মরক্কোর কবি আহমাদ আল-মাজ্জাতির কবিতা

অ+ অ-

 

|| আহমাদ আল-মাজ্জাতি ||

কবি আহমাদ আল-মাজ্জাতির জন্ম ১৯৩৬ সালে, মরক্কোর বন্দরনগরী কাসাব্লাংকায়। আরবী ভাষাভাষী আফ্রিকান মাগরেবের চলমান কাব্যচর্চায় যে গুটি কয়েক কবিকে চিহ্ণিত করা হয় আধূনিক চিন্তা-চেতনার নিশান বরদার হিসাবে, তাঁদের মধ্যে কবি আল-মাজ্জাতি ছিলেন অন্যতম। ছাত্রজীবনে যশস্বী এ কবি পড়াশোনা করেন প্রথমত সিরিয়ার দামেশ্কে, অতঃপর মরক্কোর রাজধানী রাবাত নগরীর মোহাম্মদ-পঞ্চম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন আরবী সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন তিনি কিছুকাল। তাঁর সমকালের সাহিত্য সমালোচকরা আল-মাজ্জাতির কাব্যকীর্তির বৈশিষ্ট্যকে আঁভাগার্দ ও নতুন দিগন্তের উন্মোচনকারী হিসাবে বর্ণনা করে থাকেন। জীবদ্দশায় তাঁর কেবলমাত্র একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। কবি আহমাদ আল-মাজ্জাতি ১৯৮৫ সালে ইবনে জায়দুন  ও ১৯৮৬ সালে মরক্কো পুরষ্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৫ সালে কবি মৃত্যুবরণ করেন।

প্রতিধ্বনিতে উপস্থাপিত কবিতা তিনটি ও কবির বায়ো-বিষয়ক উপাত্ত নেওয়া হয়েছে ‘পোয়েট্রি ইন্টারন্যাশনাল’ নামক সূত্র থেকে। আরবি ভাষা থেকে কবিতাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নরদ্দীন ঝৌতনি।


 

গন্তব্যে পৌঁছা

মাতাল হাঁটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই কেটে যায় তার ঠোঁট।
তার বিষাদের বিচূর্ণ আরশিতে সে প্রত্যক্ষ করে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দৃশ্যপট,
প্রার্থনার বিধুর ধ্বনিতে নড়ে তার রক্তাক্ত ওষ্ঠ।
একটি নক্ষত্র কসমিক চিৎকারে তলিয়ে যায় মহাশূন্যের অন্ধকারে।
ফসকে যায় অতঃপর তার হাত থেকে স্বপ্নের ধমনী—ফসকে যায় জপমালা
একজন জননী ছাদে কাপড় শুকোতে দিয়ে কাঁধ বাঁকিয়ে তাকান,
ঘেয়ো কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে ভরে ওঠে সরণী,
জিহ্বা কামড়ে চোখ মুদে সে আর ভেসে যায় নিশানা-বিহীন দূরে— 
দূর থেকে বহুদূরে।

 

নৈরাশ্য

এসেছি আমরা। যে মায়াবিভ্রমে জ্বলছে অগ্নিকুণ্ড নগরীর চকে
তার আলোয় আমরা পথের নিশানা খুঁজে এসেছি চলে।
এসেছি আমরা দুর্গ দেয়ালের অন্তরাল থেকে।
গা ঝাড়া দিয়ে আমরা ছুড়ে ফেলেছি আমাদের প্রতিচ্ছায়া, 
ধুলো, শব্দ ও কাফন
আর জপেছি বিড়বিড়িয়ে: আমাদের যাত্রারম্ভ ঈশ্বরের সহায়তায়
আলো—হে আলো!
কলমের কালি কিন্তু তোমার নিজস্ব
আর কেবল-মাত্র তুমি—তুমি হচ্ছে জ্বালানি তৈল, 
পবিত্র কোরান, বেদবাক্য ও বাইবেলের বিস্মৃত গল্পগাঁথা-গসপেল!

অতিক্রান্ত হয় যুগ থেকে যুগান্তর, 
তারপরও আমরা কিন্তু কেবল ঘূর্ণচক্রে ঘূর্ণিত হতে থাকি।
বিষবৃক্ষের ছায়াতলে ঢলে পড়ি নিদ্রায়—কেটে যায় আমাদের নিদাঘ রজনী।
শুধু বহতা বাতাস বাজিয়ে চলে বাদ্যযন্ত্রের সুরতন্ত্রী
আমাদের জন্য তৈরি হতে থাকে গীতল পদাবলী
যতক্ষণ না জেগে ওঠি আমরা।
জরাজীর্ণ সড়ক অতিক্রম করে যায় আমাদের কাফেলা 
খাদ্যহীন পথচলায় কাফেলা চিবোতে থাকে মাদি-উটের হাড়
ছেয়ে আসে চরাচর গভীর নৈরাশ্যে।
মূলত যাত্রী আমরা মাত্র দু-জন
তৃতীয় সহযাত্রী হচ্ছে নৈঃশব্দ্য
আর অশ্রুকে বিবেচনা করা যেতে পারে চতুর্থ সহচর হিসাবে।


বাতাসে হোঁচট খাওয়া

সৈকতে বিশ্রাম নেয় পড়ে থাকা তুষার ও তুমুল নৈঃশব্দ্য
ঊর্মিরাজি বালুকা জড়িয়ে পড়ে আছে নিস্তরঙ্গ
আর হু হু হাওয়া—মাঝিবিহীন একটি নৌকা।
একটি দাঁড়ের ভগ্ন টুকরা-টাকরা—অবশিষ্ঠাংশ
তাতে ঊর্ণনাভে নকশা আঁকে একটি মাকড়শা
কে জ্বালতে পারে আমার দুচোখে আনন্দের শিখা?
সুপ্তিতে নিমগ্ন দৈত্যকে জাগাতে পারে কে?
আর মৃত্যু হয় কার?
বাগানে মৃত্যু-গন্ধ যেন বিদ্রূপ করে চারটি ঋতুকে
আর তুমি—হে আমার নারীবন্ধু,
বসে আছো কুমারীর চোখে অশ্রু নিয়ে শ্বাসরুদ্ধ।
ঝরাপাতার আবর্জনায় পদশব্দ বুঝি-বা খুঁজে ফেরে সত্য
যার সঙ্গে সম্পর্ক একটি ছুরিকার… একটি সুরক্ষিত বাহুর জন্য।
জখমে ক্ষত-বিক্ষত আমার দেহের গভীরে
ঈগলের নখে আউলানো পালক ছিলো
নৈঃশব্দ্যের গভীরে প্রচ্ছন্ন একটি কণ্ঠস্বর
যা খুঁজে ফেরে মাদলের মন্দ্র-ধ্বনি
একটি প্রবল বৃষ্টিপাতের জন্য
পরিপূর্ণ হবে সোরাহি ধারাজলে 
বিজুলির বলয় যেন মাতে মল্লযুদ্ধে
ভাসমান মেঘদলের ছায়ায় ঢেকে যায় 
ভুল নিশানায় এগিয়ে যাওয়া অশ্বের খুরচিহ্ণ।

যাও হে অশ্ব—এগিয়ে যাও আমার মরদেহ নিয়ে
আমার ঝরে পড়া রক্ত 
বোধ করি অনুভবও করতে পারেনি পথের পরিক্রমা।
কে প্রতীক্ষা করে ভোরের
আর অরুণোদয়ের অপেক্ষায় অধৈর্য হয় কে?
কে আমার জল্পনার পাথরখণ্ড আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে?
আর কার ধারালো চঞ্চু এগিয়ে আসছে
আমার দু-চোখের দিকে?
মশালের ছিনতা্কারী হে দস্যু
গাঢ় নৈঃশব্দ্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে অবেদনময় ক্রন্দন।
অস্পষ্ট প্রবল কুয়াশাচ্ছন্নতার ভেতর চয়ন করো আলোর মল্লিকা।
আমরা গুহার আধোন্ধকার কন্দরে অনুসন্ধান করি নীরবতার
শব্দের ধারাজলে পরিচ্ছন্ন করা যায় না অশুদ্ধতাকে
এসো তবে সাঁতার কাটি পাথরডোবা তরঙ্গসংকুল সমুদ্রের জলতলে।

জলতলের গভীরে আছে নিশ্চিত আলোর অনাবিল ঝলক
তাকে বিবর্তিত করো স্ফুলিঙ্গে
যা নীরবতার শিকল ছিড়ে উদ্ধার করবে বহতা বাতাসকে
আর মানবতাকেও শেখাবে কীভাবে বরণ করতে হয় মৃত্যু!

 

ভূমিকা ও অনুবাদ || মঈনুস সুলতান