নোবেলজয়ী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ডরিস ল্যাসিংয়ের সাক্ষাৎকার

অ+ অ-

 

|| ডরিস ল্যাসিং ||

ব্রিটিশ গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। ১৯১৯ সালের ২২ অক্টোবর পার্সিয়ার (বর্তমান ইরান) কারমানশাহ শহরে এক ব্রিটিশ দম্পতির ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার নাম ছিল ডরিস মে টেইলর। বাবা আলফ্রেড কুক একজন ব্যাংকার ছিলেন, তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ আর্মির ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। মা এমিলি ম্যুড টেইলর ছিলেন একজন নার্স। ১৯২৫ সালে আরো স্বচ্ছলতার আশায় তাদের পরিবার দক্ষিণ রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) চলে যায়। আন্ডার মাই স্কিন (১৯৯৪) আত্মজৈবনিক গ্রন্থে তিনি এই শৈশবের কথা বর্ণনা করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সমাপ্তি টানেন। তারপর নানা সময়ে অ্যানি, টেলিফোন অপারেটর, স্টেনোগ্রাফার ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। এরই মাঝে তিনি কিছু ছোট গল্প প্রকাশ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি ফ্রাংক চার্লস উইজডমকে বিয়ে করেন, ১৯৪৩ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। তারপর ১৯৪৫ সালে জার্মান-ইহুদি গডফ্রেড ল্যাসিংকে বিয়ে করেন। তার সঙ্গে একটা সমাজতান্ত্রিক দলের যোগাযোগ হয়, যারা বর্ণবাদ নিয়ে কাজ করতো। ১৯৪৯ সালে তিনি গডফ্রেডের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছেলে পিটারকে নিয়ে লন্ডন চলে যান আর লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করায় তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সে দেশে প্রবেশ করতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে তার বেড়ে উঠার দেশ দক্ষিণ রোডেশিয়ায় একই কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত হন।

একজন সাদা কৃষকের স্ত্রীর সঙ্গে তার কালো কাজের ছেলের অম্লমধুর সম্পর্কের এক হৃদয় বিদারক কাহিনি নিয়ে ১৯৫০ সালে প্রথম উপন্যাস দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং প্রকাশ করেন তিনি। তার আধা-আত্মজৈবনিক গ্রন্থ চিল্ড্রেন অব ভায়োল্যান্স সিরিজ আকারে প্রকাশ করেন। মার্থা ওয়েস্ট (১৯৫২), অ্যা প্রপার ম্যারেজ (১৯৫৪), অ্যা রিপল ফ্রম দ্য স্টর্ম (১৯৫৮), ল্যান্ডলকড (১৯৬৫) ও ফোর গেটেড সিটি (১৯৬৯) গ্রন্থগুলোতে মার্থা কোয়েস্ট চরিত্রের মাধ্যমে নারী স্বাধীনতার প্রতিটা পরিস্থিতি ও পর্যায়কে বর্ণনা করেছেন। কাল্পনিক চরিত্র মার্থা কোয়েস্ট ও ডরিস ল্যাসিংয়ের বাস্তব জীবনের এমন আন্তমিশ্রণ সিরিজটাকে অনবদ্য করে তুলেছে। আন্ডার মাই স্কিন (১৯৯৪) এবং ওয়াকিং ইন দ্য শেড (১৯৯৭) আত্মজৈবনিক উপন্যাস দুটিতে শুধু নিজের জীবন না একটা দেশের সমগ্র কালকে যেন তুলে ধরেছেন।

১৯৬২ সালে প্রকাশিত তার দ্য গোল্ডেন নোটবুক উপন্যাস তার লেখক জীবনের মহৎকর্ম হিসাবে বিবেচিত হয়। ষাটের দশকের নারীবাদী আন্দোলন এই উপন্যাসকে নারীবাদী উপন্যাসের অগ্রগন্য বলে মনে করে। মানবিক আবেগ ও রাজনৈতিক আদর্শের মাঝে দ্বন্দ্বকে একটা জটিল বর্ণনা ভঙ্গির মাধ্যমে প্রস্ফূটিত করেছেন। নানা রকম দলিল ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণ যেমন সংবাদপত্র কাটিং, তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্র দৃশ্য, স্বপ্ন ও দিনলিপির সন্নিবেশে এক অনন্য রচনা শৈলীর অবতারণা করেন। খণ্ডিত আখ্যানগুলো মুখ্যচরিত্রের মন ও চেতনার প্রতিফলন করেছে। সমগ্র আখ্যানকে কোন একক বয়ানে ধরা যাবে না। ১৯৮৫ সালে দ্য গুড টেরোরিস্ট উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি সামাজিক বাস্তবতার আখ্যানে ফিরে আসেন। নারীর অধীনতা ও বামপন্থী আদর্শের নিয়ন্ত্রণের বিচ্ছিন্নতা বোধ এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে।

ক্যানোপাস ইন আরগ্যস (১-৫ খণ্ড, ১৯৭৯-১৯৮৪) ধারাবাহিক উপন্যাসটিতে তিনি কল্পবিজ্ঞান আখ্যান শৈলীর আশ্রয় নিয়েছেন। পারমাণবিক যুদ্ধোত্তর মানুষের জটিল বিকাশের রেখাচিত্র এঁকেছেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ টাইম বাইটসে তিনি ইদ্রিস শাহর সুফিবাদী ভাবনায় আলোড়িত হয়ে রচনা করেন। সংশয়, উদ্দীপনা ও দূরদর্শী শক্তির আচড়ে একটা বিভক্ত সভ্যতাকে নিরীক্ষণের মাধ্যমে নারীর অভিজ্ঞতার মহাকাব্যিক রচিয়তা হিসাবে ডরিস ল্যাসিংকে ২০০৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই সাক্ষাৎকারটি ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিলে লন্ডনে তার বাসভবনে গ্রহণ করেন অধ্যাপক জন মুলান। 

ছবি: উইকিমিডিয়ার সৌজন্যে

  

আমরা যারা লিখতাম তারা ধরেই নিতাম আমাদের অতো টাকা হবে না। আমাদের ছিলও না। আর এটা নিয়ে আমরা তেমন চিন্তা করতাম না। কিন্তু কারও তেমন টাকা হয়নি। লিখে কেউ ধনী হয়ে যায়নি। লিখে কেউ একটা রেফ্রিজেরটর বা দুটা গাড়ি কিনে ফেলবে এমন আশা করতো না। আমরা এমন চিন্তা করতামই না। আমরা এমন ভাবনাকে বুর্জোয়া ও কুরুচির পরিচয় বলে মনে করতাম।

 

সাক্ষাৎকার || ক্রুশচেভের হাতে সমাজতান্ত্রিক দল ভেঙ্গে বিচূর্ণ হয়ে গেল || ডরিস ল্যাসিং

বাংলা অনুবাদ || পলাশ মাহমুদ

 

হ্যালো, আমি জন মুলান, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইংরেজির অধ্যাপক। আমি আজকে ২০০৭ সালে সাহিত্যে নোবেল জয়ী ঔপন্যাসিক ডরিস ল্যাসিংয়ের সঙ্গে কথা বলবো। ডরিস আমার মনে হয় আমাদের আলোচনা আপনার প্রথম উপন্যাস দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং দিয়ে শুরু করলে ভালো হয়। কারণ এই উপন্যাসটিকে এখনো আপনার অনুরক্ত পাঠকরা একটা শক্তিশালী উপন্যাস বলেই মনে করেন।

ডরিস ল্যাসিং: কেউ কেউ তো মনে করে এটাই আমার লেখা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এমন মনে করাটা আমার জন্য খুবই বিরক্তিকর।

আপনার কি মনে পড়ে, উপন্যাসটি লিখতে কোন বিষয়টা আপনাকে প্রলুব্ধ করেছে?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে। অনেকেই বলতো আমি একজন লেখক। কতো গল্প লিখেছি। কিন্তু এখনও কোন উপন্যাস লিখিনি কেন? আসলে তখন আমি একটা আইনি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। বার বার জানতে চাওয়ায় আমার নিজেরও একবার মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে। এখন আমাকে একটা উপন্যাস লিখতেই হবে। আমি আমার বস মি. হিলের কাছে গিয়ে বললাম, মি. হিল আমি আপনার চাকরিটা ছেড়ে দেবো আর একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করবো। কথাটা শুনে মি. হিল হেসে ফেললেন। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি একটা উপন্যাস লিখে ফেললাম। তারপর আমি প্রায় ১০ বছরের জন্য একটা সংকটে আটকে গেলাম।

উপন্যাসের ভাবনাটা শুরু হয়েছিল একটা সংবাদপত্রের কাটিংকে ভিত্তি করে। এই ঘটনাকেই আমি উপন্যাসে তুলে এনেছি। দেখোসাদারা কি সহ্য করতে পারে না, জানো? তারা কখনোই পারে না। তা হলো, যারা তাদের মহান বা দারুণ কিছু মনে করে না। যারা তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না, আমি নিজেও তেমন একজন ছিলাম। আমি এভাবে কখনো চিন্তা করে দেখিনি। উপন্যাসে একজন নারী আছেন যে আমার পাশের ফার্মে কাজ করতো। সে কাজে নতুন যোগ দিয়েছিল। তার ব্যাপারে অন্যসব খামারিদের মধ্য একটা বদনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। সে একজন কৃষকের স্ত্রী ছিল। রাধুনী ছেলেটাকে তার পিছন থেকে পরনের জামা বেধে দিতে বলতো। চুল আচড়ে দিতে বলতো। একজন মেয়ে হিসাবে আমি এটা দেখতে পারতাম না। আমার মনে হতো, এমন আচরণ সহজে মেনে নেওয়ার মতো না। তাই বুঝতেই পারছো। উপন্যাসে আমি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলাম ওই রাধুনী ছেলেটা কেন তার মালকিনকে হত্যা করেছিল। এই ব্যাপারটা সহ্য করা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল।

আর আপনি যে পত্রিকার কাটিংয়ের কথা বললেন সেখানে কি বলা ছিল?

ডরিস ল্যাসিং: পত্রিকাও এমন কিছু একটা বলেছিল। আমার কাছে রাখা আছে কোথাও... ঘটনাটা এমন ছিল... রাধুনী তেমন ছিল... হত্যাকাণ্ড এমন এমন ছিল... আর হত্যার পিছনে কোন কারণ ছিল না

তার মানে উপন্যাসের শুরুটা যেমন ছিল ওই রকমই বলেছিল?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ। তেমন কিছুই হবে। সম্ভবত একই রকম ছিল। কিন্তু আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে এমনটা কেন হলো? সে কেন তাকে হত্যা করলো। তাই আমি যখন দেখলাম এই ঘটনায় একটা ভয়ানক নির্দয়তা প্রকাশ পেয়েছে ও সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। বিশেষ করে ছেলেটির প্রতি নারীটির যে আচরণ ছিল। আপনি মনে হয় বুঝতে পেরেছেন। মানে এটা খুব সহজেই বোঝা গিয়েছে। তাই আমার উপন্যাসের কালো রাধুনীটি যার হৃদয়ে ম্যারি টার্নারের প্রতি মানুষের সহজাত অনুভূতি কাজ করছিল। কিন্তু ম্যারি আচানক ছেলেটির সঙ্গে কুকুররের মতো ব্যবহার করতে থাকে। এবং কোন রকম দয়ামায়া না রেখেই তাড়িয়ে দেয়। এই ছিল কাহিনী। আমাকে যা করতে হয়েছে তা হলো ওই কৃষকের স্ত্রীর কথা মনে করা যখন তারা বলেছিল... সে তার রাধুনী ছেলেটাকে তার জামা পিছন থেকে বেধে দিতে বলতো... নিজেকে একটা শিশুর জায়গায় বসিয়ে আপনি বিষয়টা ভালো করে ভেবে দেখেন। এটা নিশ্চিত একটা প্রমাণ ছিল। আসলে কি ঘটেছিল সবাই জানে। এটা কিন্তু কোন মেয়ের সঙ্গে ঘটেনি।

আমি বছরের পর বছর ধরে এই গল্পটা লিখেছি। এই গল্পটা একটা যুদ্ধ কেন্দ্রিক। সব ইউ-বোট দুইবার করে ইংল্যান্ড গেল। প্রত্যাখ্যাত হলো। তৃতীয়বারের মতো আবার ফিরে এলো। আমি বইটা দেখলাম আর ভাবলাম: হে খোদা, এই বইটার দুই তৃতীয়াংশ খুব দীর্ঘ। আমি এটা হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম। খুব নিখুঁতভাবেই লক্ষ্য করলাম। আমি প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছেঁটে বাদ দিলাম। তারপর উপন্যাসটা দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং হয়ে উঠলো। এখন পাঠক কিন্তু ঠিকই প্রশংসা করে বলে আহা! কি সুন্দর কাঠামো! তারা যদি জানতো এটা কতোটা খামখেয়ালির ভেতর দিয়ে বর্তমান রূপ পেয়েছে। তারপর আমার এক বন্ধু পাণ্ডুলিপিটা একটা প্রকাশকের কাছে বিক্রি করে দিলো। প্রকাশক এটা ছাপতে রাজি হলেন না কারণ তার কাছে উপন্যাসটা কঠিন ও শ্লেষাত্মক লেগেছে। আমি জানি না এই কথাটা কতোবার বলেছি। দ্য গোল্ডেন নোটবুক আমার কাছে বেশি শ্লেষাত্মক লেগেছে। তিনি প্রকাশ করলেন না আর জোহানেসবার্গে পাণ্ডুলিপিটা বন্দি হয়ে থাকলো।

বহু বছর কেটে গেল। আমি ইংল্যান্ড চলে আসলাম। আমি কুরটিস ব্রাউন প্রকাশনায় আমার ছোট গল্প পাঠালাম। প্রকাশক জুলিয়েট ওহেয়ার আমাকে কাছে জানতে চাইলেন: আমার কাছে কোন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আছে কিনা? আমি উত্তরে জানালাম: হ্যাঁ, আছে। কিন্তু এটা জোহানেসবার্গে বিক্রি হয়ে গেছে। তিনি পাণ্ডুলিপিটা দেখতে... তিনি পড়লেন। আধা পৃষ্ঠা হবে হয়তো পড়েছেন। পড়ে বললেন তার জীবনে এর চেয়ে জঘন্য কিছু দেখেননি। তিনি জোহানেসবার্গের প্রকাশককে টেলিগ্রাম করে বললেন: এখনই এই লেখককে মুক্ত করে দাও আর তা না হলে আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য অপদস্থ করে ছাড়বো। কিন্তু সে এ কথায় কিছু মনেই করলো না। কারণ সে আসলে একটা ভণ্ড ছিল। জুলিয়েট পাণ্ডুলিপিটা পেয়ে এক সপ্তাহের মধ্য মাইকেল জোসেপের কাছে বিক্রি করে দিলো। আপনি দেখে থাকবেন বইটি প্রকাশের আগেই খুব নাম করেছিল। কিন্তু আমি যে কতোটা নির্বোধ ছিলাম আপনি বিশ্বাসই করবেন না। তারা আমাকে ফোন করে বললো: বইটা প্রকাশের আগেই তারা পুনর্প্রকাশ করছে। আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি ভাবলাম বইটা সবার কাছেই আরাধ্য হয়ে উঠছে। তারপর এটি প্রকাশ পেল এবং খুব আলোচিত হলো। তারপর তো উপন্যাসটার পাঁচ থেকে ছয়টি সংস্করণ প্রকাশ পেলো। সব এক টানে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তাই না?

হ্যাঁ।

ডরিস ল্যাসিং: তাই।

আমার কাছে মনে হচ্ছিল... আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমি বইটা আরেকবার পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল শুধুমাত্র ওই নারীর স্বর শুনছিলাম না বরং আমার নিজের খণ্ড খণ্ড স্মৃতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। উপন্যাসটির বর্ণনা শৈলী, মানে দৃশ্যের বর্ণনার কথা বলছিলাম। যদিও আমি জানি আপনি একে আটপৌরে বলবেন। এই রকম একটা বই যখন প্রথমে পড়ি, আমাকে আলাদা একটা জগতে ধরে নিয়ে আটকে রাখে যেন...

ডরিস ল্যাসিং: এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নাই।

হুম।

ডরিস ল্যাসিং: সাদা কৃষকের অস্তিত্ব আর নেই। বিলীন হয়ে গেছে।

আপনি যদি খেয়াল করে থাকেন তাহলে আমি এতে খুব আগ্রহী। উপন্যাসের মূখ্য চরিত্র মানে নায়িকা কিন্তু ততটা বীরোচিত নয়। একটা খুব মজার ব্যাপার হলো সে যেখানে যেমন ছিল সেখানেই আমাদের আগ্রহের কেন্দ্র। কিন্তু আমার কাছে তার চরিত্রটা অনেক আপত্তিজনক মনে হয়। তার ব্যবহার অত্যন্ত জঘন্য। তার প্রতি আপনার দরদ ও বিরক্ত মেশানো অদ্ভুত এক অনুভূতি ছিল মনে হয়।

ডরিস ল্যাসিং: আপনি দেখেছেন তার চরিত্রটা আমার খুব পরিচিত একটা শহরের মেয়ের আদর্শে তৈরি করা। শহুরে মেয়ে রাস্তায় বের হওয়ার জন্য আফ্রিকায় কখনো কারো বিরাগভাজন হতে দেখবেন না। সে এমন এক মেয়ে ছিল যে কি না তার স্কার্ট হাঁটুর উপর উঠিয়ে দেখতো কোন পিঁপড়ে তার পায়ে উঠেছে কি না অথবা এমন অন্য কোন কিছু। আমি ভেবেছিলাম মানে আমার যতটুকু মনে পড়ে আমি কল্পনা করেছিলাম যে যদি সে কোন কৃষকের বউ হতো তাহলে পাগল হয়ে যেতো। আমি তাকে নিয়ে এমন সব কল্পনা করতাম। আমি গল্পে তাকে নিয়ে তাই করলাম। একজন কৃষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলাম। সে ঠিকই পাগল পাগল হয়ে উঠলো। সে বাঁশ ঝাড় সহ্য করতে পারলো না। বাঁশ ঝাড় সহ্য করতে পারে না, আমার চেনা এমন মেয়ে ছিল। সে একা ছিল না। তারা এমনভাবে হাঁটতো মনে হতো তারা রাস্তায় বসবাস করছে।

কেউ একজন আমাকে বলেছিল এমন ধরনের মেয়ে তারা অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছে। তাই আমার প্রশ্ন ছিল তারা কেন এই দুনিয়ায় বিয়ে শাদী করে সংসার পাতে। কিন্তু সে তো বিয়ে করতে চাইছিল। আমরা এমন সমাজে থাকি যাদের বিয়ে করতেই হয়। আজকে দিন পর্যন্ত তাদের বিয়ে করতে হয়। যদি বিশ বছরের মধ্যে আপনি বিয়ে না করেন তাহলে ধরে নিবে আপনার কোন সমস্যা আছে। সে কিন্তু বিয়ে করেনি। সে এক প্রকার সবার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিল। আমি একটা কথাটা ঠিক মনে করতে পারছি। সে সবার বন্ধু হয়ে উঠেছিল আর এসব কিছুই বিয়ের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।

আপনার পরের বইটা কি দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং-এর মতো সফল হয়েছিল। আপনার কি মনে হয়েছিল যে, হুম এখন আমি লেখক হতে পারি। লেখালেখি আমার পেশা হতে পারে। লেখালেখি করেই আমি জীবিকা নির্বাহ করতে পারবো।

ডরিস ল্যাসিং: আমি কিন্তু লেখালেখি করে জীবন চালাতে পারছিলাম। বিষয়টা খুব মজার ছিল। এক জায়গায় আমার একটা জীবন বৃত্তান্ত দেখলাম সেখানে লেখা আছে আমি শর্টহ্যান্ড টাইপ রাইটার ছিলাম। কিন্তু আমি তো তা ছিলাম না। তারা বিশ্বাস করবে না লেখালেখি করে আমি যা আয় করতাম তার মধ্যেই আমার জীবন চলে যেতো। এভাবে আমার বহু বছর ভালোই চলেছিল। আমি ১০ বছর যাবত লিখছিলাম। একদিন কেউ একজন আমাকে বলেছিল আমি যা আয় করি তা একজন শ্রমিকের গড় আয়ের সমান। তা যেমনই হোক। আমার মনে নেই গত বছর কতো ছিল। আজকে যদি আপনি বই লেখেন তাহলে লোকে যে ভাবে দেখে তেমন করে আমাদের সময়ে দেখতো না। এখন আপনি লেখেন মানে আপনার অনেক টাকা হবে।

হুম। তাই।

ডরিস ল্যাসিং: এখন আর তেমন করে কেউ ভাবে না। তখন আমরা যারা লিখতাম তারা ধরেই নিতাম আমাদের অতো টাকা হবে না। আমাদের ছিলও না। আর এটা নিয়ে আমরা তেমন চিন্তা করতাম না। কিন্তু কারও তেমন টাকা হয়নি। লিখে কেউ ধনী হয়ে যায়নি। লিখে কেউ একটা রেফ্রিজেরটর বা দুটা গাড়ি কিনে ফেলবে এমন আশা করতো না। আমরা এমন চিন্তা করতামই না। আমরা এমন ভাবনাকে বুর্জোয়া ও কুরুচির পরিচয় বলে মনে করতাম।

তার মানে ১৯৫০ দশকে আপনি যা লিখতেন তা লিখতে গিয়ে আপনি পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতেন, তাই না? প্রকাশক বা জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করার কোন চাপ ছিল না, তাই না?

ডরিস ল্যাসিং: না। আমি কিছু ছোট গল্প লিখেছিলাম যেগুলো নিয়ে কোন প্রকাশক খুশি ছিলেন না। আমি তখন শুরু করেছি মাত্র। একটার পর আরেকটা লিখে যাচ্ছি। তবে আমার মনে পড়ে না যে আমি কখনো বলেছি, এখন আমি লেখক হয়ে উঠেছি। কিন্তু আমি তো লেখকই ছিলাম। আমাদের সময়ে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল। আসলেই সময়টা অন্যরকম ছিল।

আর আপনি কিন্তু লিখেছেন। ১৯৫০ দশকে চিলড্রেন অব ভায়োল্যান্স-এর মতো ছোট গল্প লিখেছিলেন। ওই বইগুলোতে আপনার আফ্রিকার জীবনের গল্প উঠে এসেছে।

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ। বেশিরভাগ লেখা আত্মজৈবনিক ছিল। তবে দ্য ফোর গেটেড সিটি আত্মজৈবনিক ছিল না।

না। মার্থা কোয়েস্ট-এর মতো চরিত্রগুলো আপনার আত্মস্বরূপ ছিল বলা যায় কি?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ। সে ছিল। তবে পুরোপুরি না। আপনি হয়তো জানেন যে কাহিনিটা পুরোপুরি আপনার আবিষ্কার। কিন্তু পরে কোন এক জীবনীকার এসে জানতে চাইবে কোনটা সত্য আর কোন কল্পনা? কিন্তু ব্যাপারগুলো এমন না। এই ব্যাপারে আপনাকে বসে ভাবতে হবে। এখন হয়তো আপনি সব মনে করতে পারবেন না। কিন্তু না, বেশিরভাগ অংশই কল্পনা। অর্ধেকেরও কম কমা বন্ধনীতে সত্য হয়তো থাকে। আপনি যাই লেখেন না কেন কোন না কোনভাবে তা পরিবর্তন হয়ে যায়।

এই উপন্যাসগুলোতে আমার যতটুকু মনে পড়ে মার্থা মার্ক্সবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাই না? যদি পেছন ফিরে দেখেন তাহলে আপনার কি মনে হয় এই বিষয়টা তখন কথাসাহিত্যের জন্য সমৃদ্ধ ও লোভনীয় বিষয় ছিল?

ডরিস ল্যাসিং: অ্যা রিপ্লাই ফ্রম দ্য স্ট্রম উপন্যাসটা এর অনেক কাছাকাছি ছিল। পরিহাসের ব্যাপার কি জানেন, দক্ষিণ রোডেশিয়ার সমাজতান্ত্রিক দলের এই উপন্যাস নিয়ে একটা অভিযোগ, একটা আপত্তি ছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার কি জানেন, আমার বন্ধুর এক ছাত্র বইটা পড়ে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছে যে, সে সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দিয়েছিল। আমি ভুলে গিয়েছি অন্য আর কোন দল এমনটা ভেবে নিয়েছে। আমার এটাও মনে হয়েছে এই বই পড়ে কেউ কখনো সমাজতন্ত্রে নিজেকে জড়াবেন না। কিন্তু না, এমন সব ঘটনা প্রায়শ ঘটে থাকে।

এই ধরনের উপন্যাস থেকে কোন লোক কেমন শিক্ষা নেবেন আপনি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন না। মানে ১৯৬২ সালের আগে পরে মানে যখন দ্য গোল্ডেন নোটবুক প্রকাশ হলো। উপন্যাসের এমন আঙ্গিক খুবই অন্য রকম।

ডরিস ল্যাসিং: আচ্ছা। এমন ছিল তাহলে।

আমার মতে কাঠামোর দিক দিয়ে এই উপন্যাসটা অসাধারণ। কিন্তু প্রথম দিকের পাঠকের কাছে এই বইটা নিশ্চয়ই অদ্ভুত রকম ছিল। একজন বয়ানকারীর অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিফলিত করার ব্যাপারটা অনবদ্য। আপনার এমন উদ্ভাবনের ভাবনা কেমন করে এলো, মনে পড়ে?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ, খুব মনে পড়ে। প্রথম কথা হলো তখনকার পত্রিকায় উপন্যাসের নতুন আঙ্গিক আবিষ্কার করার ব্যাপক চল ছিল। সাহিত্যের বাতাস উপন্যাসের নবধারার জন্য মুখরিত ছিল। আমি তখন এই উপন্যাস নিয়ে কাজ করছি। আমি মনে হয় সাম্প্রতিককালে অ্যা গোল্ডেন নোটবুক উপন্যাসের সারকথা নিয়ে অন্য কোথাও বলেছি। যতটুকু মনে পড়ে উপন্যাসের দ্বিতীয় বাক্য এমন ছিল: সবকিছুতে চিড় ধরেছে। আমার মনে হয় এমন কিছুই আমি লিখছিলাম। তবে নারীবাদীরা এই উপন্যাসকে আগাগোড়া একটা নারীবাদী আখ্যান বলে দাবি করে। আমি কিন্তু তেমন মনে করে লিখিনি। এমন অভিধা দেয়াতে আমি দীর্ঘদিন বিষয়টা নিয়ে বিরক্ত ছিলাম।

সে যাই হোক, উপন্যাসের এই খণ্ডিতকরণের আইডিয়া কিভাবে পেলাম? আমি ঠিক জানি না। আমি একটা নোটবুক পেলাম আর নোটবুকের আদলে টুকরো টুকরো করে লেখা শুরু করলাম। আমি আলাদা টেবিলে আলাদা আলাদা নোটবুক কল্পনা করতে থাকলাম। আর তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করে ফেললাম। বইটা যেন আমার কল্পনা থেকে ফেটে বের হতে চাচ্ছিল। এখন হয়তো কেউ মনে করতে পারবে না। কেউ গুরুত্ব দিবে না। যখনই ফোনের সুর বেজে উঠতো কেউ না কেউ সমাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে গেছে, কেউ না কেউ আত্মহত্যা করেছে, আপনাকে তার ধর্মের দিকে টেনে নিয়েছে, কেউ না কেউ বিখ্যাত ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে। সে এক অপূর্ব সময় ছিল। দেখলেন ওই দল এতো বছর পর কিন্তু আমার কথা শুনলো। সবার জন্য দল কিন্তু একটা ভালো অভিজ্ঞতা ছিল। একটা ইউটোপিয়া ভেতরে ভেতরে অঙ্কুরিত হচ্ছিল। অনেক অনেক লোক তাতে বিশ্বাসও এনেছিল। কিন্তু আমাকে ছাড়াই সবকিছু সুন্দর চলে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আমার কোন আফসোসও নেই।

আপনি কি, মানে আপনি কি এর ফলে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ, মনোমুগ্ধকর সব রিভিউ পেয়েছিলাম। এখনও অনেক লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে বলে: কলিনডেল পত্রিকায় আপনার বইয়ের রিভিউ পড়েছি। যেসব জায়গায় ছেপেছে সব জায়গায় খুব অসাধারণ লিখেছে। আর আমি বলি, হ্যাঁ, আমি জানি। ওর বিচি ভেঙ্গে দেবো, এটা ছিল সবার প্রিয় বাক্য ও পুরুষ বিদ্বেষী একটা অভিব্যক্তি।

হ্যারল্ড ব্লুম এই অভিব্যক্তিকে পুরুষ লিঙ্গের প্রতি ক্রুসেড হিসাবে অভিহিত করেছে

ডরিস ল্যাসিং: তিনি সম্প্রতি এই কথা বলেছেন নাকি?

না। অনেক আগেই বলেছেন।

ডরিস ল্যাসিং: ও আচ্ছা। দেখেছেন, অন্য সবাই এমন কথাই বলেছিল। আমাকে একটা বিষয় খুব বিক্ষুব্ধ করেছিল তা হলো আগের কোন আলোচক উপন্যাসের এই নতুন চমৎকার আঙ্গিকটা নিয়ে তেমন কিছু বলেননি। এমনকি তার এটা দেখেননি। আমি যা বর্ণনা করেছি তাই নিয়ে সবাই অস্বস্তিতে ছিলেন। তারা অন্য কিছুর প্রতি নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তারপর থেকে সাহিত্য পর্যালোচনার প্রতি আমার আলাদা মনোভাব তৈরি হয়েছে। তারা... তাদের পক্ষে খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়া সম্ভব নয়। যাই হোক, এভাবেই চলছিল। আর আমি পেয়েছিলাম... কিছু লেখক আছেন যারা আমাকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে রক্ষা করে গিয়েছেন। কবি এডউইন ম্যুর দ্য গোল্ডেন নোটবুক নিয়ে আমাকে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখেছিলেন। অনেক লোক আমাকে বলতো: এগুলো পড়ো না। এগুলোর কোন অর্থ হয় না।

বহু সময় কেটে গেল। বিশ্বের বহু দেশ থেকে বইটা ছাপা হলো। আমেরিকাসহ অন্যসব জায়গায় প্রকাশ পেলো। ফ্রান্স ও জার্মানিতে প্রকাশিত হলো না। কারণ তারা উপন্যাসটাকে বেশ শ্লাঘাত্মক মনে করতো। দীর্ঘ ১০ বছরের কথা ভাবতে পারেন আপনি? সবাই দ্য গোল্ডেন নোটবুক নিয়ে সহজ সাবলীল ছিল। কিন্তু শুধু তারাই বইটা প্রকাশ করতে চাইলো না। এমন হলে কি হয় আপনি ভালো করেই জানেন। এই অভিজ্ঞতা কিছু দেশ ও মানুষ সম্পর্কে আমার আলাদা একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে নারীবাদী আন্দোলন চলাকালে তারা উপন্যাসটিকে নারীবাদী দলিল হিসাবে ছেপে দিল।

তাই উপন্যাসের একটা অংশে যখন বহুল প্রচলিত নাম-পুরুষে বর্ণনা করা হলো। অ্যানার নোটবুকের ফ্রি ওমেন শিরোনামের অংশটা কিন্তু সেভাবে লেখা হয়নি। আমি যখন সম্প্রতি এটা আরেকবার পড়লাম, আমার কাছে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক লাগলো।

ডরিস ল্যাসিং: এটা ব্যঙ্গাত্মক হওয়াটা আবশ্যিক ছিল। কারণ এটা প্রথাগত একটা ছোট উপন্যাস যেটা পশ্চিমের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য ছিল। আমার মতো কিছু লেখক যে বেদনা অনুভব করে তাকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতা একদিকে খুব সমৃদ্ধ ও তীব্র ছিল। এমন ছোট একটা আখ্যান কিন্তু কতো আবেগপূর্ণ ছিল। তারপর এর মধ্যে একটা ফাটল দেখা দিল। ভুলে গেলে চলবে না আমি তখন একটা বিশৃঙ্খল সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। যখন ক্রুশচেভের হাতে সমাজতান্ত্রিক দল ভেঙ্গে বিচূর্ণ হয়ে গেল। তার দেয়া ভাষণ অনেক কমিউনিস্টের জন্য ভয়ানক ছিল। আপনি জানেন, কতো মানুষের জীবনে নিমিষেই শেষ হয়ে গেল।

পূর্ব প্রান্তের শ্রমজীবী কমিউনিস্ট ছেলেদের জীবন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। এই দল ছিল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তারা সব শিখেছে। তারপর দেখলো তারা এতদিন যা জেনে এসেছে তার সব সত্য নয়। তাদের জন্য এখনও আমার খুব খারাপ লাগে। এই ঘটনাটা এমন ভয়ানক ছিল। কিছু মানুষ ছিল, কি বলবো, কি শব্দ ব্যবহার করবো জানি না, হ্যাঁ, দৃঢ় চেতনার চরিত্র। তাদের জীবন একদম শেষ করে দিয়েছে। কিছু লোক আমার মতো খুব অনুতাপ করতো যে, ক্রুশচেভ যা করেছে সেটা নিয়ে তেমন বেশি কিছু বলেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে যা ঘটছিল তার খবর আমাদের কাছে ছিল কিন্তু ক্রুশচেভ সে বিষয়ে অনেক কিছু বলতে পারতেন। তিনি স্তালিন সম্পর্ক একটা নীরব অভিযোগ করেছেন শুধু। মুখে কিছু বলেননি। তাই কিছু লোক যখন বললো, না না, এমন কিছু ঘটতে পারে না। এটা পুঁজিবাদী মিডিয়ার প্রচার। অর্থোডক্স কমিউনিস্টরা এমন কথাই বলতো। অন্যেরা বলতো, খোদার দোহাই লাগে কেন এই ঘটনা অন্য রকমভাবে ঘটলো না, আরো ভালো করে ঘটলো না। এতো বিশৃঙ্খল কেন হলো? এখন তো জানেন, কতো কতো বছর পর সত্যটা প্রকাশ পেলো।

 

আমি বছরের পর বছর ধরে এই গল্পটা লিখেছি। এই গল্পটা একটা যুদ্ধ কেন্দ্রিক। সব ইউ-বোট দুইবার করে ইংল্যান্ড গেল। প্রত্যাখ্যাত হলো। তৃতীয়বারের মতো আবার ফিরে এলো। আমি বইটা দেখলাম আর ভাবলাম: হে খোদা, এই বইটার দুই তৃতীয়াংশ খুব দীর্ঘ। আমি এটা হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম। খুব নিখুঁতভাবেই লক্ষ্য করলাম। আমি প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছেঁটে বাদ দিলাম। তারপর উপন্যাসটা দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং হয়ে উঠলো।

 

ছবি: উইকিমিডিয়ার সৌজন্যে

আমার মনে হয় এটা সময়ের চালাকি। এখনো অনেকে দ্য গোল্ডেন নোটবুক কে মনে করে, মানে আপনি যে রাজনীতির কথা প্রকাশ্যে বলেছেন তাকে অনেকে লৈঙ্গিক রাজনীতির গোপন ইতিহাস বলছেন। আমার মনে হয় তারা কমিউনিজম নিয়ে যত না বলেছে তার চেয়ে বেশি জানতো। অগণিত মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গের কথা জানতো। তারা এই বিষয়ে আগেই জানতো। আগেই খেয়াল করেছে। মানুষের আচরণের উপর এই ঘটনা একটা অসাধারণ ব্যঙ্গ। এই দিকটা সম্প্রতি আমার চোখে পড়েছে। উপন্যাসের পুরুষ চরিত্রগুলো কেমন বিদঘুটে, তাই না?

ডরিস ল্যাসিং: আপনার কাছে বিদঘুটে মনে হলেও আমার কাছে তারা বাস্তব জগতের সাধারণ পুরুষ বলেই মনে হয়েছে।

হুম।

ডরিস ল্যাসিং: স্বাভাবিক ব্যবহার করা। আমার মনে হয় না আপনি এমন ভাবছেন। কিন্তু...

অনেক দিকই আছে। আমার মনে হয়, এখানে সময়ের প্রতিফলন ঘটেছে।

ডরিস ল্যাসিং: পুরুষগুলো তাদের স্ত্রীদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল না বলে মনে করছেন?

উপন্যাসে অনেক বিবাহিত পুরুষ আছে, তাই না? কে অ্যানা আর তার বন্ধু মলি?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ।

তারা প্রায়ই এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিল। অথবা এমন সুযোগ খুঁজে ফিরছিল বলা যায় অনেকটা ফ্রাইশিয়ানের মতো। কিন্তু একই সঙ্গে তারা তাদের গোছানো পরিপাটি বুর্জোয়া জীবনকে ছাড়তে চায়নি।

ডরিস ল্যাসিং: এটা আমার কাছে প্যারিস রিয়ালিজম ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয়নি। দুজন নারী চরিত্র একাকী বাস করছে। দুজনেই খুব আকর্ষণীয় সুন্দরী। এমন একটা সমাজ দেখিয়েছি যেটা খুব উদার সমাজ। আমি একে বিদ্রুপাত্মকভাবেই ব্যবহার করেছি। এমন একটা সমাজে কি ঘটবে বলে আশা করেন? আমি অযথা কঠোর হতে চাইনি। আচ্ছ, কি নিয়ে বলছিলাম। আমি আমার কথার খেই হারিয়ে ফেলেছি।

আমি উপন্যাসের সহযোগী পুরুষ চরিত্রদের নিয়ে ভাবছিলাম। অ্যানা উলফ শেষ পর্যন্ত বিবাহের পরামর্শ দাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, তাই না?

ডরিস ল্যাসিং: আমার কাছে এটা খুব হাস্যকর মনে হয়েছে।

হুম। আসলেই হাস্যকর।

ডরিস ল্যাসিং: আর মলি হলো... আমার মনে পড়ছে না সেও কি এমন কিছু করেছে কিনা? ভুলে গেলে চলবে না তারা কমিউনিস্ট ছিল। বিশ্বে একটা ইউটোপিয়া রাজ করবে এই স্বপ্ন লালন করছিল।

আচ্ছা! মলি বিয়ের সমালোচনা করে নিজেই আবার বিয়ে করেছে শেষ পর্যন্ত।

ডরিস ল্যাসিং: হুম। এইতো ধরতে পারলেন। দেখেছেন আপনি। এটা হলো... আমার কাছে এই সবকিছু খুব হাস্যকর মনে হয়েছে। আপনাকে শুধু আমাদের সময়ের সঙ্গে পার্থক্যটা মিলিয়ে দেখতে হবে। তারা কমিউনিস্ট ছিল। নতুন দুনিয়ার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছিল কিন্তু তাদের শেষটা দেখেছেন। বিয়ের পরামর্শদাতা।

এই বইটা তৈরি হওয়ার আগেই কি আপনি এই ব্যাপারটা সম্পর্কে সজাগ হয়েছিলেন। আমি জানি না এটা একটা পবিত্র গ্রন্থ হয়ে উঠেছে। যারা বইটাকে পড়েছে তারা ভীষণভাবে এর ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। বইটা তাদের জীবনকে বেশ প্রভাবিত করেছে। যারা একে ছোট করে দেখেছে তারা নয় যারা একে নিয়ে গর্ব করেছে তাদের মাঝে। এটা হতে কি খুব বেশিদিন লেগেছে?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ। অনেক সময় লেগেছে। এই বইটা নারীবাদীদের কাছে একটা আদর্শ হয়ে উঠেছিল। ওই নারীবাদীদের কাছে যারা আমার খুব ক্ষতি করেছিল। মানে আমি অনেক পুরুষের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলাম, যারা লিখেছে: নারীবাদী বই বলে তারা বইটা কখনো পড়েনি। আর এখন এটা... হ্যাঁ। আমি এমন চিঠি অনেকবার পেয়েছি। তাই নারীবাদীরা আমার এমন ক্ষতি করে দিয়েছে। পুরুষ পাঠকদের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। তারা চুপ ছিল না। ওই সময়ের কট্টর নারীবাদীতার সময় যাচ্ছিল। আমি যখন সুইডেন গেলাম তখন কিছু অভিনেত্রী আমার কাছে এসে বলেছিল: এই বইটা আমার বই। এটা আপনার বই না। একদম আপনার না। আমি জীবনে শুধু ব্লু নোটবুক পড়েছি। এমন অতিরঞ্জিত হাইস্টোরিক আবোল-তাবোল ঘটনা ঘটছিল।

উপন্যাসের আঙ্গিক নিয়ে আগে আপনি যা করেছেন আর এই বইটা লেখার পর আপনার কি মনে হয়েছে যে উপন্যাসের নিয়ে নিরীক্ষা করতে এখন আপনি আরো বেশি মুক্ত? অথবা উপন্যাসের নতুন কোন রীতি আবিষ্কার করতে চান? মানে যে ধরনের উপন্যাস আপনি লিখেছেন তার থেকে অন্য রকম কিছু কি করতে চেয়েছেন?

ডরিস ল্যাসিং: আপনি জানেন আমি এমন অনেক বই লিখেছি যা প্রচলিত রীতির বাইরে, যা বাস্তব ভিত্তিক নয়। শিকাস্তা উপন্যাস লেখার আগে আমি দ্য মেময়ারস অব অ্যা সারভাইবর এবং ব্রিফিং ফর অ্যা ডিসেন্ট ইনটু হেল লিখেছি। উপন্যাস দুটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ভিত্তি থেকে রচিত। এই পাঁচটা উপন্যাস আমার নিজের কাছে আমার শ্রেষ্ঠ লেখা মনে হয়। অনেকে হয়তো তাই মনে করে।

আপনার ক্যানোপাস ইন আরগ্যস উপন্যাস?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ।

তাই নাকি?

ডরিস ল্যাসিং: শিকাস্তা সিরিজের আগেই আমি অন্য সব শ্রেষ্ঠ উপন্যাস লিখে শেষ করেছি। যেগুলো প্রত্যেকটা একটা থেকে অন্যটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এটা অবশ্য তেমন করে সিরিজ ছিল না। আমি কিন্তু সবসময় লিখে গেছি। আপনি জানেন লেখা ছাড়া জীবনে আর কিছু করিনি। আমি চোখে পড়ার মতো কোন সামাজিক জীবনও এড়িয়ে গেছি। কারণ আমার একটা সন্তান ছিল। বাড়িতে সন্তান রেখে আপনি প্রতিরাতে নাচের পার্টিতে যেতে পারেন না।

আমার মনে হয় পাঠক কিন্তু আপনার লেখা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের কথা নিয়ে বেশ ভেবেছে। আপনি প্রথম দিকে যে ধরনের লেখক ছিলেন, মানুষ তার থেকে বিপরীত রকম লেখক হিসাবে আপনাকে ভেবে নিচ্ছে। আপনার লেখার যে ধরনের পাঠক তৈরি হয়েছিল আপনি সেখান থেকে সরে ভিন্ন কিছু লেখা শুরু করলেন। আপনার এমন জনপ্রিয়তার কালে এমন ঝুঁকি নিলেন কেন?

ডরিস ল্যাসিং: আচ্ছা। আপনি ছেড়ে দেন না। মানে এখন হয়তো সব পাল্টে গেছে। উপন্যাস কিন্তু সবার জন্য না। আমার মনে আছে আমি যখন সান ফ্রান্সিসকোতে ছিলাম, একজন লোক দাঁড়িয়ে বললো: ডরিস, এতো কিছুর পর আমার মনে হয় না আপনি সেই গতানুগতিক বাস্তববাদী উপন্যাসই লিখে যাবেন। সঙ্গে অন্য একজন নারী উঠে বললো: ডরিস, আপনি এখন চমৎকার কিছু সাইন্স ফিকশন লিখে ফেলবেন আশা রাখি। তারপর তারা দুজন একটা যুক্তি-তর্কে জড়িয়ে পড়লো। পুরো শ্রোতামণ্ডলী একটা বিতর্কে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি শুধু চুপচাপ শুনলাম। এমন ঘটনা এখন কিন্তু ঘটবে না। কারণ এসব নিয়ে এখন কেউ এতো ভাবে না। এটা একটা সমস্যা। উপন্যাস কিন্তু এমন মাধ্যম না যেখানে আপনি আপনার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী লিখতে পারবেন। তাই নয় কি? তাই আমি মনে করি না যে আজকের দিনে সেই ঝুঁকি আছে।

সাইন্স ফিকশন লেখাটাকে আপনার এতো দরকারি মনে হলো কেন কিংবা এটা লেখার উদ্দেশ্য কি ছিল? মানে কেন লেখা শুরু করলেন?

ডরিস ল্যাসিং: আমি এটা লিখতে চেয়েছি কারণ কেউ একজন বলেছিল যে, আজ পর্যন্ত কেউ কখনো দ্য ওল্ড টেস্টাম্যান্ট মানে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ, দ্য অ্যাপোক্রিপা, দ্য নিউ টেস্টাম্যান্ট এবং কোরান পরপর পড়েনি। কেউই পড়েনি। কেউ যদি পড়ে থাকেন তাহলে দেখবেন এটা আসলে একই ধর্মের বিভিন্ন পর্যায়। এটা খুবই স্পষ্ট। তাই আমি একবার পড়ে দেখলাম আর অবাক হয়ে বললাম: ও খোদা, আসলেই তো সবগুলো ধর্ম একই ধর্মের বিভিন্ন পর্যায়। তারপর আমি শিকাস্তা লিখতে উদ্বুদ্ধ হলাম। কিন্তু আমি তখনও ভাবিনি সাই-ফাই উপন্যাস লিখবো। আমি শুধু লিখে ফেললাম, মানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা চলে এলো। আরেকটা বই আমি অনেকদিন যাবত লিখতে চেয়েছিলাম তা হলো দ্য ম্যারেজেজ বিটুইন জোন্স থ্রি, ফোর এন্ড ফাইভ। আমি এটা নিয়ে প্রায় ১০ বছর যাবৎ ভেবে আসছিলাম। আমি ঠিক একে আকার দিতে পারিনি। হঠাৎ করেই এটা একটা আকার পেয়ে গেল।

এই সিরিজটার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা আমাকে খুব সৃজনশীল করে রেখেছিল। ওই বইটা লেখার পরপর আমি দ্য সিরিয়ান এক্সপেরিমেন্ট লিখে ফেললাম যেটা আমার অন্যতম ভালো কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু খুব কম মানুষই এটা পড়েছে। তারপর হঠাৎ করেই এটা লেখা বন্ধ হয়ে গেল। কেন বন্ধ হলো আমি জানি না। কোন একটা আইনি জটিলতা হয়তো ছিল। এখন ভুলে গেয়েছি কি হয়েছিল। ব্যাপারটা এমন নাটকীয় ছিল। কারা যেন কিসে স্বাক্ষর করে সিরিজটা কোথাও পাঠাতে চেয়েছিল। কোথায় আমার মনে নেই। তারপর আমি এটা লেখা বন্ধ করে দিলাম। একটা কষ্টের ব্যাপার ছিল সেটা। কিন্তু কোন ব্যাপার না। পরে আমি আরো বই লিখেছিলাম।

একটা বিষয় জানতে চাই। ক্যানোপাস ইন অ্যারগস বইটি প্রকাশের পর আমি ওই দলে যোগ দিয়েছিলাম, যারা আপনি সামাজিক বাস্তববাদী উপন্যাস লিখছেন না বলে অভিযোগ করেছিল। আপনার প্রতি নারাজ ছিল। কারণ আপনি অ্যা ডায়েরি অব অ্যা গুড এইবার উপন্যাসটি জেইন সমারস ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন, তাই না? এই কৌশল অবলম্বন করার কারণ কি বলবেন?

ডরিস ল্যাসিং: আচ্ছা। আপনি অল্পতেই খুব বিরক্ত হয়ে যাবেন যদি আপনি একই... মানে একই রিভিউ ঘুরে ফিরে পড়েন। তাই ভাবলাম যেভাবে লিখে আসছি তার থেকে অন্যভাবে লিখে দেখি কি হয়। আমি খুব ভালো করে আন্দাজ করতে পারছিলাম কি রকম হতে যাচ্ছে। কারণ আমি এই বইটা একই সঙ্গে আমার দুইজন প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ এটা প্রকাশ করতে চাইলো না। কিছু পাঠকের রিপোর্ট দেখে বুঝলাম তারা এটা নিয়ে খুবই সংশয়ে ছিল। কিন্তু আমার প্রথম প্রকাশক মাইকেল জোসেফ পাণ্ডুলিপিটা মনোনীত করলো। আমরা ঠিক করলাম আমার পরিচয় গোপন রাখবো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ওই প্রধান দুটি প্রকাশনা যারা তাদের হয়ে বই নির্বাচনের কাজ করতো। তারা দেখলাম আমার লেখা নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইলো।

এটা তো অনবদ্য ঘটনা। সত্যি তাই?

ডরিস ল্যাসিং: শুনে অবাক হয়েছেন, তাই না। তারপর বইটা প্রকাশিত হলো আর আমি প্রথম বইয়ের মতোই চমৎকার সব রিভিউ পেলাম। আরেকটা মজার ঘটনা হলো। আমেরিকা থেকে একজন লিখেছিল যে নিউইয়র্ক টাইমসকে এই বইটার রিভিউয়ের জন্য ওই প্রকাশক কমিশন করেছে যেখানে সে দাবি করেছে যে, এই বইটা চমৎকার কিন্তু তারা ছাপেনি। তারা প্রকাশ করলেও কিন্তু বইটা ভালো করতো। আমার প্রথম বই থেকেও বেশি। তাই ব্যাপারগুলো কেমন যেন অনিশ্চিত। পুরো ব্যাপারটাই এমন। কেউ কিন্তু ভাবেনি আমি কে এবং এই ব্যাপারটা খুবই অসাধারণ। ফরাসি ও জার্মানরা কিন্তু এখন আমার বই প্রকাশ করে। তারা জানে না যে আমি সেই আমি। তারা নিঃসংকোচে... আমি ব্যাপারটা খুব উপভোগ করেছি।

ডাস্ট জ্যাকেটে কি কিছু লেখা ছিল। আমার মনে পড়ে আমি বোধ হয় কোন একটা সংস্করণে লেখা দেখেছি যেটা নির্দেশ করেছিল যে, জেন সমারস লেখকের আসল নাম নয়। লেখক লন্ডনের খুব পরিচিত একজন সাংবাদিক এমন কিছু কি লেখা ছিল?

ডরিস ল্যাসিং: এটা কি এই মহাদেশে?

আমার মনে হয় এটা ছিল... এটা কোন ব্রিটিশ সংস্করণে লেখা ছিল। আমার তাই মনে হচ্ছে।

ডরিস ল্যাসিং: আমি জানি না। আমি দেখিনি কখনো।

আপনি যে ছদ্মনামে লিখেছেন তার একটা ইঙ্গিত ছিল বইতে...

ডরিস ল্যাসিং: হুম। আমার ঠিক মনে পড়ছে না।

এটা চমৎকার বিবর্ণ ধারার উপন্যাস। অত্যন্ত বিবর্ণ বই। যদি বাস্তববাদের কথা বলেন তাহলে এটা কঠিন বাস্তববাদী উপন্যাস। কারণ এর মধ্যে বাস্তবের...

ডরিস ল্যাসিং: বৃ্দ্ধ বয়সের ব্যাপার আছে।

বৃ্দ্ধ বয়স। নিঃসন্দেহে তাই।

ডরিস ল্যাসিং: অনেক কারণ আছে। আমি অনেক কিছুই মনে করতে পারছি না। বাড়ি থেকে দূরে কোথাও আমি কিছু বৃদ্ধ লোকের সংশ্রবে গিয়েছিলাম। তিনজন বৃদ্ধ নারী ও একজন বয়স্ক পুরুষ ছিল। তাদের সঙ্গে আমার সাত বা আট বছরের একটা সংযোগ ছিল। তাদের মধ্যে মাডি নামে একজনের সঙ্গে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। মাডি অত্যন্ত বদরাগী বৃদ্ধা ছিল।

 

আমার মনে আছে আমি যখন সান ফ্রান্সিসকোতে ছিলাম, একজন লোক দাঁড়িয়ে বললো: ডরিস, এতো কিছুর পর আমার মনে হয় না আপনি সেই গতানুগতিক বাস্তববাদী উপন্যাসই লিখে যাবেন। সঙ্গে অন্য একজন নারী উঠে বললো: ডরিস, আপনি এখন চমৎকার কিছু সাইন্স ফিকশন লিখে ফেলবেন আশা রাখি। তারপর তারা দুজন একটা যুক্তি-তর্কে জড়িয়ে পড়লো। পুরো শ্রোতামণ্ডলী একটা বিতর্কে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি শুধু চুপচাপ শুনলাম। এমন ঘটনা এখন কিন্তু ঘটবে না। কারণ এসব নিয়ে এখন কেউ এতো ভাবে না। এটা একটা সমস্যা।

 

ছবি: মেইল এন্ড গার্ডিয়ান

তার মানে চরিত্রটা বাস্তব কাউকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল...

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ, তার চরিত্র বাস্তবভিত্তিক ছিল। তারপর আমাদের যোগাযোগ শেষ হয়ে গেল। এখন আর মনে করতে পারি না। এটা কি বইয়ের না বাস্তবের ঘটনা। সে ক্যান্সারে মারা যায়।

হ্যাঁ, বইতে এমন ঘটেছে।

ডরিস ল্যাসিং: আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু তারা সবাই মারা গেছে। সবাই আমার বয়সী ছিল। তারা মরে গেছে। মরতে তো হবেই। একটা বিরাট শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিল। একটা বাড়ি ছিল যেখানে সব চার্চে যাওয়া নারীরা থাকতো। সারাহ নামের একজন ছিল। সে চার্চে যেতো, পার্টি করতো এমনকি বাসে চড়তো। আরেকজন মন্দ নারী ছিল যে মনে করতো কেউ তাকে তার চেয়ার থেকে সরাতে পারবে না। সে সবাই কে তার চেয়ারের চারপাশে ঘোরাতো। সে চরম খারাপ একজন মানুষ ছিল। খুবই বদমাশ বৃদ্ধা মহিলা। আরেকটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। একটা অভিযোগ ছিল যে বৃদ্ধ লোকগুলো তৈলাক্ত ত্যানা কাপড়ের দুর্গন্ধের মধ্যে থাকে। কতোটা জঘন্য। তাদের প্রচুর অর্থ থাকার পরও তারা সেটা খরচ করতে পারতো না। কিন্তু তাদের ভাড়া মেটানো হতো তাদের খাবারের বিল পরিশোধ করা হতো। সবকিছু ঠিকঠাক সময় মতো করা হতো।

আসলে ঘটনা হলো। সবজায়গায় সাপ্তাহিক খরচের প্যাকেট ড্রয়ারে জমা করে রাখা হতো। সমাজকর্মীরা আসতো আর তুলে নিয়ে যেতো। তাদের সন্তানদের টাকার দরকার ছিল তাই। এমন ঘটনাই ঘটেছে। সবাই যেভাবে বলে সেভাবে ঘটনা ঘটে না। বড় বড় জায়গায় সমাজকর্মীরা আসতো, আপনি দেখবেন তাদের চেহেরায় কেমন চিন্তার রেখা ভেসে উঠতো। আসবে, দুটি বিশ টাকার নোট টুকে নিয়ে ব্যাগে ঢোকাবো, তারপর চলে যাবো।

আমি বুঝতে পারিনি এই উপন্যাসটি আপনার জীবন থেকে নেয়া।

ডরিস ল্যাসিং: হুম। আমার অভিজ্ঞতার ফসল। অনেক ঘটনা আমার জীবনের।

তারপর কি হলো। ১৯৮৫ সালে আপনি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। উপন্যাসটি আমার অসম্ভব প্রিয়। দ্য গুড টেরোরিস্ট উপন্যাসটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে ফেলেছিলাম। যদিও ওই সময় কেন্দ্রিক তবুও মনে হয়েছে আপনি কিছুটা পিছনে ফিরে গিয়েছেন। একটা স্বঘোষিত শুদ্ধতাবাদী দল যারা নিজেদের আদর্শবাদী মানে রাজনৈতিক ভাববাদী বলে প্রচার করতো।

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ, এটাও বাস্তবতা ঘেঁষা উপন্যাস। ইউরোপ, আমেরিকা এবং পৃথিবীর সবাই ভুলে গেছে। বিপ্লবী নামে এই একটা দল ছিল। তারা বলতো আমরা বিপ্লবী। তারা কোথাও কোন একটা বাড়িতে থাকতো। একবার এই বিষয়ে আমি একটা চমৎকার চিঠি পেলাম। সবচেয়ে চমৎকার চিঠিটা পেয়েছি আয়ারল্যান্ড থেকে। লেখক বললো: এই তরুণদের জন্য ঠিক ইউনিফর্ম পড়া, ঠিক বুলি আওড়ানো, বছরের পর বছর নিভৃত সুখী জীবনযাপন করা এবং রাজনৈতিক কোন সভাতে না যাওয়া তাদের বিপ্লবী জীবনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তারা ছিল বিপ্লবী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই বিপ্লবী যুগ অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু তারা এখনও নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে যে কেউ বিপ্লবের কথা মনে করতে পারে। এখন ভাবলে আমার খুব হাসি পায় আর হাস্যকর মনে হয়। আমার বাড়ির কাছে রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা বাড়িতে বিপ্লবীদের জিনিসপত্রের আস্তানা ছিল। আমি অনেকবার তাদের দেখেছি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো তারা কখনো অর্থকড়ির আলাপ বন্ধ করতো না। তারা হয়তো বিপ্লবী ছিল কিন্তু সারাক্ষণ টাকার আলোচনা করতো। পরের পেমেন্টটা কোথা থেকে পাবে তাই নিয়ে অনবরত কথা বলতো। এটা আমার কাছে আজব লাগতো।

এই উপন্যাসের সবচেয়ে চমৎকার দিক হলো এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। অ্যালিসের চরিত্র ছিল অসাধারণ। ঘরের মেয়ে বলে মনে হতো। সে স্যুপ রান্না করতো আর সবার দেখাশোনা করতো। সে পরিত্যক্ত জায়গায় যেতো আর ভাবতো কি করে এখানে সুন্দর থাকার জায়গা বানানো যায়। তারপরও তার মধ্যে এই পৃথিবীর জন্য একটা ক্রোধ বা বিষাদের মিশ্র অনুভূতি কাজ করতো। আমার মনে হয় তার চরিত্রের এই দিকটা উপন্যাসটাকে স্মরণীয় করেছে।

ডরিস ল্যাসিং: আচ্ছা। আপনার এমন অনুভূতি কি কখনো হয়েছে। সব সমাজতান্ত্রিক দলের হৃদয়ে এই বিরোধটা কাজ করে অবশ্য। আমি জানি না এখনো তারা বলে কি না, এসো বিপ্লবী হই যেটা একটা সময় বলতো। তুমি এখানে ফ্যাসিবাদী, তুমি ওইখানে ফ্যাসিবাদী। এই চল চিরতরে চলে গেছে। তারা যখন এগুলো বলে বেড়াতো তারা তিমি মাছের জীবন বাঁচাতো। বিড়ালের যত্ন নিতো। গরীবদের খেতে দিতো। আর অন্য অনেককিছু করতো। এই অনুভূতি সমাজতান্ত্রিক দলের হৃদয়ের গহীনে কাজ করতো। আর এটা খুবই আত্মবিরোধী চেতনা ছিল। তাই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। এগুলো এমনই... অ্যালিসের মতোই... এটা এই মানুষগুলোকে বরবাদ করে দিয়েছে। নিজেদের ক্ষতি ডেকে এনেছে, তাই না?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ। এটা হ্যারোডস বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে এসেছে।

হ্যাঁ।

ডরিস ল্যাসিং: আমি জানি না আপনার মনে আছে কি না।

আমার ভালো করেই মনে আছে।

ডরিস ল্যাসিং: আইআরএ বলেছে এটা তারা করেনি। হ্যারোডস বোমা বিস্ফোরণের মতো এমন নাদান কাজ তারা করছে এটা আমরা চিন্তা করেছি বলে তারা যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে আমি বলেছিলাম: আচ্ছা, ধরে নাও অ্যালিসই এটা করছে। জেনেছো তো আসল নাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ভাবলাম, আরে কি সুন্দর উপন্যাসের শিরোনাম হতে পারে এটা। এই যে অপূর্ব সুন্দর একটা ভাববাদী ও জঞ্জাল আকীর্ণ স্বপ্নে তারা বাস করে। আমি অ্যালিসকে চিনতাম। বছরের পর বছর তাকে আমার চোখের সামনে দেখেছি। একটা সময় তার মা অ্যালিস আর তার প্রেমিককে কিছু টাকা দিলো। তারা বললো, এই টাকা দিয়ে আমরা একটা ইয়ট কিনবো আর তাতে করে আয়ারল্যান্ডে বন্দুক পাঠাবো।

তারা ঠিকই একটা ইয়ট কিনেছিল কিন্তু কোন কাজে ব্যবহার করেনি। তার অন্য কোথাও আনন্দ করে কাটিয়েছে।

১৯৯০ দশকে আপনি এই উপন্যাসগুলো লিখে যাচ্ছেন। আমরা এর বেশি কথা বলিনি। ১৯৯০ দশকে আপনি আপনার আত্মজীবনীর কয়েক খন্ড লিখেছেন যেগুলো আপনার উপন্যাসের মতোই খ্যাতি লাভ করেছে। কিন্তু ১৯৬২ সালের পর আপনার আত্মজীবনী আর আগায়নি। এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?

ডরিস ল্যাসিং: হুম। এটা খুব সহজ সরল বিষয়। ১৯৬০ সালে আমি জগতের সবার মা হয়ে উঠলাম। বাড়িতে বাচ্চা-কাচ্চায় পূর্ণ। সমস্যার অন্ত নেই। আমি জানি না আপনি খেয়াল করেছেন কি না। এই সময়ে আমার বাড়িতে ওই নারীসকল ও বাচ্চাদের নিয়ে নিদারুণ অবস্থায় ছিলাম। এমনটা কেন হলো। আমি জানি না। ওই বাচ্চারা এখন সব বড় হয়েছে। সবাই আমার খুব কাছের মানুষ। তাদের সম্পর্কে যেভাবে লেখা উচিত সেভাব লিখতে পারবো না। আমি দ্য সুইটেস্ট ড্রিম নামে যে উপন্যাস লিখেছি তাতেও তাদের কথা লিখতে পারিনি। তবে ৬০ দশকের পরিবেশটা বর্ণনা করেছি। জার্মানিতে একবার সাক্ষাৎকার দিচ্ছি। ওই তরুন প্রশ্নকারী ৬০ দশক সম্পর্কে জানতে চাইলো। সে এতোটা বিতৃষ্ণা নিয়ে প্রশ্ন করছিল যে আমি বললাম, যেমন থাকুক না কেন ওই সময়টা আমার কাছে ছিল মহিমান্বিত। আরো বললাম: ভাবুন। একজন যুবক কোথাও থেকে এসে বলবে আমার নাম বার্ট। আমি ফেডির বন্ধু। আমি কি ভেতরে আসবো? আমি বলতাম: হ্যাঁ, আসুন। তারপর সে প্রায় এক মাসের মতো আমার বাড়িতে থেকে যাবে। সাক্ষাৎকারকারী আমাকে বললো: আপনি এমন অচেনা কাউকে এতো সহজে বাড়িতে জায়গা দিতে পারেন না। সে তো চোর হতে পারতো। আমি উত্তর দিলাম: হতে পারে সে একজন চোর। কিন্তু আমরা এমনটাই করতাম। এখন আমি ভাবি। হে খোদা, সবাই কেমন ভুলে গেছে।

সোনালি দিন ছিল সেগুলো। সব জায়গায় এমন উদারতার চর্চা ছিল। আমি অন্য অনেক জগত মাতাদের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলাম। মিসিসিপির একজন জগৎ মাতা একটা চিঠিতে লিখেছেন: আমি জানি টম আপনার কাছে আছে। ওর দাঁত নিয়ে কি আমাদের আরো যত্নবান হওয়া উচিৎ না? পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। যাই হোক, আমার তার দাঁতের কথা তেমন মনে নেই। হয়তো টমের দাঁতের কিছু একটা করেছিলাম।

তার মানে পুরোনো সেই দিনের কথা মনে হলে আপনার মধ্যে মমতা ও উপহাস অনুভূত হয়

ডরিস ল্যাসিং: আমি উপহাস করি না। সময়টা চমৎকার... আধা বাক্যে কেউ কোনদিন পুরো দুনিয়াকে বোঝাতে পারে না। তুমি জানো ছেলেটার নাম ফেডি। আর আমি ফেডিকে চিনি। এই চেনাজানার ব্যাপারটা এক কথায় অনবদ্য। তাই না?

আচ্ছা। আপনার মতো করে বলতে পারবো না। কারণ আমি তো আসলে এই জীবনের ভেতর দিয়ে যাইনি।

ডরিস ল্যাসিং: না। আমার কাছে এটা অসাধারণ ছিল। এমনটা আজকের দিনে কেউ করবে না। কারণ আপনারা খুব সন্দেহবাতিক।

হ্যাঁ। আপনি আরো কিছু লিখছিলেন। ১৯৮০ ও ৯০ দশকগুলোতে আপনার কিছু লেখা শেক্সপিয়রের দ্বন্দ্বমুখর নাটকের মতো মনে হয়। এমন তুলনা অতিরঞ্জিত হবে না মনে করি। আমার মনে হয় আপনিও কিছু দ্বান্দ্বিক উপন্যাস লিখেছেন। দ্য ফিফথ চাইল্ড উপন্যাসের কথা বলা যায়। এক দম্পতি আশা করেছিল তারা একটা সুখী সুন্দর পরিবার তৈরি করবে। কিন্তু এর মধ্যে একটা হিংসুক সন্তানের জন্ম হয়। ৯০ সালে লেখা লাভ এগেইন উপন্যাসটাও তেমন। যেখানে একজন নারী যার উথালপাথাল প্রেমানুভূতিতে ডুবে ডুবে নিঃশেষ হয়ে যায় তারপর আবার সে প্রেমে পড়ে। আমার জানতে ইচ্ছে করে এইখানে এমন দ্বন্দ্ব...

ডরিস ল্যাসিং: আমি এগুলোকে দ্বান্দ্বিক উপন্যাস হিসাবে লিখিনি। দ্য ফিফথ চাইল্ড লিখেছি কারণ আমি চেয়েছিলাম একজন পরী তার বাচ্চাকে মানুষের দোলনায় রেখে যাচ্ছে তার একটা পার্থিব সংস্করণ লিখতে। আপনি জানেন পৃথিবীর প্রত্যেকটা সংস্কৃতিতে এমন প্রাচীন রূপকথা আছে। কিন্তু আমরা এই ইতিহাস ভুলে গিয়েছি। আমি দেখলাম পৃথিবীতে সত্যি বামন জাতি আছে। এদের বাস সুমাত্রার ফ্লোরেসে। আপনি কি তাদের সম্পর্কে পড়েছেন।

না। আমি পড়িনি।

ডরিস ল্যাসিং: তারা এমন এক জাতির খোঁজ পেয়েছে যারা মানুষের থেকে ক্ষুদ্রাকার। বিজ্ঞানীরা বলছে, না, এমন হতে পারে না। হয়তো তারা মানুষের বিকৃত রূপ। অন্য একদল বিজ্ঞানী বলছেন, তারা মানব জাতি কিন্তু মানুষ থেকে আকৃতিতে ছোট। আমি সব সময় ভেবে এসেছি আমাদের রূপকথার এই বামুন জাতির ধারণা এলো কোথা থেকে। কোথায় এর ভিত্তি। আমি ভাবতাম কোথাও না কোথাও এমন মানুষ আছে। আমরা রূপকথায় তাদের নানা নাম দিতে লাগলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম তারা এখানে এই পৃথিবীর মানুষ। কেন প্রতিটা দ্বিতীয় বাগানের নিচে বামন বাস করে। আমরা কি স্মরণ করছি? আমরা তো কিছু মনে করতে পারছি। আমাদের আধা অস্পষ্ট স্মৃতি থেকে কিছু তো উঠে আসছে।

আপনি ফ্যান্টাসি লিখেছেন। যদিও আমি জানি না বর্তমান সংজ্ঞায় ফ্যান্টাসি বলা যাবে কি না। এক বছর আগে আপনি দ্য ক্ল্যাফট লিখেছেন। এটাকে ফ্যান্টাসি বলা কি ঠিক হবে। এটা প্রাচীন উপকথার একটা অসাধারণ কাল্পনিক উপস্থাপনা আপনার। যেখানে স্ত্রী-লিঙ্গ পুং-লিঙ্গের পূর্ববর্তিনী এবং তারপর...

ডরিস ল্যাসিং: এরকম কিছু কথা আমি তখন পত্রিকায় পড়েছিলাম। আপনি জানেন কেমন করে একটা আইডিয়ার উদয় হয়, কিছুদিন ঘুরে ফিরে, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। ধারণাটা ছিল সবকিছু প্রথমে নারীর আকারে থাকে এবং পুরুষের আকার পরে আসে। যত এটা নিয়ে ভাববেন তত ব্যাখ্যা করার সুযোগ হবে। যেমনটা নারীরা পরিহাস করে বলে পুরুষরা বাচ্চা ছাড়া আর কিছুই না।

হ্যাঁ।

ডরিস ল্যাসিং: আমি প্রায় এমনি অর্থ করেছি। এটা আমার কাছে অনেক অর্থবহ মনে হয়। যদি সাগরকূলে সবসময় নারীদের দেখি, আবহাওয়া অনুকূল থাকে তাহলে দেখবেন তারা মাছ খাচ্ছে। তাদের পানসে জীবনে এর থেকে চমক আর কিছু হতে পারে না। তারপর হঠাৎ করে পুরুষের আগমন ঘটে। পুরুষগুলো সবসময় তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকে। ছোট নৌকা করে বিশ্ব ঘুরে বেড়ায়। টপ গিয়ার-এর মতো কোনকিছু অতর্কিত এসে হাজির হয়।

হ্যাঁ।

ডরিস ল্যাসিং: ওই অসহায় মেয়েদের জন্য বিষয়টা একটু আতঙ্কজনক।

আমি জানি না আমাদের আন্তর্জাতিক দর্শকরা টপ গিয়ার কি জানে কি না।

ডরিস ল্যাসিং: আমি জানি। আচ্ছা, এটা একটা জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান।

অনভিপ্রেত ছিল, তাই না?

ডরিস ল্যাসিং: আমি জানি এটা চমৎকার অনুষ্ঠান। মোটরবাইক চালানো নিয়ে একটা অনুষ্ঠান।

পুরুষের বাইক চালানো নিয়ে। ঠিক তাই।

ডরিস ল্যাসিং: আমি চাই সকল নারীরা এই অনুষ্ঠানটা দেখুক। খুবই মনোমুগ্ধকর। সেখানে দেখবেন পুরুষরা এই গাড়িকে কি গতিতে যেন শুষে নিচ্ছে। অনুষ্ঠানটা দেখে আমি অনেক হেসেছি। যাই হোক। এমন নারীদের নিয়ে কল্পনা করুন যারা জীবনে কখনো বিপর্যস্ত হয়নি। তাদের ছেলে বাচ্চাই থাকে না। আমি আমার প্রথম সন্তান হওয়ার সময়ে ফিরে দেখতে চাই যখন একই রুমে আরেকটা নারী ছিল যার আগে দুইটা মেয়ে হয়েছে। এইবার ছেলে হলো। আর আমার প্রথমবারেই ছেলে হলো। তার চেহেরায় দ্যুতি খেলা করছিল। ছেলেটার শরীরের ওই অংশটা দেখিয়ে সে নার্সকে বললো: এটা কি? নার্স বললো: ও মিসেস জনসন, আপনি কতো ভাগ্যবতী, আপনার একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। নারীটি বললো, একে সরিয়ে নাও। আমি ওকে বাড়িতে নেবো না। আমি তাকে বললাম, কি ব্যাপার আপা, আপনি জানেন এখানে আমারও ছেলে আছে। সে বললো, আমি ওকে বাড়িতে নেবো না। মানে এটা দেখেন। কেমন বীভৎস না? আপনি হয়তো জানেন। আপনার সন্তান আছে। ওই ছোট বাচ্চাটার এমন একটা শারীরিক অংশ আছে। তারপর এমন কথা চলতে থাকলো... এক বা দুসপ্তাহ লাগলো তার বিষয়টাকে সঠিক বলে মনে করতে। কিন্তু নবজাতককে দেখা একটা আশ্চর্যের বিষয় ছিল। সবাই নবজাতকের লিঙ্গকে প্রথমে দেখতে চায়। ভেবে দেখেন ওই মেয়েটি যখন প্রথম তার সদ্য ভূমিষ্ঠ ছেলে দেখলো। সে একটা ধাক্কা খেয়েছিল। ভেবেছিল বাচ্চাটা বোধহয় বিকৃত হয়ে জন্মেছে। কেমন হাস্যকর ব্যাপার।

তারপর আপনি আলফ্রেড এন্ড এমিলি নামে আরেকটা উপন্যাস লিখলেন। আপনি এখনো লিখছেন। ওই বইতে আপনি সম্ভবত আপনার বাবা মায়ের জীবনকে একভাবে অঙ্কিত করেছেন। এটা কি সত্য? এই ব্যাপারে যদি কিছু বলেন।

ডরিস ল্যাসিং: আচ্ছা। এটা লেখার কারণ হলো, কেন জানি না যুদ্ধকে আমার জীবনে চেপে বসা একটা বিভীষিকা মনে হয়। আমার বিশ্বাস করতে মন চায় না মানুষ যুদ্ধ করার মতো নির্বোধ। যুদ্ধ যাওয়ার একেবারেই কোন ভালো কথা না। হয় আপনি এমন করে ভাবেন অথবা ভাবেন না। আমি এই যুদ্ধ নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথাই বলবো বেশি। ইউরোপ এটা ঘটিয়েছে। এখনো তার দুর্ভোগ পোহাচ্ছি।

এই বইটা কি যুদ্ধের ফল নিয়ে?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ। আমি আমার বাবা-মায়ের জীবন থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিলুপ্ত করে দেখতে চেয়েছিলাম। আমি আবার বলতে যাই মানুষের বিপর্যস্ততার উৎসমূল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ না হতো তাহলে রাশিয়ান বিপ্লব হতো না, সোভিয়েত ইউনিয়ন হতো না, সোভিয়েত সাম্রাজ্য হতো না, হিটলার হতো না, হলোকাস্ট হতো না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতো না। গল্পে আমি তাদের এক অতি সাধারন জীবন দিয়েছি। মার্জিত ও প্রশান্তির জীবন, বিশেষ করে মাকে। তার কিছু টাকা আছে। যেখানে খুশি খরচ করতে পারে। যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। আর আমার বাবাকে একজন মেঠো কৃষক বানিয়ে দিলাম। কারণ সে সাসেক্স বা সাফকের কৃষক হতে চেয়েছিল। যেখানে তার পূর্ব পুরুষেরা এসেছে। আমি তাকে একটা মিষ্টি বউ দিলাম। তারপর উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশের শুরু যেখানে এমন কিছু ঘটে যা হৃদয়বিদারক। এই অংশে আমার বাবার জীবনের প্রকৃত ঘটনার অবতরণ করলম। তার ডায়াবেটিস হলো। তার সবই হলো যা ডায়াবেটিস রোগীর হয়।

তার মানে উপন্যাসে কল্পিত জীবন ও বাস্তব জীবনের আন্তঃমিশ্রন রয়েছে।

ডরিস ল্যাসিং: আমি এটিকে যুদ্ধ বিরোধী উপন্যাস বলবো। এটা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভয়ানক এক যুদ্ধের বই। আমি সারাজীবন এটা নিয়ে ভেবেছি। আমার অনুভবে এটা বেশি বেশি জড়িয়ে ছিল। আমি ইরাকের না গিয়েও ইরাক যুদ্ধকে অনুভব করতে পারি। এই যুদ্ধ নিয়ে অগণিত মানুষ আমার মতো হতভম্ব।

আপনি তাহলে এখনো লেখার তাড়না বোধ করেন?

ডরিস ল্যাসিং: হ্যাঁ। আমি এটা নিয়ে আর তেমন একটা ভাবি না। আমি যথেষ্ট লিখেছি। আর শক্তি পাই না।

আচ্ছা। আমিও লিখি না। আমি ততটা নিশ্চিত না।

ডরিস ল্যাসিং: উদ্দাম কোথায় চলে গেল।

আমি নিশ্চিত না।

ডরিস ল্যাসিং: আচ্ছা। ঠিক আছে। আমিও আর আগের উদ্দাম খুঁজে পাই না।

আচ্ছা। কথায় কথায় সেই সোনালি দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। আমাদের জন্য আপনার এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

ডরিস ল্যাসিং: ধন্যবাদ। আমারও খুব ভালো লাগলো। আবারও ধন্যবাদ।

উৎস লিংক: Doris Lessing–Interview-NobelPrize.org
বাংলা কপিরাইট © pratidhwanibd.com