মানুষকে ভাগাভাগি করা হয় রাজনৈতিকভাবে: সমরেশ মজুমদার
সমরেশ মজুমদার
সমরেশ মজুমদার [১০ মার্চ ১৯৪২—৮ মে ২০২৩] বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক তিনি। গল্প দিয়ে লেখালেখির শুরু। প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ ছাপা হয়েছিলো দেশ পত্রিকায় ১৯৬৭ সালে। গল্পটি লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসাবে। সেটাই তাঁর লেখক জীবনের শুরু। তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘দৌড়’। কথা সাহিত্যের ট্রিওলজি নামে পরিচিত ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’, ‘উত্তরাধিকার’ তাঁকে দুই বাংলার পাঠকদের মাঝে এনে দিয়েছে খ্যাতির শীর্ষ চূড়া। ‘সাতকাহন’ তাঁর অনন্য উপন্যাস। লিখেছেন বিস্তর। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি, আনন্দ পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা সফরে এসেছিলেন। সে সময় তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন ফরিদ কবির ও সাখাওয়াত টিপু। এটি গ্রন্থনা করেছেন মেহেদী উল্লাহ। আজ চলে গেলেন সমরেশ মজুমদার। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলোচিত এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।
সাখাওয়াত টিপু: সাহিত্য করতে এসে আপনি কখন বুঝলেন সমরেশ মজুমদার একজন সমরেশ মজুমদার হয়ে উঠলেন?
সমরেশ মজুমদার: আমি এখনো বুঝতে পারছি না একজন সমরেশ মজুমদারের সাথে আরেকজন সমরেশ মজুমদারের পার্থক্য কি? আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। পাঠক যদি আলাদা করে নেয় সেটা তাদের ব্যাপার।
ফরিদ কবির: আপনি কি কখনো টের পেলেন কিনা ব্যক্তি সমরেশ মজুমদার আর লেখক সমরেশ মজুমদারের মধ্যে কোন তফাৎ আছে?
সমরেশ: হাঁ, আমি বুঝেছি অনেক পরে। যখন দেখলাম, লেখা ছাপা হওয়ার পর পত্রিকাওয়ালারা মাস শেষে টাকা দিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশকরা বই বিক্রির টাকা দিয়ে যাচ্ছে। কোন অনুষ্ঠানে গেছি পাঠকরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তখন বুঝলাম আমার ভেতরে একটা সমরেশ মজুমদার ছিল। একটা সমরেশ মজুমদার তৈরি হয়েছিল, যার জন্য পাঠকের সাড়া পেয়েছিলাম। এই সাড়াটা আশির দশকের ১৯৮৫ কি ৮৬ সালের দিকে।
ফরিদ: ওই সময় আপনার কোন বইটি প্রকাশিত হয়ে ছিল?
সমরেশ: ওই সময় আমার ট্রিওলজি শেষ হয়ে গেছে। কালবেলা, কালপুরুষ আর গর্ভধারিণী। এই ট্রিওলজি সে সময় ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
টিপু: আপনার প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশিত হবার কত বছর পরে?
সমরেশ: তার দশ বছর পরের ঘটনা।
টিপু: ট্রিওলজিতে আপনি উপন্যাসকে একটা রাজনৈতিক মোড়ক দিতে চেষ্টা করলেন। এটা কেন?
সমরেশ: এটা বেশ মজার ঘটনা। একদিন দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ডেকে বললেন, অনেকতো ওয়ানডে ম্যাচ খেললে এবার টেস্ট ম্যাচ খেলো। মানে এবার তুমি একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখো। আমি আঁতকে উঠলাম। ‘দৌড়’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমি দম হারিয়ে ফেলেছি। মনে হয়েছিল আমি আর লিখতে পারব না। লিখতে গিয়ে গল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে, আগাচ্ছে না। আসলে আমি ওই সময় অব্দি ছোটগল্প লিখতে অভ্যস্ত ছিলাম। ধারাবাহিক উপন্যাস সপ্তার পর সপ্তা লিখব, এটা অসম্ভব মনে হল। মনে হল আমার কাছে এত গল্প নেই। উনি বললেন, কেন পারবে না? নিজেকে নিয়েই লেখ। ওই যে কথা, তারপর ভেবেছি। আমি যেভাবে ভেবেছি সেভাবে আর কেউ ভাবেনি। আমি যা দেখেছি, সেটা অন্য কেউ দেখেনি। তখন আমি আমার ভাবনাগুলো লিখতে শুরু করলাম। লেখাটা আমার আত্মজীবনী হয়নি। এতে আমার দেখা, অদেখা-জীবন আর মানুষ সম্পর্কে ধারণার জন্ম নিয়েছিল।
টিপু: কি ধারণা?
সমরেশ: যখন মানুষকে ভাগাভাগি করা হয় রাজনৈতিকভাবে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এই যে বন্যা হল সেখানেও রিলিফ নিয়ে রাজনীতি হল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে কে ভোট দিল, আর কে দিল না। যে ভোট দিল তাকে রিলিফ দেয়া হবে, আর যারা ভোট দেয়নি তাদের দেয়া হলো না। এই রাজনৈতিক দ্বিচারিতার কারণে তখন বিরূপ ভাবনা এল। পশ্চিমবাংলা জুড়ে খাদ্যাভাব চলছে। আন্দোলন হচ্ছে। পুলিশ লাঠি চার্জ করছে। তখন কলকাতায় হরতাল চলছে। বিক্ষোভকারীরা ট্রাম বাস পোড়াচ্ছে। পুলিশ বলছে, ‘জাতীয় সম্পদ রক্ষা করতে, জান-মাল বাঁচাতে, যারা ট্রাম-বাস পোড়ায় তাদের গুলি করা হবে।’ যার ফলে সেদিন পুলিশের গুলিতে লাশ পড়ে। আমিও ছিলাম সেদিন। আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। লাশ নিয়ে টানাটানি হলো। মিছিলকারীরা ভাবল তাদের দলের লোক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলেটা কে? আমি কে? এটা একটা গ্রেট প্রশ্ন। ওই যে ছেলেটা রাজনীতির শিকার হয়ে সতের বছর বয়সে জীবন দিয়ে দিল, এটা একটা মারাত্মক ঘটনা। সে কে? এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি ভাবলাম, ছেলেটা বেঁচে গেছে।
টিপু: মানে নাটকীয়তার দিকে মোড় নিল?
সমরেশ: না, অনেকক্ষণ ধরে হাঁপাচ্ছিলাম। আর পারছিলাম না লিখতে। অনেক তো হলো। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ পাতা লেখা শেষ। তবুও লেখা শেষ হচ্ছে না। এটা কিভাবে শেষ করবো? অনিমেষ তো মরে গেল। তার রাজনৈতিক আইডেন্টিটি নিয়ে এক সংকট তৈরি হল। তো এইসব বের হওয়ার পরে একদিন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আমাকে ডাকলেন। আমি গেলাম। উনি টেবিলে বসে আছেন। আমাকে বললেন, এগুলো পড়। আমি বললাম, কি এগুলো? বললেন, আমাকে গালাগাল দেয়া হয়েছে। এইসব চিঠিতে পাঠকরা বলছে, ‘আমি বুর্জোয়া কাগজের সম্পাদক। আর তুমি সর্বহারা নায়ক ছেলের চোখে মানুষকে ব্যথা দিচ্ছ। আমি জোর করে টিপে টিপে তোমার লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। এবং দেশ পত্রিকায় আমার লেখা বন্ধ। আমি পারিনি, আমি অক্ষম! এরা কোন কথা শুনতে চায় না।’ আমি বললাম, ঠিক আছে।
টিপু: জীবনকে আপনি কিভাবে দেখছেন? আপনি কি রাজনৈতিক জীবন-যাপন করেছেন?
সমরেশ: আমি সেই জীবন-যাপন করিনি, তবে দেখেছি। কিন্তু আমার বন্ধুরা যারা এই জীবন-যাপন করেছে, তারা খুব দমন-পীড়নের মধ্যে ছিল। কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, কেউ জেল খেটেছে, কেউ আত্মগোপন করেছে দীর্ঘদিন। আবার জীবনে প্রেম ব্যাপারটা সিরিয়াস একটা ব্যাপার ছিল। যে সব বন্ধু আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, তারা প্রেম করতে চাইতো না। কারণ তারা জানত, প্রেম মানে পেছনে টানা। প্রেম মানে ঘরের বাঁধন। ফলে তারা এটাকে এড়িয়ে চলত। আর সে সময় প্রেম করা অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটা সহজ ছিল না। চুম্বন-টুম্বন তো ভাবাই যায় না। এ রকম একটা পরিস্থিতি ছিল! এই যে পরিস্থিতি ছিল তার মধ্যে কালবেলা শেষ করলাম।
টিপু: মাওবাদী বা নকশাল বাড়ি আন্দোলনটা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে?
সমরেশ: মাওবাদীও ছিল আর নকশালবাদীও ছিল। নকশাল বাড়ি আন্দোলনটা কি ছিলো? এটা নিয়ে আমি জনা কুড়ি বিখ্যাত নকশাল বাড়ি নেতার সাথে আলোচনা করেছি। এটা লেখার আগে। আলোচনার পর বুঝেছি, আমি অনেকটা অন্ধের মত হস্তি দর্শন করেছি। কেউ বলছেন, শুঁড়টাই হাতি। কেউ বলছেন, লেজটাই হাতি। কেউ বলছেন, কানটাই হাতি। কেউ বলছেন, পাটাই হাতি। কেউ বলছেন, পেটটাই হাতি। কিন্তু সমগ্র হাতির কথা কেউ বলেন না। এর কথা ওকে বলেছি। এমনিভাবে যখন দেখছি, কারো সাথে কারো মিলছে না, তখন কথার গড়মিল শুনে ধন্দ্বে পড়েছি।
টিপু: দ্বন্দ্বটা কি আপনারই?
সমরেশ: না না! আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি চোখে যা দেখেছি সেটাই লিখেছি। আমি যা শুনেছি সেটাই লিখেছি। আমি যা দেখেছি, সেটাও সাধারণ মানুষ দেখেছে। আমি যেটা শুনেছি সেটাও সাধারণ মানুষ শুনেছে। সাধারণ মানুষের সাথে আমি কখনো দ্বিমত করতে পেরেছি? যেমন ধরুন, আন্দোলনের সময় আমাদের পাশের বাসায় দুটো ছেলে এসেছে। ওরা বলছে, ‘মাসি মা, খুব খিদা পেয়েছে। রাতের বেলায় আমাদের কুড়িটা রুটি দেবেন? মহিলা বললেন, হ্যাঁ বাবা নিয়ে যাস্।’ তখন নকশাল আন্দোলনের শুরু। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের একটা সমর্থন ছিল। সাধারণ মানুষ ভেবেছে, এইসব দামাল ছেলেরা দেশ আর মানুষের পরিবর্তন বয়ে আনবে। কিন্তু যেই এরা পুলিশকে মারতে আরম্ভ করল, যেই এরা গ্রামের মানুষ খুন করতে লাগল, যেই এরা বিদ্যাসাগরসহ নানাজনের মূর্তি ভাঙতে শুরু করল, অমনি জন-সমর্থন কমতে শুরু করল। সাধারণ মানুষ বিমুখ হয়ে উঠল। মানুষ ভয় পেয়ে ওদের দেখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এটা কি তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছে নাকি অন্য কোন শক্তি তাদের মধ্যে লোক ঢুকিয়ে দিয়ে ইন্ধন যুগিয়েছিল সে সময়, সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু মূলকথা, যে মানুষ সমর্থন যুগিয়েছিল, পরে সেই মানুষই তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
অনিমেষের ভুল ভাঙল একসময়। যেটা করেছে সেটার জন্য দেশ তৈরি ছিল না। আন্দোলনের সময় যে বন্দুক নিয়ে লড়াই করতে যাচ্ছে, জানি না সে বন্দুকের ভিতর গুলি ছিল কিনা। এমন একটা পরিবর্তনের জন্য দেশ তৈরি নয়, মানুষ তৈরি নয়। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের ভেতরে যে আগুন আসছে সেটা সারাদেশে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারব না। এই ভ্রান্তিটা তো, এক সময় ভাঙল।
টিপু: উপন্যাসে দেখা গেল যে রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে…
সমরেশ: কে?
টিপু: অনিমেষ…
সমরেশ: অনিমেষের ভুল ভাঙল একসময়। যেটা করেছে সেটার জন্য দেশ তৈরি ছিল না। আন্দোলনের সময় যে বন্দুক নিয়ে লড়াই করতে যাচ্ছে, জানি না সে বন্দুকের ভিতর গুলি ছিল কিনা। এমন একটা পরিবর্তনের জন্য দেশ তৈরি নয়, মানুষ তৈরি নয়। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের ভেতরে যে আগুন আসছে সেটা সারাদেশে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারব না। এই ভ্রান্তিটা তো, এক সময় ভাঙল। তবে কেউ কেউ সেই মতাদর্শে থেকে গেলেন। অনেকে অনেক সাফার করেছেন। অনেক নকশাল নেতা পরে সিপিএম’র বড় বড় নেতা হয়েছেন। উপমন্ত্রী, মন্ত্রী হয়েছেন।
টিপু: আদর্শগত দিক হতে ‘গণদেবতা’র সাথে আপনার এই মতাদর্শের পার্থক্য কোথায়?
সমরেশ: কার?
টিপু: তারাশঙ্করের…
সমরেশ: আমি কখনো এভাবে মেলাতে পারিনি। আমার কাছে ‘গণদেবতা’ একটা বিশেষ সময়, যে সময় আমি জন্মাইনি। যে সময় মানুষের মধ্যে বাম রাজনীতির বিকাশ ঘটেনি। সে সময় মাটির সেন্টিমেন্টের আন্দোলন ছিল। সে সময়টার সঙ্গে আমাদের সময়ের একটা আলাদা ব্যাপার আছে। ভেবে দেখুন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করছে যারা, তারা শুধু লুণ্ঠন করার কথা ভেবেছিলেন। ওনাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে, অস্ত্রাগার ব্যবহার করে, চট্টগ্রামের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা সেটা ত্যাগ করেননি কিন্তু। লুণ্ঠন হওয়ার পরে দেখা গেল, আর কোন কাজ নেই। ফলে হেরে যাওয়া স্বাভাবিক। ওরা কি জানতেন না, আমরা এটা করলে পরে ঝামেলা হবে। কিন্তু এটা কেন জানলেন না, আমরা এটা করবো, এটা করার পরের পদক্ষেপটা কি হবে। তো এরাও বোঝেননি, নকশালবাদীরাও বোঝেননি। সমাজ, মানুষ তৈরি হয়েছে কিনা! রাজনীতিতে মানুষ আসা শুরু করেছিল। কিন্তু ওই যে, হুমকি মারা, মানুষ মারা, পুলিশ মারা। এই সব আর কি?
টিপু: ‘পথের দাবি’ উপন্যাসের সঙ্গে কোন মিল?
সমরেশ: পথের দাবিতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে ব্যাপারটা ছিল সেটা নিয়ে আন্দোলন। ওটার সাথে কোন মিলই নাই। ওটা ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের লড়াই।
টিপু: চেতনাগত কোন মিল ছিল না?
সমরেশ: না না, এটা হলো নিজেদের মধ্যে নিজেদের… মানে আপনার সাথে আমার। আপনি যে চেতনা বিশ্বাস করেন, আমি সেই চেতনা বিশ্বাস করি না। ধরুন, তৃণমূল বলছে বামফ্রন্ট হটাও। বামফ্রন্টের দীর্ঘদিনের পজিশন আছে। যেহেতু বাম ফ্রন্ট ছাড়া অন্যকোন বিকল্প নেই, সেহেতু ওরা বলছে বামফ্রন্ট হটাও। কেউ কেউ যদি বলে, বামফ্রন্ট আমরা চাই না, হটাও; তো তৃণমূল কেন থাকবে? কিন্তু বামফ্রন্ট হটাবার পর তৃণমূল কি করবে সেটা বলছে না। প্রশ্নটা হচ্ছে, আপনার সঙ্গে আমার লড়াই। আপনার জায়গায় এসে আমি যে অন্যায় করবো না, সেটার কে নিশ্চয়তা দেবে? অথবা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে পেশির ঔদ্ধত্য দেখাবে না, সেটা কে বলবে। এখানেই কিন্তু ভূমিকা শুরু হয় মানুষের নবজাগরণের। যেটা মধ্যপ্রাচ্যে হচ্ছে।
টিপু: রাজনীতির বিষয়-আশায় এসেছে আপনার উপন্যাসে। এতে কি সাহিত্যের কোনো ক্ষতি হয়েছে?
সমরেশ: না, রাজনীতি সাহিত্যের ক্ষতি করবে কেন? আমি মনে করি, পৃথিবীর সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’। পুরোপুরি রাজনীতিক লেখা, আমার মতে, বাংলাভাষায় একমাত্র রাজনৈতিক উপন্যাস। আসলেই রাজনীতি আমাদের জীবনের সাথে মিশে আছে। এমনকি আমাদের বাঁচার জন্যই রাজনীতির দরকার আছে। এই যে ধরুন, কাল হরতাল হবে, আপনার ঘরে যদি খাবার চাল না থাকে, তাহলে আপনি কি করবেন? এই রাজনীতির কারণেই তো কালকের জন্য সন্ধ্যাবেলায় চাল কিনতে যাবেন, তাই না?
টিপু: জ্বি…
সমরেশ: দেখবেন আপনি ইনডাইরেক্টলি রাজনীতিকে মানতে বাধ্য হচ্ছেন। কিংবা রাজনীতি আপনাকে মানতে বাধ্য করছে। এটা আগে ছিল না। যদি আপনি মানতে বাধ্য হন, যদি আপনি ঘর থেকে বের হতে না পারেন, সেটা কি রাজনৈতিক জীবনের অংশ নয়?
টিপু: আমি জানতে চাচ্ছি, রাজনীতি আপনার উপন্যাসের মান ক্ষুণ্ন করছে কিনা?
সমরেশ: এই রাজনৈতিক ঘটনা, এই চাল কেনার ঘটনা। সন্ধ্যাবেলায় লাইন দিয়ে চাল কেনা। সে যদি আপনার গল্পের নায়ক হয়, সেটা কি রাজনৈতিক উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ছে না?
টিপু: সৌন্দর্য জিনিসটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সমরেশ: কিভাবে বলবো, এই যে মানুষ… সৌন্দর্য তো বায়বীয় নয়। আকাশে ভাসে না। তাকে মাটিতে পা দিতে হয়। যে সাহিত্য আকাশে ভাসে সেগুলো তাৎক্ষণিক সাহিত্য। অনেক উপন্যাসের কথা আমরা জানি, পড়তে গেলে ফুরিয়ে যাবে। মানে ক্ষণকালের আনন্দ। সেগুলো কিন্তু শূন্যে ভাসে। সৌন্দর্যে ভরা! যেমন, নিমাই ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘নীলচাঁদ’, যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’। এই দুটো কুড়ি বছরের পর মানুষ আর পড়েনি। ওই যে আনন্দ দেয়া! সেগুলো ম্যাচিউর মানুষের কাছে আসে না। একজন পাঠক ১৭ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে অনেক ম্যাচিউর হয়ে ওঠে।
টিপু: তার মানে সৌন্দর্য থাকবে না?
সমরেশ: সৌন্দর্য তো থাকবেই, তবে তার চেহারা পাল্টাবে। যেমন, আমি একটা রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসা পরিবার নিয়ে গল্প লিখছি। ওদের লড়াইটা অন্যরকম। আপনার আমার পরিবারের মত নয়। ওদের ফুটপাতে বাঁচার জন্য টাকা যোগাড় করতে হয়। এরপর যখন বৃষ্টি আসে রাত্রিবেলায়, বৃষ্টির জন্য বুড়ো চাদনির মতো পর্দা-টর্দা টানায়। বাচ্চাটাকে কোলের মধ্যে নিয়ে নেয়, মা। তখন স্বামীকে বউটা বলে, আমাদের একটা বাসা হলে হতো না! এই যে ‘আমাদের একটা বাসা হলে হতো না’- এই যে সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের শেষ কথা বলে কিছু নেই।
সৌন্দর্য তো বায়বীয় নয়। আকাশে ভাসে না। তাকে মাটিতে পা দিতে হয়। যে সাহিত্য আকাশে ভাসে সেগুলো তাৎক্ষণিক সাহিত্য। অনেক উপন্যাসের কথা আমরা জানি, পড়তে গেলে ফুরিয়ে যাবে। মানে ক্ষণকালের আনন্দ। সেগুলো কিন্তু শূন্যে ভাসে। সৌন্দর্যে ভরা! যেমন, নিমাই ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘নীলচাঁদ’, যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’। এই দুটো কুড়ি বছরের পর মানুষ আর পড়েনি। ওই যে আনন্দ দেয়া! সেগুলো ম্যাচিউর মানুষের কাছে আসে না। একজন পাঠক ১৭ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে অনেক ম্যাচিউর হয়ে ওঠে।
ফরিদ: আমার মনে হয় টিপু বলেছে, ভাষার সৌন্দর্য?
সমরেশ: না না না এসথেটিক নিয়েই তো…
টিপু: সৌন্দর্য জিনিসটাই তো মোরাল এথিকস, মানে নৈতিক আদর্শ…?
সমরেশ: মোরাল এথিকস কেন? যেমন একজন ছবি আঁকছে। ছোট পরিবার, ছোট রুমে এদের বাস। কেন আঁকছে? যে ছবি আঁকছে সে কমার্শিয়ালি আঁকছে। এডফার্মের ছবি। একদিন সেই ফার্মে একজন বিদেশি এল। তো এডফার্মের মালিক আঁকিয়েকে বললো, তুমি তো ভাল আর্ট-টার্ট করো কিছু ছবি এঁকে দাও। আঁকিয়ে বলল, আমি তো ছেড়ে দিয়েছি। দশ-বারো বছর আগে আঁকতাম। এখন আঁকিটাকি না। সেগুলো আমার বউ ফেলে না দিলে, বাড়িতেই আছে। তবুও সে বাড়িতে নিয়ে গেল। আঁকিয়ে বউকে জিজ্ঞেস করল, আমার ছবিগুলো আছে? বউ কি বলল, ওরে আমার মুণ্ড। সে খাটের তলা থেকে কাপড়ে মোড়ানো ছবি বের করল। সেটা কি বউ যত্ন করে রেখেছিল? না, সেটা বউয়ের জন্য দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ছবিগুলো টানানোর জায়গা ছিল না। তো বিদেশি ছবিগুলো চড়া দামে কিনে নিয়ে গেল। গল্পটা এখানেই শেষ হয় না। শেষ কোথায়? রাত্রে সে বউকে বলল, আমাদের ঘরটা বেশ ছোট। ছবি টানাবার জায়গা নেই। তখন বউটা বলল, দেয়ালগুলো সরিয়ে দাও। এই যে দেয়ালগুলো সরিয়ে দাও, এটা সমাজের শেষ কথা। আমি এটাই বলতে চাইছি আপনাকে।
টিপু: আপনার একটা উপন্যাস আছে, ‘সাতকাহন’। এটাতে নারীকে কি বিপ্লবী হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন?
সমরেশ: না, নারীকে মানুষ হিসেবে দেখাতে চেয়েছি। একেবারে মানুষ হিসেবে। পুরুষ আর নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, একেবারেই।
টিপু: নারী চরিত্রতো এখানে সোস্যাল ভেল্যুজ ভাঙতে চায়?
সমরেশ: ভাঙার প্রশ্নতো উঠবেই। দেখুন, আমাদের পশ্চিমবাংলার বাঙালি নারীরা যারা পরিবারের, মা-বাবার কাছে মানুষ হয়েছে, তারা মেয়েদের কলেজে ভর্তি হত। ভর্তি হয়েছে কেন? এ অবস্থায় বেশির ভাগ মেয়েরাই বিএ পরীক্ষা দিলে ভালো পাত্র পাওয়া যেতো। বেশিরভাগ মেয়ে বিয়ের পরে এমএ পড়তো। যারা পড়ত না বা মেয়েদের বিদ্যালয়ে পড়ত না তাদের বিয়ে হত না। তো এরকম একটা পর্যায়ে এসে দেশভাগের পর বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো প্রচণ্ড স্ট্রাগল করেছে। এবং সেই স্ট্রাগলের বন্দনা করা তো ভয়ংকর ব্যাপার! আমাদের যে কলোনিগুলো তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়, সেগুলোতে দেশভাগের পর, তাদের মেয়েরা কিন্তু স্ট্রাগল করে করে স্কুল পার হয়ে কলেজে পড়েছে। ওই যে মেয়েরা সকালবেলা উঠে টিউশনি করে, তারপর রান্নাবান্না করে, মাকে হেল্প করে, তারপর সে কলেজে আসে। হেঁটে আসে কলেজে, তারপর কলেজ থেকে বাড়ি যায়। বাড়ি গিয়ে মুড়ি খেয়ে, তারপর আবার ঘরের কাজ করতে যায়। রাত নয়টা থেকে আবার ক্লাসের পড়া পড়ে। এই গল্পটা যখন পাশের মেয়েটা শুনছে, সে মেয়েটা রক্ষণশীল পরিবার থেকে এসেছে। ঠাকুরদা তাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে যায়, ঠাকুরদা ছুটির পর ফের নিয়ে যায়। তারতো কোন কালচারাল গ্রোথ নেই। এই মেয়েরা, এই যে মেয়েরা আমাদের এখানে, কে তাদের প্রভাবিত করলো আমাদের এখানকার মেয়েদের। কে তাদের উদ্বুদ্ধ করলো নিজের টাকায় পড়তে? তারা বাবা-মায়ের পয়সা দিয়ে পড়ে না। এসব মেয়েরা স্বপ্ন দেখে আমি পড়াশোনা করবো, আমি চাকরি করবো। যেনতেন চাকরি নয়, বড় চাকরি করবো। আমার বাড়িটা ভাল ভাল জায়গায় করবো। এই স্বপ্নগুলো গেঁথে গেল আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের মনে। ফলে একটা নবজাগরণ তৈরি হতে আরম্ভ করলো। আমি বলি, আমাদের দেশভাগের অনেক সুফল আছে। এপার বাংলার মেয়েরা না পেলে, ওপার বাংলার মেয়েরা পাচ্ছে না। এটা নিয়ে আপনি বিদ্রোহ করবেন? আমি মনে করি, এটাতো বড় বিপ্লব।
টিপু: তাহলে আপনি কি ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে সমর্থন করছেন?
সমরেশ: আমার মনে হয়, দেশভাগটা সঠিকভাবে হয়নি। জিন্না সাহেবকে যখন মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। তখন উনি রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বল্লভভাই প্যাটেলসহ অনেকে আপত্তি করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, জিন্না যদি প্রধানমন্ত্রী হয় দেশে রায়ট শুরু হয়ে যাবে। গান্ধি এটা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। গান্ধি যদি রাজি না হতেন, তাহলে এই পাকিস্তান-ভারতবর্ষ কি হতো আমি জানি না। আর, দেশভাগ হয়েছিল বলে কিন্তু বাংলাদেশ জন্মেছে। দেশভাগ না হলে কিন্তু বাংলাদেশ জন্মাতো না। জন্মাতো কি?
ফরিদ: সংঘাতটা হতো না…
সমরেশ: আমাকে কি ছাড়বেন, যেতে হবে…
টিপু: না না আরেকটু, দেশ ভাগটা শেষ করেন…
সমরেশ: এই যে পশ্চিমবঙ্গ, এই যে পূর্ববঙ্গ–দেশভাগ কার বিরুদ্ধে আন্দোলন হতো? আন্দোলন দানা বাঁধতো না।
ফরিদ: তখন হয়তো হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দানা বাঁধতো?
সমরেশ: হিন্দু আগ্রাসন হতো না।
ফরিদ: আপনার কি মনে হয় না, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষা আগ্রাসনের শিকার?
সমরেশ: হিন্দি আগ্রাসন ভারতবর্ষে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের একটা পার্ট বা অংশ, ভারতবর্ষের যেকোনো রাজ্যের, যেকোন ভাষার মানুষ, যেকোনো মানুষ এখানে আসতে পারেন। আবার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মানুষ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারেন। ফলে সেই আগ্রাসনের সম্ভাবনা নাই। তারা তাদের মত করে কথা বলছে। এটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
ফরিদ: আপনার কী মনে হয় না পশ্চিমবঙ্গে বাংলার বিকাশ যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, মানে আমরা বলতে চাচ্ছি, বাংলাভাষাটা একটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে। ভাষার যেভাবে বিকাশ হওয়ার কথা ছিল, সেটা ওইভাবে হতে পারেনি।
সমরেশ: অবশ্যই, ঠিকই বলেছেন। এটা নিয়ে কোনো আন্দোলন হয়নি বলে। এটার উন্নয়ন করার ভাবনার কথা কেউ ভাবেনি বলে। অবশ্য আমরা একমত হয়েছি। এই যে, ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করি। আমরাও পশ্চিমবাংলায় উদযাপন করছি। সারারাত জেগে হাঁটি, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানগুলো গাই, ১৯৫২ সালে যে শহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তারা কেন প্রাণ দিয়েছিল, ভাষাকে বাঁচাবার জন্য। একটা সম্মান রাখার জন্য জীবন দিয়েছিল। উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আমরা সারাবছর ধরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন কিন্তু এটা নিয়ে ভাবিই না। আমরা একটা দিন ভাবি– যেটা ২১ ফেব্রুয়ারি। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের বেলায় ভাবি। তাহলে, আমরা ভাষা নিয়ে ভাবছি না। এই ভাবছি না বলে আমাদের এই বাংলাভাষায় অদ্ভুত অরাজকতা; অর্থাৎ আগাছা ঢুকে গেছে। এখন আপনি দেখুন, আপনি যখন কবিতা লেখেন যে ভাষায় লেখেন, আপনি যখন গদ্য বা গল্প লেখেন সে ভাষায় লেখেন না। কেন এই পার্থক্য? কেন এই ভাষায় এতো উর্দু-আরবি-ফারসি ঢুকল? যে উর্দুর জন্য ৫২ সালে মানুষ আত্মত্যাগ করলেন, সেই উর্দু শব্দ কেন বাংলাদেশের ভাষায় ঢুকলো, এটা নিয়ে কেউ ভাবেননি, কোনো কথা বলেননি। আমার একটা প্রস্তাব ছিল, একটা কমিটি তৈরি করে বাংলাভাষার একটা স্ট্যান্ডার্ড চেহারা দেওয়া হোক। এটা আগের চেয়ে ডেভেলপড এবং আগাছাগুলোকে ঝেড়ে ফেলা হোক।
ফরিদ: উর্দুতো একটা প্রতীক ছিল মাত্র, মানে…
টিপু: এটা ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রেও হতে পারত…
ফরিদ: সেটা হিন্দি হতে পারত, সেটা তুর্কি হতে পারত…
সমরেশ: আজকে ধরেন, যেভাবে বাংলায় প্রাণ পাচ্ছেন, যেভাবে আপনি কবিতা পড়ছেন, গল্প পড়ছেন, আপনি সেটা করার জন্য সচেতন হয়ে উঠছেন, আসলেই…
টিপু: বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকের গুরুত্ব আছে। রাজ্য এবং রাষ্ট্রের যে পার্থক্য, এখানে ঘটেছে কি না?
সমরেশ: না, এটা হচ্ছে…। যেমন ধরুন, আজকের কাগজে আছে, কতজন বাঙালি বা বাংলাদেশীকে লিবিয়া জিম্মা নিয়েছে, ৪০০ বাঙালি। ‘জিম্মা’ শব্দটা কেন লিখবে?’ ‘জিম্মা’ তো বাংলা শব্দের ধারে কাছে নেই।
টিপু: আবহাওয়া তো পশ্চিমবঙ্গে বলে। ‘আব’ তো আরবি শব্দ…
সমরেশ: ‘আবহাওয়া’টা তো আজকের না। ২০০-৩০০ বছর ধরে আবহাওয়া রয়েছে।
টিপু: ভাষার আত্মীকরণটা স্বাভাবিক কিনা?
সমরেশ: আত্মীকরণ দিয়ে বুঝতে চান, যেকোনো ভাষার উপর শব্দ আসবে। যেমন, ইংরেজিতে টেবিল, চেয়ার, শার্ট, প্যান্ট হিসেবে এসেছে। সেটা অভ্যেস হিসেবে এসেছে। পশ্চিমবাংলায় কোনো মানুষের ভাষায় জিম্মা শব্দ শুনবেন না। কবিতা পড়েন, গদ্যে পড়েন, গল্প পড়েন। কোথাও জিম্মা শব্দটা ছিল না। এগুলো কেন জানি মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পর থেকে এইসব শব্দ টুকটুক করে ঢোকাচ্ছে। আমার চেয়ে আপনারা ভালো বুঝবেন! আপনারা যদি লেখাগুলো পড়েন, এই বাংলাটার সঙ্গে আপনার তখনকার কিছু না কিছু বাংলা আলাদা। ‘ইমদাদুল হক মিলন’ যে বাংলা লেখেন, হুমায়ূন সে বাংলা লেখেন না। সুনীল, শীর্ষেন্দু যে বাংলা লেখেন, সে বাংলায় কিন্তু হুমায়ূন লেখেন না। আবার হক সাহেব যে বাংলা লেখেন, সে বাংলা কিন্তু আমাদের অনেকেই লেখেন না। এটা কেন হচ্ছে? একটা ঠিকঠাক বাংলা তৈরি হচ্ছে না। আমি আঞ্চলিক ভাষার কথা বলছি না। ‘আঞ্চলিক ভাষা’ তো মানুষ বলবে, কেননা এটা তার মায়ের ভাষা। আঞ্চলিক বাংলা যদি তার মায়ের ভাষা হয়, তাহলে বাংলা কি তার বাবার ভাষা? আমি বলি, একটা হচ্ছে ঘরের ভাষা, আর একটা কাজের ভাষা। ঘরের ভাষায় একজন, সে নিজের মায়ের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে, সে কাজ করতে সে বাংলা বলবেন না। মানছেন তো এটা?
টিপু: বলেন…
সমরেশ: কাজেই যে তার ঘরের ভাষায় গল্প লেখেন, উপন্যাস লেখেন—সেটা কি গ্রহণীয় হবে?
আত্মীকরণ দিয়ে বুঝতে চান, যেকোনো ভাষার উপর শব্দ আসবে। যেমন, ইংরেজিতে টেবিল, চেয়ার, শার্ট, প্যান্ট হিসেবে এসেছে। সেটা অভ্যেস হিসেবে এসেছে। পশ্চিমবাংলায় কোনো মানুষের ভাষায় জিম্মা শব্দ শুনবেন না। কবিতা পড়েন, গদ্যে পড়েন, গল্প পড়েন। কোথাও জিম্মা শব্দটা ছিল না। এগুলো কেন জানি মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পর থেকে এইসব শব্দ টুকটুক করে ঢোকাচ্ছে। আমার চেয়ে আপনারা ভালো বুঝবেন! আপনারা যদি লেখাগুলো পড়েন, এই বাংলাটার সঙ্গে আপনার তখনকার কিছু না কিছু বাংলা আলাদা।
টিপু: আপনার একটা উপন্যাসে ‘আবু’ শব্দ আছে। আরবি আবু মানে ‘আব্বা’। কিন্তু বাবা বলার ক্ষেত্রে ‘আবু’ শব্দটা ব্যবহার করা হয় না। আপনি কেন ‘আবু’ শব্দটা ব্যবহার করলেন?
সমরেশ: যেহেতু আমি দিনের পর দিন শুনছি এবং পড়ছি, যার সঙ্গে, ষাট বছর আগেকার বাংলাদেশের লোকের মুখের শব্দ, আমি ধরে নিয়েছি, দীর্ঘদিন ব্যবহার করতে করতে টেবিল-চেয়ারের মত আবুও চলে এসেছে । ‘আম্মা’ এবং ‘আমু’ এবং ‘মা’ও বলে অনেকে।
ফরিদ: কিন্তু আবুর ব্যবহারটা আসলে এই বঙ্গে কখনো ছিল না। সেটা ছিল আব্বা বা আব্বার অপভ্রংশ হিসেবে আব্বু অথবা ‘আম্মার’ অপভ্রংশ হিসেবে আম্মু। সেটা একটা মধুর ডাক হিসেবে ব্যবহার হতো…
সমরেশ: এটা ছিল ১৯৩৮-৪০ সালের, উপন্যাসের নামটা ভুলে গেছি। ওখানে আমি ‘আবু’ শব্দটা পাই। আমার ধারণা হলো, ৭২ বছর আগে ‘আবু’ শব্দটা এখানে কেন ছিল। এখানে আমি এক বাড়িতে গেছি, সেখানে ‘আবু’ বলে ডাকলো। আমি যেখানে থাকতাম, ওখানেই ওরা বাস করতো। আমি যদি বহিরাগত হতাম তাহলে ব্যবহার করতাম না। আমি যা শুনবো, আমি যা পড়বো তাইতো লিখব। ঠিক আছে?
টিপু: আরেকটা প্রশ্ন করি, আপনি লেখার ক্ষেত্রে বাজারকে কি খুব মূল্য দেন?
সমরেশ: না, না, আমি আমার মতো লিখি। পাঠক পড়লে পড়বে, না পড়লে নাই। যেমন, বাণিজ্যের কথা ভেবে আমি লিখি না। আমার প্রিয় উপন্যাস, ‘এখনো সময় আছে’। ২০০০-৩০০০ কপির বেশি বিক্রি হয়নি। কেন হয়নি? সেটা আমি বলতে পারব না। সেটা পাঠকের ভাল লাগেনি। একজন পাঠকের ভালো না লাগতেই পারে। আর না হলে সে পাঠক ছুটেই যায়। এই যার ভাল লাগছে সে ‘কালবেলা’ কিনছে। তারপরও বলব, ‘এখনো সময় আছে’ ভাল উপন্যাস। আমি আমার মতো করে লিখে যাই, পাঠক চাইলে পড়ে আবার রিজেক্টও করে।
ফরিদ: আপনি কি পাঠকের কথা মনে রাখেন না বলতে চাচ্ছেন?
সমরেশ: আমি পাঠককে বুঝবো কি করে। আমার এই উপন্যাসটা লিখলে পাঠক পড়বেই, যদি আমি জানতাম, তাহলে পৃথিবীর সব লেখকই তাই করতো। পাঠক যা চায় তাই লিখতো।
ফরিদ: ভাষা নিয়ে কি আপনি কখনো ভেবেছেন, মানে, যে ভাষাটা আপনার নিজের। যেমন– সতীনাথ ভাদুড়ীর ভাষা একরকম, কমলকুমার মজুমদারের ভাষা আরেক রকম?
সমরেশ: আমি কমলকুমারের ভাষা কখনোই গ্রহণ করতে পারিনি। কারণ, সেটা মানুষের ভাষা না। মানুষ সে ভাষায় কথা বলে না, আরোপিত ভাষা সেটা। এখন আমি সেই ভাষা ব্যবহার করি, যে চরিত্র, চরিত্রগুলো যে ভাষায় কথা বলে, একটা বাড়ির কাজের মহিলা, কাজ করতে আসে সে। তার ভাষাটা বঙ্কিমের লাইন ধরে না। তার তো রবীন্দ্রনাথ পড়ারও ক্ষমতা নেই। সে তার ভাষায় কথা বলে, সে ভাষাতেই তো আমাকে লিখতে হবে। জীবনের যে ভ্রমণ আছে, তার জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে।
ফরিদ: কিন্তু একজন লেখক কি চেষ্টা করতে পারেন না, ভাষার নতুন সম্ভাবনার দিকটা খতিয়ে দেখার?
সমরেশ: বুদ্ধদেব বসু প্রায় ইংরেজি স্টাইলে বাংলা লিখতেন। বানানও পরিবর্তন করতেন। প্রথমে চোখে চকচকে লাগত। রাংতা কাগজে মোড়া একটা কিছু সুন্দর! কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বোঝা যায়, এর দিকে নজর দেওয়ার পরে—মূল থিমটা, মূল গল্পটা, মূল বক্তব্যটা ঝিমিয়ে যাচ্ছে। মানে যেটা বলতে চাইছি, যে, তুমি দারুণভাবে ডেকোরেশন করছো! কিন্তু যাকে নিয়ে ডেকোরেশন করছো, সেটা আর হল না। কিন্তু যাকে নিয়ে, যে ভাষায় বললে, সেটা খুব খেলো হয়ে গেছে। এই ক্ষমতাটা আমাদেরও ছিল না। সেটা রবীন্দ্রনাথের ছিল। রবীন্দ্রনাথ যেটা পারেননি, আমরা সেটা কিভাবে পারবো?
ফরিদ: রবীন্দ্রনাথের ভাষাও তো মানুষের মুখের ভাষা ছিল না!
টিপু: আপনি কি আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক এগুলো পড়েছেন?
সমরেশ: আমি প্রায় অনেকের লেখাই পড়িনি।
টিপু: ওদের সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
সমরেশ: এই যে ধরুন, ইলিয়াস সাহেব। ইনি সদ্য লেখক। গৃহীত লেখক নন। গৃহীত মানে জনগৃহীত লেখক নন। সদ্য লেখক কখনোই জনপ্রিয় হন না।
টিপু: কোন রাজনীতি আছে এতে?
সমরেশ: নো রাজনীতি! আপনি একটা চিলেকোঠার …
ফরিদ: ‘চিলেকোঠার সেপাই’…
সমরেশ: চিলেকোঠার সেপাই একটা বিশাল মিথ পাল্টানোর মতো, তবে এটা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। আপনার আমার বাসার মেয়েরা এই ধরনের উপন্যাস পড়ে না।
ফরিদ: তাহলে কি আপনি বলবেন, একটি ভালো উপন্যাস আমপাঠক নেয়নি। তাহলে আমপাঠকের ওপর সাহিত্যমূল্য নির্ভর করে?
সমরেশ: একটি ভাল উপন্যাস আমপাঠক নেয়নি। একাধিক ভালো উপন্যাস আমপাঠক নিয়েছে।
ফরিদ: আমার তো মনে হয়, খুব কম ভালো উপন্যাস আমপাঠক নিয়েছে…
সমরেশ: আমার দুটো প্রিয় উপন্যাসের নাম বলছি। একটা ‘ট্রিয়লজিগুলো’, আরেকটা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’। এগুলো অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। গত ষাট বছরে রবীন্দ্র পরবর্তী, বিভূতিভূষণ পরবর্তী সময়ে এই দুটো ল্যান্ডমার্ক উপন্যাস। এখনো প্রতি বছর ২০০০-৪০০০ করে বিক্রি হচ্ছে ষাট বছর ধরে। একটা প্রজন্ম মারা যাচ্ছে, সেই প্রজন্মও কিনেছে। আর যারা কুড়ি-বাইশ বছর, লেখার সময় জন্মায়নি, তারাও কিনছে। আমি যখন লিখেছি ১৯৭৯ সাল। আজ থেকে ৩২ বছর আগে। একটা ছেলে তখন জন্মায়নি। কালকের মেলায় দেখলাম, তার বয়স কত, হয়তো ১৯ হবে। সেতো আমার লেখার সময় জন্মায়নি। তাহলে সে কালবেলার নাম শুনেছে কোত্থেকে? স্যার আমাকে বলেছে, তারপরে মা বললো। আমি বলছি না, কালবেলা মহৎ উপন্যাস। কিছু কিছু উপন্যাস রিলে রেসের মত প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে। সেগুলো ভালো উপন্যাস, খারাপ উপন্যাস যায় না।
টিপু: ধরেন, আজকে চলছে না, ভবিষ্যতে চলবে না?
সমরেশ: এসব কথা আমরা একসময় বলতাম। এর বিচার করবে কাল।
টিপু: আমি কালের বিচার করছি না। মানুষের রুচি নির্ভর করে সে কি খায়, কিভাবে বাঁচতে চায়, কি বাজার করে? এই রুচি কি পাল্টাতে পারে?
সমরেশ: হু... হু…
টিপু: ইলিয়াস তো গৃহীত মধ্যবিত্তের কাছে।
সমরেশ: আমার কাছে যা খবর ছিল, আপনার সঙ্গে একমত হচ্ছে না। ইলিয়াস শ্রদ্ধার সঙ্গে গৃহীত সেই প্রজন্মের কাছে যারা বুদ্ধিজীবী বা বোধসম্পন্ন মানুষ।
টিপু: এটা তো মাহমুদুল হক ও আহমদ ছফা দুজনের ক্ষেত্রেই?
সমরেশ: ইলিয়াস আর হুমায়ূন আহমেদ—যদি পাশাপাশি দাঁড় করান। তাহলে তো তুলনা করা যাবে না, জনপ্রিয়তা কার বেশি?
ফরিদ: না, জনপ্রিয়তা হুমায়ূন আহমেদেরই বেশি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের, যদি বলেন কাল-উত্তীর্ণ উপন্যাস তাহলে আপনি কোনটির নাম বলবেন?
সমরেশ: কোন একটি উপন্যাস হয়তো হবে।
ফরিদ: কিন্তু তার প্রতিটি উপন্যাসই তো প্রায় পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হচ্ছে…
সমরেশ: আমি তো ওই জায়গায় যেতে চাইছি না। আমি যেতে চাইছি, সত্যিকারের উপন্যাসের কাছে। রবীন্দ্রনাথের অনেক উপন্যাস আছে। তবে গোরা উপন্যাস কেউ পড়ত না। গোরা বিক্রি হত না। গোরা জনপ্রিয় হয়নি, কিন্তু গোরা তো বেশ মহৎ উপন্যাস। শেষের কবিতা পড়তো, গোরা পড়তো না। শেষের কবিতা অত্যন্ত বাজে উপন্যাস। অত্যন্ত গৌণ উপন্যাস। সাজানো বানানো উপন্যাস। কিন্তু গোরা তো বিশ্বাস করার মতো, যাকে বলে মানুষের কথা, একদম মাটি থেকে বলা। পাঠককে পড়তে বাধ্য করা যায়। বড় উপন্যাসের বেলায় টান টান ভাবটা যদি থাকে তাহলে পাঠক পড়ে শেষ করবেই। টানটা যদি না থাকে, খটমট শব্দ, শব্দের ব্যবহারগুলো আমার পরিচিত নয়, বিষয়টা আমাকে তেমনভাবে মোহগ্রস্ত করছে না। যেমন আমাদের দেশের গীতা। ঠাকুর ঘরে রেখে দেয়, কেউ পড়ে না সে রকম। আমার এক মাসি মা, উনি গীতা পড়তেন আর শিব পূজা করতেন। মাসি মাকে বললাম, মহাভারতের কৃষ্ণের কথা। মহাভারতে যুদ্ধ যখন হচ্ছে, মারপিট হচ্ছে, মানুষ খুন হচ্ছে, তখন কৃষ্ণ বসে বসে উপদেশ দিচ্ছেন? তখন তিনি বললেন, না না কৃষ্ণ মুখে মুখে উপদেশ বলছিল, অন্য কেউ লিখেছিল। কৃষ্ণ যখন মুখে মুখে বলছে, অন্য যে লোকটা লিখছে, সে লোকটাও মারা যাচ্ছে না? মাসি মা বলল, তুই কি বলতে চাস? এটা তো মহাভারতের একটা অঙ্গ। মহাভারতের একটা চরিত্রের নাম কৃষ্ণ। একজন লেখক যখন চরিত্র তৈরি করেন তখন তার মুখ দিয়েই কথা যা বলার সেগুলো লেখকেরই কথা। গীতা কিন্তু ব্যাস দেবেরই লেখা। ব্যাস লিখেছিলেন বলে কৃষ্ণ বলেছিলেন। মহাভারত লিখেছিলেন ব্যাস দেব ও তার বন্ধুরা। কারণ, সে মুহূর্তে গীতা দেখুন, আজকে কিছু কিছু মানুষ না পড়ে দ্রুত শ্রদ্ধা জানায়, কিছু মানুষ পড়ে শ্রদ্ধা জানায় আর বেশিরভাগ মানুষই সেগুলো পড়তে চায় না। তার কারণ, পড়ে যদি শিক্ষিত হয়ে যাই।
টিপু: আপনি ডায়ালগের চাইতে আখ্যানকে বেশি গুরুত্ব দেন কেন?
সমরেশ: আখ্যান না, মানসিকতা, চিন্তাটাকে বেশি গুরুত্ব দিই। আমি ভাবলাম, সেই ভাবনাটাকেই আমি বেশি গুরুত্ব দিই। মানে চরিত্র ভাবনা। বিশ্লেষণ করতে সুবিধা হয়। আর সংলাপ …
টিপু: সংলাপ কম, কিন্তু আখ্যানের পরিমাণ বেশি।
সমরেশ: এটা আপনি আমাকে বললেন, ভাই আমি তো এভাবে ভাবিইনি। আমি ভেবে-চিন্তে নিই।
টিপু: ধন্যবাদ।
সমরেশ: নতুনধারার পাঠকদেরকে অনেক ধন্যবাদ।
প্রথম প্রকাশ: অধুনালুপ্ত নতুনধারা পত্রিকা।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন