প্রতিবর্তন
তেলাপাকার ছেঁড়া পাখনা যেমন অনবরত পাক খায় গোছলের বালতিতে, ঠিক সেভাবে ধোঁয়া-ওঠা হালিমের বাটিতে তখনও ভাসছিল ভাঁজা পেঁয়াজর কয়েকটা কুঁচি। এগুলো ঠিক সেভাবে ভেসে বেড়াচ্ছিল না, বড়জোর এটাকে লেপ্টে থাকা বলা চলে, ফিতে-ছেঁড়া স্যান্ডেল যেভাবে লেপ্টে থাকে প্যাচপ্যাচে কাদার মধ্যে, সেরকম। এটা একটা আশ্চর্য বিষয়ই বটে, টইটুম্বুর বাটিভর্তি ময়লা হলুদ রঙের তরলটুকুর প্রথম দুয়েক চামচ গলাধঃকরণের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো ভোক্তার পেটে চালান হয়ে যাওয়ার কথা; যদিও ভোক্তা ইচ্ছে করেই রসিয়ে রসিয়ে খাওয়ার অভিপ্রায়ে আলগোছে চামচ থেকে ফেলে দেয় না খয়েরি রঙা এই পেঁয়াজ কুচিগুলো। আর তাছাড়া দৈবাৎ এই চর্মগুলা থেকে গেলেও এগুলোর প্রকট রঙ অপরিবর্তিত থাকার কথা নয়, কারণ ভোক্তা অর্থাৎ সাজ্জাদ যেভাব চামচ দিয়ে বাটির ভেতরকার তরলটাকে ঘুটছে তাতে ঘন হালিমের মাখামাখি হয়ে এগুলোর খয়েরি রঙ উবে যাওয়ারই কথা। তার অবশ্য সে খেয়াল ছিল না, কেননা খাওয়ার সময় এ-ধরনের আনুবীক্ষণিক তীক্ষ্ণতা নিয়ে খাদ্যবস্তুর দিকে তাকিয় থাকা তার স্বাভাব নয়, তবুও সামনে রাখা প্রায় নিঃশেষিত এই বাটিটার মধ্যে এরকম আশ্চর্য অসামঞ্জস্যতা তার চোখে ধরা পড়ল; কেননা তার অখণ্ড মনোযোগ এই তরলটুকুর মধ্যেই নিবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয় সে, যেহেতু ঠিক তার টেবিলে—আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তার ঠিক সামনের চেয়ারটাতেই এসে বসেছে সেই লোকটা।
এটা একটা বারোয়ারি হোটেল, যার যখন যেমন ইচ্ছে তেমন চেয়ারে এসে বসতে পারে, কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়, লোকটি তার পূর্বপরিচিত এবং লোকটির উদ্দেশ্য আঁচ করা তেমন কিছু কঠিন নয় তার জন্য। আর তাই, সে তার দিকে না তাকিয়ে হালিমের বাটির মধ্যে ঢেলে দিতে চায় নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ। তাতেই তার কাজ খুঁজে না পাওয়া দৃষ্টিতে ধরা পড়ে এই আকস্মিক ঘটনা। বিষয়টা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কি? আসলে সে তার ভাবনাটাকে আটকে রাখতে চাইছিল বাটিটার নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে যাতে সামনে বসা ওই উৎকট লোকটা ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যায় বাটি বেয়ে কিলবিলিয়ে উঠতে থাকা ঈষোদোষ্ণ ধোঁয়ার সঙ্গে। যদিও সে দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল লোকটা ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে সোজাসুজি। আবার তা নাও হতে পারে এ জন্য যে, তার সঙ্গে সাজ্জাদের হরহামেশাই সাক্ষাৎ হয় এবং অপ্রয়োজন কাউকে বিরক্ত করতে দেখা যায় না তাকে, যদিও পরিচিত বা অর্ধপরিচিত, কখনো কখনো অপরিচিত মানুষের কাছে এই লোকটার প্রয়োজন লেগেই থাকে। যখন সে অন্য কারও পশ্চাদ্দেশে সেঁটে থাকে বেখেয়ালে লেগে যাওয়া চুইংগামর মতো কেবল তখনই সে সাজ্জাদকে দেখে এড়িয়ে যায়। এ-মুহূর্তে হয়তো লোকটা সাজ্জাদের দিকেও তাকিয়ে নেই, হয়তে হালিমের বাটিটাই তার নজর আটকে দিয়েছে চুম্বকের মতো। আটপৌরে বউয়ের উপস্থিতিতেও ছা-পোষা কেরানির ঠিকরানো চোখ দুটি যেভাবে আটকে যায় বিশ ইঞ্চি টিভি পর্দায় অনবরত কাঁপতে থাকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার যুগল বক্ষে, হয়তো সে সেভাবেই নির্নিমিষ তাকিয়ে আছে অমৃতের এই আধারটার দিকে। লোকটাকে ছাপোষা কেরানির আটপৌরে বউ আর হালিমের বাটিটাকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সুডৌল স্তনের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে হঠাৎই হাসি পেয়ে যায় সাজ্জাদের।
লোকটার একটা পোশাকি নাম হয়তো ছিল কোনো এককালে, এখন লোকে তাকে ‘পাগলা সেলিম’ বলেই ডাকে। অন্যসব পাগলের মতো সেলিমেরও পূর্বজীবনের কিছু মুখ চটকানো ঘটনা জনতার মুখে মুখে চিরকালীনতা পেয়ে গেছে। শোনা যায় এসএসসি পরীক্ষায় সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার গৌরব অর্জন করে ধন্য করে ফেলেছিল তার অখ্যাত এলাকাটাকে; যদিও এ প্লাসের এই যুগে এটা তেমন কিছু আহামরি অর্জন নয় এবং হয়তো সে সময়েও ভুরি ভুরি ছাত্র প্রথম বিভাগে পাশ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অফিসের এক্সিকিউটিভের পদগুলো দখল করে বসেছে এখন। কিন্তু সাজ্জাদ যে-পাড়ায় থাকে সে পাড়ায় প্রথম বিভাগ বেশ দুর্লভই বটে। সেলিমের ব্যাপার আরও শোনা যায়, একবার সে নাকি কোনো এক থানার ডাকাবুকা দারাগাকে জটিল ইংরেজির বেমক্কা ঘায়ে চিৎপটাং করে দিয়েছিল প্রায়। তাকে নিয়ে অন্য যেসব গল্প বাজারে প্রচলিত আছে সেগুলো এতটা লাগামছাড়া যে সেসব গল্পের অবতারণা করে তার প্রতি পাঠকের আগ্রহ ও সহানুভূতি বাড়িয়ে না তোলাই শ্রেয়; কেননা এ গল্পে তার চরিত্রটা বেশ জটিল এবং তার সম্পর্কে এসব সত্য-মিথ্যা কাহিনি পাঠককে বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে।
সেলিম ছিল পরিবারর জ্যেষ্ঠ সন্তান আর তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সে তার মা-বাবার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারই ছিল তাদের, একইসঙ্গে বৃহৎ পরিবারও। পাঁচভাই চারবোনসহ মোট এগারো জনের পরিবারটির এক মাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তার বাবা, যিনি বয়স ও শরীরের যুগপৎ ভারে ক্লান্ত হয়ে উঠছিলেন শেষদিকে। কোনো এক আধাসরকারি অফিসের পিয়ন শ্রেণির এই ঘুষখোর পিতাটি প্রায় আক্ষরিক অর্থেই তাদের অথৈ সাগর ভাসিয়ে দিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন বছর দশেক আগে। নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়ে পানিভর্তি কাচের গ্লাস যেমন ছত্রখান হয়ে ছিটকে যায় দিগ্বিদিক, ঠিক সেভাবে তার ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে পড়ে পাড়াময়। বড় মেয়েটা, যার সম্পর্কে লোকে এ ধারণা চাপিয়ে দিয়েছে যে, সে তার ছারপোকার মতো স্বামীটাকে প্রতিদিন নিয়ম করে পেটায় আর তার সেই পাশুঁটে-মুখ পতিদেবতাটি তাতে নাকি একধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করে এবং শুধু এই সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখার জন্যই নাকি সে তার বংশানুক্রমিক বাবুর্চির পেশাটা বাদ দিয়ে পাড়ার মধ্যেই একটা বিউটি পার্লার খুলে বসেছে, যেখান তার চণ্ডাল বউটি বিয়ের কনেদের মুখে প্যানকেক আর ব্লাশন ঘষে, আর সে আয়েস করে ম্যানেজারের চেয়ারে বসে আর চুবিয়ে ডালপুরি খায়।
তার অন্য বোনগুলোর ব্যাপারেও পাড়ার মধ্যে অনেক রসালো গল্প চালু আছে। তারা নাকি দু-তারা তিনতারা হোটেলে নিয়মিত যাতায়াত করে এবং এরই মধ্যে একজন আবার পেট খসিয়েছে একবার।
সেলিমের ভাইগুলোর দু-একটা নিয়মিত চাঁদাবাজি ছিনতাই করে বলে পাড়ায় বেশ ফিশফিশ হয় আর তাদের দেখে সেসব কথা অবিশ্বাসও করা যায় না, কারণ তাদের চুল সবসময় অদৃশ্য জলে মাখামাখি হয়ে খুলির সঙ্গে লেপ্টে থাকে এবং জিন্সের প্যান্টগুলো অনাবশ্যকভাবে পশ্চাদ্দেশ ও হাঁটুতে অতিরিক্ত ফেইড হয়ে থাকে আর তার পকেট থেকে আলতোভাবে উঁকি মেরে বেরিয়ে থাকে বেনসনের সোনালি প্যাকেট। এসব লক্ষণকেও যদি নিশ্চিতভাবে তাদের কীর্তির স্মারক হিসেব চিহ্নিত করা না যায় তবে মোক্ষম অস্ত্র হিশেবে তাদের পৈত্রিক বাড়িতে পুলিশ আসার রেকর্ডটাকে তুলে ধরা যায়। সেলিমের ক্ষেত্রেও অবশ্য শোনা যায় যে পুলিশের প্রহারের ধকল সইতে না পেরে তার আজ এই পরিণতি।
বাবা মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগেই এলাকার ত্রাস হিশেবে আত্মপ্রকাশকারী সেলিম এবং তৎকালীন রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলটির সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে এলাকার মধ্যে যথেচ্ছো কর্মকাণ্ড শুরু কর দেয়, যার এক-আধটু প্রমাণ পেতে সাজ্জাদকেও প্রখর দৃষ্টি মেলে দিতে হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় সে একবার সাজ্জাদের ওপরও চড়াও হয়েছিল এবং তার কারণ শুধু এটা ছিল যে প্রায় সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও সাজ্জাদ তাকে ‘সেলিম ভাই’ বলে সম্বোধন করলেও ‘ভাই’ শব্দটি নাকি শুনতে পায়নি সে। অবশ্য সাজ্জাদ পরে এই দুর্ঘটনার একটা মনস্তত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিল এই মর্মে, যে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে কেউ অত্যধিক দক্ষতা বা ক্ষমতা অর্জন করলে তার দাপট তার দুর্বল সমবয়সিদের ওপর বর্তায়; কেননা ক্ষমতা প্রকাশের সবচাইতে সহজ উপায় সম্মান, আকার আয়তন, ওজন কিংবা বয়সের ওপর তা ঝালাই করে নেওয়া।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেলিমেরও পতন ঘটতে শুরু করে এবং তার বিরুদ্ধে নথিবদ্ধ মামলাগুলো এবার সদলবলে বেরিয়ে পড়ে গোপন ফাইলের ফুলকা গিট খুলে। নতুন সরকারর আঞ্চলিক শক্তিকে বৃদ্ধি করার মহৎ ব্রত নিয়ে এলাকারই কিছু অপুষ্ট ছেলে-ছোকরা প্রবল আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে এরই মধ্যে। দুর্মুখেরা বলে, এটাও সেলিমের জেলে যাওয়ার অন্যতম কারণ। সে যাই হাক, তখন সেলিমের ঘরে প্রায় প্রতিদিনই নীল ইউনিফর্ম-পরা লোকজনের আনাগানা লেগে থাকত। অনেকের ধারণা, তারা নাকি মূলত আসত সেলিমের টসটসে পেয়ারার মতো বোনগুলোর সঙ্গে খাতির জমাতে। পাড়ার রসিকজনদের দেওয়া এই উপমা মিথ্যা ছিল না, কেননা সাজ্জাদ নিজেও বহুবার তাদের আসতে-যেতে দেখে নিজের হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়েছিল। আসবার সময় ওড়না ফুঁড়ে বের হওয়া তাদের বুকগুলো কিংবা যাওয়ার সময় তানপুরাসদৃশ তাদের পশ্চাদ্দেশের মৃদুতাল তাকে একধরনের অপার্থিব সুখে আবিষ্ট করত। মেয়ে দুটির চেহারাও ছিল মারমার কাটকাট, যদিও সে তাদের চেহারার দিকে চেয়ে থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট করেনি কোনোদিন।
সেলিম কিন্তু বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারল না। কেননা এলাকার মুরুবিরাও ঘন ঘন পুলিশ আসাটাকে এলাকার অসম্মান হিসেবে বিবেচনা করলন এবং নতুন একটা কাজ খুঁজে পেয়ে যারপরনাই রোমাঞ্চিত হলেন। কেননা সদ্য গজানো গার্মেন্টসগুলোর বদৌলতে গড়ে ওঠা মেয়েগুলোর একচালা মেসবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উরু চুলকাতে তাদের আর ভালো লাগছিল না। আর এই ব্যাপারটা প্রথম অনুধাবন করেন মাধুরী টেইলার্সের মালিক ইসমাইল মিয়া, যার দ্বিতীয় স্ত্রী সেই চল্লিশোর্ধ্ব বয়সেই রঙচঙ নাইটি পরে রান ফাক করে দাঁড়িয়ে থাকত মুদি দোকানগুলোর সামনে।
সেলিম ফিরে এলেও কারো চেহারায় তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। কারণ এরই মধ্য জেলফেরত অনেক বীরপুরুষ মুখে মুখে সেলিমের ভারসাম্য হারাবার বিত্তান্ত জানিয়ে গেছে পাড়ায়। তাই সাড়ে পাঁচ বছর পর ফিরে এসে ‘এক-গু-আ টিয়া দ-ও না’ বলে চিৎকার করলেও কউ ভ্রূক্ষেপ করেনি তার দিক তাকিয়ে। শুধু যারা একটু অসহিষ্ণু তারা কোনোমতে একটা টাকা দিয়ে কেটে পড়েছে, আর যারা বিনোদনপ্রিয় তারা তাকে ক্ষেপিয়ে তুলে মজা লুটেছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে সেইসব লোকগুলোর মায়েদের সঙ্গে তার কল্পিত সম্পর্কের কথা বলে রক্ত তুলেছে গলায়। অবশ্য এর জন্য তাকেও মাশুল দিতে হয়েছে বহুবার এবং তারই জের ধরে তার মস্তিষ্ক আরো আরো বিগড়ে গিয়ে কোষে কোষে গিট লেগে গেছে একেবারে, বছরের বিশেষ বিশেষ সময় যার কিছুটা আঁচ পাওয়ার যায়। সাজ্জাদ অবশ্য এর কোনো দলেই ছিল না কখনো, কেননা সেলিমকে দেখলেই তার মনে পড়ে যেত সেই দিনটার কথা, যেদিন কোনো কারণ ছাড়াই সেলিম তার শক্তির সদম্ভ নমুনা দেখিয়েছিল সাজ্জাদের মতো নির্বিষ তরুণকে অনাবশ্যক চড় মেরে।
“হেতি আর বশি খাইতু ন, হিতি খাইতুন আর”—সে যখন বিড়বিড় করে এই কথাগুলার পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছিল তখনও সাজ্জাদ তার দিকে তাকাচ্ছিল না। না দেখেও সে ষ্পষ্ট বুঝতে পারছিল হালিমের বাটিটাকে সেলিম গিলে খাচ্ছে তার লোভাতুর চোখ দিয়ে। সাজ্জদের বারবার মনে হচ্ছিল সে তার দিকে তাকানো মাত্রই সেলিম চেয়ে বসতে পারে হালিমের বাটিটা। হালিমের বাটিটায় অবশ্য পেঁয়াজকুচিসুদ্ধ কয়েক চামচ মরিচ ছাড়া তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। এটুকু সে চাইলেই বাড়িয়ে দিতে পারে সেলিমের দিকে, কেননা এই লোকটাকে দেখে বাকিটা খাওয়ার ইচ্ছে এমনিতেই উবে গেছে তার। সে শুধু ভয় পাচ্ছিল লোকটার চোখ দুটোর কথা ভেবে। আচ্ছা, সেলিমের কি মনে আছে সেই দিনটার কথা? থাকার কথা না, অবশ্য। পুরনো কোনো স্মৃতি মনে থাকল তা ওর অবস্থা আজকে এমন হতো না। “আর না খাইস, আঁরে দি দে।” সাজ্জাদ চমকে তাকাল লোকটার দিকে। সদ্যপ্রসূতির কুচকানো পেটের মতো তুবড়ে যাওয়া মুখে প্রচণ্ড লোলুপ চাহনি ছাড়া অন্য কোনো অভিব্যক্তি দেখা না গেলেও সাজ্জাদের হুট করে মনে পড়ে গেল তার প্রবল পরাক্রান্ত চেহারার কথা যা সে প্রথম অনুভব করছিল সেদিন, যেদিন সেলিম তুচ্ছ অজুহাতে তাকে চড় মেরেছিল রাস্তার কিনারে অনবরত জল ঝরতে-থাকা ওয়াসার বারায়ারি কলটার সামনে। সেই দৃশ্যটা সাজ্জাদের আঁতকে-ওঠা চোখে ফ্ল্যাশব্যাকর মতো ঝলসে উঠল, যেখানে সে কল থেকে হাতের চেটোতে নিয়ে পানি খাচ্ছিল একটা ক্ষেপের ক্রিকেট ম্যাচ শেষ করে এসে। হঠাৎই অসতর্কতাবশত পাইপের মুখে সাজ্জাদের হাত লেগে যায় আর তাতে তীব্রবেগে ছিটকে আসা জল দিকভ্রান্ত হয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা সেলিমের শাদা জামায় ফুটকি এঁকে দেয়। সাজ্জাদ এই অসাবধানতার জন্য ক্ষমা চাওয়ার অভিপ্রায় বিনীতভাব তার নাম সম্বোধন করলেও কোনো এক অজানা কারণে সে চড় বসিয়ে দেয় সাজ্জাদর বামগালে। আট বছরের সুদীর্ঘ সময়ও সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কণামাত্র মুছে দিতে পারেনি তার স্মৃতি থেকে, বরং বহুদিন এই মুহূর্তটা সজোরে ধাক্কা মেরে গেছে তার চোখের পাতায় এবং তার গোবেচারা মধ্যবিত্ত মানসকে খাবলে খামচে দিয়ে গেছে নিয়ম করে। কী এক অক্ষম ক্রোধ সাজ্জাদ হাসফাস করত প্রতিদিন! তার মনে হতো বিশ্বসুদ্ধ মানুষজন এই দৃশ্যটা দেখে ফেলছে, আর সেই হেঁটে যাওয়ার সময়েই যেন তারা তা নিয়ে কানাকানি শুরু করে দিত নিজেদের মধ্যে। তারপর কখন যে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা ডিটলসসহ থিতিয়ে গেছে, তার মস্তিঙ্কের অজানা খাঁজে তা সে নিজেও জানে না।
সাজ্জাদের সামনে বসে থাকা এই লোকটাই তার স্বাভাবিক তারুণ্যের গতিকে আটকে দিতে চেয়েছিল, যা ছিল তার কাছে নিছকই একটা সাধারণ ঘটনা। এই সেই সেলিম আট বছরের ব্যবধান যাকে শুষে ছিবড়ে নিঃস্ব ভিক্ষুক বানিয়ে এনে ফেলেছে সাজ্জাদের সামনে। জট বাধা নোংরা চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, এখানে-সেখানে চটা ওঠা কালচে ঠোঁট আর নোংরা চিমসানো পাঞ্জাবি, যেটার প্রকৃত রঙ আর চেনা যায় না কোনোভাবে; মোটকথা একজন প্রকৃত পাগলের আকারে নিয়তি যেন তাকে ছুড়ে দিয়ছে সাজ্জাদের সামনে। তাকে দেখে সাজ্জাদের করুণা হচ্ছিল না, বরং পেট ওগড়ানো কিসের যেন ঝাঁজালো এক পিণ্ড সাজ্জাদের পিত্ত ঠেলে গলায় উঠে আসতে চাইছিল। সাজ্জাদ খেয়াল করে দেখল, এটা একটা দুর্বিনীত ক্রোধের জটা পাকানো পিণ্ড, যা তার নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে দানা বেঁধে ছিল অনেক বছর। এই যে মানুষের মতো দেখতে অদ্ভুত জন্তুটা তার দিকে কাতর চাহনি মেলে তাকিয়ে রয়েছে, সে তো সেই লোকটাই যে তাকে কোনো একদিন নিজের বীরত্ব দেখাতে চেয়েছিল ডান হাতের চটা দিয়ে তীব্র জোরে চড় কষিয়ে। মনের অজান্তেই সাজ্জাদের হাত চলে গেল নিজের বাম গালে। সাজ্জাদের সামনে রাখা হালিমের বাটিটা যেন তাদের দুজনের মধ্যে সংযোগের সুতো গেঁথে দিতে প্রস্তুত। বাটিটি যেন তাকে আহ্বান জানিয়ে অপেক্ষা করছে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তের। নির্নিমেষ কয়েক মুহূর্ত সেলিমের দিকে তাকিয়ে থেকে আলগোছে সমস্ত দৃশ্যপটে চোখ ঘুরিয়ে নিল সাজ্জাদ। হোটেলে লোকজন তেমন একটা নেই। দূর একটা বাচ্চা ছেলে নোংরা ন্যাকড়া দিয়ে ফ্লোরটাকে ঘষে-ঘষে পরিষ্কার করছে, বয়দুটো নিজেদের মধ্যে আলাপে ব্যস্ত, দুতিনটা ছেলে আয়েশ করে আড্ডা পিটাচ্ছে এককোনায়। ক্যাশে-বসা লোকটাও তাকিয়ে নেই এদিকে। এসব মানুষগুলোর কোনো আগ্রহই নেই তাদের দুজনের প্রতি। তারা তো জানে না, স্মৃতিতে গেথে বসা একটা অপমানের তীব্র চোরাস্রেত সাজ্জাদের দিকে ধেয়ে আসছিল প্রতিপক্ষের দুর্বলতম আত্মসমর্পণের পরিপূর্ণ ফায়দা নিতে।
সাজ্জাদের চামচটা প্রায় মুখের সামনে এনে পেটের মধ্যে থেকে ঝাঁকিয়ে তোলা একদলা হালিম-মেশানো হলদে থুথু মুহূর্তেই উগড়ে দিল চামচের মধ্যে এবং সন্তর্পণে বাটির মধ্যে সেটা কয়েকপাক গুলিয়ে সেলিমের সামনে ঠেলে দিয়ে বলল—‘নে, খা!’
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন