মলয় রায়চৌধুরীর আলোয় কবি মুনিরা চৌধুরী

অ+ অ-

 

কবি মলয় রায়চৌধুরীর নাম অনেকদিন ধরে শুনলেও, তাঁকে পেয়েছিলাম এই ফেসবুকের মাধ্যমে। হাংরি আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে জেনে আসলেও ফেসবুকে তাঁর সরব উপস্থিতি জানার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন কিছু না কিছু পোস্ট করতেন। কখনো নিজের বই নিয়ে বা কোনো না কোন লেখা লিখে কিম্বা কখনো অন্যের বই বা লেখা নিয়ে প্রচুর পোস্ট দিতেন। ফেসবুকে কবির সক্রিয়তা অনেক তরুণদেরকেও হার মানাতো। আমিও অবাক হয়ে কবির সক্রিয় ভাবটা অনুভব করতাম। প্রাণচাঞ্চল্যের প্রাচুর্যে ভরা কর্মচঞ্চল এক যুবা মনে হতো তাঁকে। কখনোই মনে হয়নি কবির এতো বয়স হয়েছে। মৃত্যু ভাবনাকে হয়তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন! অথচ মৃত্যু আমাদের পায়ে পায়ে চলে। সেই মৃত্যুকে বরণ করলেন, বিলীন হয়ে গেলেন অনন্তের মাঝে।

চিন্তার ছুরি দিয়ে নিজেকে কাটাছেঁড়া করতেন কবি মলয় রায়চৌধুরী। অনুভূতি নিয়ে খেলা করতেন। অনুভব করতে চাইতেন তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডে জৈবিক স্বাদ। এমনই চিন্তাশক্তি নিয়ে সাহিত্যের জগতে তিনি দাপিয়ে বেড়াতেন। কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল-বিচ্ছৃংখল মানসিকতা ছিল, ছিল সৃষ্টি তত্ত্বে ভিন্ন ধারণা, ভিন্ন দর্শন। তাঁর এমন চড়াই-উৎরাই মানসিকতাকে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। তাই খুব রয়েসয়ে চিন্তা করে কথা বলতাম। ২০১১ সালে কবিকে ফেসবুকে বন্ধু হিসেবে পাই। তারপর থেকে আমাকে তিনি বিভিন্ন লেখার লিঙ্ক শেয়ার করতেন। ফলে কবিকে আরো জানতে পারি, বুঝতে পারি। এমন কবির সান্নিধ্য বা সংস্পর্শ জীবনকে উদ্দীপিত করে বটে। বেঁচে থাকার আনন্দ কি, তা তাঁর লেখা পড়ে অনুধাবন করেছি। কারণ, তিনি সমাজের প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসা এক কবি।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় মনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে প্রশ্রয় দিতেন তিনি। বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে জীবনকে দেখতে চাইতেন না বলে, দেশভাগের পর লক্ষ্য করলেন বাংলা সাহিত্যে অচলায়তন অবস্থা বিরাজ করছে। কবির মধ্যে ভয় কাজ করছিল এই ভেবে যে, ঊনিশ শতকের মনীষীদের মতো আর কোনো বাঙালি মনীষী বোধ হয় আসবেন না। তিনি মনে করতেন, সৃজনক্ষমতা নির্ভর করে নিজের উপরে। তখন সংস্কৃতি বিকশিত হয়, হয় সমৃদ্ধ। যখন সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে যায়, তখন মানুষ যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করে অর্থাৎ ক্ষুধার্ত হলে মানুষ যেভাবে হাভাতের মতো খেতে থাকে! তিনি আরো মনে করতেন, যে কোনো দেশের সংস্কৃতি সরলরেখায় গড়িয়ে যায় না। সংস্কৃতির ধর্মই হলো প্রকৃতির মতো। তাকে ছেড়ে দিতে হয়। একমাত্র জৈবপ্রক্রিয়ায় এর প্রসার ঘটে। যার জন্য এর বাঁক কোনদিকে যাবে তা আগাম বলা সম্ভব নয়। ঠিক এই মানসিকতা নিয়ে কবি দেখলেন, দেশভাগের পর বাংলা সাহিত্যে একটা স্থবির অবস্থা লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। তখন গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। একারণে তাঁকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টাও বলা হয়। এই আন্দোলনের সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীর দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, দেবী রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নামও যুক্ত হয়েছিল। এখানে হাংরি শব্দের অর্থ ক্ষুধা অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; বোঝানো হয়েছে একটা সময়ের পচন পর্বকে।

