মার্কি দ্য সাদের গল্প ‘দুজনের ঘর’
লেখক পরিচিতি
মার্কি দ্য সাদ [জন্ম: ২ জুন ১৭৪০, প্যারিস, ফ্রান্স—মৃত্যু: ২ ডিসেম্বর ১৮১৪, প্যারিসের কাছে চারেতঁ-তে], প্রকৃত নাম দোনাতেঁ-আলফাঁসে-ফ্রাঁসোয়া, কাউন্ট দ্য সাদ। বাংলায় তাকে অনেকেই মার্কুয়েস দ্য সাদ হিসেবে চিনে থাকবেন। ফরাসি ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক। অবাধ মেলামেশার পক্ষের এক চিরন্তন মুখপাত্র। সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ও সাত বছরের যুদ্ধের পর তিনি বিয়ে করেন। একই সঙ্গে বেশ্যা ও স্থানীয় তরুণদের নিয়ে অবাধ যৌনাচারের জগতে জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে তাকে বারবার জেলে যেতে হয়েছে এবং মৃত্যুর হাত থেকেও অল্পের জন্য বার বার বেঁচে গেছেন। ফরাসি অভিজাত সমাজের জন্মগ্রহণ করার পরও তিনি ফরাসি বিপ্লব সমর্থন করেন কারণ তার মনে হয়েছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা তার দিক থেকে যৌন স্বাধীনতার সমান্তরালে কাজ করবে। চারেতঁ-তে দুই দফায় (১৭৮৯-৯০, ১৮০১-১৪) তাকে উন্মাদ আশ্রমে পাঠানো হয়, পরিণতিতে তিনি সেখানেই মারা যান। তাঁর জীবনের প্রায় ৩২ বছরই জেলখানায় জেলখানায় কেটেছে। জেলখানার একঘেঁয়েমি আর প্রচণ্ড রাগকে প্রশমিত করতেন খোলামেলা যৌনতা নির্ভর উপন্যাস আর নাটক লিখে। ‘দ্য ১২০ ডেস অব সডোম’ [১৭৮৫] হল চারজন লম্পটের কাহিনি যারা তাদের শিকারকে নিয়ে অবিরাম উন্মত্ত ভোগে ও অজাচারে সময় কাটায়। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ‘জাস্টিন’ [১৭৯১] উপন্যাসের নায়িকা যন্ত্রণাভোগ করে কারণ সে বুঝতে পারে না নৈতিক ঈশ্বর বলে কিছু নেই এবং আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি বা বাসনাই হল একমাত্র বাস্তবতা। এছাড়াও তাঁর অন্য রচনার মধ্যে আছে ‘ফিলোসফি অব বেডরুম’ [১৭৯৩], ‘জুলিয়েট’ [১৭৯৭] এবং ‘ক্রাইমস অব প্যাশন’ [১৮০০]। তাঁর ভাবমূর্তি আর লেখা থেকে ‘স্যাডিজম’ কথাটির উদ্ভব। বর্তমান লেখা রিচার্ড সিভার অনূদিত ‘দ্য মিস্টিফাইড ম্যাজিস্ট্রেট অ্যান্ড আদার স্টোরিস’ বই থেকে নেওয়া। ‘রুম ফর টু’ থেকে ‘দুজনের ঘর’ অনূদিত হয়েছে।
দুজনের ঘর
প্যারিসের রু সাঁ-অনরে এলাকায় থাকত এক সম্পদশালী ব্যক্তির সুন্দরী স্ত্রী। তন্বী তরুণী। বয়স বাইশ। হৃষ্টপুষ্টতার দিক থেকে দেখলে, তারপরও সে যতটা আকর্ষণীয় ততটাই তৃপ্তিদায়ক, যদিও যেমনটা আমি বলছি তার দেহরেখা তারচেয়েও বেশি ঔদার্যময়। সেই সঙ্গে আরো যোগ করা লাগে, যে এমন মনোহর শরীর তো তার আছেই, তারওপর সে ছিল স্বর্গীয় স্তনের অধিকারিনী এবং এই শরীরী গুণের সঙ্গে তার ছিল গতিময় কৌতুকবোধ, উচ্ছল প্রাণবন্তভাব, এবং জগতের যা কিছু ভোগ্য তা থেকে সুখ গ্রহণের সীমাহীন ক্ষমতা—এমন কি যেগুলো বিবাহের নিয়মকানুনের দিকে থেকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। এই বছরখানিক আগের কথা, সে মনে মনে ঠিক করেছিল যে সে তার স্বামীর বদলে দুজন সহকারী নিয়োজিত করবে, যে স্বামী কেবল বিশ্রী এবং বৃদ্ধই শুধুই নয়, সে তাকে মোটেও সুখী করতে তো পারে না, তারওপর সে তার স্বামী হিসেবে দায়িত্ব থেকে নিজেকে একরকম খালাস করিয়ে নিয়েছিল, তারপরও যখন সে তা পালন করতো তার সামান্যই সে পূরণ করতে পারত। আদতে, যদি সে সামান্যও তার তুষ্টি বিধান করতে পারত, তাতে তার চাহিদাময়ী স্ত্রীকে, ডোলমেনি, ওই সেই তন্বী তরুণীটির নাম, তাকে সামান্যই শান্ত করতে সক্ষম হতো।
যে-ব্যবস্থা সে তার প্রেমিকদের জন্য করছিল, তা এর চেয়ে ভালো আর হতে পারত না: দ্য-রুয়ি, সে এজন তরুণ সেনা অফিসার, যে এসে বিকাল চার থেকে পাঁচটা পর্যন্ত থাকত, তারপর আসত দোলব্রিয়াস নামে এক তরুণ ব্যবসায়ী, সে দেখতে অসামান্য সুদর্শন, তার থাকার সময় ছিল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা। এই সময়টাই সবচেয়ে ভালো সময় যখন নিশ্চিতভাবে তাকে কেউ বিরক্ত করবে না। সকালটা সে দোকানেই কাটাতো, এবং মাঝে মাঝে বিকালেও সেখানে বসত, এছাড়াও তার স্বামীকে সে তার সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারাদি আলাপ আলোচনা করতে একরকম বাধ্য করত। তারওপরে মাদাম ডোলমেনি তার নারী বন্ধুদের একজনকে বিশ্বাস করে বলত যে, এই যে সম্পর্ক দুটি, একটি পর অন্যটি, সে চালিয়ে যাচ্ছে, তা সে ভীষণভাবে উপভোগ করছে। এই পদ্ধতিতে কল্পনাশক্তির আগুন এখনো জ্বলজ্বল করে, এবং তার মতে, অগ্নিকুণ্ডকে নতুন করে না জ্বালিয়ে এক সুখের আগুন থেকেই অন্য সুখের আগুনে যাওয়ার ভেতরে যে আনন্দ, এর চেয়ে তৃপ্তিদায়ক আর কিছু হতে পারে না। মাদাম ডোলমেনি এমনই উৎফুল্ল এক মানুষ যে ভালো করে জানত কী করে বিচিত্র অনুভূতিগুলো ও প্রেমের আবেগকে নিখুঁত করে তোলা যায়। খুব অল্প নারীই আছে যারা এ ব্যাপারে এতটা প্রতিভাময়ী, যে সে ধরনের অতি সামান্য অর্থহীন বিষয়গুলোকে বোঝার ক্ষেত্রে যেখান থেকে সে নিশ্চিত বুঝতে পারত, সমস্ত কিছু বলার মতো করেই করার কাজগুলো হতো, এবং তার দুজন প্রেমিক বলতে গেলে কেউ কারো চেয়ে কম নয়। আলাদা করে একজনের দক্ষতাকে যেমাত্রায়ই বিবেচনা করা হোক না কেন, তা বলতে গেলে কম আর বেশি একই রকমের: এক প্রেমিকের কাজ আরেকজনের কাজকে পূর্ণ করত, আসলে যেটা বলতে হয় তা হল, দ্বিতীয় প্রেমিকই প্রথম জন কিনা এটা যে কেউ খেয়াল করলেও সহজেই ভুল করতো: তারা মনে করত একই লোক ওই দিনে বার বার আসা যাওয়া করছে। আর যতটা সম্ভব আনন্দ আহরণ করার কাজটা নিশ্চিত হত, তখন আর তফাত বিচারের কী দরকার! সেখানে আরও একটা ব্যাপার ছিল: মাদাম ডোলমেনি গর্ভ হওয়া নিয়ে ভীষণ ভয়ে ভয়ে থাকত, এবং জানত যে তার স্বামী কখনোই অতটা বোকা নয় যে তার কটিদেশের সৌন্দর্য নষ্ট হতে দেবে, যদিও তার দুই প্রেমিকের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি কমই ছিল যা নিয়ে সে আতঙ্কে থাকত। অবশ্য একজন শরীরব্যবচ্ছেদ বিদ্যার পারদর্শী হিসেবে এর একটা হিসাবও তার করা ছিল, যেমনটা সে এটাকে বজায় রাখতো যাতে ভালোবাসার দুই ফলের একটির নির্যাস একটি অন্যটিকে নস্যাৎ করে দিতে পারে।
একদিন, এই কঠিনভাবে মেনে চলা শৃঙ্খলা যা ওই দুই গোপন মিলনের সংকেত দুটোতে বজায় ছিল সেটা কিছুটা তালগোল পাঁকিয়ে গেল, এবং আমরা যেমনটা দেখে আসছিলাম, দুই প্রেমিক, যাদের একের সঙ্গে অন্যের কখনোই দেখা হয়নি, সুখময় এক ঘটনার ভেতর দিয়ে তাদের দেখা হয়ে গেল। দ্য-রুয়ি, প্রেমিক নম্বর এক, তার নির্ধারিত সময়ের কিছুটা পরে সেদিন এসেছিল, আর যেনবা শয়তান নিজের হাতে সেদিন তাদের মিলিয়ে দিতে এই কাজটি করেছিল, দোলব্রিয়াস, প্রেমিক নম্বর দুই, সেদিন চলে এসেছি সময়ের আগেই।
প্রাজ্ঞ পাঠক, তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়টি দেখতে পারবেন যে, এই যে আপাত নিষ্পাপ ভুল দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি অনিবার্য একটা মুখোমুখি ঘটনার জন্ম দেবে: আর সেটিই ঘটল। কিন্তু এর সমস্ত ভদ্রতা এবং লাগাম টেনে ধরে আমরা বর্ণনা করতে চেষ্টা করছি, সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, যাতে আমরা এমন একটি পরিস্থিতির কথা বলতে চলেছি, যেটি নিজের থেকেই চূড়ান্তভাবে লাম্পট্যময়।
ভাগ্যের অদ্ভুত মুদ্রাদোষে—কিন্তু তারপরও আবার বলতে হয়, জীবন কি এইরকম ঘটনা দিয়েই পরিপূর্ণ নয়?—আমাদের তরুণ সেনা অফিসার, তার প্রেমিকার দিকে প্রতিমুহূর্তে দায়িত্ব পালন করার সময় কিছুটা চিন্তায় থাকতেন প্রেমিক হিসেবে তার ভূমিকাটি যথাযথ পালিত হচ্ছে কিনা। তার প্রেমিকাকে দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরার বদলে সে চাইত ভিন্নভাবে সে তাকে ধারণ করুক; এক কথায়, যাই করা হতো সে মাত হয়ে যেত, মাদাম ডোলমেনির পাল্টা ভূমিকা পালনের ভেতর দিয়ে, যে ক্যালিপিগাসের ভেনাসের১ মতো আদুল গায়ে, নিতম্বের সৌন্দর্যময়তা নিয়ে, সে তার প্রেমিকে দিকে ঝুঁকানো অবস্থায় থাকত, তার ওপরে ঘোড়ায় চড়ার মতো করে, যেন ওই কাজে সে যথারীতি নিজেকে উৎসর্গ করছে, এভাবেই তা তার শোবার ঘরে দেখা যেত, যেখানে এই কৃত্যটির রহস্যময়তাটি উদ্যাপন করা হতো, তার শরীরের অংশ গ্রিকদের মতো উপাসনারত সেই রকম ঐকান্তিকতার সঙ্গে, দৃশ্যত যে দেবীর কথা বলা হলো তার মতো করে, শরীরের সেই অংশ, নিতম্ব, তর্কাতীতভাবে সৌন্দর্যময়, এবং এর দিকে, কোনো রকম কঠিন দৃষ্টি না হেনে, যে কেউ খুঁজে পাবে অনেক আদরনীয় দক্ষতা যা প্যারিসের নিজেরই আছে।
এই ছিল আমাদের প্রেমিকপ্রেমিকা যুগলের অবস্থান যখন দোলব্রিয়াস, যে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছিল, গুনগুন করে ফুর্তিতে থাকা গান ভাজতে ভাজতে, দেখেই তার দম আটকে গেল এবং সে দেখল যে শরীরীব্যবচ্ছেদ কোনো ভদ্র এবং সতীসাবধ্বী নারী অন্তত এভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে না।
যে দৃশ্য বহু মানুষের জন্য পুরোদস্তুর একটা সুখাবেশ এনে দিতে পারে দোলব্রিয়াস সেখানে সে স্তম্ভিত হয়ে থমকে রইল।
‘‘এ আমি কী দেখছি?’’ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘বিশ্বাসঘাতিনী! এই-ই তুমি আমার জন্য জমিয়ে রেখেছিলে?’’
মাদাম ডোলমেনি, যে সেই মুহূর্তে তার নারী শরীরের নিচে সেইসব গোঙানির অভিজ্ঞতা নিচ্ছিল, সেই শরীর সত্তার চেয়ে তার মনে যেন আরো নতুন বলে বলীয়ান হয়ে উঠল, অনেকটা যেন তার প্রতি মোক্ষম জবার দেওয়ার জন্যই।
‘‘অ্যাই দুষ্টু, তাতে তোমার সমস্যাটা কী বলেতো?’’ সে তার দ্বিতীয় প্রেমিককে বলল, নিজেকে যেভাবে যে প্রথমের কাছে সম্পূর্ণভাবে দিয়ে যাচ্ছিল যে দেওয়ার কাজটি কোনোমাত্র স্থগিত না করে। ‘‘তোমার মনখারাপ হওয়ার মতো এর ভেতরে কোনো কিছুই তো আমি দেখছি না। আমাদের আর বিরক্ত করো না ইয়ার, এসো, তুমিও মজাটায় যোগ দেও না: তুমি দেখছ না এখানে দুজনের জন্য ঘরটা যথেষ্টই বড় হয়ে আছে।’’
দোলব্রিয়াস, এমন বিপদের মুখেও তার প্রেমিকার এমন অবিচলতা দেখে আর না হেসে পারল না, তৎক্ষণাৎ ঠিক করল এখন সবচেয়ে ভালো যেটা করার তা হলো আর একটি কথা না বাড়িয়ে এই ফুর্তিতে যোগ দেওয়া।
আর সবদিকের বিবেচনাই বলে যে, ওই তিনজন ভীষণ এক হৈ হল্লাময় আনন্দোচ্ছল সময় কাটিয়েছিল।
টীকা
১. ক্যালিপিগাসের ভেনাস, এটা এসেছে দুটো গ্রিক শব্দ থেকে। ‘ক্যালোস’ অর্থ ‘সৌন্দর্য’ এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘পিগাস’ শব্দটি যার মানে ‘নিতম্ব’। ইতালির নেপলসে থাকা ফারনিসির সংগ্রহের একটা শিল্পকর্ম, যে বছর সাদকে ভিসেন্নেসে বন্দি করা হল তার আগে তিনি এখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এটিকে তার কাছে সৌন্দর্যের দেবীর সবচেয়ে সেরা প্রতিকৃতি বলে মনে হয়েছিল। এই মূর্তির কথা সাদের আরো অনেক লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে। নারী শরীরের অংশ হিসেবে নিতম্ব—তাঁর মানব শরীরবিদ্যায় এই অঙ্গের প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা ছিল।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন