কাটা ঘুড়ি

অ+ অ-

 

সকালে ঝলমলে রোদ উঠেছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের নীলে ছানাকাটা পাঁশুটে ছোপ পড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতি একেবারে থম মেরে আছে। অসহ্য গুমট গরমে দর দর করে ঘাম হচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে গলা শুকিয়ে কাঠ, এই মুহূর্তে একটু জল পেলে ভালো হতো।

সামনের বারান্দায় নানা মানুষের জটলা। প্রত্যেকেরই চোখমুখ গম্ভীর। সুমিতার বর পেছনের ব্যালকনিতে খালি গায়ে বসে ঘন ঘন কাশছে। ক্রনিক হাঁফানির রোগী, শ্বাস টানার জন্যে বুকের খাঁচাখানা হাঁফরের মতো ওঠানামা করছে। অত্যধিক রোগা হওয়ায় পাঁজরগুলো এত স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে যে, ইচ্ছে করলেই গুনে নেওয়া যায়। ওর বেশি বয়েসের দ্বিতীয় পক্ষ রান্নাঘরে সর্ষের তেলের খোঁজ করছিল। না পেয়ে জিজ্ঞাসু মুখে আমার সামনে বার কয়েক পাক মেরে গেল। এমন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে রুগ্ন-হেঁফো স্বামীর বুকে তেল মালিশ করার দৃশ্যটা হয়তো সতীসাধ্বী রমণীর পতিসেবার একটা আদর্শ বিজ্ঞাপন হতে পারত।

আশপাশের কোয়ার্টার থেকে প্রতিবেশীরা এসে নানা কেজো আলোচনা করছেন। বাবলা, মানে সুমিতার একমাত্র গুণধর পুত্র বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ফুল, মালা, খইটই আনতে গেছে। বেরবার আগে সে আমার কাছে টাকা-পয়সার খোঁজ নিতে এসেছিল। শেষের দিকে সুমিতার কাছে টাকা-পয়সা একেবারেই ছিল না। কয়েক মাস ধরে ওষুধ আর চিকিৎসার জন্যে জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছিল। এ মাসে রামেশ্বরের থেকে দুহাজার টাকা ধার পর্যন্ত করতে হয়েছে। কিন্তু বাবলাকে সেকথা বলে লাভ নেই, বিশ্বাস করবে না। এ মাসের শুরুতেও সে মাসোহারা আদায় করতে এসেছিল। যথারীতি যা নয় তাই বলে কুৎসিত গালাগালের শেষে জবরদস্তি করে সেটা নিয়ে গিয়েছিল।

আমাকে খিস্তি করাটা ওর পবিত্র কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই যতক্ষণ ছিল, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার উদ্দেশে পুরনো ধারাল কুকথার সঙ্গে সাম্প্রতিকতম উদ্ভাবিত দেবভাষার মিশেল অকৃপণভাবে বর্ষণ করে গেছে। শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিল, কদর্য শব্দ আবিষ্কারের জন্যে যদি কোনও পুরস্কার থাকত, তাহলে নিশ্চিত সেটি বাবলার ঝুলিতেই যেত।

মাস তিনেক আগে আমার একটা ছোট গল্প আর একটা রম্য রচনা ছাপা হয়েছিল। সেই বাবদ সাকুল্যে আড়াই হাজার টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল, কিন্তু মিনিমাম ব্যালান্স না থাকবার জন্যে ব্যাংক ঊনষাট টাকা কেটে নিয়েছে। বাকি টাকা থেকে জীবনদাকে একহাজার দিতে হয়েছে। সুমিতা হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে জীবনদার পাইস হোটেলই আমার ভরসা। প্রথমত আমি তেমন রাঁধতে-টাঁধতে পারি না। তার ওপর দিনভর হাসপাতাল, ডাক্তার আর ওষুধের পেছনে চক্কর কাটতে কাটতেই দিন কাবার হয়ে যাচ্ছিল। ঘরে ফিরে উদরপূর্তির জন্যে হাঁড়ি-কড়াই ধরার মতো অবস্থা থাকছিল না।

সেই টাকা থেকেই বাবলাকে হাজার খানেক দিতে হল। টাকাটা ও এমন আলগোছে নিল, যেন আমার ছোঁয়া লাগলেই ওর জাত চলে যাবে। তারপর খুচরো নোটগুলো গুনে নিয়ে চোখমুখ কুঁচকে খুব বিরক্ত স্বরে বলল, মোটে এক হাজার!  ফুল-মালা, খাট, খইটই, এতে কখনও হয়?

আমি বললাম, আমার কাছে আর নেই।

শুনেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। চার অক্ষরের একটা চোখা খিস্তি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, নেই মানে? ইল্লি আর কী! মার সব টাকা তো তুমিই গাব করেছ, নেই বললে হবে? ভালোয় ভালোয় মাল ছাড়ো, নইলে কুরুক্ষেত্তর হয়ে যাবে বলে রাখলাম।

বাবলার এত চোটপাটের মধ্যেও ওর সুমিতাকে মা বলে উল্লেখ করাটা কানে বেশ লাগল। সুমিতা শুনতে পেলে নিশ্চয় খুশি হতো।

আচ্ছা ঢ্যামনা লোক তো মাইরি! দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! আরও কিছু ছাড়ো। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে! মাঝরাতের বাসি মড়া, দেরি হলে পচে ঢোল হয়ে যাবে সে হুঁশ আছে!

