সমুদ্র বাথটাব কিংবা রিংমাস্টার বিষয়ক

অ+ অ-


এই যে সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, মূলত যে সময়টায় সবাই ঘরে ফেরে। এই যে নদীর ধারে বসে আধো অন্ধকারে আমি এক দৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জলে নেমে পড়ার তীব্র বাসনাকে কোনভাবেই আটকাতে পারি না, এই যে ব্রিজটার ওয়াকওয়েতে ধীর লয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই পেছন থেকে দ্রুত গতিতে আসা কোন ট্রাকের নিচে দুম করে মাথা পেতে দিতে ইচ্ছে করে, এই যে... এই যে... এই ‘এই যে’ শেষ হবে না। 
অথচ বিশ্বাস করুন, কোন একটা কারণ নেই এমন ইচ্ছে করার। একজন মানুষের যতগুলো উপকরণ থাকলে সোসাইটি তাকে সুখী মানুষ বলে ভাবে আমার তার চেয়েও দু'চারটা উপাদান ও উপকরণ বেশি আছে। ফ্ল্যাট, গাড়ি, সরকারি উচ্চপর্যায়ের চাকরি [যদিও বর্তমানে পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ এ আছি], বেশ কয়েকটা নামে বেনামে জমি, ব্যাংক একাউন্ট, বিদেশ ভ্রমণ এসব তো লাল চা আমার কাছে। সেই লাল চায়ে দুধ, চিনি মিশিয়েছে আমার প্রেজেন্টেবল ওয়াইফ, মেধাবী সন্তান ও দুই বাড়ির আই মিন নিজ ও শ্বশুর বাড়ির তুখোড় সব প্রফেশনালস। দু’পেগ গলায় ঢালতে আমায় বারে যেতে হয় না, বউকে লুকাতে হয় না। বউয়ের সামনেই আমি আমার গ্ল্যামারাস, আলট্রা মডার্ন বান্ধবীদের ঘাড়ে বা কোমরে হাত দিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারি। এদের দু’একজনের সাথে আমার সম্পর্ক বিছানা অব্দি। স্ত্রী তা বুঝেও না বোঝার ভান করে। আমার বন্ধুদের আড্ডায় বউও যোগ দেয় কখনো সখনো। আড্ডায় তখন মুখ চলে বটে তবে ওদের প্রত্যেকের জিহবা আর চোখ অন্য কথা বলে। আমি বুঝি তো। বন্ধুদের চোখ যে আমার বউয়ের গ্লাসি স্কিন পেট থেকে নামতে নামতে নাভীহৃদে নামে অথবা ফিনফিনে শাড়ি ভেদ করে ব্লাউজের ভেতর থেকে উড়তে চাওয়া কবুতরের ডানার ভাঁজে ডুবে থাকে; এসব বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। কিন্তু ওদের দৌড় অই পর্যন্তই। আমি আমার বউয়ের চয়েস জানি৷ 
—আজ কী বার? 
—কেন রে, লিস্ট চেক করবি? 
—কিসের লিস্ট? 
—না মানে, আজ কার সাথে...
বন্ধু সাজুর ইঙ্গিতে হাসতে যাবো ঠিক তখনই আমার মনে পড়ে গেল আজ কী বার। চট করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথাটা বোধহয় একটু টলে উঠলো। সাথে তলপেটে একটা চাপ। কাল রাতে একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিলো। অথচ তখন একবারও মাথায় আসেনি রফিকুল্লাহ ট্রেডার্স এর সাথে আজ আমার ডিল ফাইনাল করার কথা। তলপেটের চাপটা বাড়ছে। তবু মোবাইল হাতে নিলাম। দশটা বিশ! সাড়ে দশটায় মিটিং। আধা ল্যাংটো অবস্থাতে দৌঁড় দিলেও রফিকুল্লাহকে ধরা যাবে না। মেজাজ খিচিয়ে গেল। ঝাল ঝাড়লাম বন্ধুর উপর।
—শালা! তোরাই আমার বারোটা বাজাবি। ইশ! মিনিমাম দুই কোটি টাকা হাতছাড়া হয়ে গেল। টেন্ডারের নেগোসিয়েশনটা আমি করিয়ে দিতে পারলেই... 
তলপেটের চাপ আর নিতে পারলাম না। কথা শেষ না করেই সোজা দৌঁড়ে টয়লেটে ঢুকে পড়লাম। উফ! শান্তি। শরীরের সব রোমকূপ যেন অবসাদে ঢলে পড়লো। কিন্তু মাথা থেকে রফিকুল্লাহ আর মিনিমাম দুই কোটি টাকা গেল না। মাছির মত ভ্যান ভ্যান করতে লাগলো। তলপেটের মত এই দুই জিনিসও আমার মাথায় অনবরত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলো। 
বিশ্বাস করুন ঠিক তখনই কেউ একজন কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘রফিকুল্লাহ আর টাকা, এই দুটোকেও কমোডে ফ্ল্যাশ করে দাও।’ আমি স্পষ্ট শুনলাম। এত স্পষ্ট আর তীক্ষ্ণ যে আমি সৌচকর্ম না সেরেই তরাক করে লাফ দিয়ে উঠে যাচ্ছিলাম প্রায়! না চাইতেও হা করা মুখ নিয়ে পুরো ওয়াশরুম পর্যবেক্ষণ করলাম। তারপরই হাসি পেল নিজের বলদামি দেখে। আরেহ! আমি বাচ্চাদের মত ভূতের ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি কেন? এটা স্রেফ টেনশান ও উত্তেজনা থেকে—এটা না বোঝার কিছু নেই। 
রফিকুল্লাহর মুখটা মনে পড়লো তখনি। লোকটার চেহারা আর আচরণ দুটোই চোখা। চাউনিটা শেয়ালের মত। কানের লতি ঝুলে থাকে অযাচিত। জায়গার জিনিস জায়গায় না থাকলে যেমন বেখাপ্পা লাগে রফিকুল্লাহর কান দেখলে আমার তেমন লাগে। মনে হয় কেউ ঠ্যালা দিয়ে সামনে এগিয়ে প্রায় গালের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে৷ আমি জীবনে এত বড় বড় কুতুবকে লাইনে নিয়ে আসছি কিন্তু এই ব্যাটা একটা চিজ। কারো লাইনে সে যায় না। অন্যকে নিজের লাইনে নিয়ে আসে। আমাকে সে তার লাইনে হাঁটতে বাধ্য করেছে বলা যায়। যখন কথা বলে মনে হয় হেলায় খেলায় একটা বলে দিলো। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। ওটাকেই ফুল এণ্ড ফাইনাল ভাবতে হবে। নব্বই শতাংশের বেশি ভাবে না। বাঙালির যা স্বভাব আর কি। ফলত তারা রফিকুল্লাহর সাথে কাজ করতে পারে না। আর রফিকুউল্লাহ এভাবেই তার চারপাশ আগাছামুক্ত রাখে। বাট লোকটার সাথে কাজ করে আনন্দ আছে। কমিশন বা শেয়ার কোনটাই সে আটকিয়ে রাখে না। তার কাছে সব নগদের কারবার। দীর্ঘ পনেরো বছরের পথচলা এই লোকটার সাথে। কোনদিন মদ,  মেয়েমানুষের নেশায় দেখিনি। নামাজ পড়তেও দেখিনি। আজব এক পাবলিক। কম করে হলেও তিনশো কোটি টাকার মালিক এই লোক কাজ শেষে বাড়ি ফিরে স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে অংক করায়, পলাশী বাজারে গিয়ে পুঁইশাক, মলা মাছ নিয়ে দামাদামি করে। বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করে। তারপরই আবার দুই হাত বউ আর ছেলের কান্ধে রেখে কোন এক রিসোর্ট থেকে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে। ছবি তো আমিও পোস্ট করি। শুধু কী বউ বাচ্চা! আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে বিদেশের অপূর্ব সব লোকেশানের ছবি আছে আমাদের। ফ্যামিলি ট্রিপে আমরা বছরে দু'বার দেশের বাইরে হৈ হৈ করে আসি। লোকজন ছবির নিচে মন্তব্য করেন—‘দারুণ সুখে আছেন ভাই, কী কপাল আপনার!’, ‘সুখী পরিবার’, ‘আহা! আমরাও যদি যেতে পারতাম!’ ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কী! কমের পক্ষে ৪০০/৫০০ কমেন্টসে ভাসবে আমার নিউজফিড। সেখানে রফিকুল্লাহর কমেন্টস হয়তো মাত্র ২০/২৫ টা। কিন্তু অই সামান্য কয়টা মন্তব্যই আমার চার পাঁচশো মন্তব্যকে ফু দিয়ে পালকের মত উড়িয়ে দেয় নয়তো পুকুরের পানিতে দশ পয়সার কয়েনের মত টুপ করে ডুবিয়ে দেয়। আমার হাহাকার বাড়ে, ঈর্ষা ঘনীভূত হয়। মেকি আনন্দে মুহূর্তেই আগুন জ্বলে ওঠে। আমি মরিয়া হয়ে উঠি ওকেও মিথ্যে প্রমাণ করতে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। অবশেষে একদিন  সুযোগটা এসে যায়। রফিকুল্লাহ বাজার থেকে পাঁচমিশালি মাছ কিনে ফেসবুকে পোস্ট করে  ক্যাপশনে লিখলো, ‘বউ রে বলছি বেশি করে পিয়াজ আর ধনেপাতা দিয়ে রান্না করো।’ ব্যাস আমি চাঞ্চটা মিস করলাম না । না জানিয়ে রফিকুল্লাহর বাসায় উপস্থিত হলাম। নিশ্চিত ছিলাম এই ঘন বর্ষায় রফিকুল্লাহ বাজারে যেতেই পারে না আর পাঁচমিশালি মাছ তো দূর কী বাত। সো, এই মিথ্যেটা ধরা আমার জন্যে অনেকটা না হলেও ভালোই স্বস্তি আনবে। অন্তত রফিকুল্লাহও যে কিছুটা ফেইক জীবনযাপন করে তার প্রমাণ আমার পোড়া হৃদয়ে কিছুটা বার্নলের প্রলাপ এনে দেবে। যেতে যেতে ওর  খাবার টেবিলের ছবি দিয়ে কী লিখবো সেই ক্যাপশনটাও নোটপ্যাডে লিখে রাখলাম। মোক্ষম চাঞ্চ ৷ ঠিক পৌনে একটায় ফোন দিলাম রফিকুল্লাহকে। 
—ভাই কেমন আছেন? 
—ভালো স্যার। আপনি কেমন আছেন?  
—জ্বি ভালো। আমি তো আপনার বাসার সামনে। 
—বলেন কী! 
—হ্যাঁ একটা জরুরি কাজে এদিকে এসেছিলাম। ভাবলাম আপনি বাসায় থাকলে ঢু মেরে যাবো।  
—বাসাতেই আছি। আসেন স্যার। গরীবের সাথে দুটা ডালভাত খাবেন। 
প্রথমে ভদ্রতাসূচক কিছুক্ষণ না না করলাম। অতিরিক্ত ভদ্রতা দেখাতে গেলাম না। মিশন ফস্কে যেতে পারে।অবশেষে ‘ওকে আসছি’ বলে ভুয়া ভদ্রতার ইতি টানলাম। আনন্দের আতিশয্যে রফিকুল্লাহর বাসায় ঢুকবার আগে কেজি দুয়েক মিষ্টি, কিছু ফল কিনে ফেললাম। না চাইতেও মনে গানের সুর ভেসে এলো ‘আইজ পাশ খেলবো রে শ্যাম’। কলিংবেল চাপতে হল না। লিফটের পেট থেকে বের হতেই দেখি রফিকুল্লাহ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে কান অব্দি বিস্তৃত হাসি নিয়ে ।
—আরে ভাই কেমন আছেন?  
—জি স্যার ভালো, ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আসেন স্যার। কী সৌভাগ্য আমার। গরীবের বাড়িতে হাতির পা পড়লো। 
—আরেহ। কী যে বলেন! হাতির পা তো গরীবের বাড়িতেই পড়বে। বড়লোকদের বাড়িতে তো আর কলাগাছ থাকে না। হা হা হা... 
নিজের জোকস এ নিজেই এক প্রস্থ হাসলাম। রফিকুল্লাহও হাসলো তবে তা আমার চেয়ে বেশি নয়। আমি আড়চোখে খুটিয়ে খুটিয়ে রফিকুল্লাহর এক্সপ্রেশন ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷ একটু কী চিন্তিত মনে হচ্ছে রফিকুল্লাহকে? আমি অভিজ্ঞ ডুবুরির মত ওর চেহারার কোনাকাঞ্চিতে লজ্জা, হতাশা অথবা বেকায়দায় ধরা খাওয়ার অস্বস্তি খুঁজে বেড়াচ্ছি। রফিকুল্লাহর বউ এসে আমাকে সালাম দিয়ে ভাবি বাচ্চাদের খোঁজখবর নিলো। বউয়ের মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি। রফিকুল্লাহকে আড়ালে ডেকে কিছু বলতে চাইলে আমি হৈ হৈ করে উঠলাম। 
—ভাবি, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি কী আপনাদের পর? যা আছে তাই খাবো। বাইরে থেকে কিচ্ছুটি আনাবেন না। তাহলে তো বাইরেই খেতে পারতাম।
বউ খুব কষ্ট করে হেসে বললো, ‘ভাই, আজ বলতে গেলে একেবারেই নিরামিষ। এ দিয়ে আপনাকে খেতে দেই কী করে।’  

আমার মনে লাড্ডু ফুটলো। অন্তত একদিন রফিকুল্লাহকে মিথ্যে প্রমাণ করার আনন্দে আমি তখন আত্মহারা। খাবার টেবিলের দিকে যতই এগুচ্ছি ততই উত্তেজনা বাড়ছে। টেবিলে লাউ দিয়ে ডাল, পটল  ভাজা, শাক। আনন্দে চিৎকার দিতে গিয়েও হজম করলাম। নাই, টেবিলের পুরো মানচিত্রে কোথাও পাঁচমিশালি মাছ নাই। হাত ধুয়ে টেবিলে বসতে যাবো অমনি দেখি একটা পেয়ালায় পাঁচমিশালি মাছ নিয়ে হাজির রফিকুল্লাহর বউ। মুহূর্তে আমার হাসিহাসি মুখটা মুখপোড়া বান্দরের মত হয়ে যায়। আমার শরীর, মন জ্বলতে থাকে। চোখ পুড়তে থাকে। এত তীব্র সে জ্বলুনি আর পোড়ানি যে মনে হয় রফিকুল্লাহর সাথে সাথে ফেসবুকের নাম নিশানাও মুছে ফেলি। এ তো সামান্য ফেসবুকের ঘটনা, কাজের ক্ষেত্রেও এমন। দেখা গেল আমি মহা উৎসাহ নিয়ে কোন নেগোসিয়েশন বা টেন্ডারের কথা জানাতে গেলাম। আমি নিশ্চিত, এ ব্যাপারে ও কোনক্রমেই জানতে পারে না। কারণ ব্যাপারটা সেটেলই হয়েছে হয়তো কয়েক ঘণ্টা আগে। আমিই প্রথম সংবাদদাতা, এ ব্যাপারে একশো পার্সেন্ট শিওর হয়ে ওর অফিসে ঢুকলাম। গিয়েই টেবিল ঠুকে বললাম, ‘রফিকুল্লাহ ভাই, গুড নিউজ আছে। আজ আস্ত বোতল একটা গিফট করেন, ভরপেট খাওয়ান। তারপর কঠিন নিউজ দিবো।’ রফিকুল্লাহ বোতল দিলেন, চেম্বারে দিল খুশ করা সব খাবার আনালেন। আরো কিছু হুকুম আছে কিনা জানতে চাইলেন। তার চোখেমুখে উৎসাহ দেখে আমি নিশ্চিত থাকতাম সে কিছুই জানে না। পেট ভাসিয়ে, চোখেমুখে রহস্য নিয়ে আমি যখনই বিষয়টা বলতে শুরু করবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই সে তার কোন অধঃস্তনকে ডেকে সেই বিষয়েরই খোঁজ খবর জানাতে বললেন। কিছু দিকনির্দেশনাও দিলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে কানের লতি ছোঁয়া হাসি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘বলেন স্যার, কী য্যান বলতে চাইছিলেন। এইবার বলেন। গুড নিউজ শুনি।’ আপনারা তখন ভাবতে পারেন আমার অবস্থাটা? কান ঝা ঝা করতে থাকে। বমি বমি পায়। মনে হয় আমি একটা সার্কাসের বান্দর। রিং মাস্টারের কথায় নেচে-কুঁদে খেলা দেখালাম। এবার তার নির্দেশ মান্য করে খাঁচায় ঢুকে পড়লাম। আর রফিকুল্লাহ যখন বারবার বলতে থাকে, ‘বলেন স্যার, গুড নিউজ বলেন’, আমি তখন স্যারকে শুয়ার শুনতে পাই। এরপর পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া পোড়া কলিজা নিয়ে যখনই উঠতে যাবো রফিকুল্লাহ তখন আস্ত বোতলের ব্যাগটা হাতে ধরিয়ে দেয় বিনয়ের সাথে। খেলা শেষে মাস্টার যেমন দয়াপরবশ হয়ে কোন প্রাণীর দিকে খাবার ছুঁড়ে দেয় তেমনি আর কি। ‘হারামজাদা’ এই গালটাও আমাকে মনে মনে দিতে হয়। আর মনে মনে দেয়া গাল মানেই হজমের, মানে অর্ধেক নিজের আর বাকি অর্ধেক তার। যার উদ্দেশ্যে গালিটা দিলাম আর কি। নিজের ভাগটা আগে—এই তত্ত্বানুযায়ী ‘হারাম’ আমার ভাগে আর ‘জাদা’ রফিকুল্লাহর ভাগে। হারামের আগে পরে যা-ই বসাও কী হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর জাদার আগে পিছে যা-ই বসাও তা শুনতে কত ভালো লাগে!  
ধুর! কমোডে বসেও শান্তি নেই। রফিকুল্লাহ আসবে। আসবেই। বিশ্বাস করুন, এমন নিভৃতের সময়েও সে এসে হানা দেয়। ভাববেন না আজ রফিকুল্লাহর সাথে মিটিং বাতিল হল বলেই আমি ওকে নিয়ে ভাবছি। তাকে নিয়ে ভাবনা আমার জীবন রুটিন। এই রুটিনের কোন ব্যত্যয় নেই। নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনির মত কিছুক্ষণ পরপর সে আসবেই। প্রায়ই মনে হয় রফিকুল্লাহ আমার আত্মার ছায়া। যে জীবনযাপন আমি চেয়েছিলাম, এই মানুষটা সেই জীবন যাপন করছে । আমি যে আকাশ চেয়েছিলাম এই মানুষটা সেই আকাশ পকেটে পুরে বসে আছে। আমি যে রোদ-বর্ষা, আলো-ছায়ার জীবন চেয়েছিলাম এই লোকটা সেই জীবন আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেই সেই যাপনে ঢুকে পড়েছে। হয় না অনেক সময়। যাত্রাপালায় যেমন। এক আর্টিস্ট হয়তো আসতে দেরি করছে কিন্তু আর্ট তো থেমে থাকবে না। সো আরেকজন অনুপস্থিত আর্টিস্টের পোষাক পরে স্টেজ পারফরম্যান্সে নেমে পড়েছে। আমার আর রফিকুল্লাহর ব্যাপার অনেকটাই সেরকম। 

আমি রফিকউল্লাহ থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বড়শিতে আঁটকে গেছি। চণ্ডীদাস আর রজকিনী টাইপ বড়শি না। একেবারে সামুদ্রিক শামুকের খোল দিয়ে বানানো বড়শিতে। নট নড়নচড়ন। রফিকুল্লাহর কাছে আমার কোন গোপনীয়তা নেই। নেই মানে রাখা সম্ভব হয়নি। আমার ইন্স এণ্ড আউটস তার জানা। এমন নয় সে জানতে চেয়েছে। এমন নয় সে খুব আগ্রহী ছিলো জানতে। এমনকি আগ্রহ দূর কী বাত, সাধারণ ইচ্ছেটুকুও তার ছিলো না। অথচ প্রতিটি তীব্র সত্য যেন কমলালেবুর খোসার মত তার সামনে খুব হেলাফেলায় উন্মুক্ত হয়েছে। আর সেই উন্মুক্তকরন যখন আমার নিজের হাতেই হয়েছে, তখন কাকে দোষ দেবো আমি? এগারো বছর ধরে গোপন রাখা বিষয়টি জানতে তার এগারো মিনিটও লাগেনি। আমার দুই বাচ্চা যে আমার নয়, আমার বউ যে পুরুষ আসক্ত নয়, এক মধ্য দুপুরে আমিই রফিকুল্লাহকে বাড়ি ডেকে এনে দেখিয়ে দিলাম। কেন জোর করেছিলাম সেদিন? জোর না করলে রফিকুল্লাহ আমার বাড়িতে ঢুকতো না। আর বাড়িতে না ঢুকলে এত সব জানতোও না। রফিকুল্লাহ ওয়াশরুমে যাবে বলাতে আমিই গেস্টরুম দেখিয়ে দিয়েছিলাম। আমার বউ যে তখন গেস্টরুমে বাড়ির সুন্দরী কজের মেয়ের সাথে ছিলো আমি কী করে জানবো! রুমটা লক করা থাকলেও এসব ঝামেলা হতো না। রফিকুল্লাহ ছিটকে বেড়িয়ে এসেছিলো রুম থেকে। থরথর করে কাঁপছিল। আমার নিরবতায় সে আরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। দু'দিন পর বাধ্য হয়েই তাকে সব বলতে হয়েছে। পরিবারের লোকজনের কাছেও যে সত্য আমি নিবিড় যত্নে ও সতর্কে গোপন করেছি, যে সত্য আমি আমার ছায়াকেও বুঝতে দেইনি, সেই সত্য কত হেসেখেলে তার কাছে প্রকাশ পেলো! এক সত্য খুলে দিলো হাজারো মিথ্যের দুয়ার যার খিল আমি এঁটে রেখেছিলাম খুব সন্তর্পণে। রফিকুল্লাহ সব শুনেছে, চুপ করে থেকে দীর্ঘসময় পরে আমার হাতটা ধরেছে। সেই স্পর্শ আমাকে আশ্বস্ত করেছে। এক মুহূর্তের জন্যেও সে বিশ্বাসের অমর্যদা করেনি। আমাকে নিরাপত্তাহীন করেনি।
রফিকুল্লাহকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন রফিকুল্লাহ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমি জানি না। তাহলে কি রফিকুল্লাহ নিজেই আমাকে বলেছে টাকা সহ তাকে কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিতে! আশ্চর্য! কী হচ্ছে এসব! বাথটাবের ধার ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে রফিকুল্লাহ। মুখে হাসি নেই কিন্তু গম্ভীর ভাবও নেই। একটা প্রশ্নবোধক হাসি চোখে নিয়ে কী অপলক তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। আমি কাকের মত চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকি রফিকুল্লাহ আমায় দেখতে পাচ্ছে না। আচ্ছা, একটা ধাক্কা দিয়ে রফিকুল্লাহকে বাথটাবে ফেলে দিলে কেমন হয়? মিথ্যে প্রবোধ আর মরীচিকা মাখা জীবনযন্ত্রণাকে কাধে নেয়া লাশের মত বয়ে যাচ্ছি আমি আর কেউ একজন দর্শকের মত দাড়িয়ে সেটা দেখবে, এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। তার চেয়ে…
আমি কমোড থেকে উঠে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম রফিকুল্লাহর দিকে। রফিকুল্লাহ তখনো একভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি রফিকুল্লাহকে ঘোলা দেখছি, না না… সম্ভবত রফিকুল্লাহই আমাকে ঘোলা দেখছে। অন্ধকারের শরীর বেয়ে নেমে আসছে শীতলতা…
বাথরুমের দরজায় কারা যেন খুব জোরে কড়া নাড়ছে। আমার খুলবার কোন তাড়া নেই। উত্তর দেবারও গরজ নেই। রফিকুল্লাহ খুললে খুলবে, না খুললে নাই। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে ৷ বাথটাবের পানিতে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে অথচ একটা অনন্ত ঘুম আমি সমুদ্রে দিতে চেয়েছিলাম…