মৃতদের সঙ্গে আড্ডা ও অন্যান্য কবিতা

অ+ অ-

 

|| আশঙ্কা ||

আবারও গণঅভ্যুত্থান হলো। 

ওই লোকটার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে হাসি 
মৃত্যুর ভয়ে যে যুদ্ধে যায়নি; 
ভালো থাকার জন্য যে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল সম্পদের পাহাড়। 
লোকটা পাখি পুষতো। পাখিটা বিপ্লবী, খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে।

লোকটার কবরে কালো টাকার ফুল। 
সন্তানেরা তার মত্ত একে-অপরকে হত্যার নেশায়! 
পাখিটা বেঁচে নেই, খুন হয়ে গেছে। ১৯৪৭-৫২-৬৯-৭১-৯০
২০২৪ 
তৃতীয় স্বাধীনতা
দ্বিমত প্রকাশের অধিকার
গণঅভ্যুত্থান কি আবারও বেহাত হতে যাচ্ছে?
সাবধান
টাটকা সূর্যে শুকাচ্ছে এলিটের গাড়ি-কোট—ধূর্তহাতের হাতঘড়ি। 
নায়কের পোশাকে খলনায়কেরা জড়ো হচ্ছে সিংহাসনের ছায়ায়।

 

||  ÷ ||

গনগনে মধ্যদুপুর। ইলেকট্রিসিটি বেড়াতে গেছে, ফিরবে না বাড়ি!

খেজুরগাছ + আমগাছের ছায়া
তালগাছ + লিচুগাছের ছায়া
পুকুরে হাঁসের ছানা + মাটিতে কুকুরের হাঁসফাঁস।
ওই লাল জামা পড়া কিশোরীটি কই যায়
ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে মোরগ হাতে?
মোল্লাবাড়িতে খতনা হচ্ছে শিশু কবিরের,
সাইকেলে চড়ে বাড়ি ফিরছে আবুল কাসিম
পেছনে ব্যাগভর্তি সবজি ও ইলিশ।
ইলিশ মাছের ৩০ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি
পুবের ধুলা ভিক্ষা করে পশ্চিমা সূর্যের বাড়ি।

ইলেকট্রিসিটি বিয়োগ হয়ে গেছে, ইলেকট্রিসিটি যোগ হতে পারছে না।

আকাশে হারিয়ে গেছে বুড়োবুড়ি
সন্তানেরা ÷ করছে মাটি।

 

||  পায়ে টুপি, মাথায় জুতো ||

তাকে দেখলেই মনে হয়—মাথায় জুতো, পায়ে টুপি।
তুখোড় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর,
কবিত্বের চেয়ে দক্ষতা বেশি যার ম্যানেজ করার।

নিজে মদ না খেলেও
স্ব-আয়োজনে মদের আসরে মদ ঢেলে দিতে ভালোবাসেন। 
অন্যের কালো টাকায় সাহিত্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। আর তাতেই এপার বাংলা-ওপার বাংলায় কবি বলে স্বীকৃতি মিলে গেল সমাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিও জুটে গেল। কবিতায় মোটা মোটা মিথ্যা মিথ্যা সরকারি-বেসরকারি-গৃহপালিত-রাস্তায়পালিত পুরস্কারও জুটল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের পদও জুটে যাবে।

আহা, কী আনন্দ! কী আনন্দ! জীবনানন্দ-জীবনানন্দ... 
এবার আর কী চাই? কিছুই চাই না—

দুঃখ একটাই, তরুণ লিখিয়েরা তার কবিতা পড়ে না—কাদের যেন কবিতা পড়ে। এ সময়ের তরুণ কবিরা একদম মূর্খ! একদম মূর্খ! নবীন কবিদের শিক্ষিত করতে এপার আর ওপারের বিষখ্যাত সাহিত্যিকদের দাওয়াত করতে হবে!

 

||  মৃতদের সঙ্গে আড্ডা ||

কেউ বিপ্লবী ছিল না, কারও কারও বিপ্লবীর ছদ্মবেশ ছিল।
অনেকেই চে গুয়েভারার ছবিঅলা টি-শার্ট পরতে ভালোবাসত।
অনেকেই মার্ক্স-লেনিন বা কাস্ত্রোকে নিয়ে দারুণ বক্তৃতা করতে পারত,
কেউ কেউ আবার কলাম লিখতে।

কেউ অগোছালো ছিল না, তবে কারও কারও 
অগোছালো থাকার অভিনয় ছিল।
কারও কোনো সত্যিকারের পাগলামি ছিল না,
তবে কেউ কেউ নিজেকে পাগল হিসেবে জাহির করতে চাইত।

হায়, আমার লেখক বন্ধুদের মধ্যে কোনো ব্যর্থ মানুষ নাই,
সকলেই গড়পড়তা মাঝারি মানের প্রতিভা।

যেহেতু লেখকবন্ধুরা মাঝারি মানের,
তাই নিজেকেও মাঝারি মনে হতে থাকে।

একদিন ফেসবুক থেকে এই মাঝারিদের ডিলিট করতে শুরু করি।

 

||  ঘুমাও নুহের নৌকায় ||

ধর্মগ্রন্থ পাঠ শেষে তোমার কবিতাতে ধর্মগ্রন্থের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তোমাকে দেখেছি শেষবার নুহের নৌকায়। চোর নিয়ে যায় তোমার পাণ্ডুলিপি, তারপর খুন হয় গলির রাস্তায়। আসামির হাতে পাওয়া কবিতা পড়ে পুলিশ হয় বাদশাহিবিরোধী! তুমি কী ভাবছিলে সেদিন বিষণ্ন হয়ে আকাশে তাকিয়ে? শয়তানও যে উঠে পড়ল নৌকায় গাঁধার লেজে ভর করে!

তোমার উপন্যাস পড়ে বোঝা যায়—রাষ্ট্রীয় পদক-পদবি মানে শিকল। মূর্খতা বর্ষণ হচ্ছে, কিয়ামতের লক্ষণে আটকে যাচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্র! ৩৬০০০ রাজ খেতাব নিয়েও তোমার মতো একটি মালা গাঁথতে পারে না রাজঝিনুক।

তোমার কবিতাতে নাই কোনো শব্দ, নাই কোনো রেখাচিত্র।
কিন্তু কিছু একটা আছে—যা সাদা পৃষ্ঠার চেয়ে আকর্ষণীয়।

 

|| দানবের দারোয়ান ||

আঁকাবাঁকা বোকাসোকা পত্রিকা অফিস। হায়, কী লিখব সম্পাদকীয়তে!

নামহীন একটি জোকার ঘোড়া এসেছে শহরে
ঘোড়ার পিঠে লেখা—
‘চমকে-ঠমকে নিদারুণ ভোগে-উপভোগে
আমাদের মৃত্যু ভার্চ্যুয়াল জাগতিক রোগে।’

আহা, জীবনটা কাঠবিড়ালির মতো পারত হতে কবির। 
একটি টিয়া অন্য টিয়ার পাশে ওড়ে,
শহরের সব সাইকেল আছে কাত হয়ে।
হাওয়া নেই, শীতলতা নেই, সত্য নেই, সাহসিকতা নেই
একটা জীবন পার হয়ে যাচ্ছে কবির জবুথবু ভৌতিকতায়!  

দানবের জুতোর কাছে সংবাদপাখি নত সিজদায়!