মুরাকামির শহর এবং তার অনিশ্চিত প্রাচীর

অ+ অ-

 

নোট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪-এ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে মুরাকমির নতুন উপন্যাস দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেইন ওয়ালস (শহর এবং তার অনিশ্চিত প্রাচীর)-এর ইংরেজি সংস্করণ। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। বইটির একটি খসড়া সংস্করণ পড়ার সুযোগ পাই। সেটি অবলম্বনেই এই বই পর্যালোচনা।

‘দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেইন ওয়ালস’ কী নিয়ে তা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। এটি শুরু হয় এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে, যার কাজ স্বপ্ন পড়া। সেই স্বপ্নগুলো একটি গ্রন্থাগারের তাকগুলোতে সঞ্চিত থাকে। আর এই গ্রন্থাগারটি এমন একটি শহরে অবস্থিত, যা একটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রবেশপথ পাহারা দেয় এক গেটকিপার। আর প্রতিটি মানুষের একটি ছায়া থাকেযা স্বতন্ত্রভাবে তার স্বত্বাধিকারী থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতে পারে। উপন্যাসটি পড়া ছিল আমার জন্যে এক ধৈর্যের পরীক্ষা। গল্পের শেষদিকে এসে মনে হলো, হ্যাঁ, এখানে কিছু গভীরতা হয়ত রয়েছেতবে আকস্মিক সমাপ্তি যেন একরকম অসম্পূর্ণতার অনুভূতি রেখে গেল। এটি এমন এক মুগ্ধতার আবেশ, যা বার বার আলগোছে ফসকে যায়। মুরাকামির এই উপন্যাসের ভাষার শৈল্পিকতা অনস্বীকার্য; কিন্তু সেই সৌন্দর্যের গভীরে ঢুকে দেখি কাহিনির গতিবিধি যেন কিছুটা স্তব্ধ, প্রায় একঘেয়ে। ‘হার্ড-বয়েলড ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যান্ড দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বরং গভীরতা ও জটিলতায় অনেকখানি এগিয়ে ছিল, আর সেই তুলনায় এখানে শহরের উপস্থাপনা যেন শূন্যতায় ভাসমান।

গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি ছেলে আর মেয়ের সম্পর্কএকটা স্বপ্নের শহরকে একত্রে কল্পনা করা হয়েছে, যেখানে মেয়েটির আসল সত্তা বাস করে। কিন্তু সেই মেয়েটির হঠাৎ অদৃশ্য হওয়া ছেলেটিকে রেখে যায় একাকিত্বের অন্ধকারে। শহরের সেই প্রাচীরের ওপারের মায়াবী স্থানে পৌঁছানোর জন্য ছেলেটি নিজের ছায়াকে ত্যাগ করে। সেখানে পৌঁছালে দেখা মেলে অলৌকিক প্রাণী, কালহীন ঘড়ি এবং এক রহস্যময় স্বপ্নপাঠকদের। কিন্তু সেই শহরের পুরোপুরি রূপ কি আমরা জানতে পারি? গল্পটা কি কোনো গন্তব্যে পৌঁছায়? মনে হয় চরিত্রগুলোর আসল অনুভবকে বেখাপ্পাভাবে চাপা রেখে মুরাকামি যেন বারবার একই দৃশ্যপট তুলে ধরছেন।

গল্পটি মুলত The Town and Its Uncertain Wall ( ইংরেজি শিরোনাম জে রুবিনের Music of Words থেকে নেওয়া)। এটি ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বুংগাকুকাই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি গল্পটি নিয়ে খুবই লজ্জিত ছিলেন এবং প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ অনুশোচনা করেছিলেন। তাই এটি ইংরেজিতে অনুবাদের অনুমতি দেননি। ২০২৩ সালে (জাপানি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত) এই ছোট গল্পকে তিনি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে পরিণত করেন, এই তথ্য জানার পর মনে হলো, হয়তো এটুকুতে থেমে গেলে ভালো হতো। এই দীর্ঘায়িত রূপে গল্পটা যেন নিজের ভেতরেই আটকে গেছে। গল্পের গভীরে পৌঁছাতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল, যেন যাত্রাটি অর্থপূর্ণ হয়। কিন্তু একসময় মনে হলো, যেন একজন সাহিত্যিক বহুবছর ধরে একই রকম থিতু গল্পকে পুনরাবৃত্তির আবর্তে ফেরাচ্ছেন। মনে হচ্ছিল, এই দীর্ঘ লেখনীর প্রতিটি শব্দ যেন আক্ষেপের প্রতিধ্বনি।

উপন্যাসের শেষে মুরাকামি একটি পরিশিষ্ট যুক্ত করেছেন। এক ধরনের কৈফিয়ত। তাঁর ভাষায়, আমি সাধারণত আমার উপন্যাসে পরিশিষ্ট যুক্ত করতে পছন্দ করি না (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি কোনো না কোনোভাবে সাফাই দেওয়ার মতো মনে হয়), তবে এই কাজটির ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে মনে করি শুরু থেকেই আমি অনুভব করেছিলাম যে এই গল্পটিতে এমন কিছু গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে, যা আমার কাছে অত্যন্ত অর্থবহ। কিন্তু সেই সময়ে, দুঃখের বিষয়, সেই কিছু পুরোপুরি প্রকাশ করার জন্য আমার লেখনী যথেষ্ট পরিণত ছিল না। আমি তখন মাত্র সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি এবং আমার লেখার সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তখনও অর্জন করতে পারিনি। গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমি অনুশোচনায় ভুগছিলাম, তবে যা ঘটে গেছে তা বদলানো সম্ভব ছিল না। আমি ভেবেছিলাম, একদিন উপযুক্ত সময় এলে এটি সম্পূর্ণভাবে পুনর্লিখন করব…” আমরা যদি বিবেচনা করি যে তিনি The Town and Its Uncertain Wall গল্পটি লিখেছিলেন Pinball, 1973 এবং A Wild Sheep Chase-এর মধ্যবর্তী সময়ে, তাহলে এটি একজন তরুণ লেখকের সাহসীভাবে তার সৃষ্টিশীল পরিসর প্রসারিত করার প্রয়াস বলেই মনে হয়। উপন্যাসটি Hard-Boiled Wonderland and the End of the World-কেই সংযুক্ত করে। মুরাকামি বলেন যে, দুটি গল্পকে পাশাপাশি, পর্যায়ক্রমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। শেষে, এই দুটি গল্প একসঙ্গে মিশে যাবেএটাই ছিল আমার ধারণা, যদিও তা খুবই অস্পষ্ট ছিল। তবে, কীভাবে এই দুটি গল্প একত্রিত হবে, সেটা লিখতে বসে আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কারণ, আগেভাগে কোনো পরিকল্পনা তৈরি না করে, শুধুমাত্র মন যা চেয়েছিল সেটাই লিখে গিয়েছিলাম।”......ঠিক যেমন ভেবেছিলাম, শেষের দিকে এসে দুইটি গল্প কোনোভাবে সুন্দরভাবে একসঙ্গে মিলে গেল। ঠিক যেন দুই দিক থেকে খনন করা দীর্ঘ সুড়ঙ্গ মাঝখানে এসে এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে পূর্ণতা পেল। ৩১ বছর বয়সী এক নবীন লেখক গল্প লেখেন—“The Town and Its Uncertain Wall এবং ৭১ বছর বয়সী এক পরিণত পূর্ণকালীন লেখক সৃষ্টি করেন The City and Its Uncertain Wall। পার্থক্য তো কিছু থাকবেই, কিন্তু উপন্যাসটি পড়ার পরে মনে হয়েছে সেই পার্থক্য সম্ভবত ততটা বড় নয়।

২০২০ সাল ছিল করোনা ভাইরাসের বছর। ঠিক সেই সময়, মার্চের শুরুর দিকে, যখন করোনা ভাইরাস জাপানে তীব্র আকার নিতে শুরু করেছিল, মুরাকামি এই উপন্যাস লেখা শুরু করেন এবং প্রায় তিন বছরের প্রচেষ্টায় এটি সম্পূর্ণ করেন। এই সময়ে প্রায় বাইরে বের হননি, দীর্ঘ কোনো ভ্রমণও করেননি। এক অদ্ভুত, খানিকটা চাপ সৃষ্টি করা পরিবেশে প্রতিদিন এই উপন্যাসে ধীরে ধীরে কাজ করে গেছেনযেন কোনো স্বপ্নপাঠক একটি গ্রন্থাগারে বসে পুরনো স্বপ্ন লিখছে। প্রথম খণ্ডটি সম্পন্ন করার পরে প্রায় ছয় মাস পাণ্ডুলিপিটি ফেলে রেখেছিলেন। পরে উপলব্ধি করেন যে গল্পটি আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। এরপর তিনি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড লেখা শুরু করেন। তাই পুরো কাজটি শেষ করতে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। মুরাকামি বলছেন, এই কাজটি আমার কাছে দীর্ঘদিন ধরে গলার কাঁটার মতো বিঁধে ছিল নতুন আঙ্গিকে পুনরায় লিখতে পেরে আমি সত্যিই স্বস্তি অনুভব করছি।

মুরাকামির লেখায় নারীদের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নের উদ্রেক করে। এই উপন্যাসেও সেই পুনরাবৃত্তি। মিসেস সোয়েদার মতো একজন যোগ্য, সক্ষম চরিত্রকে তিনি অপ্রাসঙ্গিক করে রাখলেন সহকারীর ভূমিকায়, যেন তার ক্ষমতার পরিচয় আমরা না পাই। মুরাকামির সাহিত্যকর্মে নারী চরিত্রের পূর্ণাঙ্গতা এবং তাদের স্বকীয়তা যেন অধরাই রয়ে গেল।

যদিও এই গল্পের গভীর ধীরলয়ে প্রতিফলিত হয় মুরাকামির বোধগম্যতায় চিরস্থায়ী কৌতূহলসময়, মৃত্যু, চেতনা, এবং বাস্তবতা। তার লেখায় আমরা পাই তার দৈনন্দিনতার প্রতি প্রেম। যেমন, এই উপন্যাসেও তার প্রিয় রুটিনের প্রতি প্রেম প্রকাশ পেয়েছেব্লুবেরি মাফিন আর কফির সৌন্দর্য, প্রতি শিফটের শেষে সিগারেট আর ড্রিঙ্ক। একদিকে তিনি শাশ্বত প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করছেন, অন্যদিকে দৈনন্দিনের মধ্যে সেই শাশ্বততার ছোঁয়া নিয়ে আসছেন। এই দ্বৈততা তার লেখার বৈশিষ্ট্য।

আমি এই উপন্যাসের জগতে ঘুরে বেড়ানোর সময় প্রতিটি চরিত্রের সাথে নিজের একটা সংযোগ খুঁজে পেয়েছি। মুরাকামির কল্পনার সেই প্রাচীরঘেরা শহর, বরফে মোড়া লাইব্রেরি, কফিশপের নিস্তব্ধতাপ্রতিটি জায়গা যেন সত্যিই স্পর্শ করে যায়। সাধারণ চরিত্রদের সাথে মিশে থাকা এই মিথস্ক্রিয়া মুরাকামির জগতের বৈশিষ্ট্য। সেই শহরের গলি ঘুরে বেড়াতে চায় মন, যেন প্রাচীরের ওপারের সেই রহস্যময় জগতে কিছু অজানা উত্তর অপেক্ষা করছে।

মুরাকামির সাহিত্যকর্মে হয়তো সরল কোনো উত্তর নেই। জীবন যেমন প্রশ্নে ভরা, তার গল্পও তেমনিকোনো সরল পথ নেই, শুধু কল্পনার এক প্রশস্ত জগৎ। আর সেই জগৎ একবার স্পর্শ করলে, তার বিস্তৃত গভীরতায় প্রতিধ্বনিত হয় জীবন ও মৃত্যুর নিরবধি রূপকথা।

হোর্হে লুইস বোরহেসের কথার মতো, একজন লেখক তার জীবনে আন্তরিকভাবে বলতে সক্ষম এমন গল্পের সংখ্যা মূলত সীমিত। মুরাকামি মনে করেন আমরা সেই সীমিত কিছু মোটিফকেই শুধু বিভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন আকারে পুনর্লিখন করে চলিএমনটা বলা হয়তো ভুল হবে না।