ওর নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। কঠিন গলায় বললাম, বলেছি তো, আমার কাছে আর নেই।

আমার গলা দিয়ে এমন কঠিন স্বর বেরতে পারে, এটা হয়তো বাবলা ভাবতে পারেনি। তাই প্রথমটায় একটু থতমত খেল। কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিগুণ তেজে গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচিয়ে বলল, রোয়াব দেখাচ্ছিস? ঠিক আছে, ফিরে আসি, তারপর তোকে মজা দেখাচ্ছি। শালা ভেড়ুয়া কোথাকার! মনে রাখিস, তুই শালা শুধু একটা ফুঁয়ের মামলা!

তারপর ওর স্টকে যত রকম অপশব্দ ছিল, সেসব অকাতরে উজাড় করে দিতে দিতে সঙ্গে আনা জনা দুয়েক ইয়ারদোস্তকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

ইতিপূর্বে বাবলার সঙ্গে আমার যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে, প্রত্যেকবার অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ওর যতরকম কদর্য গালাগাল জানা আছে, সবই নিবেদন করে গেছে। প্রথম প্রথম তবু নলচের আড়ালে তামাক খাওয়ার মতো আপাত-আড়াল রেখে শব্দবাণ ছুড়ত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আড়াল-আবডালটুকুও সরে গেছে। ফলে এখন যা কিছু বলার, অত্যন্ত সততার সঙ্গে বিন্দুমাত্র রাখঢাক রাখে না।

সুমিতা থাকলে অবশ্য দা-বটি, হাতের কাছে যা পেত, তাই নিয়ে তেড়ে যেত। কিন্তু তাতেও বাবলাকে থামানো যেত না। বরং গলার স্বর এবং কেচ্ছার চটক যেত বেড়ে।

বাবলার এহেন কুনাট্যে অবশ্য এই সরকারি আবাসনের অন্যান্য বাসিন্দারা এতকাল খুব মজা পেয়ে এসেছে। একটা উনিশ-কুড়ি বছরের বখে-যাওয়া নেশাড়ু যুবক সর্বসমক্ষে উচ্চৈস্বরে কান লাল-করা ভাষায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের মায়ের কেচ্ছা নিবেদন করছে, এর চাইতে আমিষ-গন্ধী বিনোদন আর কী-ই বা হতে পারে!

ইয়ে, মানে আলমারির চাবিটা কি তোমার কাছে?

আবার সেই মহিলা, সুমিতার হেঁফো বরের দ্বিতীয় পক্ষ। হাসপাতালে যাওয়ার আগে একদম শেষ মুহূর্তে সুমিতা চাবিটা আমার কাছে দিয়েছিল বটে, কিন্তু গতকাল হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকে সেটা আর খুঁজে পাচ্ছি না। হয় ওরা কেউ বের করে নিয়েছে, নয়তো আমার প্যান্টের পকেট থেকে কোথাও পড়ে গেছে। আমি ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে ঘাড় নাড়লাম।

নেই মানে? তুমি তার রসের নাগর ছিলে, তোমার কাচেই তো সে মাগীর যথাসব্বস্ব, আলমারির চাবি তোমার কাছে থাকবে নাতো কি ও পাড়ার বিশে বাগদির কাচে থাকবে? ভালোয় ভালোয় চাবিটা দিয়ে দাও বলচি, নইলে তুমি আমার গায়ে হাত দিয়েচ বলে এক্ষুণি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব বলে রাকচি।

বলতে বলতেই বুকের কাপড় সরিয়ে ব্লাউজের হুকে হাত দিল সে।

আক্রমণের ধরণটা চমৎকার। মহিলার অভিনয় দক্ষতারও তারিফ না করে পারা যায় না। কালো-কোলো গোলগাল মাংসল চেহারা। তরুণীই বলা চলে, সর্বাঙ্গে গ্রাম্যতার ছাপ। কুতকুতে চোখ দুটো থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। হিংস্র প্রাণির মতো যেভাবে এগিয়ে আসছিল, মনে হল কামড়ে দেবে হয়তো।

ঠিক সেই সময়ে কোত্থেকে সুপর্ণা এসে হাজির হল। হাতে একটা জলের বোতল এবং এক প্যাকেট বিস্কুট। সুপর্ণাকে দেখে একটু থমকে গেল সে।

সুপর্ণা বলল, কাল রাত থেকে তো পেটে কিছু পড়েনি। দুটো বিস্কুট খেয়ে জল খান, অমলদা।

সুমিতার খবর পেয়ে ওর সহকর্মীদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত একমাত্র সুপর্ণাই এসেছে। আরও কেউ কেউ আসবে নিশ্চয়। তবে শুনেছি, কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনচেতা এবং স্পষ্টবক্তা সুমিতার বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।

হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা নিতে নিতে সুপর্ণার মুখের দিকে তাকালাম। শুনেছি, সরকারি হাসপাতালের নার্সরা নাকি খুব কঠিন মনের হয়। সুমিতার মধ্যেও কখনও কখনও সেই কাঠিন্যের ঝলক দেখেছি। অথচ সুপর্ণা আমার মতো নিতান্ত অনাত্মীয় একজন পরাশ্রয়ী মানুষের জন্যে যে এতটা মমতা পুষে রেখেছে, তা আগে কখনও টের পাইনি। ঠাণ্ডা জলে চুমুক দিয়ে শরীরের সঙ্গে মনটাও যেন জুড়িয়ে গেল।

 

|| দুই ||

আবার মেঘ-ভাঙা রোদ উঠেছে। সামনের খোলা চত্ত্বরে নড়বড়ে সস্তা খাটিয়ায় সুমিতা চিত হয়ে শুয়ে আছে। মুখের লাবণ্য তার অনেকদিন আগেই চলে গিয়েছিল। নিয়মিত পরিচর্যায় ধরে রাখা অবশিষ্ট পালিশটুকুও গত দেড়-দুমাসের রোগ-যন্ত্রণা, বহুবিধ ওষুধ এবং রেডিয়েশানের কল্যাণে বিদায় নিয়েছে। চুলগুলো উঠে গিয়ে মাথাজোড়া মস্ত টাক। মুখখানা ঈষৎ হা-হয়ে থাকায় ওর গর্বের ঝকঝকে সুন্দর এবং সাজানো দাঁতের সারির ওপর দুপুরের রোদ ঝলকাচ্ছে। ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের ওপর কয়েকটা নীল ডুমো মাছি, বন্ধ চোখের পাতায় কে যেন দুটো তুলসি পাতা দিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে পুরো দৃশ্যটা এমন কুৎসিত হয়ে উঠেছে যে, চেয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গিয়ে সুমিতার গায়ের ওপরে চাপা দেয়া বিছানার চাদরটা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিলাম।

সুমিতার সতীন খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে বুঝি আমাকে দেখছিল।  চোখে চোখ পড়তে মুখ বাঁকিয়ে তীব্র ঘৃণার সঙ্গে  টিপ্পনি কাটল, আহা, সোহাগ কত! ভেড়ুয়া কমনেকার!

তারপর গলার স্বর খানিকটা চড়িয়ে বলল, একনো বলচি, চাবি কোথায় রেকেচ, ভালোয় ভালোয় দিয়ে দ্যাও। এ বেলারানিরে একনো চেনোনি তুমি। তুমার মতো মেনিমুকোরে কী করে ঢিট কত্তি হয়, সে বিদ্যে ভালোই জানা আছে আমার।

সুমিতা বেঁচে থাকতে ওর হেঁফো স্বামী কিংবা তার এই অতি যৌবনবতী দ্বিতীয় পক্ষ, কেউই এই হাউসিং-এর ধারে ঘেঁষতে পারেনি। আজ সুযোগ পেয়ে মহিলা সেই অধরা অধিকার সুদে-আসলে ফলিয়ে নিচ্ছে।

অসুস্থ অবস্থায় প্রথম যখন সুমিতা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, তখন আমার হাঁটা-চলার ক্ষমতা ছিল না। সারাদিন শুয়ে শুয়েই কাটত। তারপর একটু একটু করে যখন বাইরে বেরতে শুরু করলাম, তখনই টের পেয়েছিলাম, সুমিতার সম্পর্কে এই আবাসনের সকলেরই প্রবল কৌতূহল। কারও সঙ্গে দেখা হলেই আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, সুমিতার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক-এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন করত। সেই কৌতূহল ফিকে হয়ে আসার পর কথা বলা দূরে থাক, আমাকে সকলে কেমন যেন এড়িয়ে চলে। আজ অবশ্য চিত্রটা কিঞ্চিৎ ভিন্ন। আবাসনের লোকজন টুকটাক কৌতূহল মেটাতে আমাকেই এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে, পরামর্শ দিচ্ছে।

আলমারির চাবিটা হাতিয়ে ভাবচ বুঝি সব্বস্ব গাব করবে, তাই না? সে গুড়ে বালি। আমিও রইলুম একেনে থানা গেড়ে বসে। মড়ার সঙ্গে সোহাগ করে যে চুলোয় খুশি যাও, আমি নড়চি নে! তুমার মতন মিনমিনে জার আমি বহুত দেকিচি।

মহিলা হয়তো আরও কিছু বলত। কিন্তু হঠাৎ বাইরে একটা গোলমালের আওয়াজ ওঠায় কথা থামিয়ে বাইরে ছুটলো। আমিও পায়ে পায়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, বাবলা গেটের কাছে ছিটকে পড়ে গোঙাচ্ছে।

শুনলাম, সে আমার দেওয়া টাকায় আকন্ঠ মদ গিলে এসে উৎসাহের আতিশয্যে দেবভাষায় নিজের মায়ের নতুন কোনও আখ্যান শুরু করেছিল। সামনের ফ্ল্যাটের শোভন পুরকাইত নাকি আচমকা ওর গালে সপাটে থাপ্পড় কষাতেই বেচারার এই হাল। এতদিন যার কেচ্ছা শোনার জন্যে সকলে কান খাঁড়া করে থাকত, সে মারা যেতেই শিক্ষিত বাবুদের বিবেক হঠাৎ এতখানি জেগে উঠবে, এটা হয়তো ছোকরা আন্দাজ করতে পারেনি।

শবানুগমনের জন্যে আনা মালা আর রজনীগন্ধার স্টিকগুলো মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। খইয়ের ঠোঙাটা বুঝি ফেটে গিয়েছিল। বাতাসের টানে সারা কম্পাউনডে সেই খই উড়ে বেড়াচ্ছে। পুত্রের অবস্থা দেখে হয়তো সুমিতার রুগ্ন স্বামীর টান উঠেছে। ঘরের ভেতরে বসে উত্তেজিত হয়ে সে কী যে বলছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

সামনের ব্লকের বীরেশ্বরবাবু সমানে চেঁচাচ্ছেন, মারুন, আরও মারুন। মেরে হারামজাদার মুখ ভেঙে দিন। নিজের গর্ভধারিণী মা, তাঁকে নিয়ে কিনা!

আবাসনের আরও কয়েক জনও বাবলাকে সমানে শাসিয়ে চলেছেন। ভদ্দরলোকের বিবেক বলে কথা! বাবলা বুঝি টের পেয়েছে, আজ হাওয়া বিশেষ সুবিধের নয়। সে মুখ বন্ধ করে এমনভাবে নেতিয়ে পড়ে আছে যে দেখে মনে হচ্ছে, অজ্ঞান হয়ে গেছে বুঝি।

শোভনবাবুর সঙ্গে একসময়ে সুমিতার বেশ একটা আলোআঁধারি সম্পর্ক ছিল। অনেকদিন এমন হয়েছে, সুমিতার ডিউটি অফ, শোভনবাবুর মাস্টারনি বউ স্কুলে বেরিয়ে গেছেন। আমি হয়তো বারান্দায় বসে লেখার মকসো করছি, শোভনবাবু এসে আড়চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে সটান ঘরে সেঁধিয়ে গেছেন।

তখন আমি ছিলাম সুমিতার ঢাল। যতই অসুস্থ আর দুর্বল হই, একজন জোয়ান-মদ্দ তো বটে! তাই আমার উপস্থিতিতে ওদের সেই নিরালা যাপন নিয়ে কেউ কখনও তেমন সন্দেহ করেনি।

আমি অবশ্য ওসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি। সুমিতা না থাকলে হয়তো সেবার আমার হাসপাতাল থেকে ফেরাই হতো না। আমার অসুখ যখন বাড়াবাড়ির অবস্থায়, সেই সময়ে কারা যেন আমাকে সরকারি হাসপাতালে এনে ফেলে গিয়েছিল। বাঁচার আশা প্রায় ছিল না বললেই চলে। ভাগ্যিস হাসপাতলের নার্স সুমিতা আমাকে চিনতে পেরেছিল সেদিন। অত বছর বাদে আমার সেই ভাঙাচোরা ক্ষয়িষ্ণু চেহারা চিনতে পারাটা ওর পক্ষে কম কৃতিত্বের কথা নয়!

সম্পর্ক বলতে সেই কোন কিশোরবেলায় একই বাড়িতে কয়েক বছর ভাড়া থাকা। আমি ওর চাইতে ক্লাস দুয়েক এগিয়ে ছিলাম, তাই অঙ্ক কিংবা ইংরেজি আটকে গেলেই সুমিতা নিঃসঙ্কোচে আমার কাছে চলে আসত। মাঝে মাঝে বিনা প্রয়োজনেও আসত। কথা খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণ বোকার মতো চেয়ে থাকত, তারপর লাজুক মুখে নিঃশব্দে উঠে পড়ত।

সরকার থেকে উদ্বাস্তুদের জন্যে জমি দেয়া হচ্ছে শুনে হঠাৎ একদিন তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওরা কোথায় যেন চলে গেল।  সে সময়ে ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে আমি শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখি ওরা চলে গেছে, শুধু আমার অঙ্কের বইয়ের মধ্যে একটা ছোট্ট চিরকুট, আমরা চলে যাচ্ছি, পরে ঠিকানা জানিয়ে চিঠি দেব, উত্তর দিও কিন্তু

অবশ্য ওর পাঠানো ঠিকানায় কখনও চিঠি লিখতে ইচ্ছে হয়নি আমার। বয়ঃসন্ধির সেই আবেগ-জর্জর কালেও সুমিতার প্রতি আমার হয়তো তেমন টান ছিল না। এক তরফা দুচারটে চিঠি দেওয়ার পর সুমিতাও সেটা বুঝেছিল নিশ্চয়।

হাসপাতাল থেকে সে যখন আমাকে ছাড়িয়ে এনেছিল, তখন আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। কলকাতার সেকেন্ড ডিভিশনে খেলবার সময় পা ভাঙার পর ফুটবল ছাড়তে হয়েছিল। চাকরিবাকরি করি না, দাদা আর কতকাল টানবে। তার ওপর বৌদি ঝগড়ায় পিএইচডি। সেখান থেকে বেরিয়ে নানা ঘাটের জল খেতে খেতে কখন যে বয়সে ভাঁটার টেন এসেছে, টের পাইনি। শেষমেশ একটা সস্তার মেসে ঠাঁই নিয়েছিলাম। রোজগার বলতে খুচখাচ টিউশ্যানি, টুকটাক লেখালিখি এবং অনুবাদের কাজ, দিনরাত পরিশ্রম করে কোনও রকমে চলছিল। কিন্তু বাদ সাধল শরীর। ঘুসঘুসে জ্বর, আস্তে আস্তে কাশির দমকে দমকে রক্ত ওঠে, সারা গায়ে পাচড়ার মতো বিজবিজে ঘা। জ্বরে বেহুঁশ অবস্থায় কবে যে আমাকে সরকারি হাসপাতালে রেখে যাওয়া হয়েছিল, বুঝতে পারিনি।

সেই চূড়ান্ত দুঃসময়ে সুমিতা আমাকে আবিষ্কার করে তার কাছে নিয়ে এসেছিল। চান করানো, খাওয়ানো, ওষুধ-পথ্যের যোগান দেওয়া, এক কথায়, আমার এই পুনর্জন্ম সুমিতারই দান।

তবু সুস্থ হওয়ার পর আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একদম ভাবিনি, তা নয়। সে প্রভু, আমি তার আজ্ঞাবাহী ভৃত্য কিংবা ক্রীতদাস, এমনটা মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে সেই হারানো কৈশোরের কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি আমার মধ্যে কিছু অন্যায় প্রত্যাশার জন্ম দিত। তখন সুমিতাকে মনে হতো যন্ত্রমানবী। তার কাছে মানুষ মানে যেন শুধুমাত্র একটা রক্ত-মাংসের শরীর, শিরা-উপশিরা, অস্থি, মজ্জা, মেদ আরও নানা উপাদানের এক জটিল  সমাহার। এসবের মধ্যে মন বলে যে আলাদা কিছু থাকতে পারে, সেটা যেন ও মানতে চায় না।

আবার হয়তো কোনও বৃষ্টিভেজা দুপুরে কিংবা বর্ষণক্ষান্ত প্রদোষে সুমিতা সম্পর্কে আমার এই অনুভব বদলে যেত।  আমার সদ্য প্রকাশিত কোনও গল্প কিংবা কবিতার লাইন যখন সুমিতার গলায় খেলে যেত, তখন আমার মনে হতো, মুখে না বললেও সুমিতা আমার সৃষ্টির সবচেয়ে বড় অনুরাগী। কোনও কোনও দিন ও যখন পোষা বিড়ালের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে ওম খুঁজত, তখন মনে হতো, সে যেন অত্যন্ত আটপৌরে এমন এক মেয়েমানুষ, ইচ্ছে করলেই যাকে দুমড়ে মুচড়ে নিজের মতো করে পাওয়া যায়। আবার পরক্ষণেই সে যেন এক দুর্বোধ্য কবিতা ওঠে। প্রতিটি শব্দ চেনা, অথচ সামগ্রিকভাবে  অর্থ বোঝা দুষ্কর।

মাত্র মাস ছয়েক আগের কথা। স্টেশান থেকে ফেরার পথে রামেশ্বরের বউ আমাকে পাকড়াও করে বলল, তুমি কেমনধারা মরদ হে! না-ই বা হল বিয়ে করা বউ, মেয়েমানুষটা তো তোমারই বটে! তোমার চোখের সামনে সে নিত্যনতুন পুরুষ ধরে ফূর্তি লোটে, তোমার ঘেন্না হয় না?

সুদখোর রামেশ্বর জাতে বিহারি। তার বাঙালি বউ যে বয়সে ঢের বড়ো, এক নজর তাকালেই বোঝা যায়। কেউ কেউ বলে, বউ টউ সব বাজে কথা, আসলে ঐ মেয়েমানুষটাই রামেশ্বরকে টাকার লোভ দেখিয়ে ফুঁসলে এনেছে। যাই হোক, জোয়ান মরদ স্বামী নিয়ে বিগতযৌবনা ঐ মহিলার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। যেহেতু রামেশ্বর দরকার হলেই সুমিতার ফাই-ফরমাস খেটে দেয়, রাস্তায় দেখা হলে স্কুটারে তুলে স্টেশানে পৌঁছে দেয় এবং কোয়ার্টারে এসে মাঝে মাঝে চা খেয়ে যায়, তাই ওই মহিলা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতলবে আমাকে তাতাতে চাইছিল।

তার কথা শুনে আমি হেসে ফেলেছিলাম।

আমাকে হাসতে দেখে ভয়ঙ্কর চটে গেল সে। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, আ মোলো যা, বেহায়া মিনসে হাসে দ্যাখো। বলি তোমার দেহে কি ঘেন্না-পিত্তি বলে কিছু নেই? চোখের সামনে নিজের মেয়েমানুষ অন্য ব্যাটাছেলে নিয়ে ঘরে দরজা দিলে যারা হাসতে পারে, তাদের কী বলে জান? তাদের বলে ভেড়ুয়া, বেশ্যের দালাল।

মহিলা হয়তো আরও অনেক খারাপ খারাপ কথা বলত, কিন্তু আমি আর দাঁড়ায়নি।

তারপর থেকে ওর কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। খুব অভিমান হচ্ছিল সুমিতার উপরে। আমি বুঝি ওর কেনা বই! পড়বার বাধ্যবাধকতা নেই! নিতান্তই কিছু করার না থাকলে তাক থেকে নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে একটু উলটে পালটে দেখা এবং তারপর আবার লোক-দেখানোর জন্যে তাকে সাজিয়ে রাখা!

রামেশ্বরের বউয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যেবেলা এক আপাত-ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে আমি ওকে বললাম, এবার ওসব ছাড়ো সুমিতা। বেলা যে পড়ে এল!

নিমেষে বদলে গেল সে। ফণাধরা গোখরো সাপের মতো ঘাড় উঁচিয়ে হিস হিস করতে করতে আমাকে এক ধাক্কায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, কী, এতবড় স্পর্ধা, আমার উপর গার্জেনগিরি ফলাতে এসেছ? তোমার কাছে কি আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? আমার যা খুশি, করব, তাতে কার বাপের কী? আমি কারও খাইও না, পরিও না। বরং কিছু পরগাছাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। তা ছাড়া তোমাকে তো আমি আটকে রাখিনি, ভাতারও করিনি! এখানে না পোষালে রাস্তা দেখ, মাথার দিব্যি দিয়ে কে তোমাকে আটকে রেখেছে?

কিছু বুঝে ওঠবার আগেই সে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে-কামড়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। তারপর ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র আছড়ে ভাঙতে লাগল।

 

|| তিন ||

সম্বল বলতে একখানা ঝোলা ব্যাগ, কয়েকটা পুরনো পাজামা-পাঞ্জাবি আর টুকটাক লেখার সরঞ্জাম। কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

আশা করেছিলাম, বেরবার সময় সুমিতা হয়তো আমাকে আটকাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে ওসব কিছুই করল না। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল শুধু। বিকেলের মরে আসা আলোয় ওর বিষণ্ন মুখখানায় একটু বেদনার ছায়া হয়তো পড়েছিল, কিন্তু আমার অভিমানী চোখ তা ছোঁয়ার চেষ্টা করেনি।

পথে নেমে পড়লাম মহা সমস্যায়। কোথায় যাব, কী খাব, কিছুই ভাবা হয়নি। পকেটের অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। পেট চালাবার জন্যে এক সময়ে অনেক উঞ্ছবৃত্তি করেছি বটে, কিন্তু নতুন করে শুরু করতে গিয়ে বুঝলাম, অনভ্যাসের ফোঁটার চড়চড়ানি বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন।

তবুও জেদের বসে কয়েকদিন নানা জায়গায় ঘুরলাম। সাধুর আখড়া থেকে হোটেলের কিচেন, ঢুঁ মারতে মারতে আমি যখন প্রায় হতোদ্যম, এমনি সময়ে সুমিতা খুঁজে পেতে আমাকে ফের ধরে এনেছিল। বুঝেছিলাম, এই কর্কশ স্বেচ্ছাচারী পেশাদার নার্সের মধ্যে সেই কিশোরীবেলার সুমিতা একেবারে মরে যায়নি। 

আমরা এবার বেরোব। আপনি তৈরি হয়ে নিন। ওঁর ছেলে তো বলছে, মুখাগ্নি করবে না। সেক্ষেত্রে আপনি

নিচেরতলার ফ্ল্যাটের উপেন মাঝি। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের পিয়ন হলেও হাবেভাবে সে-ই যেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। একটু লেখালিখি করি, এটা জানার পর থেকে আমাকে কিছুটা বাড়তি খাতির করে।

ওকে কিছু না বলে আমার ঝোলা ব্যাগখানা খুঁজতে লাগলাম।

শবযাত্রীরা মোটামুটি প্রস্তুত। বাবলা মদ এবং মারের যৌথ প্রভাবে সামনের নিমগাছটার গোড়ায় সিমেন্ট-বাঁধানো বেদীতে কাত হয়ে পড়ে আছে। জেগে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সুমিতার বর কোত্থেকে খানিকটা সিঁদুর নিয়ে এসে ওর কপালের উপর উপুড় করে ঢেলে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বিড়বিড় করে বলে চলেছে, আহারে! কত যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেল মেয়েমানুষটা! এট্টু বারমুখো ছিল বটে, কিন্তু হাজার হোক আমারই তো ধম্মো সাক্ষী করা বউ! ভেতরে ভেতরে যে অমন রোগ বাঁধিয়ে বসে আছে, আমি যদি একবার জানতে পারতাম, এত সহজে তোমাকে যেতে দিতাম নাগো

হঠাৎ আমাকে সামনে দেখতে পেয়ে গলার স্বরটা ঈষৎ চড়িয়ে কান্নার মতো সুর করে বলতে লাগল, আহারে! গায়ে পরগাছা জন্মালে কত মহীরুহ পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়! কোন লজ্জায় যে শালা হারামখোরটা এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছে!

এরপর অন্যদের দিকে ফিরে বলতে লাগল, আপনারা হয়তো জানেন না, আমিই সুমিতা বসুর বিয়ে করা প্রকৃত স্বামী। আমার সঙ্গে তার ডিভোর্সও হয়নি, ছাড়ান-কাটানও হয়নি। গ্রামে আমার জমি-জমা ছেড়ে আসবার উপায় ছিল না বলে নেহাৎ চাকরির খাতিরে সে শহরে একা থাকত। তাই বলে সে তো আর আমার পর হয়ে যায়নি! এখানে এসে শুনছি, কোন উনপাজুরে হারামখোর নাকি তার বুকের উপর চেপে তাঁকে সর্বস্বান্ত করে ফেলেছে। এমনকী এখনও সে ঘাঁটি গেড়ে এখানে বসে আছে! তা আপনারা সবাই সরকারি মানুষ, আইন-কানুন আপনারা আমার চাইতে বেশি জানেন। সুমিতার স্থাবর, অস্থাবর যা কিছু আছে, এখন সেসবের মালিক কিন্তু আমি আর আমার ছেলে বাবলা। আপনারা দেখবেন, কোনও জালিয়াত আবার সেসব যেন গায়েব করতে না পারে। শখ করে তো লোকে পশু-পাখি, কুকুর-বেড়াল, কত কিছু পোষে। তাই বলে তো আর মালিকের সম্পত্তি পোষ্যের হয়ে যায় না!

লোকটার বলার ভঙ্গিটা বেশ নাটুকে। যুক্তির যা ধার, তাতে ইচ্ছে করলে ভালো উকিল হতে পারত।

সূর্য কিছুটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে, তবু মেঘমুক্ত রোদের তাতে শরীর যেন ঝলসে যাচ্ছে। সুমিতার মুখখানা কালো হয়ে গেছে, দেহ ফুলতে শুরু করেছে। গালদুটো সেই কিশোরীবেলার মতো টুবো টুবো লাগছে। একটু আগেও ওর কানে যে সোনার মাকড়ি ছিল, এখন আর সেটা নেই। হাসপাতালে সুমিতার সহকর্মীরা মাকড়িজোড়া খুলে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু সুমিতা রাজি হয়নি।

সেবার সুমিতার কাছে ফিরে আসবার পর দেখেছিলাম, সে যেন অদ্ভুতরকম চুপচাপ হয়ে গেছে। আমার জন্যে গরম গরম লুচি-বেগুনভাজা আর চা করে নিয়ে এল। তারপর আমার হাত থেকে ঝোলাটা নিয়ে তার থেকে ময়লা জামা-কাপড় বের করে কাচতে বসে গেল।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমার বিছানায় বসে খুব নরম গলায় বলল, কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম, তুমি বুঝি আর আসবে না!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ তুলে দেখি, সুমিতা গভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মুখ থেকে সত্যি কথাটা বেরিয়ে এল, কোথায় আর যাব বল!

সে একই রকম উদাস গলায় বলল, উড়ন্ত পাখির কি বসার জন্যে ডালের  অভাব হয়? যে কোনও এক ডালে বসে পড়লেই হল!

আলোচনাটা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝে উঠতে না পেরে চুপ করে রইলাম। সুমিতাও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করল, কোনও বন্ধন তো নেই। একসময়ে বারোয়ারি ভাড়া বাড়িতে কয়েক বছর একসঙ্গে বসবাস, তা সে সম্পর্ক কবেই ফিকে হয়ে গেছে! হাসপাতালে তোমাকে আমি না চিনলে তুমি হয়তো আমাকে চিনতেই পারতে না! কিছু কিছু স্মৃতি মেয়েরা হাজার চেষ্টা করলেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। কিন্তু তোমার জীবনের মস্ত ক্ষতিটাও বুঝি আমিই করেছি। তুমি লেখক মানুষ, আমার খপ্পরে না পড়লে একজন খারাপ মেয়েমানুষের আশ্রিত হওয়ার বিড়ম্বনা ভোগ করতে হতো না তোমাকে!

আমি শশব্যস্ত হয়ে বললাম, থাক না সুমিতা, আজ এসব পুরনো কাসুন্দি নাই বা ঘাঁটলে!

সে হঠাৎ রুষ্ট গলায় বলল, কেন? দুর্গন্ধে তো তোমার অরুচি নেই! নর্দমায় যার বসবাস, তার পক্ষে কি গন্ধের বাছবিচার সাজে!

আমার হাসি পেয়ে গেল। ওর কথাগুলো চোখা চোখা বটে, কিন্তু গলায় সেই ঝাঁঝ নেই। বরং নরম পেলবতায় ওর কথাগুলো কেমন আত্মসমালোচনার মতো শোনাচ্ছিল। আমি ওর হাতখানা হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, খারাপটা যখন বুঝতে পারো

ও এক ঝটকায় হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে পুরনো মেজাজে বলল, বুঝি, কিন্তু মানি না। তোমাদের মতো সুযোগসন্ধানী পুরুষদের তৈরি করা ভালো-খারাপের অনুশাসনকে আমি ঘেন্না করি! তোমরা যে সুযোগ পেলেই অন্যের ঘরে সেঁধিয়ে যাও, অরক্ষিত অবস্থায় থাকলে শিশু থেকে প্রৌঢ়া, কেউই যে তোমাদের লালসার থাবা থেকে নিষ্কৃতি পায় না, সে বেলা তোমাদের লজ্জা করে না? তোমরা শিখিয়ে দেবে, কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ? তোমাদের সামর্থ্য থাকলে একসঙ্গে পাঁচটা মেয়েমানুষ পুষতে পারো। সেটা তোমাদের পৌরুষ। ওই যে আমার হেঁফো বুড়ো অসমর্থ বর, সেও একটা ডবকা মেয়েমানুষ জুটিয়ে এনে বউ সাজিয়ে রেখেছে, কই, তার গায়ে তো কেউ থুতু দেয় না! আমি খারাপ মেয়েমানুষ, অথচ মাস গেলে আমার পাঠানো টাকা নিতেও তার ঘেন্না হয় না, না পাঠালেই বরং ছেলে পাঠিয়ে জুলুম করে, সেটা বুঝি ভালো?

আমি তাকিয়ে দেখলাম, ওর দুচোখে জলের ধারা নেমেছে। ওকে বুঝি আজ কথায় পেয়েছে, কাঁদতে কাঁদতে বলে চলল, একবারও কি ভেবে দেখেছ, এ জীবনে আমি কী পেলাম? কিশোরীবেলায় যাকে ভালো লেগেছিল, সে আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। আমার রাতের ডিউটির জন্যে অসুবিধে হয় বলে আমার বিয়ে করা বর বুক ফুলিয়ে অন্য মেয়ে মানুষ নিয়ে ঘর করে, তার বেলা দোষ হয় না! আমিও ঠিক করেছি, আমিও পুরুষ পুষবো। একটা, দুটো, পাঁচটা, আমার যতগুলো ইচ্ছে! আমি তোমাদের ন্যায়নীতির দাড়িপাল্লায় লাথি মারি!

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সুমিতা।

একখানা রজনীগন্ধার মালা, কয়েকটা ফুলের স্টিক আর এক বাক্স ধূপকাঠি নিয়ে সুরেন মুখার্জী এলেন। এ বি ব্লকের স্বঘোষিত মাতব্বর। এসেই হৈচৈ শুরু করে দিলেন, একী! একজন সরকারি কর্মীর আনটাইমলি ডেথ, তার উপর উনি ছিলেন একটা হাসপাতালের সেবিকা, আর্ত মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছেন, তার জন্যে কেউ একটা ফুল কিংবা মালা আনেনি! হাউ স্ট্রেঞ্জ!

বলতে বলতে নিজেই সুমিতার ফুলে ওঠা দেহের উপর মালাখানা রাখলেন। ভদ্রলোকের চোখমুখের অবস্থা দেখে মনে হল, মৃতদেহের এত কাছাকাছি যাওয়ার ফলটা ওঁর পক্ষে সুখকর হয়নি। সুপর্ণা সজল চোখে দূরে দঁড়িয়ে ছিল। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সে এক শিশি কড়া পারফিউম মৃতদেহের উপর ঢেলে দিতে চারিদিক উগ্র গন্ধে ভরে উঠল।

সুপর্ণা আমার কাছে এসে আস্তে আস্তে বলল, অমলদা, আর দেরি কেন?

আমি বললাম, না, মানে ওর বাড়ির লোকজনও তো এসেছে, তারা যতক্ষণ না বলছে

সুপর্ণা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ওর আবার বাড়ির লোকজন কে? সুমিতাদির এই মাস তিনেকের হাসপাতাল বাসের মধ্যে তো কাউকে কখনও আসতে দেখিনি। আপনিই না খেয়ে, না দেয়ে দিনরাত হাসপাতালে পড়ে থেকেছেন। সুমিতাদিকে শেষের দিকে চান করানো, খাওয়ানো, আমরা বলাবলি করতাম, অমলদা মেয়েদেরও হার মানালেন।

আমি ওর কথা চাপা দেওয়ার জন্যে বললাম, আজ ওসব কথা থাক সুপর্ণা। তোমরাও তো ওর জন্যে কম করোনি। একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, শেষের সে সময়ে পাশে থাকতে পারাটা আমার কর্তব্য ছিল। হাজার হোক

সুপর্ণা কাঁদতে কাঁদতে সরে দাঁড়াল। আমার মনে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এল। যাক, সুমিতার জন্যে তা হলে একজন অন্তত চোখের জল ফেলবার লোক ছিল।

বাবলার বুঝি নেশা কেটে গেছে। সে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আমার দিকে কটমট করে তাকাতে তাকাতে কোয়ার্টারের ভেতরে চলে গেল। হাউজিং-এর লোকজনই ধরাধরি করে খাটিয়াটা ট্রাকে তুলে দিলেন।

সুপর্ণা বাবলাকে হয়তো মৃতদেহের সঙ্গে যাওয়ার জন্যে বলছিল। সে হঠাৎ হাত-পা নেড়ে বলতে শুরু করল, ইল্লি আর কী! দায় কেঁদেছে আমার, অমন মেয়েমানুষের মুখে আগুন দেয়ার!

সুপর্ণা অত্যন্ত আস্তে আস্তে বলল, তোমার মা, তাঁর মুখাগ্নি করার

কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বাবলা চিৎকার করে কীসের মা? কার মা? অমন পরপুরুষের সঙ্গে কাটানো

বাবলা হয়তো আরো কিছু কুকথা বলত। কিন্তু অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে পুনরায় মারের ভয়ে চুপ করে গেল।

সুরেন মুখার্জী ট্রাকের উপর থেকে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করতে লাগলেন, আরে অমলবাবু, দেরি করছেন কেন?

আমি আমার ঝোলাখানা নেওয়ার জন্যে কোয়ার্টারের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখি সুমিতার স্বামী এবং সেই মেয়েমানুষটা দরজা আগলে বসে আছে। একপ্রকার ওদের ডিঙিয়েই ঘরে ঢুকতে হল। ভেতরে গিয়ে আমি তো অবাক। এইটুকু সময়ের মধ্যেই সুমিতার সংসারের যাবতীয় জিনিস বাঁধাছাদা সারা। এমনকি দু ঘরের দুখানা খাটই খোলা হয়ে গেছে। বিছানাপত্র সুন্দর রোল করে বাঁধা।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমার ঝোলা ব্যাগখানা পাওয়া গেল না। এমনকি আমার লেখার সরঞ্জাম, বইপত্র, কোনও কিছুরই চিহ্নমাত্র নেই!

দরজা আগলে বসে থাকা দম্পতি অত্যন্ত খর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে  অস্বস্তি হতে লাগল, আমার জিনিসপত্রের কথা জিজ্ঞেস করতে আর প্রবৃত্তি হল না। ওদের ডিঙিয়েই নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম।

শোভনবাবু চেঁচিয়ে বললেন, কী হল, অমলবাবু, গাড়িতে উঠুন। আর কত দেরি করবেন?

আমি গাড়ির কাছে গিয়ে বললাম, আপনার এগিয়ে যান। সামান্য কাজ মিটিয়ে আমি আসছি।

শববাহী গাড়িটা ধীরে ধীরে হাউজিং-এর গেট ছেড়ে বেরোচ্ছে। পেছনের ডালা খোলা। আমি দেখলাম, সুমিতার মাথাটা গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে বেরিয়ে যাচ্ছে, অভিমানে ওর ঠোঁট দুটো যেন ফুলে উঠেছে।

আনমনে জিটি রোড ধরে হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ মনে হল, পেছন থেকে আমার নাম ধরে কেউ যেন ডাকছে। থমকে দাঁড়ালাম।

সুপর্ণা একপ্রকার ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে ধরে ফেলল। তার ব্যাগ থেকে একখানা ফাইল বের করে আমার হাতে দিতে দিতে বলল, সুমিতাদির কিছু ফিক্সড ডিপোজিট আমার কছে রাখতে দিয়েছিলেন। ওগুলোতে আপনাকে নমিনি করা আছে। সুমিতাদি এগুলো আপনাকে দিতে বলে গেছেন।

আমি হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিলাম। তারপর সুপর্ণা চলে যেতেই ফাইলের কাগজগুলো টুকরো টুকরো করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটতে লাগলাম।

মাথার ওপর কর্কশ শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি, এক ঝাঁক ধবল বক দিনান্তের শেষ আলোটুকু শুষে নিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।