাব একটার পর একটা নিজের কবিতা শোনায় ক্লান্তিহীন বিরক্তিতে মালিয়ার কপালের ভাঁজ গাঢ় আল-শাবাব সতর্ক করে দেয়, দিনে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত জেনারেটার চলে ডিজেল শেষ হলে জেনারেটরও বন্ধ হয়ে যায় মালিয়া জেনে গেছে দিনে; এখনই কুঁড়ে আর দোকানগুলোতে একের পর এক আলো জ্বলে উঠবে জ্বলে ওঠাটা দেখতে কী সুন্দর! দূর থেকে জেনারেটারের ঠার-ঠার-ঠার শোনা যায় না ব্যাগ থেকে একটা জেল পেন বের করে আল-শাবাবের হাতে দেয় মালিয়াএটা দিয়ে লিখবেন বাতাসে ঝিঁঝির শব্দ ফুটতে ব্যাকুল হয়ে থাকা ছাতিম আশ্বিনেই সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছে  

পঞ্চাশোর্ধ মোমফুলিকে মালিয়ার কথা জানিয়েছিল আল-শাবাব মোমফুলির ইনবক্স-আউটবক্স ছোটো-বড়-সমবয়সী নানান জাত-বেজাতের প্রেমিকে প্রেমিকে সয়লাব চিংড়িঘেরের ব্যবসায়ী হীরার আংটি দেবে লিখেছিলসেই থেকে কল্পিত মেছোগন্ধে বিবমিষায় পেটগুলিয়ে দুদিন বিছানায় এপাশ-ওপাশ রে মোমফুলির হালত খারাপ ডালিমের জুস গাল গড়িয়ে গলার ভাঁজে রক্তের মতো জমে গেলে অসহ্য লাগে সব কিছু শুয়ে শুয়ে বলেপথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো!

চিংড়িওয়ালার চেয়ে পথিক চৌধুরী বেটার এককালে চৌ পথিক নামে কবিতা লিখতো এখন সে শুধু কবি কিংবা সংস্কৃতির একজন কেউকেটাই নয়; রুবিকমসহ অন্যান্য বহুআকাঙ্ক্ষিত সাহিত্য পুরস্কার কমিটির নির্ধারকও তার গুলশান পার্ক বাড়িতে মার্গীয় সঙ্গীত বিষয়ক আলোচনার পার্টিতে কয়েকজন দেশি-বিদেশি শিল্পবোদ্ধা বন্ধুর সঙ্গে মোমফুলিও আমন্ত্রিত একজন অতিথি ছিল বিশেষ মেন্যু আইটেম চুইঝাল দিয়ে হাঁসের মাংসের সিক্রেট রেসিপি না জানলেও মোমফুলির খেতে কোনো অসুবিধা হয়নি বরং গোপনে সে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিল কথা জেনে যে, এখনও বুকের মাংস খেতে ভালোবাসে পথিক সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল বন্ধুরা ওদের উদ্দেশ্যে চৌ পথিক বলছিল, ফরাসিরা কীভাবে হাঁসের বুকের শুকনো মাংস রান্না না-করে খায় আর কেমন করেই-বা সেই মাংস শুকিয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে নির্দেশক জামিল কাত হয়ে বার-বার নেশাতুর মাথা রাখছিল মোমফুলির কাঁধে হঠাৎ ডান স্তনের দিকে নখসমেত থাবা এগিয়ে আসছে টের পেয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয় মোমফুলি। ভাবনা বাড়ে। এটা চৌ পথিকের হাত নয়তো? তাহলে গতবারের মতো রুবিকম ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কার্যত সেটাই হবে। টপসি হাত ধরে দুবার ড্রয়িং রুম থেকে লিভিং এর দিকে গেছে চৌ পথিক মোমফুলির বলা কথাটা, আসলে, যা হতে পারতোপথিক, তুমি টপসি পাইয়াছো!

তিনটা বালিশযোগে শায়িতা মোমফুলির কাছে আল-শাবাব যখন মন মালিয়ার কথা পাড়ে, সটান হয়ে উঠে বসে মোমফুলি মুখ গহ্বর থেকে থু করে কমলালেবুর অফহোয়াইট দানা ছুঁড়ে দেয় কুঁড়ের খোলা জানলা দিয়ে জামিল বর্তমানে প্রেমিক মর্যাদা পেলেও মোমফুলি আড়চোখে তাকায় আল-শাবাবের দিকে মুঠোআলগা হয়ে মালিয়ার দিকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু সেই হিসাব রে উদাস হয়ে যায় স্বামী আর এক ছেলে নিয়ে দুখের সংসারে সুখের নাটক করতে করতে মোমফুলি একদিন সত্যি সত্যি নাটক লিখবে এমন মনস্থির করে স্বামীর গাড়ির অকটেন পুড়িয়ে সে একবার-দুইবার ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকার কামার-কুমার বাড়ি যায় ফিরে এসে লম্বা খাতা মেলে ধরেবুকের নিচে, বালিশের ওপর নাটক লেখার কায়দাকানুন অজানা থাকায় লিখে ফেলে দুটি সরল উপন্যাস—‘লৌহ আর মৃত্তিকা কফিতে চুমুক দিয়ে, এসির হাওয়ায় গা এলিয়ে একের পর এক ব্রাত্যজনের আখ্যান লিখে লিখে আজ বিশ বছর হলো মোমফুলি মাহমুদ একজন বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক লৌহ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছে জামিল দিনের বেলা রিহার্সেল হয় মাঠের পুব দিকে

মন মালিয়াকে চটপটির দোকানের সামনে দেখেছে মোমফুলি মুখের আদলটা চেনা-চেনা, কোথাও দেখেছে কি না মনে করতে পারে না মোমফুলিকেও সেদিনই প্রথম দ্যাখে মালিয়া। মোমের মতো ফর্সা  ত্বক এতো মসৃণমশা রক্ত টেনে নেয়ার আগেই পিছলে যাবে! চোখে চোখ পড়তেই অপরিচিতের ভদ্রতাজনিত হাসি বিনিময় করে ওরা মোমফুলির চোখ দুটো উজ্জ্বল কিন্তু নির্দয়; ঠোঁটের সঙ্গে হেসে ওঠে না  

টর্চের আলো এগিয়ে আসে ঘাসের বুকে আলো-আঁধারের নকশা কেটে নামকাওয়াস্তে চৌকিদার শমসের আলি টর্চ হাতে ইতিউতি ঘোরে দিনের বাকিটা সময় তার ঘুমের আর পান-তামাকের যতোদূর চোখ যায়, মাঠের বিস্তৃতি ততখানি ধূলাময় বৃষ্টিপাতের অঞ্চলটি ঊষর নয় আবাদী এক সময় পরিত্যক্ত হলেও অভাবী লোকেরা আসতো বাস স্টেশানে নেমে যাদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকত না, তারাই এখানে মৌসুমী চাষবাদের পত্তন ঘটায় ফসল উপচে হাতে পয়সা এলে জমি বর্গা দেয় অন্য চাষীদের কেউ কবিরাজি শুরু করে, কেউ কাঠুরে গহীন অরণ্যের শাল-সেগুন, হরিতকি-বহেরা, নিম-তুলসির সতেজ হাওয়া এদের প্রাণ জুড়ায় ডাল-পাতা, ফল-বীজ, শেকড়-বাকল জীবিকার নিশ্চয়তা দেয় কালের হাওয়া লেগে দেশসুদ্ধ সবকিছু যেভাবে বদলে যায়, অবারিত ভূমিও বুনো-গেঁয়ো থেকে কিঞ্চিৎ পালিশ করা আধা নাগরিক চেহারা নিয়ে জাতে ওঠে এর কতখানি পাহারা দেয়া যায় কে জানে?

চৌকিদারের ছেলে রুবেল চটপটির দোকানে কাজ করে বারো/তেরো বছরের শ্যামলা ছেলেটা বড় মায়াকাড়া অপরিচিতির জড়তা কেটে গেলে হাসিমুখে পানির বোতল, পেপার ন্যাপকিন এগিয়ে দেয় মালিয়াকে না চাইতেই রাতে দোকানের কাজ শেষ করে রুবেল প্রায়ই ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে থাকে দুহাত মাথার নিচে দিয়ে আকাশের তারা দ্যাখে লুব্ধক কিংবা প্রক্সিমা সেন্টরাইরুবেল এদের নাম না জানলেও আকাশজুড়ে চূর্ণ-চূর্ণ নক্ষত্রের ঝিকমিক এতোটুকু ম্লান হয় না আল-শাবাবের বেসুরো কবিতা শোনার চেয়ে ওরকম তারা গোনা ভালোএই সিদ্ধান্তে যেতে মালিয়ার বেশি সময় লাগে নানামটা কেমন অদ্ভুত! পূর্ণিমা চটপটি ফুচকা, মালিয়ার কথা শুনে মুখটা এগিয়ে আনে আল-শাবাব কানের কাছে গাঢ়স্বরে বলেকী সুন্দর নাম, পূর্ণিমা! চাঁদের আলো  

এই আলো আদপে চাঁদের না, সূর্যেরমালিয়া বলে আল-শাবারের মুগ্ধদৃষ্টি কিংবা দেবীরূপ ভক্তি কোনোটিই কবিতা ভালো লাগানোর পক্ষে সহায়ক হয় না মালিয়ার কুঁড়েঘর অব্দি এসেও আল-শাবাবকে চৌকাঠ থেকে ফিরে যেতে হয় আল-শাবাব প্রত্যাখাত হয়ে বিড়বিড় করেকী স্বার্থপর মেয়ে! এর হাতে বাদাম তুলে দিয়েছিলাম? কবিতা শুনিয়েছিলাম!

একটি পাতা খড়ের চালে আটকে ছিল পতনোন্মুখ জোর বাতাসে আলগা হয়ে ওড়ে

 

মোমফুলির গাছে এই প্রথম কমলা এসেছে গাছের বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই কমলা ফলবে এতোটা আশা করা যায়নি মোমফুলির মসৃন পিঠে লোশান লাগিয়ে দেয় মালিয়া নরম হাতের স্পর্শে আরাম লাগে মোমফুলির আধবোজা চোখে মালিয়াকে চাইনিজ কমলালেবুর চাষবৃত্তান্ত শোনায় রোপনের পর নতুন পাতা এলে সার দিতে হয় গাছ ঝাপড়া করতে হয় ওপরের দিকে ডাল-পালা ছেঁটে দিয়ে এতে ফলন বেশি হয় আচমকা প্রসঙ্গ বদলায়। চৌ-পথিকের কবিতাগুলো নাকি সবই মোমফুলির ঠিকঠাক করে দেয়া তখনো চৌ বিশেষ কোনো ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেনি রুবি কম্প্যানির সিএসআর উপদেষ্টাও হয়নি সেই আমলে ঝোলাভরা কবিতার বই নিয়ে ঘুরঘুর করতো তরুণী মোমফুলির আশেপাশে চুলের নীল অন্ধকারে মুখ গুঁজে দিতো সুযোগ পেলেই ইতিহাস শুনতে শুনতে লোশনভরা টিউবের মুখ লাগায় মালিয়া মোমফুলির কাঁধে থেকে কাপড় নামিয়ে পিঠ ঢেকে দেয় মোমফুলি আল-শাবাবের কবিতায় চলে আসে এবং দৃঢ়ভাবে জানায় এমন আখাস্তা কবিদের প্রতি পকেটে একজন করে মেয়ে থাকে থাকবেই, কারণ পুরুষ বড় বজ্জাত মোমফুলির কোমর ছাপানো সিল্কি চুলে ঢিলাঢালা বেণি গেঁথে দেয় মালিয়া রূপালি গোড়ায় সিঁথিটা বেশ চওড়া দেখায় একটা হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে টাইট করে বেঁধে দেয় বেণির আগায়। তাবত প্রেমিক আর কবিকূলের প্রতি বিষ ওগরাতে থাকে মোমফুলি, নাহলে ওর পেট ফাঁপায়। কমলা খেয়ে দানা কোথায় ফেলবে বুঝতে পারে না মালিয়া মুখের ভেতর, জিভের ওপর দানা দুটো ঘুরপাক খায় আর মালিয়ার মনে হয়, কমলালেবুর ফুল দেখতে কেমন?      

একদিন আলটপকা বৃষ্টিতে মালিয়ার পুরো শরীর ভিজে চুপচুপা অক্টোবরে এমন বর্ষাকালীন বৃষ্টি ভাবা যায় না হঠাৎ বিনামেঘে বৃষ্টি উড়ে এলে যা হয়, চুপসানো কাপড়ের পুঁটলি হয়ে ঠাণ্ডা জল-হাওয়ায় কাঁপছিল মালিয়া বিছানা ছেড়ে মোমফুলি ধোঁয়া ওড়ানো মশলা-চা নিয়ে আসে উষ্ণতায় বরফজমাট কিছু গল্প ধীরে ধীরে গলে যায় বহমান গরম জলে পা ডুবিয়ে দুজন বসে থাকে মোমফুলির বুকের ভেতর থেকে ক্ষণিকের জন্য চিংড়িপচা গন্ধ ধুয়ে যায় মালিয়ার ভেজা চুল থেকে আলগা পানির ফোঁটা মুছে দেয় গামছা ষে মালিয়ার মনে পড়ে—‘ঠিক মতো চুল ঢেকে না রাখায় ইরানে নীতি পুলিশের হাতে এক নারীর মৃত্যুর কথা উজ্জ্বল, মসৃণ, অবাধ্য চুলের জন্যও মেয়েদের খুন হতে হয়!! মোমফুলি লক্ষ্য করেভেজা চুলেই হাতখোঁপা করে মালিয়া পরমুহূর্তে আবার আলগাও করে দেয়, বেখেয়ালে   

আকাশটা তখনো মর্বিড মনটা ঘোলাটে এবং অসহিষ্ণু নোটবুকে মালিয়া লিখে ফেলেআমি কি স্কেপিস্ট? পৃথিবী মূলত বদ্ধভূমি অগণন গলিত শবের হাঁ-মুখ দেহচ্যুত মাথার নিরর্থক পড়ে থাকা অন্ধকার আর বাসি রক্তপচা মাংসের অনেক অনেক ওপরে শুকুন এদের ঝাপটানো ডানা ঘষা খায় আকাশের গায়ে এই নির্লিপ্ত পৃথিবীতেতাকিয়ে তাকিয়ে জ্যান্তরা যেখানে গণহত্যা দ্যাখেকবন্ধ  হয়ে থাকাই শ্রেয় সামান্য ডানে-বামেও যারা পালিয়ে বেড়াতে পারে না, যারা বুঝে গেছে দৌড় শুধু ভাগাড় থেকে ভাগাড়ান্তে, তাদের মধ্যে কেউ বাঁচার তগিদে খুঁজে নেয় অন্যকিছু সাময়িকভাবে সেটা হতে পারে নাটকের রিহার্সেলমোমফুলি যা দেখাতে পারে মালিয়াকেমাঠের আরেক প্রান্তে খোলা আকাশের নিচে জামিলের সঙ্গে মালিয়াকে পরিচয় করিয়ে দেয় মোমফুলি দুদিন ব্যাপী নাট্যোৎসব হবে বাংলা নাটকের সঙ্গে ইংরেজিও রুটিন ইনকুয়েরির মতোই জামিল মালিয়াকে জিজ্ঞেস করেনাটকে অভিনয় করবেন? আপনাকে দিয়ে হবে না, নাবলে মাথা দুপাশে নাড়ায় মালিয়া ঈর্ষায় আধাপোড়া মনকাঠ থেকে-থেকে ধিকিয়ে উঠলেও সেই ধোঁয়ার ঝাঁঝ ভেতরে পাঠিয়ে দেয় মোমফুলি আঙুল তুলে ইশারা করে দোতলা দালানের দিকে   

বিশাল প্রান্তরের ভেতর পুরো লোকালয় যেন সেঁধিয়ে গেছে মাঠ তো নয় জগত-সংসার! এদিকে মালিয়া আগে আসেনি হাওয়ার ঘূর্ণিতে সিগারেটের ছেঁড়াখোঁড়া ফয়েল, আইসক্রিমের মলিন হয়ে যাওয়া মোড়ক আর বাদামিরঙা শুকনা পাতা ওর চলিষ্ণু পায়ের সামনে পাক খেয়ে ফিরে যায় নিচতলার পুরোটা জুড়ে গমগমে শপিং মল ওপরে প্রদর্শনী হল আর ফুড কোর্ট ভিড়ের মধ্যে নোনাধরা দেয়ালে সাঁটা পোস্টারে চোখ পড়ে মালিয়ার; একটি নিখোঁজ সংবাদ একজন পুরুষের পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি দেয়ানিচে লেখাআরমান শেখ। বয়স ৪০, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। এখানে ওখানে ঘষা খাওয়া পোস্টারের ডানদিকে ওপরের কিছুটা অংশ চুন-চলটাসহ উঠে গেছে। ছবিটা ঘোলাটে অথচ কী জীবন্ত দুটো চোখ! লোকালয় থেকে মানুষ কেমন করে হারিয়ে যায়? সেফটিপিন, প্রেসক্রিপশান কিংবা থার্মোমিটার তো আর না!    

মালিয়ার ভিড়-ভীতি আছে লোক সমাগম হলেই ওর দমবন্ধ লাগে ফুসফুস ভরে লম্বা লম্বা শ্বাস টানে মালিয়া মোমফুলিকে দেখতে পায় না। শ্বাসরোধ হয়ে আসার আগেই সে দোতলায় উঠে যায় নিরিবিলিতে হাঁফ ছাড়ে সুলতানের পেইন্টিংস দেখতে দেখতে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে যায় নিচে পাকা হাতে জিনিসপাতি ঘাঁটাঘাঁটি করে মোমফুলি বাজ পাখির চোখে যাচাই রে ছোঁ মেরে তুলে নেয় জাম-কালারের সেরা মনিপুরী শাড়িটা ভাঁজ খোলে। বাঁ-কাঁধ আর বুকের ওপর মেলে ধরে আয়নায় কী অপরূপ দ্যাখে নিজেকে! সেখানে হঠাৎ বিম্বিত আল-শাবাবের ছায়া।      

ফুল্লবিকশিত হাসি মোমফুলির ঠোঁটে ঘাড় ঘুরিয়ে সে পেছন ফিরে তাকায়। ডান হাতে কাঁধের আঁচল চেপে আল-শাবাবকে কপট কটাক্ষে বলেমেয়েটা ভালো না, বুঝলে? তোমার ওই মন মালিয়া! এদের ব্যাগের একেক পকেটে একেকজন পুরুষ থাকে কী স্বার্থপর মেয়ে! কী আত্মকেন্দ্রিক! দ্যাখো, একা একা উপরে চলে গেছে! এরচেয়ে তো শাকিলা বেটার, যদিও তার সাজগোজ ভ্যাম্পের মতো

    

স্তূপ করে রাখা বিরাট সব আধোয়া ডালা-ঢাকনা, সিলভারের ড্যাগ-ডেকচির গায়ে চটপটির মশলা আর আধভাঙ্গা মটরদানা লেগে আছে লাল মগে হুইল পাউডার গুলিয়ে হাঁটুর কাছে পরনের প্যান্ট ধরে গোড়ালি থেকে সামান্য ওপরের দিকে টানে রুবেল একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসে লোগোটা মলিন হয়ে এলেও বোঝা যায় আরএফএলের। তারপর মাটির ওপর ডালা খাঁড়া করে ধরে রাখে এক হাতে। আরেক হাতে তারের জালি মগের ফেনায় ডুবিয়ে তোলে। একমনে মাজেঅনুজ্জ্বলকে সামান্য উজ্জ্বল করার চেষ্টায়। বারবার ঝাঁকি খেয়ে ডান বাহুতে বেঁধে রাখা ফ্যাকাসে লাল সূতাটা তাবিজসহ  কিছুটা নেমে যায়। চেয়ারে সেই রুবেল ধোয়া-পাকলার কাজ সারে; এসব দৃশ্য দূর থেকে দ্যাখে মালিয়া দিনশেষে রুবেলের ডেকচি ধোয়া আর তারা দেখাকাজ দুটো ভিন্ন হলেও নিষ্ঠা আর নিবিষ্টতায় কোনো ফারাক নেই সহজলভ্য ছিল বলেই দিন কিংবা রাত্রি নিয়ে মালিয়া ভাবেনি, যেভাবে নিজের জন্ম আর জীবন নিয়েও ভাবেনি সামান্য যা কিছু পেয়েছেঅনায়াসেই শুধু মাথার ভেতর কেউ যখন বলেখোঁজো, তখন মাঝপথে এসেও ভিন্ন দিকে যাত্রা শুরু হয় কী যে খুঁজছে সে জানে না, তাই খুঁজেও পায় না জীবনের সুষমবিন্দু বলে হয়তো আদৌ কিছু নেই একটা রুটম্যাপ এতোই দুষ্প্রাপ্য যে মাঝে মাঝে পথের অস্তিত্ব নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়ে মালিয়া বাস্তব হাতড়ে কাল্পনিক কিছুই হয়তো সে খুঁজছে কিংবা কল্পনায় খুঁজছে বাস্তব সারবস্তু    

ঘরে ফেরে মালিয়া, একা জেনারেটারে তেল নেই এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে আধখানা মোমবাতি জ্বলে সমস্ত ঘরে জায়মান বলতে ওই শিখাটুকু আর দেয়ালে প্রতিফলিত মর্মস্পর্শী ছায়া মেঘের গুরুগুরু শব্দ চারপাশে বিন্দু ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে বৃত্ত পেরিয়ে পরিধির ওপারে চলে যায় আর কল্পনা চেতনা ছাড়িয়ে অতিচেতনায় অন্বেষণযোগ্য হয়ে ওঠে আমায় রাখিলেন সাঁই কূপজল করে আন্ধেলা পুকুরে নিচুস্বরে গান গায় মালিয়া নিজের সঙ্গে কবে হবে সুজল বরষা, আমি চেয়ে আছি ওই ভরসা আরো দুর্ভেদ্য দুর্গমে বাস্তবতা আর কল্পনার একই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে অপুর্ব পাক খায় মালিয়া তা থৈ... একের পর এক তীব্র ঘুর্ণি তোলে নাচের ঘূর্ণাবর্তে ঝাঁক-ঝাঁক পায়রা উড়ে যায় মালিয়ার ক্লান্ত হাত মুকুল মুদ্রায় পাঁচ আঙুলের আগা একসঙ্গে মিলিত অবস্থায় উর্ধ্বে প্রসারিত কলাফুলের মতো নতমুখী একটা সাদা পালক হাওয়ায় ভেসে ভেসে হাতের মণিবন্ধে স্থির দুচোখের পাতা ভারী হয়ে জড়িয়ে আসে মোম গলে যায় স্বপ্নঘোরে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ওঠে মালিয়া   

খুব ভোরে আলো ফোটার আগে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় খালপাড় ধরে ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে থাকে ডগায় লেগে থাকা ফোঁটা ফোঁটা শিশিরে পা ভিজে যায় গতির তোড়ে গোড়ালি থেকে এংকলেটের সুতা ছিঁড়ে ক্ষুদ্রাকৃতির পুঁতিগুলো হুড়মুড়িয়ে মাটিতে নেমে আসে অগোচরে জোরে জোরে শ্বাস নেয় সে বাতাসে জলজ গন্ধ খালের এদিকটা বিস্তৃত হয়ে নদীর সঙ্গে মিশেছে আশ্বিনের শেষেও ক্ষীণতোয়া বলা যায় না বাঁশের সঙ্গে বেঁধে রাখা কোষা নৌকার গলুইয়ে সে দীর্ঘ পথভাঙা পা-জোড়া ডুবিয়ে দেয় মালিয়া ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়াতেই আপাদমস্তক ক্লান্তি ধুয়ে যায় পানির তলে  দুটো পা কত অকিঞ্চিৎ, মালিয়া ভাবে, তবু গোড়ালিতে-আঙুলে জড়িয়ে যায় লতা-গুল্মের সরু সরু আটি, শেকড়সুদ্ধ ক্ষুদিপানা আর তোপাপানার গোছা এমন কথা বলা হয়েছিলখোঁজো, তবেই তো কিছু! মালিয়ার মনে হয় নিজেকে হারিয়ে ফেলা মানুষও এক প্রকার নিখোঁজ মানুষ। কোনো সহৃদয় মানুষের পক্ষে কি আত্মবিলুপ্ত মানুষটির সন্ধান করা সম্ভব? এই নিরুদ্দিষ্টের জন্য কোনো হারানো বিজ্ঞপ্তি জারি হয় না তাই যোগাযোগের শেষ সূত্রও থাকেও না। এসব এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই ঢেউ এলে মালিয়া টের পায় ডুবন্ত পা থেকে পানার গুচ্ছ নিজেকে ছাড়িয়ে ভেসে যায়। ফের জড়িয়ে যায় লতাপাতা। অনুভবের এই পৌনঃপুনিকতা যেন জগতের অনিত্যতার কথাই বলে। কাউকে হারিয়ে ফেললেও সেই শূন্যতাকে যেভাবে পূর্ণ করে দেয় সঠিক আগন্তুক। আসা-যাওয়ার সেই সত্যটুকু সহজভাবে নিতে পারলে জটিলতা সামলে নেয়া যায়।           

দূর থেকে ডিঙিটাকে দ্যাখে মালিয়া বৈঠা বেয়ে আসা লম্বা-চওড়া লোকটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট দুজনের  চোখে নিছক কৌতূহল লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নামে লোকটা মালিয়া একটু আড়ষ্ট দোতলা দালানের একতলায় দেখেছিল লোকটাকেনিখোঁজ সংবাদের পোস্টারে ঘোলাটে ছবির নিচে ওর নাম লেখা ছিলআরমান শেখ। রোদপোড়া গাঢ় তামাটে রঙ আর তেমন উজ্জ্বল নেই যদিও। এমন জীবন্ত  চাহনি বিরল তাই অভুলনীয় সেই চোখ বাস্তবিকই জ্যান্ত হয়ে বলেআপনি এখানে? হাঁটতে হাঁটতে মালিয়া মাঠ পার হয়ে এতোটা দূর চলে এসেছে, আরমানের কাছে বিষয়টা বড় বেখাপ্পা ঠেকে মালিয়াকে সে একদিন দেখেছে নাগরিক মেয়ে বনবাদাড় উজিয়ে সাত সকালে খালে-বিলে কেমন করে? মালিয়া দেখছে সবই, আবার কিছু দেখছেও না চায়ের উশখুশানিটা বাড়লেও ওপারে যেতে হবে জেনে চুপসে যায় আরমান গম্ভীর স্বরে বলেএতো দূর কম মানুষই আসতে পারে, মালিয়া সত্যের অব্যয় রূপ দশদিকে খুঁজতে হয় পোস্টার থেকে নেমে এসে কেউ নাম ধরে কথা বললে যতোটুকু বিস্মিত হওয়া দরকার, মালিয়া এর ছিটেফোঁটার ধার না ধেরে, আরমানের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে,  সেলোয়ার-কুর্তায় কাদা মাখিয়ে ডিঙিতে ওঠে আরমান নৌকা ঠেলা দিয়ে লগি মারে মালিয়াকে সুলতানের প্রদর্শনীর দিন দেখেছিল আরমান মেয়েটার শ্যামলা মুখাবয়বে চোখ দুটো খুব তীব্র, ওর দিকে তাকিয়ে কেমন দেখাটাই না দেখছিল! শুনে মালিয়া হেসে ফেলেআপনি আমাকে দেখেছেন? আমিও কিন্তু আপনাকে আপনি তো হারিয়ে গেছিলেন! আরমান ভাবেআদৌ কি হারানো যায়? মুখে বলেএই যে পেয়ে গেলেন! মালিয়া অজস্র বছর পর প্রাণ খুলে হাসেচলেন, হারিয়ে যাই লবণ আর তামাকের জন্য মাঝে মাঝে শহুরে-বাজারে যাওয়া ছাড়া মানবসৃষ্ট সভ্যতা থেকে আরমানের অবস্থান দূরেই শিষ্টতা, ভদ্রতাসমাজ এবং জীবনযাত্রার বিশিষ্ট উৎকর্ষতাগুলোশেষতক তাকে আর খুঁজে পায় না। তাই হয়তো দেয়ালের ওপর হারিয়ে যাওয়ার পোস্টার পড়ে।     

অনেকটা দূরত্ব পেরিয়ে নৌকা তখন বিলে যতোদূর মালিয়ার চোখ যায় অবাধ আকাশের নীচে গোলাপি রঙের বিস্তার পদ্মবনে লগি ঠেলে নৌকা বিলের মাঝ বরাবর এগিয়ে যায় ভোরের আলোয় পদ্মকলি সামান্য ঠোঁট খুলেছে দূর থেকে ভাসমান পদ্মের গোলাপি রঙটুকুই দৃশ্যমান উত্তরে-দক্ষিণে, পুবে-পশ্চিমে গোলাপির পর গোলাপির বিভ্রমে মালিয়া সমাচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকে। দশদিক জুড়ে এটাই কি সত্যের উদ্ভাস? হাত সামনে প্রসারিত করে আরমান শেখ; তর্জনী তোলে ঈশানকোণেওই যে দিকের অন্তে আনন্দস্বরূপ নির্দেশিত জায়গার দিকে তাকিয়ে স্বচ্ছ পানি ছাড়া কিছু দেখতে পায় না মালিয়া বেলা চড়ছে দ্রুত দাঁড় বায় আরমান লোকালয় বেশি দূরে না, সেটা বোঝা যায় ঝিকমিক পানিতে দাপিয়ে সাঁতরানো নারীদের দেখে নাওয়া শেষ হলে, খালি কলসের কোমর পানিতে এদিক-ওদিক দুলিয়ে ডুগডুগ করে পানি ভরে ওরা। কলস কাঁখে ঠেকিয়ে পাড়ে ওঠে বলিষ্ট দেহভঙ্গিমা লেপ্টে থাকা ভেজা শাড়ি থেকে শক্তি ঠিকরায় ঘাটে ডিঙি ভিড়লে মালিয়া এবার নিজেই নেমে যায়; পিচ্ছিল মাটিতে যোগমুদ্রার ভারসাম্যে জামায় লেগে থাকা কাদার প্রলেপ ততক্ষণে শুকিয়ে চিড়চিড় করে ফাটছে যে পথে যেতে হয়, আরমান দেখিয়ে দেয়এইটুকুই। চায়ের তৃষ্ণা না, যেন জন্ম অন্বেষণের তৃষ্ণা তাকে তাড়িয়ে হাঁটায় খাপছাড়া রোদ এসেছিল যেদিন; কোনো এক রবিবারে, মালিয়ার মাথার ভেতর সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল জীবনের জলাশয়ে ফাৎনা ফেলে ছিপখানা হাতে নিয়ে সে একঠায়ে বসে ছিল। না-জেনেবুঝে ঠাণ্ডা অন্ধকার জলে ঝাঁপ দেয়ার ধাক্কাটা এসেছিল ভেতর থেকেই  

নৌকায় চড়ে মালিয়া প্রশ্ন করেছিলআমরা কোথায় যাচ্ছি? প্রত্যুত্তরে আরমান হেসেছিল নৌকা পদ্মবিলের দিকে ঘুরিয়ে যেন-বা সার্ত্রের মতো বলেছিল চেইঞ্জ হ্যাজ টেকেন প্লেস! তবে তা-ই হোক; নৌকার গন্তব্য কোথায় মালিয়া জানে না। মালিয়া বরং ভাবছিল জন্ম ইস্তক যা-কিছু সে পেরিয়ে এসেছে একের পর এক অমোঘ ঘটে যাওয়া অন্ধকার অতলান্তিক গহনে রূপান্তরের একেকটি স্তরে মানুষ শুধু একটা সাবজেক্ট মাত্র এই অবস্থান্তর ঠিক দৃশ্যমান না; বিমূর্ত বলেই এর কোনো লক্ষ্য বা লক্ষ্যবস্তু নেই। নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য সেনসিটিভিটি নিয়ে এই যে ভিন্ন আকার বা অবস্থায় পরিণত হয়ে যাওয়াসেটা অসহায়ত্ব কিংবা আত্মপ্রত্যয়ের প্রচলিত ধারণার বাইরের বিষয় নদীর পাড় থেকে ছোটো ছেলেদের সমাবেশ মালিয়ার পিছু নিয়েছে নির্ভয়ে মালিয়া হাঁটতে হাঁটতে লাকড়িপোড়া ধূমল উনুন পার হয়ে যায়; মাটির হাঁড়িতে প্রাগৈতিহাসিক আগুনে তখন টগবগ করে ভাতের ফ্যান উথলায় উঠানের নরম রোদে পাটি পেতে ছেলে শুইয়ে দিয়ে আসে বৌ ছেলের কোমরের কালো কাইতনে ঘুঙুরের তিনটি দানা বাঁধা ঘুমের ভেতর শিশুর দেয়ালাকেমন হাসছে! তাল মিছরির ঠাণ্ডা শরবতে কাগজি লেবুর ফোঁটা ফোঁটা ঘ্রাণ মিশিয়ে মালিয়ার দিকে এগিয়ে দেয় বৌ তারপর পুষ্ট ঠোঁটে চওড়া হাসি এনে জিজ্ঞেস করে মালিয়া কী খেতে চায়? মালিয়া খুশি হয়। রুবেলও হাসিমুখে পানির বোতল, পেপার ন্যাপকিন এগিয়ে দিতো। বানর-নাচ দেখতে গিয়েছিল রুবেল। বানরওয়ালা ডুগডুগি বাজিয়ে বানরকে নির্দেশ দেয়আজকালকার ছেলেদের মতো হেঁটে দ্যাখাও! জোয়ান বানর দুহাত পেছনে নিয়ে হেলে দুলে বিন্দাস হাঁটে। ঘিরে থাকা দর্শকরা হাততালি দেয়। উবু হয়ে বসে বানরের জব্বর মজার অঙ্গভঙ্গি দেখে রুবেল। দ্বিগুন জোরে ডুগডুগি বাজায় বানরওয়ালা সালমান শাহের মতো লাফাতে বলায় তক্ষুণি বানর উলটা ডিগবাজি খায়। রুবেলের পায়ের সামনে গিয়ে পড়লে লেজের ঝাপটে পিছু হঠে রুবেল। ভারসাম্য না রাখতে পেরে নিজেই বেমক্কা ডিগবাজি খায়। ছড়ে যাওয়া কনুই থেকে রক্ত গড়ায়। ফিরে এসে ডান কনুইয়ের রক্তিমাভ ক্ষতের ওপর দুর্বা ঘাস চিবিয়ে লাগায় আলগা আলগা চাপ দিয়ে। মালিয়া এসে পাশে বসে শোনে বানররাজের লঙ্কাকাণ্ডভাগ্যিস তো লেজে আগুন ছিল না! অবশ্য সেই রাবণও নেই, লঙ্কাও নেই। রুবেলের হাত ধরে ক্ষতটা পরখ করে মালিয়াখুব গভীর না। সেরে যাবে। চারকোণা তাবিজের দিকে চোখ পড়লে সে রুবেলকে জিজ্ঞেস করে তাবিজ কী জন্য? জানা গেলো ঘুমের মধ্যে কথা বলা, উশখুশ করা, কান্না করা আর জাগ্রত অবস্থায় আকাশের তারা দেখা বদজ্বিনের কারসাজি। এইসব বন্ধ করার জন্যই পিতলের তাবিজের তদবির দিয়েছিলেন জ্বিননবশকারী বড় হুজুর। বদজ্বিনের এমন অভাবনীয় আসরের কথা জেনে হেসে ফেলে মালিয়া।  কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্টও হয়। কতদিন ওর ইচ্ছা জেগেছে মাঠে শুয়ে আকাশের দিকে সোজা চোখ দুটো মেলে দেয়ার। দৃষ্টি অগণন নক্ষত্র ফুঁড়ে ছায়াপথ ধরে কত দূর যায় তা জানার ঔৎসুক্যের চেয়ে তাকিয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষাটাই বরং বেশি ছিল। মনে মনে রুবেলের একটা নাম দিয়েছিল মালিয়াআকাশমুখী।

রুবেল একই রকম দেখতে আরেকটি পিতলের তাবিজ এনেছিল মালিয়ার জন্য। মালিয়া জিজ্ঞেস করেনিকেনো? তাবিজটা নিয়ে রুবেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। হয়তো আনমনেই আকাশের দিকে কখনো তাকিয়ে ছিল মালিয়া আর রুবেল দেখছিল বদজ্বিনের আলামত। সুরক্ষা কবচ এনে দেয় এমন শুভাকাঙ্ক্ষী যে বড় দুর্লভ!  

শরবতে চুমুক দিতেই কী যেন মনে পড়েহয়তো তিন পিস বরফের শীতলতা কিংবা কোকাকোলার সাপ্লাইহীন দিনের বিকল্প শরবতের মিষ্টতার কথা। বুকের ভেতরটা জুড়িয়ে গেলে মালিয়া বৌ-কে বলেতোমাদের ভালো হোক। ফসলের ভারে ধীরগতির গরুর গাড়ি পার হয়ে হাঁটতে থাকে মালিয়াশিশির শুকিয়ে পায়ে-পায়ে ধূলা উড়িয়ে ওর গা-হাত-পা সাদাটে চোখ-মুখ শুকনো কিন্তু প্রাণময় খড়ের  চালের নিচে আগুনের ফুলকি ছুটছে, কামারের ছন্দোবদ্ধ শক্তিশালী ঘা পড়ছে টকটকে লাল তাতানো লোহার পাতে; সেই শব্দও এক সময় অশ্রুত কামারশালা পার হয়ে দক্ষিণের পথ ধরে মালিয়া। রোগির নাড়ি টিপে নিদান হাঁকায় কবিরাজ আদা, যষ্ঠিমধু আর রাজ্যের গাছ-গাছড়া বেছে থেঁতলায় হামানদিস্তায় জড়িবুটি বানায়। কাশের গুচ্ছ হাতে বালিকারা মালিয়ার পিছু পিছু হাঁটেছেলেদের মতোই নির্ভয়ে বরং কিছুটা কৌতূহলেগলায় তাদের শেফালিমালার সুঘ্রাণ ছেলেরা বলেকাঠুরে নাকি কুড়াল দিয়ে বাঘের মুণ্ডু কাটতে পারে মেয়েরা বলেসুঁই আর সুতলি দিয়ে সেই কাটামুণ্ডু ফের জুড়েও দেয় তবেই না বাঘ জ্যান্ত হয়ে বনে ফিরে যায় মালিয়া সকৌতুকে ওদের টুলটুলে গাল টিপে বলেকাঠুরের মনে কত মায়া! দূরে মাঠপারের জোড়া তালগাছের নিচে আরমান শেখ সিগারেট ফোঁকে, তাকিয়ে থাকে ক্রমশ বিন্দু হয়ে আসা মালিয়া আর মালিয়ার জটলার দিকে।         

রোদ-ছায়া ভরা পথে মালিয়ার অনিঃশেষ হাঁটা চারপাশের শব্দ-গন্ধ-বর্ণ-স্পর্শ রক্তের মতো অস্তিত্বে বাহিত হয়ে পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে তীক্ষ্ম করে আর হাওয়ার ফিসফিসানি ওর কানে কানে বলে দেয় যা কিছু জিজ্ঞাস্যহতে পারে সেটা সবুজ গাছের ভেতর অদৃশ্য আগুনের সূত্র কিংবা ভূ-গর্ভে লুকিয়ে যাওয়া পানির উৎসমুখের জলজ মানচিত্র। মালিয়া জেনে যায় নিজেকে নিবিড়ভাবে খুঁজে না পেলে জীবন শেষতক কোনো রকম সুখ-দুঃখ, দায় আর গ্লানিবোধ নেয়ার উপযোগী থাকে না। আগাম শীতের ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে মালিয়া সেদিকেই হাঁটতে থাকে, যেখানে বহুকাল আগে মায়ের ফেলা দেয়া পুরনো খবরের কাগজের ছেঁড়া টুকরোগুলো জুড়ে গিয়ে পূর্ণতার কোলাজ হয়ে যায় যাপনের একেকটি স্তরে সময়ের মুখোমুখি হওয়ার খণ্ডিত ফলাফল অর্থপূর্ণ হয় সামগ্রিকতায়। এর বাইরে যতোদূর চোখ যায়, হাওয়া ছুটলেই সবুজের কাঁপন কিষানেরা সুঠাম নিড়ানি দিয়ে ধানগাছের গোড়া থেকে ঘাস আলগায় এতোটা দূর থেকে ওরা মালিয়াকে ঠাহর করতে পারে, কি পারে না নিরাসক্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে ধরিত্রীর বুকে ফের নিড়ানি চালায় এই ভূমিই তাদের পবিত্র অধিষ্ঠাত্রী নিরন্নের মুখে অন্নদাত্রী একটা আপেক্ষিক বিভাজন রেখা পার হয়ে, মালিয়া অবাধ প্রান্তরে উন্মুক্ততার মুখোমুখি থমকে দাঁড়ায় সোনালি আভা দশদিক খুলে সমস্ত চরাচর গান গাইছে সুর কেবল তাদের শ্রাব্যসীমা ধরা দেয়যারা শুনতে চায়।  

নিঃসীম দিগন্তে নাক-মুখ উঁচু করে শ্বাস নেয় মালিয়া শিরায়-উপশিরায় একই সঙ্গে সঞ্চারিত অগাধ সুখবোধ আর দুঃখবোধ। শেকড়কাটা অস্তিত্বে হঠাৎ টান লাগে। পায়ের তলা দিয়ে মূল গজিয়ে পলি ফুঁড়ে নেমে যায়।   

...

[গল্পে যিনি কাহিনির চেয়ে কথনকে গুরুত্ব দেনশ্রদ্ধেয় দাদা কবি স্বপন রায়কে।]