ভালোরে আমি ভক্তি করি: বাউল শফিক আলী

অ+ অ-

 

বাউল শফিক আলীর কথা

সুনামগঞ্জের হাওর ঘেরা গ্রামগুলোতে অসংখ্য পীর-ফকির-বাউলের বসত। সাধক-মহাজনদের এই উৎস ভূমিতে ঘোরাফেরা করতে করতে এখন তাঁদের শিকড়-বাকড়ে নিজেও কিছুটা জড়িয়ে পড়েছি। তাই বলতে পারি, দুনিয়াতে যত প্রকার আমল-আখলাকের মানুষ আছে, বাউলও তত প্রকার। সেই হিসাবের নজির দিতে গেলে আস্ত একখানা মহাভারত লিখতে হবে। সহজ কথায়, আমি মানুষ রতন খুঁজি। তাই শফিক আলীকে আমার জরুরি দরকার। তিনি একজন শ্রমিক। ছয় মাস মাছ ধরেন, মাছ বেচেন। শুকনার ছয় মাস কৃষকের বাড়িতে চাষবাসের কাজ করেন। তাঁর খোঁজ পেয়ে ছিলাম প্রায় বছরখানেক আগে। অনেক চেষ্টা করেও নাগাল পাই না। ফোন একটা আছে। প্যাক-পানিতে কাজ করেন বলে সাথে রাখেন না। এই শীতে আমিও তক্কে-তক্কে ছিলাম। শফিক আলীর দেউড়িতে দাঁড়িয়ে খোঁজ নিতেই একজন বললেন, ‘খেওলা হাওরের দক্ষিণ জাউড়ে কামে গেছে।

আছিমপুর গ্রামের পাকা সড়কে দাঁড়িয়ে একজন আঙুল তুলে আমাকে দেখিয়ে দিলেন, অই যে শফিক আলী। মাখন মিয়ার জমিনে কাম করে। আমি চেয়ে দেখি অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে, হাওরের খোয়া খোয়া সবুজের মাঝে শফিক আলীরা কয়টা কালো বিন্দু মাত্র।বোরো ক্ষেতের মোটা বাতর ধরে হাঁটছি। শীতের মিষ্টি বিকালটা মা-মাটির আদর খেয়ে জলপাই রঙের হয়ে গেছে। আমার চারপাশে এতো সবুজ! লালিমায় এতো নীরবতা! তিরিশ-চল্লিশ মিনিটের হাঁটা পথ আমার কাছে প্রিয়তমার সঙ্গ-সুখ হয়ে উঠে।

শফিক আলী বোরো ক্ষেতের কাদাপানিতে ঘাস সাফ করছেন। সাথে ক্ষেত-মালিকসহ আরো তিন জন। আছরের আজান পড়তেই তিনি ছুটি পেলেন। বিরাট পুরুষ। মজবুত দেহ। এখনো আধাআধি চুল কাঁচা। দাড়ি সাদা না হলে অনায়াসেই পাঁচচল্লিশ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। ক্ষেতের বাতরে বসে জমিনের ঘোলা পানি দিয়ে তিনি হাত-পা ধুয়ে, গামছায় মুখ মুছতে মুছতে আমাকে প্রশ্ন করেন, এইসব দ্যায়া কিতা অইতো? ইতাতো গোপন জিনিস। যার যার নিজের রাস্তা।

হাওরে খেটে খাওয়া এরকম সাধুসন্ত মানুষেরা বাচালকে পছন্দ করেন না। তাই আমি নীরবে হাসি। অনুরোধের সুরে বলি, আসেন ভাই একটু বসি। এই বলে আমি পাশের পতিত ক্ষেতের শুকনা নাড়ার ওপর কাঁধের ব্যাগ রেখে হাতে হাত মিলাই। বুক মিলাই। তারপর বাউল শফিক আলীকে নিয়ে শুকনা ক্ষেতের নাড়ার ওপর পাকপাঞ্জাতনের আসন পাততে আমার আর দেরি হয় না। খেয়াল করলাম বাউল শফিক আলী ডান হাতটা মুঠি করে নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলেন। সম্ভব হলে সাক্ষাৎকার নেবার আগে আমি ওই গ্রামে গিয়ে আমার দরকারের মানুষটার খোঁজ-খবর নিয়ে আসি। মন মতো হলে ফোনে কিংবা অন্য কোনো বাউলের মাধ্যমে যোগাযোগ করি। মনমাফিক না হলে চিরতরে বিদায়। আছিমপুরের এক স্কুলপড়ুয়া ছেলের কাছে নাম বলতেই বলেছিল, তাইনে দুই কেজি চাইলের ভাত খাইতা পারুন। চাখানার দোকানদার খবর দিলো, যৌবনে শফিক আলী বীর আছলা, একলা লাঠি ধরলে একশ মানুষ দৌড়ে পলায়।এক বুড়ো বললো, সাধনা খায়। কিন্ত মানুষ ভালা।

 

বাউল শফিক আলীর সঙ্গে আলাপ

শেখ লুৎফর: আপনার বয়স কত?

শফিক আলী: আনুমানিক প্রায় ষাট-উনষাট হবে।

শেখ লুৎফর: আপনি এই সাধনার জগতে, গানের জগতে আসলেন কীভাবে?

শফিক আলী: আমার মনের মানুষ একজন ছিল, ব্যাটার নাম কোদালি। মানুষে ডাকতো কোদালি শাহ। তাঁর মুর্শিদ ব্যাটারে হুকুম দিয়েছিল, সব সময় সাথে কোদাল রাখতে, মানুষের সেবা করতে। আমি ছোট কাল থেকে ব্যাটার পিছে পিছে থাকতাম। তিনি গান গাইতেন

মানুষেতে মানুষ খোঁজ, মনের মানুষ কলবে,
তা না হলে, সোনার জমিন তামা হবে।

শেখ লুৎফর: আপনার মুর্শিদের নাম কী?

শফিক আলী: ইব্রাহীম মস্তান, বিশ্বনাথ। আল্লার হুকুম হলে চৈত্র মাসে, বছরে একবার মুর্শিদ বাড়ি একটা মুরগি নিয়ে যাই। ইচ্ছা করে হাপ্তা-হাপ্তা যাই। অভাবে ছাড়ে না।

শেখ লুৎফর: রাতে কী করেন?

শফিক আলী: যা পারি আল্লাহ-রসুলের নাম লই। মাছ ধরতে, মাটি কাটতে গেলেও আল্লাহ-রসুলের নাম লই।

শেখ লুৎফর: মসজিদে যান?

শফিক আলী: যাই। আৎকা আৎকা। একটানা তিন-চার দিন চলে যায়। আছে না একটা, মনে ডাক দিলে যাই। পাঁচ ওয়াক্ত শরিয়তের বেলা। আমাদেরও এসব করা লাগে। নামাজ না পড়ে কেউ ওলি-আউলিয়া হতে পেরেছেন? রোজা মিস নাই। খালি মুখের মাঝে রোজা নানফছে রোজা, হাদিসে প্রমাণ

শেখ লুৎফর: রোজা মানে কী?

শফিক আলী: রোহু...জা। রুহু তাজা। [রুহু... শব্দটা শফিক আলী এমন জোরে উচ্চারণ করেন যে আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। তারপর দ্রুত তাকিয়ে দেখি শফিক আলী তার স্বাভাবিক আলাপে মগ্ন।] তো তুমি সহবাস করলা, রাতে গোসল করলা, এসব কী জাত রোজা? এই রোজা আমি মানি না। এটা হলো মরা রোজা।

শেখ লুৎফর: তাহলে রমজানের মাসে আপনি সহবাস করেন না?

শফিক আলী: আ...রে...সব্বোনাশ, এসব করে আমি রোজা রাখলাম কিসের লাগি? গালি, রাগ, কুদৃষ্টি, কুচিন্তা রোজাতে এসব চলবে না।

শেখ লুৎফর: তারাবির নামাজ পড়েন?

শফিক আলী: ইফতারির পরে নামাজে যাই। নামাজের পরে মাওলানাদের সাথে থাকি। আমার বাপ আলেম ছিলেন। আমার বাপ মোজাফ্ফর আলী মসজিদে নামাজ পড়াতেন। মা আছকাবান বিবি পাক্কা নামাজি ছিলেন।

শেখ লুৎফর: মানুষ কী?

শফিক আলী: একমাত্র আল্লার জাত হল মানুষ। আমরা গরিব। আমাদের গরিরির মাঝে মানুষরে খেদমত করা লাগে। মানুষরে ভালোবাসা লাগে। আমাদের তো এই দালান-টাকা, অনেক জমির দরকার নাই। ভালোবাসা দরকার। মানুষরে ভালোবাসাভালোরে আমি ভক্তি করি।

[শফিক আলী করজোড়ে দুই হাত তুলে গোটা মানব জাতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই বয়সে এসেও তিনি তরুণের মতো প্রাণোচ্ছল। শিশুর মতো সরল। নরম। প্রকৃতির মতো খোলা কিন্তু অন্তরে অন্তরে গভীর এক দিশা নিয়ে বেঁচে আছেন। তার সিলেটি টান ও প্রত্যেকটা কথা উচ্চারণের সময় দেহের ভঙ্গী ও মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ওঠানামা দেখে আমার ভয় লাগে। মনে মনে স্থির করি, উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবো না।]

শেখ লুৎফর: আমাদের চারপাশে প্রচুর মানুষ ভুল পথে হাঁটছেন, এসব দেখলে কেমন লাগে?

শফিক আলী: তারে বুঝাতে হবেএসব করতে পারে না সে। বুঝাতে বুঝাতে সে ভালা হতে পারে। দুনিয়াতেই কাজের বিচার হয়ে যায়। দুনিয়াতেই সব। মাছ ধরা, কাম করা, বেশি বেশি পেলে খাও, বাজারে বেচা। আনন্দ লাগে। সব আনন্দ।

শেখ লুৎফর: রাতে হাওরে যে মাছ ধরেন সামনে বিষাক্ত সাপ পড়ে না?

শফিক আলী: বড় বড় সাপ পড়ে সামনে। এই ফনার উপরে মাথা তুলে, ফোঁসফোঁস করে। আমরা কইচলে যা, সরে যা। আমাদের সাথে কিসের জন্য ভেজাল কর? আমরা তো নির্ভেজাল মানুষ। তখন তারা নীরবে চলে যায়।

শেখ লুৎফর: মুর্শিদের কথা আরেকটু বলবেন?

শফিক আলী: আমাদের [বাউলদের] কথা হলো, আল্লাহকে পেতে গেলে মানুষের সেবা করা লাগে। আর নামাজ-রোজা, তোমার দেহের খাজনা। আল্লায় তোমারে কই থেকে দিবে? তুমি সুন্দরভাবে মানুষরে সেবা-যত্ন করো। মানুষ সবকিছুর মূল। মানুষরে যদি তুমি সেবা দিতে পারো—‘মানুষ খুশি তো, তোমার আল্লাহও খুশি।

শেখ লুৎফর: হাওরে যখন মাছ ধরেন, সাপটাপ এসব মারেন?

শফিক আলী: এটা মারতে পারে না, না এটা পারে না। [শফিক আলী মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাত একটু উপরে তুলে প্রতিবাদ করেন!]

শেখ লুৎফর: আপনার শরীরে তো প্রচুর শক্তি!

শফিক আলী: শক্তি কিতা? আমি দাঁড়ালে চল্লিশটা মানুষ দৌড়ে পালিয়েছে।

শেখ লুৎফর: ঠিকমতো বুঝলাম না

শফিক আলী: মনে করো যৌবনে আমি মারামারিতে গ্যাছি। আমি লাঠি হাতে দাঁড়ালে চল্লিশটা মানুষ ইন্দুরের লাহান দৌড় দিয়ে পালিয়েছে।

শেখ লুৎফর: কেমন খেতে পারেন?

শফিক আলী: একদিন হাওরে মাছ ধরছি। একটা নৌকা সড়কে আটকে গ্যাছে। দশজনে টানে, কিন্তু নৌকা লড়ে না। আমারে ডাকলো। আমি কইলাম, তোমরা সরে যাও। তারা কইল, একলা নিবাগা? কইলাম, হ। নিতে পারলে দেড় সের খাজা খাওয়াবে। না পারলে পাঁচশো ট্যাহার বাজি।

মুর্শিদের নামে এক টানে নৌকা সড়ক থেকে পানিতে নামিয়ে দিলাম। রাতে শিবগঞ্জ বাজারে দোকানের চারপাশে শ শ মানুষ। একজনে কয়, ‘দেড় কেজি খাজা বোলে খাইতো!’ একজনে কয়, ‘মাগো! তার বাপ মরলেও খাইতে পারবে না।’ এই বড় থালায় দেড় সের খাজা সামনে নিয়ে বসছি। চারপাশে শ শ মানুষ। মানুষে কয়, ‘না খাইতারলে পাঁচশ ট্যাহা জরিমানা?’

আমার উঠছে বিগার [রাগ]! তিনটা-চারটা মুঠমাইরা ধরি। টিপা মারি। মড়মড় কইরা ভাঙে, দুই-তিনবার চাবায়া গিলে ফেলি। শেষে আর মাথা নিচের দিকে নামে না। গলার কাছে আইসা গ্যাছে! খালি ডালডা দ্যায়া ভাজা। চোখ বন্ধ হইয়া আইতাছে। আতায়া আতায়া [হাতড়ে হাতড়ে] দ্যাহি তিনটা রইছে! আমি কই, এইতারে মুখে ভইরা লইয়া যাইমুগা। মুর্শিদের নামে একটু পানি চাইলাম। পানির লগে কোনো মতে তিনটারে গিলে বইসা রইলাম। অহন কেউ কয়, ‘পেট ফুইল্যা মইরা যাইবো।’ কেউ কয়, ‘খালি খাজা হাগবো।’ আমি একটা বিড়ি ধরাইয়া ঘরে গ্যাছিগা। গিয়া দুইডা পিঁয়াইজ আর কতখানি লবণ খাইয়া ঘুমায়া রইছি।

শেখ লুৎফর: অসুখ হয়েছিল আপনার?

শফিক আলী: অসুখ কী? তিনদিন ভাত খাইনি। নিচ দিয়ে খালি টপটপাইয়া ঘি পড়ে। নাভির মাঝে কামড় মারে।

শেখ লুৎফর: বিছানায় শুয়ে ছিলেন?

শফিক আলী: না, কাম করছিমাটিকাটা কাম। [আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। পৃথিবীতে এখনো সত্যিকারের মানুষ আছে দেখে তৃপ্তি পাই। কিছুটা হলেও জীবনের স্বাদ অনুভব করি।]

শেখ লুৎফর: ভাত না খাওয়ার জন্য পরিবার কিছু বলেছিল?

শফির আলী: সন্দেহ করে আমার বউ কয়, এই যে দ্যাহ, গোসা কইরা হে ভাত খায় না। এই যে দ্যাহ, হে কুবাজপুর গেরামে গিয়া আরেক বেটির লগে লাইন করছে। সেইখানে খায়। আমার ঘরের ভাত পইরা থাহে! আমি বললাম, কথা বলিস না। এমুন এমুন দেড় কেজি খাজা খাইছিলাম শিবগঞ্জ বাজারে। তুই এই দেশের মাইনষেরে জিগাইয়া দ্যাখ, হাছা না মিছা?

শেখ লুৎফর: আপনার আশপাশের মানুষ বিষয়ে কিছু বলুন

শফিক আলী: অনেক দায়িত্ব আছে। ভালা দায়-দায়িত্ব। গরিবজনের অসুবিধা, খেতে পায় না। আমার চাইট্টা থাকলে আমি চুরি করে হলেও তাদের দেই।

শেখ লুৎফর: চুরি কেন?

শফিক আলী: আমাদের মুটকি থেকে হলেও দিয়ে দেই। পরিবারকে বলার দরকার নাই। খামাখা অশান্তি করবে। তাই চুরি করে গামছার মধ্যে বাইন্ধ্যা কিংবা যেছার মধ্যে বাইন্ধ্যা দিয়ে দেই। মানুষ সুখে থাকুক। ভালা থাকুক।

বাউল শফিক আলী গড়নগাড়নে রূপকথার বীরের মতো। তাঁর নোংরা লুঙ্গি, ছেঁড়া কোটের নিচে হৃদয়টা সত্য ও সুন্দরের দোতারায় বাঁধা। আপন মহিমায় সে কয়লার খনিতে একখণ্ড হীরক। মরে যাওয়া বিকালের লাল আলোতে, তাঁর কুটকুটে কালো নাক-মুখ কপালের বলিরেখায় পরমাত্মা জ্বলজ্বল করে। দেখতে পবিত্র লাগে। খুব পবিত্র!