পোলিশ ঔপন্যাসিক ওলগা তোকারচুকের নোবেল বক্তৃতা

অ+ অ-

 

|| ওলগা তোকারচুক ||

ওলগা তোকারচুক পোল্যান্ডের সুলেহুফ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যায়ন করেন। ১৯৯৩ সালে তার প্রথম উপন্যাস দ্য জার্নি অব দ্য বুক-পিপল প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি আঠারো শতকের ফ্রান্স ও স্পেনের প্রেক্ষাপটে রচিত। চরিত্রগুলো পিরিনীয় পর্বতমালায় একটা রহস্যজনক বই খুঁজতে বের হয়। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত প্রাইমেভাল এন্ড আদার টাইমস তার যুগান্তকারী উপন্যাস। এই উপন্যাসে তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কয়েক প্রজন্ম ধরে একটি পরিবারের ধারাবাহিক কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কাহিনীটি পৌরাণিকস্থানের একটি শক্ত প্রতীকী প্রভাব রয়েছে। প্রাণবন্তভাবে বাস্তব চিত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর পোলিশ ইতিহাসকে চিত্রিত করেছে। তোকারচুক একবার বলেছিলেন, উপন্যাসটিতে তিনি পোল্যান্ডের অতীত ভাবমূর্তিকে ব্যক্তিগত প্রয়াসে নিরীক্ষণ করতে চেয়েছেন।

২০০৭ সালে প্রকাশিত ফ্লাইটস উপন্যাসে তিনি প্রাচীন মানচিত্র ও ভ্রমণের চিত্রাঙ্কন অন্তর্ভুক্ত করেন। এটা অনেকটা সুবিশাল এনসাইক্লোপিডিয়ার প্রতিচ্ছবি মনে হবে। পৃথিবী যেন অনন্তকাল ধরে উড়ে বেড়াচ্ছে তার স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। এই উপন্যাসটির জন্য তিনি ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেন। তোকারচুক বাস্তবতাকে কখনো ধ্রুব ও চিরস্থায়ী বলে মনে করেন না। তিনি তার উপন্যাসকে সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের ভিত্তিতে নির্মাণ করেন। প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতি, বুদ্ধি বনাম বৈকল্য, নারী বনাম পুরুষ, গৃহ বনাম সন্ন্যাসীর বৈপরীত্য। তার চমকপ্রদ অপরাধমূলক উপন্যাস ড্রাইভ ইউর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড(২০১৮) একটি অধিবিদ্যক কল্পসাহিত্যের হাস্যরসাত্মক প্রকাশ।

দ্য বুক অব জ্যাকব(২০১৪) এখনও পর্যন্ত তার সাহিত্য সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এখানে তিনি সাহিত্যের বিগত ধারা ও রীতিকে পরিবর্তন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। উপন্যাসটিকে সার্থক করার জন্য বহু বছর ধরে গ্রন্থাগার ও আর্কাইভগুলোতে ইতিহাস বিষয়ে গবেষণায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন। মূলচরিত্র জ্যাকব ফ্রাঙ্ক ১৯ শতকের অনন্য সাধারণ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা। তার অনুগত সহচররা তাকে ডাকতো মানবজাতির নতুন ত্রাণকর্তা। তোকারচুক যেভাবে মাত্র ১০০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ কাহিনীর বয়ানে একজন চরিত্রের অবয়ব আঁকতে গিয়ে আরো অসংখ্য চরিত্রের মনের ভেতর সমানভাবে প্রবেশ করেছেন, সাহিত্যের জগতে এটা খুবই অভিনব।

তোকারচুক ২০০৮ সালে ফ্লাইটস ও ২০১৫ সালে দ্য বুক অব জ্যাকব উপন্যাসের জন্য পোল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সম্মাননা নাইক পুরষ্কার লাভ করেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তার সর্বশেষ উপন্যাস দ্য ইমপোসিয়াম’-এর জন্য ইউরোপিয়ান সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আমাদের নিজস্ব জীবন অভিজ্ঞতার বাইরে কল্পিত কাহিনীর মাধ্যমে অন্যের জীবন ও বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে এমন এনসাইক্লোপেডিক আকাঙ্ক্ষার জন্য ওলগা তোকারচুককে ২০১৮ সালে সাহিত্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তিনি একমাত্র গল্পকার যিনি একই বছর পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাবান দুটি সাহিত্য পুরস্কারবুকার ও নোবেলের সম্মানে অভিষিক্ত হন।

 

|| সম্পাদকীয় নোট ||

পোলিশ ঔপন্যাসিক ওলগা তোকারচুকের একজন দরদী গল্পকারশিরোনামের বক্তৃতাটি দেন নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশানের অনুষ্ঠানে। সম্প্রতি নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশান প্রতিধ্বনি পত্রিকাকে বক্তৃতাটির বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশের কপিরাইট প্রদান করেছে। আমরা নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশান ও ওলগা তোকারচুকের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। প্রতিধ্বনির জন্য এটি অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ।

একজন দরদী গল্পকার || ওলগা তোকারচুক

অনুবাদ || পলাশ মাহমুদ

 

|| ১ ||

জীবনে প্রথম ছবি কবে দেখছি ভাবলেই আমার মায়ের একটি ছবির কথা মনে পড়ে। ছবিটা আমার জন্মের আগে তোলা। দুঃখের বিষয় ছবিটা সাদা কালো ছিল, ফলে ছবিটার অনেক খুঁটিনাটি বিষয় মুছে গেছে, ধূসর কিছু আকৃতি ছাড়া তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই।  আলোটা মোলায়েম, কিছুটা বৃষ্টিস্নাত, অনেকটা বসন্তবেলার কোমল আলোর মতো। যে আলো জানালার কাঠ বেয়ে ঘরে টুকে পড়ে। তারপর পুরো ঘরময় আবছা একটা দীপ্তি ছড়িয়ে রাখে। সবকিছুতে একটা অস্পষ্টতা তৈরি করে। আমার মা পুরাতন রেডিওর পাশে বসে আছে। রেডিওতে একটা সবুজ চোখের ছাপ লাগানো আর দুইটা ডায়াল। একটা ডায়াল দিয়ে শব্দ বাড়ায় আর কমায়। আরেকটা দিয়ে রেডিও স্টেশন খুঁজে বেড়ায়। এই রেডিওটা আমার শৈশবকালের নিত্যসঙ্গী ছিল। এই রেডিও দিয়েই আমি মহাজগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছিলাম। আবলুস কালো রেডিও নবকে ঘুরালে অ্যান্টেনার নাজুক কাঁটাগুলো স্থান পরিবর্তন করতো। কাঁটাগুলোর আওতায় সকল স্টেশনকে পাওয়া যেতো। ওয়ারশ, লন্ডন, লুক্সেমবুর্গ আর প্যারিস। মাঝে মাঝে ঘ্যারঘ্যার শব্দ হতো। অস্পষ্টভাবে কখনো প্রাগ বা নিউইয়র্ক। আবার কখনো মস্কো বা মাদ্রিদ স্টেশন বলে মনে হতো। যখনই অ্যান্টেনার কাঁটাগুলো হোঁচট খেতো। মনে হতো কৃষ্ণগহব্বরে পড়ে গেছে। যখনই এমন কিছু ঘটতো আমার মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে একটা শীতল কাঁপুনি দিয়ে উঠতো। আমার মনে হতো এই রেডিওর মাধ্যমে কতো কতো সৌরজগত ও ছায়াপথ আমার সাথে কথা বলবে। মনে হতো আমার সাথে কলতান আর কলহে মেতে উঠতো। মনে হতো তারা আমার কাছে এমন সব তথ্য পাঠাতো যার মর্মার্থ উদ্ধার করা আমার জন্য অসম্ভব ছিল।

ছোটবেলায় যখনই আমি এই ছবিটার দিকে তাকাতাম আমার নিশ্চিত মনে হতো মা বোধহয় রেডিওর ডায়ালটা ঘুরিয়ে আমাকেই খুঁজে বের করতে চাইতো। একটা অতি সংবেদনশীল রেডারের মতো মা মহাবিশ্বের অসীম সাম্রাজ্যের কোন কোণায় আমি লুকিয়ে আছি খুঁজে বের করতে চাইতো। কখন আমি পৃথিবীতে আসবো জানতে চাইতো। তার চুলের স্টাইল, গায়ের পোশাক দেখলেই বোঝা যায় ছবিটা কোন সময়ের তোলা। খুব সম্ভবত ষাটের দশকের শুরুর দিকে হবে। ছবির ফ্রেমের বাইরের কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুঁজো হয়ে বসে সীমানার বাইরে কিছুর দিকে থাকলে ছবির দর্শকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় কি দেখছিল। একজন শিশু হিসেবে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করতাম মা আসলে কিসের দিকে এমন নিবিড় ভাবে তাকিয়ে ছিল। ছবি তোলার সময়ে আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি। এটি ছবি তোলার এক মুহূর্তের অবস্থা মাত্র, কোন প্রক্রিয়া নয়। ছবিতে নারীটিকে খুব মনমরা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে বেখেয়ালে ডুবে আছে। পরবর্তীকালে মাকে আমি বহুবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি কিসের কষ্টে ডুবে ছিলেন। মাও সবসময় একই উত্তর দিয়েছে। আমি তখনও কেন পৃথিবীতে আসিনি সেটা ভেবেই কষ্ট পেতো। আমার কথা নাকি তার খুব মনে পড়তো।

আমি জিজ্ঞেস করতাম, আমি তো তখনও দুনিয়াতে ছিলামই না। তাহলে আমাকে কিভাবে মনে পড়তো?

আমি জানতাম। আপনার তখনই কারো কথা ভেবে খারাপ লাগবে যখন তাকে আপনি জীবন থেকে হারিয়ে ফেলবেন। কোন কিছু হারিয়ে গেলেই আমাদের মাঝে একটা অভাব কাজ করে। আকাঙ্ক্ষা হলো হারানোর পরবর্তী অবস্থা।

মা প্রতি উত্তরে বলতো, কিন্তু তুমি এটাকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করতে পারো। কারো অস্তিত্ব থাকার পরও তোমার তাকে খুব মনে পড়তে পারে।

এই ক্ষুদ্র ভাব বিনিময়, ষাট দশকের শেষের দিকে পশ্চিম পোল্যান্ডের কোন এক গ্রামে, আমার ও মায়ের মধ্যে এই ছোট কথোপকথনের মুহূর্তটুকু চির অমলিন স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। আমার সমগ্র জীবনে এই স্মৃতি একটা শক্তি, একটা প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই স্মৃতি আমার অস্তিত্বকে এক উচ্চতা দিয়েছে। আমাকে জড়বস্তুর আটপৌরে জীবনের বাইরে নিয়ে গেছে। জীবনের দৈবঘটনা ও কার্যকারণ সম্পর্কের বাইরে নিয়ে গেছে। সম্ভাবনার নীতিকে অতিক্রম করে বাঁচতে শিখিয়েছে। সময়ের সীমানার বাইরে অনন্তকালের কাছাকাছি আমার সত্তাকে বসিয়েছে। আমার শিশু মনে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি যা কল্পনা করি তার বাইরেও জগৎ আছে। তাই আমি যদি বলিও, আমি নেই। তারপরও আমি আছি এই বাক্য থেকে বের হতে পারবো না। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অদ্ভুত শব্দগুচ্ছ হলো আমি আছি।

তাই একজন নারী যে কিনা জীবনে কখনোই ধার্মিক ছিল না। হ্যাঁ, আমার মায়ের কথাই বলছি। মা আমার মাঝে এমন এক আমি সৃষ্টি করে দিয়েছে যাকে আমরা একসময় আত্মা বলে জানতাম। আমাকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দরদী গল্পকারের হাতে তুলে দিয়েছে।

 

|| ২ ||

জগৎ হচ্ছে তথ্য, আলোচনা, চলচ্চিত্র, গ্রন্থ, গপ্প, ও ছোট ছোট উপাখ্যানের সুবিশাল তাঁতে বোনা এক খণ্ড কাপড়ের মতো। আজকের দিনে এই জগৎ তৈরির তাঁতটি প্রকাণ্ড আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট আবিস্কারের পর। প্রায় সবাই এই জগৎ তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে পারে। নিজের অজান্তেই সবাই এই জগৎ নির্মাণের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। ভালোবেসে নয় বা ঘৃণা থেকেও নয়। কল্যাণের জন্য নয় কিংবা অমঙ্গলের জন্যও নয়। যখন এই গল্পে কোন পরিবর্তন আসে আমাদের জগতও বদলে যায়। এই দিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের দুনিয়া মূলত শব্দ দিয়ে নির্মিত।

আমরা আমাদের জগৎ নিয়ে আসলে কি ভাবি? কিংবা আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো। আমরা আমাদের জগৎ কে কিভাবে বর্ণনা করি তা অনেক গুরুত্ব বহন করে। যখন কোন ঘটনা ঘটে তার গল্পটা যদি বলা না হয় তাহলে তার অস্তিত্ব স্থবির হয়ে যায়। আর একদিন নিঃশেষ হয়ে যায়। এই বিষয়টা শুধু ইতিহাসবিদদের জন্য সত্য নয় বরং সকল মতের, সকল পথের রাজনীতিবিদ ও স্বৈরাচারের জন্যেও প্রযোজ্য। যেই জগতের বয়ান বুনন করবে সেই তার দায় বহন করবে।

আজকের দিনের মূল সমস্যা কী জানেন? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, পৃথিবী যেভাবে চোখের পলকে অতিদ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতের জন্য আমরা কোন সুগঠিত বয়ান লিখতে পারছি না। এমনকি চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনারও কোন গল্প বলতে পারছি না। আমরা যথার্থ ভাষা পাই না। কোন দৃষ্টিতে বয়ান করবো তা নিয়ে সংশয়ে থাকি। সঠিক রূপক, সঠিক পুরাণ আর নতুন কোন উপকথার খুব অভাব বোধ করি। তারপরও আমরা ইতিহাস বিকৃত ও বিবর্ণ কিছু আখ্যানের আস্ফালন দেখতে পাই। এই কাহিনীগুলো আমাদের ভবিষ্যতের কল্পিত আখ্যানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই যে নতুন কোনকিছু না থাকার চেয়ে পুরাতন কিছু থাকা ভালো। অথবা পুরাতন সামান্য কিছু আখ্যান দিয়েই আমদের নিজেদের কল্পনার দিগন্তের সীমাবদ্ধতার সাথে সমঝোতা করতে হবে। ছোট করে বলতে, বর্তমান জগতের গল্প বলতে আমরা নতুন কোন উপায় পাচ্ছি না।

আজকে আমরা প্রথম-পুরুষের বয়ানের এক বহুস্বরের বাস্তবতায় বাস করি। আমারা চারদিক থেকে বহুস্বরের অর্থহীন গুঞ্জন শুনতে পাই। প্রথম-পুরুষের আখ্যান বলতে ওই গল্পটা বুঝাচ্ছি যেখানে গল্পকার নিজে কম বেশি নিজের কণ্ঠে বয়ান করে বা নিজের কলমে লেখে। আমরা এই ধরনের ব্যক্তি স্বতন্ত্র দৃষ্টির, এই আত্মজৈবনিক স্বরকে স্বাভাবিক, মানবীয় ও সৎ স্বর বলে গ্রহণ করেছি। যদি এই স্বর বৃহৎ বা মহৎ কোন প্রেক্ষাপট থেকে বলা হয় না। প্রথম-পুরুষের আখ্যান অনেক সময় অভাবনীয় ভাবে কিছু অপূর্ব নকশা আকঁতে পারে। যা শুধু এই আখ্যানগুলোতেই পাওয়া যায়। স্বতন্ত্র বলে এতে সবসময় একটা নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ জারি থাকে। নিজের সত্তা সম্পর্কে ও নিজের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে সচেতন থাকে। আবার এটি জগৎ ও ব্যক্তির মধ্যে একটা বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। তখন মাঝে মাঝে যেকোন এক বিরোধী পক্ষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারে।

আমি মনে করি, প্রথম-পুরুষের বর্ণনা সমকালীন আখ্যানের ধারায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। যেখানে বর্ণনাকারী দুনিয়ায় আত্মবাদী চেতনার কেন্দ্র হিসাবে ভূমিকা পালন করে। পশ্চিমা সভ্যতা অনেকটা ব্যক্তিসত্তার স্বকীয়তার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ও নির্ভরশীল। আর এটাই আমাদের বাস্তবতার বলয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এখানে ব্যক্তি মানুষই মূখ্য অভিনেতা এবং তার বিচার বিবেচনাকেই সবসময় চূড়ান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। প্রথম-পুরুষের কণ্ঠে বলা গল্পগুলোই মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। গল্পগুলো অনেক শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিয়ে পড়া হয়। জীবনে অনেক আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণার যোগান দেয়। এই রকম গল্পের চোখ দিয়ে আমরা যখন বিশ্বকে দেখি, যে চোখ দিয়ে একজন ব্যক্তি বিষয়ীগতভাবে দুনিয়াকে দেখে। যা আবার অন্য অনেক ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি সত্তার সমতুল্য। তখন পাঠক বা শ্রোতা সহজেই নিজেকে গল্পকারের সাথে নিজের আত্মিক বন্ধন গড়ে তুলতে পারে। কেননা বক্তা সবসময়  নিজের অবস্থানে শ্রোতাকে বসার আহ্বান জানায়।

সাহিত্যের জগতে বা ব্যাপকার্থে মানব সভ্যতার জন্য উত্তম-পুরুষের আখ্যানগুলোর অবদান কোনভাবে অতিমূল্যায়ন করা যাবে না। তারা পৃথিবীর গল্পটাকে পুনর্নির্মাণ করেছে। তাই বর্তমান কাহিনীর স্রোতে দেবতা ও বীরপুরুষদের উল্লেখযোগ্য কোন স্থান নেই। কেননা তাদের সাথে মানুষের কোন সংযোগ নেই বা কোন প্রভাব নেই। আছে শুধু আমাদের মতো মানুষের ব্যক্তিগত ইতিহাস। রক্তমাংসের মানুষের সাথেই কেবল আমরা নিজেদের মেলাতে পারি। লেখক ও পাঠকের মাঝে সমানুভূতি নির্ভর নতুন একটা আবেগীয় বোঝাপড়া তৈরি হয়। পারস্পরিক যোগাযোগের এই প্রকৃতির কারণেই লেখক ও পাঠক পরস্পরের কাছাকাছি আসে। আলাদা দুটি সত্তার মধ্যকার দেয়াল ভেঙে পড়ে ও সীমানা অদৃশ্য হয়ে যায়। একটা উপন্যাসের সীমান্তে লেখকের ব্যক্তিসত্তা ও পাঠকের ব্যক্তিসত্তা খুব সহজে পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। একটা চিত্তাকর্ষক উপন্যাসে এই সীমান্ত যতবেশি অস্পষ্ট হয়ে উঠবে ততবেশি পাঠক তার সমানুভূতির মাধ্যমে মুহূর্তের জন্য হলেও নিজেই গল্পকার হয়ে উঠে। তাই সাহিত্য এখন অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এমন এক সভা যেখানে প্রত্যেকেই তাদের নিজের ভাগ্য নিজেই লিখতে পারে। অথবা তারা অপর-সত্তার কণ্ঠে স্বর দিতে পারে। এটাকে অনেকটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। যে কেউ কথা বলতে পারে। সবাই তার নিজের স্বতন্ত্রতা অনুযায়ী স্বর নির্মাণ করতে পারে। মানুষের ইতিহাসে এত বিশাল সংখ্যক লেখক ও গল্পকার আগে কখনো পৃথিবীতে আসেনি। এটা অভূতপূর্ব। আমরা বরং পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখতে পারি তা আসলেই সত্য কিনা।

আমি যখন কোন বইমেলায় যাই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখি আজকের দুনিয়ায় আসলেই ঠিক কতো বই প্রকাশিত হয়েছে? পুঙ্খানুপঙ্খুভাবে লেখক সত্তাকে জানতে চেষ্টা করি। সহজাত প্রবৃত্তি প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা অন্য যেকোন জীবনরক্ষাকারী প্রবৃত্তির মতো সমান শক্তিশালী। প্রবৃত্তিসমূহ সবচেয়ে বেশি কার্যকরভাবে শিল্প মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়। মানুষ সবসময় অন্যের দৃষ্টি গোচরে থাকতে চায়। মানুষ সবসময় অন্যদের থেকে একটু বিশেষ অনুভব করতে চায়। সমকালীন সাহিত্যের ধারায়—‘আমি আমার একান্ত গল্পটি বলতে চাই বা আমি আমার পরিবারের কাহিনীটা বলতে চাচ্ছি অথবা আরো সহজে আমি কোথা থেকে এসেছি তার পিছনের গল্পটা বলতে চাই’—এমন উত্তমপুরুষের বয়ান সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বর্তমানে এটাই হচ্ছে যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ আজকের সারাবিশ্বে লেখালেখি করার সুযোগ খুব সহজ হয়ে উঠেছে। অনেক লোক এই শব্দ দিয়ে গল্প বলার ক্ষমতা অর্জনও করেছে। যেটা আগে অল্প সংখ্যক লোকের আওতায় সীমাবদ্ধ ছিল। আপাতবিরোধী মনে হলেও, এই পরিস্থিতি অনেকগুলো একক গায়কের সমবেত সঙ্গীত সভার মতো মনে হয়। যেখানে সবাই সকল শ্রোতাদের সমান মনোযোগের জন্য গানের প্রতিযোগিতা করছে। সবাই একই সমুদ্র পথে ভ্রমণ করছে আর একজন আরেকজনকে ডুবানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। তাদেরকে বোঝার জন্য যতটুকু জানা দরকার সবটুকু আমরা জানি। ব্যাপারটা এমন যে, তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাকে মেলাতে পারি। মনে হবে তাদের জীবনটা আমাদের নিজেদের জীবন। মাঝে মাঝে পাঠকের অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ ও হতাশাজনক হয়ে পড়ে। কেননা, কোন লেখক সত্তা সার্বজনীন বাস্তবতাকে ধারণ করার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আমরা যে জিনিসটাকে ঠিক মতো ধরতে পারি না তা হলো গল্পের বহুমাত্রিক সম্ভাবনা। এটা অনেকটা রূপকগল্পের মতো। যেমন রূপক গল্পের মুখ্য চরিত্র নিজে একটা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অবস্থার মধ্যে বাস করে। আবার একই সাথে সে নির্দিষ্ট ও বিশেষ অবস্থার সীমানা অতিক্রম করে যেকোন দেশের যে কোন ব্যক্তি হয় উঠতে পারে। যখন কোন পাঠক কোন উপন্যাসের গল্পকে অনুসরণ করে তখন সে উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্রের ভাগ্যের সাথে একাত্মবোধ করে। কাহিনীর মাঝে নিজের অবস্থান সনাক্ত করে যেন গল্পটা তার আত্মজৈবনিক। অন্যদিকে রূপকগল্পে পাঠক তার সকল নিজস্বতাকে পুরোপুরি সমর্পণ করে যেকোন মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এমন মনোজাগতিক জরুরী পরিস্থিতিতে রূপক আখ্যান আমাদের অভিজ্ঞতাগুলোকে সার্বজনীন চেহেরা দেয়। ভিন্ন ভিন্ন পরিণতির একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করে। আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে রূপককাহিনীর ধারা অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছি। এই ঘটনাটা আমাদের বর্তমান অসহায়ত্বের অকাট্য সাক্ষ্য।

আমরা যাতে অগুণিত বইয়ের শিরোনাম আর লেখকের শেষ নামে ডুবে না যাই। সাহিত্যের লেভিয়াথেনের মতো প্রকাণ্ড শরীরকে আমরা বিভিন্ন সাহিত্য রীতিতে বিভক্ত করেছি। ঠিক যেমন বিভিন্ন খেলাকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করি। খেলোয়াড়দের মতো লেখকরা তেমনি বিশেষ সাহিত্য ধারায় দক্ষ হয়ে উঠে।

সাহিত্যের বাজারকে বানিজ্যকীকরণের ফলে সাহিত্যের শাখাগুলো প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে। এখন সারাবছরই এক জায়গায় একধারার সাহিত্যের উৎসব চলে তো অন্য জায়গায় অন্যরীতির সাহিত্যের মেলা বসে। ভিন্ন সাহিত্য ভিন্ন সময় ভিন্ন জায়গায়। কোথাও অপরাধমূলক উপন্যাস তো কোথাও কল্পকাহিনী বা কল্পবিজ্ঞান বইয়ের খরিদ্দাররা সমবেত হয়। এই নব্যপরিস্থিতির বিশেষ উদ্দেশ্যে ছিলবই ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা, গ্রন্থাগারগুলো যাতে বিশাল সংখ্যক প্রকাশিত বই পাঠকের জন্য তাকে সাজিয়ে রাখতে পারে। সর্বোপরি পাঠককুল যেন এই বিশাল বইয়ের রাজ্যে সাথে পরিচিত হতে পারে। কিন্তু তার পরিবর্তে বইয়ের বিভিন্ন বিমূর্ত শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে। শুধুমাত্র বর্তমান কাজের অবস্থান অনুযায়ী নয় বরং লেখকরা কখন থেকে লেখা শুরু করেছিলেন তার সময় অনুযায়ীও। সাহিত্যের ধারা অনেকটা কেক বানানোর ছাঁচের মতো। যা একই রকম ফল দেয়। সাহিত্য রীতিগুলোর ভবিষ্যত অনুমান ক্ষমতা একটা মহৎ গুন বলে বিবেচনা করা হয়। তাদের গতানুগতিক রীতির প্রয়োগ একটা অর্জন। পাঠকরা আগে থেকে জানে ওই উপন্যাসে সে কি পাবে এবং সে ঠিক তাই পায় যা সে মনে মনে ভেবেছে।

আমি সবসময় স্বজ্ঞাতভাবে এই রীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করে আসছি। যেহেতু তারা লেখকের সৃজনশীল স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের অপরিহার্য দুটি গুণ পরীক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার সীমা অতিক্রমণ করার ব্যাপারে উদাসীন করে তোলে। তারা সাহিত্যের খামখেয়ালিতে ভরা সৃজনশীল প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। যে প্রক্রিয়া ছাড়া শিল্প তার পথ হারায়। একটি ভালো বই কখনোই সংযুক্ত সাহিত্য ধারার মাপে শ্রেষ্ঠ হতে হয় না। সাহিত্যের বানিজ্যিকীকরনের অনিবার্য ফল হলো সাহিত্যকে ধারা অনুযায়ী বিভক্তকরন। আধুনিক পুঁজিবাদের বিভিন্ন বানিজ্যিক ধারণা যেমন ব্রান্ডিং ও টার্গেট মার্কেটের দর্শনে নির্ভর করে বইকে বিক্রয়যোগ্য পন্য হিসাবে মূল্যায়ন করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

আজকের দুনিয়ায় আমাদের সবচেয়ে বড় সন্তুষ্টির জায়গা হলো জগতের গল্পগুলো বলার জন্য নতুন একটি শিল্প মাধ্যমের উন্মেষ। যেখানে গল্পগুলো বইয়ের পাতায় পড়ার বদলে সিরিজ আকারে পর্দায় দেখানো হয়। এর একটা গোপন উদ্দেশ্য হলো আমাদের মধ্যে একটা মোহ ঢুকিয়ে দেয়া। অবশ্য এই গল্পগুলো হাজার বছর আগেই অস্তিত্বশীল ছিল। শতরকম পৌরাণিক কাহিনী, হোমারের কাব্য, হেরাক্লিসের আখ্যান, এখিলিস বা ওডেসিয়াসের মহাআখ্যানগুলোই মূলত সিরিজগুলোর প্রথম মহানায়ক। কিন্তু এই সময়ের পূর্বে কখনো এই মাধ্যম আমাদের প্রাত্যহিক দিনের এতটা সময় দখল করে রাখে নাই। আমাদের সম্মিলিত কল্পনার বলয়কে এতটা প্রভাবিত করতে পারে নাই। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক প্রশ্নাতীতভাবে সিরিজের সম্পত্তি হয়ে আছে। জগতের গল্প বলার এই নতুন ধরনের প্রভাব এক কথায় বিপ্লবাত্মক। সেই সাথে গল্প বুঝার ধরনও নতুন।

গল্প বলার এই সময়ে সিরিজ শুধুমাত্র কাহিনীর কালিক বলয়ে আমাদের সরাসরি অংশগ্রহণকে বর্ধিত করেছে। এর নতুন নতুন দিক উন্মুক্ত করেছে, নতুন নতুন প্রশাখার জন্ম দিয়েছে, সাথে সাথে এর নতুন নিয়মও তৈরি করেছে। প্রথমদিকে এর প্রধান কাজ ছিল যতটুকু সময় সম্ভব দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা। সিরিজের কাহিনীর চরিত্র ও আখ্যান বস্তুকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। তাদের এমন অভাবনীয় ধাঁচে একত্রে জুড়ে দেয়। একটা সময় হতবুদ্ধ হয়ে  গডস ফ্রম মেশিন’-এর মতো গল্প তৈরির পুরাতন পদ্ধতিতে ফিরে যায়। নতুন কাহিনী তৈরির সময় চরিত্রদের মনোজগতকে তাৎক্ষণিকভাবে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হয়। যাতে তার গল্পের রূপরেখার মাঝে ঘটনাসমূহকে আরো অধিক ভালো করে জুড়ে দিতে পারে। একটা চরিত্র গল্পের শুরুতে খুব নম্র ও গম্ভীর থাকে। কিন্তু গল্প যত এগিয়ে যায় সে ততই প্রতিশোধপরায়ণ ও হিংসাত্মক হয়ে উঠে। একটা পার্শ্বচরিত্র হয়ে উঠে মূলচরিত্র। অন্যদিকে আপাত মূলচরিত্র যার প্রতি আমরা ইতোমধ্যে অনুরক্ত হয়ে পড়েছি সে তার তাৎপর্য হারায়। সত্য বলতে একটা পর্যায়ে চরিত্রটি সম্পূর্ণ কাহিনী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর আমরা হতাশ হয়ে পড়ি।

আরেকটা সিজন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কাহিনীর সমাপ্তির দরজা উন্মুক্ত করে রাখে। যেখানে চরিত্রের আবেগ অনুভূতির শুদ্ধিকরন (ক্যাথারসিস) সম্ভব নয়। চরিত্রের মনের ভেতরের রূপান্তরের অভিজ্ঞতা কিংবা গল্পের ঘটনা প্রবাহে অংশগ্রহণ তাকে এক ধরনের পূর্ণতা ও সন্তুষ্টি এনে দেয়। গল্পের সমাপ্তির বদলে এই ধরনের জটিলতা মানে ক্যাথারসিসের পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়। যার ফলে দর্শকরাও অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফেবুলা ইন্টারাপটা  বহু আগেই সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রাচ্যের শেহেরজাদের গল্প থেকে আমরা আগেই জেনে গিয়েছি। এমন রচনা শৈলী সিরিজগুলোতে আবার ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের আত্মবাদী মনোভাবকে পাল্টে ফেলে আমাদের মনোজগতে এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলছে। আমার জীবন থেকে আমার সত্তাকে টেনে-ছিঁড়ে বের করছে। চরম উদ্দীপকের মতো আমাদের সম্মোহিত করে রাখছে। একই সাথে এই সিরিজগুলো নিজেকেই অন্তর্ভুক্ত করছে। পৃথিবীর নতুন, পরিশুদ্ধ ও বিশৃঙ্খল ছন্দ হিসাবে। পৃথিবীর বিশৃঙ্খল যোগাযোগ, অস্থিরতা ও প্রবাহ হিসাবে। এই গল্প বলার আঙ্গিকটা সম্ভবত নতুন কোন সূত্রের সন্ধানে ক্রিয়াশীল।

এই দিক থেকে সিরিজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আছে। এই যেমন ভবিষ্যতের আখ্যানের উপর। গল্প বলার ধরন পরিমার্জন হবে এই সময়ের বাস্তবতার সাথে মানানসই হয়।

কিন্তু সবকিছুর উপর আমরা একটা পরস্পরবিরোধ ভরা বিশ্বে বাস করি। পরস্পরকে বাতিল করে দেয় এমন তথ্যের জগতে চলাচল করি। সবকিছু সবকিছুর সাথে হাড়ে মজ্জায় দ্বন্দ্বে লিপ্ত।

আমাদের পূর্বপুরুষগণ বিশ্বাস করতেন জ্ঞান অর্জনের সুযোগ মানুষের জন্য শুধুমাত্র সুখ, সুস্থতা, স্বাস্থ্য ও সম্পদই বয়ে আনবে না বরং সমতা ও ন্যায়ে ভরা এক সমাজ গঠনেরও সুযোগ দিবে। কিন্তু তাদের চিন্তায় যেটা ধরতে পারেনি সেটা হলো তথ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান জ্ঞানের সহজ লভ্যতা।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শিক্ষাগুরু জন আমোস কমিনিয়াস প্যানফিজম শব্দটি দিয়ে পৃথিবীর সব শাখার জ্ঞান ধারণ করতে পারে এমন সর্বজ্ঞাত ও সার্বজনীন জ্ঞানের ধারণাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। সবার কাছে তথ্য সরবরাহের সমান সুযোগকেই বুঝিয়েছেন। বিশ্বের সকল তথ্যের সহজ লভ্যতা একজন সামান্য কৃষককে একজন পরিশীলিত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে তার নিজ অস্তিত্ব ও বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। জ্ঞানের সহজলভ্যতা কি মানুষকে একটু সংবেদনশীল করে তোলে না? তারা কি জীবনকে সমতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পরিচালিত করে? যখন ইন্টারনেট প্রথম আবিষ্কৃত হয় তখন প্যানফিজম ধারণাটি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখা দেয়। উইকিপিডিয়া অনেকটা কমিনিয়াসের প্রতিফলন। সমমনা বহু দার্শনিকদের সমাবেশের মতো। অবশেষে মানবজাতির স্বপ্ন পূরণ হলো বলে মনে হয়। উইকিপিডিয়া আমাকে খুব মুগ্ধ করে এবং আমি একে সমর্থন ও করি। এখন আমরা সীমাহীন তথ্য ভান্ডার সৃষ্টি ও সংগ্রহ করতে পারি। তথ্যগুলোকে বিরামহীনভাবে যুক্ত ও হাল নাগাদ করতে পারি। পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে অবাধে লেখক ও পাঠক সমানভাবে এই তথ্য প্রবাহে প্রবেশ করতে পারে।

স্বপ্ন পূরণ অনেক সময় হতাশার কারণও হতে পারে। এটি পরিস্কার যে আমার এই অফুরন্ত তথ্যভান্ডারকে ধারণ করতে সক্ষম নই। এটি আমাদের একত্রিত ও মুক্ত করার বদলে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি দিকে নিয়ে গেছে। আমাদের ভিন্ন ভিন্ন বুদবুদের ভেতর আটকে ফেলেছে। এমন সব গল্প তৈরি করেছে যা একটির সাথে আরেকটির কোন মিল নেই। একটি আরেকটির সাথে সাংঘর্ষিক। পরস্পরের ঘোর বিরোধী। তাছাড়া ইন্টারনেট সম্পূর্ণভাবে ও বিবেচনাহীন ভাবে বাজার প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থার প্রতি নিবেদিত। জ্ঞানের প্রবাহের সার্বজনীন প্রবেশাধিকারের বদলে তথ্য ব্যবহারকারীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার হিসাবে দেখা হয়। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা অ্যাফেয়ার্স কেলেঙ্কারির পর তা প্রমাণিত হয়েছে। জগতের ঐক্য ধ্বনি শোনার বদলে আমরা অর্থহীন গুঞ্জন শুনতে পাই। একটা অসহনীয় স্থবির অবস্থা। যেখান থেকে আমরা সবচেয়ে নির্জনতার সুর শুনতে পাই আর আমরা মর্মাহত হই। এই বেসুরের নব্য-বাস্তবতায় শেক্সপিয়ারের এই বিখ্যাত উক্তি থেকে মানানসই আর কিছু নাই। ইন্টারনেট এখন নির্বোধের মুখের রূপকথার মতো অর্থহীন ধ্বনি ও ক্রোধে পূর্ণ।

দুর্ভাগ্যক্রমে নৈতিক দার্শনিকদের গবেষণাও জন আমোস কমিনিয়াসের স্বজ্ঞার সাথে বিরোধপূর্ণ। কমিনিয়াস ভেবেছিলেন জগতে সব তথ্য যত বেশি উন্মুক্ত ও সহজলভ্য হবে, রাজনীতিবিদরা তত বেশি সুবিবেচনার সুযোগে পাবেন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা এত সহজ ও সরল থাকেনি। তথ্যের সহজ লভ্যতা চমৎকার ব্যাপার হতে পারে। এর জটিলতা ও অস্পষ্টতা থেকে সব রকম আত্মরক্ষার দরজাও খুলে দিতে পারে। তথ্যকে প্রত্যাখান ও অবরোধ করতে পারে। যে কোন কিছুকে সাধারণীকরন ও সহজীকরন করার নীতি গ্রহণ করে দলীয় ভাবাদর্শ ও এজেন্ডাকে প্রচার করতে পারে।

মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের সমাহার কল্পকাহিনীর সংজ্ঞাকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বারবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারিত ও ভুল পথে পরিচালিত হতে হতে পাঠকদের নিজস্ব চিন্তার স্নায়বিক বৈকল্য দেখা দিচ্ছে। কল্পকাহিনীপ্রসূত এমন অবসাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তথ্যসাহিত্য (নন-ফিকশন) ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তথ্যবিভ্রান্তির এই জনসমুদ্রে আমরা এই চিৎকারগুলোই শুনতে পাই যে, আমার লেখায় শুধু সত্য বলবো, সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলবো না। কিংবা আমার গল্পটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বন করে লেখা।

যখন গণবিনাশের জন্য মিথ্যেকে বিধ্বংসী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে তখন থেকে উপন্যাস পাঠকদের কাছের তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। যদিও বানোয়াট গল্প একটা আদি মাধ্যম। আমাকে প্রায়ই এই অবিশ্বাস্য প্রশ্নটা করা হয়, আপনি কি এমন কিছু লিখেছেন যা আগাগোড়াই সত্য? আর প্রত্যেকবার আমার মনে হয় এই প্রশ্নটি সাহিত্যের সমাপ্তির লক্ষণ। পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটি নির্দোষ কিন্তু লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটি মহাবিপর্যয়কর। আমি মূলত কি বলতে চাচ্ছি? আমি কিভাবে হ্যানসের ক্যাসট্রোপ, আন্না কারেনিনো বা উইনি দ্য পুহর অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করবো? পাঠকের এমন উৎসুকতাকে সভ্যতার পশ্চাদপদতা বলে মনে করি। এটাকে আমাদের বহুমাত্রিক ক্ষমতার (মূর্ত, ঐতিহাসিক, এমনকি প্রতীক, পৌরাণিক) অবনতি বলবো।

জীবন বলে আমরা যেই ধারণা বুঝি মানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনার ধারাবাহিকতা। এই প্রশ্ন জীবনে আমাদের অংশগ্রহণকে দুর্বল করে তোলে। জীবন হচ্ছে কতগুলো ঘটনার সমষ্টি কিন্তু এটি তখনই স্বার্থক যখন আমরা জীবনকে ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। ঠিকভাবে বুঝতে পারি। ঠিক ভাবে একটা অর্থ দিতে পারি যাতে ঘটনাগুলো একটা অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়। ঘটনা হলো যাচাইযোগ্য কিছু তথ্য কিন্তু অভিজ্ঞতা হলো সম্পূর্ণ প্রকাশ করা যায় না এমন ভিন্ন কিছু। ঘটনা নয় কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের জীবন গঠনের উপাদান হিসাবে কাজ করে। অভিজ্ঞতা প্রক্রিয়াজাত হয়ে আমাদের স্মৃতিতে জমা থাকে। অভিজ্ঞতা আমাদের মন গঠনের ভিত্তি হিসাবেও কাজ করে। জীবনে অর্থের একটা গভীর কাঠামো তৈরি করে যার ভিত্তিতে আমরা আমাদের জীবনকে উন্মোচন করি। যত্নসহকারে পুরো জীবনকে যাচাই করি। আমি মনে করি শ্রুতিগল্প এই কাঠামোর শর্ত হিসাবে কাজ করে। সবাই জানে পুরাণগুলো বাস্তবে ঘটেনি কিন্তু আমরা শুনে আসছিও এগুলা সব সময় ঘটে আসছে। পুরাণ শুধু প্রাচীনকালের মহাবীরদের অভিযানে ঘটে নাই। আজকের দিনের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র, গেইমস ও সাহিত্য দিয়েও ভবিষ্যতের পুরাণ সৃষ্টি হচ্ছে। জনমানবশূন্য পর্বত যেমন রাজবংশের আবাস হয়ে উঠেছে তেমনি  আজকের লরা ক্রফটের মহানায়কোচিত ঘটনা আগামীর পুরাণ।

সত্য ও মিথ্যার এমন প্রবল বিভক্তি ও আমাদের অভিজ্ঞতার গল্প দিয়ে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয় তার নিজস্ব একটা বিশেষ মাত্রা আছে।

আমি কল্পসাহিত্য ও তথ্যসাহিত্যের মাঝে এমন মোটা দাগের পার্থক্য নিয়ে তেমন উদ্দীপ্ত হই না। যতক্ষণ এরা বিবৃতিমূলক ও বিচক্ষণতার পরিচয় না দেয়। কল্পকাহিনীর সংজ্ঞার মহাসমুদ্রে যে সংজ্ঞাটি আমি বেশি পছন্দ করি তাও সবচেয়ে পুরাতন সংজ্ঞা। যে কথাটা অ্যারিস্টটল বলেছেন। কল্পকাহিনী সবসময় একটা সত্যের মতো।

ই এম ফস্টারের সত্য গল্প ও কাহিনীসম্পর্কে পার্থক্যটাও আমি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি বলেন, রাজা মারা গেলো তারপর একদিন রানীও মারা গেলো। এটা একটা গল্প। কিন্তু যখন আমরা বলি, রাজা মারা গেলো। সেই শোক সইতে না পেরে একদিন রানীও মারা। এটা একটা কাহিনি। প্রত্যেকটা কল্পনাপ্রসূত প্রক্রিয়া গল্পের তারপর কি ঘটবে? থেকে মানব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেন এমন করে ঘটলো? এই প্রশ্নে গমন করে।

সাহিত্য সবসময় এই কেন-এর উত্তর খুঁজে। আমরা যতই বার বার এই প্রশ্ন করি না কেন। সেই একই সাধারণ উত্তর পাই—‘আমি কিছু জানি না।

তার মানে সাহিত্য যে প্রশ্নগুলো করে তা কখনো উইকিপিডিয়াতে পাওয়া যাবে না। যেহেতু সাহিত্য তথ্য ও ঘটনার বাইরের বিষয়। সাহিত্য পাওয়া যাবে মানুষের অভিজ্ঞতায়।

কিন্তু এটা সম্ভব যে উপন্যাস ও সাহিত্যর সাধারণ শাখাগুলো আমাদের চোখের সামনে অন্যান্য বয়ানের তুলনায় খুবই প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। চিত্রের গুরুত্ব ও যে সব শিল্প মাধ্যম আমাদের অভিজ্ঞতা কে সরাসরি উপস্থাপন করতে পারে যেমনচলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, ভার্চুয়াল বাস্তবতাএই মাধ্যমগুলো আমাদের প্রচলিত পাঠ অভ্যাসের নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠছে। পঠন একটি জটিল মনস্তাত্বিক ও প্রত্যক্ষনজনিত প্রক্রিয়া। এটার জন্য বিমূর্ত ও অবোধ্য বিষয়কে ধারণা ও বচনে নিয়ে আসে তারপর সংকেত ও প্রতীকে রূপান্তরিত করে। অবশেষে এটি ভাষার আকার থেকে অভিজ্ঞতার আওতায় নিয়ে আসে। এটি করতে হলে যথেষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা লাগে। সর্বোপরি পাঠ করতে যথেষ্ট মনোযোগ লাগে যা বর্তমান বিভ্রান্তিকর বিশ্বে খুব দুর্লভ।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিনিময়, পারস্পরিক যোগাযোগ, জনশ্রুতি, প্রচলিত ভাষা, মানব স্মৃতি ও গুটেনবার্গ বিপ্লব ইত্যাদির মাধ্যমে মানবজাতি অনেক দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। যখন গল্পের লিখিত রূপ কোন পরিবর্তন ছাড়া হুবহু অসংখ্য বার পুনর্মুদ্রণ করা হয় তখন এটি ব্যাপকতা লাভ করে। চিন্তাকে ভাষা দিয়ে প্রকাশ ও পরে লেখার আবিস্কার মানুষের বিশাল অর্জন। আজকের দিনে ঠিক এমনই একটা বিপ্লবের মুখোমুখি হচ্ছি। আমাদের অভিজ্ঞতাকে কোন লিখিত রূপের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি পাঠকের কাছে প্রেরণ করছি।

বর্তমানে কোন ভ্রমণ দিনলিপি রাখতে হয় না। যখন আপনি সহজেই একটা ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে বিশ্ববাসীর নিকট নিমিষেই পৌঁছে দিতে পারেন। এখন আর কষ্ট করে লিখতে হয় না। যখন আপনি সেকেন্ডে কল করে কথা বলতে পারেন। কেন এত ঢাউশ উপন্যাস পড়বেন যখন আপনি টেলিভিশনে অল্প সময়ে সিরিজ দেখতে পারেন? ঘরে বসে ভিডিও গেমস খেলতে পারলে কেন আপনি বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাবেন? কারো আত্মজীবনী পড়বেন কেন? যখন আপনি ইন্সটাগ্রামে তারকাদের অনুসরণ করে তাদের জীবনের সবকিছুই জানতে পারি।

আজকে গ্রন্থের সবচেয়ে বড় বিরোধী পক্ষ কোন আলোকচিত্র নয়। যেমনটা আমরা গত বিংশ শতাব্দীতে ভেবেছিলাম। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আজকের দুনিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার দুনিয়া। এই দুনিয়া সরাসরি আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদনকে প্রভাবিত করে।

 

|| ৩ ||

জগতের গল্প বলার সংকট সম্পর্কে আমি কোন সার্বিক চিত্র আকঁতে চাই না। কিন্তু জগতে কিছু একটা দরকারি জিনিসের অভাব আছে এই বিষয়টা আমি প্রায়ই ভাবি। আমি কাচের পর্দায় দেখি। ইন্টারনেট অ্যাপসে দেখি। কিন্তু সব কিছুকেই অবাস্তব মনে হয়। দূরের মনে হয়। দ্বিমাত্রিক লাগে। এমনকি অদ্ভুত রকম অবর্ণনাত্মক লাগে। যে কোন অদ্ভুত তথ্যও আশ্চর্যরকমভাবে সহজ হয়ে গেছে। এই সময়ে যে কেউ, যে কোন কিছু, যে কোন জায়গায়, যে কোন সময় খুব ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। অন্যদিকে যে কোন বিশেষ ও নির্দিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ নিশ্চয়তা নিয়ে বলা যায়। যেমন: পৃথিবী সমতল, টিকা মৃত্যুর কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কোন অর্থ নেই, অথবা পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র হুমকির মুখে নেই। সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে কোথাও না কোথাও কোন না কোন মানুষ ডুবে যাচ্ছে। কোথাও না কোথাও কোন না কোন সময়ে জন্য কোন না কোন রকম যুদ্ধ চলছে। অবাধ তথ্যের প্লাবনে ব্যক্তির নিজস্ব বার্তাগুলোর সীমারেখা হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্মৃতিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অবাস্তব হতে হতে একদিন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

জগতের সকল সত্য, সুন্দর ও শুভ সংবাদগুলো নির্বোধ, নিষ্ঠুর, ঘৃণাসূচক বক্তব্য ও সহিংসতার ছবির বন্যায় মারাত্মকভাবে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু  গভীর বেদনা জাগানো আবেগে নিজের প্রভাব ফেলার কোন ক্ষমতা এদের নেই। ভাষায় প্রকাশ করাটা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আমি বলতে পারি না যে, জগতের কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে সবার মাঝে এই অনুভূতি মহামারীর মতো ছড়িয়ে গেছে, যা আগে কেবল বিষাদগ্রস্ত কবিদের দখলে ছিল। চারিদিক থেকে উৎকণ্ঠার প্রস্রবণ নেমে আসছে।

সাহিত্য হচ্ছে সেইসব বলয়ের মধ্যে অন্যতম যারা আমাদেরকে পৃথিবীর নিরেট তথ্যের কাছাকাছি রাখে। কারণ তথ্য সবসময় মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির। কারণ সাহিত্য সর্বদা চরিত্রের আভ্যন্তরীণ চিন্তা ভাবনা ও অভিপ্রায়কেন্দ্রিক। অন্যান্য চরিত্রের গূঢ় ও অগম্য অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে। পাঠককে সহজেই চরিত্রদের মনোজাগতিক আচরণ ব্যাখ্যার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। একমাত্র সাহিত্য আমাদের অন্য আরেক ব্যক্তির জীবনের গভীরে প্রবেশ করার সূযোগ দেয়। তাদের চিন্তা চেতনাকে বুঝতে সহায়তা করে। তাদের আবেগ অনুভূতিকে বিনিময় করতে ও তাদের ভাগ্যের সাথে নিজেকে একাত্ম করতে সহায়তা করে।

একটা গল্প কিছু অর্থকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। যদিও এটা সেই অর্থকে সরাসরি প্রকাশ করে না। এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন অর্থের পিছনে ছোটে না। গল্পটির কাঠামো ও পরীক্ষণের উপর দৃষ্টিপাত করে। কখনো এটি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। নতুন ভাব প্রকাশের উপায় খোঁজে। পরিমিতভাবে লিখিত কোন গল্পকে আমারা এই প্রশ্নগুলো করতে পারি না: এই ঘটনাটা এইভাবে কেন ঘটলো?, এই গল্প দিয়ে আসলে কী বুঝাতে চেয়েছে?, এই গল্পটার মূল বক্তব্য কি?, এই গল্পটার পরিণতি কি হবে? খুব সম্ভবত আমাদের মন গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই বিবর্তত হয়েছে। গল্প একটি প্রক্রিয়ার মতো যেগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লক্ষাধিক উদ্দীপককে অর্থ প্রদান করে। এমনকি যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখনও তাদের বয়ান তৈরি হতে থাকে। গল্প হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অফুরন্ত তথ্যকে সংগঠিত করার প্রক্রিয়া। গল্প হলো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে একটা সংযোগ করার প্রক্রিয়া। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও কার্য-কারণ সম্পর্কিত শ্রেণীর বিন্যাস। মন ও আবেগ উভয়ে এই প্রচেষ্টায় সমভাবে অংশগ্রহণ করে।

আশ্চর্য হবার কিছু না। গল্পের মাধ্যমে প্রথমদিকে যে আবিষ্কারগুলো হয়েছে তার মধ্যে নিয়তি অন্যতম। এটা মানুষের কাছে সবসময় ভয়ানক ও অমানবিক মনে হয়েছে। নিয়তি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে শৃংখলা ও স্থিরতা প্রতিষ্ঠা করেছে।

 

|| ৪ ||

ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ

ঠিক কয়েক বছর পর। ছবির এই নারীটি, আমার মা, যে কিনা আমার জন্মের আগেই আমাকে মনে করে মন খারাপ করতো। একদিন আমাকে রূপকথা পড়ে শোনাচ্ছিল। এর মধ্যে হ্যান্স ক্রিস্টিয়ানের একটা গল্প ছিল। একটি চায়ের পাত্র যেটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। মানুষ পাত্রটিকে কতো খারাপভাবে ব্যবহার করেছে পাত্রটি সে বিষয়ে অভিযোগ করে যাচ্ছিল। যখনই পাত্রটির হাতল ভেঙে গিয়েছিল তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু লোকগুলো যদি তত শৌখিন না হতো তাহলে হয়তো তারপরও তাকে ব্যবহার করতো। অন্য ভাঙা বস্তুগুলোও তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তাদের নিজেদের ক্ষুদ্র সুখভরা জীবনের মহাআখ্যানগুলো বলছিল।

নিতান্ত শিশু হিসেবে আমার রক্তিম গাল ও জলভরা চোখ নিয়ে খুব দরদ নিয়ে গল্পগুলো শুনতাম। কেননা আমি বিশ্বাস করতাম জড় বস্তুরও নিজস্ব সমস্যা ও আবেগ আছে। সম্পূর্ণ মানব সমাজের ন্যায় একটা সামাজিক জীবন আছে। রান্নাঘরের আলমারিতে রাখা বাসনগুলো একটি আরেকটির সাথে কথা বলতে পারে। ড্রয়ারের চামচ, ছুরি ও কাটা চামচ একটা পরিবারের মতো থাকতে পারে। একইভাবে পশুপাখিরা খুবই রহস্যময়, জ্ঞানী ও আত্মসচেতন প্রাণী যাদের সাথে মানুষ সবসময় পরম আত্মিক বন্ধনে যুক্ত ছিল। মানুষের সাথে একটা গভীরে প্রোথিত সাদৃশ্য ছিল। নদী-নালা, বন-জঙ্গল ও পথেরও অস্তিত্ব ছিল। তারাও সজীব ছিল যা আমাদের ভূমিকে চিত্রাঙ্কিত করেছে। আমাদের মধ্যে একটা নৈকট্য বোধ তৈরি করেছে। হেঁয়ালিপূর্ণ স্থানিক মনন তৈরি করেছে। আমাদের চারপাশের ভূ-দৃশ্যও অনেকটা প্রাণময়। চাঁদ ও সূর্যের মতো সকল দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান মহাজাগতিক বস্তুগুলো নিজস্ব প্রাণশক্তিতে পূর্ণ।

ঠিক কখন থেকে আমি সন্দেহ প্রবণ হয়ে উঠলাম। ঠিক কখন আমার মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি লাগলো আর সবকিছু ভিন্নভাবে দেখতে লাগলাম। সবকিছু তত ক্ষুদ্র লাগলো না। আমার চোখে সবকিছু সহজ ও সরল হয়ে উঠলো। পৃথিবীর কলতান থেমে গিয়ে শহরের কর্কশ স্বরে ভরে গেলো। কম্পিউটারের গুনগুন, মাথার উপর দিয়ে বয়ে চলা উড়োজাহাজের গগণবিদারী নিনাদ ও তথ্যের সাগর থেকে তেড়ে আসা সাদা শব্দের করাল গ্রাসে পৃথিবী নতজানু হয়ে পড়লো।

একটা পর্যায়ে এসে আমরা আমাদের জীবনকে টুকরো টুকরো করে দেখতে লাগলাম। সবকিছু আলাদা আলাদা করে বুঝতে লাগলাম। যেন একটা থেকে আরেকটা এক ছায়াপথ দূরত্বে অবস্থান করছে। আমাদের যাপিত জীবনের ধরন বিষয়টাকে আরো বেশি করে নিশ্চিত করে দিচ্ছে। ডাক্তাররা নির্দিষ্ট রোগ ছাড়া চিকিৎসা করে না। আমরা যে পথে কাজে যাই সে পথে তুষার চাষে কোন কর আরোপের সংযোগ নাই। আমাদের দুপুরের খাবারের সাথে বিশাল মজুত খামারের কোন ব্যাপার নাই। এশিয়ার কোন জীর্ণ কারখানার সাথে আমার পোশাকের সম্পর্কের কোন খোঁজ রাখি না। সবাই সবকিছু থেকে আলাদা আলাদা। কারো সাথে কোনকিছুর কোন সংযোগ নাই।

আর এই জটিল বাস্তবতার সাথে তাল মেলাতে আমাদের দেয়া হয়েছে নাম্বার, নামের ট্যাগ, কার্ড, প্লাস্টিকের পরিচয় পত্র। এসব কিছু করা হয়েছে পৃথিবীর ক্ষুদ্র একট অংশে আবদ্ধ করে জগতের সামগ্রিকতা থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য।

আমরা দেখতে পাচ্ছি না পৃথিবী নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না পৃথিবী শুধুমাত্র একগুচ্ছ জড়বস্তুর সংগ্রহশালা হয়ে যাচ্ছে। প্রাণহীন এক বলয় যেখানে আমরা পথ হারিয়ে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি। অন্যের অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্তের প্রভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উদ্দেশ্যহীন ঘুরছি। অবোধ্য কোন নিয়তি ও অস্তিত্বের বোধ মেনে নিয়ে কোথাও আবদ্ধ আছি। অথচ এরাই আমাদের মানব ইতিহাস গঠনের শক্তি হিসাবে কাজ করে। আমাদের আধ্যাত্মিকতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অগভীর ও আচরণ নিষ্ঠতায় পরিণত হচ্ছে। আমরা শুধুমাত্র শারীরিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর অন্ধ অনুসরণকারী হয়ে যাচ্ছি। এই শক্তিগুলো আমাদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যেন আমরা সবাই জম্বি। আজকের এই বিভ্রান্তির দুনিয়ায় সত্যি আমরা জম্বি!

এই জন্য আমি সবসময় ওই অন্য জগতের জন্য অধীর হয়ে থাকি। ওই চা পাত্রের দুনিয়ার জন্য অধীর হয়ে থাকি।

 

|| ৫ ||

আমি সারাজীবন ওই সমস্ত পারস্পরিক বন্ধন ও প্রভাবগুলো নিয়ে মুগ্ধ হয়েছি যেগুলো সম্পর্কে আমরা তেমন সচেতন থাকি না। কিন্তু এই সম্পর্কগুলো হঠাৎ করে আমাদের সামনে চলে আসে। হয় কাকতালীয় ঘটনার বিস্ময় হিসাবে না হয় নিয়তির অমোঘটানে দেখা হয়ে যায়। ওই সকল সেতু, নাট-বল্টু, ঝালাইকৃত জয়েন্ট ও সংযোগগুলো যার সব আমি আমার ফ্লাইটস উপন্যাসে তুলে এনেছি। আমি সবসময়ই ঘটনা একত্রিত করে আসছি। জগতের শৃংখলা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে একজন লেখকের মন হলো সংশ্লেষাত্মক মন। এই মন দুনিয়ার সকল সম্ভাব্য ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র তথ্যকে একত্রিত করে তাদের দিয়ে পুরো একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে চায়।

আমাদের কিভাবে লেখা উচিৎ? কিভাবে একটা গল্পের কাঠামো দাড় করানো উচিৎ যাতে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে যায় যেখান থেকে একটা নক্ষত্রতূল্য জগৎ তৈরি করা সম্ভব।

স্বভাবতই আমি মনে করি পুরাণ, উপকথা, শ্রুতিকথা যেগুলো মুখে মুখে তৈরি হয়েছে, যাদের জন্য আমাদের জগত অস্তিত্বশীল, তাদের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এই সময়ের গল্পগুলো হতে হবে আরও বহুমাত্রিক ও জটিল প্রকৃতির। যেহেতু আমরা অনেক বেশি জানি। আমরা দূরের বস্তুগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস্য রকম আন্তঃসম্পর্কের প্রকৃতিটা জানি।

চলুন বিশ্ব ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তের দিকে ফিরে তাকাই।

১৪৯২ সালের ৩রা অগাস্ট, সেদিন স্পেনের পালোস বন্দরের ঘাট থেকে সান্তা মারিয়া নামে ছোট ক্যারাভেলে করে ক্রিস্টোফার কলম্বাস সমুদ্র যাত্রা করেন। আকাশে সূর্য ঝলমল করছিল। নাবিকেরা ঘাটে আনাগোনা করছিল। খালাসীরা বাক্স উঠানামা করায় ব্যস্ত ছিল। প্রচণ্ড রৌদ ছিল কিন্তু পশ্চিমদিকের মৃদুমন্দ বাতাস বিদায় জানাতে আসা স্বজনদের অজ্ঞান হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। গাংচিলেরা মানুষের কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে জলের উপর লম্বা ঢালু রাস্তার উপরে আর নিচে দিয়ে উড়ে বেড়াতে লাগলো।

সমুদ্রের এক পাড়ের এই ছোট একটি সাধারণ ঘটনা সমুদ্রের অন্য পাড়ে ৬০ মিলিয়ন মধ্যে ৫৬ মিলিয়ন আদি আমেরিকানদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই সময়ে তারা বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ ভাগ ছিল। ইউরোপিয়ানরা অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু মরণাত্মক রোগ উপহার হিসাবে নিয়ে এসেছিল। রোগ ও ব্যাকটেরিয়ার জন্য আদি আমেরিকানদের কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল না। তার উপর ছিল অমানবিক সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞ। এই জাতি নিধন চলেছে বছরের পর বছর যা পুরো ভূ-ভাগের চেহারাই বদলে দিয়েছে। যেখানে শিম, ভূট্টা, আলু ও টমেটো চাষ হতো। সুশৃংখল পদ্ধতিতে পানি সেচ করার প্রচলন ছিল। সেখানে বুনো ঘাস ফিরে এসেছিল। কয়েক বছরের মধ্যে ১৫০ মিলিয়ন একর চাষের জমি পুরোপুরি জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। যেহেতু বনায়ন ফিরে এসেছিল। ব্যাপক পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিল। গ্রিন হাউজ ইফেক্ট দুর্বল হতে লাগলো। যা বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে নিম্নগামী করে ফেলেছিল। সতের শতকের শেষের দিকে ইউরোপ মহাদেশে যে দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে ছোট একটা বরফ যুগ চলেছিল। বৈজ্ঞানিক মতে এই বিপর্যয় ছিল আমেরিকান নিধনের ফল।

এই ছোট বরফ যুগ সমগ্র ইউরোপের অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছিল। পরবর্তী কয়েক দশকে লম্বা বরফ জমাট শীতকাল, স্নিগ্ধ শীতল গ্রীষ্মকাল, তীব্র তুষারপাতের কারণে প্রচলিত কৃষি খামারকে আমূল বদলে দিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের ছোট ছোট পরিবার যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতো তারা অকেজো হয়ে পড়লো। দুর্ভিক্ষের ঢেউ গ্রাস করে ফেললো। বিশেষায়িত উৎপাদনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড ঠান্ডা জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। তাদের কৃষি খামারগুলো উৎপাদনক্ষম ছিল না। তারা ব্যবসা ও বানিজ্য করতে শুরু করলো। প্রবল ঝড়ের হুমকিতে ডাচ নিম্নভূমিগুলো শুকিয়ে যেতে ত্বরান্বিত করেছিল। জলাভূমি ও অগভীর সামুদ্রিক এলাকাগুলোকে শুকনো ভূমিতে পরিণত করে ফেলেছিল।

এই বরফ যুগের পরিসীমা যখন দক্ষিণাভিমুখে অগ্রসর হয় তখন কডের ঘটনাটি ঘটে। যদিও এটা  স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর জন্য মহাদু্র্যোগের কারণ। কিন্তু ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। দেশ দুটিকে নৌ ও বানিজ্যিক শক্তিতে অগ্রসর করে তোলে।

এমন প্রকট শীতলতা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোকে সবচেয়ে ভীষণভাবে ভুগিয়েছে। গ্রীনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডকে ভেঙ্গে দুই ভাগ করেছে। তীব্র শীত শস্য উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে দিয়েছে। দীর্ঘকালের জন্য দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য ঘাটতিতে আক্রান্ত হয়েছে। তাই সুইডেনের লোভাতুর হাত ইউরোপের দক্ষিণ অভিমুখে বাড়িয়েছে। পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে (বিশেষ করে বাল্টিক সাগর বরফে জমে যাওয়ায় সৈন্যরা সহজে পথ পাড়ি দিতে পেরেছিল)। ইউরোপ দীর্ঘ ত্রিশ বছরের যুদ্ধ লিপ্ত ছিল।

বিজ্ঞানীরা আমাদের বাস্তবতাকে আরো ভালো করে বোঝার জন্য, জগতকে আরে শৃঙ্খলিতভাবে সুসংগত দেখানোর জন্য, গভীরভাবে সম্পর্কিত দেখানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা এখন আর সহজ বাটারফ্লাই ইফেক্ট না যেটা শুরুতে একটা ছোট পরিবর্তন দিয়ে শুরু হবে তারপর ভবিষ্যত এক মহীরুহের আকারের ফল বয় আনবে। আজকের যুগে আমাদের অগণিত প্রজাপতির সমাহার। অনবরত অগণিত পাখার ঝাপটানো। সময়ের পরিক্রমায় চারিদিকে জীবনের শক্তিশালী ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।

আমার মতে বাটারফ্লাই ইফেক্টের আবিষ্কার আমাদের দক্ষ হয়ে উঠার ক্ষমতার সময়কালকে ও আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সমাপ্তি ঘোষণার লক্ষণ বলে মনে হয়। একইভাবে জগতে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের নিশান। এটা মানবজাতির একজন নির্মাতা, একজন বিজেতা বা একজন আবিষ্কারক হওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারে নাই। এই লক্ষণ এটাই প্রকাশ করে যে বাস্তব হচ্ছে এমন জটিলতর যা মানুষ তার কল্পনাতেই আনতে পারে নাই। আমরা শুধু এই জটিল বাস্তব প্রক্রিয়ার ক্ষুদ্র একটা অংশমাত্র।

আমাদের আকর্ষণীয় অস্তিত্বের অনেক অনেক প্রমাণ আছে। মাঝে মাঝে বিশ্বপরিক্রমায় আমাদের সত্তাকে আশ্চর্যরকমভাবে নির্ভর করতে হয়। আমরা সবাইমানুষ, বৃক্ষ, জন্তু ও জড় বস্তুএক জায়গাতে সন্নিবেশিত হয়ে আছি। পদার্থবিদ্যার নিয়মে সবাই পরিচালিত হচ্ছি। এই সাধারণ স্থানের একটা নির্দিষ্ট আকার আছে। এই আকারের মাঝে পদার্থবিদ্যার নীতিতে অগণিত আকার খোদাই করে রেখেছে যারা অবিরতভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত আছে। আমাদের হৃদযন্ত্রের রক্তজালিকা অনেকটা নদীর অববাহিকার মতো। গাছের পাতার আকার প্রায় হৃদযন্ত্রের মতো। ছায়াপথের ঘূর্ণন গতি অনেকটা রান্নাঘরের ওয়াশ বেসিনের মতো। ব্যাকটেরিয়ার উপনিবেশের মতোই আমাদের সমাজ কাঠামো কাজ করে। ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক দিকগুলোর সাথে জগৎ ও বাস্তবতার মাঝে অসংখ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

আমাদের কথা, চিন্তা ও সৃজনশীলতা কোন বিমূর্ত কিছু নয়, যা জাগতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। বরং আমাদের সারবস্তু পরিবর্তনের অসীম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্য স্তরে পৌঁছানোর একটি ধারাবাহিকতা।

 

|| ৬ ||

আমি প্রায়ই ভাবি আজকের দিনে এটা কী সম্ভব? নতুন কোন গল্পের ভিত্তি খুঁজে বের করা। যা একইসাথে বিশ্বজনীন, বিস্তৃত, সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রকৃতির মূল প্রোথিত, পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক এবং একই সাথে সর্বজন বোধগম্য। এমন কোন গল্প কি আছে যা ব্যক্তির নিজস্ব স্বত্ত্বার অন্তর্গত যোগাযোগহীন কারাগারের সীমারেখাকে ছাড়িয়ে যাবে। একই সাথে অসংখ্য বাস্তবতাকে প্রকাশ করবে। পরস্পরের মধ্যে অটুট সম্পর্ক প্রকাশ পায়। তাহলেই কেবল সবার সাথে বিনিময়কৃত মতামতগুলোর কৃত্রিমতার কেন্দ্র থেকে, অস্পষ্টতা থেকে ও পদদলন থেকে নিজেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখতে পারবে।

আমি খুব আনন্দিত যে সাহিত্য অলৌকিকভাবে তার নিজস্ব সকল বিষয় যেমন খামখেয়ালিপনা, অলীকতার প্রবাহ, উস্কানি, হাস্যরস ও উন্মাদনা ইত্যাদির উপর নিয়ন্ত্রণ ও দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। আমি উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রশস্ত পরিপ্রেক্ষিতের স্বপ্ন দেখি। আমরা যা কল্পনা করে রেখেছি তার থেকে গল্পটা যেন প্রসঙ্গের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমি স্বপ্ন দেখি ভাষা যেন সব থেকে অস্পষ্ট স্বজ্ঞাকে প্রকাশের ক্ষমতা রাখে। আমি এমন এক রূপকের স্বপ্ন দেখি যা সব সাংস্কৃতিক ব্যবধানকে ছাপিয়ে যাবে। সর্বশেষ সাহিত্যের ধারা যা বৃহৎ পরিসরের ও সীমা অতিক্রমকারী কিন্তু তারপরও পাঠকরা পড়তে ভালোবাসবে।

আমি এক নতুন ধরনের গল্পকারের স্বপ্ন দেখিএকজন চতুর্থ-পুরুষ যে কিনা শুধু ব্যাকরণ দিয়ে তৈরি হবে না। যে কিনা প্রত্যেকটা চরিত্রের প্রত্যেকটা দৃষ্টিকোণকে আত্মস্থ করতে সক্ষম। এমনকি চরিত্রের সক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে। যার দেখার দৃষ্টি অসীম ও বোঝার দৃষ্টিকোণ প্রশস্ত। যে কিনা সময়ের গন্ডিকে অবহেলা করতে জানে। আর হ্যাঁ, আমি মনে করি এমন গল্পকারের আবির্ভাব সম্ভব।

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন বাইবেলে কে সেই আশ্চর্য গল্পকার যে কিনা উচ্চ কন্ঠে বলে: শুরুতে ছিল শব্দ? কে সেই গল্পকার যে কিনা পৃথিবীর সৃষ্টির বর্ণনা দিয়েছে। প্রথমদিন যখন শৃঙ্খলা থেকে গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। কে মহাবিশ্বের উৎসের অনুক্রম অনুসরণ করেছে। কে ঈশ্বর কি চিন্তা করে জানতে পেরেছে। নিজের সংশয় সম্পর্কে সচেতন। কে স্থির হাতে কাগজে সেই অবিশ্বাস্য বাক্যটি লিখেছে: এবং ঈশ্বর দেখেছেন যে এটা মঙ্গলময়। কে সে যে ঈশ্বরের চিন্তাকে জানতে পেরেছে?

সকল ধর্মতাত্ত্বিক সংশয় দূরে রেখে আমরা এই রহস্যময় দরদী গল্পকারকে বিস্ময়কর ও বিশিষ্ট জ্ঞান করতে পারি। এটাই একটা দৃষ্টিকোণ, একটা দেখার প্রেক্ষাপট যেখান থেকে আমরা সবকিছু দেখতে পারি। সবকিছু দেখতে পারা মানে বিশ্বের চূড়ান্ত সত্যকে জানা যে সবকিছুই পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়ে একটা সামগ্রিক রূপ নেয়। যদিও তাদের মধ্যে সংযোগগুলো আমাদের কাছে এখনও উন্মুক্ত না। সবকিছুকে সামগ্রিকরূপে দেখতে পারা মানে জগতের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। কারণ এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে আজকে এখানে যা কিছূ ঘটছে তার সাথে অন্যখানে কিছু ঘটে যাওয়ার সংযোগ আছে। পৃথিবীর একপ্রান্তে কোন সিদ্ধান্ত নিলে তার কোন না কোন প্রভাব অন্যপ্রান্তে পড়বে। আমারতোমার মধ্যে পার্থক্য করলে তা খুবই বির্তকিত হয়ে পড়বে।

তাই কোন বিষয়ে গল্প বললে এমন সততার জায়গা থেকে বলা উচিৎ যার সামগ্রিক একটা রূপ পাঠকের মনে ফুটে উঠে। পাঠক যেন সব বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে একত্রিত করে একক একটা নকশা তৈরি করতে পারে। একটা ছোট ঘটনার মাঝে সমগ্র মহাজগতকে দেখতে পায়। কোন গল্প বলা মানে হলো সবাই ও সবকিছু একটি সাধারণ ধারণায় পৌছে যায়। প্রতিটি গ্রহের ঘূর্ণায়েনের মতো করে এই ধারণা যেন আমাদের মনে তৈরি হয়।

সাহিত্যের এটা করার শক্তি আছে। আমাদের উচিত উচ্চ সাহিত্য ও নিম্ন সাহিত্যর শ্রেনীবিন্যাস মুছে ফেলা। জনপ্রিয় ও কুলীন সাহিত্যের সীমা অতিক্রম করা। সাহিত্যের ধারাগুলোকে হালকা করে দেখা। মহাজাগতিক সাহিত্যের ধারণাকে মাথায় রেখে সকল জাতীয় সাহিত্যর সংজ্ঞাকে বাতিল করা উচিৎ। সাহিত্য একটা একক সত্তা। অনেকটা ইউনোস মুন্ডাস-এর (এক বিশ্ব) মতো। একটা সাধারণ মনোজাগতিক বাস্তবতা যেখানে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো এক রকম। লেখক ও পাঠক একই ভূমিকা পালন করে। লেখক একবার সৃষ্টি করে। পাঠকেরা ব্যাখ্যার মাধ্যমে বারবার সৃষ্টি করে।

সম্ভবত আমাদের ভগ্নাংশকে বিশ্বাস করা উচিত। এটা সেই ভগ্নাংশ যা মহাজগত সৃষ্টি করে আমাদের অভিজ্ঞতাকে আরো বেশি করে বর্ণনা করতে পারে। আরো জটিল উপায়ে এবং আরো বহুমাত্রিকতা নিয়ে। আমাদের গল্পগুলো একটা অন্যটাকে অগণিতভাবে নির্দেশ করতে পারে। তাদের মূল চরিত্রগুলো একটা অন্যটার সাথে নানাভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

আমি মনে করি আজকে বাস্তববাদ বলতে যা বুঝি তার ধারণাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা উচিত। নতুন কোন ধারণা যা আমাদের আত্ম-অহমিকার দিগন্তকে পার হতে সহায়তা করবে। কাচের পর্দাকে ভেদ করে পর্দার পাশের জগতকে দেখাবে। কেননা ইদানিং আমরা গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে গড়ে উঠা সম্পর্ক দিয়েই জগৎ ও তার বাস্তবতাকে দেখি। সম্ভবত আমাদের সামনে অবশ্যম্ভাবীভাবে নব্য-পরাবাস্তববাদ অপেক্ষা করছে। কিছু পুর্নবিন্যাস্ত দৃষ্টি পথ যা আমাদের যেকোন প্রহেলিকার সামনে দাঁড়াতে ভীত হতে দিবে না। কার্য-কারণ সম্পর্কের সরল নিয়মের বিরুদ্ধে যেতে দ্বিধা করবে না। বাস্তবিকার্থে, আমাদের বাস্তবতা অনেকটা পরাবাস্তব হয় উঠেছে। আমি নিশ্চিত পুরাতন অনেক গল্পকে আমাদের নতুন বৌদ্ধিক প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষিতে নতুন করে আবার লিখতে হবে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অনুপ্রেরণায় নতুন রূপ দিতে হবে। কিন্তু আমি সবসময় মনে করি সব লেখায় আমাদের পুরাণের প্রসঙ্গ ও সমগ্র মানুষের কল্পনাকে উল্লেখ করতে হবে। পুরাণের জমাট কাঠামোতে ফিরতে পারলে বর্তমানে আমরা যে বিশেষায়িত যুগে বাস করছি তার মাঝে একটা স্থিরতার বোধ নিয়ে আসতে পারবো। আমি মনে করি পৌরাণিক গল্পগুলো আমাদের মনোজগত গঠনে ভূমিকা রাখে। আমরা সম্ভবত তাদেরকে কখনোই এড়িয়ে যেতে পারবো না (বড় জোর আমরা তাদের প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারি)।

কোন সন্দেহ নাই কোন প্রতিভাবান খুব শীঘ্রই আর্বিভূত হবে। যে কিনা কল্পনাতীত বয়ান লিখবে। যেখানে সব প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা একত্রিত করে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গল্প লিখবে যা আগে কখনও কেউ লেখেনি। এই নতুন গল্পশৈলী নিশ্চিত আমাদের পরিবর্তন করে দিবে। পুরাতন ও সীমাবদ্ধ প্রেক্ষিতকে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু উন্মুক্ত করে দিবে। যদিও এটা আমাদের মাঝেই বিরাজমান ছিল কিন্তু আমরা অন্ধের মতো একে দেখতে পাই নাই।

টমাস মান তার ডক্টর ফাসটাস উপন্যাসে এমন এক সুরকার সম্পর্কে লিখেছেন যে কিনা পরম সঙ্গীতের একটি নতুন আকার সৃষ্টি করেছেন। যে সুর মানুষের চিন্তাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম। কিন্তু মান এটা বর্ণনা করেননি যে এই সঙ্গীতটা কিসের উপর নির্ভরশীল। তিনি শুধু কল্পনার মাধ্যমে ধরে নিয়েছেন এমন সুর সৃষ্টি সম্ভব। সম্ভবত এইটুকু প্রচেষ্টাই একজন শিল্পী করতে পারেন। কোন কিছুর পূর্বাভাস দেয়া যার অস্তিত্ব সম্ভবপর। যার ফলে একে কল্পনায় ধারণ করা যায়। তাই কল্পনা করা হলো অস্তিত্বের প্রথম সোপান।

 

|| ৭ ||

আমি কল্পনা সাহিত্য লিখি, তবে তা পুরোপুরি বানোয়াট নয়। যখন আমি কিছু লিখি তখন তাকে আমার ভেতর থেকে অনুভব করতে হয়। গল্পের যেসব জীব ও জড় বস্তু থাকবে তার সব কিছু আমার চেতনার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। মানুষ ও মানুষের বাইরে সকল সত্তা ও উপাদান। সব প্রাণী ও প্রাণহীন বস্তু। আমি সব বস্তু ও ব্যক্তিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাছ থেকে দেখি। প্রথমে আমার ভেতরে তাদের মূর্ত করে তুলি। তারপর বাহ্যিকভাবে তাদের ব্যক্ত করি।

এই দরদের অনুভূতি আমার ভেতরে কাজ করে। কারণ দরদ হলো কোন কিছুকে মূর্তমান করে তোলার একটা শিল্প। অনুভূতি বিনিময়ের শিল্প। দরদ দিয়ে আমরা অনেকভাবে জগতের মিলগুলো আবিষ্কার করতে পারি। গল্প সৃষ্টি মানে অবিরাম কোন কিছুকে জীবন দান করা। সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকে অস্তিত্বমান করে তোলা যেগুলো আমাদের অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করবে। যে অবস্থা মানুষ সহ্য করেছে ও তাদের স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে। দরদ সকল কিছুকে মূর্তমান করে তোলে যার সাথে এটার প্রাসঙ্গিকতা আছে। এদের একটা আত্মপ্রকাশের স্বর দান করে। এদের একটা স্থান ও কাল প্রদান করে যেটাতে এরা অস্তিত্বশীল থাকবে, প্রকাশিত হবে। চায়ের পাত্র কথা বলতে শুরু করেছে তাই দরদকে ধন্যবাদ জানাই।

দরদ হলো ভালোবাসা প্রকাশের সবচেয়ে বিনয়ী মাধ্যম। এটা এমন এক ভালোবাসা যা আপনি ধর্মগ্রন্থ বা বেদবাক্যে খুঁজে পাবেন না। কেউ এটা নিয়ে কসম কাটে না। কেউ এটা নিয়ে উদ্ধৃতি দেয় না। এর নির্দিষ্ট কোন প্রতীক বা সংকেত নেই। এটা কোন অপরাধের দিকে ঠেলে দেয় না কিংবা প্রতিহিংসা জাগায় না।

এটা তখনই আবির্ভূত হয় যখন আমরা আমাদের আত্মসত্তার বাইরে অন্য কারো দিকে খুব আবেগ নিয়ে তাদের জীবনকে কাছ থেকে দেখি।

দরদ খুব অন্তস্থ ও স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। এটা সহানুভূতি মতো বিনয়ী অনুভূতির উর্ধ্বে। তার বদলে এটা একটা সচেতন সম্ভবত কিছুটা বিষাদময় কিছু। সবার সাথে ভাগ করে নেয়ার মতো আবেগ। দরদ হলো ভিন্ন ব্যক্তির প্রতি গভীর আবেগতাড়িত উদ্বেগ। দরদ প্রাকৃতিকভাবে খুব নাজুক অনুভূতি। দুঃখ দুর্ভোগে দরদের কোন প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। সময় একে বশ করতে পারে না। দরদ আমাদের সবাকে একত্রিত করে একটা বন্ধন তৈরি করতে পারে। আমাদের মাঝে ভিন্নতা ও সাদৃশ্যকে প্রকাশ করে। এটা পৃথিবীকে জীবন্ত, প্রাণসঞ্চারী ও পরস্পর সংযুক্ত হিসাবে উপস্থাপন করে। সবার সাথে সহযোগী মনোভাব তৈরি করে। একজনকে অন্যজনের উপর নির্ভরশীল করে তোলে।

সাহিত্য এমন এক দরদে ভরা যা নিজের জন্য নয় বরং অন্যের জন্য বাঁচতে প্রলুব্ধ করে। দরদ উপন্যাসের মনোজগতের মৌলিক কলকব্জা। আমি কৃতজ্ঞ এমন জাদুকরী যন্ত্রের জন্য। মানুষের মাঝে আন্তঃযোগাযোগ তৈরির সবচেয়ে অকৃত্রিম মাধ্যম। দরদ আছে বলেই আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো সময়ের পরিক্রমা অতিক্রম করতে পারে। তাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারে যারা এখনো জন্ম গ্রহণ করেনি। আমরা আজ যা লিখেছি আগামীকাল তারা তাই হয়ে উঠবে। আমাদের অস্তিত্ব ও আমাদের জগত সম্পর্কে যে গল্পগুলো লিখেছি তার মাঝে নিজের অস্তিত্ব ও জগতকে খুঁজে পাবে।

আমার ঠিক জানা নেই তাদের জীবনটা কেমন হবে। তারা কেমন মানুষ হয়ে উঠবে। আমি এই না জানা, না বোঝার কারণে খুব লজ্জা ও অপরাধ বোধে ভুগি।

বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু সংকটের মাঝে আমরা আমাদের সঠিক পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমরা কেমন এই অবস্থার বিরোধীতা করতে উৎকণ্ঠিত। এই বিশ্বকে মুক্ত করতে চাচ্ছি। বলতে চাচ্ছি জগৎ তো শূন্য থেকে আসে নাই। আমরা ভুলে যাই যে জগৎ অদৃষ্ট ও নিয়তির পরিণতি নয়। বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এমন কি ধর্মীয় বিষয়ে বিশেষ সিদ্ধান্তের সমাবেশ। লোভ, প্রকৃতির মর্যাদা দানে ব্যর্থতা, স্বার্থপরতা, অগভীর কল্পনা, অবিরাম শত্রুতা ও দায়িত্ব বোধের অভাব বিশ্বকে একটি জড় ও অকেজো বস্তু করে রেখেছে। যে বস্তু কেটে টুকরো টুকরো করা যায়। যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে ধ্বংস করে ফেলা যায়।

এই কারণেই আমি বিশ্বাস করি আমাকে গল্প বলে যেতে হবে। এমনভাবে বলতে হবে যেন পৃথিবী একটা একক জীবন্ত সত্তা। আমদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে। এমনভাবে বলতে হবে যে আমরা খুব সামান্য ও সাধারণ কিছু কিন্ত একই সাথে পৃথিবী শক্তিশালী অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

Copyright © Nobel Prize Foundation 2019

বাংলা কপিরাইট © প্রতিধ্বনি

উৎস লিংক  Olga Tokarczuk–Nobel Lecture-NobelPrize.org