তোত্তোচানের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য
তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি
তেৎসুকো কুরোয়ানাগি
অনুবাদক: চৈতী রহমান
মূল্য: ২০০ টাকা
প্রকাশক: দ্যু
আমির খান অভিনীত বলিউডের ‘তারে জামিন পার’ দেখেনি এমন চলচ্চিত্রপ্রেমী খুব কম পাওয়া যাবে। ঈশান নামের ছোট্ট ছেলেটি, যে কিনা বর্ণ লিখতো উল্টো করে, কিন্তু তার ছবি আঁকার হাত ছিল অসাধারণ। একাডেমিক খারাপ রেজাল্টের জন্য ঈশানকে নিয়ে তার বাবা-মার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাকে পাঠানো হলো দূরের বোর্ডিং স্কুলে। যেখানে চেনা পরিবেশ ঈশানের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা সেখানে বোর্ডিং স্কুল! তার ভাগ্য ভালো যে, রাম (আমির খান) নামের এক শিক্ষককে পেয়েছিল। যে তার অসুখ ও সীমাবদ্ধতাকে বুঝতো। কেননা ছোটবেলোয় রাম নিজেও ছিল ঈশানের মতো। পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু বুঝতে পারতো না। সিনেমার শেষদিকে দেখা যায়, ঈশান ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। যা ছিল রাম ও ঈশানের বিশাল এক বাধা জয়ের গল্প।
জাপানি শিশু তোত্তোচান-এর জীবনের গল্পটাও এমন। মায়ের সঙ্গে রেলগাড়ি ভ্রমণের সময় যে জীবনের শুরুতে ট্রেনের টিকিট চেকার হতে চেয়েছিল। সে ছিল ছোটবেলা থেকে দুষ্টু। অন্য শিশুদের মতো নিয়মের ঘেরাটোপে আবদ্ধ হতে চাইতো না। এই কারণে একদম অল্প বয়সেই অর্থাৎ প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় তোত্তোচান স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়। তা-ও জাপানের মতো একটা দেশে! যেখানে শিশুদের অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু তোত্তোচানের মা তাকে বহিস্কৃত হওয়ার ঘটনাটি বুঝতে দেননি। শিশুমনে যাতে দুঃখ না লাগে তার দিকে সচেতন ছিল তার মা। এরপর মা তাকে নিয়ে যান এক নতুন স্কুলে। ঈশান যেমন রামের হাত ধরে পাল্টে গিয়েছিল তেমনি তোত্তোচানও পেয়েছিল তোমোয়ে গাকুয়েন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোশাকু কোবাইয়াশি মশাইকে। যিনি শিশুদের কেবল খেয়ালই রাখতেন না, ছিলেন তাদের বন্ধুও। প্রধান শিক্ষক ধরনের গুরু-গম্ভীর ছিলেন না তিনি। তোত্তেোচানের নতুন স্কুলে খুব বেশি শিক্ষার্থী ছিল না। তবে তাদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না যে কোবাইয়াশি মশাইকে ভালোবাসতো না। ভালোবাসতো তোমোয়ে স্কুলকেও।
প্রথাগত স্কুল বলতে যা বুঝায়, তোমোয়ে স্কুল ছিল তার একেবারে বাইরে। পাঠদান হতো থরেথরে সাজিয়ে রাখা রেল কামরায়। তোত্তোচানদের সঙ্গে ছিল অনেকে দুষ্টু, মিষ্টি ও ব্যতিক্রমী শিশু। শিশুরা এই স্কুলে খেলতে খেলতে শিখতো। কোবাইয়াশি মশাই খেয়াল রাখতেন শিশুরা যেন টিফিনে সম্পূর্ণ পুষ্টিগুণ পায়। আর এই টিফিনকে তিনি নাম দিয়েছিলেন, ‘সমুদ্রের কিছু আর পাহাড়ের কিছু’। শিশুরা যাতে খাদ্য চিবিয়ে খায় তার জন্য ছড়া গানও বাধেন তিনি। তোমোয়ে স্কুলে পড়ালেখার চাইতে বেশি হতো খেলাধুলা ও প্রকৃতি চেনার পাঠ। যেন এটা কেবল স্কুলই ছিল না, ছিল এক পরিবার। ছিল সঙ্গীত ও কবিতা লেখার চর্চাও। কোবাইয়াশি মশাইয়ের তত্ত্বতালাশ করে বের করা পিয়ানোতে তোলা ইউরিদমিক্সের তালে তালে চলার ক্লাস হতো শিশুদের। তিনি জানতেন, সঙ্গীত শিশুমন বিকাশে কেমন প্রভাব রাখে। পাঠদানের পাশাপাশি শিশুরা যাতে বাইরের জগত চিনতে পারে তার জন্য তোমোয়ে স্কুলে ছিল পাঠাগার কামরাও। শিশুরা বাথরুম চেপে রেখে হলেও লাইব্রেরিতে মজার মজার বই পড়ার দিকে বুঁদ হয়ে থাকতো। টিফিনের সময় সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একজন কথা বলতো আর অন্যরা হাসতে হাসতে খাবার খেতো। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো, যেখানে জিতত কোনো ব্যতিক্রমী শিশু। ব্যতিক্রমী বলেই কোনো শিশু যাতে হীনমন্যতায় না ভুগে তার জন্য এই আয়োজন ছিল কোবাইয়াশি মশাইয়ের।
তোমোয়ো স্কুল ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীনভাবে চিন্তার বীজ বপন করে দিয়েছিল। বড় হয়ে তারা মন দিয়েছিল সফলতার চেয়ে সুখি হওয়ার দিকে। তোত্তোচানও বড় হয়ে স্বাধীন পেশা বেছে নেয়। ছোটবেলাকার সেই দুষ্টু মিষ্টি মেয়েটি পরে অনেকের অনুরোধে আশির দশকের দিকে লিখেছিল ‘তোত্তোচান’ নামে নিজের জীবনের গল্প। তোমোয়ো স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে তার এখনো যোগাযোগ আছে। তাদের কেউ বড় বিজ্ঞানী, কেউ সংসারী, কেউ ব্যবসায়ী। তারা সুখি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তোমোয়ো স্কুল ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর তাদের আর একসঙ্গে ক্লাস করা হয়নি।
তোমোয়ো স্কুলের শিক্ষকেরা শিশুদের আউটিংয়ে নিয়ে যেতো। রাতের বেলা ভূতের গল্প শুনে ভয় পেতো তারা। কোনো শিক্ষক যদি শিশুদের সঙ্গে উচ্চগলায় বা অশিশুসুলভ কথা বলতো তবে প্রধানশিক্ষক তাদের আচ্ছা করে বকে দিতেন। এমনকি দোষটা তুলে নিতেন নিজের ঘাড়ে।
এই হলো তোত্তোচানের জীবনের শুরুর দিকের স্কুল জীবনের গল্প। যে পথ প্রদর্শক হিসেবে পেয়েছিল কোবাইয়াশি মশাইয়ের মতো একজন শিক্ষককে। যিনি ছোটোছোটো শিক্ষার্থীদের কথা খুব মনেোযোগ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতেন হাসিমুখে। বড় মানুষেরা সচরাচর যা করেন না। একবার ভাবুন তো, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জাপানের এই তোমোয়ো স্কুলের পার্থক্য! অবাক না হয়ে না পারবেন না। আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়ার পর থেকে স্যারের বেতের ভয়ে থাকে সারাক্ষণ। আর তোমোয়োর শিশুরা শিক্ষকের কাঁধে চড়ে, কোলে বসে গল্প করত।
উপরোক্ত কথাবার্তা হলো জাপানের লেখক তেৎসুকো কুরোয়ানাগির লেখা ‘তোত্তোচান, জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি’ নামের বেস্টসেলার বইটির হালকা রেখাপাত। বইটির বাংলা তর্জমা করেছেন চৈতী রহমান। জাপানের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যটা কোথায় তা বোঝার জন্য তাঁর লেখা বইটির চমৎকার ভূমিকা থেকে কিয়দংশ উপস্থাপন করছি, ‘তোত্তোচানের গল্পে আমরা দেখতে পাই মানবশিশুকে রীতিমত স্বাধীন ‘মানুষ’ হিসেবে বড় করার জন্য একজন প্রধান শিক্ষক ইশকুল নিয়ে কী দারুণ স্বপ্ন দেখছেন। তাঁর স্বপ্ন দেখার মূলে রয়েছে মানবসমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা। আমাদের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং তাতে চলমান ইশকুলগুলো শিশুদের কেবল শিক্ষিত করে, পরীক্ষা নেয়, ধরাবাঁধা বহু নিয়মকানুন শেখায়। কিন্তু ইশকুলগুলো শিশুদের স্বাধীন মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করতে দিয়ে, তাদের মস্তিষ্ক থেকে সত্যিকার প্রতিভা বের করে আনতে প্রায়শই ব্যর্থ হয়। আর ব্যর্থ হয় শিশুকে সুখি মানুষ হিসেবে জীবনযাপনের পথ দেখাতে।’
তোমোয়ো স্কুল ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীনভাবে চিন্তার বীজ বপন করে দিয়েছিল। বড় হয়ে তারা মন দিয়েছিল সফলতার চেয়ে সুখি হওয়ার দিকে। তোত্তোচানও বড় হয়ে স্বাধীন পেশা বেছে নেয়। ছোটবেলাকার সেই দুষ্টু মিষ্টি মেয়েটি পরে অনেকের অনুরোধে আশির দশকের দিকে লিখেছিল ‘তোত্তোচান’ নামে নিজের জীবনের গল্প। তোমোয়ো স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে তার এখনো যোগাযোগ আছে। তাদের কেউ বড় বিজ্ঞানী, কেউ সংসারী, কেউ ব্যবসায়ী। তারা সুখি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তোমোয়ো স্কুল ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর তাদের আর একসঙ্গে ক্লাস করা হয়নি।
আমাদের এখানকার শিশুদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। শিশুরা ব্যাগ বোঝাই বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, বড় হচ্ছে। কিন্তু তাদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। সেসবের দিকে খেয়াল নেই বড়দেরও। কেননা বড়দের ছোটবেলাও কেটেছে একই বৃত্তের মধ্যে। পেশাগত জায়গায় আমাদের দেশের শিক্ষকেরাও জ্ঞানপিপাসু নন। শিশুদের মন তারা বোঝে না। ভালো শিক্ষকের দায়িত্ব কেবল ‘অ, আ’ পড়ানো নয়। শিশুর প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। যেমনটা পেরেছিলেন কোবাইয়াশি মশাই।
যুদ্ধে বিশাল ক্ষতি হয়েছিল জাপানের। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমার আঘাতের চিহ্ন এখনো অনেক শিশু বয়ে বেড়াচ্ছে। তারপরও জাপান ঘুরে দাঁড়িয়ে এশিয়ার তো বটে, অর্থনীতি ও শিল্পে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রের একটি। জাপানিজদের লড়াকু, বিনয়ী ও পরিচ্ছন্নতা প্রিয় হিসেবে খ্যাতি আছে। চরিত্রে এসব পরিবর্তন একদিনে হয়নি। দেশটিতেও একসময় বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠীর ক্ষমতার লড়াই ছিল নিয়মিত ঘটনা। সেই জাপান এখন অন্যের জন্য বড় উদাহরণ। কেননা তারা শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। কথায় আছে, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। সেই শিশুদের তারা যথার্থ মর্যাদা দিয়ে বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের দেশে যা হয়, কয়েক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা তো আছেই, তার সঙ্গে ধর্ম শিক্ষার নামে ছোটবেলা থেকে সম্প্রীতিতে বিভেদের বীজ বপন চলতে থাকে। কে কোন বিষয়ে পড়বে, কেমন চিন্তা করবে তা চাপিয়ে দেয় বড়রা। শিশুরা শিখে বড়দের দেখে। সেই শিশুরাও একসময় বড় হয়ে বড়দের অনুকরণ করে। কোনটা ভুল বা শুদ্ধ সে জ্ঞান হারায়। কিন্তু তোমোয়ো স্কুলের শিক্ষার্থীরা যার যে বিষয়ে আগ্রহ সে বিষয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে পড়তো। গবেষণা করতো। তোত্তোচনের তেমন এক বন্ধু ছিল, নাম তাইচান। যে ছোটবেলা থেকে ছিল পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী। স্কুলে যার যেমন পড়ার থাকতো তখন সে পদার্থবিজ্ঞান খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবতো, নাড়াচাড়া করতো। আর এখন সে বিশ্বের সেরা পদার্থবিদদের একজন।
আমাদের এখানকার শিশুদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। শিশুরা ব্যাগ বোঝাই বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, বড় হচ্ছে। কিন্তু তাদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। সেসবের দিকে খেয়াল নেই বড়দেরও। কেননা বড়দের ছোটবেলাও কেটেছে একই বৃত্তের মধ্যে। পেশাগত জায়গায় আমাদের দেশের শিক্ষকেরাও জ্ঞানপিপাসু নন। শিশুদের মন তারা বোঝে না। ভালো শিক্ষকের দায়িত্ব কেবল ‘অ, আ’ পড়ানো নয়। শিশুর প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। যেমনটা পেরেছিলেন কোবাইয়াশি মশাই। আকিরা তাকাহাশি নামের যে ছেলেটি শারীরিকভাবে বামন ছিল তাকে মানসিক বিকাশে দারুণ সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। তোত্তোচানের সেই বন্ধু পরে অত্যন্ত ভালো ফল করে মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিগ্রি নেয়। এখন সে অন্যদের মতোই জীবন যাপন করে। বামন হওয়ায় তার মধ্যে হীনমন্যতা নেই। আমাদের শিশুদের দুর্ভাগ্য কোবাইয়াশি মশাইয়ের মতো একজন শিক্ষক নেই। আর তোমোয়েো স্কুলের মতো কোনো শিক্ষাঙ্গন নেই।
নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করে এই চর্চা।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়
মার্চ ২৩, ২০২৩ ১৭:৫৮