পুলিৎজার জয়ী ঔপন্যাসিক জেইন অ্যান ফিলিপসের সাক্ষাৎকার

অ+ অ-

 

|| জেইন অ্যান ফিলিপস ||

জেইন অ্যান ফিলিপস একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। তার সর্বশেষ উপন্যাস নাইট ওয়াচ ২০২৪ সালে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হয়। প্রথম ছোট গল্পগ্রন্থ ব্ল্যাক টিকিটস ১৯৮০ সালে আমেরিকান একাডেমি অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব র্আটস এন্ড লেটার প্রবর্তিত স্যু কাউফম্যান পুরস্কার লাভ করে। গ্রন্থটিকে পরবর্তীকালে আমেরিকান ছোটগল্পের ক্লাসিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৯ সালে বহুল সমাদৃত উপন্যাস লার্ক অ্যান্ড টারমাইট আমেরিকার দুটি বিখ্যাত কথাসাহিত্য পুরস্কার ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড এবং ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ডে একই সঙ্গে চূড়ান্ত তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হয় এবং হার্টল্যান্ড পুরস্কার লাভ করে। আমেরিকান তুখোড় সাহিত্য সমালোচক মিচিকো কাকুতানি এই উপন্যাসের রচনাশৈলীতে ফকনার, উলফ, কেরোয়াক, ম্যাককুলার ও মাইকেল হারের প্রতিধ্বনি আর আবছায়া দেখতে পান। অধিকাংশ উপন্যাসের পটভূমি মূলত তার জন্মভূমি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার জমিন এবং ইতিহাসকে ভিত্তি করে। আখ্যানভূমি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে হলেও কিন্তু তাদের ভাবনা ও সংলাপ বাস্তবতা এবং কল্পনার সুনিপুণ মিশ্রণ এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তার লেখা সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ সাবলীল গদ্যের বর্ণনাভঙ্গি পাঠক ও সমালোচককে সমানভাবে আকৃষ্ট করে। ২০১৩ সালে রচিত কোয়াইট ডেল ফিলিপসের বহুল আলোচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও উপন্যাসটি কিছুটা জটিল প্রকৃতির, তবে একই সঙ্গে সত্য ও কল্পনার এক মনোমুগ্ধকর মিথষ্ক্রিয়া। একজন প্রতারক ও ঠগের বাস্তব জীবনের ভয়াবহ অপরাধের কাহিনি, যার স্মৃতি তাকে হিংস্র শিকারীর মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই সত্যের সঙ্গে সাহিত্যিক কল্পনা মিশিয়ে লেখক মানব জীবনের হতাশা ও একাকীত্বের এক করুণ আখ্যান সৃষ্টি করেছেন। 

সম্পাদকীয় নোট

মার্কিন নামজাদা ঔপন্যাসিক জেইন অ্যান ফিলিপসের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় Los Angeles Review of Books-এর ২০১৩ সালের অক্টোবর সংখ্যায়। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন আরেক খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক ম্যারি অ্যান কল্টন। সম্প্রতি প্রতিধ্বনিকে Los Angeles Review of Books সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ প্রকাশের অনুমতি দেয়। আমরা Los Angeles Review of Books-এর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। প্রতিধ্বনির জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ।  

 

জীবনের কিছু সুন্দর অর্থ থাকে যা আমাদের আয়ুষ্কালের সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যাবার নয়, কোন ট্র্যাজেডি দিয়ে নিঃশেষ হবার নয়। আমার কাছে ওই জীবনই বেদনার যে জীবনকে আমরা কখনো জানতে পারি না। যে জীবনকে আমরা কখনো মনে রাখি না।

ম্যারি অ্যান কল্টন: কোয়াইট ডেল লেখার ক্ষেত্রে আপনার আত্মস্বর কতটুকু অনুপ্রাণিত করেছে?

জেইন অ্যান ফিলিপস: আমি ছোটবেলা থেকেই কোয়াইট ডেল-এর কাহিনি কিছুটা পুরাণকথা এবং কিছুটা ভৌতিক গল্প হিসাবেই জেনে এসেছি। যে স্থানে এই ঘটনা ঘটেছিল, এখন তার সামান্য চিহ্নমাত্র আর নেই। যদিও গ্রামের মেঠো পথ আর বিচ্ছিন্ন কিছু পল্লী এখনো আছে। আমার মায়ের বলা গল্পটা এই কাহিনিকে অনেক ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আগস্টের এক তপ্ত দুপুরে মা আমার নানীমার হাত ধরে বলেছিল, আমি ধুলোমাখা পথে হাঁটছিলাম। যতদূর চোখ যায় শুধু চকচক করা কুচকুচে কালো গাড়ির লাইন দেখছিলাম। শুধু গাড়ির দরজা ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সবাই যেন মার্ডার গ্যারেজেরস্মৃতি ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আমার মার তখন ছয় বছর বয়স। একবার মনে হলো কি, মা যেন আমার সঙ্গে তার নিজের ঘটে যাওয়া জীবনস্মৃতি তুলে ধরেছেন। হাজার হাজার মানুষ ভোরে রাস্তায় হাঁটছিল। খবরের কাগজে মুখরোচক গল্প পড়ে যাচ্ছিল। তারা সবাই বুঝতে পারছিল যে তাদের খুব কাছেই ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে। যে সব নারী সামাজিক নিরাপত্তার বাইরে অবস্থান করে, যারা স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশের করে বা ঝুঁকি নেয়। এই অপরাধের ঘটনাটি তাদের জন্য একটা চরম শিক্ষা ও সতর্ক সংকেত। উপন্যাসে এমিলি থর্নহিল ঠিক এই বিশ্বাস বা সংস্কারের মুখোমুখি হয়। নারী ও শিশুর প্রতি অপরাধ এখনো দুর্বলের প্রতি সবলের শক্তি প্রয়োগকেই নির্দেশ করে।

ম্যারি অ্যান কল্টন: হেনরি পাওয়ারস সত্যি করে নিচের বিজ্ঞাপনটি ছেপেছিলেন:

ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন: সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কলেজ ডিগ্রি। ১,৫০,০০০/= ডলার বা তারও বেশি মূল্যের সঞ্চিত সম্পদ আছে। মাসিক আয় ৪০০ থেকে ৩০০০/= ডলার পর্যন্ত []। আমার ব্যবসায়ের ধরনের জন্য আমি অতটা সামাজিক সম্পর্কে থাকতে পারি না। যার কারণে এখন পর্যন্ত আমি আমার সঙ্গে মানানসই কোন নারীর দেখা পাই নাই। যেহেতু আমার সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মধ্য-পশ্চিমের প্রদেশগুলোতে, সেহেতু আমি বিয়ের পর সেখানেই পাকাপাকিভাবে থাকতে চাচ্ছি। আমি একজন অ্যাল্ক ও ম্যাসন। সুন্দর করে সাজানো ১০ রুমের একটি বাড়ি আছে। আমার স্ত্রীর একটি প্রাইভেট গাড়ি থাকবে ও হাত খরচের জন্য যথেষ্ট অর্থও পাবে। সারাদিন মজা করা ছাড়া অন্য কোন কাজই করতে হবে না। কিন্ত তাকে অবশ্যই স্বামীভক্ত ও মনোগ্যামি হতে হবে।

কর্নেলিয়াস ও. পিয়ারসন, পি.ও.বক্স ২২৭, ক্লার্কসবার্গ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া।

এটা ভেবেই অবাক হই যে, ১৯৩০ দশকের নারীরা এমন বিজ্ঞাপনের উত্তর দিত। যেন চরম অনিশ্চিয়তার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে এমনটা করাই খুব মহৎ কোনো কাজ। যখন কোয়াইট ডেল লেখার জন্য গবেষণা করছিলেন, তখন কি বুঝতে পেরেছিলেন যে নারীরা সাধারণত নিজেদের একাকীত্বর জন্য এমনটা করে?  নাকি তাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকে?

জেইন অ্যান ফিলিপস: যখন আমি ১৯৩০-এর দশক নিয়ে গবেষণা করছিলাম, তখন একট ব্যাপার আমার কাছে খুব পরিস্কার ছিল। ১৯৩০-এর দশক ছিল এখনকার সময় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সময়। পাওয়ারস যে ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণ বিরল। আজকের দিনে টেলিভিশনে অসংখ্য প্রোগ্রাম সিরিয়াল কিলিংয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ ও প্রচার করা হচ্ছে, যা আবার অনেক জনপ্রিয়ও। আমরা তো প্রায়ই ম্যাস শুটিং, স্কুল শুটিংয়ের খবর শুনতে পাই। যদিও ওই লোকগুলোকে অসভ্য, বর্বর বলে মনে করা হয় বা লুচ্চা পুরুষ মানুষের মতো অনৈতিক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করে। কিন্তু এটা ঠিক প্রমাণিত নয় বা সবার কাছে সন্দেহজনক মনে হতো না যে শূন্যতায় ভরা হৃদয়ের ওই লেখাগুলো একজন সাইকোপ্যাথ লোকের। মধ্যবয়সী পুরুষের বিবাহ ঘটানোর জন্য ১৯৩০-এর দশক ছিল এক উর্বর সময়। আর পুরুষগুলো যত সম্পদশালী বা সমাজে সম্মানিত হবে বিয়ে করার সফলতা তত নিশ্চিত ছিল। তখনকার সময় এখনকার মতো ডেটিং করতে হতো না। বিয়ে ছিল একমাত্র লক্ষ্য। প্রণয়ালাপ যা হতো তা প্রেমপত্রের মাধ্যমেই শেষ করতো। আয়ুষ্কাল ছিল খুবই অল্প। ৪৫ বছর বয়সে বিধবা হওয়াটা ছিল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার।

আমি মনে করি কোয়াইট ডেল উপন্যাসটি আস্থা ও প্রেরণার কথা বলে, তার অতীত, দাম্পত্য জীবনে তার বিচ্ছিন্নতার কথা বলে, সমাজের প্রান্তদেশে তার অবস্থান কোথায়? সেখানে সে কতটা নাজুক অবস্থায় আছে তার বাস্তবচিত্রকে অঙ্কিত করে। যদিও সে কর্নেলিয়াস পিয়ারসনের দৈহিক উচ্চতা বা তার সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণকে সন্দেহের চোখে দেখে, কিন্তু এই অপরাধকে তখনকার সময়ে সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে তেমন মন্দ চোখে দেখা হতো না, যেমনটা এখনকার সময়ে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দেখানো হয়। পাওয়ারস বা পিয়ারসনের অপরাধের দক্ষতাকে তেমন খাটো করে দেখা ঠিক হবে না।

তারা তখনকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচরণবিধি ও পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখেই আচরণ করেছে। সমাজ স্বীকৃত ভদ্র ও সম্মানিত পুরুষের মতোই হাজির হতেন। বাগদত্তাকে ততটুকু সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখতেন যতক্ষণ পর্যন্ত নারীটি তাকে বিয়ের জন্য উদগ্রীব না হয়ে উঠতো। অথবা এটাও ভেবে নিত যে, যদি বিয়েটা না হয় তাহলে সে জীবনের সকল সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত হবে। উপন্যাসে এমিলি যেমনটা বলেছিলেন, সে হচ্ছে একজন নিখুঁত অভিনেতা যার সঙ্গে নারীরা নির্দ্বিধায় দূরে কোথাও ঘুরতে চলে যেতে পারে। ততক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে মন্দ কিছুর ছিটেফোঁটা দেখতে পায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত খুব দেরি না হয়ে যায়। অ্যাইখারের সন্তানদের সঙ্গে যদি তার দৃশ্যগুলো বিবেচনা করি, তাহলে আমরা দেখবো সে কতটা মন্ত্রমুগ্ধকর।

ম্যারি অ্যান কল্টন: অ্যানাবেল, হার্ট ও গ্রেথের সঙ্গে কর্নেলিয়াসের ঘটনাগুলো মনে হয় কোয়াইট ডেল-এর সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অংশ। এ রকম দৃশ্য লেখা যেমন কঠিন তেমনি নির্মোহভাবে পড়াটাও বেদনার।

জেইন অ্যান ফিলিপস: উপন্যাসটি পাঠকের মনের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ ও ভয়ের অনুভূতি জাগাতে সক্ষম। আমরা মনে করিআমরা নিশ্চিতভাবেই গল্পের শেষটা জানি। কিন্তু কোয়াইট ডেল গল্পের সমাপ্তি নয় বরং আমাদের জানার সীমানা পেরিয়ে একজন মানুষ কিভাবে আরেকজন মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকিএমন গভীর দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে ভাবায়। উপন্যাসটি লেখার বহু আগে থেকেই আমি অ্যাইখারের সন্তানদের সর্ম্পকে জানতাম। তাদের সব হারানোর দুঃখগাথা, যেমনটা অসংখ্য শিশু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের পরিস্থিতিতে সময়ের অতলে হারিয়ে যায়। যাই হোক, যখনই আমি তাদের নিয়ে লিখা শুরু করলাম। তখন থেকেই ওই শিশুরা আমার কাছে জীবন্ত আর বাস্তব বলে মনে হতে লাগলো। মনে হলোউপন্যাসটিতে তাদের আমি বাঁচিয়ে তুললাম। আমি তাদের জীবনের প্রাচুর্য আর মহিমার কথা লিখতে চেয়েছি। তাদের শক্তি আর সুন্দর সময়ের কথা বলতে চেয়েছি।

জীবনের কিছু সুন্দর অর্থ থাকে যা আমাদের আয়ুষ্কালের সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যাবার নয়, কোন ট্র্যাজেডি দিয়ে নিঃশেষ হবার নয়। আমার কাছে ওই জীবনই বেদনার যে জীবনকে আমরা কখনো জানতে পারি না। যে জীবনকে আমরা কখনো মনে রাখি না। তাইতো অ্যানাবেলের বাস্তবতা আরো বহুমাত্রিক মনে হয়যা আমাদেরকে ১৯৩১ সালের দুনিয়ার বাস্তবতার বাইরে নিয়ে যেতে সক্ষম। তার মন হয়তো পাওয়ারসের অন্ধকার দিককে ধারণ করতে পারে না। কিন্তু সে ঠিকই অবারিত মাঠের শব্দকে ধরতে পারে, দিগন্তহীন প্রান্তরকে আঁকড়ে ধরতে পারে যেখানে সে আবার তার প্রিয় দাদীর সঙ্গে মিলিত হবে। যেমনটা আমি লিখেছি, হাজারো শব্দ-সুরে ও জীব-প্রানে ভরা তৃণভূমি। বাতাসের শো শো আওয়াজের মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকারা ডাকছে [] আর পাখিগুলো একমনে সুর করে গান গাইছে।

উপন্যাসের শেষের দিকে কোয়াইট ডেল-এর সাহিত্যিক সৌন্দর্য পাওয়ারসের কাছ থেকে সবকিছু ফিরিয়ে নেয়, বলা যায় তাকে যেন ধুলোয় মিশিয়ে ফেলে। শিশুদের সঙ্গে কর্নেলিয়াসের দৃশ্যগুলো লেখা আমার জন্য একটু কঠিন ছিল বৈকি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমি বোধ হয় কর্নেলিয়াসকে তার মজ্জা থেকে জানি। অনেকটাই মানুষের বিপরীত সত্তা হিসাবে। পাওয়ারসের সঙ্গে যুগলবন্দী তাকে যেন আরো শক্তিমান ও ধারালো করে তুলেছিল। তার আলতো ছোঁয়াও যেন ঠিক এক সম্মোহনকারীর মতো। তার গভীর নীল চোখ মন্ত্রমুগ্ধময়, যেন বিবশ করে ফেলবে। তারপরও, অ্যানাবেলের নিজস্ব কিছু শক্তি আছে। সে মনে করতো যখন কর্নোলিয়াস শিশুদের ফেরৎ নিতে আসে আর বলে যে তার মা তাদের নিতে এসেছে। সে তার মায়ের গায়ের ঘ্রাণ শুকতে থাকে, প্রথমে তার নিচে, পরে তার উপরে এবং তার সামনে যা কিছু আছে []। সে জানতো তার মায়ের ঘ্রাণের একটা ওজন আছে, যেমনটা বাতাসেরও ওজন আছে। অথবা একটা শক্তি আছে যা কোন কিছুকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে পারে। এটা এমন মনে হচ্ছিল যে, অ্যানাবেল তার নিষ্পাপ দুরদর্শিতা দিয়ে তার নিজের রক্ষাকর্তা ও বীরপুরুষদের ডেকে এনেছিল। এমিলি অ্যানাবেল সম্পর্কে অতটা জানতো না। কিন্তু পাঠককুল ঠিকই এমিলির ওপর অ্যানাবেলের প্রভাবকে আচঁ করতে পেরেছে। পরোক্ষ, নিগূঢ়, নির্দিষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত করতে অক্ষম একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব। রূপকার্থে বলা যায়প্রিয়জনের শরীর থেকে ভেসে আসা হালকা মিহি সুগন্ধি, যে কিনা কিছুক্ষণ আগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, হয়তো বা আর ফিরবে না।

ম্যারি অ্যান কল্টন: সত্য ঘটনা অবলম্বনে সৃষ্ট অপরাধমূলক আখ্যানে কল্পসৃষ্ট চরিত্রগুলো যুক্ত করার পিছনে আপনার কী উদ্দেশ্য থাকে?

জেইন অ্যান ফিলিপস: শুরু থেকেই আমি কোয়াইট ডেল-কে অ্যানাবেলের উপন্যাস বলে মনে করি। ছেলেবেলা থেকে হ্যানস ক্রিসশিয়ান অ্যান্ডারসনের দ্য লিটল ম্যাচ গার্ল আমার প্রিয় রূপকথার গল্প। এই গল্পের মতোই আমি অ্যানাবেলের সঙ্গে ওর দাদী লাভিনিয়ার সম্পর্কের প্যাটার্ন আঁকতে চেয়েছি। লাভিনিয়ার মৃত্যু যেন আস্তার বাচ্চাদের প্রতিরক্ষার সমাপ্তির মতো। বলা যায়, অ্যানাবেলের জন্য এই মৃত্যু আরো বৃহৎ ট্র্যাজিডি। কেননা, অ্যানাবেলের হৃদয়ে দুনিয়া সম্পর্কে যে বোঝাপড়ার কলাকৌশল জমা আছে, যে নাট্যশৈলী, অঙ্কনশিল্প ও রূপকল্পবিদ্যার মনন আছে তার প্রায় সবই লাভিনিয়ার উৎসাহে বিকাশ লাভ করেছে। পাঠকরা আস্তে আস্তে সহজে বুঝতে পারে যে, অ্যানাবেল শুধুমাত্র খেয়ালি মনের অধিকারী নয়, বরং সে সত্য করেই দুনিয়ার প্রচলিত বৃত্তের বাইরের দৃশ্যাবলী দেখতে পায়। ঠিক ঠিক বুঝতে পারে, কী ঘটতে চলেছে। লাভিনিয়া ছিল তার সত্যিকারের বন্ধু। অ্যানাবেলের তন্ময়তার সঙ্গে দাদীর অবিরাম প্রভাব আস্তার কাছে খুবই একঘেঁয়ে লাগে।

এরকম আরো কিছু কাল্পনিক চরিত্র আছে। যা এখানে না বলাই ভালো। কেননা, অনেক পাঠক আছেন যারা উপন্যাসটি পড়ার পূর্বেই এই সাক্ষাৎকারটি পড়ে ফেলতে পারে। এই উপন্যাসে এমন অনেক বাঁক আছে যেখানে শুভবোধ সবসবময় অন্ধকার ও দুর্দশার পাশাপাশি অবস্থান করে। মানুষ সবসময় এই মন্দের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। হস্তক্ষেপ করার আকাঙ্ক্ষা করে। অভিলিপ্সা, প্রচেষ্টা ও ভালোবাসা মানব-ট্র্যাজিডির পথ রুদ্ধ করে দেয়। কেউ কেউ হারিয়ে যায়। কেউ কেউ এই নিয়তির হাত থেকে রক্ষা পায়। নিজেকে ও অন্যকে রক্ষায় ব্রত পালন করে। এটাকে কি বলবো বলোশুধুই একটা ঘটনা, দৈবঘটনা, নিয়তি না ভাগ্যের খেলা? এটা হয়তো আরেকটি প্রশ্ন যেটা নিয়ে আপনাকে খুব সাবধানে পদক্ষেপ নিতে হবে। আপনি কি মনে করেন, লুয়েলা এবং ইভা বেলের প্রকাশিত অবয়বের চেয়ে আমরা তাদের ভেতরের রূপকে বেশি জানি। কেমন হতো যদি তারা এখনো বেঁচে থাকত। মনে হচ্ছে, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে অর্থের একটা যোগসাজশ আছে।

পাওয়ারসের গ্রেফতারের পরপরই একটা গোপনীয় তথ্য আমজনতাকে জানানোর জন্য প্রেসের কাছে ফাঁস করে দেয়া হয়। বিয়ের ঠিক পরপরই পাওয়ারস তার নববধূ লুয়েলার নামে একটা উইল করে রেখেছিল। আদতে লুয়েলা যেন ঠিক এমনই একটা উইল পাওয়ারসের জন্য করে। তার জন্য এটা একটা নীল নকশা ছিল। যখন দুই বোনের মা হঠাৎ করে অজ্ঞাত কারণে মারা যায় তখন স্বভাবতই লুয়েলা ও ইভা বেলে উত্তরাধিকার হিসাবে তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়। দু’বোন কিন্তু উইলে সাইন করেনি। সম্ভবত ইভা বেলে সাইন করতে অস্বীকার করেছিল (পাওয়ারসও বিয়ের কারণে বা প্রতারণা করার পরও তিল পরিমাণ কিছু পায়নি) এবং উইলটিও সত্যায়িত করা হয়নি। পাওয়ারস নিজেই এই বিষয় ফাঁস করে দেয় যাতে মনে হয় বোনেরা তার প্রতারণার শিকার। উপন্যাসে এমিলি যেমনটা আন্দাজ করে যে, বোনেরা পাওয়ারসের ভ্রমণ, এমনকি কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরপর নগদ অর্থ ও দামী জিনিসপত্রের ট্রাঙ্কের আনাগোনাকে খুব সানন্দে সহজভাবেই নিয়েছে। আর এসব কিছুই পাওয়ারসের অপরাধকে আড়াল করার জন্য খুব সুনিপুণভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। সম্ভবত, পাওয়ারসের নিজের কিছু ভার্সনকেও সামনে নিয়ে আসে। বিশেষ করে বিভিন্ন ব্যক্তির আদলে পাওয়ারস যেভাবে ছলনা করে আসছে। তারা হয়তোবা জানে না যে কে, কখন বা কিভাবে সে তার এসব অশুভ উদ্দেশ্য পূরণ করেছে? তবে বলা যায়, আইকারের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সবাই মিলে তাকে তার উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করতে সহায়তা করেছে। এমিলি বিচারের পর যা বলেছে তা এক নতুন আবিষ্কারের দিকে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে পাওয়ারসের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। এটা খুব পরিষ্কার যে পাওয়ারস সম্পর্কে সত্য উদঘাটন করার জন্য অবিচল অনুসন্ধান শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাঁচানো নয়। বরং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা ও যেসকল হতভাগা পাওয়ারসের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে শোষণের শিকার হচ্ছিল তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা।

আমার কাছে লুয়েলা পাওয়ারসের মৃত্যু সনদপত্র আছে। সে পঞ্চাশের দশকের দিকে ক্লার্কসবাগে মৃত্যু বরণ করেছিল। মৃত্যুর কারণ হিসাবে অপুষ্টি ও পারকিনসন্স সিনড্রোম-এর কথা উল্লেখ করা আছে। যে কেউ এই দৃশ্যটা কল্পনা করতেই পারে যে দুই বোন নিভৃতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছে। এক সময় যা পাওয়ারসের মুদিখানা ছিল, তার জানালা দিয়ে বাইরে আনমনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

ম্যারি অ্যান কল্টন: ঘোরের মধ্যে থাকা বিষয়টি কোয়াইট ডেল-এর যেকোন মূখ্য চরিত্র থেকে বেশি শক্ত জায়গা দখল করে আছে। আপনি কি এই ঘটনা নিয়ে আগে থেকেই কোন রকম পূর্বানুমান বা বদ্ধমূল ধারণায় আবদ্ধ ছিলেন? যদি তাই হয় তবে ঠিক এই সময়ে এসে এই গল্পটি কেন লিখলেন?

জেইন অ্যান ফিলিপস: আবিষ্ট থাকা কোন কিছুতে পূর্ণ মনোযোগী হওয়ার একটা ছাঁচ হিসাবে কাজ করতে পারে। আবেশের সঙ্গে যদি প্রত্যক্ষণ ও সহমর্মিতা যোগ করা যায় তাহলে তা ধ্যানের একটা আকার হিসাবে কাজ করতে পারে। এমিলি পাওয়ারসকে থামাতে, সত্যকে সকলের সামনে নিয়ে আসতে পূর্ণ নিবিষ্টতা নিয়ে কাজ করেছে। সে একজন সাংবাদিক হিসাবে যে কোন ঘটনার সারফেইসকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে অভ্যস্থ। এই কাজ করতে গিয়ে সে মাঝে মাঝে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কেননা সে সব সময় তার ভেতরের আবেগ ও সহজাত প্রবৃত্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে যা অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়।

আমার কথাই যদি বলি, আমিও আমার উপন্যাসগুলোর দুনিয়া নিয়ে সমানভাবে আবিষ্ট হয়ে থাকি। উপন্যাসের দুনিয়ায় আমি ঠিক তেমনভাবেই জীবন যাপন করি যেমনটা আমি আমার নিজের বাস্তব দুনিয়ায় বাঁচি। কোয়াইট ডেল-এর পাশাপাশি অবস্থিত বহুপৃথিবী, সম্ভবত একটা রূপক মাত্র। লেখকরা ঠিক যেমনটা দুনিয়াকে প্রত্যক্ষণ করে সেরকমবহুস্তর বিশিষ্ট, সমকেন্দ্রিক বৃত্তের সমাহার যা আমাদেরকে দুনিয়া ও এর বাস্তবতা সর্ম্পকে একটি গভীরতর উপলদ্ধি যোগায়। যদি লেখার কালের কথা বলি, তাহলে বলবো এই উপন্যাস লেখার আগে আমার ভেতর আরো কয়েকটি উপন্যাস লেখার তাড়না ছিল। আমি আমার লেখালেখিকে একটা চলমান প্রক্রিয়া মনে করি। লেখালেখিতেই আমি আমার অনুসন্ধান চালিয়ে যাই। আমার সকল সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের অভিজ্ঞতা লাভ করি। সময়ের যুগপৎকে জানতে পারি। দুনিয়ার সবকিছুর নিজস্ব অর্থগুলোকে বুঝতে পারি। আখ্যানের চক্রে লেখক যে মুক্তির স্বাদ উপস্থাপন করে তা জানতে পারি।

ম্যারি অ্যান কল্টন: এই উপন্যাসের সমাপ্তি কি আপনাকে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আবেগীয় প্রশান্তি এনে দেয়?

জেইন অ্যান ফিলিপস: ভালোবাসা মৃত্যুকে পরাজিত করতে পারে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এই গল্পের একটি ভার্সন কোয়াইট ডেল উপন্যাসে এখনো বেঁচে আছে, হয়তো আগামীতেও বেঁচে থাকবে। আমার মনে হয় গল্পের শিশুরা যে সব পাঠককুলের মনে সমবেদনা জাগাতে পেরেছে তাদের মাঝে এখনো শিশুরা বেঁচে আছে। উপন্যাসটির আখ্যানচক্র ও উদ্দেশ্যই হলো সকল ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রে পাঠককে সবেগে টেনে নিয়ে যাওয়া। পুরাতন সময়ের সঙ্গে আমাদের সময়ের একটা চটকদার অমিল যেমন আছে তেমনি ভূতুড়ে মিলও রয়েছে। আমাদের কালের আবর্তে দাঁড় করিয়ে দেয়: ট্র্যাজিডিকে বেশ ভালোভাবেই আগাম আঁচ করা যায়। দুনিয়ার সব উপাদানের ভারসাম্য রাখা যায়। সকল ঘটনায় শুভবোধের শক্তির মাঝে আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব থেকে মন্দ অভিপ্রায় সব কিছুই যেন জড়িয়ে আছে। যে গল্প ও রূপকথার গল্পগুলো অ্যানাবেলের বাস্তবতাকে জানান দেয় সেগুলো এমনভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায় যেমনটা অ্যানাবেলের অঙ্কিত ফিগারগুলো ক্যানভাসে উড়ে বেড়ায়।

অ্যানাবেল চেতনার যে জায়গাতে বাস করে—“তা তার চিন্তার জায়গার মধ্যে এক বিশাল দূরত্ব বা শূন্যতা সৃষ্টি করে”—আর এই দূরত্ব তার কল্পিত জীবনের প্রতিরূপ হিসাবেই আর্বিভূত হয়। আমি মনে করি, পাঠকগণ উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে এত কাছ থেকে জানার পর জীবন সম্পর্কে এক ধরনের মুক্তি, পূর্ণতা এবং গভীর সুখ অনুভব করে, হয় তা আলোতে না হয় আঁধারে।

 

ম্যারি অ্যান কল্টন

ম্যারি অ্যান কল্টনের গল্প ও অন্যান্য লেখা লস্ট চিলড্রেন চ্যারিটি এন্থোলজি, থ্রাইস ফিকশন ও কননোটেশন প্রেসসহ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার লেখা গল্প এ পারফেক্ট ফ্যামিলি হাউজ দ্য গ্লাস ওমেন প্রাইজে সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। তার গৃহীত সাক্ষাৎকার লস এ্যাঞ্জেলস রিভিউ অব বুকস, হার সার্কেল জাইন, হেরাল্ড ডি প্যারিস, ওয়ার্ড রায়টপ্রাইম নাম্বারসহ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

Published & Copyright © This interview originally appeared in the Los Angeles Review of Books on October 11, 2013.