বর্মণ স্টুডিও
ঘন সবুজ বনের মধ্যে হলদে ডোরাকাটা হরিণেরা মনের আনন্দে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। মা হরিণটা মাথা নীচু করে সস্নেহে চেয়ে আছে শিশুটির দিকে, আর শিশুটি মায়ের শরির ঘেঁষে লেপটালেপটি করছে। মা হরিণের ডান পাশে আরও একটা হরিণ। আর বাম পাশে বড় একটা গাছের গায়ে ঝুলছে থোকা থোকা লালচে রঙের ফুল। কী ফুল কে জানে! বেলুচিস্তানে কি এরকম বন জঙ্গল আছে? ওদেশে কি গাছে গাছে রঙিন ফুল ফোটে? ওখানকার বনেও কি হরিণ পাওয়া যায়? মায়াবী চোখের নীরিহ অসহায় হরিণ?
স্টুডিওর মাঝখানে ফোকাস লাইট ঝোলানোর রডে উল্টো হয়ে ঝুলছিল নিমাই। শরিরটা পুরোপুরি উদোম। মারের চোটে পরনের ধুতি ছিঁড়ে কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে! শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা পা দুটোর চামড়া কেটে রক্ত ঝরছে। সেই রক্ত তার উরু বেয়ে নিচে নামতে নামতে শিশ্নের কাছে এসে জমে আছে ফোঁড়ার মত। তার ঠোটেঁর কাছটা নীল, কাটে নি তবে ছেঁচে গেছে বোধ হয়, কী প্রচণ্ড ব্যথা, মুখ খুলতেও কষ্ট হচ্ছে। চোখের চারপাশটাও যে ফুলে গেছে বেশ বুঝতে পারছে সে। ভাল করে চাইতে পারছে না সে। ঠিক কতক্ষণ ধরে মার খাচ্ছে সে মনে করতে পারছে না। চোখের সামনে পরিচিত সেই সবুজ বন, সেই বনে হলদে ডোরাকাটা হরিণেরা, মাঝে মাঝেই ঝাপসা হয়ে আসছে সেই দৃশ্য। সবুজ হলুদ মিশিয়ে কয়েকটা রঙিন আঁকিবুকি দেখতে পাচ্ছে কেবল এখন। উল্টো অবস্থায় ঝুলতে ঝুলতেই চোখের কোণ দিয়ে সে দেখে বেলুচ সৈন্য দুজন ব্যাপক মারধরের পর ক্লান্ত হয়ে সেই ব্যাকড্রপের সামনে দুটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। কপালের ঘাম মুছছে একজন। আরেকজন না কামানো ময়লা গাল চুলকাচ্ছে খস খস করে। খানিক পর সৈন্য দুজনের চেহারাও ঝাপসা হয়ে এল তার চোখের সামনে। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এখন।
জুন মাসের প্রচণ্ড দাবদাহ শহরে। সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি নামবে দু একদিনের মধ্যেই, আর এখানে একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর থামাথামি নাই। চলবে টানা কয়েক দিন। পাহড়ি ঢল নেমে এলে রাস্তায় রাস্তায় পানি জমে যাবে। সুরমার জল উপচে পড়বে দুধারে। কীন ব্রিজের কানা ছুঁই ছুঁই করবে সেই পানি। এমনটা চলবে প্রায় সারা বর্ষা। আহা, বৃষ্টিটা নামলে একটু ঠাণ্ডা হতো ঘরটা। শরিরে এক সূতা পরিমাণ কাপড় নাই, তবু ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরির। আচ্ছা, ভারি খাকি পোশাক পরা সৈন্য দুজনের কি গরম লাগছে না? কী ভীষণ গুমোট গরম স্টুডিওর ভেতর!
কীন ব্রিজ থেকে নেমে খানিকটা এগোলেই বর্মণ স্টুডিও। সিলেট শহরের দু চারটা হাতে গোণা ফটো স্টুডিওর একটি। মূলত লন্ডনগামী সিলেটিরা পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে আসে এসব স্টুডিওতে। কখনও সৌখিন স্বামী স্ত্রী আসে বিয়ের পর একটা স্মরণীয় যুগল ছবি তুলতে। বিলেতি কায়দায় স্ত্রীটি সেজেগুজে শাড়ি পরে সোফার চেয়ারে একটুখানি বাঁকা হয়ে বসে, পাশে কোট প্যান্ট পরা স্বামী দাঁড়িয়ে পোজ দেয়, কখনো স্ত্রীর চেয়ারের হাতলটা ধরে, কখনো স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে। কীভাবে দাঁড়াতে বা বসতে হবে তা ননী কাকাই বলে দেন। বন জঙ্গল আর হরিণ শাবকের ব্যাকগ্রাউন্ড পছন্দ না হলে ননী কাকা ব্যাকড্রপ পালটে দেন কখনো কখনো। তার স্টকে সুন্দর গোলাপী পদ্ম পুকুরের পর্দাও আছে একটা। খদ্দের সাজগোজ করে তৈরি হয়ে যাবার পর নিমাই স্টুডিওর দরজা বন্ধ করে ঘরটা অন্ধকার করে দেয়, তারপর উঁচু রডে ঝুলতে থাকা বড় বড় আলোগুলো একে একে জ্বেলে দেয়, যে রডে সে নিজেই এখন ঝুলে আছে ফোকাস লাইটের মত। তফাত হল এই যে আলোগুলো এখন বন্ধ, ঘরটা মিশমিশে অন্ধকার, আর ভীষণ গরম। আর খদ্দের বলতেও এখানে কেউ নেই, আছে দুজন ক্লান্ত, গরমে পরিশ্রান্ত, ঘর্মাক্ত বিরক্ত বেলুচ সৈন্য।
গাল চুলকানো সৈন্যটা আবার তৈরি হল মারধরের জন্য। হাতে তুলে নিল পাশে রাখা মোটা লাঠিটা। উল্টো অবস্থায় ঝুলে থাকার কারণে লোকটার শরিরের মাঝখানটাই কেবল চোখে পড়ল নিমাই এর। মেদহীন পেটটা দুলতে দুলতে এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। ভারি বুটের আওয়াজ শোনা গেল। লোকটা এগিয়ে এসেই তার ওল্টানো মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে খামচে ধরল আগে।
কাঁহা কামিনে? হুংকার দিয়ে উঠল লোকটা-তেরি তসবীরওয়ালে?
হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল নিমাই। চুলগুলি গোছা গোছা ছিঁড়ে আসছে লোকটার হাতের মুঠোর ভেতর। এত জোরে টেনে ধরেছে যে মনে হচ্ছে মাথার তালুর চামড়া সুদ্ধ উঠে আসবে। মা আ আ, ও মা আ আ আ বলে চিৎকার করে উঠল সে। জবাবে লোকটা তার ভাষায় তার মাকে কী বলে যেন গালি দিল একটা। এক দলা থুথু ফেলল তার মুখে।
এই হারামজাদা বর্মনোর বাচ্চা, খইয়া দেস না খেনে ননী কুনহানো?
এবার পেছন থেকে কথা বলে ওঠে ফুকড়া মজিদ, যে সৈন্য দুটিকে এখানে নিয়ে এসেছে। ফুকড়া মজিদ তাহলে চলে যায় নি। এ ঘরেই আছে। এতক্ষণ দেখতে পায় নি নিমাই।
আমি জানি না, আমি জানি না গো ও ও- বলে আবারও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে পনেরো বছরের নিমাই। সত্যিই সে জানে না নীলমণি কাকা ওরফে ননী কাকা কোথায় গেছে? বুড়ি ঠাকুমাকে বাড়িতে একা রেখে সেই কবে শহর থেকে হাওয়া গেছে ননী কাকা। তার পর থেকে এ পর্যন্ত সুনসান পড়ে ছিল এই বর্মণ স্টুডিও। স্টুডিওর স্টিলের রডগুলো আর ভাঙা লাইট দুইটা, জীর্ণ ছিন্ন ফোম বের হওয়া দুটো সোফার চেয়ার, আর ওপাশে ছোট্ট ড্রেসিং রুমের দেয়ালে সাঁটা বড় আয়নাটাতে ধুলো জমেছে দিনে দিনে। আয়নাটার সামনে একটা ছোট ড্রেসিং টেবিলে চিরুণি আর পাউডারের কেস একা একা চুপচাপ পড়ে আছে কতদিন। কেবল ননী কাকার বিশাল ক্যামেরাটা কবে যেন হাপিস হয়ে গেছে দোকান থেকে। এখন কেউ আর বিকেলবেলা সেজেগুজে ভাল জামা কাপড় পরে ছবি তুলতে আসে না এখানে, এই আতংকের নগরে ছবি তোলার প্রশ্নই আসে না এখন। খানিক দূরে সিলেট সার্কিট হাউসে ডেরা পেতেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা, পারতপক্ষে এদিককার ছায়াও মাড়ায় না কেউ ভয়ে, ফুকড়া মজিদ আর তার দলবল ছাড়া। তবে মাঝে মাঝে নিমাই এখানে আসত বইকি।
এই দুর্দিনেও সপ্তাহান্তে একবার দরজা খুলে খালি স্টুডিওটা অকারণেই ঝাড়পোঁছ করত নিমাই। ধুলো মাখা হরিণগুলিকে সাফ করত ভেজা ত্যানা দিয়ে। উঁচু একটা পেতলের ফুলদানি ছিল পাশে দাঁড় করানো, ফুলগুলি ছিঁড়ে গেছে তবু গুছিয়ে এদিক ওদিক করে সাজাত। সাজঘরের আয়নাটা পরিস্কার করে চকচকে রাখত। তারপর একা একা ক্যামেরার শূন্য স্ট্যান্ড এর এপাশে দাঁড়িয়ে ননী কাকার মত করে চেঁচিয়ে বলত-একটু মাথা কাইত করইন দেখি ডাইনে, বাহ এই তো! আরে বৌদি একটুখানি হাসেন। মিষ্টি করিয়া। মাথার ঘুমটাখান একটু পিছে। বাহ বাহ। এইবার রেডি?
তার স্বপ্ন ছিল একদিন ননী কাকার কাছে হাতে খড়ি হবে তার ছবি তোলার। কী আশ্চর্য এক জগত লুকিয়ে আছে এই ছবি তোলার ক্যামেরাটার মধ্যে। লেন্সের ভেতর দিয়ে মানুষগুলো চিরদিনের জন্য কেমন বাঁধাই হয়ে যায় সেকেন্ডের মধ্যে। একবার ওর মধ্যে আটকে গেলে সুন্দরী কোন নববধূর এক চিলতে লাজুক হাসি আর কখনোই কেউ মুছে ফেলতে পারে না সারা জীবনে। যদি কেউ ভ্রু কুঁচকে থাকে রাগী রাগী ভঙ্গিতে, তাহলে সেই লোকটা যে সমস্ত জীবন এরকম ভ্রু কুঁচকেই থাকবে সবার দিকে চেয়ে, সেকথা ভাবলেই হাসি পেত তার। কখনো কোন ছোট্ট শিশু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত মায়ের কোলে বসে চুপটি করে, হয়তো মুখে বুড়ো আঙুলটা পুরে, সোজা ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে-বড় হয়ে ওই ছবিটা দেখে না জানি কত মজা পাবে শিশুটি-এই ভেবে উদ্বেলিত হয়ে উঠত নিমাই। ননী কাকার কাছ থেকে ক্যামেরার নানা পার্টস এর নাম জেনে নিয়েছিল সে। সামনের চোঙাটা হল লেন্স। ওটাই আসল জিনিস, মুহূর্তকে ধরে রাখার আসল কারিকুরি সে-ই করে। যে ফোকড় দিয়ে মানুষগুলোকে ক্যামেরাম্যান দেখেন তার নাম ভিউফাইন্ডার। ওতে চোখ রাখার পর হাতের ডান দিকে একটু নিচে থাকে শাটার। শাটারের ওপরই ভেতরে বসানো থাকে ফিল্ম, মানে নেগেটিভ। নিমাই এই সব জানে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ভিউফাইন্ডারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শাটারটা টিপে দিলেই কম্মো সারা! সময়টা সারা জীবনের জন্য স্থির হয়ে যাবে ওই লেন্সের ভেতর। আর নড়াচড়া করতে পারবে না। কী আজব যন্ত্র এটা।
তো যুদ্ধের শুরুতে ননী কাকা কোথায় যেন চলে গেল, কিন্তু নিমাই এর দোকানে আসা বন্ধ হল না। কারণ এই দোকান আর ওই ক্যামেরা তাকে রোজ চুম্বকের মত টানত। মাঝে মাঝেই এসে স্টুডিও পরিস্কারের কাজ করত নিমাই, ধুলো ঝাড়ত, আয়নাটা মুছত, মনে মনে সে জানত একদিন আবার এই বর্মণ স্টুডিওতে আলো জ্বলবে, আবার শাটারের আওয়াজ পড়বে, একদিন আবার ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আলতো করে মুখে পাউডার বুলিয়ে নেবে কোন মেয়ে। ননী কাকা ফিরে এলে আবার খদ্দেরদের আনাগোণায় চঞ্চল হয়ে উঠবে এই স্টুডিও। কিন্তু আজকে এখানে এসে এমন মর্মান্তিক ভাবে যে ধরা খেয়ে যাবে তা কে জানত?
রডের সাথে দড়ি দিয়ে টাইট করে বাঁধা পায়ের পাতা দুটিতে সপাং সপাং করে লাঠির বাড়ি পড়তে শুরু করেছে এতক্ষণে। ব্যথা আর যন্ত্রণার অনুভূতিগুলোও কেমন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে নিমাই এর। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে, মাথার ভেতরটা কেমন খালি খালি। পা দুটো যেন আর শরিরের সাথে নেই, আলগা হয়ে খুলে পড়ে গেছে কোথাও। মারগুলো আর ভাল মত টের পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সাথে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে চলেছে সৈন্যটা অপরিচিত ভাষায়। কাকে গালি দিচ্ছে লোকটা? ননী কাকাকে? কী এমন করেছে ননী কাকা?
কয়েকদিন আগেই কোম্পানীগঞ্জ থানার টুকের বাজারে ভয়ানক এক যুদ্ধ হয়ে গেছে বলে শুনেছে নিমাই। লামাডেক্সি গ্রামে ঢুকে অবর্ণনীয় অত্যাচার শুরু করেছিল পাকিস্তানিরা। গ্রাম জুড়ে লাগিয়ে দিয়েছিল আগুন, ছেলে বুড়োকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনছিল উঠানে, আর ঘরের ভেতর ঢুকে বিবস্ত্র করছিল মেয়েদেরকে। খবর পেয়ে টুকের বাজার এর উত্তর দিক থেকে দুই ভাগে ভাগ হয়ে পঁয়ত্রিশ জনের এক মুক্তির দল চুপি চুপি এগোতে শুরু করেছিল সেদিকে। পাকিস্তানিগুলো এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। আকস্মিক আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে পালানোর সময় গায়েঁর তিনজনকে বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তারা। নদীর পাড় থেকে তাদের ওপর সমানে গুলি চালাচ্ছিল মুক্তিরা। শেষমেষ ওই তিনজনকেও বাধ্য হয়ে বুড়দেও এর কাছে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছিল সৈন্যরা। টুকেরবাজার এর এই ঘটনা নিয়ে সিলেট শহরে এখন মহা উত্তেজনা। সৈন্যরা হাতের শিকার ছেড়ে ভয়ে এমন লেজ তুলে পালাবে কেউ ভাবতেও পারে নি। পাকিস্তানিদের সাহস আর তাকত নিয়ে হাসাহাসি চরমে। জয়বাংলা রেডিওতেও গমগমে গলায় ঘটনাটা বর্ণিত হয়েছে। সেটা শুনেছে সারা দেশের মানুষ। ওদের লালদিঘীরপাড়ায় জোর গুজব, ক্যাপ্টেন ইয়ামীন আলীর ওই সাহসী মুক্তিদের দলে তাদের বর্মণ স্টুডিওর মালিক ফটোগ্রাফার নীলমণি সিংহও নাকি ছিল! শুনে একেবারে তাজ্জব হয়ে গেছিল নিমাই। ননী কাকা ক্যামেরা চালাতে জানে বটে, কিন্তু বন্দুক চালাতে শিখল কখন? লোকে যে বলে মার্চ মাসে শহর ছেড়ে পালিয়ে কমলাপুর লোহারবন্দ ইকো ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং নিতে চলে গেছিল তার ননী কাকা-সেই গুজব কি তবে সত্যি?
মার খেতে খেতে এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল নিমাই। কতক্ষণ বা কতদিন এভাবে অজ্ঞান হয়ে স্টুডিওর মধ্যে পড়েছিল সে জানে না। কিন্তু গভীর ঘুমঘোরে সে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছিল কারা যেন ছবি তুলতে এসেছে স্টুডিওতে, হাসাহাসি করছে, আহ্লাদী করছে। কে যেন মিষ্টি গলায় বলছে-ওগো দ্যাখো না বেণীটা ডাইন দিকে আনতাম নি সামনে, না পিছনে থাকতো। মাথার কাপড়টা সরাইতাম নি একটু? কিলান লাগের তো আমারে কও না? ননী কাকাও কাকে যেন ধমক দিয়ে বলছিল-উহুঁ, আফনার টাই বান্দা হইছে না, দ্যান আমি বান্দিয়া দেই, আহা মুখটা একটু ডাইনে। এই তো! আবার কখন যেন কিশোরী গলায় কে একজন তার কানে ফিসফিস করে বলছিল-তুমার কাকারে দিয়া আমার একখান ফটো তুলিয়া দিবায় নি নিমাই, আমার বড় শখ একখান ফটো তুলার! ওমা, কে সেই কিশোরী, ওদের পাড়ার চামেলী না তো? সে কোত্থেকে আসবে এখানে? চামেলীরা না সব বর্ডার পার হয়ে শিলং চলে গেল কবে, বাপ মা ঠাকুমা কাকা কাকী সমেত? একটা ফটো তোলার খুব শখ ছিল চামেলীর। আহা, ফটোটা তুলে রাখলে চামেলীর কিশোরী শ্যামলা মিষ্টি মুখটা বাঁধাই হয়ে থাকত চিরকালের জন্য। তারা যদি আর কখনো ফিরে না আসে, আর নিমাই যদি চামেলীর চেহারাটা ভুলে যায় একদিন?
স্টুডিওর ঘন কালো অন্ধকারে পেঁচার মত চোখ দুটি সয়ে আসতে শুরু করেছে তার, যন্ত্রণা বা খিদে পিপাসা কোন অনুভূতিই আর অবশিষ্ট নেই, কতদিন কত ঘন্টা যে ঝুলতে ঝুলতে পার হয়ে গেল সে জানে না। বাইরে কি এখন বৃষ্টি হচ্ছে? না এখনও সেই গুমোট গরম? জালালী কবুতরগুলো এখনও কি উড়ে উড়ে কীন ব্রিজের ওপর দিয়ে সুরমা নদীর ওপারে গিয়ে আবার সন্ধ্যে বেলা ফিরে আসে? শাহজালালের মাজারে এখনও কি মানত করতে আসে দুঃখী ব্যর্থ পরাজিত মানুষেরা? এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দিন যায় নিমাই এর। এই ঘরে সময় আটকে গেছে, সময়ের সাথে তার দুলতে থাকা জীবনও। এই ঘরে এভাবে ঝুলতে ঝুলতেই হয়তো সে মারা যাবে একদিন। বাইরের কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না।
কিন্তু ভাগ্য ভালো, আবার একদিন কারা যেন হুড়মুড় করে এসে ঢুকল বর্মণ স্টুডিওর ভেতর। দরজাটা কারা যেন হ্যাঁচকা টানে খুলল, তেরছা প্রখর আলো এসে ঢুকল স্টুডিওর ভেতর। সেই আলোতে এতদিন অন্ধকারে থাকা চোখ দুটো কুঁচকে গেল তার। চোখ বন্ধ অবস্থায় উল্টো হয়ে ঝুলতে ঝুলতেই সে টের পেল কারা যেন টেনে হিঁচড়ে কাদেরকে এনে বস্তার মত ছুড়েঁ ফেলল মেঝেতে। ওপাশের ছোট সাজঘরটাতে আলো জ্বলে উঠল বহুদিন পর। সে আবছা দেখতে পেল সাজঘরে একটা মেয়েকে, চামেলী কি? না চামেলী নয়! অন্য কেউ। কিন্তু চামেলীরই বয়সী। আলো না সওয়ার কারণে নিমাই চোখ বন্ধ করল। সে স্বপ্নের মধ্যে দেখল সাজঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় আর কপালে আলতো করে পাউডার বুলিয়ে চোখের কোণ দিয়ে নিজেকে মুগ্ধ নয়নে দেখে নিচ্ছে কেউ, হাতির দাতেঁর চিরুণী দিয়ে কপালের সামনের চুলগুলি পাট পাট করে নিচ্ছে। আহা, ও কি সিঁদুরের কৌটো খুলে আরেকবার গাঢ় করে নিল সিথিঁর লাল দাগটা? সুরমাদানি বের করে চোখের সুরমাটা কি আরেকবার টেনে নিল সযত্নে? গলার নেকলেসটা ঠিকঠাক করে নিল একবার? কিন্তু ননী কাকা নেই, তার ঢাউস ক্যামেরাটাও নেই। কে ছবি তুলবে মেয়েটার? চোখ বন্ধ করে এই সব ভাবতে ভাবতেই সে শুনতে পেল ভয়ে আতংকে ননী কাকার স্টুডিওর ব্যাক ড্রপের হরিণগুলো ছবির মধ্য থেকে কেমন করে যেন বেরিয়ে এসেছে। তারা তড়পাচ্ছে স্টুডিওর ভেতর। ছোটাছুটি করছে। আর্তনাদ করছে। আর সুস্বাদু মাংসের ঘ্রাণে উন্মত্ত কয়েকটি চিতাবাঘ ঝাপিয়েঁ পড়ছে হরিণগুলোর ওপর। হরিণগুলোর বিকট আর্তনাদ শুনতে শুনতে নিমাই মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস এই মুহূর্তে ননী কাকার বিরাট ক্যামেরাটা এই ঘরে নাই, থাকলে এই নরকদৃশ্য চিরকালের জন্য বাঁধাই হয়ে থাকত লেন্সের ভেতর!
নির্মমতা! কত যে সহ্য করেছে মানুষ!
সাদিয়া সুলতানা
এপ্রিল ০৮, ২০২৩ ১৩:৫০
সকাল সকাল দারুণ একটি গল্প পড়লাম। মুক্তিযুদ্ধের এই গল্পটা চমৎকার।
ইসরাত জাহান
এপ্রিল ০৫, ২০২৩ ০৯:৪১