হাংরি আন্দোলনের প্রভাব ব্যাপক এবং গভীর হলেও এর স্থায়ীত্ব হয় মাত্র পাঁচ বছর (১৯৬১-১৯৬৫)। এর তাত্ত্বিক দুর্বলতা ছাড়াও কিছু কিছু কার্যকলাপের কারণে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটি গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হয়। কবিতায় খিস্তিখেউড় ও স্ল্যাং শব্দ ব্যবহার করে সুশীল সমাজের চোখে পড়ে যায় এই আন্দোলন। ফলে, অপ্রাতিষ্ঠানিক বাংলা সাহিত্যচর্চার কারণে হাংরি আন্দোলন বেশিদিন গড়াতে পারেনি; পড়ে যায় মামলামোকদ্দমার রোষানলে। অসামাজিক এবং অশ্লীল অসাহিত্যিক কার্যকলাপ দিয়ে অচলায়তনকে ভাঙ্গার এই প্রক্রিয়াটা সুধীজনরা আর নিতে পারেননি। বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্য কবি মলয় রায়চৌধুরীকে জেলেও যেতে হয়েছিল। এসব ব্যাপারে কবির চিন্তার দর্শন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্ন মনে আসতো। কিন্তু ভয় হতো বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে; চিন্তার জগতে বড়বেশি তার ছেঁড়া ছিলেন কি-না; কিম্বা আমি সাধারণ মানুষ বলে! যদিও এই আন্দোলন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মহলে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। কবির ভাবধারায় তরুণদের মাঝে জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। এখনো কবিকে কেউ কেউ অনুসরণ করে চলেছেন।

 

ছবি: মলয় রায়চৌধুরীর ফেসবুকের ওয়াল থেকে

মলয় রায়ের এতো ভারী-ভারী বিষয়, ভারী-ভারী ভাবের সাহিত্য বেশিদিন গলধঃকরণ করতে পারিনি। কারণ, নিত্যদিনের জীবন-জীবিকার দৌরাত্ম্যে। তাই কবির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। হঠাৎ করে কবি যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন। সময়কাল ছিল ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত। এরই মধ্যে বিলেত প্রবাসী কবি মুনিরা চৌধুরী ২০১৮ সালে, ১৭ নভেম্বর হঠাৎ অন্তর্ধান করেন। আচমকা তার এই মৃত্যু সাহিত্যমোদীদের মধ্যে তোলপাড় তোলে। তার মৃত্যু রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে। আমিও তার মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলাম না। আবেগে আপ্লুত হয়ে কবি মুনিরা চৌধুরী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাকে জানার, তাকে বোঝার চেষ্টা করি। তার কবিতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে থাকে। কবিতার আলোয় তাকে তুলে ধরার অভিপ্রায়ে একটা কাজের উদ্যোগ নিই। কাজটি ছিল কবি মুনিরা চৌধুরীকে মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন জনের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করে একটা স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা করা। কাজটি আমার জন্য দুরূহ ছিল। তারপরও কাজটি সম্পন্ন করি। সম্পন্ন হওয়ার পরেই আবার আমি কবি মলয় রায়চৌধুরীকে পেয়ে যাই।

