রাতের দ্বিতীয় প্রহরে
রাত তার প্রথম প্রহর পার হয়ে দ্বিতীয়তে এসে পড়েছে। আকাশে প্রায় পূর্ণ চাঁদ, যেন অশরীরী কেউ তার জ্বলজ্বলে একটি চোখ মেলে পৃথিবীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কেউ হয়ত আগুনে পুড়ে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া চোখা মাথা লোহার শিক দিয়ে ফুড়ে অশরীরীটির আরেকটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। তাই সে এখন বাকী থাকা একটি চোখেই পৃথিবীর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, জেগে থাকা অবস্থায় মুহূর্তের জন্যও পলক ফেলে না।
আকাশের গায়ে সাদা-সাদা বিভিন্ন আকৃতির ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ পাড়ার দুষ্ট ছেলে-মেয়েদের মত অবিরাম ছুটোছুটি করছে। অশরীরীটি তার একটিমাত্র জ্বলজ্বলে চোখে কখনও মেঘের ভেতর দিয়ে, কখনও বা মেঘেদের ফাঁক দিয়ে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে সবকিছু দেখে নেয়ার চেষ্টায় রত। মেঘের ভেতর দিয়ে তার দৃষ্টি ঝাপসা ও মেঘেদের ফাঁকে তার দৃষ্টি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠে, সমানুপাতে পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টিকেও সে দেয় বদলে।
পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে রাতের বিস্তীর্ণ আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, মেঘেদের রূপ ধরে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পরিবর্তিত হতে থাকা নানা ধরনের বিন্যাস নিয়ে অশরীরীটির দৃষ্টি পথে ভিড় করে আছে। আর অশরীরীটি বাস্তবসম্মতভাবে ছুটোছুটি করছে যাতে করে পৃথিবীর কোন ঘটনাই তার নজর এড়িয়ে না যায়। নাকি পৃথিবীর একপ্রান্তে ঘনসন্নিবিষ্ট ভাবে গড়ে উঠা ছোট একটি গ্রামের ভেতরে আনকোরা ঢেউটিনের তৈরি দো-চালা ঘরটির পাশে যে ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে তা স্পষ্টভাবে দেখার জন্য অশরীরীটি এমন অস্থির হয়ে আছে। তা না হলে, কই তার মধ্যে কিছুক্ষণ আগেও তো এত তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি!
অশরীরীটি কি তার একটিমাত্র জ্বলজ্বলে চোখ মেলে, কখনও কিছুটা স্পষ্ট ও মাঝে মাঝে ঝাপসা দৃষ্টিতে সবকিছুই কি পুরোপুরি দেখতে পায়?
মাতাব্বরের জোয়ান ছেলে সোহেল, গ্রামটির শেষ মাথায় অবস্থিত বড় বাড়িটি থেকে বের হয়ে কোন ঘরের পিছন পাশ দিয়ে, কোন ঘরের সামনে দিয়ে, কারো বাড়ির উঠানের উপর দিয়ে, নানা ধরনের চিপা অলিগলি পেরিয়ে এমন জায়গায় চলে এসেছে; যেখান থেকে দো-চালা টিনের ঘরটি চাঁদের আলোয় আবছাভাবে চোখে পড়ে। আসার পথে নলকূপের পানি গড়িয়ে চলা ড্রেনের মধ্যে তার একটি পা ডুবে গিয়েছিল। সাদা মেঘের আড়ালে পড়ে চাঁদের আলো ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল বলেই যে তার পা ড্রেনের কাদার মধ্যে দেবে গিয়েছিল তা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। কারণ সাদা মেঘেদের ফাঁকফোকর দিয়ে পৃথিবীর সাথে লুকোচুরি খেলা চাঁদের আলো তার চলার পথের একমাত্র অবলম্বন ছিল না। মোবাইল ফোনের টর্চের মৃদু আলোও পায়ের সামনে মাটিতে পড়ে তার চলার গতির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছিল। হঠাৎ তার মন গ্রামের ভেতরকার এই অলিগলি পথ ছেড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জটিল ঘোরানো-প্যাঁচানো পথে ছুটে গিয়েছিল বলেই তার পা ড্রেনের মধ্যে হড়কে গিয়েছে। গ্রামের ভেতরকার বাকী পথটুকুতে সে তার পায়ের দিকে একবারও তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। শুধুমাত্র লুঙ্গির সামনের অংশটাকে হাতের মুঠিতে কুঁচিয়ে ধরে উপরের দিকে টেনে তুলে সামনের দিকে পা চালিয়েছে।
এখানে এসেই কেবলমাত্র সে তার কাঁদা লেগে যাওয়া পায়ের দিকে মনযোগ দিল। লুঙ্গির নিচের অংশ দুই হাতে কুঁচিয়ে টেনে তুলে থাইয়ের চিপায় রেখে কিছুটা উবু হয়ে মোবাইল ফোনের টর্চের আলো ফেলে ভালো করে চেয়ে দেখল—হাঁটুর খানিকটা নীচ থেকে একটি পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আছে, তবে অপর পায়ে কাদামাখা জলের সামান্য একটু ছিটাও লাগেনি। পায়ের পাতা ও স্যান্ডেলের মাঝখান দিয়ে কাঁদা ঢুকে যাওয়ার ফলে ওখানটা বেশ পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। এজন্যে বাকি রাস্তাটুকু হেঁটে আসতে তাকে বেশ কষ্ট করে আসতে হয়েছে এবং চটচট করতে থাকা একধরনের শব্দও তাকে কম বিরক্ত করেনি। পায়ে কাদা লাগার জন্য নয় বরঞ্চ কাদামাখা পা-টি দেখে ফেলার ফলেই তার পুরো শরীর এবার ঘিনঘিন করে উঠল। নোংরা পা-টা ধুতে হলে তাকে এখন এই বাড়ির নলকূপ চাপতে হবে, চাপলেই শব্দ হবে নির্ঘাত। এই মুহূর্তে কোন ধরনের শব্দ তৈরি করা নিরাপদ হবে না, তার চেয়ে বরং পা টা-ই নোংরা থাকুক। সে ভাবল, কাদা মাখা পা থেকে মনযোগ উঠিয়ে নিলে, ধীরে ধীরে শরীরের ঘিনঘিন ভাবটা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে যাবে। পাশের খড়ের গাদায় কাদামাখা পা টা বার কয়েক মুছে নিল শুধু।
তার মোবাইল ফোনটি এখনও চালু আছে—মনে পড়তেই সে খানিকটা চমকে উঠে পিছিয়ে যায়। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে যদিও তার ফোনে কল আসে না, তারপরও সতর্ক থাকার মার নেই। এই অবস্থায় যদি চলে আসে তাহলে বেজে উঠা রিং টোন তার সকল পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারে। সে পায়ের পাতার আঙ্গুলের দিকের অংশে ভর করে উবু হয়ে বসে দুই থাইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় মোবাইল ফোনটি এনে মাইক্রোফোনের উপরে কাভারে যে সরু একফালি ছিদ্র আছে সেখানে তর্জনী রেখে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে পাওয়ার বাটনটি চেপে ধরে। মোবাইল ফোনটি চাপা-কান্নার মত শব্দ করে উঠে, পর্দায় উজ্জ্বল আলোর একটি ঝলকানি দিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এবার মোবাইল ফোনটি বুক পকেটে সিগারেটের প্যাকেটের পাশে রেখে সে উঠে দাঁড়ায়। পায়ের পাতা মাটিতে ফেলার শব্দটুকুও যাতে না হয়—এমনভাবে অতিসতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।
সোহেল নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে দো-চালা ঘরটির বেশ কাছে চলে আসে। ঘরটির সামনে খরখরে মাটির একটি আয়তাকার উঠান। বেশ দীর্ঘ উঠানটির ওপাশে আরেকটি বেশ পুরাতন দো-চালা ঘর; বেড়ার, চালের ঢেউটিনের সমস্ত জায়গাতেই মরিচা ধরা, চাঁদের আলো পড়ে সামান্য একটু অংশও চিকচিক করছে না। বেশ কাছ থেকে তাকিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়—ঘরটা কোন দিকেই সামান্য একটুও হেলে পড়েনি বরঞ্চ তৈরি হওয়ার সময়ের মতই এখনও বুক টান-টান করে দাঁড়িয়ে। তবে একটু দূর থেকে—ছেলেটি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে—তাকালে মনে হয় মরচে ধরা ঢেউটিনের এই দো-চালা ঘরটি যেন সামনের দিকে একটু নুয়ে পড়েছে। এই ঘরটিতে যারা বাস করে, বয়সের ভারে তারা খানিকটা কুঁজো হয়ে গিয়েছে বলেই এরকম ধারণা হয় কি-না কে জানে! আয়তাকার উঠানটির এপাশে-ওপাশে অবস্থিত দো-চালা ঘরদুটো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের আলো লেগে একটি ঝলমল করছে, অন্যটি নিষ্প্রভ। চাঁদের আলোয় ঝলমল করতে থাকা দো-চালা ঘরটিকে সোহেলের কাছে আবেদনময়ী কোন নারী বলে ভ্রম হয়। নারীটি যেন তার পরনের সমস্ত কাপড় খুলে ফেলে সৌষ্ঠব দেহের অপরূপ ভঙ্গিমা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদের সমস্ত আলোকে নিজের দিকে আকর্ষণ করছে।
সোহেল খানিকটা দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। একটি শুকনো পাতার উপর পা পড়লে মচমচ করে শব্দ হয়। পায়ে কাঁটা ফুটেছে এমন ভাব করে সে দাঁড়িয়ে যায়—না, তাকে ধৈর্য হারালে চলবে না, একটু বেসামাল হয়ে পড়ার কারণে তার মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সে আস্তে করে শুকনো পাতাটির উপর থেকে পায়ের পাতা উঠিয়ে নিয়ে সামনে ফেলে। নীচের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে পা টিপে টিপে আবার চলতে শুরু করে। দো-চালা ঘরটির পাশ থেকে হাত বিশেক দূরে একটি সুপারি গাছের আড়ালে এসে দাঁড়ায়। তার সবকিছুই পরিকল্পিত, সুপারিগাছের পাশে দাঁড়ানোটাও। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করতে থাকে। কতক্ষণ করতে হবে কে জানে!
সোহেল মাটিতে তার পায়ের অবস্থান ঠিক রেখে সুপারি গাছের পাশ দিয়ে খানিকটা সামনে ঝুঁকে দো-চালা ঘরটির দিকে তাকায়। সামনের দিকে দরজার পাশে গরাদবিহীন নীল রঙের জানালাটার খানিকটা অংশ সে দেখতে পায়। মুহূর্তেই তার মনে কিঞ্চিত আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠে। সে মৃদু পায়ে সুপারিগাছের আড়াল থেকে সামান্য একটু সরে এলে পুরো জানালাটি তার দৃষ্টি সীমানার অভ্যন্তরে চলে আসে। আশার ঝলকানিটুকু তৎক্ষণাৎ দপ করে নিভে যায়। সে বুঝতে পারে, গরাদহীন জানালাটি ভেতর থেকে হুড়কো এঁটে বন্ধ করে দেয়া। না, আর কোন উপায় নেই, বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া! ঘরের দিকে চোখ রেখেই পিছন দিকে হেঁটে আবার সুপারি গাছে আড়ালে চলে আসে সে।
বেশ কয়েকবার দুপুর বেলায়—পাপিয়াকে সে দেখেছে গরাদহীন জানালার ভেতর দিয়ে মুখ বের করে দাঁড়িয়ে থাকতে। সেসময় তার বুকের ভেতরটা থেমে যেত, ইচ্ছা হতো পাপিয়ার শ্যামল মুখটি দু-হাতে টেনে তার বুকের মধ্যে গুজে দিতে। বুকের ভেতরটা থেমে যাওয়ার কারনে সে নিজেও দাঁড়িয়ে যেত হঠাৎ; হাঁটার গতি থেমে গেছে বুঝতে পেরে দ্রুত পদক্ষেপে সরে এসেছে। মেয়েটা কিন্তু ঘরের ভেতরে কোথাও আড়াল হয়নি এমনকি গোলগাল মুখটি পর্যন্ত জানালা থেকে সরিয়ে নেয়নি।
একদিন, উঠানের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে জানালা দিয়ে একটু ঝুঁকে পাপিয়া তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই ভর দুপুরে গেছিলেন কই?’ মেয়েটির মুখ থেকে আচম্বিতে এই প্রশ্নটা শুনে, সে কোথা থেকে আসছে—তা যেন ভুলে গিয়েছিল। সোহেল তখন ভেবেছিল, পাপিয়ার হয়তো তার প্রতি মন পড়েছে। তার এমন সুঠাম শরীর দেখে মেয়েদের মন পড়তেই পারে—সেসময় এরকমটাই বুঝিয়েছিল নিজেকে। এখন সে বুঝতে পারে, মেয়েটি মোটেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। অনেক বছর বাবার বাড়িতে কাটিয়ে এসে শ্বশুর বাড়ির নতুন আশ্রয়ে বসবাস শুরু করতে চাওয়া মেয়েটির বোধ হয় ইচ্ছা হয়েছিল গ্রামের সকলের সাথেই ভালো সম্পর্ক তৈরি করে নেয়ার। যার ফলেই সোহেলের সাথে ভদ্রতা করে দুটো কথা বলতে চেয়েছিল, এর বেশি নয়। উপযাচক হয়ে মেয়েটির কথা বলায় প্রশ্রয় পাওয়া সোহেল এবার মেয়েটির ঊর্ধ্বাঙ্গের দিকে ভালোমত তাকায়, পুরনো স্নিগ্ধ ভালো লাগা এবার জৈবিক আকর্ষণের তীব্র রূপ ধরে ফিরে আসে তার মধ্যে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মেয়েটির শরীর তার দৃষ্টি পথ আগলে দাঁড়িয়ে আর সকল মেয়ের দেহাবয়বকে আড়াল করে ফেলে।
সেই থেকে গ্রামের পাশের সড়কটি পরিহার করে ভেতরের এই অলিগিলি পথ ধরে তার নিয়মিত যাতায়াত শুরু। এই দিক দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে হেলে পড়া দুপুরে পাপিয়াকে সে দেখেছে—গোসল সেরে ভেজা চুলে উঠানের মাঝখানে পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে ঝুলানো তারে জামা-কাপড় মেলে দিচ্ছে। কখনও বা বিকেল বেলায় দেখতে পেত—পাশের বাড়ির মেয়ে-বৌদের সাথে আড্ডা সেরে বাড়ির দিকে ফিরে আসছে। সোহেলের চোখ দুটি মেয়েটির মুখ পরিক্রমা সেরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গলার নীচের দিকে নেমে আসে। ওড়নায় জড়িয়ে থাকায় স্তনের ভাঁজ পুরোটা চোখে না পড়লেও কল্পনার আলোকরশ্মির সাহায্যে বুকটাকে সে উন্মুক্ত করে ফেলত। সন্ধ্যাবেলায় মাঝে মাঝে মেয়েটিকে দেখতে পেত—দো-চালা ঘরটির পাশে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা গনগনে হেঁশেলের উপর বসান—রান্না হতে থাকা ভাত-তরকারির হাড়ির সামনে হাঁটুর উপর মাথা রেখে নিমগ্ন হয়ে বসে আছে। তখন তার নজর পড়ত মেয়েটির বাহুর দিকে। জামার খাটো হাতাটি উপরের দিকে খানিকটা কুঁচিয়ে উঠে যাওয়ায় বাহুর অনেকটা অংশই নগ্ন হয়ে থাকত। টানটান চামড়ার মজবুত বাঁধনে ফুলে উঠা মাংশগুলো ভেতরে থাকতে পারছে না যেন, সবুজাভ গাঢ় ত্বক ভেদ করে বের হয়ে আসার জন্য অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মাটির ভেতরকার বীজ যেমন তার ভেতরে বড় হয়ে উঠতে থাকা ভ্রূণের চাপে মাটির উপরকার স্তর ফুড়ে উঠতে চায়। মেয়েটির মাংসল বাহু দেখে তার মনের শুকনো কাঠখড়গুলোতে গনগনে হেঁশেলের মত দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠত।
সোহেল সুপারিগাছের পাশে দাঁড়িয়ে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা হেঁশেলটির দিকে নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের ভেতরটা শূন্য ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রার মত ঠাণ্ডা হয়ে উঠে, হেঁশেলটিকে লাল শিখার আগুন জ্বালা অবস্থায় দেখতে চায় সে, পেতে চায় উত্তাপ। সে মাতালের মত টলতে টলতে হেঁশেলের কাছে চলে আসে। মাটিতে পা ফেলার শব্দকে এবার তেমন একটা আমলে নেয় না। হেঁশেলের পাশে উবু হয়ে বসে সার্টের পকেট থেকে বেনসন সিগারেটের প্যাকেটটি বের করে আনে। ভেতরে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা কাঠ-কয়লার আগুন দিয়ে সে সিগারেট ধরিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া টেনে বুকের শীতলতা কমিয়ে আনতে চায়। হাতের দুই আঙ্গুলের চিপায় আধপোড়া সিগারেটটিকে রেখে আবার সুপারিগাছের পাশে চলে আসে সে। হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শূন্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়তে থাকে। কুণ্ডলীটি যেন ইজেল আর ভেতরে ধোঁয়ার চিকন চিকন রেখাগুলো দক্ষ শিল্পীর তুলির আঁচড় নিখুঁতভাবে অক্লান্ত অধ্যবসায়ে আঁকা হতে থাকে পূর্নযৌবনা পাপিয়ার থমথমে শরীরের গড়ন।
পাপিয়া যখন নতুন বউ হয়ে এ গ্রামে ঢোকে তখনই সোহেল তাকে প্রথম দেখতে পায়। এই গ্রামের অন্য অনেকের মত শ্রমিক ভিসায় সৌদি-আরবে থাকা—এই বাড়ির বড় ছেলে রফিক ছয় মাসের জন্য ছুটি কাটাতে এসে বেশ দূরের একটি গ্রাম থেকে জড়ান শাড়ির ভেতর জড়সড় হয়ে থাকা পুতুলের মত পাপিয়াকে বিয়ে করে আনে। মেয়েটির শরীরে তখন যৌবনের রেখা ফুটে উঠতে শুরু করেছে কেবল। শুকিয়ে যাওয়া গভীর নদীতে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে নতুন করে পানির ছুটে আসার মধ্যে যেমন বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে পাড় ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উন্মত্ততার ইঙ্গিত থাকে, কিশোরী মেয়েটির শরীরেও তেমন একটা ইশারা ছিল। ছুটি কাটিয়ে রফিক আবার তার কর্মস্থলে ফিরে গেলে কিশোরী পাপিয়াও চলে যায় তার বাবার বাড়িতে। তবে বিদেশে যাওয়ার আগে রফিক তার পুতুলের মত বউটির শরীরে গর্ভ সঞ্চার করে যায়। দীর্ঘ ছয় বছর পর ছুটি কাঁটাতে আবার দেশে এলে, অনেকদিন ধরে স্বামী-সঙ্গ না পাওয়া মেয়েটি তার পাঁচ বছরের ছেলেটিকে সাথে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে চলে আসে। এখন পাপিয়ার শরীরে পূর্ণ যৌবন যেন জ্বাল দিতে থাকা দুধের মত উপরস্তর ভেদ করে উথলে উঠতে চাইছে।
পাপিয়ার শরীরের কথা মনে পড়তেই হাতের দুই আঙ্গুলের চিপায় পুড়তে থাকা সিগারেটটি মাটিতে খসে পড়ে। স্যান্ডেল দিয়ে পিষে সিগারেটের আগুনটাকে নিভিয়ে ফেলে সে। তবে মেয়েটিকে পূর্ণযৌবনা দেখার পর থেকেই তার ভেতরে কামনার যে আগুন জ্বলছে—অন্য মেয়েদের বিছানায় দাপাদাপি করেও নেভাতে পারে না, বরঞ্চ আগুনের শিখাটি যেন ফনা ধরা সাপের সরু জিহ্বার মত আরো বেশি মাত্রায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। রফিক যখন দেশে ছিল তখন রাতের বেলায়, পাপিয়াকে বিবসনা অবস্থায় নানা ভঙ্গিমায় তার স্বামীর সাথে কল্পনা করে দম আটকে যাওয়ার মত অবস্থা হতো তার। অনেকদিন পরে দেশে আসা রফিকের ছুটির সময়টা হয়তো স্রোতের টানে বয়ে চলা ডিঙ্গি নৌকার মত খুব দ্রুত পার হয়ে গেছে। তবে সোহেলের কাছে এই ছয় মাস সময়টাকে মনে হয়েছে অগুনিত মুহূর্তের সমাহার। তারপর একদিন তার অপেক্ষার বিন্দু বিন্দু মুহূর্তগুলো ফুরিয়ে যায়, সে শুনতে পায় রফিক ছুটি শেষ করে তার কর্মস্থলে ফিরে গিয়েছে। এই আনন্দের সাথে আরেকটি আশঙ্কার ঘোর তার ভেতরে জমা হয়ে উঠে। মেয়েটি শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে আবার তার বাবার বাড়ি চলে যায়নি তো!
রফিকের ফিরে যাবার খবর শুনে সোহেল সাথে সাথে পাপিয়ার শ্বশুর বাড়ির পথে রওনা হয়। সূর্য তখন মধ্যগগণে। সে দেখতে পায় পুরো বাড়িটি খড়খড়ে উঠানের নিঃসঙ্গতায় ধূসর হয়ে উঠছে। লক্ষ লক্ষ সূচ যেন ভেতর থেকে তার শরীরের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে আসতে থাকে। নিজের মনে গজরাতে গজরাতে সে বাড়িটি অতিক্রম করে চলে আসে। কিছুক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মত এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করার পর তার মনে আশার একটি ক্ষীণ আলোক বিন্দু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কি জানি, মেয়েটি হয়ত তার বাপের বাড়িতে ফিরে যায়নি—তখন সে বোধ হয় পাশের বাড়ির মেয়ে-বৌদের সাথে গল্প-গুঁজব করতে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ সে আবার ফিরতি পথ ধরে। বাড়িটির উঠানে পা পড়তেই তার শরীর ফুড়ে বের হতে থাকা সূচগুলোর তীক্ষ্ণ মাথা ভোতা হতে হতে ধীরে ধীর মিলিয়ে যায়। টানটান করে বাঁধা ঝিয়াই তারের উপর ছড়িয়ে দেওয়া মেয়েটির ভেজা সেলোয়ার-কামিজ থেকে পানির ফোটা টপ টপ করে উঠানের শুষ্ক মাটিতে পড়ার সাথে সাথে শোষিত হয়ে যাচ্ছে। তার মনে হল, চুইয়ে চুইয়ে পড়া পানির ফোঁটা যেন প্রচণ্ড পিপাসায় শুকনো খড়ের মত হয়ে যাওয়া তার জিহ্বার উপর একটু একটু করে পড়ছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে গরাদহীন জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখে চৌকির উপর আসন পেতে বসে মেয়েটি তার বাচ্চা ছেলেটিকে শিশু পাঠ পড়াচ্ছে।
সুপারিগাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সোহেলের পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যায়। অপেক্ষার প্রহর যেন হতাশার বালুচর হয়ে তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে থাকে। গাছটা ধরে ধরে সে আস্তে আস্তে বসে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার হুড়কা খোলার খুট শব্দ তার মস্তিষ্কের কোষে মৃদু আঘাত হানে, তৎক্ষণাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে দো-চালা ঘরের দিকে কান রেখে নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, প্রত্যাশা পূরণের আকষ্মিকতায় বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করে। ঐটুকুই মাত্র, তারপর দরজা খোলার ক্যাঁচক্যাঁচ ধরনের শব্দ তরঙ্গ ভেসে আসার সময় সীমাটুকুও পার হয়ে যায় অবলীলায়। দরজা খুলে জ্যোৎস্নার আলোয় বের হয়ে আসে না কোন শ্যামল রঙা মেয়ে। দরজার হুড়কো খোলার এই খুট শব্দটি কি তাহলে বাহির থেকে আসেনি, মস্তিষ্কের কোষাভ্যন্তরে জন্ম নিয়ে সেখানেই মৃদু আঘাত হেনেছে কেবল!
সোহেল আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে শুরু করে, পাপিয়া কি বের হবে? আচ্ছা, আজকে রাতে যদি সে ঘর থেকে বের না হয়, তাহলে! কিসে সে নিশ্চিত হবে? পাপিয়া তো আর তার আহ্বানে বাইরে আসছে না, বের হবে হয়তো প্রকৃতির ডাকে। সোহেলের শুধু এইটুকু মাত্র জানা আছে যে, মেয়েরা সাধারণত রাতের দ্বিতীয় প্রহরে তলপেট ভারী হয়ে গেলে তা খালাস করতে ঘরের বাইরে আসে। তার সন্দেহ ঘন হয়ে উঠতে থাকে; প্রকৃতি যদি আজকে তাকে ডেকে না দেয় কিংবা প্রকৃতির ডাক যদি মৃদু হয়, না সাড়া দিয়ে সে যদি তার বাচ্চা ছেলেটিকে কোলে নিয়ে ঘুমোতেই থাকে, তাহলে! ভিন্ন কোন রাস্তা নেই, আসতেই হবে তাকে এই দো-চালা ঘরটির পাশে, যতদিন পর্যন্ত না পাড় ভেঙ্গে চলা নদীর মত মেয়েটির ভেতর ডুবে গিয়ে শরীর জুড়াতে না পারে।
ধৈর্যের ধূসরভূমিতে স্থির বসে কেটেছে ছয়টি মাস। তারপর কলা-কৌশলের উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলার চেষ্টা দুই-মাস ধরে। বারবার হোঁচট খেয়ে পড়েছে শুধু, এক পদক্ষেপও সামনে এগুনো হয়নি। এরপর অনেক ভেবে, শক্তি খাটানোর এই রাস্তার দিকে মোড় ফেরা। এই পথেই পৌঁছে যাবে তার গন্তব্যে—এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। তার পেটান শরীরের অদম্য শক্তির সাথে মেয়েটির পেরে উঠার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে তার আক্ষেপ শুধু একটাই, মেয়েটি যদি তখনই রাজী হয়ে যেত তাহলে কি তাকে এমন কষ্ট করে চোরের মত ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই সুপারিগাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো! পাপিয়াকে একবার হাতের মুঠোয় পেলে সে সুদে-আসলে এই কষ্টের মাসুল তুলবে—মনে মনে এইরকমই প্রতিজ্ঞা করে সে।
শুধুমাত্র পাপিয়ার ফোন নাম্বারটা পাওয়ার জন্য তাকে কত ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিতে হয়েছে। খুঁজে খুঁজে হয়রান, কারো কাছেই নেই এমনকি যাদের সাথে সে বিকাল বেলায় আড্ডা দেয় তাদের কাছেও না। কে জানে কেন? অবশেষে একটা কৌশলকে মোক্ষমভাবে কাজে লাগিয়ে সে সফলতা পায়, তবে শেষ পর্যন্ত ফোন নাম্বারটি তার কোন কাজে আসেনি। তার মনে পড়ে, ফোনে অপরিচিত একজনের গলা শুনতেই আঁতকে উঠেছিল পাপিয়া। মেয়েটি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিল, তার ফোন নাম্বার চুরি হয়ে গেছে। সোহেল প্রথমে নানা ধরনের কৌশলপূর্ণ কথা-বার্তা বলে পাপিয়ার কাছ ঘেঁষার চেষ্টা করে, মেয়েটি ভদ্রভাবে যতটুকু পারে এড়িয়ে যেতে থাকে। তারপর একদিন সে ধীরে ধীরে তার মনের কথা খুলে বলতে শুরু করে; পাপিয়া রাজি তো হয়নি বরং সোহেল বাড়াবাড়ি শুরু করলে, এসব কথা যাতে সে আর মুখে ‘না’ আনে—এই বলেও তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু এত সহজেই সে তো ছাড়বার পাত্র নয়। আর তার মুখের উপর ‘না’ বলা—এটাকেও সে বরদাশত করতে পারেনি।
গ্রামের ভেতর কোন ব্যাপারে কাউকে তো এখন পর্যন্ত তার মুখের উপর ‘না’ বলতে শোনেনি। গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তিরাও তার সাথে খুব বুঝে-শুনে কথা বলে। ছোটবেলা হতেই পরিবার ও গ্রামের সকলের কাছ থেকেই নির্বাধ প্রশ্রয় পেয়ে আসছে সে। আগে বুঝতে পারত না, গ্রামের সকলের তাকে এমন প্রশ্রয় দেওয়ার কারণটা আসলে কি। কিছুটা বয়স হওয়ার পর বুঝতে পেরেছে, উত্তারধিকার সূত্রে পাওয়া তাদের প্রচুর জমিজিরাত ও গ্রামে তার বাবার প্রচণ্ড দাপট-ই এর কারণ। সকলের কাছে থেকে এমন প্রশ্রয় পেতে পেতে, গ্রামের ভেতরে যা-খুশি তাই করাটা—তার কাছে বিশেষ অধিকারের মত মনে হয়েছে। এটাতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, যেখানে যা-ইচ্ছা করতে পারে না, সেখানে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। এ কারণে তার লেখা-পড়াটাও বেশি দূর গড়াল না। গ্রামের প্রাইমারি শেষ করে বেশ দূরে থানা সদরে হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরপরই বুঝতে পারল, যা-ইচ্ছা তাই করার বিশেষ অধিকারটি এখানে রক্ষিত হচ্ছে না; তার নিজ গ্রামের কয়েকজন বাদে এখানে আর কেউ তাকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। শুধু লেখাপড়ায় যারা ভালো এবং এই এলাকার প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের ছেলেপেলে, তাদেরকেই অন্যান্য ছাত্ররা ও শিক্ষকরা আদর করে ও নানা রকম প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, তবে সেটাও অফুরন্ত নয়। শিক্ষকদের বেত খেয়ে অন্যদের হাড় হয় জর্জর, ভালো ছাত্রদের টিটকিরি শুনতে শুনতে কান হয় ঝালাপালা। তার বাবার দাপটের আওতা এই স্কুলপ্রাঙ্গনটাকে বেষ্টন করতে পারত না বলে তার প্রচণ্ড আক্ষেপ হতো, তবে লেখাপড়ায় তার উন্নতি সাধন করে প্রশ্রয় পাওয়ার ব্যাপারটি কখনও তার মাথায় খেলত না। ক্লাশ ক্যাপ্টেনের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে অনেক ভোটের ব্যাবধানে ফেল করলে, পুঁইশাকের কচি ডগার মত বেড়ে উঠতে থাকা তার অহংবোধ প্রচণ্ডভাবে নাড়া খায়। তার গ্রামের ছেলেপেলেদের সাথে নিয়ে একদিন ভাল ছাত্র ক্লাস ক্যাপ্টেনকে পিটিয়ে স্কুল থেকে সেই যে পিঠটান দিল, আর কোনদিন ওমুখো হয়নি।
বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেলেও সোহেল এখনও বিয়ে করেনি। বিয়ের শারীরিক প্রয়োজনটুকু মেটায় সে অন্যভাবে। গ্রামের ভেতরেই তার নিজের কয়েকজন শয্যাসঙ্গিনী আছে। এদের প্রত্যকের স্বামী দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকের কাজে নিয়োজিত, গ্রামের লোকজন এদের ডাকে বিদেশির বউ বলে। দুই-একজন সন্তানের মা, পূর্ণযৌবনা এই বিদেশির বউদের তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। মাস কয়েক স্বামী-সোহাগ পেয়ে তারপর বছরের পর বছর পুরুষসঙ্গহীন থাকতে থাকতে তাদের মনে যেমন ময়লা-আবর্জনা জমা হয় তেমনি শরীরেও মরিচা ধরে যায়। শরীর-মনের মরিচা-আবর্জনা ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে দেওয়ার আহ্বান কারো কাছ থেকে পেলে, নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে কে যেন সাড়া দিয়ে উঠে। সাড়া দিবেই বা না কেন? তাদের স্বামীরা বিদেশে গিয়ে কি বউব্রত হয়ে বসে থাকে! উপার্জনক্ষম পুরুষদের জন্য পৃথিবীর কোন জায়গায়ই-কি মেয়ের অভাব হয়! কেউ কেউ তো আবার এই দেশ থেকে যাওয়া কোন মেয়েকে বিয়ে করে দিব্যি ঘর সংসার শুরু করে দেয় সেখানেই; টাকা পয়সা পাঠায় না, এমনকি খোঁজ খবর রাখাটাকেও বাহুল্য মনে করে। বিদেশে গিয়ে তৃষ্ণার্ত পুরুষ যদি টাকা দিয়ে বা ইচ্ছুক অপর কোন তৃষ্ণার্ত নারীর সাথে মিলিত হতে পারে তাহলে দেশে তারা কোন আশায় গলা শুকিয়ে বসে থাকবে! তবে কিছুটা মধ্যবিত্ত ঘরানার পতিব্রতা দু-একজন বিদেশির বউ মাঝে মাঝে বেঁকে বসে দারুণভাবে। তবে এই বেঁকে যাওয়াটাকে একমুহূর্তের জন্যও সোজা করে নিতে পারলে আর ভাবনা থাকে না, এরপর থেকে তারা নিজেরাই বেলা-অবেলায় ডাকাডাকি করে।
নতুন শয্যাসঙ্গিনী যোগাড় করার ক্ষেত্রে সোহেল পুরাতনদেরকে কাজে লাগায়। এ-ধরনের কাজে তাদের মন কিছুটা ক্ষুণ্ন হলেও কাজটা না করে তাদের উপায় থাকে না, কারণ তা না হলে তারা তাদের এই পুরুষ সঙ্গহীন জীবনে সোহেলের তাগড়া শরীরের উত্তাপ টুকু হারাবে। এমনকি সোহেল তাদের শত্রুও হয়ে উঠতে পারে। সোহেল যদি তাদের সাথে শত্রুতা শুরু করে তাহলে তাদের বিপদের আর সীমা থাকবে না। শুধুমাত্র পেটের সন্তানটিকে কোলে নিয়ে এক কাপড়ে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে, অবাধ্যতার পরিণাম নিশ্চিত কলঙ্ক মুখে মেখে আশ্রয় মিলবে না বাপের বাড়িতেও—এটাই বড় ভয়, নিরাপত্তার দেয়াল ধ্বসে যাওয়ার ভয়। তাই তারা সোহেলের আদেশমত সকল কাজ করে দেয়, চাইলে টাকা-পয়সাও দিতে হয় মাঝে মাঝে।
বিছানায় সোহেলের আচরণ দেখেই তারা বুঝতে পারে নতুন কাউকে তার ভাল লেগেছে কী-না। নতুন কাউকে পছন্দ হওয়ার পর তাকে কাছে না পাওয়া পর্যন্ত অন্যদের সাথে সে তেমন অন্তরঙ্গ হতে পারে না, মনে হয় কেউ যেন তার কোমরে রশি বেঁধে পিছন দিক থেকে বিরামহীন টানছে।
এই বার যেমন পাপিয়াকে মনে ধরার পর, এক বিদেশির বউয়ের বিছানা থেকে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নেমে যাচ্ছে দেখে, শরীরে কাপড় জড়াতে জড়াতে পিছন দিক দিয়ে সোহেলের হাতটি টেনে ধরে মুখ নামিয়ে বিদেশির বউটি জিজ্ঞেস করে, ‘নতুন কাউরে বুঝি মনে ধরছে তোমার?’
সোহেল মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দেয়: ‘হ, রফিকের বউ পাপিয়ারে। এখন অর মুখটাই খালি মাথার মধ্যে বনবন কইরা ঘোরে, আর কারু মুখ দেকতে ইচ্ছা করে না। অরে না পাওয়া পর্যন্ত আমার বুকের আগুন নিভব না। তুমি কাইলকাই অর কাছে যাও, ফোন নাম্বারডা আমারেই আইন্যা দেও আগে।’
— ‘ঐ মাইয়াডা হুনছি একটু অন্যরকম। পরপুরুষরে নাকি কাছে ঘেঁষতে দেয় না।’ মেয়েটার কণ্ঠ একটু একটু কাঁপতে থাকে।
— ‘হেইডা আমি দেকমু। তোমারে কইছি নাম্বার আইন্যা দিতে নাম্বার আইন্যা দিবা। তোমার কাছেও তো পরপুরুষ আছিলাম, আপন হই নাই এখন, আর বেঁকা তো তুমিও কম আছিলা না, তোমারে সোজা করতে যন্ত্রণাতো কম পোহাই নাই, কিন্তু সোজা তো করছি।’ সোহেল মেয়েটিকে একটু খোঁচা দিয়ে বলে।
—‘হুনছি, পাপিয়া তার ফোন নাম্বারডাও কাউরে দেয় না।’ অযথাই যেন মেয়েটির কণ্ঠে খুশির ছোঁয়া লাগে।
—‘খুশি অইয়া লাভ নাই, অরে আমি হাতের মুঠায় আনমুই; তুমি কাইলকা বিকালে যাইয়া ফোন অর নাম্বার চা-বা। যদি না দেয়, তাইলে আমার বুদ্ধিমত খালি কাম চালাইয়া যাবা।’
—‘আর হুনছি তোমার জামাই নাকি বিদেশে মেলা টাকা-পয়সা কামাই করতাছে, আমারে কিছু টাকা দেওন লাগবো, আগেভাগেই জানাইয়া রাখলাম তোমারে।’ এই বলে সোহেল ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল।
বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল সোহেল সুপারিগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ পরেই পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করবে। এর মধ্যে যদি প্রকৃতির ডাকে পাপিয়া বের হয়ে না আসে, তাহলে তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে। একটা অনিশ্চয়তার ছায়া তার মধ্যে ঘন হতে থাকে। এর মধ্যে আবার ধরা পড়ে যাওয়ারও ভয় আছে। পাপিয়ার শ্বাশুড়ি যদি পুরাতন দো-চালা ঘর থেকে বাইরে আসে! বয়স্ক নারীরা যদিও বাইরে বের হলে, তলপেট খালাস করার জন্য বেশি দূর এগোয় না; ঘরের সামনেই উবু হয়ে বসে পড়ে। তারপরও যদি দূর থেকে তাকে ছায়ার মত দেখতে পেয়ে খড়খড়ে কণ্ঠে, ‘উনু কেরা খারাইয়া অইছে, কেরা উডা, কেরা উনু, কতা কয় না কে,’ বলতে শুরু করে! তখন সে পালাবে কোথায়? ঝাঁঝাল কণ্ঠের চিৎকার শুনে পাপিয়ার শ্বশুর চোখ ডলতে ডলতে ঘুম থেকে জেগে উঠে কিছু দেখতে বা বুঝে উঠতে পারার আগেই—‘এই চোর আইছে, চোর আইছে, নিছে নাকি কিছু, আমার সর্বনাশ হইয়া গেল নাকিরে’ এরকম আরো নানা কিছু বলতে বলতে কর্কশ কণ্ঠে চেঁচামেচি শুরু করে দিবে। তাদের এই দুই জনের চিৎকার-চ্যাঁচামেচি হৈ-হট্টগোলে এই পাড়ার সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠে গ্রামে নতুন আসা বিদ্যুতের আলো জ্বালিয়ে চিৎকার করতে করতে দরজা খুলে ঘরের সামনে এসে দাঁড়াবে। বা আধোঘুমে কোন দিক থেকে চিৎকার আসছে ঠিকমত বুঝতে না পেরে এদিক-সেদিক দৌড়াতে শুরু করবে। তখন এখান থেকে সটকে পড়াটা তার জন্য হবে বিশাল এক ঝামেলার ব্যাপার! এসব কথা মনে হতেই তার শরীর ভয়ে হিম হয়ে আসে।
দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ভাবতে ভাবতে খানিকটা পাশ ফিরে পুরাতন দো-চালা ঘরটির দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ করে নতুন আলোর একটা ঝলকানি অনুভব করে। তার মনের মধ্যে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসে একরাশি ত্রাস। সে জড়সড় হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে, কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। না, টর্চ লাইটের আলো ফেলে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না, বেশ খানিকক্ষণ কান পেতে থেকে দূর থেকে কারো হেঁটে আসার মৃদু শব্দটুকু শুনতেও সে ব্যর্থ হয়। ভয়ের ভাব কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ করে তার মনের মধ্যে একটি ক্ষীণ আশার আলো ধীরে ধীর উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তাহলে কি অবশেষে পাপিয়া…! মুখ ঘুরিয়ে দো-চালা ঘরটির দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায় উপরে টিনের চালের নীচ দিয়ে এবং নীচে মাটির ঢোয়ার উপর দিয়ে ফ্লোরোসেন্ট আলো লম্বা সরু ফালি হয়ে বের হয়ে আসছে। পুরোপুরি উল্লসিত হওয়ার সময়টুকুও যেন সে পায় না। সাথে সাথে তার মস্তিষ্কের নির্দেশে শরীরের সমস্ত কোষ নিজেদেরকে প্রস্তুত করে তুলতে শুরু করে। দরজার হুড়কো খোলার খুট শব্দটি সে সুপারিগাছের তলা থেকেই স্পষ্ট শুনতে পায়। বেড সুইচে চাপ দিয়ে মেয়েটা প্রথমে আলো জ্বালিয়ে দেয় তারপর আস্তে আস্তে চৌকি থেকে নেমে দরজার কাছে এসে হুড়কো খুলে—সোহেল মনে মনে পাপিয়ার কাজের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে। তারপর তার হিসাবকে মিলিয়ে দিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে দরজাটি খুলে যায়। চাঁদের মেটে আলোর ভেতর দিয়ে ঘরের সামনে একফালি ফ্লোরোসেন্ট আলো ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়ে আয়তাকার হয়ে উঠে। কিছুক্ষণ পর পাপিয়া সেই আলোতে এসে দাঁড়ায়! মেয়েটি ঢুলতে ঢুলতে ঘরের কোনা পর্যন্ত এগিয়ে আসে। এবার সোহেল সুপারি গাছের পাশ থেকে মেয়েটিকে বেশ স্পষ্টভাবেই দেখতে পায়। মেয়েটির পুরো শরীর এখনো ঘুমে জড়ান, মুখের শ্যামল প্রান্তরে বিছানো আবছায়ায় ঢাকা বড় বড় চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে আছে। কিছুটা উবু হয়ে ঘরের কোণা থেকে পানিভর্তি বদনাটা তুলে নিয়ে ঘরের পাশ দিয়ে পিছন দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তারপর আরেকটি বাঁক ঘুরে ঘরের পিছনে চলে গেলে, মেয়েটি সোহেলের দৃষ্টি সীমানা থেকে অন্তর্নিহিত হয়ে যায়।
একটানে লুঙ্গির গিট্টু খুলে জোরে একটা ঝাড়া দিয়ে বেশ খাটো করে কোমরের সাথে শক্ত করে বেঁধে নেয় সোহেল। পাপিয়া ঘরের পেছন থেকে বের হয়ে আসার সাথে সাথে ঘরের পাশ এবং উনুনের মাঝখানের জায়গাটিতেই তাকে ধরে ফেলবে—এমনটাই স্থির করে সে। একটুও যাতে শব্দ না হয় এমনভাবে পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে কয়েক কদম ফেলে সুপারিগাছের পাশ থেকে সামান্য একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। ঘরের পিছন দিক থেকে মেয়েটার হেঁটে আসার শব্দ শুনতে পেয়ে সে চকিত হয়ে ঘরের পেছন পাশের কোণার দিকে তাকায়, আবছাভাবে মেয়েটার অবয়ব নজরে আসে।
পাপিয়া আরেকটু সামনে এলে সোহেল আবার এগোতে শুরু করে। এবার সে মেয়েটার অনেকটাই কাছাকাছি চলে আসে তবে মেয়েটার ঘুমের ভাব এখনও ঠিকমত কাটেনি বলে আশেপাশে কারো উপস্থিতি টের পায় না। সে দ্রুত হেঁটে মেয়েটার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
মেয়েটা তার মুখের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন সে তাকে বাস্তবে নয় আলো-ছায়ায় ঘেরা দুঃস্বপ্নের ঘোরের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে। সোহেলের আচার-আচরণে যে ভয় তার বুকের মধ্যে এতদিন ধরে একটু একটু জমে উঠছিল তা যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে তার ভোর রাতের ঘুমের মধ্যে চলে এসেছে। দুঃস্বপ্নেরা যে সাধারণত ভোররাতের দিকে হানা দেয়—তা সে ভালো করেই জানে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিমানকে শুধুমাত্র তার মনের ভয় ভেবে, ভোর রাতের এই দুঃস্বপ্ন থেকে দ্রুত পালিয়ে যেতে পেছনে চিতাবাঘ লাগা ঘাই হরিনীর মত তড়িৎ গতিতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সাথে সাথে একটি জোয়ান পুরুষের প্রকাণ্ড শরীরের সাথে প্রচণ্ড রকম ধাক্কা লেগে মেয়েটির হাতে থাকা আধ ভর্তি বদনাটি মাটিতে পড়ে পানি ছিটকে এসে তার পায়ে লাগে। তৎক্ষণাৎ সে আধো আধো ঘুম থেকে বদনার পানির মত ছিটকে বের হয়ে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ে। হৃদপিণ্ড থেকে গরম রক্ত ছিলকে বের হয়ে জলোচ্ছ্বাসের মত তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায়। পানির গভীরে বিশাল তোলপাড় হলে যেমন কাঁপে তার উপরিতল, তেমনিভাবে কাঁপতে থাকে তার নাজুক শরীর। তার মুখ থেকে অস্ফুট গুঞ্জনের মত কিছু শব্দ বের হয়ে আসে: ‘আ প নে, আপনে এখানে কেন? এত রাইতে কি জন্য আইছেন?’
ক্রিকেট মাঠে চার-ছক্কা হাকানো পেশীবহুল হাত দিয়ে উঠান ঝাড় দেয়া—ঘর লেপা-বাসন মাঝা কোমল হাতটি চেপে ধরে চাপা স্বরে বলে: ‘তুমি জানো না, কি জন্য আইছি আমি। তোমারে আমি ভালোবাসি, একটু সোহাগ করতে আইছি তোমারে।’
তার অনিচ্ছার সময়ে স্বামীর বাহুবন্ধনে যে বিদ্রোহটি অভেদ্য আবরণের ভেতরে মাথাগুজে পড়ে থাকে, সেই বিদ্রোহটি এবার ছাড়া পেয়ে ভেতরের সমস্ত শক্তি নিয়ে গর্জে বের হয়ে আসতে একমুহূর্ত দেরি করে না। শক্ত মুঠিতে ধরা হাতটি মোচড়াতে মোচড়াতে ও অন্যহাতটি দিয়ে সোহেলের হাতটিকে টেনে ছাড়িয়ে দিতে দিতে চাপা তবে বেশ দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে: ‘আপনে এখনি চইল্যা যান কইতাছি, নইলে কিন্তু ভাল অইবনা। আমি চিৎকার কইরা বেবাকরে ডাইক্যা তুলমু কইলাম।’
মেয়েটির সমস্ত শরীরে ফুটে উঠা এমন তেজী ভাব ও মুখ থেকে বের হওয়া ভয় ধরান কথায় সোহেলের ভেতরটা রোষান্বিত হয়ে উঠে। সে মুখে কিছু না বলে, তার অপর হাতটি দিয়ে মেয়েটির পিঠ বেষ্টন করে পাঁচ আঙ্গুলে নগ্ন বাহুমূল জাপটিয়ে ধরে চাপ দিয়ে মেয়েটিকে তার বুকের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এভাবেই সোহেল পাপিয়ার জেদীভাবটাকে গুড়িয়ে দিতে চায়, মুখে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করে না। সোহেল নিশ্চিত জানে মেয়েটি চিৎকার করে লোক ডাকার কথা বলে তাকে শাসালেও, উচ্চরবের একটা শব্দও সে মুখে আনতে পারবে না।
পাপিয়া ফাঁদে আটাকা পড়া অসহায় বন্য পশুর মত সোহেলের আবেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যায় শুধু, সুতীক্ষ্ণ তীরের মত কোন চিৎকার তার মুখ ফুড়ে বের হয়ে আসে না। চিৎকার করলেই কি সে রেহাই পাবে? ফাঁদে আটকা পড়া হরিণ কি চিৎকার করে নিস্তার পায়! বরঞ্চ লোকজন এগিয়ে এসে খুশিতে হাততালি দিয়ে ওঠে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মজা দেখে।
চারদিক নীরব দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলতে শুরু করা শামুক যেমন হঠাৎ কোন শব্দ পেয়ে নিজেকে শক্ত খোলসের ভেতরে গুটিয়ে নেয় ঠিক তেমনিভাবে অবাধ্য হয়ে উঠা বিদ্রোহটি আশেপাশের ঘুমিয়ে থাকা মানুষের জেগে উঠার শঙ্কায় ফনা নামিয়ে নিজের গর্তে ফিরে গিয়ে অবাধ্যতার ক্লান্তিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বুকের ভেতর থেকে একটা অজানা ভয়ের কুণ্ডলী উপরের দিকে উঠে মুখময় ছড়িয়ে যায়।
পাপিয়া টেরই পায়নি যে, সোহেল এতক্ষণে তার ঘাড়ের একপাশে মুখ ঘষতে শুরু করেছে। তার সমস্ত শরীর জাঁক মেরে উঠে, ছড়িয়ে পড়তে থাকা ভয়ের কুণ্ডলী আরো ঘন হয়ে উঠে, বাড়তি ভয়টুকু তার নিজেকেই, আপন শরীরকে। এরই মধ্যে মেয়েটির ঘাড়ের একপাশ থেকে মুখ সরিয়ে আরেক পাশে গোঁজার সময় মেয়েটির মুখের উপর তার দৃষ্টি থেমে যায়। পাপিয়ার মুখের মধ্যে সে অবাধ্য বিদ্রোহের বদলে দেখতে পায় ঘনীভূত হয়ে উঠা একটা ভয়ের ছায়া। অবাধ্যতা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠা সোহেল এবার ভয় দেখে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে। মেয়েটিকে দেখার পর থেকে এই প্রথম সে তার মুখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেল। সোহেল মেয়েটির ভয়ে আচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভয় পাওয়াকে উপভোগ করতে থাকে। ভয়ের ছায়াটি ধীরে ধীরে তার মুখ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একই রকম মুখের আদল নিয়ে বের হয়ে আসে। এই ভয়ের মুখটিকে তার পাপিয়ার মুখের চেয়ে অনেক বেশি স্নিগ্ধ ও আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে। সে মেয়েটির ঘাড়ে মুখ গুজে দেওয়ার বদলে ভয়ের ছায়াটির ঘাড়ে প্রচণ্ড হরষে মুখ ঘষতে শুরু করে দেয়।
উচ্চরবে চিৎকারের বদলে পাপিয়ার মুখ থেকে মৃদুস্বরে ফুটে বের হতে থাকে ছোট ছোট শীৎকার ধ্বনি। নিজে থেকেই আরো খানিকটা অন্তরঙ্গ হয়, ব্রা-বিহীন সামান্য একটু ঝুলে পড়া স্তন জোড়া সোহেলের বোতাম খোলা বুকে আস্তে করে চেপে ধরে। একমাত্র মুক্ত হাতটি উপরের দিকে তুলে সোহেলের শ্যাম্পু করা ঘন-কালো, ঘাড় পর্যন্ত পড়া লম্বা চুলের ভেতর দিয়ে আঙ্গুল চালাতে চালাতে নরম গলায় বলতে থাকে: ‘ভাইডা কইছি, আইজক্যা না, আইজক্যা আমার শরীরডা ভালো না।’ এতক্ষণে কিছুটা শিথিল হয়ে পড়া মুঠিতে এখনও ধরে থাকা হাতটি উপরের দিকে তুলে সোহেলের হাতের উল্টা দিকটি তার নিজের কপালে ছোঁয়ায়। সন্ধ্যা থিকাই কেমন জানি জ্বর-জ্বর লাগতাছে। আর এই সময়েই আমার শাশুড়ি তাহাজ্জতের নামাজ পড়ার জন্য উইঠা পড়ে। আমাগো এই অবস্থায় দেইখ্যা ফালাইলে কেলেঙ্কারি হইয়া যাবো। ভাইডা কইছি, তুমি আইজক্যা যাওগা। আমার শরীরডা ভাল হইলে আমি নিজে তোমারে ফোন দিয়া ডাইকা আনমু। বাইরে না, তোমারে ঘরে নিয়া যামু’, বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সোহেলের কাঁধে মাথা ঠেকায় মেয়েটি।
সোহেল এবার তার মুখটি মেয়েটির বুকের দিকে নামিয়ে আনতে আনতে ভাবে, তাকে কি এত বোকা ভাবলে চলে! মেয়েদের ছেনালীপনা বুঝতে পারবে না, এতই কি নির্বোধ সে! মেয়েরা তাদের চাতুরী দিয়ে প্রথম দিকে তাকে ঘায়েল করতে পারত, তাই বলে এখনও পারবে, এই পঁচিশ বছর বয়সেও, মেয়েদের ছলচাতুরীর শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা কি তার ঘটে কম জমেছে। বিপরীত ভাবনাও তার মনে আসে, মেয়েটির কথা তো সত্যও হতে পারে। মেয়েটি কপালে লেগে থাকা হাতের উল্টো পিঠে সে বেশ গরম অনুভব করে। আর মেয়েটার বুক থেকে উপরকার জামা ভেদ করে সিদ্ধ ধানের গরম ভাপ উঠছে যেন। আসলেই কি আজকে সন্ধ্যা থেকে তার জ্বর! সন্দেহের পেন্ডুলামে ঝুলে তার মন এদিক-ওদিক দুলতে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে একদিক খানিকটা ঝুঁকে পড়ে। জ্বরের ফলে হয়ত নয়, ভয় পাওয়ার কারণে বা তার প্রতি শারীরিক উত্তেজনায় মেয়েটির শরীর গরম হয়ে উঠেছে। শরীর উজ্জীবিত হয়ে উঠলেও, তার পতিব্রতা মনটি সামাজিক অনুশাসনের শৃঙ্খলে আটকা পড়ে থাকার কারণে হয়তো সে এমন অনিচ্ছুক। বিশাল হাতুড়ির প্রচণ্ড আঘাতে এই শিকল ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হবে। একবার হয়ে গেলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। এই দো-চালা ঘরটির পাশে এসে ঘন্টার পর ঘণ্টা অজানা আশঙ্কায় ভীত হয়ে আর তাকে বসে থাকতে হবে না। রিমোট কন্ট্রোলের মত মোবাইল ফোনের বোতামে একটি চাপই—মেয়েটি দরজা খুলে বের হয়ে আসার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠবে।
সোহেলের সংশয়গ্রস্ত মন এবার সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে এক লাফে সাহসের চূড়ান্ত মাত্রায় উঠে পড়ে। তার কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মেয়েটির দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে শক্তিশালী হয়ে উঠা একটি পা ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দিয়ে—প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়ারকে ঘায়েল করার নিখুঁত কৌশলে-জবাই করার আগে কোরবানীর পশুর সামনে-পিছনে দুই পা রশিতে বেঁধে লম্বা বাঁশ দিয়ে চাড় মেরে মাটিতে ফেলার কায়দায় খানিকটা বাঁকিয়ে আড়াআড়িভাবে চাপ মারতেই, পিঠের পাশে আবেষ্টনী দিয়ে ধরা হাতের উপর হাটু ভেঙ্গে পড়ে যায় মেয়েটি। সোহেল পাপিয়াকে আবেষ্টনী দিয়ে ধরে রাখা অবস্থাতেই উবু হয়ে মেয়েটির গরম শরীরটাকে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা মাটিতে শুইয়ে দেয়।
তারপর মেয়েটার বাঁকা পা-দুটিকে সোজা করে নিয়ে নিম্নাঙ্গের উপর বসে পড়ে; সবুজের উপর লালের বাহারি ছোপ ওয়ালা কামিজটাকে একটি হ্যাঁচকা টানে উপরের দিকে তুলে গলার কাছে কুঁচিয়ে রাখে। খোলা আকাশের নীচে মেঘে ঢাকা চাঁদের ঝাপসা আলোয় উন্মুক্ত হয়ে পড়া স্তনে হাত পড়তেই সে বুঝে ফেলে কুচাগ্র বেশ স্ফীত হয়ে উঠেছে; এতে সে আরো অনেকবেশি উৎসাহী হয়ে উঠে ওদুটোকে এমনভাবে চাপতে শুরু করে যেন কোন হিংস্র পশু সামনের পায়ের নখর দিয়ে মাটি আচড়াচ্ছে। এরপর ধীরে ধীরে নিজের মুখটাকে মেয়েটার মুখের দিকে নামিয়ে আনতে থাকার মুহূর্তে চাঁদটি মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এলে ঝাপসা আলো মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে উঠে। নামিয়ে আনতে থাকা মাথাটি যেন একটি অদৃশ্য বাঁধার সাথে ঠুকে যায়। সে দেখতে পায়—পাপিয়ার মুখটি প্রচণ্ড পরিমাণ ভয় পেয়ে চিৎকার করার ভঙ্গীতে হা হয়ে আছে, এমনিতেই বড় বড় চোখ দুটো আরো বেশী প্রসারিত, মোটা কালো ভ্রু দুটি কপালের দিকে বেশ খানিকটা তোলা, কপালের চামড়া বলিরেখা পড়ে যাওয়া বৃদ্ধ মানুষের মত কোঁচকানো, গালের ফোলা ফোলা মাংশগুলো দেবে যাওয়া, খাড়া চিবুকটি খানিকটা ঝুলে পড়া। সোহেলের মুখটা স্প্রিং-এর মত স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপরের দিকে উঠে পড়ে। তার পুরো শরীর ঝিমঝিম করে উঠে, হাতে-পায়ে খিল ধরে যায়; মনে হতে থাকে মুহূর্তের মধ্যে তার হৃদপিণ্ডটি যেন তার শরীরের শিরায়-উপশিরায় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দিয়েছে। ধীরে ধীরে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে সে।
পাপিয়ার নিম্নাঙ্গের উপর বসে থাকা অবস্থাতেই, সূর্যের আলো প্রবেশ করতে না পারা গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে সোহেল দৌড়াতে থাকে। একটা সূক্ষ্ম সুতার মত অদৃশ্য কি একটা যেন তার মাথা থেকে বের হয়ে সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যের দিকে তাকে টানছে প্রচণ্ড বেগে। মাঝে মাঝে বিশাল-বিশাল বন্য গাছগাছালির সাথে ধাক্কা লাগে, মাটিতে বিছানো লতানো কাঁটায় তার পা ছড়ে যেতে থাকে, লতা-পাতা ঝোপঝাড়ের মধ্যে আটকে পড়ে, হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, অদৃশ্য সূক্ষ্ম সুতাটির হ্যাঁচকা টানে আবার উঠে দাঁড়ায়, দৌড়াতে শুরু করে। ছুটতে ছুটতে সে ভীষণ মাত্রায় ক্লান্ত, পা দুটি অবশ হয়ে গেছে; দরদর করে ঘাম ঝরে তার গায়ের পোশাক ভিজে জবজবে হয়ে উঠে। হাঁটুর উপর হাত রেখে খানিকটা উবু হয়ে ক্লান্তির শ্বাসটাও ফেলতে পারে না—সূক্ষ্ম সুতাটি তাকে সামনের দিকে টানতে থাকে অবিরাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল—সোহেল যখন গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে সূক্ষ্ম সুতার টানে শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সামনের দিকে ছুটে চলছে তখন এগিয়ে যাওয়ার সাথে তাল রেখে কমে যেতে থাকে তার বয়স, সে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যায়; সেই অনুযায়ী তার পোশাক-আশাকের আকার ও ধরনও যায় বদলে। এভাবে অনেকটা পথ অতিক্রম করে আসার পর সে বুঝতে পারে অন্ধকার বেশ হালকা হয়ে উঠেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে অদৃশ্য সূক্ষ্ম সুতার একটা হঠাৎ তীব্র টানে সে গহীন অরণ্য ছেড়ে একটা খোলা জায়গায় এসে আছড়ে পড়ে, উপরের দিকে মুখ তুলে দেখতে পায় সে তাদের বাড়ির ভেতরের উঠানে পড়ে আছে; চারপাশটা কেমন যেন আবছা অন্ধকার, ফ্লোরোসেন্ট আলোতে ভরা নয়। তার হাত-পা অনেক ছোট ছোট ও শরীরটা বেশ হালকা হয়ে উঠেছে বুঝতে পেরে এবার নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে যায়—সে এখন পাঁচ-ছয় বছরের ছোট্ট সোহেলে পরিণত হয়ে উঠেছে—তার পরনে হাফ প্যান্ট ও ছোট ছোট লাল ফুল তোলা সুতি কাপড়ের হাফ হাতা সার্ট। তাদের বাড়িটাও এখনকার মত নয়—তার পাঁচ বছর বয়সে যেমন ছিল ঠিক তেমন রূপ ধরে আছে। এখনকার ইটের দেওয়াল তোলা রঙিন টিনের চালের ঘরটির বদলে দেখতে পায় রূপালি ঢেউটিনের মেঝে কাঁচা ঘরটি। ঘরটির ভেতর থেকে জানালা গলে হারিকেনের একফালি হালকা আলো বাইরে এসে পড়ছে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই সে হঠাৎ একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ শুনে কিছুটা চমকে উঠে। এর কিছুক্ষণ পর পাশের আরেকটি বেশ ছোট ঘরের দরজা খোলার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ শুনতে পায়। পাঁচ বছরের সোহেল সেদিকে পাশ ফিরে হালকা অন্ধকারের মধ্যেই দেখতে পায়—অবিকল তার মত দেখতে, একই ধরনের গায়ের পোশাকে পাঁচ বছর বয়সী একটা ছেলে হাতের উল্টা পিঠে চোখ ঢলতে ঢলতে কৌতূহলোদ্দীপক মুখে দরজা খুলে বের হয়ে আসে। ছেলেটি তার পাশ দিয়ে হেঁটে জানালাটির সামনে ঘরের ঢোয়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটি তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সে নিজেই ঐ ছেলেটিতে পরিণত হয়ে উঠে। পাঁচ বছরের ছোট সোহেল এবার কচি কচি আঙ্গুল দিয়ে লোহার শিক ধরে ঘরের ঢোয়ায় উঠে জানালা দিয়ে একটু তেরছা ভাবে ঘরের ভেতরে তাকায়। মৃদু আলোতে সে দেখতে পায়, খাটের উপর তার যুবতী মা বিছানার উপর শুয়ে আছে ও তার নিম্নাঙ্গের উপর বসে আছে তার যুবক বয়সের বাবা। মায়ের মুখের দিকে দৃষ্টি গেলে সে হঠাৎ আঁতকে উঠে।
পাপিয়ার নিম্নাঙ্গের উপর বসে থাকা সোহেল কিছুটা ফিরে আসে বর্তমানে আর কিছুটা থেকে যায় অতীতে—তার সেই পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে। সে একই সাথে এখান থেকে পাপিয়ার মুখ এবং কাঁচা ঢোয়ার উপর দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে তার যুবতী মায়ের মুখ দেখতে পায়। আলাদা আলাদা গড়নের মুখ দুটির মধ্যে একই ধরনের প্রচণ্ড ভয় পাওয়া অনুভূতি ফুটে আছে। এরপর মুখ দুটি পাশা-পাশি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে, ক্রমান্বয়ে পরস্পরের সাথে সংমিশ্রিত হয়ে একটি মুখাবয়বে পরিণত হয়। হঠাৎ সে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত করে মেয়েটির নিম্নাঙ্গের উপর থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে।
ঘরের কাঁচা ঢোয়ায় দাঁড়িয়ে জানালার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকা পাঁচ বছরের সোহেল এবার মায়ের মুখের উপর থেকে চোখ তুলে তার যুবক বাবার মুখের দিকে তাকায়। সেখানে সে লোলুপতা ও হিংস্রতার মিশ্রিত অভিব্যক্তি দেখতে পায় এবং তার চোখ আটকে যায়।
ঠাণ্ডা মাটিতে ছিটকে পড়া সোহেল এবার নিজের চওড়া বুকের মধ্যে পাঁচ বছরের সোহেলের চোখে দেখা তার যুবক পিতাকে—মুখে একই রকম অভিব্যক্তি নিয়ে হাটুগেড়ে বসে থাকা—অনুভব করে। তখন তার মুখ ধীরে ধীরে আবার উল্লাসে ভরে উঠে। সে পাশ ফিরে দেখে, পাপিয়া শোয়া অবস্থা থেকে পিঠ বাঁকিয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করছে। এবার সে আর তার যুবতী মায়ের ভয় পাওয়া মুখটিকে পাপিয়ার মুখের পাশে দেখতে পায় না। সোহেল তখন খানিকটা ঘুরে গিয়ে দুই হাত দিয়ে পাপিয়ার দুই বাহুমূলে সজোরে ধাক্কা মারে। মেয়েটি মৃদু শব্দ করে মাটিতে পড়ে যায়। বিপরীত দিক থেকে আরেকটি ইলেকট্রিক শক সোহেলকে আবার পাপিয়ার নিম্নাঙ্গের উপর বসিয়ে দেয়। হতভম্ব হয়ে যাওয়া মেয়েটির দেহ অর্ধ-অচেতনের মত মাটিতে অসার হয়ে পড়ে থাকে। হঠাৎ করে সোহেল দো-চালা ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা কচি কণ্ঠের, ‘আম্মু… আম্মু… আম্মু…’ ডাক শুনতে পায়। তবে মেয়েটির মুখে কোন ধরনের ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না, সে যেন কোন ডাক শুনতে পায়নি। সোহেল এবার খানিকটা নিচু হয়ে অসার হয়ে শুয়ে থাকা পাপিয়ার দেহটাকে আস্তে করে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরে, জলোচ্ছ্বাসের প্রচণ্ড তোড়ে ভেসে যেতে থাকা মানুষ যেমনভাবে ডুবন্ত গাছের শাখা-প্রশাখা আকড়ে ধরে। এই মুহূর্তে এই দুইজনের কাছেপিঠে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে চাঁদের আবছা আলোতেও দেখতে পেত, পুরুষ্টু আঙ্গুলের দুইটি কোমল হাত সোহেলের পিঠের দিকে ধীরে এগিয়ে আসছে; তার কাঁধে স্থাপিত নারী মুখটিতে ফুটে উঠা ভয়ের অনুভূতি খানিকটা আশ্বস্ততার ভাব নিয়ে এখনও টিকে আছে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন