আমি ডেমোক্র্যাট হিসেবেই জন্মেছি: রবার্ট ফ্রস্ট
প্যারিস রিভিয়ুর হয়ে রবার্ট ফ্রস্টের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন রিচার্ড পয়রিয়ার, যা ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে ফ্রস্টের বাসায়। প্যারসি রিভিয়ুতে উল্লিখিত ছোট ভূমিকায় পয়রিয়ার ফ্রস্টের সাধারণ বেশভূষার সঙ্গে তার প্রখর ব্যক্তিত্বের কথা তুলে ধরেন। সে সময় ৮৬ বছর বয়সী ফ্রস্টকে তিনি শারীরিকভাবে ভীষণ শক্তপোক্ত বলেও উল্লেখ করেন সেখানে। সে যা-ই হোক, রবার্ট ফ্রস্টের ব্যক্তিত্ব ও ভাবনার জগতের অনেক কিছুই উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে। কলেবর বিবেচনায় ও একেবারে সে সময়ের কিছু বিষয়কে ছেটে ফেলা হয়েছে সাক্ষাৎকারটি থেকে। প্রতিধ্বনির জন্য সাক্ষাৎকারটির অনুবাদ করেন কবি ও অনুবাদক নেলসন।
রবার্ট ফ্রস্ট: লেখার বোর্ড ছাড়া আমি কখনো লিখি না। জীবনে আমার কখনো টেবিল ছিল না। সবকিছুতেই লিখি। জুতার শুকতলাতেও লিখি।
প্রশ্ন: কখনোই ডেস্ক পছন্দ করলেন না কেন? এটা কি অনেক বেশি ভ্রমণ ও থাকার জায়গা বদলের কারণে হয়েছে?
ফ্রস্ট: এমনকি তরুণ বয়সেও আমার কোনো ডেস্ক ছিল না। কোনো লেখার ঘর ছিল না।
প্রশ্ন: কেমব্রিজকে কি এখন আপনার তুলনামূলক বেশি নিজের বাড়ি মনে হয়?
ফ্রস্ট: শীতকালে। কিন্তু আমি ভারমন্টের রিপটনে প্রায় পাঁচ মাস ছিলাম। সেখানে আমি গ্রীষ্মের লম্বা সময় কাটিয়েছি। কিন্তু এটা এখন আমার অফিস ও কাজের জায়গা।
প্রশ্ন: ভারমন্টে আপনি ব্রেড লোফ স্কুল অব রাইটিংয়ের কাছে থাকেন তাই না?
ফ্রস্ট: তিন মাইল দূরে। খুব কাছে না। জানি যে, ওটা আছে ওখানে। আমি কিছুটা দূরেই থাকি, পর্বতের ওপাশে এক রাস্তার ধারে। আমি যতটা নই, তারচেয়েও বেশি করে তারা আমাকে এর সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। স্কুলটিতে ও সম্মেলনে আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। এ পর্যন্তই।
প্রশ্ন: স্কুলটির সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আপনি, তাই না?
ফ্রস্ট: তারা এমনটাই বলে। সম্মেলনের শুরুর সময়ে আমার আরও কিছু করার ছিল বলে আমি মনে করি। খুবই হালকা চালে আমি মিডলবারি স্কুলের প্রেসিডেন্টকে বলেছিলাম, ‘স্কুল শেষে এ জায়গাটিকে সামাজিক কাজে ব্যবহার করছেন না কেন?’ আমার মাথায় নিয়মিত কিছু ছিল না—কোনো ফি না, কিছু না। শুধু এক-দুই সপ্তাহে কিছু সাহিত্যিককে ডাকার বিষয়টি মাথায় এসেছিল। কিন্তু তারপর তারা নিয়মিতই বিষয়টির আয়োজন করে।
প্রশ্ন: ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সাল সময়টায় যখন আপনি ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন সেখানে আপনি থেকে যাবেন?
ফ্রস্ট: না। না, আমি সেখানে কিছুদিনের জন্য দরিদ্র হতে গিয়েছিলাম। আর কিছু না। সেখানে থাকার সময় আমি কোনো বই প্রকাশের কথা ভাবিনি। সেখানে কাউকে বই দিতামও না আমি। আমি তখন ৩৮ বছর বয়সী, তাই না? এমনটাই হবে। বই হিসেবে আমি ম্যাগাজিনের মতো কিছু একটার কথা ভেবেছিলাম। এ ক্ষেত্রে আমার ভাগ্য তেমন ভালো নয়, আর মাঝেমধ্যে চেক পাঠানো ছাড়া সেখানে কেউ আমার দিকে কোনো মনোযোগ দেয়নি। তাই আমার মনে হয়নি, আমি বই প্রকাশের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর আমি তিনটি বই লিখেছিলাম—মানে তিনটি বই হওয়ার মতো লেখা—আ বয়’স উইল, নর্থ অব বোস্টন ও মাউন্টেইন ইন্টারভ্যাল-এর কিছু অংশ।
প্রশ্ন: ইংল্যান্ডে থাকতে পাউন্ডের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টা নিয়ে যদি বলতেন?
ফ্রস্ট: এটা ফ্র্যাঙ্ক ফ্লিন্টের মধ্য দিয়ে ঘটেছিল। প্রথম দিককার চিত্রকল্পবাদী ও অনুবাদক। তিনি পাউন্ডের বন্ধু ছিলেন এবং সেই ছোট দলটির সদস্য ছিলেন। এক বইয়ের দোকানে দেখা হয়েছিল, বলেছিলেন, ‘আমেরিকান?’ আর আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে বুঝলেন?’ বললেন, ‘জুতা।’ সেটা ছিল একটা কবিতার বইয়ের দোকান, হ্যারল্ড মনরোর, মাত্রই গোছগাছ হয়েছে। তিনি বললেন, ‘কবিতা?’ উত্তরে বললাম, ‘অভিশাপটি আমি গ্রহণ করেছি।’ তারপর তিনি বললেন, ‘তোমার নিজের দেশের লোক এজরা পাউন্ডকে তো চেনো?’ আমার উত্তর ছিল, ‘আমি তার কথা কখনোই শুনিনি।’ সত্যিই শুনিনি। সাহিত্য ম্যাগাজিনগুলো আমি এড়িয়ে যেতাম—আমি এগুলো তেমন একটা পড়িনি—আর গালগল্প—এসবের দিকে আমি কখনোই তেমন মনোযোগ দিইনি। আমার উত্তর শুনে তিনি বললেন, ‘আমি তাকে তোমার কথা বলব।’ কিছুদিন পরই পাউন্ডের কাছ থেকে একটি কার্ড আসে। আমি দু-তিন মাসেও সে কার্ড ব্যবহার করিনি।
প্রশ্ন: প্রকাশের আগেই আপনার বই—আ বয়’স উইল দেখেছিলেন তিনি তাই না? এটা কীভাবে হলো?
ফ্রস্ট: বইটি আগে থেকেই প্রকাশকের কাছে ছিল। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কার্ড পাওয়ার তিন-চার মাস পর আমি যখন পাউন্ডের সঙ্গে দেখা করি, তখনো এটি প্রকাশিত হয়নি। আমি সেই কার্ড খুব একটা পছন্দ করিনি।
প্রশ্ন: সেই কার্ডে পাউন্ড কী লিখেছিলেন?
