বনজ ঘ্রাণ
পোড়ানোর সময় শরীরের গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। ইব্রাহিম জানে প্রতিটি মানুষের শরীরে নিজস্ব একটা গন্ধ আছে। আর এই ধরনের অপারেশনে এসে সে বুঝতে পেরেছে যে, পোড়ানোর সময় সেই গন্ধটাই ছড়ায়। মানুষ পোড়া গন্ধ কিন্তু কাবাব পোড়ানোর মতো গন্ধ নয় কখনো। তবু্ও রাস্তার পাশের কাবাবের দোকানগুলো থেকে যখন মাংস পোড়ানোর গন্ধ নাকে এসে লাগে, আগে ওই গন্ধে ক্ষিধে চাগিয়ে উঠলেও এখন গা গুলোয় ইব্রাহিমের।
জঙ্গলটা ঘন। ওরা যথেষ্ট সচেতন থাকে এসব বিষয়ে। একটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসব কাজ যে কতটা রিস্কি! তাই তো খুঁজে খুঁজে লোকালয়ের বাইরে, কোথাও নির্জন নদীর ধারে বা গভীর ঘন জঙ্গলে সারতে হয় কাজগুলো। এত গভীর ঘন জঙ্গল এর আগে ইব্রাহিম কখনো দেখে নাই। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে সুন্দরবন গিয়েছিল। ওই সুন্দরবনও এর তুলনায় কম ঘনত্বের মনে হয়েছিল। এই বনের গাছগুলো এত দীর্ঘ, আর ঘন যে আকাশ দেখা যায় না। যেন এক একটা ছাতা। দীর্ঘ স্ট্যান্ডের প্রান্তে গিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে পাতার আচ্ছাদন। ঢেকে দিয়েছে আকাশ, আচ্ছন্ন করে দিয়েছে চরাচর। ত্থ ত্থ করে থেমে থেমে ভেসে আসছে পেঁচার ডাক। কখনো খল চরিত্রের মতো রাতের নিজস্ব শব্দ ও নৈশব্দকে খান খান করে দিয়ে ডেকে উঠছে বুনো শেয়াল! এরই মাঝে গাড়ি থেকে কমান্ডো স্টাইলে ঝাপিয়ে পড়ে ওরা। সবার মধ্যে তীব্র ব্যস্ততা। অপারেশনের সময়টায় ওদের সবার ভেতরে থাকে টানটান উত্তেজনা। যত দ্রুত কাজটা শেষ করা যায় ততই ভালো।
|| ২ ||
ইব্রাহিমের এই সময়টায় সবচেয়ে খারাপ লাগতে শুরু করে। সে শুধু মনে মনে ভাবে, এরকম একটা কাজে আসতে হয় তাকে! কতবার ভেবেছে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে গ্রামে গিয়ে পুকুরে মাছ চাষ করবে। সবজি লাগাবে ঘরের পাশের জমিতে। কিন্তু তারপরও সে সেইফটি সিকিউরিটি আর সোসাইটিতে ঘুরপাক খাওয়া এক আইডেন্টিটির মোহে পড়ে থাকে এখানে! নাকি সে চাইলেও আর এই চক্রবুহ্য থেকে বের হতে পারবে না! সে যে অনেক কিছু জেনে গেছে!
ইব্রাহিম খুব সাধারণ ইনট্রেভার্ট একজন মানুষ। তার পার্সোনালিটির সঙ্গে এই কাজটা মানায় না এমন ধারণা অনেকেরই। তার নিজেরও তাই ধারণা কিন্তু বিষয়টা অন্যরাও বুঝতে পারবে এতোটা আনস্মার্টও নিজেকে সে মনে করে না। সে হয়ত একজন গবেষক হতে পারত বা শিক্ষক। কিন্তু বাবা অকালে মরে গিয়ে সেই সুযোগটা আর তার রইল না! তার বাবা মানুষটা ছিলেন খুব সফলভাবে অসফল একজন মানুষ। জীবনে হ্যানো ব্যবসা নাই যা তিনি করার চেষ্টা করেন নাই। কিন্তু কোন কিছুতেই সফল হন নাই। এই অসফল মানুষটা তার আয়ুর দৌড়েও অসফল হয়ে যখন মারা যান, তখন বলাই বাহুল্য তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের সামনে এই পৃথিবীতে টিকে থাকার কোনও রসদ ছিল না। ইব্রাহিম তখন সবে অনার্স পাশ করেছে। টিউশনির টাকায় তার নিজের পড়ার খরচটা চালাতে পারলেও একটা সংসারের ভার বয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। একের পর এক চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে সে যখন ক্লান্ত, তখন তার এক আত্মীয়া তাকে চাকরিটা পাইয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। ভদ্রমহিলার রাজনৈতিক যোগাযোগ উল্লেখ করার মতো। তাই এই বাজারে চৌদ্দগোষ্ঠীর দলীয় মতবাদের কুষ্ঠি ঠিকুজি না মিললে যেখানে চাকরি পাওয়া যায় না, সেখানে তার একটা কাজ পাওয়া সহজ হয়েছিল।
|| ৩ ||
খারাপ লাগাটা কাটাতে ইব্রাহিমের এই মুহূর্তে একটা সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু বসের সামনে খেতে পারছে না। অগত্যা সে তার ইউনিটের লোকগুলোর দক্ষযজ্ঞ দেখতে লাগল। এ কাজে তারা বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে বলতে হবে। তীব্র গতিতে ডেডবডির ব্যাগটা জিপের পেছন থেকে বের করে আনল তারা। একটু জায়গা পরিস্কার করে নিয়ে চিতার মতো করে একে একে সাজিয়ে দিল কাঠগুলোকে। মুহূর্তে পেট্রোল ঢেলে সেদিকে ছুড়ে দেয়া হলো একটা জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি। এরপর ক্ষণিকের অপেক্ষা! কটমট শব্দে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে আগুন। কিন্তু কই!
ক্রমশ কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। লোকগুলো আগুনের আঁচ তাদের গায়ে না লাগে এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে অস্থির অপেক্ষা করছে। যতটা সম্ভব দ্রুত কাজ শেষ করতে চায় তারা। কিন্তু…!
আগুন এতো ধীরে জ্বলছে কেন? চাপা হুংকার ছোড়েন টিম লিডার!
ঠিক বুঝতে পারছি না বস!
পেট্রোল মারা হয় নাই ঠিক মতো?
দুই গ্যালোনের বেশি ঢালা হইছে স্যার।
তাহলে জ্বলে না ক্যান, কী কাঠ আনছো ওগুলা?
লোহা কাঠ, সিন্দুর কাঠ।
ফাজলামি করো আমার সাথে! এইটা কি সুন্দরবন? শাল, গজারের জঙ্গলে সুন্দর কাঠ কোত্থেকে আসবে?
ইব্রাহিম!
ইয়েস স্যার!
আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করো, কুইক! আমরা এইখানে পিকনিক করতে আসি নাই। জগৎ জোড়া মানুষকে জানান দেয়ার কিছু নাই!
|| ৪ ||
আগুন জ্বলছে। তবে যেভাবে জ্বলার কথা সেভাবে নয়। বরং আরো তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মানুষটার শরীরের বনজ ঘ্রাণটা।
এরই মাঝে ইব্রাহিম বলে ওঠে, বস একটা বনজ গন্ধ পাচ্ছেন না? কমান্ডিং অফিসার বিরক্তিতে খেকিয়ে উঠে বলে, জঙ্গলে বনজ গন্ধ থাকবে না, থাকবে এয়ারপোর্টে?
ইব্রাহিম জানে, গন্ধটা লোকটাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। তিনি তার অস্বস্তি গোপন করতেই বিরক্ত হয়ে উঠছেন। গন্ধটা তীব্রভাবে জানান দিচ্ছে এখানে কিছু হচ্ছে।
গন্ধটা ইব্রাহিমকেও স্বস্তি দিচ্ছে না।
তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে একটা চেনা মানুষকে। তার রুমমেট আলভির শরীরে ছিল এমন একটা বনজ ঘ্রাণ। আলভি যখন দুপরবেলা মিছিল করে, ঘেমে টেমে হলের রুমে ফিরত, তখন এমন একটা গন্ধ ছড়িয়ে যেত ঘরময়।
ইব্রাহিম অনেকদিন বলেছেও আলভিকে। ‘জানো দোস্ত, তোমার এই স্মেলটার জন্য তোমার বৌ পাগল থাকবে। কেমন একটা নেশা ধরানো জিনিস!’
‘কী যে কও তুমি দোস্ত!’ ইব্রাহিমের কথায় কোনো পাত্তা না দিয়েই আলভি তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা দেয়। দরজা থেকে বেরোতে গিয়ে আবার রুমের ভেতরে শুধু মাথাটা ঢুকিয়ে বলে, ‘এসব কথা আবার সবার সামনে কইও না, লোকে ভুল-টুল বুঝতে পারে!’
আচ্ছা, আলভী এখন কোথায়? শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফের টুকরো গড়িয়ে যায় ইব্রাহিমের!
কিছুদিন আগে আলভির সাথে দেখা হয়েছিল। সেদিনও তাকে মিছিলেই দেখেছিল সে। আলভীর মতো প্রতিবাদী মানুষ সে কখনো দেখে নাই। সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে মুখিয়ে থাকে ছেলেটা! তারুণ্যে ঝলমল করছে যেন সারক্ষণ। সংশয় হীন, ক্লেদ হীন, নির্ভার সেই জীবনে যেন যৌবনের জয়গান ছাড়া আর কোনো কিছুর ঠাঁই ছিল না।
তারও আগে স্কুলের রি-ইউনিয়নে আলভির সাথে দেখা হয়েছিল একবার। ইব্রাহিমকে বলেছিল সে বিয়ে করেছে। তার পার্টির এক মেয়েকে। ভালোবেসে বিয়ে করেছে তারা। তার স্ত্রী মা হতে চলেছে। আলভির ভেতরে এক প্রচ্ছন্ন আনন্দের আভা দেখেছিল সেদিন সে।
‘অনেক রেসপনসিবল হতে হবে এখন, বুঝলা দোস্ত!’ বলেছিল ইব্রাহিম।
নীচের ঠোঁটটা হালকা কামড়ে ধরে চিন্তিত ভঙ্গিতে শুধু ‘হুম’ বলেছিল ছেলেটা। আনন্দের সাথে কোথায় যেন এক অনিশ্চয়তার ছায়া। একটু চাপা স্বরে বলেছিল, ‘কোথাও তো একদণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়াইতে পারি না। সর্বক্ষণ দৌড়ের উপ্রে রাখে ওরা।’
ওরা কারা ইব্রাহিম জানে, বলে না কিছু। হয়ত আলভির সাথে বেশি কথা বলাটাও ঠিক হচ্ছে না তার। কিন্তু আলভিকে কীভাবে এড়িয়ে যাবে সে! আলভির সাথে দীর্ঘদিন একসাথে থাকা, কত সুখদুঃখ ভাগ করে নেয়া। কত কতদিন আলভি ওকে খাইয়েছে। ইব্রাহিম মুখে না বললেও আলভি যেন বুঝে ফেলত তার সমস্যাটা।
আজ এই মুহূর্তে যেমন ইব্রাহিম অনুভব করতে পারছে, কে যেন, কী যেন জানান দিচ্ছে তাকে!
কেন সে দেখল না একবার মুখটা খুলে!
যদিও নিয়ম নাই।
তাছাড়া এই বনজ গন্ধটা না ছড়ালে তো তার সন্দেহ করারও কিছু ছিল না!
এখনো সে মনে মনে চাইছে, তীব্রভাবে চাইছে, যেন অন্য কেউ হয়। অন্য কোনো মানুষ!
কত মানুষের শরীরে তো একই রকম গন্ধ থাকতে পারে! কে, কে শুধু গন্ধ শুকেই আইডেন্টিফাই করতে পারবে মানুষটাকে! মা! মা পারবে?
সন্তানের শরীরের গন্ধ মা ছাড়া আর কে চেনে! কিন্তু শৈশবের খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসার পর যখন বদলে যায় গোটা শরীরবৃত্তীয় বিষয়গুলো! তখনও কি মায়ের ঘ্রাণেন্দ্রিয় খুঁজে পায় তার সন্তানের বদলে যাওয়া গন্ধ! পায়, পায় নিশ্চয়ই। সন্তান নিজের কাছে হয়তো বড় হয়ে উঠে। স্বতন্ত্র সত্তা ভাবতে থাকে নিজেকে, কিন্তু মায়ের কাছে তো সে সেই শিশুই! আর, আর একজন চিনবে এই ঘ্রাণ। তার বুকের কাছে মুখ নিয়ে মুগ্ধ হতো যে! যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তো তার সারা শরীরের কোষে কোষে! সে তার স্ত্রী!
কিন্তু এই রাতে! এই ঘোর অমানিষার রাতে, কে দেবে তাকে এইসব সাক্ষ্য প্রমাণ।
|| ৫ ||
ইব্রাহিম!
বসের গর্জনে সম্বিত ফেরে ইব্রাহিমের।
এতো দেরি হচ্ছে কেন?
এতো ধোঁয়া কেন, কোথাও কোনো ষড়যন্ত্র হইতেছে না তো!
আগুন কই, আগুন? এখন তো দেখতেছি আশপাশের লোকজন সব এসে পড়বে! মন্ত্রচালিতের মতো ধাতব অস্ত্রটাতে হাত চলে যায় লোকটার।
ইব্রাহিম একটু নার্ভাস হয়ে পড়ে।
নার্ভাস হয়ে পড়তে দেখা যায় ইউনিটের সবাইকেই।
কী হচ্ছে এসব! কেন হচ্ছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কেউ।
কিন্তু কালো ধোঁয়া ক্রমশ বিশাল কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠছে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গল ছাপিয়ে লোকালয়ের দিকে। এই গভীর রাতে সেখান থেকে দলে দলে এগিয়ে আসছে মানুষ। মন্ত্রচালিতের মতো হেঁটে আসছে তারা। তাদের পায়ের শব্দে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো গমগমে চাপা গর্জন উঠছে। অথচ কারো মুখে কোনো কথা নাই। কিছু বলার প্রয়োজনও নাই। সব যেন তারা জানে! শুধু হাজারো মানুষের পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে।
ওদিকে অপারেশনে আসা মানুষগুলো আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। ক্রমশ যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তাদের। দিগ্বিদিক ছুটছে তারা।
শুধু সম্মোহিতের মতো বসে আছে ইব্রাহিম। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চিতা থেকে ছড়িয়ে পড়া চির চেনা বনজ ঘ্রাণের মায়া ছেড়ে সে যেতে পারছে না!
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন