কাল বহু দূর || চিমামান্দা নগোজি আদিচে

অ+ অ-

 

|| চিমামান্দা নগোজি আদিচে ||

বর্তমান আফ্রিকান সাহিত্যের উজ্জ্বল নাম চিমামান্দা নগোজি আদিচে। দ্য টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেন্টের মতে, সমালোচকদের বহুল প্রশংসিত তরুণ অ্যাংলোফোনিক সাহিত্যিক যারা নতুন প্রজন্মকে আফ্রিকান সাহিত্যের দিকে আকর্ষণ করছে, তাদের মধ্যে চিমামান্দা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তার প্রথম উপন্যাস পার্পল হিবিস্কাস সমালোচকদের নজর কাড়ে এবং  বেস্ট ফার্স্ট বুক ক্যাটাগরিতে কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কার লাভ করে। নাইজেরিয়ার ইনুগু শহরে এক ইবু নৃগোষ্ঠী পরিবারে ১৯৭৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন চিমামান্ডা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বাবা জেমস নওয়ে আদিচে ইউনিভার্সিটি অফ নাইজেরিয়ায় পরিসংখ্যানের অধ্যাপক ছিলেন। আর মা গ্রেস ইফিওমা ছিলেন একই ইউনিভার্সিটির প্রথম নারী রেজিস্ট্রার। ১৯৯৭ সালে আদিচে কিছু কবিতা প্রকাশ করেন এবং ১৯৯৮ সালে ফর লাভ অফ বিয়াফিরা নামের একটি নাটক রচনা করেন। ২০০২ সালে তার ছোটগল্প ইউ ইন আমেরিকা কেইন প্রাইজ লাভ করে এবং দ্যাট হারমাটন মরনিং যৌথভাবে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। ২০০৩ সালে তিনি ওহেনরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

 

কাল বহু দূর || চিমামান্দা নগোজি আদিচে

অনুবাদ || দিলশাদ চৌধুরী

এটা ছিলো তোমার নাইজেরিয়ায় কাটানো শেষ গ্রীষ্মকাল, তোমার বাবা মায়ের বিচ্ছেদের ঠিক আগের গ্রীষ্মকাল, তোমার মায়ের তোমাকে দিয়ে আর কখনো নাইজেরিয়ায় পা না রাখার, তোমার বাবার পরিবারের সাথে, বিশেষত দাদীর সাথে, দেখা না করার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয়ার আগের গ্রীষ্মকাল। তোমার ওই গ্রীষ্মের তাপটুকু বেশ ভালোই স্মরণে আছে, এমনকি এখনও, আঠারো বছর পরেওযেভাবে দাদীর উঠোনে আর্দ্র তপ্ততা ছড়িয়ে থাকতো,  এত এত গাছে ঘেরা একটা উঠোন যে টেলিফোন তার পাতায় পাতায় জড়িয়ে থাকতো আর শাখাগুলো একে অন্যকে ছুঁয়ে যেত আর মাঝেমধ্যেই কাজুবাদাম গাছে আম আর আমগাছে পেয়ারা ঝুলতে দেখা যেত। ঝরা পাতার পুরু চাদর তোমার খালি পায়ের নিচে ভিজে উঠত। বিকেল দিকে হলদে পেটের মৌমাছি তোমার আর তোমার ভাই ননসো আর তোমার ফুপাতো ভাই ডোজিরও মাথার চারপাশে ভোঁ ভোঁ করত, আর সন্ধ্যাবেলা দাদী কেবল তোমার ভাই ননসোকেই গাছে উঠতে দিত ফলে ভরা ডালগুলো ঝাঁকাতে, যদিও তুমি ওর চেয়েও ভালোভাবে গাছে উঠতে পারতে। ফলের যেন বৃষ্টি নামত, আভোকাদো আর কাজু আর পেয়ারা, তুমি আর তোমার ফুপাতো ভাই ডোজি সেগুলো কুড়িয়ে ভরে নিতে পুরনো বালতিগুলোতে।

এটা সেই গ্রীষ্মকাল ছিলো যেবার দাদী নোনসোকে শেখালো কিভাবে নারকেল সংগ্রহ করতে হয়। নারকেল গাছে ওঠা বেশ শক্ত ছিলো, শাখাহীন আর এত লম্বা, আর দাদী ননসোকে একটা লম্বা লাঠি দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলো কিভাবে গুঁতো দিয়ে ওই খসমসে স্তরযুক্ত জিনিসগুলোকে নিচে ফেলতে হবে। দাদী তোমায় দেখালোনা, কারণ তার মতে মেয়েরা কখনো নারকেল পাড়ে না। দাদী একটা শক্ত পাথরে ঠুকে সাবধানে নারকেল ফাটিয়ে নেয় যাতে পানিময় দুধটা নিচের অংশে রয়ে যায়, একটা অমসৃণ পেয়ালা যেন। ঠান্ডা বাতাসের মত দুধের একটা করে চুমুক সবাই পেত, এমনকি খেলতে আসা রাস্তার ছেলেপুলেগুলোও, আর দাদী চুমুকের ঐতিহ্যে খবরদারি করত যাতে প্রথম চুমুকটা ননসোই পায়।

এটা সেই গ্রীষ্মকাল ছিলো যখন তুমি দাদীকে জিজ্ঞেস করেছিলে যে কেন ডোজির বয়স তেরো, ননসোর চেয়ে এক বছর বেশি হওয়া সত্ত্বেও প্রথম চুমুক ননসোই পায় আর দাদী উত্তর দিয়েছিলো যে ননসো তার ছেলের একমাত্র ছেলে যে কিনা নাবুইসি বংশের নাম সামনে নিয়ে যাবে যেখানে ডোজি তো কেবল এক নোয়াডিয়ানা, মেয়ের ঘরের ছেলে। এটা সেই গ্রীষ্মকাল ছিলো যেবার তুমি উঠানে একটা সাপের খোলস দেখতে পেলে, অটুট আর খাঁটি, ঠিক যেন একটা স্বচ্ছ মোজা, আর দাদী তোমায় বললো যে সাপটার নাম হলো এচি এটেকা, অর্থাৎ কাল বহুত দূর। এক কামড়, সে বললো, আর দশ মিনিটেই সব শেষ।

এটা অবশ্য সেই গ্রীষ্ম নয় যেবার তুমি তোমার ফুপাতো ভাই ডোজির প্রেমে পড়েছিলে, সেটা আরও কয়েক গ্রীষ্ম আগে, যখন ওর বয়স ছিলো দশ আর তোমার সাত, আর তোমরা দুজন মিলে গুটিসুটি দিয়ে ঢুকে গেলে দাদীর গ্যারেজের পেছনের চিকন জায়গাটায় আর ও ঢোকাতে চেষ্টা করলো তোমরা দুজন যাকে বলতে ওর কলা তোমার টমেটোয়, কিন্তু তোমরা দুজনের একজনও নিশ্চিত ছিলে না যে কোন ফুটোটায় ঢোকাতে হয়। যাই হোক, এটা ছিলো সেই গ্রীষ্ম যেবার তোমার চুলে উকুন হয়েছিলো, আর তুমি আর তোমার ফুপাতো ভাই ডোজি তোমার মোটা মোটা চুলের ভেতর হাত চালিয়ে খোঁজ লাগাতে ওই ছোট্ট কালো পোকাগুলোর জন্য আর পিষে ফেলতে তোমার নখে আর অট্টহাসি দিতে ওদের রক্তভরা পেট ফাটার শব্দে; সেই গ্রীষ্ম যেবার তোমার ভাই ননসোর জন্য তোমার ঘৃণা এতটাই বেড়ে গেলো যে ওটা যেন তোমার দম আটকে দিচ্ছিলো আর ডোজির জন্য তোমার ভালোবাসা আরও ফুলেফেঁপে শরীর ঘিরে জড়িয়ে রইলো।

এটা সেই গ্রীষ্ম ছিলো যেবার তুমি বজ্রঝড়ের মধ্যে দেখলে একটা আম গাছকে প্রায় সমান দুটো ভাগে ভেঙে পড়তে, যখন বিদ্যুতের চমক আকাশে আগুনরেখা টেনে দিচ্ছিলো। এটা সেই গ্রীষ্ম যেবার ননসো মারা গেলো।

দাদী ওটাকে গ্রীষ্মকাল বলত না। নাইজেরিয়ায় কেউই বলত না। এটাকে বলা হয় আগস্ট, বৃষ্টির দিন আর হারমাতন ধুলিহাওয়ার সময়ের মাঝখানে চ্যাপ্টা হয়ে থাকা। সারাদিন ঝরঝর, রূপালী বৃষ্টি ছিটকে আসে বারান্দায় যেখানে তুমি, ডোজি আর ননসো চড় দিয়ে মশা মারতে আর ভুট্টা পোড়া খেতে; নইলে সূর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আর তুমি পানির ট্যাংকে ভাসো যেটা তোমার দাদী অর্ধেক ভরে রাখে, একটা দারুণ মেকি জলাশয়। ননসোর মারা যাবার দিনটা শান্ত ছিলো, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিলো সকালে, কুসুম রোদ বিকেলে, আর সন্ধ্যায়, ননসোর মৃত্যু। দাদী ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলোওর প্রাণহীন শরীরের দিকে তাকিয়েবললো ই লাপুতাগো মযে ননসো তাকে ধোকা দিয়েছে, জিজ্ঞেস করছিলো ওর শরীরটাকে যে কে এখন নবুইসি খানদানের নাম এগিয়ে নেবে, কে বংশে বাতি দেবে।

তার চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা চলে এলো। রাস্তার ওপারের বাড়ির সেই মহিলাটাসেই মহিলাটা যার কুকুর প্রতিদিন সকালে দাদীর ময়লার ঝুড়িতে এসে অনুসন্ধান চালাতোযে তোমার সাড়হীন ঠোঁট থেকে খোশামোদ করে বের করে নিয়েছিলো আমেরিকান ফোন নাম্বারটা তারপর ফোন দিয়েছিলো তোমার মাকে। এই সেই প্রতিবেশী যে কিনা তোমার হাত থেকে ডোজির হাত আলাদা করেছিলো, তোমাকে বসিয়েছিলো আর পানি খেতে দিয়েছিলো। প্রতিবেশীটা খুবই চেষ্টা করেছিলো, তোমাকে কাছে টেনে নিয়ে যথাসম্ভব দূরে রাখতে যাতে তুমি তোমার দাদী আর মায়ের ফোনে বলা কথা শুনতে না পাও, কিন্তু তুমি হেঁচড়ে সরে গেলে ওই মহিলার থেকে, ফোনের দিকে। দাদী আর মায়ের কথাবার্তার সম্পূর্ণ কেন্দ্র ছিলো ননসোর মৃতদেহ, ওর মৃত্যু নয়। তোমার মা জোর দিয়ে বলছিলো যাতে ননসোর দেহ এই মুহূর্তে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হয় আর দাদী মাথা নাড়াতে নাড়াতে তোমার মায়ের কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করছিলো। তার চোখে এক অদৃশ্য উন্মত্ততা ফুটে উঠছিলো।

তুমি জানো যে তোমার দাদী কখনোই তোমার মাকে পছন্দ করতো না। (কয়েক গ্রীষ্ম আগে তুমি তাকে তার বন্ধুদের বলতে শুনেছওই কালো আমেরিকান মেয়েটা আমার ছেলেটাকে সুতোয় বেঁধে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে।) কিন্তু ফোনে দাদীকে দেখে তুমি বুঝতে পেরেছিলে যে দাদী আর মা এখন একজোট। তুমি নিশ্চিত ছিলে যে তোমার মায়ের চোখেও এই একই লালচে উন্মত্ততা বাসা বেঁধেছিলো।

যখন তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলে, ফোনের লাইনে তার কণ্ঠ এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো যা এতবছরে কখনোই হয়নি এমনকি বহুবছর আগে যখন তুমি আর ননসো গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে দাদীর কাছে আসতে তখনও না। তুমি ঠিক আছ? তার গলায় ভয় ছিলো, যেন সে সন্দেহ করছিলো যে তুমি একদম ঠিকই আছ, ননসোর মৃত্যু সত্ত্বেও। তুমি ফোনের তারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে আর অল্পই কথা বললে। সে বললো যে তোমার বাবাকে খবর পাঠাবে, যদিও তোমার বাবা ছিলো কোনো এক বনের মধ্যে কৃষ্ণ চিত্র উৎসবে যেখানে না ছিলো ফোন, না ছিলো রেডিও। শেষমেশ সে ফোঁপালো, একটা কর্কশ ফোঁপানি, কুকুরের ডাকের মত, তোমাকে এটা বলার আগে যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আর সে ননসোর দেহ ওখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। এটা শুনে তোমার তার হাসিটার কথা মনে পড়লো, একটা হো-হো-হো হাসি যেটার উৎপত্তি ছিলো তার পেটের গভীরে আর উপরে আসতে আসতেও কখনো সেটা মোলায়েম হয়ে উঠত না, যা ছিলো তার সরু শরীরটার পক্ষে খুবই বেমানান। যখন সে ননসোর ঘরে শুভরাত্রি বলতে যেত, সবসময়ই এই হাসিটা হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসত। বেশিরভাগ সময়েই তুমি তোমার হাতের তালু দিয়ে কান চেপে ধরতে যাতে ওই শব্দটা তোমার শুনতে না হয়, এমনকি সে যখন শুভরাত্রি বাবু, ভালোভাবে ঘুমাও বলতে তোমার ঘরে আসত তখনও তুমি হাতের তালু দিয়ে কান বন্ধ করে রাখতে। তোমার ঘর থেকে কিন্তু কখনোই সে ওই হাসিটা হাসতে হাসতে বের হতো না।

ফোনে কথা বলার পর দাদী মেঝেতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে, চোখের পলক ফেলে না, এ ধার থেকে ওধারে গড়াগড়ি দেয়, যেন সে কোনো বোকা বোকা খেলা খেলছে। সে বলে যে ননসোর দেহ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া অন্যায় হবে, যে ওর আত্মা সবসময় এখানেই ঘুরে বেড়াবে। ওর আসল স্থান এই মজবুত মাটিতে, যে মাটি ওর পতনের ধাক্কা শুষে নিতে সক্ষম হয়নি। ওর জায়গা এই গাছগুলোর বুকে, যাদের একটি ওকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারেনি। তুমি বসে বসে তাকে দেখতে থাকলে, আর যদিও প্রথমে চাইলে সে উঠে এসে শক্ত করে তোমায় জড়িয়ে ধরুক, পর ‍মুহূর্তেই আর চাইলে না।

আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে আর দাদীর উঠানের গাছগুলো এখনো ঠিক আগের মতই আছে ; তারা এখনো যেন প্রসারিত হতে হতে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আছে, এখনো উঠানটায় ছায়া দিচ্ছে। কিন্তু অন্য সবকিছু যেন আগের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে : ঘর, ঘরের পেছনের বাগান, মরচে ধরে তামাটে হয়ে যাওয়া পানির ট্যাংক। এমনকি পেছনের উঠানে থাকা দাদীর কবরটা অব্দি ছোট মনে হয়, তুমি কল্পনা করতে থাকো যেন তার শরীরটা ছোট্ট কফিনে আঁটার জন্য কুঁচকে ছোট হয়ে গেছে। কবরটা একটা পাতলা সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে ঢাকা; ওটার চারিদিকের মাটি সদ্যকাটা আর তুমি সামনে দাঁড়িয়ে দশ বছর পর ওটার অবস্থা কল্পনা করছ, পরিচর্যার অভাবে গজিয়ে ওঠা আগাছার জটলা ঢেকে দিয়েছে সিমেন্টের পরত, যেন কবরটার গলা টিপে ধরেছে।

ডোজি তোমাকে দেখছে। বিমানবন্দরে ও তোমাকে সতর্কভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো, বলেছিলো স্বাগতম আর কি বিস্ময়কর ব্যাপার যে তুমি ফিরে এসেছ, আর তুমি ওই ব্যস্ত, ছোটাছুটিময় লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে একটা দীর্ঘ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলে যতক্ষণ না ও মুখটা সরিয়ে নিলো, ওর চোখ খয়েরী আর দুঃখী, একদম তোমার বন্ধুর পুডল কুকুরের মত। যদিও তোমার ওই চাহনির প্রয়োজন ছিলো না, এটা জানতে যে ননসোর মৃত্যুর রহস্য ডোজির কাছে একদম সুরক্ষিত ছিলো, সবসময় থাকবে। দাদীর বাড়ির দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে ও তোমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে আর তুমি বলো যে তোমার মা এখন ক্যালিফোর্নিয়ায়; তুমি তাকে যদিও এটা বললে না যে সে থাকে একদল মানুষের সংঘে যাদের মাথা কামানো আর স্তন ফোঁড়ানো, আর যখনই সে ফোন করে তুমি কথার মাঝখানেই কেটে দাও।

তুমি আভোকাডো গাছটার দিকে এগিয়ে যাও। ডোজি এখনও তোমার দিকে তাকিয়ে আছে আর তুমিও ওর দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করো সেই ভালোবাসার কথা যেটা তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিলো সেই গ্রীষ্মে, যখন তোমার দশ বছর বয়স, যেটা সেই বিকেলে  ননসো মারা যাওয়ার পর তোমাকে বাধ্য করেছিলো শক্ত করে ডোজির হাত ধরে রাখতে, যখন ডোজির মা, তোমার ফুপু ম্যাগবেচিবেলিজে, আসে ওকে নিয়ে যেতে। ওর কপালে ছড়িয়ে থাকা রেখাগুলোতে একটা মৃদু বিষাদ লুকিয়ে আছে, একটা হতাশা ওর দুপাশে হাত ছড়িয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গিতে। তোমার হঠাৎ মনে হয়, ও নিজেও তোমার মতই অপেক্ষা করে ছিলো কিনা। তুমি কখনোই জানতেনা ওর শান্ত হাসির পেছনে কি লুকিয়ে আছে, বা ওই সময়গুলোর পেছনে যখন ও এতটাই স্থির হয়ে বসে থাকত যে ফলের মাছিরা এসে ওর বাহুতে বাসা বাঁধার চেষ্টা করত, তোমাকে দেয়া ছবি আর কার্ডবোর্ডের খাঁচায় রাখা পাখির পেছনে যাদের ও পুষত মরে না যাওয়া অব্দি। তুমি ভাবো কি হতে পারে, যদি হয় আর কি, ভুল নাতিটা হওয়ার ব্যাপারে ওর কি মনে হতো, সেই নাতি যে কিনা নাবুইসি নামটা এগিয়ে নিতে পারেনি।

তুমি আভোকাডো গাছের গোড়াটা ছুঁতে এগিয়ে যাও; যেই মুহূর্তে ডোজি কিছু বলা শুরু করে তোমাকে চমকে দিয়ে কারণ তুমি মনে করেছ ও ননসোর মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলবে, কিন্তু ও তোমাকে বলে তোমার দাদীকে বিদায় জানাতে আসাটা ওকে কতটা বিস্মিত করেছে কারণ ও খুব ভালো করে জানে তুমি দাদীকে কতটা ঘৃণা করো। ঘৃণা’—শব্দটা তোমাদের দুজনের মধ্যকার বাতাসে যেন একটা অভিযোগের মত ভাসতে থাকে। তুমি ওকে বলতে চাও যে ও যখন নিউইয়র্কে তোমাকে ফোন করলো, আঠারো বছরে প্রথমবার যখন তুমি ওর গলাটা শুনছিলে, এটা বলতে যে দাদী মারা গেছেভাবলাম তোমাকে জানানো প্রয়োজনএই ছিলো ওর বলা শব্দতুমি তোমার অফিসের ডেস্কের ওপর হেলে পড়লে, তোমার পা যেন গলতে শুরু করলো, এক জনমের সব নৈঃশব্দ্য যেন ভেঙে পড়ছে, আর এর কারণটা দাদী ছিলো না যার কথা তোমার মনে পড়ছিলো, ছিলো ননসো, আর ও, ডোজি, আর সাথে এই আভোকাডো গাছটা, আর তোমার নীতিহীন শৈশবের রাজ্যের সেই স্যাতস্যাতে গ্রীষ্মকাল আর সেই সকল জিনিস যা কিছু থেকে তুমি নিজের ভাবনাকে বিরত রেখেছিলে, যেসকল ভাবনাকে একটা পাতলা চাদরের মত তুমি ভাঁজ করে তুলে রেখেছিলে।

কিন্তু তার বদলে তুমি চুপ করে থাকো আর তোমার হাতের তালু গভীরভাবে চেপে ধরো গাছটার অমসৃণ গোড়ায়। যন্ত্রণাটা তোমাকে আরাম দেয়। তোমার মনে পড়ে যায় আভোকাডো খাওয়ার দিনগুলো; তুমি লবন দিয়ে খেতে ভালোবাসতে আর ননসো লবন ছাড়া আর তাই দাদী সবসময় তোমাকে কর্কশভাবে শোনাত যে তুমি জানোইনা কোনটা আসলে ভালো কারণ তুমি বলতে যে লবন ছাড়া আভোকাডো খেলে তোমার বমি পায়।

ভার্জিনিয়ায় একটা শীতল অশালীনভাবে বেরিয়ে থাকা সমাধিস্তম্ভের গোরস্থানে ননসোর শেষ কাজ হয়, তোমার মা পা থেকে মাথা অব্দি ধূসর কালো কাপড়ে ঢাকা ছিলো, এমনকি মাথায় একটা ঘোমটাও দিয়েছিলো যা তার দারুচিনি রঙের ত্বকে চমক আনছিলো। তোমার বাবা তোমাদের দুজনের থেকেই দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো, গায়ে তার সবসময় পরা দাশিকি, ঘাড়ে কুন্ডলী পাকে জড়িয়ে থাকা দুধরঙা কাউরি। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে সে পরিবারের কেউ নয়, যেন সে ওইসব অতিথিদের একজন যারা জোরে জোরে খবর আদায়ের চেষ্টা করে পরে তোমার মায়ের কাছে চুপিসারে জিজ্ঞেস করে যে ঠিক কিভাবে ননসো মারা গেলো, ঠিক কিভাবে ও সেই গাছগুলোর একটা থেকে পড়ে মরে গেলো যেগুলোতে ও একদম বাচ্চা বয়স থেকে চড়ে বেড়াচ্ছে।

তোমার মা এত এত প্রশ্নের জবাবে কাউকেই কিছু বললো না। সে তোমাকেও ননসোর ব্যাপারে কিছু বললো না, এমনকি সে যখন ওর ঘর পরিস্কার করছিলো আর ওর জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলো তখনও না। সে তোমাকে ওর কিছু রাখতেও বললোনা, আর তাতে তুমি স্বস্তি অনুভব করলে। তুমি কোনো বই রাখতে চাইলেনা যেখানে ওর হাতের লেখা আছে যা তোমার মায়ের মতে টাইপ করা লেখার চেয়েও সুন্দর। তুমি ওর পার্কে তোলা কবুতরের ছবিও রাখতে চাইলে না যেগুলো দেখে তোমার বাবা বলেছিলো ননসো ওর বয়সের তুলনায় অনেক প্রতিভাধর। তুমি ওর আঁকা ছবিগুলোও রাখতে চাইলে না, যেগুলো কিনা তোমার বাবার আঁকা ছবিরই নকল শুধুমাত্র আলাদা আলাদা রঙে। ওর কাপড়ও নয়, ওর স্ট্যাম্প কালেকশনও নয়।

তোমার মা শেষঅব্দি ননসোর প্রসঙ্গ তুললো, ওর অন্ত্যেষ্টির তিন মাস পর, যখন সে তোমাকে ডিভোর্সটার ব্যাপারে বললো। সে বললো, বিষয়টা এমন না যে ডিভোর্সটা ননসোর কারণে হচ্ছে, যে তোমার বাবা আর সে বহুদিন ধরেই দূরে সরে যাচ্ছিলো। (তোমার বাবা তখন জানজিবারে, ননসোর শেষ কাজের একদম পরেই সে চলে গিয়েছিলো।) তারপর তোমার মা জিজ্ঞেস করলো: ননসো কিভাবে মারা গিয়েছিলো?

তোমার এখনো ভাবতে অবাক লাগে যে তোমার মুখ দিয়ে কিভাবে ওই কথাগুলো বের হয়েছিলো। তুমি এখনো সেই ঠান্ডা মাথার বাচ্চাটাকে চিনতে পারো না, যেটা তুমি ছিলে। এটা সেজন্যও হতে পারে যে যেভাবে তোমার মা বলেছিলো যে ডিভোর্সটা ননসোর জন্য হচ্ছেনাযেন ওই একমাত্র ডিভোর্সের কারণ হবার যোগ্য, যেন তুমি কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। অথবা হয়ত এটা ছিলো সেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা যেটা তুমি আজও অনুভব করো, কোঁচকানো যেকোনো কিছুকে মসৃণ করার আকাঙ্ক্ষা, অতিরিক্ত অসমান সকল কিছুকে সমান করার আকাঙ্ক্ষা। তুমি তোমার মাকে বললে, গলাটায় লাগসই রকম কিছুটা অনিচ্ছার ভাব রেখে, যে দাদী ননসোকে আভোকাডো গাছটার সবচেয়ে উঁচু শাখাটায় উঠতে বলেছিলো এটা দেখতে যে ও কতখানি লায়েক পুরুষমানুষ হয়ে উঠলো। তারপর সে তাকে ভয় দেখিয়ে বসেমজা করে যদিও, তুমি তোমার মাকে আশ্বস্ত করলেওকে বলে বসে যে ওখানে একটা সাপ আছে, এচি এটেকা, ওর কাছের একটা শাখাতেই। দাদী ওকে বলেছিলো না নড়তে। বলাই বাহুল্য যে ও নড়লো আর গাছ থেকে পড়ে গেলো, আর যখন ও পড়লো এমন শব্দ হলো যেন গাছ থেকে একসাথে অনেকগুলো ফল ঝরে পড়লো। একটা শুষ্ক শেষ বিরতি নিলে তুমি। দাদী ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো, ওকে দেখছিলো, তারপর ওর উদ্দেশ্যে চিৎকার শুরু করলো এই বলে বলে যে কিভাবে ও বংশের একমাত্র ছেলে, কিভাবে মরে গিয়ে ও বংশের ধারার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো, কিভাবে ওর পূর্বজরা এজন্য অসন্তুষ্ট হবে। ও নিশ্বাস নিচ্ছিলো, তুমি তোমার মাকে বললে। ও যখন নিচে পড়লো তখন ও নিশ্বাস নিচ্ছিলো, কিন্তু দাদী চিৎকার করেই গেলো ওর ভগ্ন শরীরটার সামনে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ না ও মরে গেলো।

তোমার মা আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগলো। আর তুমি ভাবতে লাগলে মানুষ সবসময়ই এরকম পাগলা চিৎকার দেয় নাকি যখন তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে বেছে নেয়। সে ভালোই জানত যে ননসোর মাথা একটা পাথরের সাথে ধাক্কা খায় আর ও ওই মুহূর্তেই মারা যায়সে ওর মৃতদেহ দেখেছে, ওর ফেটে আলগা হয়ে যাওয়া মাথা দেখেছে। কিন্তু সে এটাই বিশ্বাস করতে বেছে নিলো যে নিচে পড়ার পর সত্যিই ননসো বেঁচে ছিলো। সে কাঁদলো, হাহাকার করলো, আর অভিশাপ দিলো সেই দিনটাকে যেদিন তার চোখ তোমার বাবার ওপর পড়েছিলো, তার কাজের প্রথম প্রদর্শনীর দিনটাতে। তারপর সে তাকে ফোন করলো, তুমি শুনলে তাকে ফোনে চিৎকার করতে: তোমার মা এসবের জন্য দায়ী! উনি ওকে আতঙ্কিত করে ফেলে দিয়েছে! উনি এসবের পরেও কিছু করতে পারত, কিন্তু না, তার বদলে উনি ওখানে দাঁড়িয়ে রইলো, উনি সর্বাঙ্গে যা সেই একটা মূর্খ গোঁড়া আফ্রিকান মহিলার মত আর ওকে মরতে দিলো!

তোমার বাবা এরপরে অবশ্য তোমার সাথে কথা বলে, বলে যে সে বুঝতে পারছে যে সবকিছু তোমার জন্য কতটা কঠিন কিন্তু কথা বলার ক্ষেত্রে তোমার সচেতন হওয়া উচিত ছিলো যাতে মানুষ আরও বেশি কষ্ট না পায়। আর তুমি তার কথাগুলো নিয়ে ভাবলেকথা বলার ক্ষেত্রে সচেতন হওভাবলে সে যদি জানত যে তুমি প্রতিটা শব্দই মিথ্যে বলছিলে।

আঠারো বছর আগের সেই গ্রীষ্মকাল তোমার প্রথম আত্ম-উপলব্ধির গ্রীষ্মকাল। সেই গ্রীষ্ম, যখন তোমার মনে হয়েছিলো ননসোর সাথে কিছু ঘটা দরকার, যাতে তুমি বেঁচে থাকতে পারো। এমনকি কেবল দশ বছর বয়সেই তুমি জানতে যে কিছু মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জায়গা দখল করে রাখতে পারে শুধুমাত্র বেঁচে থেকে, যে কিছু মানুষ শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্ব দিয়েই অন্য অনেকের শ্বাসরোধ করে ফেলতে পারে। ননসোকে এচি এটেকা দিয়ে ভয় দেখানোর বুদ্ধিটা তোমার একারই ছিলো। কিন্তু তুমি এটা ডোজিকেও বললে, বললে যে তোমাদের দুজনের জন্যই এখন এটা প্রয়োজন যে ননসোর কোনো ক্ষতি হোকহতে পারে সেটা ওর শরীরের কোনো ক্ষতি, ওর পা ভেঙে দেয়া যেতে পারে। তুমি ওর ত্রুটিহীন চটপটে শরীরটায় একটা ত্রুটি যোগ করতে চাইছিলে, যাতে মানুষ ওকে একটু হলেও কম ভালোবাসে, যাতে ও যা কিছু তড়তড়িয়ে করে বেড়ায় তা একটু হলেও কম করতে পারে। যাতে ও তোমার জায়গাগুলো একটু হলেও কম দখল করে। ডোজি কিছুই বলল না, তার বদলে শুধু তোমার একটা ছবি একে ফেললো যেখানে তোমার চোখের বদলে মস্ত দুই তারা।

দাদী ভেতরে রান্না করছিলো আর ডোজি চুপ করে তোমার কাছেই দাঁড়িয়ে, তোমাদের কাঁধ পরস্পরকে স্পর্শ করছিলো যখন তুমি ননসোকে আভোকাডো গাছটার সবচেয়ে উঁচু ডালে উঠে দেখাতে বলছিলে। ওকে তাতিয়ে কাজটা করানো সহজ ছিলো, তোমার শুধু ওকে এটুকুই মনে করিয়ে দিতে হত যে গাছে উঠতে তুমি ওর চেয়ে বেশি পারদর্শী। আর তুমি ছিলেও, একটা গাছ, যেকোনো গাছ, তুমি তড়তড়িয়ে বেয়ে উঠে যেতে পারতে, সেকেন্ডের মধ্যেতুমি সে সকল জিনিসে অধিক পারদর্শী ছিলে যেগুলো শেখালেই হয়না, যেগুলো দাদী ওকে শেখাতে পারেনি। তুমি ওকেই আগে যেতে বললে, দেখতে যে ও আভোকাডো গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটায় তুমি যাওয়ার আগেই যেতে পারে কিনা। ডালগুলো দুর্বল ছিলো, আর ননসো তোমার চেয়ে ভারী। দাদীর ঠুসে ঠুসে ওকে খাওয়ানোর জন্যই হয়ত। আরও একটু খাও, দাদী প্রায়ই বলত। তোমার কী মনে হয় এগুলো কার জন্য রেঁধেছি? যেন তোমার কোনো অস্তিত্বই নেই। কখনো কখনো সে তোমার পিঠ চাপড়ে দিত আর ইগবুতে বলত, ভালোই হচ্ছে এগুলো তুমি শিখছ, ননে, এভাবেই একদিন তোমার স্বামীর সেবা করবে তুমি।

ননসো গাছে উঠলো। উঁচু থেকে আরও উঁচুতে। তুমি অপেক্ষা করলে যতক্ষণে ও সর্বোচ্চ উচ্চতার একদম কাছাকাছি না চলে যায়, যতক্ষণে ওর পা আর সামনে যেতে টলমল হয়ে না যায়। তুমি সেই সংক্ষিপ্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করলে যখন ও গতির ফাঁকে পড়বে। একটা স্বাধীন মুহূর্ত, মুহূর্ত যখন তুমি সবকিছুর নীলাভ অংশটা দেখলে, জীবনেরওতোমার বাবার চিত্রকলার নিখুঁত উজ্জ্বল নীল, অনুকূল সময়ের, বৃষ্টিস্নাত সকালের ধোয়া আকাশের। তারপর তুমি চিৎকার করে উঠলে। সাপ! এচি এটেকা! সাপ! তুমি বুঝতে পারছিলে না যে সাপ তুমি গাছের শাখায় বলবে, নাকি গুঁড়ি বেয়ে উঠছে বলবে। কিন্তু তাতে কিছু এলো গেলো না, কারণ ওই কিছু সেকেন্ডেই ননসো নিচে তোমার দিকে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দিলো, ওর পা পিছলে গেলো, হাত হাওয়ায় ভাসতে লাগলো। অথবা বলা চলে গাছটা নিদারুণভাবে ননসোকে ঝেড়ে ফেলে দিলো।

তোমার এখন মনেও পড়ে না ঠিক কতটা দীর্ঘ সময় ননসোর দিকে তাকিয়ে তারপর তুমি দাদীকে ডাকতে গেলে, আর এই পুরো যাত্রায় ডোজি তোমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো, চুপচাপ।

ডোজির শব্দটা—‘ঘৃণা’—তোমার মাথায় ঘুরপাক খায়। ঘৃণা। ঘৃণা। ঘৃণা। শব্দটা নিশ্বাস নেয়াই কষ্টকর করে তোলে, সেভাবেই যেভাবে তোমার অপেক্ষার দিনগুলোতে তোমার নিশ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়ছিলো, ননসো মারা যাবার পরের মাসগুলোতে আর কি। তুমি অপেক্ষা করছিলে যাতে তোমার মা খেয়াল করে যে তোমার কণ্ঠ স্বচ্ছ পানির মত আর পা ইলাস্টিক ব্যান্ডের মত, যাতে তোমার মা তার শুভরাত্রি বলার শেষটা করে তোমার ঘরে সেই গভীর হো-হো হাসির সঙ্গে। তার বদলে সে শুভরাত্রি বলার সময় তোমায় জড়িয়ে ধরে একটু বেশিই সাবধানতার সাথে, সবসময় কথা বলতে থাকে ফিসফিস করে, আর তুমি তার চুমু এড়িয়ে যেতে থাকো হাঁচিকাশির অভিনয় করে। বছরের পর বছর সে তোমায় এক স্টেট থেকে আরেক স্টেটে নিয়ে ঘুরতে লাগলো, নিজের ঘরে লাল মোমবাতি জ্বালাতে লাগলো, আর নিষিদ্ধ করলো নাইজেরিয়া বা দাদীর ব্যাপারে সমস্ত আলাপ, তোমার বাবার সাথে তোমার দেখা-সাক্ষাৎও, সে আর কখনোই ওই হাসিটা হাসলো না।

ডোজি এখন বলে, তোমায় বলে যে কিছু বছর আগে থেকে সে ননসোকে স্বপ্নে দেখা শুরু করে, স্বপ্ন যেখানে ননসো তার চেয়ে বড় আর লম্বা, আর তুমি শুনতে পাও কাছেই এক গাছ থেকে ফল পড়ার শব্দ, আর তুমি না ঘুরেই ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকো, কী চেয়েছিলে তুমি, ওই গরমের ছুটিতে, কী চেয়েছিলে?

তুমি জানতেই পারো না কখন ডোজি সরে এসে তোমার পেছনে দাঁড়ায়, এত কাছে যে তুমি ওর গায়ের লেবু লেবু গন্ধটা পাও, হয়তো ও একটা কমলার খোসা ছাড়িয়ে পরে আর হাত ধোয়নি। ও তোমাকে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি করে আর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তুমিও ওর দিকে তাকিয়ে থাকো আর দেখো যে ওর কপালে সূক্ষ্ম বলিরেখা আর চোখে এক নতুন তীক্ষ্ণতা। ও বলে ওখানে ওর চাওয়ার কিছু ছিলো না, কারণ ওর কাছে তোমার চাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। একটা দীর্ঘ নৈঃশব্দ্য ছেয়ে যায় যখন তুমি দেখো কালো পিঁপড়ার একটা সারি গাছের গুড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে, প্রতিটা পিঁপড়াই সাদা কিছু একটা অল্প অল্প করে নিয়ে উঠছে যেটা কিনা সাদা কালোর একটা নকশা তৈরি করছে। ও তোমায় জিজ্ঞেস করে যে তুমিও এভাবে স্বপ্ন দেখছ কিনা যেভাবে ও দেখেছে, তুমি না বললে, তোমার চোখ ওর চোখ এড়িয়ে গেলো, আর ও তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তুমি ওকে বলতে চাইলে তোমার বুকের যন্ত্রণার কথা আর তোমার কানের শূন্যতার কথা আর সেই ঘোলা বাতাসের কথা ওর ফোনকলের পরের, আরও বলতে চাইলে হুট করে খোলা সেই দরজাগুলোর কথা, চেপে রাখা জিনিসগুলো হঠাৎ বেড়িয়ে আসার কথা, কিন্তু ও চলে যাচ্ছে। আর তুমি একা, ফুপিয়ে কেঁদে চলেছ, আভোকাডো গাছটার নিচে।