ফ্রস্ট: শুধু লেখা ছিল, ‘ঘরে, কোনো এক সময়।’ পাউন্ডের মতো করেই লেখা। তাই আমার কাছে একে খুব একটা উষ্ণ আমন্ত্রণ বলে মনে হয়নি। একদিন কেনসিংটনের চার্চ ওয়াকের কাছ দিয়ে হাঁটার সময় সেই কার্ডটি আমি আবার হাতে নিই এবং তাঁর খোঁজ শুরু করি। তাঁকে খুঁজে পেলাম এবং তাঁর মতো করেই বললাম, ‘আমি দ্রুত সাড়া দিইনি।’ তারপর তিনি বললেন, ‘ফ্লিন্ট বলছিলেন, আপনার একটি বই আছে।’ আমি বললাম, ‘থাকার কথা ছিল।’ তিনি বললেন, ‘আপনি এটা এখনো দেখেননি?’ ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে চলুন একটা কপি সংগ্রহ করি কী বলেন?’ বইটির বিষয়ে তিনিই প্রথম কথা বলতে চেয়েছিলেন। পাউন্ডের অনেক চমৎকার বিষয়ের মধ্যে এটা অন্যতম: তিনিই প্রথম এগিয়ে আসতে চাইতেন। কখনো লোকজনকে ফোন করে দেখতে চাননি যে, তারা কীভাবে সাড়া দেয়। তিনি তাবৎ উৎসাহ নিয়েই নীরব থাকতে পারতেন। আমরা আমার প্রকাশকের কাছে গেলাম। সেখানেই তিনি বইটি পেলেন। আমাকে দেখালেন না। পকেটে নিয়ে নিলেন। তাঁর ঘরেই ফিরে এলাম আমরা। ব্রিটিশ উচ্চারণে বললেন, ‘এটা আমাদের পছন্দ হলে রাগ করবে না তো?’ আমি বললাম, ‘আহ পড়ে দেখ, পছন্দও কর।’ খুব দ্রুতই কিছু একটা পড়ে তিনি হেসে উঠলেন। আমি বললাম, বইটির কোন জায়গা পড়ে তিনি হাসছেন আমি জানি। কী পড়ে পাউন্ড হাসতে পারেন, তা আমি জানি। এর পরপরই পাউন্ড বললেন, ‘তুমি বাড়ি যেতে পার। আমি এর আলোচনা করব।’ আমি সেই বই ধরেও দেখিনি। আমি আমার বইটিকে না নিয়েই, এমনকি না ছুঁয়েই সেদিন বাড়ি গিয়েছিলাম। তিনি সেটা রেখে দিয়েছিলেন। তাঁর হাতে থাকা অবস্থায়ও এটা আমি কদাচিৎ ভালো করে দেখেছি।
প্রশ্ন: তিনিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক সমালোচনাটি লিখেছিলেন, তাই না?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। এই আলোচনা শিকাগোর স্টেটসে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু এটা ইংল্যান্ডে আমাকে তেমন সাহায্য করতে পারেনি। সেখানে বইটির ওপর আলোচনা একটু পরে শুরু হয়, যখন এটি বাজার থেকে ফুরিয়ে যায়। মনে হয় ইংল্যান্ডে বইটির ওপর যারা আলোচনা লিখছিলেন, তাদের কেউই জানতেন না যে শিকাগো থেকে এরই মধ্যে এর আলোচনা বেরিয়েছে। তাদের আলোচনায় অন্তত তেমনটা মনে হয়নি। কিন্তু তাঁর এই আলোচনা আমার প্রাথমিক সুনাম ও লেখক স্বীকৃতির জন্য সহায়ক হয়েছিল। আমি এই সবকিছু নিয়ে বরাবরই রোমাঞ্চ বোধ করতাম—বিশেষত আমার সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত সব আচরণ। আপনি হয়তো জানেন, সেখানে তাঁকে নিয়ে বেশ কৌতূহল ও মিশ্র এক ধরনের অবস্থান ছিল লোকের। তিনি ইয়েটস, হফারসহ (ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড) আরও কিছু লোকের বন্ধু ছিলেন।
প্রশ্ন: আপনি কি হফারকে চিনতেন?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, তাঁর (পাউন্ডের) মাধ্যমেই। এবং ইয়েটসকেও, এটাও তাঁরই মাধ্যমে।
প্রশ্ন: ইংল্যান্ডে থাকতে ইয়েটসের সঙ্গে আপনার কতবার দেখা হয়েছে?
ফ্রস্ট: খুবই কম। পাউন্ডের সঙ্গেই সব সময়—মনে হয় সব সময়ই।
প্রশ্ন: আপনি যখন লন্ডন ছেড়ে গ্লুচেস্টারশায়ারে যাচ্ছেন, তখন আপনি কি বুঝেছিলেন যে, আপনি লন্ডন শহরে বিদ্যমান সাহিত্যিক সমাজের প্রবণতার বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
ফ্রস্ট: এমনকি লন্ডন ত্যাগের সঙ্গেও এর কোনো সংযোগ নেই। সেই সময়ে আমার পদক্ষেপগুলো ছিল অনেকটাই অসচেতন। আমি জানতাম না বিশ্বে আদৌ আমার কোনো অবস্থান থাকবে কিনা। আর আমি কোনো অবস্থানের জন্য ছুটিওনি। দেখুন, কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা আমার প্রবণতা নয়। একই সঙ্গে আমার প্রবণতা এই ধরনের দল দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ারও বিপরীত—কী বলা যায় তাদের—যারা নিজেদের জর্জিয়ানস, বা এডওয়ার্ডিয়ানস (এডওয়ার্ড মার্শের অনুসারীরা) বলে পরিচয় দিত। আমি টের পেয়েছি যে, তিনি তাঁর (এডওয়ার্ড মার্শ) বইয়ে আমাকে নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি।
প্রশ্ন: লন্ডনে আপনার পরিচিত সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে এমন গোষ্ঠীবদ্ধতা কি খুব বেশি ছিল?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। খুবই হাস্যকারভাবে ছিল। আমার মনে হয় এখানেও অনুরূপ দশা। আমি জানি না। আমি ঠিক এখানকার নই। কিন্তু তারা হয়তো বলবে, ‘ওহ সে তো সেই বন্ধু, যে লোকেদের জন্য ঘ্যানঘ্যানে নানা বিষয় নিয়ে লেখে। আমেরিকায় এ ধরনের পরিচিত কোনো লোক কি আছে?’ যেন এটা একটা প্রকল্পিত বিষয়। ধরুন (জন এডওয়ার্ড) মেসফিল্ডের কথা—এই দলের লোকেরা মেসফিল্ডকে চেনেন না, কিন্তু তারা বলবে, ‘ওহ, এ তো সেই লোক যিনি এদের জন্য এই এই করতেন।’
প্রশ্ন: সেই সময় আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন এডওয়ার্ড থমাস?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, তিনি ছিলেন তার বয়সী অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা। তিনি আমার মতোই নিভৃতে থাকতেন। কেউ জানতই না তিনি কবিতা লিখতেন। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি কবিতা লিখতেন না। আর এটা এমন কিছু ছিল, যার মাধ্যমে আমি তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে যাই। আমরা খুব ভালো বন্ধু হই। না, সেই সব ভীরুর জীবনের অংশ হওয়াটা আমার প্রবণতার বাইরে ছিল। আমার বন্ধু ছিল। তবে খুব বিক্ষিপ্তভাবে। আমিও পারতাম... জানেন তো পাউন্ড প্রতি সপ্তাহে একটি বিকেল রেখে দিতেন ফ্লিন্ট, (রিচার্ড) অ্যালডিংটন ও এইচ ডির (হিল্ডা ডুলিটল) সঙ্গে আলাপের জন্য। এই দলে একসময় (থমাস আর্নেস্ট) হিউমও ছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তাঁরা একত্রিত হতেন পরস্পরের কবিতা ঘষামাজা করতে।
প্রশ্ন: হিউমের সঙ্গে দেখা হতো? এই কবিতা পুনঃলিখন সভায়, নাকি এ বিষয়টিকে আপনি গ্রহণই করেননি?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, আমি হিউমকে চিনতাম, খুব ভালোভাবেই জানতাম। কিন্তু এ ধরনের কোনো সভায় আমি কখনো যাইনি। পাউন্ডকে বলেছিলাম, ‘সেখানে কী করেন আপনারা?’ তিনি বললেন, ‘পরস্পরের কবিতা পুনঃলিখন করি।’ আমার প্রশ্ন ছিল, ‘কেন?’ তাঁর উত্তর, ‘এগুলোর তারল্য কমাতে।’ হাসতে হাসতেই বললাম, ‘এটা অনেকটা সামাজিক খেলার মতো শোনাচ্ছে। আর আমি একজন সিরিয়াস শিল্পী।’ তিনিও হাসলেন এবং আমাকে আর কখনোই সেই সভায় ডাকেননি।
প্রশ্ন: পাউন্ড ও এডওয়ার্ড থমাসের মতো আপনি যাদের জর্জিয়ান বলছেন, তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আপনার নিজস্ব শৈলী তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি, তাই তো? কারণ, ততদিনে আপনি প্রায় তিনটি কবিতার বইয়ের কাজ শেষ করে ফেলেছেন।
ফ্রস্ট: বলা উচিত, আড়াইটি। এর বাইরে হান্টিংটন লাইব্রেরি যে কবিতাগুলোর কথা জানিয়েছিল, তারও একটি অংশ (উনিশ শতকের) নব্বইয়ের দশকে লেখা। সেখানে আমার প্রথম যে কবিতা, যা এখনো ছাপা হচ্ছে, তা ১৮৯০-এ লেখা। এখনো ছাপা হচ্ছে। চলছেই।
প্রশ্ন: এটা সম্ভবত আ বয়’স উইল-এ নেই। সেখানে সংকলিত কবিতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটিও সম্ভবত ১৮৯৪ সালে লেখা।
ফ্রস্ট: না, এটা ওই বইয়ে নেই। আমার প্রকাশিত প্রথম কবিতাটা ওখানেই আছে। আমার প্রথম লেখা কবিতাই প্রথম প্রকাশিত কবিতা। ১৮৯০ সালের আগে আমি না গদ্য, না পদ্য—কিছুই লিখিনি। এর আগে আমি লাতিন ও গ্রিক বাক্য লিখতাম।
প্রশ্ন: গারনেট ও পাউন্ডের মতো কিছু সাহিত্য সমালোচক আপনার লেখার প্রসঙ্গে লাতিন ও গ্রিক কবিতার প্রসঙ্গ হরহামেশাই টানেন। আপনি ধ্রুপদী সাহিত্য প্রচুর পড়েছেন?
ফ্রস্ট: সম্ভবত লাতিন ও গ্রিক আমি পাউন্ডের চেয়েও বেশি পড়েছি।
প্রশ্ন: এক সময় লাতিন শেখাতেনও তো?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। পালিয়ে যাওয়ার পর যখন আবার কলেজে ফিরলাম, তখন মনে হলো গ্রিক, লাতিন ও দর্শন হলে আমি বোধ হয় টিকে থাকতে পারব। সেই বছরগুলোয় আমি শুধু এগুলো নিয়েই ছিলাম।
প্রশ্ন: রোমান্টিক কবিদের কবিতা কি প্রচুর পড়তেন? বিশেষত ওয়ার্ডসওয়ার্থ?
ফ্রস্ট: না, আমাকে সেখানে সাঁটা যাবে না। আমি সব ধরনের বিষয়ই পড়েছি। আমার পাঠাভ্যাস নিয়ে জানতে চাইলে কয়েকদিন আগে আমি এক ক্যাথলিক যাজককে বলেছি, ‘আপনি যদি ক্যাথলিক শব্দটির অর্থ বুঝে থাকেন, তবে আমার পাঠাভ্যাস অনেকটাই ক্যাথলিকের মতো।’
প্রশ্ন: আপনার মা আপনাকে কী কী পড়ে শোনাতেন?
ফ্রস্ট: এটা আমি আপনাকে বলতে পারব না। সব ধরনের বিষয়। খুব বেশি নয়, একটু একটু করে সব। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, যিনি আমাদের সমর্থন দিতেন। স্কটল্যান্ডে জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছেন ওহাইওর কলম্বাসে। কলম্বাসে সাত বছর তিনি শিক্ষকতা করেন, বিষয় ছিল গণিত। বাবা হার্ভার্ড শেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার আগে মা তাঁর সঙ্গে এক বছর পড়েছিলেন। হাইস্কুল থেকে বের হওয়ার পরপরই তাঁরা হাইস্কুল পর্যায়েই শিক্ষকতা শুরু করেন। আমার এমন সব শিক্ষক ছিলেন, যারা কখনো কলেজে যাননি। লাতিন ও গ্রিকের দুজন উল্লেখযোগ্য শিক্ষক ছিলেন আমার, যারা কখনো কলেজেই যাননি। তাঁরা ফ্রেড রবিনসনকেও পড়িয়েছেন। তাঁকে আর আমাকে একই শিক্ষকেরা পড়িয়েছেন। ফ্রিটজ রবিনসন, সেই বুড়ো জ্ঞানী। আমার মা ছিলেন ঠিক তেমন। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই হাইস্কুলে পড়ানো শুরু করেন, আর ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন। এই সবকিছু আমি অনেক পরে এসে সূত্রবদ্ধ করেছি, যেমনটা আমি প্রায়শই করি চলতে চলতে। পেনসিলভানিয়ায় তাঁর বিয়ের তারিখটি নিয়ে আমি অনুসন্ধান শুরু করি এবং পেনসিলভানিয়ার লুইসটাউনে এই সূত্রগুলো পাই।
প্রশ্ন: আপনার মা ম্যাসাচুসেটসের লরেন্সে একটি বেসরকারি স্কুল চালাতেন, তাই না?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, চালাতেন, লরেন্সেই। তাঁর স্কুলটি ছিল বেসরকারি। অন্য স্কুলে পড়ার সময়ই আমি সেখানে নিজে পড়িয়েছি। যখনই আমার মন খুশি থাকত, তখনই আমি বিভিন্ন স্কুলে পড়াতাম।
প্রশ্ন: তখন আপনার বয়স কত?
ফ্রস্ট: সেটা ডার্টমাউথ ছেড়ে যাওয়ার ঠিক পরপরই, ১৮৯৩-৯৪ হবে; ২০ বছর বয়স তখন। নগরজীবন নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেই বসন্তের সময় আমি বের হয়ে পড়তাম। তখন স্কুলটিতে সময় দিতাম। আমার মনে হয় আমি দু-তিনবার স্কুলটিতে সময় দিয়েছি; একই স্কুলে। বারোটি শিশুকে নিয়ে ছোট স্কুল, বারোজনই হবে, সবার খালি পা। লরেন্সে আমি পত্রিকাতেও কাজ করেছি। এ ক্ষেত্রে আমি আমার মা-বাবাকে অনুসরণ করেছি। জীবিকার জন্য আমি ঠিক কী করতে চাই, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। অল্পই শিখেছিলাম, কাগজে কাজের অভিজ্ঞতাও নগন্য, কিছুদিন খামারে কাজ করেছি, সেটা ছিল আমার নিজস্ব পলায়ন। পত্রিকায় কাজের ক্ষেত্রে আমি আমার মা-বাবাকেই অনুসরণ করেছি। কিছুদিন একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছি—সাপ্তাহিক পত্রিকা—তারপর নিয়মিত সংবাদপত্রে। লরেন্সে সেই পত্রিকা এখনো টিকে আছে।
প্রশ্ন: যখন কবিতা লিখতে শুরু করলেন, তখন কোনো কবিতে কি মুগ্ধ ছিলেন?
ফ্রস্ট: আমি এই তত্ত্বের ঘোর বিরোধী। স্টিভেনসনের* সেই তত্ত্ব, যেখানে বলা হচ্ছে আপনাকে কারও তোতায় পরিণত হতে হবে। অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে এটিই মার্কিন শিক্ষার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। *(চসারের সম্পাদক; হার্ভার্ডের ইংরেজির সাবেক অধ্যাপক।)
প্রশ্ন: নিজের কবিতার সঙ্গে অন্য কোনো কবির কাজের সঙ্গে কোনো মিল কি কখনো লক্ষ্য করেছেন?
ফ্রস্ট: আমি এটা অন্য কারও কাছ থেকে জানতে চাই। আমি জানব না।
প্রশ্ন: কিন্তু যখন উদাহরণস্বরূপ আপনি রবিনসন বা স্টিভেনস পাঠ করেন, তখন নিজের কবিতার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পান কি?
ফ্রস্ট: ওয়ালেস স্টিভেনস? তিনি আমার বেশ পরের।
প্রশ্ন: আমি বলতে চাইছি, যখন তাকে পাঠ করছেন, তখন আপনি কোনো মিল পাচ্ছেন কি না—
ফ্রস্ট: কোনো সম্পর্ক, আপনি তাই বলছেন তো? না, আপনি এটা বলতে পারেন না। না। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি বিষয় নিয়ে লেখেন।’ আমি বলেছিলাম, ‘আর আপনি লেখেন টুকরো-টাকরা নিয়ে।’ তারপর তাঁর পরবর্তী বই বের হলে তিনি তা আমাকে পাঠিয়ে লিখেছিলেন, ‘আরও কিছু টুকরো।’ আমি এটা ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলাম। না, তাঁর কাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক বোধ করিনি কখনো। আমরা বন্ধু ছিলাম। সে অনেক আগে। আমি জানি না, আপনি আমার সঙ্গে কাকে মেলাবেন।
প্রশ্ন: আমি শুনেছি আপনি একবার বলেছিলেন, রবার্ট লয়েল আপনার সঙ্গে ফকনারের সম্পর্ক রয়েছে বলে দেখাতে চাইছেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি অনেকটা ফকনারের মতো।
ফ্রস্ট: আমি কি এটা বলেছিলাম?
প্রশ্ন: না, আপনি বলেছিলেন রবার্ট লয়েল আপনাকে এমনটা বলেছিল।
ফ্রস্ট: তা দেখুন, রবার্ট লয়েল একবার আমাকে কী বলেছিল জানেন? তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দাদা-পরদাদার মুখের ভাষা ছিল নিউ ইংল্যান্ডের কথ্যভাষা। বার্নস-এর ভাষা আর ‘দ্য বিগলো পেপারসের ভাষা একই তাই নয় কি?’ আমি বলেছিলাম, ‘রবার্ট, বার্নস কোনো ভাষারীতি নয়। স্কচ কোনো ভাষারীতি নয়। এটা একটা ভাষা।’ তিনি যেকোনো কিছুই বলতে পারেন, বাদ দিন।
প্রশ্ন: তাহলে আপনার পাঠে আপনি সচতেনভাবে কখনোই কোনো বিশেষ পথে হাঁটেননি বলে ধরে নিচ্ছি।
ফ্রস্ট: আমি সবটাই পড়েছি। আমার পলায়নের একটি পথ ছিল কবিতা। কোনো কবিতে মুগ্ধ হলেই আমার মনে হতো, নিশ্চয় এমন আরও অনেক আছে। ধরা যাক পুরোনো একজন—শার্লি যেমন, ‘আমাদের রাজ্য ও রক্তের গৌরব’ (দ্য গ্লোরিজ অব আওয়ার ব্লাড অ্যান্ড স্টেট)—কী অসাধারণ কবিতা। আমি আরও খুঁজতে লাগলাম। নেই। এমন আর মাত্র দুটি পেলাম, ব্যাস। মনে আছে সেই সময় আমার সঙ্গের কিছু ছেলে কিছু বিশেষ ধরনের কবিতার প্রতি আগ্রহী হতো। মনে আছে ব্রাওয়ারের কথা—রুবেন ব্রাওয়ার, হার্ভার্ডে মাস্টার অব অ্যাডামস হাউসের পর আমহার্স্টে যে ছিল অন্য কারও ক্লাসের ছাত্র। মনে আছে একদিন বলেছিলাম, ‘কেউ কি আমাকে ওই কবিতাটি পড়ে শোনাবে?’ এটা ছিল এডওয়ার্ডসের পুরোনো কবিতা—‘ইন গোয়িং টু মাই নেকেড বেড অ্যাজ ওয়ান দ্যাট উড হ্যাভ স্লেপ্ট’। সে এটা এত ভালো পড়েছিল যে বলেছিলাম, ‘তোমাকে আমি সারা জীবনের জন্য “এ” দিলাম।’ এভাবেই আমরা পরস্পরের সঙ্গে মজা করতাম। তাকে আমার ক্লাসে নিয়মিত পেতাম না। আমহার্স্টে আমি অন্য ক্লাসগুলোতেও যেতাম মাঝেমাঝে। তাকে আমি খুব দ্রুতই আবিষ্কার করি। কী বলব, সেই পঙ্ক্তিগুলো পাঠের সময় তার কণ্ঠ, কত সহজে সে এই কঠিন কবিতাটি পাঠ করল, যেখানে ছিল সেই পুরোনো উক্তি—‘বিশ্বাসী বন্ধুর প্রস্থানেই হয় ভালোবাসার নবায়ন।’ আমি খুবই ক্যাথলিক ধাঁচের। এটা আমাকে তাড়া করল। সেই সময় জার্মানির শিক্ষিতজনদের মতো আমি ছিলাম না। এমন কিছুই ছিল না। কোনো একজনের সব লেখা পড়তে হবে—এমন ধারণাকে আমি ঘৃণা করি। কিন্তু আমি অনেক কিছু চেখে দেখেছি, সত্যিকার অর্থেই অনেক পড়েছি।
প্রশ্ন: যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখন পাউন্ড যেমনটা পড়তেন, তেমন কবিতা কি আপনিও পাঠ করেছেন?
ফ্রস্ট: না। পাউন্ড তখন প্রণয়গীতি পড়ছিলেন।
প্রশ্ন: কোনো বিশেষ কবিকে নিয়ে কি আপনাদের মধ্যে কথা হয়েছে?
ফ্রস্ট: যখন আমাদের প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি রবিনসন ও দি লা মারে-তে মুগ্ধ। দি লা মারেকে নিয়ে নিজের মুগ্ধতা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন এবং মনে হয় রবিনসনকেও ছুড়ে ফেলেছেন। আমরা বড় জোর দুটি ছোট কবিতা নিয়ে আলাপ করেছি। তাঁর সাথে আমার মাত্র কয়েক সপ্তাহ কেটেছে। তাঁর পদ্ধতি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। উইলি হুইসলারের (জেমস ম্যাকনিল হুইসলার) মতো যাদের তিনি পছন্দ করতেন না, তাদের বিষয়ে তিনি লোকেদের মনে কঠোর ধারণা তৈরি করতেন। ভেবেছিলাম তিনি হুইসলারের প্রভাবে পড়ে যাবেন। তাঁদের পদ্ধতিটি ছিল অনেকটা ফরাসি বক্সিংয়ের মতো। একেবারে দাঁত বরাবর মারতেন তাঁরা।
প্রশ্ন: সম্মান ও নান্দনিকভাবে।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। সেই গানটি তো শুনেছেন, সেই নোংরা গানটি: ‘দে ফাইট উইথ দেয়ার ফিট’। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে পাউন্ড আমাকে বাউন্ডুলেপনার সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন।
প্রশ্ন: সে সময় সেখানে খুব বেশি কি বোহেমিয়ার চর্চা ছিল?
ফ্রস্ট: আমার দেখা যেকোনো সময় ও স্থানের চেয়ে বেশি। আমার ছিল না। তিনি আমাকে রেস্তোরাঁসহ বিভিন্নস্থানে নিয়ে যেতেন। এক রেস্তোরাঁয় আমাকে জুজিৎসু দেখিয়েছিলেন। আমাকে মাথার ওপর দিয়ে ছুড়ে ফেললেন।
প্রশ্ন: তিনি এমন করেছিলেন?
ফ্রস্ট: আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তাঁর মতোই শক্তিশালী ছিলাম। তিনি বললেন, ‘তোমাকে দেখাচ্ছি, দেখাচ্ছি। দাঁড়াও।’ তো আমি দাঁড়ালাম এবং আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি আমরা কবজি ধরলেন, পেছনে টান দিলেন আর মাথার ওপর দিয়ে ছুড়ে ফেললেন।
প্রশ্ন: আপনার কেমন লাগল?
ফ্রস্ট: ওহ, এটা কিছু না। রেস্তোরাঁয় থাকা সবাই দাঁড়িয়ে গেল। নিজেকে তিনি প্রায়ই টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় দিতেন। আমি তাঁর সঙ্গে কখনো টেনিস খেলিনি। তারপর তিনি এমন সব জায়গায় ও এমন সব লোকের কাছে নিয়ে যেতেন, যেখানে থাকত সেই সব বিশেষ কবি, যারা তাদের বিভিন্ন সরঞ্জাম ফেলে এসে জড়ো হয়েছে। তারা ‘বটিনকিসের’ মতো নয় একেবারেই। একটা ঘটনা মনে আছে। একজন কবি ছিল সেখানে, আফ্রোদিতিকে নিয়ে দ্য ইংলিশ রিভিয়ুতে যার একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল; কীভাবে আফ্রোদিতির সঙ্গে লেদারহেডে তার দেখা হলো—এই ছিল বিষয়বস্তু।* *(ফ্রস্ট জন হেলস্টনের কথা বলছেন। কবিতার নাম ‘আফ্রোদিতি অ্যাট লেদারহেড’।) এই কবিতা ইংলিশ রিভিয়ুর মার্চ সংখ্যায় পনেরো পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হলো। তিনি ছিলেন শ্রমিক। তাঁর নাম আমার মনে নেই। তাঁর কথা আর কখনো শুনিনি। হতে পারে তিনি লিখে যাচ্ছেন এবং তাঁর হয়তো বইও আছে। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের শ্রমিক। সাইকেল চালিয়ে আসতেন। চায়ের জলসা হতো। সবাই ছিল উচ্ছ্বসিতভাবে সন্ত্রস্ত, বুঝলেন তো! সন্ত্রাস, সামাজিক সন্ত্রাস। লাল গলা, মোটা, পেটানো শরীরের, শক্তিশালী, অনেকটা জন এল লুইস বা এমন কারও মতো। কিন্তু সে ছিল এক কবি। এজরার (পাউন্ডের) নির্মিত কবিদের দেখলাম। এজরা ভাবত তিনিই এটা করেছেন। যেকোনো একজনকে বাছাই করল, যে কিনা কখনোই কিছু লেখেনি, তাকেই কবি বানানোর কাজে নেমে পড়ত। আমরা এগুলোতে জড়াতাম না।
প্রশ্ন: দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের বই পর্যালোচনা বিভাগে কার্ল শাপিরোর যে প্রবন্ধটি লিড হয়েছে, সেখানে আপনার প্রশংসা করে বলা হয়েছে, আপনি পাউন্ড ও এলিয়টের মতো ‘আধুনিকতাবাদের’ অপরাধে অপরাধী নন। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ফ্রস্ট: এটা মজার না? তারা আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে—আমি যেখানেই যাই, পশ্চিমে কিংবা বিশ্বের যেখানেই যাই তারা প্রশ্ন করে—আধুনিক কবি কী? আমি প্রায়শই এটি এড়িয়ে যাই। এক রাতে আমি বলেছিলাম শুধু, ‘একজন আধুনিক কবিকে অবশ্যই এমন হতে হবে, যিনি যেখানেই থাকুন না কেন, যে সময়েরই হোন না কেন আধুনিক মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে সক্ষম হবেন। এটাকে এভাবে বলা যায় আর কি! (সময় ও স্থান নিরপেক্ষভাবে) তিনি যদি জীবিত থাকতে পারেন এবং মানুষের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে পারেন, তবেই তিনি বেশি আধুনিক বলে বিবেচিত হবেন।’
প্রশ্ন: হ্যাঁ, কিন্তু পাউন্ড বা এলিয়ট যে ভাষায় বা ভঙ্গিতে কথা বলেন তাকে অনেকেই মনে করেন যে, আপনার থেকে একেবারে আলাদা ধাঁচের।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। মনে হয় এলিয়ট পাউন্ডের মতো অত দূরবর্তী নন। আমার কাছে পাউন্ডকে অনেক বেশি গীতিকবির মতো মনে হয়। অনেকটা বেটান ডে বোঁরি ও আর্নট ড্যানিয়েলের মতো বা আরও কয়েকজনের সংশ্লেষিত রূপ বলে মনে হয়। আমি কখনো সে পথে হাঁটিনি। আমি পুরোনো ফরাসি জানি না। আমার যা ছিল না, তেমন বিদেশি ভাষা আমার পছন্দ নয়। ভাষান্তর আমি পড়ি না। আমি দান্তেকে নিয়ে ভয়াবহ ও অস্বস্তিকর কথা বলতে পছন্দ করি। পাউন্ড অবশ্য পুরোনো ফরাসি ভাষা জানতেন বলে মনে হয়।
প্রশ্ন: পাউন্ড একজন ভালো ভাষাতাত্ত্বিক, তাই না?
ফ্রস্ট: আমি জানি না। ফ্লোরিডায় তাঁর একজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি তাকে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘পাউন্ড? লাতিন ক্লাসে আমি তাকে পেয়েছিলাম। আর পাউন্ড শব্দরূপ ও ধাতুরূপের মধ্যকার পার্থক্য কখনোই জানত না।’ তিনি পাউন্ডের ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন। বুড়ো মানুষ, কিন্তু এখনো এজরার ওপর চটে আছেন। (হাসি) পাউন্ডের শত্রু তৈরির শিল্পকলা।
প্রশ্ন: পাউন্ডের খোঁজ জানেন কি? এই সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি?
ফ্রস্ট: না। গত বছর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সে আমাকে দুটি চিঠি লিখেছিল। বেশ মজার ছোট চিঠি।
প্রশ্ন: ওয়াশিংটনে এ নিয়ে কার সঙ্গে কথা বলেছেন?
ফ্রস্ট: অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে একটা রফা হয়েছে। আর্চির (ম্যাকলিশ) সঙ্গে সেখানে আমি দুবার গেছি। কোনো কাজ হয়নি। কারণ তারা আলাদা দলের বলে মনে হয়। আর আমি কোনো দলের নই।
প্রশ্ন: হ্যাঁ, কিন্তু রবার্ট লির নাম কি আপনি নেননি? যেহেতু আপনার বাবা গৃহযুদ্ধের সময় কট্টর ডেমোক্র্যাট ছিলেন? এটা আপনার মধ্যে কিছুটা হলেও ডেমোক্র্যাট ভাব এনে দিয়েছে, নাকি আনেনি?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, আমি একজন ডেমোক্র্যাট। আমি ডেমোক্র্যাট হিসেবেই জন্মেছি। ১৮৯৬ সালের পর থেকেই আমি অসুখী। কেউ একজন বলেছিল, ‘এটা হওয়া, আর রিপাবলিকান হওয়ার মধ্যে তফাৎ কী?’ আমরা হেরে যাব; বিশেষত আর্চি যখন ভাবল যে আমরা হেরে যাব, তখনই আমি সেখানে গেলাম। আমি একাই গেলাম। সোজা অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে গিয়ে বললাম, ‘এজরা পাউন্ডের বিষয়ে আপনার মনোভাব জানতে আমি এখানে এসেছি।’ সেখানে তারা দুজন তখন একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আমাদের মনোভাব আমাদের। তাকে মুক্ত করি চলুন।’ ঠিক এটাই হয়েছিল। আর আমি বললাম, ‘এই সপ্তাহে?’ তারা বললেন, ‘আপনি বললে এই সপ্তাহেই। আপনি একজন আইনজীবী ঠিক করুন। আমরা কোনো আপত্তি জানাব না।’ তাই যেহেতু তারা রিপাবলিকান, সেহেতু আমি গিয়ে বন্ধুত্ব পাতালাম থারম্যান আর্নল্ডের সঙ্গে। বামপন্থী সেই ভালো লোকটিই হলেন আমার আইনজীবী। সে রাতে বসেই আমি আদালত বরাবর একটি আবেদন লিখলাম, আবার ছুড়েও ফেললাম। সকালে শহর ছাড়ার ঠিক আগে আরেকটি আবেদন লিখলাম। এবারেরটি ছোট। এটুকুই। এজরা খুবই ছোট একটি চিঠির মাধ্যমে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল: ‘তুমি যা করছ, তার জন্য ধন্যবাদ। এর ধারাবাহিকতায় একটা ছোট আলাপ দাবি করে।’ তারপর বড় করে নিজের নাম সই করা। তারপর সে আরেকটি চিঠি পাঠাল, আরেকটু আবেগপূর্ণ।
প্রশ্ন: ইতালির উদ্দেশ্যে তিনি রওনা হওয়ার আগে কি তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?
ফ্রস্ট: না, না, আমি তাকে কায়দা করে বিদায় জানাতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, আমার কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি তার হোক। কিন্তু সে আমার প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধ করেছিল। জানেনই তো তার অবস্থা ভালো ছিল না। (ফ্রস্ট এখানে যা বলতে চেয়েছেন, তা পরে একান্ত আলাপে স্পষ্ট হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, পাউন্ডের কিছু বন্ধু, বিশেষত মেরিল মুরের কথা, যাদের বক্তব্য ছিল পাউন্ডের জন্য ভালো হবে সেন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে থাকা। মুর বলেছিলেন, পাউন্ডের সেখানে ছোট একটি ঘর ছিল।) যা হোক এটা ছিল দুঃখজনক একটা বিষয়। সে একজন কবি। এ বিষয়ে আমি কখনোই, কখনোই প্রশ্ন তুলিনি। আমরা সব সময়ই বন্ধু ছিলাম, আছি। কিন্তু যুদ্ধের সময় সে যা করেছে, তা আমি পছন্দ করিনি। আমি আরেকজনের মারফত বিষয়টি জেনেছি। ফলে এটি আমি সেভাবে বিচার করে দেখিনি। কিন্তু এটা ভীষণ বাজে ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। সে বোকার মতো এর ওপর বাজি ধরেছিল। আর যখন কেউ এভাবে হেরে যায়, তখন তাকে এ নিয়ে পীড়ন করতে চাই না আমি।
প্রশ্ন: আমি আপনার কবিতার সঙ্গে অন্যদের কবিতার তুলনা নিয়ে বহু প্রশ্ন করেছি। কিন্তু আরও বহু বিষয় রয়েছে, যা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ আপনি বিজ্ঞানের প্রতি ভীষণ আগ্রহী।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, আপনি আপনার সময়ের বিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হবেনই, তাই না? অনেকেই আমার যাবতীয় লেখায় জ্যোতিষ বিজ্ঞানের প্রভাবকে শনাক্ত করেছেন।
প্রশ্ন: যেমন, ‘দ্য লিটারেট ফার্মার অ্যান্ড দ্য প্লানেট ভেনাস’?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। কিন্তু এটা ওই বইয়ের সবটাজুড়ে আছে, সবটা জুড়ইে। অনেক কবিতা, অন্তত বিমটির নাম আমি বলতে পারব, যেখানে জ্যোতিষবিজ্ঞানের বিষয় আছে। একদিন একজন এটা এভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি কতটা আগ্রহী, তা কেউ শনাক্ত করল না কেন?’ আপনি এটাকে একটা পক্ষপাত বলতে পারেন। অনেক পুরোনো একটা বই, যা আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে; নাম ছিল ‘আওয়ার প্লেস অ্যামং ইনফিনিটিস’। প্রক্টর নামের ইংল্যান্ডের এক নামকরা জ্যোতির্বিদের লেখা। এটা উল্লেখযোগ্য পুরোনো একটি বই। আমার এক কবিতায় এর কথা আমি উল্লেখ করেছি। সেখানে আমি এই বইয়ের নামটিই ব্যবহার করেছি। বলেছি যে, তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে যখন আমি পড়তে শুরু করি, তখন কোনো বই পড়া শুরুর সময়েই আমার এই বইটি পড়তেই হতো। সঙ্গে ছিল ‘দ্য স্কটিশ চিফস’। মনে আছে, সে বছরের কথা, যে বছর আমি একটি বই পুরো পড়তে শুরু করি। আমার এক ছোট বোন ছিল, যে বই পড়ত, প্রচুর বই, সব ধরনের সবার বই। সে ছিল খুবই দারুণ। আমার ক্ষেত্রে—আমার জন্য এই দরজা খুলে যায় মূলত আমার দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে।
প্রশ্ন: যখন আমরা বিজ্ঞান ও সাহিত্য নিয়ে আলাপ করছি, তখন প্রশ্ন আসেই যে, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) যে সাহিত্যের ওপর কয়েকটি কোর্স শুরু করল, তা নিয়ে কী ভাবছেন?
ফ্রস্ট: আমার মতে তারা উচ্চতর গণিত ও বিজ্ঞান নিয়ে থাকলেই ভালো করবে। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান। আমার এই ভাবনার কথা তারা জানে। আমি তাদের এ নিয়ে বেশি সমালোচনা করতে চাই না। এটা অনেকটা এ রকম যে, মানুষের সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার হলো বিজ্ঞান। বস্তুর বা মহাবিশ্বের ভেতরে গিয়ে তার মধ্যে অভিযান চালানোটাই তার সবচেয়ে বড় অভিযান। কিন্তু এই অ্যাডভেঞ্জারই আমাদের ধর্ম, মানুষের ধর্ম, আর আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো মানবিকতা। হয়তো বিজ্ঞানীরা চাইছেন তাদের শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দিতে যে, কে আসলে বিজ্ঞানের জগতে এই অভিযানে নেমেছে। মনে করিয়ে দিতে চাইছেন যে, বিজ্ঞান আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে অল্প কিছুই যোগ করে, সামান্য কিছু। হতে পারে এটা মনোবিজ্ঞান বা এমন কিছুর মাধ্যমে, কিন্তু এটা কিছুটা অদ্ভুতুড়ে। আর তাই, বিজ্ঞানীরা হয়তো শিক্ষার্থীদের অর্ধেক সময় নিতে চাইছেন মানবিক শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে।
এটা কিছুটা অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। তারা আমাদের নিয়ে এবং বিশুদ্ধ বিজ্ঞান নিয়ে বরাবরই একটু বেশি উদ্বিগ্ন। বরং তাদের পক্ষে নিজেদের বিষয় নিয়ে যতটা যাওয়া যায়, ততটা এগোনো ভালো। একবোরে শুরুর দিকে আমি সেখানে ছিলাম এবং এ নিয়ে আমার সংশয়ের কথা জানিয়েছিলাম। এক রাতে কম্পটনের (এমআইটির প্রেসিডেন্ট কার্ল কম্পটন, ১৯৩০-১৯৪৮) সঙ্গে ছিলাম আমি। সেই আলোচনায় তিনি আমার পাশেই বসেছিলেন। ‘বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের জগতে আমাদের কিছু খামতি আছে, তাই না?’ দর্শকদের সামনেই আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বলালাম। তিনি বললেন, ‘হতে পারে—আমার মনে হয় তাই।’ বললাম, ‘সেই খামতি পূরণের দিকেই এগিয়ে যাওয়াটা ভালো।’ সে অনেক বছর আগের কথা।
প্রশ্ন: মাত্রই মনোবিজ্ঞানের কথা বললেন। একসময় মনোবিজ্ঞান পড়েছেন, তাই না?
ফ্রস্ট: ওটা ছিল পুরোটাই তামাশা। আমি মনোবিজ্ঞান পড়াতে পারতাম। মনোবজ্ঞিানীদের প্রতিষ্ঠানে আমাকে যোগ দিতে বলা হয়েছিল (মিরেল মুর বলেছিলেন)। সেটা অনেক বেশি গুরুতর বিষয় ছিল। কিন্তু আমি গেলাম টিচার’স কলেজে (বর্তমানে প্লাইমাউথ স্টেট ইউনিভার্সিটি) সেখানকার ভ্রান্ত ধারণা ঘোচাতে যে, তাদের ক্লাসরুমে তৈরি হওয়া ধারণার সঙ্গে অন্য যেকোনো মনোবৈজ্ঞানিক ধারণার কোনো না কোনো সংযোগ রয়েছে; এই ভ্রান্তি দূর করতে যে, মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট ধারণা থাকলে তারা যা কিছু, তাই করতে পারে। তারা এমনটাই ভাবত।
প্রশ্ন: একসময় তো আপনি উইলিয়াম জেমসের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন?
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। এটাই অনেকটা আমাকে হার্ভার্ডে ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সেখানে থাকার সময় তিনি বরাবরই আমার থেকে দূরে ছিলেন। সান্টিওনা, রয়েসসহ দর্শনের লোকেদের মাঝে আমি ছিলাম। ছিলেন মানস্টারবার্গ, জর্জ হার্বার্ট পামারের মতো কবিরা। তাদের সবার সঙ্গেই আমার সংযোগ হয়েছিল। কিন্তু আমি সেখানে জেমসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তারপর একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
প্রশ্ন: সে সময় কি সান্টিওনার প্রতি আপনি খুব আগ্রহী হয়েছিলেন?
ফ্রস্ট: না, বিশেষভাবে না। তবে হ্যাঁ, আমার সব সময় অবাক লাগত যে, তিনি সব সময় ভাবছেন যে তিনি কোথায় যাচ্ছেন, আর সব কীভাবে ঘটে চলেছে। বিষয়টি কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করেছি। তাকে কখনো ব্যক্তিগতভাবে জানতাম না। কলেজে থাকতে আমি কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে জানতাম না। আমি অনেকটা নিজের মতোই থাকতাম। কিন্তু তাকে আমি পছন্দ করতাম। সেই চমৎকার উচ্চারণ—তিনি ছিলেন এমন কিছু, যাকে শুনতেই হতো, অনেকটা তার লেখার মতোই। কিন্তু তিনি কী বলতেন, তা আমি বুঝতাম না। অনেক বছর পর টের পাই তার কথার মধ্যে ছিল এক ভ্রান্তির জগৎ; দুই ধরনের, সত্য ও মিথ্যা। আমার মনে হলো—মিথ্যার ভ্রান্তিই সত্য হবে বোধ হয়। কারণ, দুই নেতিবাচক তো ইতবিাচকতারই জন্ম দেয়।
প্রশ্ন: কবিতার বাইরে আপনার আগ্রহের বিষয়াদি নিয়ে যেহেতু কথা হচ্ছে, তখন আমরা রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলতেই পারি। মনে আছে এক সন্ধ্যায় আপনি বলেছিলেন, আপনার ‘প্রোভাইড, প্রোভাইড’ কবিতার সঙ্গে কোনো একভাবে হেনরি ওয়ালেস যুক্ত।
ফ্রস্ট: এ ধরনের বিষয়কে লোকে বাড়িয়ে বলে। আমি যখন কবিতাটি পড়ি, তখন ওয়াশিংটনে হেনরি ওয়ালেস ছিলেন। সামনের সারিতেই বসেছিলেন। যখন কবিতার শেষাংশ পড়ছি, তখন দেখলাম তিনি ও তার স্ত্রী হাসছেন।
প্রশ্ন: ‘নিউ ডিলার’ হিসেবে আপনার তেমন খ্যাতি নেই। (অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি তোলা ডেমোক্রেটিক দলের বাম ধারা, যারা সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের কথা বলত। তিরিশের মহামন্দার সময়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে ১৯৩৩-১৯৩৯ সময়ে এই ধারা বেশ জোরালো হয়ে ওঠে।)
ফ্রস্ট: তারা মনে করে আমি ‘নিউ ডিলার’ নই। বাস্তবে এবং সত্যিকার অর্থেই আমি তা নই। এটা খুবই স্পষ্ট। বহু বছর আগে লেখা, এই নিউ ডিলের বহু আগে ‘দ্য ডেথ অব দ্য হায়ারড ম্যান’ লেখায় আমি ঘর সম্পর্কে দু ধরনের ভাবনার কথা উল্লেখ করেছি। একটি হচ্ছে পুরুষের দৃষ্টিতে: ‘ঘরে হলো এমন দেশ; যখনই যেতে চাইবে/ তারা তোমাকে গ্রহণ করবে।’ ঘর সম্পর্কে পুরুষের অনুভূতি এমন। এই কথার উত্তরে লোকটির স্ত্রী বলছে: ‘আমি একে বলতে চাই/ ঘর এমনই, যার জন্য যোগ্য হতে হয় না।’ এটাই নিউ ডিল, নারীর দৃষ্টিভঙ্গী, মায়ের দৃষ্টিভঙ্গী। আপনাকে মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য হতে হয় না। কিন্তু বাবারটা পেতে যোগ্য হতে হয়। সে অনেক বেশি স্বতন্ত্র। এদের একজন রিপাবলিকান, একজন ডেমোক্র্যাট। বাবা তার সন্তানের ক্ষেত্রে বরাবরই রিপাবলিকান (রক্ষণশীল), আর মা সবসময় একজন ডেমোক্র্যাট (উদারনৈতিক)। খুব অল্প লোকই দ্বিতীয় বিষয়টিকে শনাক্ত করতে পারে। তারা শেষটাকেই শনাক্ত করে, পুরুষের কাঠিন্যকে শনাক্ত করে।
প্রশ্ন: এই কবিতাটি সংকলনে খুব কমই দেখা যায়। আপনার কবিতার সংকলনগুলো কি আপনার ঠিকঠাক প্রতিনিধিত্ব করছে?
ফ্রস্ট: যখন কেউ আমার কোনো কবিতাকে নতুন করে তুলে আনে, আমি খুশি হই। আমি জানি না। অন্যদের মতো করে বলতে চাই—আমি এটা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় ‘বার্চেস’ বা এমন অধিকাংশ কাব্য সংকলনে স্থান পাওয়া কবিতাগুলো ‘তমসাচ্ছন্ন’, যেমনটা লিওনেল ট্রিলিং আপনার ৮৫তম জন্মদিনে জোর দিয়ে বলেছেন?
ফ্রস্ট: জানি না। ট্রিলিংয়ের কথার পর আমার উচিত ছিল নিজের বইগুলোয় আবার নজর বোলানো এবং বিস্ময় নিয়ে বলা যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন অনেক কিছুই যে আছে, তা কেন তিনি আগে খেয়াল করলেন না। পুরোটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন।
প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয়েছে? তিনি কি জনপরিসরে আপনাকে নিয়ে থাকা ‘ভুল ধারণা’, বিশেষত আপনার কবিতা সম্পর্কিত কিছু সাধারণ ভুল ধারণা ঠিক করার কথা ভেবেই এটা করেছেন?
ফ্রস্ট: তিনি নিজেই ভুল করেছেন। তিনি নিজেই এটা স্বীকার করেছেন, তাই না? আমার লেখায় ঢুকতে তিনি কী সংকটে পড়েছিলেন, তা বলছিলেন। অনেকটা স্বীকারোক্তির মতো, কিন্তু আনন্দদায়ক।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনার অনেক ভক্তই আপনার কবিতা নিয়ে তার বলা ওই দুটি শব্দ—‘অন্ধকারময়’ ও ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে আপত্তি করেছেন।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ। অবশ্য ওই রাতে তিনি আমাকে কিছুটা বিস্মিতই করেছিলেন। তিনি আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তার পরই আমার কথা বলতে হতো। জন্মদিনের পার্টি। আমাকে নিয়েই। এতে আমি কষ্ট পাইনি। প্রথমে অবশ্য ভেবেছিলাম তিনি আমাকে আক্রমণ করছেন। তারপর যখন তিনি সফোক্লিস ও ডি এইচ লরেন্সের সঙ্গে আমার তুলনা করতে লাগলেন, তখন আমি যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। এই দুজনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী! সফোক্লিসের বিষয়টা হয়তো আমি পছন্দ করতাম, কিন্তু আমি ধন্ধে পড়ে গেলাম। আর ডি এইচ লরেন্সের বিষয়টি আমাকে আক্ষরিক অর্থেই অথৈ সাগরে নিয়ে ফেলল। তারপরও এসব ঠিক আছে। আমাকে তারপরই কথা বলতে হতো এবং নিজের কবিতা থেকে পাঠ করতে হতো। তো আমি এই ভেবে বিপাকে পড়ে গেলাম যে, তার এই কথার পর আমি কী পাঠ করব। তার এই লেখা আমি আগে পড়িনি, সেখানেই পেয়েছি। আমি তার লেখা আগে অতটা পড়িনি। আমি সমালোচনা পড়ি না। এই ঘরে আপনি কোনো ম্যাগাজিন পাবেন না।
প্রশ্ন: তার এই বক্তব্যের পর আপনি পার্টিজান রিভিউতে যখন এর স্বপক্ষে তার লেখাটি পড়লেন, তখন কি একটু ভালো বোধ হয়েছিল?
ফ্রস্ট: তার বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তিগুলো আমি পড়েছি। খুবই চাতুর্যপূর্ণ ও আগ্রহোদ্দীপক। ভালো লাগল। তিনি খুবই বুদ্ধিমান। কিন্তু আমি এমন লেখা, বিশেষত ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখা আমি খুব কম পড়ি। শাপিরোর সেই লেখাও আমি পড়িনি। কিন্তু তার বক্তব্য ছিল আমার জন্য নতুন কিছু। তিনি কি আমার বন্ধুস্থানীয়?
প্রশ্ন: হ্যাঁ। আপনার বন্ধুই হবেন। কিন্তু অন্য সব বন্ধুর মতোই। আপনার কাছের বন্ধুদের তুলনায় আপনি অনেক বেশি সহজ—এটাই তিনি দেখাতে চাইছিলেন। অনেকটা জে ডোনাল্ড অ্যাডামসের মতো, যিনি ট্রিলিংয়ের বক্তব্য খণ্ডন করে আপনার পক্ষ হয়ে একটা রাগী লেখা লিখেছেন টাইমসে। তবে জে ডোনাল্ড বোধ হয় আপনাকে তেমন ভালো বোঝেন না।
ফ্রস্ট: শাপিরো কী বলছিলেন?
প্রশ্ন: তিনি বলেছেন, অধিকাংশ আধুনিক কবিতা অস্পষ্ট ও অতিজটিল, যা বিশেষত পাউন্ড ও এলিয়টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এই কথা আপনার ক্ষেত্রে সত্য নয়।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, আমি জটিল হতে চাইনি। বোকা বানাতে চেয়েছি—জানেনই তো, বজ্জাতি এক ধরনের। কিন্তু একগুঁয়ে ও নাছোড়বান্দা ভ্রম তৈরির একঘেয়ে পথে হাঁটিনি।
প্রশ্ন: আপনার কবিতায় যতটা জটিলতা, তা মূলত বহুস্বরে জোর দেওয়ার কারণে। একবার বলেছিলেন, সচেতন বা অবচেতনভাবে কোনো বক্তব্যের দ্বৈত অর্থ তৈরির ক্ষেত্রে আপনি স্বরের ভিন্নতার ওপরই জোর দেন।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, আপনি এটা করতে পারবেন। যা বলেছি, তার সবটাই অব্যক্ত রেখে দিতে পারেন। অনেক কবিতাতেই এই বৈপরীত্যের বিষয়টি আছে। খুবই ঘনিষ্ঠ লোকেদের সঙ্গে এই বৈপরীত্যের ঢঙে আলাপ জুড়তে পারেন। তারা বুঝবে আপনি কী বলছেন। এই ইঙ্গিত, পূর্বাভাস ও বিপরীতের ঐক্য মিলেই তৈরি হয় চূড়ান্ত ইঙ্গিতটি। বিশ্বস্ত লোকেদের সঙ্গে চাইলে ইঙ্গিত ও পূর্বাভাসের ভাষায় কথা বলা যায়। যে ইঙ্গিত আপনি দিয়েছেন, তা বুঝতে না পারলে বা বিপরীতভাবে ইঙ্গিতটি ভুলভাবে পাঠ করলে এমনকি পরিবারও ভেঙে যায়। মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে তাকালে চারপাশে এটাই দেখবেন। আমি জানি না। না, জানি না। আমি সাহিত্যিকের মতো জীবন কাটাইনি। এই বন্ধুরা, তারা সত্যিই নিজেদের বর্ণনার জন্য, নিজেদের বোঝার জন্য তাদের গদ্য নিয়ে কাজ করেছে। আমি এটা করিনি। আমি নিজের সম্পর্কে খুব বেশি জানতে চাইনি। আমি জটিল নই—শাপিরোর এই ভাবনা আমাকে কৌতুহলী করল। এটা ঠিক আছে। আমি এই জীবনে কখনো কোনো আলোচনা, কোনো প্রবন্ধ লিখিনি। আমি প্রতিনিয়ত প্রবন্ধ লেখার বিষয়টি এড়িয়ে গেছি। তারা সবাই সাহিত্যিক দুনিয়ার মানুষ। আমার সময় ছিল না; আপনি জানেন আমি এগুলো নিয়ে কাজ করিনি। আমি প্রাতিষ্ঠানিক নই; ওটা আমার কাঙ্ক্ষিত দুনিয়া না। কিন্তু আমি কিছু আবাদ করেছি; আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি হেঁটে বেড়িয়েছি; অন্য লোকেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রচুর কথা বলতে ভালোবাসি। কিন্তু আমার তেমন সাহিত্যিক জীবন ছিল না, কখনোই সেভাবে সংঘবদ্ধ ছিলাম না। আমি পোয়েট্রি সোসাইটি অব আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট; না সম্মানিত প্রেসিডেন্ট। বেশ আগে একবার (এমন দায়িত্বে ছিলাম)। আমি তাদের ভালো চাই। আমি চাই সেই ফাউন্ডেশন তাদের সবাইকে জায়গা করে দিক, যত্ন নিক।
প্রশ্ন: ফাউন্ডেশনের কথা আসছে, সাহিত্যিক ছলকে আপনি কেন সংস্কৃতি বিবর্জিত বিষয় বলে জ্ঞান করলেন?
ফ্রস্ট: এটা মজার বিষয়। তাদের অধিকাংশই কলেজে গেছে এবং কবিতাকে তাদের মধ্যে ঢুকতে দিয়েছে। যেকোনো ভাষায় তারা যা-ই পড়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই কবিতা। একটু ভাবুন। ফলে এর প্রতি তাদের একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং আমাদের প্রজন্মের করা নানা দুর্ব্যবহারকে তারা মেনে নিয়েছে। তারা হচ্ছে সেই প্রজন্ম, যারা মনে করে, আমাদের কল্পনাশক্তি তেমন নয়—আমাদের ব্যবস্থায় কল্পনার স্বল্পতাকেই তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। আমাদের যথেষ্ট কল্পনাশক্তি থাকলে যেন আমরা রুশদের পরাস্ত করতে পারতাম। আমি এটা বলতে ভালোবাসি যে, ‘এমিলি ডিকিনসন সঙ্গে থাকলে আমরা হয়তো গৃহযুদ্ধ জিততাম।’ অথচ আমরা জানতামই না যে, তিনি সেখানে ছিলেন। খুবই মজার ব্যাপার।
প্রশ্ন: ভালো কবির চেয়ে কবিতার জন্য ভালো পুরস্কারের সংখ্যা এখন বেশি—এই কথার সঙ্গে কি আপনি একমত হবেন?
ফ্রস্ট: জানি না। এভাবে বিচার করা আমি অপছন্দ করি। আমাদের নিয়ে যাবতীয় ফাউন্ডেশন নিয়ে তাদের কৌতূহলী হওয়াটা দারুণ। এগুলো থেকে কী বেরিয়ে আসবে, তা কেউ জানে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বিসর্জন ও ঝুঁকির অনুভূতিই হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বড় চালিকাশক্তি। এটা থেকেই আপনি যা পাওয়ার পাবেন। সরিয়ে নিলে দেখবেন, কবি হওয়ার মধ্যে কোনো ঝুঁকিই নেই। বাজি ধরে বলতে পারি, আপনি আপনার পবিত্র আত্মার অনেকাংশই তাহলে হারিয়ে ফেলবেন। যন্ত্রণাবোধের জন্যই তারা সেখানে আছে। একবার আমাকে জনসম্মুখে চার-পাঁচ শ নারীর সামনে প্রশ্ন করা হলো—আমি লেখার অবসর কীভাবে পাই। আমি বললাম—‘গোপনে বলি, যেহেতু মাত্র পাঁচ শ জন এখানে উপস্থিত এবং সবাই নারী—চোরের মতো কিছুটা চুরি করে নিই, অন্য পুরুষদের মতোই কিছুটা বন্দী করে ফেলি, আর আমার ছোট টিনের কাপে অল্প জায়গাই আছে।’ মনে হতে পারে আমি অনেকটা ভিক্ষুকের মতো। কিন্তু সচেতনভাবে আমি কখনোই ভিক্ষুক নই। আমি ভাগ্যবানদের একজন... কলেজসহ সব জায়গায় সুবিধাপ্রাপ্তদের একজন আমি। মার্কিন ধারার মতো করেই একটা সুবিধা আমার আছে: কারও কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেওয়ায় ধন্যবাদ জানিয়ে কোনো চিঠি আমাকে লিখতে হয়নি কখনো। কলেজ পেরিয়ে গেছি এর মধ্যেই। কবিতা সব সময়ই ভিক্ষুক ছিল। বিদ্বৎজনেরাও ভিক্ষুকই ছিলেন। কিন্তু তারা কলেজ প্রেসিডেন্টদের কাছে তাদের ভিক্ষাবৃত্তিকে মহানভাবে উপস্থাপন করতেন।
প্রশ্ন: আমি বলছিলাম, বর্তমানে সম্মানিত হওয়ার যোগ্য লোকেদের তুলনায় পুরস্কারের সংখ্যা বেড়ে গেছে হয়তো। আর এমন পরিস্থিতিতে মাঝারিপনার পালে কি হাওয়া লাগে না? একই সঙ্গে এটি সত্যিকারের মেধাবীদের শনাক্ত ও সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা কিনা?
ফ্রস্ট: এমন প্রশ্ন আমাকে আগেও করা হয়েছিল। আর আমি বলেছিলাম, কোনো একটা অবস্থানে পৌঁছাতে হলে কোনো ব্যক্তির সামনে ঠিক কী পরিমাণ সংকট উপস্থিত হতে হয়, তা আমি কখনো বলতে পারব না। এটা আপনি কখনোই পরিমাপ করতে পারবেন না। কোনো মনোবিজ্ঞানই আপনাকে এরহ হদিস দিতে পারবে না যে, দৌড়ে জেতার জন্য কোন লোকটির পিঠে চাবুক, আর কার পিঠে চাপড় দরকার। এ বিষয়ে আমার এই বোঝাপড়াটা আমি বেশ পছন্দ করি, যদিও অন্যরা এভাবে ভাবে কিনা জানি না। কবিতাকে আমি একটা পারফর্ম্যান্সের দৃষ্টিতে দেখি, কবিকে দেখি পরাক্রমশালী হিসেবে, অনেকটা এথলেটের মতোই। তিনি একজন পারফর্মার। আর কবিতায় এমন অসম্ভব বৈচিত্র্য আনা যায়, যা বলার নয়। অবয়ব ও বাগ্রীতি বদলে বদলে যায় বরাবর। আমার দারুণ লাগে যখন আমি দুই-তনি স্তবক লিখি, তারপর আমি সেই সব বাক্যের মধ্যে নিবিষ্ট হয়ে থাকি। একই স্তবকে সব পঙ্ক্তির বিন্যাশ আমি অপছন্দ করি। প্রতিটি কবিতাই আমার কাছে এক ধরনের পারফর্ম্যান্স। কেউ একজন (থমাস ন্যাশ) বলেছিল যে, ‘তাবৎ বিষয়াদির মাঝখানে কবিতা হলো বৌদ্ধিক মজ্জার মতো। বৈদগ্ধ থাকতে হয়। এই দারুণ পরিশ্রমে পাওয়া বস্তুটির একেবারে শেষ সারটুকু এই বৈদগ্ধই। এটা একেবারেই চকচক করে না।’
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কাব্যিক হোক, আর যা-ই হোক, চিন্তা মাত্রই সাংগঠনিক কৌশল। তারা গিবনের (দ্য হিস্টোরি অব দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার) কথা বলে। তিনি যখন মারা যান, তখনো তিনি তাঁর ইতিহাস বর্ণিত সমান্তরাল এক সত্তা হিসেবেই মারা যান। সকল চিন্তাই আদতে সংঘের কৌশল। যা সামনে আছে, যা উঠে আসছে, তা বুঝে ওঠার আগে, তা টের পাওয়া বড় মুশকিল। এটার সঙ্গে ওটাকে মেলাতে হয়, আর তখনই জেগে ওঠে।
প্রশ্ন: এই সাংগঠনিক বা সংঘের কৌশল আসলে কীভাবে কাজ করে?
ফ্রস্ট: এটা ধরুন অনেকটা আমার একটা মুখোশ কোনো একটা সংঘ ধারণ করল বা তার ওপর চেপে বসল। ঈশ্বর বললেন, ‘জব, আমি শয়তানের সামনে নিজেকে জাহির করলাম শুধু।’ জব এ কথায় কিছুটা বিচলিত হলো, কিছুটা হতাশও। ঈশ্বর বললেন, ‘তুমি কি কিছু মনে করেছ?’ আর সে বলল, ‘না, না।’ সে বলল, ‘না।’ বলতেই থাকল। বলবার এই ভঙ্গিটাই সব। মানে যেভাবে ‘না’ বলা হলো। আমি টের পেলাম এটাই আমাকে এটা লিখিয়েছে। এই একটা বিষয়ই।
প্রশ্ন: আপনার আরেক মুখোশ—‘আ মাস্ক অব মার্সি’ কি এ ধরনের প্রেরণা থেকেই লেখা?
ফ্রস্ট: আমি দেখলাম বিশ্বের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকে ক্ষমাই হলো মূল বিষয়, যেমনটা আছে (বুক অব) জোনাহ-এ। বাইবেলের শুরুর দিকেও কোনো এক জায়গায় আছে, নগর ঢুড়ে যদি দশজন ভালো লোক পাওয়া যায়, তবে তুমি কি তাদের হাতছাড়া করবে? কিন্তু জোনাহ-এর ঘটনায় এর চেয়েও বাজে নমুনা আছে। জোনাহকে বলা হলো সেই নগরে গিয়ে নগরের ধ্বংস নিয়ে ভবিষদ্বাণী দিতে। জোনাহ ভাবলেন, ঈশ্বর তাকে পরাজিত করবেন। আবার ইশ্বরকে ক্ষমাহীন বলে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। ঈশ্বরকে আপনি যেকোনোভাবেই কল্পনা করতে পারেন, ক্ষমাহীন নয়। ফলে তিনি পালিয়ে গেলেন এবং তিমির পেটে আশ্রয় নিলেন। এটাই দেখার জায়গা। অথচ কেউ শনাক্তই করল না। এড়িয়ে গেল।
প্রশ্ন: ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মযাজকদেরই এই মুখোশের সর্বোচ্চ গ্রহীতা বলে আপনি কেন মনে করেন?
ফ্রস্ট: দারুণ তো, আপনি এটা বললেন। আইনের বাইরে অন্য সম্প্রদায়গুলো কিন্তু এটা দেখতে পায় না। তারা এটা ভাবতেই বেশি পছন্দ করে যে, তাদের মধ্যে বিদ্রোহ আছে। এই ধারণাটা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। কিন্তু এমন কিছু তাদের মধ্যে নেই। তারা বিদ্রোহী নয়। তারা উভয়েই ভীষণ তত্ত্বপ্রেমী ও প্রচল ধারার। কিন্তু আপনি এটা কী করে বুঝলেন? খুবই মজা পেলাম। দেশের যেখানেই গেছি, রাব্বি ও যাজকেরা উভয়েই আমার প্রতি ভীষণ সদয় ছিলেন। আমি তাদের সঙ্গে কানসাস সিটিতে থেকেছি একসঙ্গে। দেখুন এই মুখোশগুলোর সবই ভালো প্রচলিত মতবাদের। তারা এটা প্রচার করে যে, ভালো ও মন্দ একটা আরেকটার ওপর জাহির করে নিজেদের। কানসাস সিটিতে থাকার সময় আমি এ নিয়ে চট করে দ্বিপদী লিখলাম—‘তাদের এই মুখোমুখি ছাঁচে/ ভালো-মন্দ এতটা দিন ধরে বেঁচে আছে।’
প্রশ্ন: দ্বিপদী লেখা কি অনেকটা চট করে লেখার মতো? এক তরুণ কবিকে চিনি আমি, যার দাবি—প্রতি সকালে ক্লাসে যাওয়ার আগে ৬-৯টার মধ্যে সে লিখতে পারে।
ফ্রস্ট: বিড়াল বশের তো একটা মাত্র রাস্তা নেই, বহু রাস্তা। আমার ক্ষেত্রে কোনটি, আমি জানি না। যখন আমি কোনো কিছু শুরু করি, আমি চলতেই থাকি। একেবারে প্রথম লেখাটি আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে লিখতে শুরু করেছিলাম, সৃষ্টি করতে শুরু করেছিলাম, কোনো এক মার্চে। পুরো বিকাল আমি এটা লিখেছি এবং এটা নিয়েই পড়ে ছিলাম এমনকি রাতের খাবারের জন্য দাদির কাছে যেতেও দেরি হয়েছিল। শেষ করলাম। কিন্তু এটা পুড়ে গেল। কিন্তু এটা কীভাবে হলো? কীভাবে পুড়ল? বহু কথা। কত যে অসাধুতা, কত যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে লিখে যেতে হয়। প্রায়ই আমার একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়: ‘লেখকের কান্না না থাকলে, পাঠক কাঁদবে না। লেখক বিস্মিত না হলে, পাঠকও বিস্মিত হবে না।’ কিন্তু আমি তো এও বলেছি: ‘বিক্ষোভ ছাড়া কোনো দুঃখবোধ, খেদ জন্মাতে পারে না।’ কোনো কিছু যখন এত বড় যন্ত্রণার হয়, তখন তার মধ্যে কেউ সুসময় দেখবে কী করে? আমি যা বলতে চাই, তা আমি কোন নারকীয় সুসময়ে বসে লিখছি? পুরো বিষয়টিই আসলে পারফর্ম্যান্স, পরাক্রম ও সংঘের কৌশল। সমালোচকেরা কেন এগুলো নিয়ে কথা বলে না। কোন কৌশল বা কোন সংঘজোরে লেখাটি এ পথে গেল, কিসের স্মরণ, কোন অভিমুখ? তারা এগুলো নিয়ে কেন কথা বলে না। নম্বর। আপনাকে নম্বর পেতে হবে। তারা স্বীকার না করলেও এটাই সত্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে—ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, জ্যোতিষশাস্ত্র, ইতিহাস এবং এই দেশে আপনার বেঁচে থাকা এই সবকিছুতেই এটা সত্য।
প্রশ্ন: তরুণ কবিরা কি আপনাকে উপহার পাঠায়?
ফ্রস্ট: মাঝে মাঝে। বেশি না। কারণ, আমি সাড়া দিই না। আমি চিঠি লিখি না। তারপরও আসে আমার কাছে। তাদের সঙ্গে দেখা করি, কথা বলি। কিছু বই পাই। তারা কী করছে, তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন