শিল্পী মনসুর-উল-করিমের আঁকা শেষ পোর্ট্রেট!

অ+ অ-

 

প্রতিকৃতি হচ্ছে ব্যক্তির মানস জগতের নিসর্গ প্রতিরূপ। এটা নিছক রক্ত-মাংসের অবয়ব নয়। হুবহু প্রতিকৃতি আঁকতে আপাতত মুন্সিয়ানা যথেষ্ট। কিন্তু তা শিল্পোত্তীর্ণ হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। তাহলে তো ফটোগ্রাফিই যথেষ্ট ছিল। পাশ্চাত্য শিল্পকলার ইতিহাসে ভিঞ্চির মোনালিসা থেকে শুরু করে রেমব্রান্ট, ডিউরর, রুবেন্স, হোলবেইন, ভেরমেয়ার, হোগার্থ, রেনোয়ার, দেগা, মানে, ভ্যান গখ, সার্জেন্ট, সেজান, পিকাসো, মাতিস, শিকেল, ফ্রয়েড, হপার, বেকম্যান প্রমুখ প্রত্যেক শিল্পী অসংখ্য আত্মপ্রতিকৃতি এবং পরিচিত মানুষজনের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। কেবলমাত্র ফরমাইশি কারণে নয়, চেহারার মাঝে মানসিক অভিব্যক্তি তথা সেই সময়কে ধারন করা ছিল সেইসব শিল্পীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্যই তাঁদের আঁকা পোর্ট্রেটগুলো টিকে আছে শিল্প-ইতিহাসের অংশ হিসেবে।

আমাদের দেশে শিল্প ঘরানায় ফিগারেটিভ কাজের চল ধর্মীয় ট্যাবু ও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতায় খুবই কম। শিল্পী মুর্তজা বশীর এক্ষেত্রে ছিলেন ব্যতিক্রমী। শিল্পী তাঁর ছাত্রজীবন ও শিল্পী জীবনের অনেকটা সময় পাশ্চাত্য ঘরানা ও আবহাওয়ায় কাটানোর সুবাদে আত্মপ্রতিকৃতি ও প্রতিকৃতি আঁকার সহজাত প্রবৃত্তি আয়ত্ত্ব করেছিলেন। সিঙ্গেল হ্যাণ্ড ড্রয়িং-এ সিদ্ধহস্ত ছিলেন শুরু থেকেই। সম্ভবত আমাদের দেশে তিনিই সবচেয়ে বেশি ড্রয়িং মাধ্যমে নিজের ও পরিচিত মহলের প্রতিকৃতি এঁকেছেন।

মুর্তজা বশীর কালি ও কাগজে যে কয়জন পছন্দের মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছেন, আমি নিজেও সেই অল্প কিছু সৌভাগ্যবানদের মধ্যে ছিলাম। তবে ২০১৩ সালে তরুণ শিল্পী রাসেল কান্তি তেলরং মাধ্যমে প্রথম আমার পোর্ট্রেট আঁকে। ওল্ড মাস্টারদের ঘরানায় আঁকা অতিরিক্ত জীবন্ত ছিল। প্রায় এক বছর লেগেছিলো কাজটি শেষ করতে। কিন্তু এরপরও এক অপূর্ণতা কাজ করছিল। চাইছিলাম আমার ভেতরে মনোজগতের টানাপড়েন, ভাব বিলাস, ব্যক্তিগত দুর্বোধ্যতা, কল্পনার ঘাত-প্রতিঘাত সময়ের অনুষঙ্গে আমাদেরই প্রাচ্য ঘরানার কোন শিল্পীর তুলিতে যদি আঁকানো যেত! সেটি তিশিয়ান-ভেলাসকুয়েজ-লরেন্সদের প্রতিকৃতির মতো পেলব-নান্দনিক না হয়ে হবে অনেকটা পল গঁগা, এডওয়ার্ড মুঙ্খ বা লুসিয়ান ফ্রয়েডদের ঘরানায় অভিব্যক্ত-প্রকাশবাদের তুলির ছাপে।

মুঙ্কের সেই নাইন বোহেমিয়ান কম্যাণ্ডমেন্টস-এর দাগে প্রতিকৃতি আঁকতে তাই অনুরোধ করেছিলাম কাছের মানুষ শিল্পী মনসুর-উল-করিমকে। মনসুর ছিলেন মুর্তজা বশীরের সরাসরি ছাত্র। আরেকটি কাকতালীয় বিষয় হলো, আমার প্রথম পোর্ট্রেট করা রাসেল কান্তি দাশ আবার মনসুরের সরাসরি ছাত্র। এই শিল্প পরম্পরায় তিন কালের তিন শিল্পীর সাথে কিভাবে যেন জড়িয়ে গিয়েছিলাম।

করোনাকাল চলছিল তখন। ২০২০ সালের ৬ মে ফোন দিয়েছিলাম শিল্পী মনসুর উল করিমকে। কয়েকটি সেল্ফি তুলে তাঁর ইনবক্সে পাঠিয়ে অনুরোধ করলাম আমার শ্মশ্রুমণ্ডিত একটি পোর্ট্রেট এঁকে দিতে। ২০১৫ সালে সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিল্পী মু্র্তজা বশীর পরম যত্নে আমার ক্লিন শেভড পোর্ট্রেট এঁকে দিয়েছিলেন কালি-কলমে। তখন শর্ত দিয়েছিলেন মাথার চুল কিছুটা বড় করতে হবে। তাই করেছিলাম।

মনসুর সেটা জানতেন। সেই প্রসঙ্গ মনে করিয়ে শিল্পী বললেন, আমি তো পোর্ট্রেট ভালো পারি না, আর করিও না। কিন্তু তুমি কিভাবে চাও? হুবহু দরকার নেই। অ্যাক্রিলিকে আপনার নিজস্ব স্টাইলে আঁকলেই আমি খুশি। মনসুর আমার ব্যগ্রতায় সম্মত হলেন। সাধারণত পোর্ট্রেট আঁকেন না। নিসর্গের বিমূর্ততা তাঁকে বেশী টানে। নিজের অল্প কিছু আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন, তাও বেশিরভাগ ড্রয়িংয়ে। ছাত্রজীবনে ২য় বর্ষে একবার অ্যানিমেল স্টাডিতে ছাগল আঁকছিলেন। তখন তাঁর এক শিক্ষক মজা করে বলেছিলেন, ছাগলটা তো দেখতে তোমার মতই লাগছে।

ভেতরে তখন ভীষণ অভিমান হয়েছিল তাঁর। সেই থেকে ক্যানভাসে কখনো কারো প্রতিকৃতি আঁকেননি। নিজেরও না। তবে তাঁর মায়ের প্রতিকৃতি এঁকেছেন বহুবার। খুব ছোটবেলায় মাকে হারানোর কারণে মায়ের স্মৃতি নেই বললেই চলে। তাই কল্পনায় অজস্র মমতাময়ী নারীর ছবি এঁকে তার মাঝেই তিনি নিজের মাকে খুঁজতে চেয়েছিলেন। নিজের প্রয়াত স্ত্রীর প্রতিকৃতিও তিনি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আঁকতে পারেননি। আঁকতে বসলেই বারবার আবেগাক্রান্ত হয়ে উঠতেন মনসুর। সবচেয়ে বড় বিষয়, সচেতনভাবেই এই মাধ্যমে আঁকাআঁকি এড়িয়ে যেতেন তিনি। এসবই তাঁর কাছ থেকে শোনা।

এই সূত্রে ছোট্ট একটা শিল্প ইতিহাস যোগ করি। কিংবদন্তি ডাচ মাস্টার ভিনসেন্ট ভ্যান গখ বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে ঐসব চিকিৎসকদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। যেভাবে চিকিৎসক হিসেবে আমার সাথে ঘনিষ্ঠতা অটুট ছিল মু্র্তজা বশীর, মনসুর উল করিমের সাথে। শম্ভু আচার্য, ম্যালকম আর্নল্ডসহ আরো অনেক পরিচিত গুণী শিল্পীদের সাথে সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল সেই সূত্রে। তবে মু্র্তজা ও মনসুরের প্রতি নানা কারণে আমার আত্মিক টান অন্য রকম।

যাই হোক, ১৮৮৮ সালে ভ্যান গখ যখন প্রেমের পরীক্ষা দিতে নিজের বাম কান কেটে আর্লের হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তখন তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন নবীন ইন্টার্ন ডা. ফেলিক্স রে। টানা দুই সপ্তাহ ডা. ফেলিক্স সেই ক্ষ্যাপাটে শিল্পীর সেবা-যত্ন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে তখন বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁরা নিজেদের জীবন নিয়ে আড্ডা আলাপে সময় কাটান। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ভ্যান গখ তেলরং-এ ডা. ফেলিক্সের পোর্ট্রেট এঁকে উপহার দিয়েছিলেন।

মনসুর-উল-করিমের আঁকা শেষ পোর্ট্রেট

কিন্তু পোর্ট্রেটটা দেখে ডা. ফেলিক্স মোটেও খুশি হননি। নিজের ছবি দেখে নিজেই আঁতকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, আমি মোটেও দেখতে এরকম নই। চুলের রং লাল হবার প্রশ্নই আসে না, তার উপর মাথার পেছনে কড়া সবুজ ও লাল রংয়ের আল্পনার মধ্যে আমার চেহারাটাই যেন হারিয়ে গেছে। ভদ্রতার খাতিরে ডা. ফেলিক্স মুখ ফুটে ভ্যান গখকে আরো বেশি কিছু বলেননি। কারণ ততদিনে ভ্যান গখের মানসিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছিল। তাঁকে ভর্তি হতে হয়েছিলো সেন্ট রেমির সেন্ট পল মানসিক হাসপাতালে। সেই হাসপাতালের ইনচার্জ ছিলেন ডা. পেরন।

ভ্যান গখের মানসিক রোগটির কেতাবী নাম ছিল, একুইট ম্যানিয়া উইথ হ্যালুসিনেশনস অব সাইট এণ্ড হিয়ারিং এণ্ড এপিলেপটিক ফিটস এট ভেরি ইনফ্রিকুয়েন্ট ইনটারভেলস।’ একজন মানসিক রোগীর আঁকা পোর্ট্রেটটি অপছন্দ হবার কারণে স্বাভাবিকভাবে ডা. ফেলিক্স ছবিটির বিশেষ কোন যত্ন নেননি। ফেলে রেখেছিলেন অবহেলায়। ফেলিক্সের মা তখন সেই ক্যানভাসটি ব্যবহার করেছিলেন বাড়ির পেছনে তাদের মুরগির খামারের দরজা হিসেবে। ছবিটা সেভাবেই অনেকদিন অবহেলায় পড়ে ছিল।

১৯০১ সালে শিল্পী হেনরি মাতিসের বন্ধু চার্লস ক্যামোইন আর্ল এলাকার যেখানে যেখানে ভ্যান গখ কাজ করেছেন সেই সব জায়গা দেখতে যান। ততদিনে ইম্প্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের তালিকায় ভ্যান গখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। এই অকালপ্রয়াত প্রতিভাবান শিল্পীর হারানো কাজের সন্ধান করতে গিয়েই ক্যামোইন তখন ডা. ফেলিক্সের মুরগির খামার থেকে ফেলে দেয়া পোর্ট্রেটটি উদ্ধার করেছিলেন। শিল্পের বাজারে সেই সাত রাজার ধনটি এখন সংরক্ষিত আছে মস্কোর স্টেট পুশকিন মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস গ্যালারিতে।

অবশেষে মনসুর উল করিম নিভৃত করোনাকালে রাজবাড়ীতে নিজ স্টুডিওতে দুর্বল শরীর নিয়ে বেশ দ্রুত পোর্ট্রেটটি আঁকা শেষ করলেন।কখনো তাড়া দেইনি। এরপর ২০ মে ফেসবুকের ইনবক্সে ছবি তুলে পাঠলেন তিনি। খুব দ্রুত আঁকছিলেন বোঝা যায়।  মজা করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,

আমাকে কি চেনা যায়?

যারা তোমাকে একবার দেখেছে তারাই ছবিটা দেখে বলেছে এটা তুমি। মনসুর জবাব পাঠালেন।

সেই সাথে আরো জানিয়েছিলেন কিছুটা সিম্বলিজম ঘরানা মেনে কাজটি করেছেন। আমার চেহারায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের দূরাগত আভাস ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। নিজের চেহারা নিয়ে দ্বিমত করিনি।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ডা. ফেলিক্সের মতো ভুল আমি করবো না। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর কোভিড মহামারীতে মনসুর হঠাৎ চলে গেলেন। মৃত্যুর আগে ইউনাইটেড হাসপাতালে রোগশয্যায় অনেক কথা হয়েছিল। তখনো জানতাম না তিনি চলে যাবেন। শিল্পীর মৃত্যুর তিন দিন পর রাজবাড়ীতে বুনন আর্ট স্পেস গ্যালারিতে গিয়ে ছবিটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

ভোজবাজির মতে যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। পুরো বাড়ি-চত্বর খুঁজেও পোর্ট্রেটটি পাচ্ছিলাম না। অথচ হাসপাতালে মৃত্যুর তিন দিন আগে শেষ দেখায় মনসুর আমাকে জানিয়েছিলেন ছবিটা তাঁর শোবার ঘরে রাখা আছে। কিন্তু সেখানেও ছিল না সেটি। অগত্যা শিল্পীর শেষ জীবনে তাঁর সাথে বুননে সময় কাটানো এক ঘনিষ্ঠজনকে ফোন করে জানতে পারলাম গ্যালারির ভিতর কোথাও সেটা থাকতে পারে।

অবশেষে পুনর্বার গ্যালারি খোলা হলো। সেখানে স্টোর রুমে রাখা থরে থরে সাজানো বড় বড় ক্যানভাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা দুই ফুট বাই দেড় ফুটের আমাকে খুঁজে পেলাম। খুঁজতে থাকা সবাই এক সাথে বলে উঠলো, এই তো পাওয়া গেছে!’ চোখের সামনে ক্যানভাসটি স্পর্শ করা মাত্রই দমকা বাতাসের ধাক্কা টের পেলাম। মনসুরের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্কের সুতোয় প্রচণ্ড টান অনুভব করলাম। পোর্ট্রেটটি এক অর্থে শিল্পী তাঁর শিল্প-বিশিষ্টতার সম্ভাব্য সব ধরনের ফর্ম-কম্পোজিশন-টেক্সচারের সারাংশ!

সেই মুহূর্তে মনে হলোছবিটি নয়, আমার দরকার ছবির শিল্পীকে। পেইন্টিংটি নয়, বাস্তবের মনসুরকে আমার বেশি প্রয়োজন। যদি কোন ঐশী শক্তি পেতাম তবে মনসুরের হাজারতম ক্যানভাসের বিনিময়ে রক্ত-মাংসের মানুষটাকে ফেরত চাইতাম। সামনাসামনি গল্প করার মানুষটিকে। এরপর যতবার পোর্ট্রেটটি দেখি, ততবার মনে হয় মনসুর আমাকে ধারন করেছিলেন। প্রচণ্ডভাবে। নিজের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তখন অচেনা বোধ হয়।