অপ্রেমের গল্প
[এক শকুন আমার পায়ে ঠোকরাতে ঠোকরাতে বিক্ষত করে যাচ্ছিল। জুতা ও মোজা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার পর এখন পা দুটোয় ঠোঁট দিয়ে খোচাচ্ছে। একবার দুই পায়ে ঠোকরায়, তারপর অস্থিরভাবে আমাকে ঘিরে চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করে এবং আবার আমাকে ঠোকরানোর পরিশ্রম করতে থাকে। এক লোক আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমাদের দুজনের দিকে একবার তাকায়, তারপর জানতে চায় কেন আমি শকুনের শিকার হলাম।
‘কেন! আমি অসহায়,’ বললাম তাকে, ‘ও এসে আমাকে ঠোকরাতে শুরু করল, আমি স্বাভাবিকভাবেই ওকে তাড়ানোর চেষ্টা করেছি, ওর গলা টিপে ধরেছি; কিন্তু প্রাণিটার অনেক শক্তি। সে তো আমার মুখ বরাবর লাফিয়ে উঠে আক্রমণ করেছিল। পরে আমার মনে হলো, পা পেতে দেওয়াটাই ভালো হবে। এখন তো ওর ঠোকরে আমার পা ছিঁড়ে প্রায় আলাদা হয়ে যাচ্ছে।’
‘মানে, তুমি নিজেই এভাবে তোমার পা দুটোকে বিক্ষত হতে দিচ্ছ, আজব’, লোকটি বললো, ‘একটা মাত্র গুলি, সঙ্গে সঙ্গে শকুন খতম।’
‘তাই?’, আমি বললাম, ‘দয়া করে করবা ভাই কাজটা?’
‘সানন্দে’ লোকটি বললো, ‘আমি এই বাড়িতে যাব আর বন্দুক নিয়ে আসব। তুমি কি আর আধঘণ্টা ধৈর্য ধরতে পারবে?’
‘জানি না’, ব্যথায় এক মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়ে গিয়ে আমি বললাম। তারপর বললাম, ‘কৃপা কর, যেভাবেই হোক, চেষ্টা কর।’
‘বেশ’, সে বললো, ‘যত তাড়াতাড়ি পারি আমি আসছি।’ আমরা যখন কথা বলছিলাম, শকুন শান্ত হয়ে আমাদের কথা শুনছিল। তখন সে একবার আমার দিকে, আরেকবার লোকটির দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম যে, শকুন আমাদের প্রতিটি কথা বুঝেছে। শকুনটা আবার পাখা মেলল, পেছনের দিকে ঝুঁকে গেল, বর্ষা নিক্ষেপকারীর মতো পেছনে ঝুঁকে বিপুল শক্তি নিয়ে লাফিয়ে উঠে আমার মুখ দিয়ে ওর ঠোঁট ঢুকিয়ে দিল আমার গভীরে। পেছনে ধপাস করে পড়ে গিয়ে আমি এটা অনুভব করে স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে, শকুনটা অবাধে আমার রক্তে ডুবে যাচ্ছে, আর আমার রক্তে ভরে যাচ্ছে সকল গভীর খাদ এবং ভেসে যাচ্ছে সকল কূল-কিনারা।–ফ্রান্ৎস কাফকা]
ত্রিশোর্ধ টগবগে স্ত্রৈণ দুই সন্তানের এক পিতাকে একদিন চুম্বন করার পর আমার নেশা হয়ে গেল। ওর স্ত্রীর মতো করে আমি ওকে তিন্নির বাপ ডাকতে শুরু করলাম। সে আমার কোলে শুয়ে প্রমত্তা মেঘনায় ভাসতে ভাসতে এক ঝলমলে জোছনা রাতে মরে যাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। স্বপ্নে ওর মরদেহ মেঘনায় ভেসে যাচ্ছে আর কয়েকশ’ মাছ ওর মাংস, ধমনি-শিরা, রক্ত আর হাড়ের রস খেয়ে একরাতে বড় বড় রপ্তানিযোগ্য মাছ হয়ে যাচ্ছে। ও বলে যে, কিছুতেই ওর মরদেহ ডাঙায় পড়ে থেকে যেন শকুনের খাদ্য না হয়! স্বপ্নের মতো জলমগ্ন মৃত্যুর সাধ পূরণ করার জন্যই নাকি আমার সঙ্গে যখন দেখা হয় না তখনও সে বেঁচে থাকে, পরিবারের সাথে সময় কাটায়, আর আমার সঙ্গ লাভের অপেক্ষা করে। যদিও ও জানে যে নদীতে মরদেহ বিসর্জন নিষিদ্ধ হবার পর চারদিকে দিন-রাত আলোর পাহারা বসানো হয়েছে, একটু এদিক-ওদিক হলেই গুলি করা হবে। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম, চোখের সামনে প্রিয়জনের গুলি খেয়ে মেঘনার ঢেউয়ে মিশে যাওয়ার দৃশ্য দেখব, তারপর মিডিয়ার সামনে গভীর শোক প্রকাশ করব, একটা উদ্ভট লোকের সাথে পাগলামী করার মাধ্যমে জীবনে বৈচিত্র্য যুক্ত করব।
প্রেমে পাগল হবার ভান করা অস্বাভাবিক কিছু নয়, বিশেষ করে চল্লিশের কোঠায়, হয়তো খানিকটা ব্যতিক্রমী, কিন্তু বিস্ময়কর কিছু নয়। আসলে যা কিছু স্বাভাবিক তা হয়তো ভালোই, তবে ঠিক উপভোগ্য নয়, কেননা তাতে বৈচিত্র্য থাকে না। আমার মনে হয়, জীবন যখন একঘেয়ে হয়ে ওঠে, তখন মানুষ মরে যেতে চায়। মরে যাওয়াটা আজকাল ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। কিন্তু মরে যাবার পর বেঁচে থাকা মানুষগুলো যে কি বিষম ঝামেলা পোহায়, ওরা জানে না। মরদেহ সৎকার করতে মানুষের দীর্ঘ সময় চলে যায়, কাজ পেছায়। গোরস্থানে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়, আগে থেকে বুকিং দেওয়া না থাকলে বডি প্রিজারভেটিভের পেছনে বিপুল খরচা হয়ে যায়, গোর-খোদককে এক্সট্রা পেমেন্ট দিতে হয়ে, পুলিশের ছাড়পত্র নিতে টাকা লাগে, ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হয়, এমনকি আমার মতো প্রভাবশালী লোকজনও পেরে ওঠে না। কিন্তু গুলি খেয়ে মরলে কোনো ঝামেলা নেই। নিষেধের আইন ভেঙে যারা মরে, তাদেরকে কেউ চেনে না। পরিবারের লোকজন পর্যন্ত লিখিত বিবৃতি দেয়—হ্যাঁ, ওকে আমরা চিনি, আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের পরিবারে একটা আউট ল জন্মেছিল, কিন্তু ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার পরিবার নিতে পারে না, ওর মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিতান্ত ব্যক্তিগত। এসব কারণে পুলিশ সহজে গুলি করতে চায় না, ভয় দেখিয়ে কাজ সারে। তবে, আমি পুলিশকে ম্যানেজ করব। আজকাল ম্যানেজ করেই তো বাঁচে সবাই।
সেদিন, নগরের বাইরে, নগরে পরিণত হওয়া গ্রাম থেকে বহুদূরে, হাওর ম্যানুফ্যাকচার করে বানানো ঝিলের পাড়ে, আকাশের তলায়, এক ক্যাফেতে বসে, পাশের টেবিলের চোখের সামনে, আমি তিন্নির বাপের ঠোঁট থেকে আইসক্রিম তুলে নেওয়ার ছলে গভীর চুম্বন করলাম। ও নিঃশ্বাস বন্ধ করল। পরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল মাথা উপরের দিকে তুলে। উপরেই তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর শব্দ করে শ্বাস ছাড়ল। ওকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। মনে হলো, ওর মধ্যে এমন একটা ভাবের উদয় হয়েছে যার কারণে সে কি করবে বা কি বলবে তা বুঝতে পারছে না। পরে মুচকি হেসে বলল, চুম্বনের মাধ্যমে ও নাকি প্রাণায়াম করে—নিঃশ্বাস বন্ধ রাখে, তারপর ছাড়ে, আস্তে আস্তে, তারপর লম্বা নিঃশ্বাস নেয় আবারও, আবারও চুম্বন করবে বলে। তখন ওকে আশ্চর্য শান্ত, স্থির দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমি একটা চিৎকার শুনতে পেলাম। তিন্নির বাপের শান্ত দেহের খুব ভেতর থেকে চিৎকারটা আসছিল। মনে হলো যেন অদৃশ্য কারো কাছে জানতে চাইছে ওর পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে। কিন্তু চিৎকারটা আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পচ্ছে না। চতুর্দিকে সবকিছু স্বাভাবিক। তিন্নির বাপকেও স্বাভাবিক অথচ উদ্দীপ্ত লাগছিল। ব্যাপারটা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছিলাম না, কেউ বিশ্বাস করবে না। বলবে, এটা আমারই মনের ভুল। রাজনীতি করতে করতে সমাজটাকে আমার চেনা হয়ে গেছে। সবকিছুকে সন্দেহের চোখে দেখাই সমাজের কাজ। অতএব, নির্লিপ্ত থাকতে হবে। আমিও নির্লিপ্ত স্বরে শুকরের মাংস এবং দূর পাহাড় থেকে চামেকো লরিতে পরিবাহিত পাহাড়ি মদের অর্ডার দিলাম। তিন্নির বাপ বলল, ‘শুকরের মাংস খাইতে পার?’ আমি উত্তর দেবার আগেই নিজেই আবার বলল, ‘না, মানে, এইটা আমি খাই নাই, বিশ্বাস কর; দেখি ট্রাই করে।’ ওর ভেতরের চিৎকারটা কি বলতে চাইছে তা বোঝার জন্য আমি ওকে আবারও চুম্বন করতে সামনে ঝুঁকলাম। চ্চৎ! টেবিলের উপর রাখা ওর মোবাইল ফোনটা টেরেরেং টেরেরেং করে বেজে ওঠার সাথে সাথে ওর বউয়ের মুখের ছবি স্ক্রিনে ভেসে ওঠল। আমি একটুও না চমকে কোমর সোজা করে বসলাম। একটা আজব সাউন্ড সিস্টেম ওর ফোনের, কাছাকাছি থাকা লোকেরা সবাই কলারের কথা দিব্যি শুনতে পায়। এ বিষয়ে ও বলে যে ‘আমার ফোনে তো গোয়েন্দারা আড়ি পাতেই, সুতরাং জগত জানুক আমার সকল কথা, একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমি তো কথা শোনাতেই চাই, প্রাইভেসি আমার ভাল্লাগে না।’
ফোনে ওর বউ বলছে, ‘তিন্নিকে স্কুল থাকি এক্সপেল করসে। অই যে ওদের স্কুল-গেটের সামনে চিকেন ফ্রাই বিক্রি করে যেই লোকটা, যার ভ্যানের উপ্রে গ্যাস সিলিন্ডার বসানো, ডেঞ্জারাস লোক, সেইখানে মরা মুরগী পড়ে থাকতে দেখে তিন্নি নাকি বলছিল—এইটা খাওয়াইবেন? মরা মুরগি খাওয়াইতেছেন?—তাই নিয়ে তুলকালাম... প্রিন্সিপাল বলছে, তিন্নি নাকি মিথ্যা অভিযোগ তুলছে একজন তরুণ উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে... তারা মিথ্যা বলা বাচ্চাকে স্কুলে রাখবে না... তুমি স্কুলে যাও...’। আমি বললাম, ‘আমিও যাব।’
পাহাড়ি মদ আর শুকরের মাংস পাশের টেবিলে গিফ্ট করে দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সোজা তিন্নির স্কুলে গেলাম। প্রিন্সিপালের ঘরে হাজির হলাম, বললাম, ‘আরে স্যার মরা মুরগি ফ্রাই করার ঘটনা তো সত্য, তবে এইটা খুব সিরিয়াস কোনো সত্য না, সবখানেই মরা মুরগি দুই-চারটা রান্না হয়, খালি মরা মুরগী কেন হবে, মরা গরু, মরা খাসি, কিছুই মানুষ আর ফেলে না, ফেলবেই বা কেন... সব মাংসেরই দাম চড়া তো, স্যার...।’ প্রিন্সিপাল চেয়ার থেকে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘আপনি কে? আপনাকে তো আগে দেখি নাই!’ তিন্নির বাবা আমতা আমতা করে জানায়, ‘ইয়ে, উনি... ওনাকে তো চেনার কথা... উনি শিক্ষামন্ত্রীর কাছের মানুষ... অবশ্য আপনি হয়তো আর সবার মতোই, টেলিভিশন দেখেন না, দেখলে নিশ্চয় ওনাকে চিনতেন... আরে স্যার, উনি পাশে ছিলেন বলেই শিক্ষাামন্ত্রীর এত এত সাফল্য... সেইটা বড় কথা নয়, স্যার, আসল কথা হলো, উনি আমার বন্ধু... আমি, মানে, এই দেশের বুদ্ধিজীবী একজন, সুশীল সমাজ আর কি, পুরষ্কার পাই নাই বইলা আমারেও চিনবেন না, সেইটাও বড় কথা নয়, স্যার, তবে তিন্নির বাপ যে আমিই সেইটা তো জানেনই... তিন্নি, আমার নয়নমনি... মরা মুরগি রান্না যে হয়—ব্যাপারটা ওর জানার কথা না, শিশু তো... মানে এইটা যে ঘটে সেই তথ্য তো আপনারা ওকে দেন নাই। এগুলো আস্তে আস্তে জানতে জানতেই তো শিশুরা বড় হবে... সুতরাং একটা কমপ্লেন করছে তিন্নি, কমপ্লেন করার স্কিল যে হইছে সেইটা তো দারুন ব্যাপার, এইটা ওর পার্ট অব এডুকেশন... এই ঘটনায় তো ওরে এক্সপেল করতে পারেন না!’
আই বাপ, কোনো দ্বিধা নয়, বিভ্রান্তি নয়, একজন পাকা বুদ্ধিজীবীর মতো ভাষণ দিয়ে ফেলল তিন্নির বাবা, এমনকি আমার পরিচয় দেওয়ার সময় ওর স্মার্টনেস যেন আরও টান টান হয়ে উঠল! প্রিন্সিপাল আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন। আমিও প্রিন্সিপালের চোখের দিকে ততোদিক সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘স্কুলের সামনের ফুটপাত ফাস্ট ফুডঅলাদের ভাড়া দিয়ে ভালোই কামাইতেছেন, নাকি, স্যার?’ প্রিন্সিপাল থতমত খেয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, তিন্নিকে তো এক্সপেল করি নাই, জাস্ট এক্সপেল করার গুজব ছড়াইছি! কি বলব ম্যাডাম, দায়িত্ব, স্কুলের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাকে দুই-একটা গুজব ছড়াইতে হয়। আপনে তো জানেন, এবং বোঝেন, এই মরা মুরগির চিকেন ফ্রাই ভেন্ডররা দুর্ধর্ষ, ওরা দলে-বলে স্কুলে হামলা করে বসতে পারে, পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে তো আমাকে, চাকরি থাকবে না তো নইলে। ফুটপাত ভাড়া না দিলে এলাকায় স্কুল চালাইতে পারা যায় না, যায়? ম্যাডাম, আপনি জানেন... বিশ্বাস করেন, ফুটপাত ভাড়ার টাকা একটাও স্কুলে আসে না, নেতাদের ম্যানেজ করে চলতে হয় তো আমাদের... নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তার প্রশ্নে...’। তারপর প্রিন্সিপাল সাহেব তিন্নির বাবাকে তিন্নির জন্য সাতদিনের ‘ছুটি চাহিয়া আবেদন’ করতে বললেন। আরও বললেন, ‘সাতদিন বাদে এই ইস্যুটা এমনিতেই ঢাকা পড়বে। কোনো ইস্যুই এক সপ্তার বেশি আর টেকেই না। তাছাড়া, তিন্নির ক্লাস-টিচারকে বলে দিচ্ছি, তিন্নি যাতে এবার ফার্স্ট না হলেও সেকেন্ড বা থার্ড হয়, সেজন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া হবে। হে হে, ম্যাডাম, আপনি তো জানেন, এক থেকে দশের মধ্যে প্লেস করলে আমরা তো টিউশন ফি ফ্রি করে দিই... কফি দিতে বলি, ম্যাডাম?’ ‘না, থাক’, প্রিন্সিপালকে বললাম, ‘সিস্টেম বোঝার জন্য, থ্যাংকস।’
স্কুল থেকে বের হয়ে তিন্নির বাপ তিন্নির মাকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি বন্ধ করতে বলল এবং ফোনের সাউন্ড সিস্টেম উপচে ওঠা তিন্নির মায়ের হাসি আমি শুনতে পেলাম। ততক্ষণে বিকেল গড়াতে শুরু করেছে। ওকে বললাম, ‘এখন কিন্তু পাহাড়ি মদ আর শুকরের মাংস বেশি জমবে, যাবা, আবার, ম্যানুফ্যাকচার্ড ঝিলের পাড়ে?’
ও বললো, ‘ওরাও কি মরা শুকর খাওয়ায়?’
আমি বললাম, ‘জীবন্ত প্রাণি খাওয়া যায়, বলো? মরাই তো খাই। জবাই করি, তারপর মরার অপেক্ষা করি, তারপর সেটার পালক বা চামড়া ছিলে টুকরো টুকরো করে কেটে রান্না করি, ঝলসাই, এবং খাই।’
‘কিন্তু ধরো, শুকরটা অসুখ করে মরে থাকে যদি...,’
‘অসুখ, ধ্যাৎ! তুমি জান, দেশে কত খামার এখন গরু-খাসির? কত হাজার লক্ষ পোলট্রি? সেখানে কি প্রাণিগুলো মরে না? প্রতিদিন মরে। সেগুলো ফেলে দেওয়ার কথা শুনছো কোনোদিন? তো, কি করে? ভাতের দোকানে বেচে দেয়, সস্তায়। তাতে সব পক্ষেরই লাভ। শুনছো নাকি যে হোটেল-রেস্টুরেন্টে মাংস খেয়ে কেউ মরছে? আবে হালায়, মরা মুরগী তো মরা মুরগী মানুষ যে রোজ কুকুর খাচ্ছে না তারই বা নিশ্চয়তা কি! দেখ, রাস্তায় কুকুর মরে পড়ে থাকতে দেখ আজকাল? কুকুরকে আর মরতেই দেয় না কুকুর অধিকার ফোরামের লোকেরা! তারাও জানে, ভালোই চলে কুকুরের মাংস। সুতরাং যেকোনো মরদেহ যদি ঠিকঠাক প্রসেস করে পাতে দেওয়া যায়... ব্যাপারটা তো প্রশংশনীয়! খেপতেছ কেন?’
‘কিন্তু থাক, আমার শরীরটা ঠিক লাগছে না।’ বলে তিন্নির বাপ।
আমি হেসে বললাম, ‘এই তো অজুহাত খাড়া করছ! আরে পাগল, তুমি যে মানুষের মাংস খাচ্ছ না তা কি বলতে পারবে নিশ্চিত করে? এটা তো জানো, কখনও কখনও মানুষের মাংস খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না? এখন তো মানুষ অসুখে মরে না, মরে? হয় আত্মহত্যা করে, নয় দুর্ঘটনায় মরে অথবা গুলি খায়, খুন হয়। দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সামনে অসুখ দাঁড়াতে পারে? পারে না। দেশের মানুষ দেখতে কত সুন্দর হয়ে উঠছে, দেখ, মানুষের মাংস আমি না খাইলেও অনুমান করতে পারি যে খাসির চেয়েও স্বাদ বেশি হবে। একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তোমার অজানা নয় যে এখন আর মরদেহ বলে কিছু নাই, এমনকি গরুও মরে না অসুখে। মরে যাওয়াটা, মানে, মানুষের এবং যেকোনো প্রাণির মরে যাওয়া এখন সোশ্যাল চয়েস। মরা-পচা-গলিত শব আর তুমি কোথাও দেখবে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো দেশে আর শকুন নাই, নিশ্চয় জান তুমি। মরদেহ পড়ে থাকে না বলে শকুনের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। শকুনের বিলুপ্তি একটা দুঃখজনক ঘটনাই...’
আমার কথা শেষ হবার আগেই তিন্নির বাবা দৌড়ে গিয়ে চলন্ত রাস্তায় পা দেয়, এবং মিলিয়ে যায়। নগরে চলন্ত রাস্তা চালু হবার পর যে কেউ যেকোনো সময় রাস্তায় উঠে পড়লেই কোথাও না কোথাও চলে যেতে পারছে!
আমার আশ্চর্য লাগে, এইরকম একটা ব্যাকডেটেড লোকের প্রতি আমার মতো একজন ডিস্টিংগুইশড লেডি আকৃষ্ট হয়েছিলাম! আমাকে নেগলেক্ট করল! হাহ! ওকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, উচিত শিক্ষা দিতে হবে। আমি তিন্নির বাপের নামে মানহানীর মামলা ঠুকে দিলাম।
দুদিন পরেই কোর্টের অর্ডার পাওয়া পুলিশ জানালো, তিন্নির বাবাকে সরকারি রিহ্যাবে পাঠানো হয়েছে। লোকটা নাকি বদ্ধ উন্মাদ। গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশ দেখে, তিন্নির বাবা ওদের সতের তলা ভবনের ছাদে একটা শকুনের মরদেহের সামনে হাতজোড় করে বসে আছে। শকুনটা নাকি ওদের ছাদের উপর দিয়ে যাবার সময় বৈদ্যুতিক তারে ধাক্কা খায় এবং ছাদের উপর এমনভাবে আছড়ে পড়ে যে বিকট শব্দে ভবনের, চার গুণন ষোল, অর্থাৎ, চৌষট্টি পরিবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শকুন দেখতে যারাই ছদে গিয়েছিল, সবাইকে তিন্নির বাপ কামড়ে দিয়েছে। ‘ও আসলে পাগল হইছে, পুলিশ ভাই, আমাদের পরিবারটা বাঁচান’, বলে তিন্নির মা পুলিশের সামনে হাউ মাউ করে কেঁদেছে। ভেরি স্যাড!
তিন্নির বাবাকে দেখতে আমি রিহ্যাবে গিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের মতো আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কেন তিন্নির বাবাকে পাগল মনে করছে সবাই। নিশ্চয় ওকে বাঁচাতে চাইছে আইনের হাত থেকে। আমিও ছেড়ে দিলাম। বেশ দরদ মাখানো স্বরে তিন্নির বাপের সুস্থতা কামনা করলাম। রিহ্যাবের জানালার ওপারে বসে তিন্নির বাপ আমাকে বলে, ‘একটা শকুনও আর বেঁচে রইল না, আমি এখন ডাঙাতেও মরতে পারব। একটা ধু ধু প্রান্তরের ঘাসের উপরে মরে যেতে চাই, নিয়ে যাবে আমাকে?’ কথা বলার সময় সে হাতজোড় করে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাতজোড় করে কুঁজো হয়ে কথা বলা মানুষ আমার দুই চোখের বিষ।
বাহ! ভালো লাগল গল্পটা। ভিন্ন স্বাদের (হয়তো মানুষের মাংসের মতন)
ফিরোজ এহতেশাম
সেপ্টেম্বর ০১, ২০২৪ ০১:৫০