২০২১ সালে কবি তুষার গায়েনের মাধ্যমে মলয় রায়চৌধুরীকে পাই। আমার সম্পাদিত গ্রন্থের জন্য তুষার গায়েন মুনিরার কবিতা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী একটি লেখা ফেসবুকে শেয়ার করলে তা কবি মলয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি মুনিরাকে নিয়ে অনলাইনে আলোচনা করতে চাইলে তুষার গায়েন আমার সঙ্গে মলয় রায়ের যোগাযোগ করিয়ে দেন। তারপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো। বেশিরভাগই কথা হতো কবি মুনিরাকে নিয়ে। তিনিই প্রথম কবি মুনিরাকে নিয়ে কলকাতা থেকে লাইভ ভিডিও করেন। সেখানে আলোচক হিসেবে তুষার গায়েন ও মলয় রায়চৌধুরী স্বয়ং ছিলেন; সেইসাথে আমিও ছিলাম। তুষার গায়েন এবং মলয়দা মুনিরার কবিতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। আর আমি কেন কবি মুনিরাকে নিয়ে এমন একটা গুরু কাজে হাত দিলাম, তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান কেমন হতে পারে, তা নারীপুরুষ অনেকেরই ধারণা আছে। কবি মলয়ও বুঝতে পারেন বিষয়টি। তাই মুনিরার সামাজিক অবস্থান বুঝতে পেরে, বিশেষ করে মৃত্যুর পরেও যখন মুনিরাকে অস্তিত্বহীন করতে চাইলো, যার প্রেক্ষিতে আমার এই চ্যালেঞ্জ নেয়া যে, কবিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে মুনিরার লেখনী, সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং তার কবিতা দিয়ে; তখন মলয়দাও কবি মুনিরার ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। খুলে ফেললেন ‘মুনিরা চৌধুরীর কবিতা’ নামে ফেসবুকে একটি পাবলিক গ্রুপ। আমাকে বললেন, মুনিরাকে নিয়ে যেন সব পোস্ট ওখানে শেয়ার করি। তারপর মুনিরার নামে উইকিপিডিয়া খুলতে চাইলেন। আমাকে বললেন, মুনিরার সব ইনফরমেশন দিতে। আমার পক্ষে সব তথ্য দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, এ ব্যাপারে মুনিরার ফ্যামিলি এবং তার বন্ধুবান্ধব কেউই আমাকে সহযোগিতা করেনি। যা তথ্য পেয়েছি তা অনলাইন ঘেটে উদ্ধার করেছি। ইতোমধ্যে মুনিরার ফেসবুক একাউন্ট,  মুনিরার করা বাংলা একাডেমি লন্ডনের ফেসবুক পেইজ, সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। এসব বলার পর বললেন, যা আছে দাও, তা-ই দিয়ে চেষ্টা করি। কিন্তু উইকিপিডিয়ার পেইজ খোলা সম্ভব হয়নি। কারণ, যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য ছিল না। এরই মধ্যে মলয় রায়চৌধুরী বিভিন্ন অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় কবি মুনিরাকে নিয়ে লেখা শেয়ার করতে লাগলেন। আমাকে বাংলা কবিতা’ নামে কবি ও কবিতার ওয়েবসাইটে মুনিরার কবিতা শেয়ার করতে বললেন। কিন্তু কিছু টেকনিক্যাল অসুবিধার কারণে আমি কাজটা নিয়মিত করতে পারিনি। এটা আমার অক্ষমতা। তার কিছুদিন পর শুনি তিনি কবি মুনিরার কবিতা সংকলন করতে চাইছেন। তখন জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কাছে মুনিরার সব কবিতা আছে? তখন বললেন, তোমার সম্পাদিত বইয়ে যা আছে, তা-ই নিয়েছি।’ আমি বললাম, ওখানে সব কবিতা নেই, কিছু কবিতা দিয়েছি।’ তখন জিজ্ঞেস করলাম, মুনিরার কোনো কবিতার বই আপনার কাছে নেই? তিনি বললেন, না।’

আমি একটু অবাকই হলাম। যে মানুষটি মুনিরাকে এতো স্নেহ করেন, সেই মানুষটির কাছে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই! আসলে কবি মুনিরা মানুষটিই এমন। নিজের প্রচার প্রচারণায় ধার ধারতেন না। তারপরও মলয় রায় কিভাবে মুনিরাকে পেলেন তা তিনি মুনিরা চৌধুরীর কবিতা সংকলনের মুখবন্ধে যেভাবে লিখেন, তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি।

 

ছবি: মুনিরা চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরীর কথা

ইংল্যাণ্ড নিবাসী মুনিরা চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। ফোনে আর ফেসবুকে। উনি আমাকে বলেছিলেন আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি ওনাকে দিতে, কার্ডিফ বাংলা একাডেমির সংগ্রহালয়ে রাখবেন, তার জন্য দুটো এয়ার টিকেট পাঠিয়ে দিচ্ছেন আমার আর আমার স্ত্রীর জন্য। প্রবাসে নিজভাষে পত্রিকার সম্পাদক মন্দিরা পালের কাছে আমার ফোন নম্বর পেয়েছিলেন। তাঁর কবিতা পড়ে অসাধারণ কবি-প্রতিভার পরিচয় পেয়েছিলুম।

সেসময়ে ইন্টারনেটে তাঁর কবিতা সেভাবে পাইনি।

অথচ তার কয়েকদিন পরেই আত্মহত্যা করলেন। আমি স্তম্ভিত। ওনার কবিতায় যে চোরাগোপ্তা আত্মহত্যার বার্তা থাকতো তা নিছক কবিতা ছিল না তাহলে। মারা যাবার পর ওনার মৃত্যু নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন সাইটে। এপার বাংলার কোনো সাইটে ওনার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হয়নি; কবিতাও দেখিনি কখনও এপার বাংলার সাইটে আর লিটল ম্যাগাজিনে।

...

তাঁর অকাল-মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। তবু বাংলাদেশে তাঁর গুরুত্ব স্বীকার করা হয়নি। তাঁর কবিতার ধারা যে বাংলাদেশের কবিতাকে নতুন মোড় দিয়েছে সেকথা স্বীকার করা হয়নি। সত্যি বলতে, তাঁকে পাত্তা দেয়নি সেদেশের আলোচক মহল।

মুনিরা চৌধুরীর কবিতায় বারবার শ্যাম-এর উল্লেখ আলোচকদের পছন্দ হয়নি বলেই মনে হয়। তাঁর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না বলে আঞ্জুমান রোজী আর তুষার গায়েন, যাঁরা বিদেশে থাকেন এবং স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশি প্রাতিষ্ঠানিকতার দোষমুক্ত, তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

ফেসবুকের মাধ্যমে মুনিরা চৌধুরীর সঙ্গে মলয় রায়ের পরিচয় হলেও মুনিরার কবিতাশক্তিই তাঁকে আরো কাছে টেনে নেয়। যার কারণে মুনিরার হঠাৎ মৃত্যুর পর মলয়দা বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তাছাড়া মুনিরাকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছিলো না দেখে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য একে পর এক উদ্যোগ তিনি নিতে থাকেন। মুনিরার কবিতা সংকলন বের করার জন্য মলয় দাকে আমার সংগ্রহে মুনিরার দুটো কবিতা বইয়ের প্রতিটি পাতার ছবি তুলে পাঠিয়ে দেই। সেই কবিতাগুলো টাইপ করে পাণ্ডুলিপি বানিয়ে তাপস গুপ্তের সম্পাদনায় কলিকাতার  গীবার্ণ প্রকাশনী থেকে কবিতা সংকলনটি প্রকাশ হয়। সংকলনটি প্রকাশ হওয়ামাত্রই তাঁর ফেসবুক ওয়ালে এবং মুনিরা চৌধুরীর কবিতা নামে ফেসবুকের পাবলিক গ্রুপে অক্টোবর ১৩ তারিখে পোস্ট দেন। কবির সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় ১৯ অক্টোবর। মুনিরা চৌধুরীর কবিতা সংকলন কিভাবে সংগ্রহ করবো সেই ব্যাপারে। তারপর সব ইতিহাস হয়ে গেলো। বিধির কি বাম, তার কিছুদিন পর অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর (২০২৩) মলয় দার তিরোধান হয়। বাংলা সাহিত্যের জগতে আদর করে হাতে ধরে সামাজিকভাবে নিমজ্জিত এক কবিকে স্থায়ী আসন দিয়ে গেলেন। যে কাজটা বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকেরা করতে এখনো কুণ্ঠাবোধ করেন। কবি মুনিরা চৌধুরী কালের পাটাতনে ঠাঁই পেয়ে গেলন।

মলয় রায় শুধু মুনিরাকেই তুলে ধরেননি, তিনি এমন আরো অনেক সম্ভাবনাময় কবি সাহিত্যিকদের তুলে ধরেছেন। তম্মধ্যে আমিও অধম আছি। মলয় দাকে এব্যাপারে কখনো অনুরোধ করতে হয়নি। নিজ থেকেই তরুণদের উৎসাহের কারণ হতেন। ভালোবেসে সাহিত্যের মাঝে সত্য সুন্দরের সন্ধানে তরুণদের কাছে টানতেন। কতটা উদারতার পরিচয় তিনি দিয়ে গেছেন, তা বলাই বাহুল্য। জীবনভর সাহিত্য সাধনায় ব্যপ্ত ছিলেন। তাঁর সারাজীবনই ছিল বিতর্কিত। ব্যতিক্রমী কাজ করতে গিয়ে বিতর্কের জন্ম দিতেন। তিনি মূলধারার বাংলা কবিতার অনুশাসন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আমৃত্যু নিজের অবস্থানে অটল থেকেছেন। সেখান থেকে এক চিলতে বিচ্যুত হননি। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। পোস্ট মর্ডানিজমসহ তিনি বিভিন্ন ইজম নিয়েও বিস্তর লিখে গেছেন। তাঁর তিরোধানে বাংলা সাহিত্যে এক বড় শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তবে তাঁর স্মৃতিটুকু আমাদের মাঝে আশীর্বাদ হয়ে থাকবে; সেইসাথে তিনিও বাংলা সাহিত্যে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন।