অসীম সাহার আলোচিত কবিতা

অ+ অ-

 

|| অসীম সাহা ||

বাংলাদেশী কবি ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলায় মামার বাড়িতে। মাদারিপুর তার পৈত্রিক নিবাস। পিতা অখিল বন্ধু সাহা ছিলেন অধ্যাপক। ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন তিনি। স্নাতক পাস করে তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উনসত্তরের অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তার স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায় [১৯৮২], কালো পালকের নিচে [১৯৮৬], পুনরুদ্ধার [১৯৯২], উদ্বাস্তু [১৯৯৪], মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি [২০০১], অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব [২০০৬] ও মুহূর্তের কবিতা [২০০৬]। কবিতা ও উপন্যাস ছাড়াও অসীম সাহা লিখেছেন প্রবন্ধ ও গান। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে একুশে পদক লাভ করেন। সুপরিচিত এ-কবি ১৮ জুন ২০২৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিধ্বনি তার কয়েকটি আলোচিত কবিতা উপস্থাপন করছে।  

 

যাও

যে প্রশস্ত পথের সন্ধান তুমি পেয়েছো
সেই পথ ধরে তুমি সামনের দিকে এগিয়ে যাও
প্রলয়ের অন্ধকার তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!

শুধু আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিও;
বিভক্ত কাচের দুপাশে দুরকমের তুমি
আর নেপথ্যের হাহা অন্ধকারে আমি একা!

তুমি আর একবার বুঝে নাও—
প্রশস্ত পথ ধরে তুমি সামনের দিকে
এগিয়ে যেতে পারবে কিনা?
আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি:
অন্তত আমার প্রলয়ের অন্ধকার
কিছুতেই তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!

যদি তুমি পারো তবে যাও—
তুমি যাও!

 

স্পর্শ

তোমার শরীরে হাত আকাশ নীলিমা স্পর্শ করে
ভূমণ্ডল ছেয়ে যায় মধ্যরাতে বৃষ্টির মতন
মুহূর্তে মিলায় দুঃখ, দুঃখ আমাকে মিলায়
জলের অতল থেকে জেগে ওঠে মগ্ন চরাচর
দেশ হয় দেশ, নদী হয় পূনর্বার নদী
নৈঃশব্দ্য নিরুণ হাতে করতালি দেয়
নিসর্গ উন্মুক্ত করে সারাদেহে নগ্ন শরীর
কোনখানে রাখি তুলে দেহের বিস্তার
তোমার শরীরে হাত দীর্ঘতর আমার শরীর;
তোমার শরীরে হাত সূর্যোদয়, মেঘে রৌদ্র
জন্মান্তর আমার আবার;

তোমার শরীরে হাত একদিন, এই জন্মে শুধু একবার!

 

তুমি
 
একবার এক রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে
একটি ট্রেনের জানালায় তোমাকে দেখেছিলাম—
গায়ে পশমি-চাদর, চোখে হালকা-রঙের সানগ্লাস
তোমার সমুদ্রের মতো গভীর দৃষ্টি—
হয়তো বা আমার দিকেই!
মনে হলো, তুমি ইশারায় ডাকছো আমাকে।

আমার চোখ দু’টো জানালায় স্থির,
পৃথিবীর সব কোলাহল
অকস্মাৎ আফ্রিকার নির্জন বনভূমি হয়ে গেলো;
সব মানুষ এখন অপার স্তব্ধতায় নির্বাক।
এখানে আর কোনোদিন গার্ডের হুঁইসেল বাজবে না
প্ল্যাটফর্মের কাউন্টার থেকে
কোনোদিন বিক্রি হবে না কোনো টিকিট
যাত্রীরা লাগেজসহ ফিরে যাবে যার-যার ঘরে;
শুধু লাইনে দাঁড়ানো একটিমাত্র ট্রেন আমার চোখের সামনে
চিরকালের জন্যে অপেক্ষা করবে;
শুধু তুমি ছাড়া ট্রেনের সব কামরা থেকে
সকলেই একে-একে নেমে যাবে এখানে-ওখানে।
আর আমি বিশ্বজয়ী কোনো এক সম্রাটের মতো
একটি কবোষ্ণ ঠোঁটে
খুব সজোরে চেপে ধরবো আমার এই তৃষ্ণার্ত ঠোঁট;
আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরবো চুম্বকের মতো।

চতুর্দিকে অন্ধকার নেমে আসবে
সারা পৃথিবী ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে
কিন্তু আমরা আমাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই ঠোঁট
পরস্পর চেপে রাখবো ততোদিন
যতোদিন না আমাদের যৌবন শেষ হয়ে যায়!
অথচ ইস্পাতের অনেকগুলো চাকায়
আমার একটিমাত্র বাসনা মাড়াতে-মাড়াতেই
তুমি কী অনায়াসে সুদূরের দিকে চলে গেলো!
তবে সেদিন, কেন তুমি ও-রকম সাড়া দিয়েছিলে?

 

কবি নামের চামচা

কবি নামের চামচা আছে
গলায় তাদের গামছা আছে
কবি আছে নানান রকমফের;
আমলা দেখে হাত কচলায়
তেল মারে আর মাছ খচলায়
দুই আনাতে কবি বিকোয় ঢের!

অকবিদের কবি বানায়
তাদের কি আর কবি মানায়?
দামড়া কিছু কবি আছে
তাদের বুকে ছবি আছে
বলতে পারো সে-সব ছবি কাদের?
গুলশানেতে বাড়ি আছে
সাপ্লাইয়ের নারী আছে
হরেকরকম মুখোশ আছে যাদের।

টাকার জোরে, মামার জোরে
দেশ-বিদেশে তারাই ঘোরে
উৎসবেতে তারাই যে হয় গণ্য;
কবিতা আর শিল্প তো নয়
ক্রমশ তা হচ্ছে যে ক্ষয়
কবি নামের অকবিদের জন্য!

 

এনজিওগ্রাম
 
বাইপাস দিয়ে নতুন রাস্তা ধরে ছুটে যেতে আমার খুব ভালো লাগে!
কিন্তু তার জন্যে সংযোগ-সড়ক চাই—
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এরকম ভাবতে-ভাবতে
যখন জানলাম, সংকীর্ণ পথের শেষপ্রান্তে ব্যারিকেড দিয়ে বসে আছে
রক্তকণিকার জমাটবাঁধা কিছু কেয়াকাঁটার ঝাড়—
তখন তাকে অপসারিত করার জন্য সশস্ত্র পুলিসবাহিনীর মতো
যখন একা একা খুব দ্রুতবেগে ছুটে গেলো
স্প্রিংয়ের কেমিক্যালসজ্জিত কিছু স্বয়ংক্রিয় তার—
আমার চোখে নেমে এলো অসমাপ্ত ঘুম!

ঘুম ভাঙলে জানতে পারলাম, এরই মধ্যে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটে গেছে
কোলাহলমুখরিত হৃদয়ের আন্তর প্রদেশে!
২.৭৫ সেন্টিমিটার আকারের অপ্রতিরোধ্য ট্যাংকও তাকে
প্রতিহত করতে পারেনি কোথাও!

অন্ধকার রাত্রির বাইপাস পার হয়ে অবদমিত একটি হৃদয় শুধু ছুটে গেছে
মাধবীলতার বনে, অসংবৃত সুন্দরের কাছে!
বেসরকারি গ্রামে গ্রামে আগুনের হলকায় সরে গেছে
মৃত্যুর বাইপাসে ধাবমান আর একখানি তরল হৃদয়!