আনিসুজ্জামানের পত্রালাপ: ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড সময়

অ+ অ-

 

 

প্রিয় আনিসুজ্জামান : তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র
সম্পাদক: মতিউর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৫২
মূল্য: ৬৫০ টাকা

এমন এক সময়ে আনিসুজ্জামান [১৯৩৭-২০২০] জন্মগ্রহণ করলেন এবং তাঁর জীবনের প্রথম বিশ বছর কাটালেন, যা নানা অর্থেই গোলমালের কাল সেই সময়ের বর্ণনায় ইতিহাসের সত্য যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি লেখক-জীবনীতেও তার একটি বড়ো অংশ প্রকাশিত হয়েছে। আনিসুজ্জামান তাঁর নিজের আত্মজীবনীতেও এই বিষয় স্পষ্ট করেছেন বেশ জোরেশোরেই। পুরোনো সময় খুঁজে পাওয়ার সংকট আর তার বিপরীতের সম্ভাবনার বিষয়েই কথা বলছি। কিন্তু এর বিপরীতে ইতিহাসের নানা মিছে কথাও লেখা হয়েছে। ইতিহাস রাজানুকূল্যে যেমন লেখা হয়, তেমনি রাজার আনুকূল্যের বিপরীতেও লেখা হয়। বিপরীতে লেখা ইতিহাসই জনজীবন আর জনমানসের সাথে বেশি সম্পৃক্ত। আত্মজীবনী সেই ধারার রচনার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার থেকে আরো এক ধাপ ওপরে অবস্থান চিঠির। চিঠি তাৎক্ষণিক লেখা হয়। সেই তাৎক্ষণিকতায় থাকে আকাঁড়া বাস্তবতা। যে বাস্তবতা নিজের মতো করে পরে লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু তা সম্ভব হতে পারে আত্মজীবনীর মতো রচনাতে।

সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে প্রিয় আনিসুজ্জামান : তাঁকে ও তাঁর লেখা চিঠিপত্র। এই বইয়ের আনিসুজ্জামানের কাছে প্রেরিত নানাজনের চিঠি যেমন আছে; তেমনি আনিসুজ্জামানের নিজের লেখা কিছু চিঠিও রয়েছে। চিঠিগুলো নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ ওপরে যে আলাপ হলো তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। যুগের এই সত্যতা যাচাইয়ের জন্য দরকার পড়ে নানা প্রমাণের। চিঠি সেই প্রমাণের যোগানদার। এই যোগানে সুবিধাও অনেক। চিঠিপত্রের ভেতরে কাটছাট করার সুযোগ কেবল চিঠি লেখার সময়েই থাকে। কিন্তু এরপর যদি চিঠিগুলো সম্পাদনার সময় সংকলক কিংবা সম্পাদক কিছু কাটছাট করে, তবেই তা পরিবর্তন করা সম্ভব। এ ভিন্ন চিঠিতে জমে থাকা সময়ের বাস্তবতার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এই কারণেই কোনো একটি সময়ে ঘটে যাওয়া বাস্তবতার বাস্তব বয়ান চিঠিপত্রেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আনিসুজ্জামানের কাছে লেখা এই চিঠিগুলোতে এই বিষয়টি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

বইয়ের সম্পাদক চিঠিগুলোর যে সমস্ত শ্রেণিতে শ্রেণিকরণ করেছেন তার প্রথমে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতায় আনিসুজ্জামানে কাছে বিভিন্নজনের লেখা চিঠিগুলো। আমি বলবো, এই সংকলনে সবচেয়ে জরুরি অংশ এটি। বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন আনিসুজ্জামান। সেই যখন প্রথম দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো, সেই সময়েই বলা যায় আনিসুজ্জামানের ভেতরে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে বলছেন, তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের জন্যে মায়ের ব্যবহৃত পুরোনো দুধের কৌটায় করে পাকিস্তানের জন্য চাঁদা তুলেছেন। এই বিষয় একেবারেই শৈশবে আনিসুজ্জামান করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায়, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-আদর্শের যে উন্মেষ ও বিকাশ তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালিত হয়েছে এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এরপর ঢাকায় আসার সাথে সাথেই শুরু হয় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলনেও আনিসুজ্জামানের বড়ো ভূমিকা ছিল। এরপর ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। আর এরই ধারাবাহিকতায় আসলো বাঙালির আত্মমর্যাদার লড়াইয়ের দিন মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই ভূমিকা সরাসরি যুদ্ধ করে নয়। সাংগঠনিকভাবে গুরু দায়িত্ব পালন করেই এই বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণ করেছেন। এই বৃহৎ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আনিসুজ্জামান যুদ্ধের পুরোটা সময় নানাজনকে চিঠি লিখেছেন। আবার এর বিপরীতে অনেকেই তাঁকে চিঠি লিখেছেন। যে চিঠিগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। বিবেচিত হবে রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের ইতিহাস নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক উপাদান হিসেবেও। আদতে সময়ের ফ্রেম বদলে যেতে পারে ইতিহাস রচনার সময়; ক্ষমতা এই কলকাঠিটি নাড়ে। সাহেবী ধারার ঐতিহাসিকরা এই বিষয় ভারতের ইতিহাস রচনার সময়ই করেছেন। হান্টার, ডব্লিউ কক্স কিংবা চার্লস স্টুয়ার্টের মতো নামজাদা ঐতিহাসিকদের বাংলার ইতিহাস নির্মাণের দৃষ্টিভঙ্গি এই বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। ইতিহাস নির্মাণের বেলায় এর বিপরীতে থাকবে আনিসুজ্জামানের এই সমস্ত চিঠি।

যুদ্ধের দিন মানুষের পালিয়ে বাঁচাই হয়ে পড়ে চরম বাস্তবতা। এই বাস্তবতা কোনো শ্রেণিই এড়িয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আনিসুজ্জামান নিজেও এই বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাঁকেও নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ভারতে গিয়ে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সাথে। এরই ফলে তাঁকে কেবল স্বদেশের মানুষকে চিঠি লিখতে হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়, একইসাথে তাঁকে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে চিঠি লেখা জরুরি হয়ে পড়ছে। যাঁরা তাঁকে চিঠি লিখছেন তাঁরা সেই সময় নানা কারণে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। যদিও তাঁদের বড়ো অংশ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মানুষ। যাঁদের সাথে পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকেই আনিসুজ্জামানের একটি হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে। সেই সম্পর্ক যুদ্ধদিনের বাস্তবতায় কেমন হয়ে উঠলো, তা এই চিঠিগুলোর ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এই ধারার একটি চিঠি ব্যারি মরিসন তাঁকে লিখেছিলেন। যে চিঠিতে ব্যারি আনিসুজ্জামান যুদ্ধদিনে কীভাবে জীবনযাপন করছেন, আর তার খোঁজখবরের ব্যাপারটি আছে। আছে কিছু অর্থ সহায়তার বিষয়। চিঠিগুলো কেবল নিছক সম্পর্কের খাতিরে আনিসুজ্জামানকে লেখা হয়নি। এই চিঠিগুলো লেখার পেছনে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল তাঁর নিজের মেধা ও মননের ভিতটা। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে তাঁর তৎপরতার বিষয়টি।

যে সময় আনিসুজ্জামান দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, সেই সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনি নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। দেশের নানা প্রান্তে লুটপাট ও ধর্ষণ চলছে অবাধে। ঢাকা হয়ে উঠেছে একটি মৃত নগরী। ২৫ মার্চের পর থেকেই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া শুরু করেছে ঢাকার লোকজন, ক্রমান্বয়ে সমগ্র বাংলাদেশের লোকজন। এই বিষয়টি সম্পৃক্ত ছিল আনিসুজ্জামানের পরিবারের সাথেও। আনিসুজ্জামানের আত্মীয়স্বজন সেই সময়ে ঢাকায় বসবাস করছে, ঢাকার বাইরেও আছে অনেকেই। বিষয়টি আনিসুজ্জামানকে যেমন ভাবিয়েছে, তেমনি করে তাঁর নিজের পরিবারের লোকজনও তাঁকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তার ভেতর দিয়ে গেছে। এই যে নিজের পরিবারের লোকজনের লেখা চিঠি, যা লেখা হয়েছে আনিসুজ্জামানকে, তা কেবলই তাঁর ও তাঁর পরিবারের অসহায়ত্বের বিষয়টি প্রকাশ করে না। সাথে সাথে সেই সময়কার ঢাকা আর ঢাকার বাইরের বাস্তবতার অকৃত্রিম চিত্র স্পষ্ট হয় এই চিঠিগুলোতে। এই ধারায় লেখা চিঠির বিষয়াদি ব্যক্তিকতার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হওয়ার পরও সামষ্টিকতার ভেতরে পৌঁছোতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধদিনে একটি দেশের বাস্তবতার আলেখ্য হয়েছে চিঠিগুলো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আনিসুজ্জামানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশেষ করে শিক্ষা, শিল্প, সাংস্কৃতিক জগৎকে ব্যবহার করে এবং তার ওপর সওয়ার হয়ে সমগ্র পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্বের একটি বড়ো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসার বিষয় আনিসুজ্জামান করেছেন সক্রিয়তার ভেতর দিয়ে। বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু পাল তাঁকে যে চিঠিটা লিখেছেন, তাতে লেখক জানাচ্ছেন যে বাংলাদেশশীর্ষক আলোচনা সভায় তাঁকে উপস্থিত থাকতে হবে। এই যে সম্পর্ক তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের মতো বৃহৎ সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য তিনি সম্পৃক্ত হয়েছেন, এটি যুদ্ধের ময়দানে নেমে যুদ্ধ করার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। অর্থাৎ বহির্বিশ্বের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনমত গ্রহণ সেটাই এই।

রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা যুদ্ধকে কীভাবে নিয়ন্ত্রিত করছিল, অর্থাৎ এই যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলের বিষয় সে সময় সমগ্র পূর্ব-বাংলার জনগণের ভেতর ছিল তাই যুদ্ধের সময় বড়ো সমস্যা হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে বামফ্রন্ট এবং জাতীয়তাবাদীএই দুই ধারার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নানা সমালোচনার ভেতরে পড়েছিল। নিজেদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দ্বন্দ্ব। যুদ্ধকে বিতর্কিত করে ফেলছিল। তা আনিসুজ্জামানকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট হয়। এছাড়া শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় জীবনযাপনের নানা টুকরো টুকরো কাহিনি তাঁকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট হয়েছে।

আনিসুজ্জামানের প্রথম গল্প কবে লিখেছিলেন তা সুস্পষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়। তবে তিনি যে তাঁর প্রথম গল্পটি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের সংকলনে ছেপেছিলেন তা নানান প্রমাণের মাধ্যমে স্বীকৃত। এরপর একটি বর্ণিল জীবনের অধিকারী আনিসুজ্জামান শুধু সাহিত্যিক হিসেবে আর সক্রিয় থাকেননি। তিনি কর্মজীবনে সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু কেবলই অধ্যাপনার ভেতর দিয়েই তাঁর কাজকর্ম শেষ হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। তাঁর সময়ের এবং তারও পরের সময়ের সাহিত্যিকদের সাথে একটি গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সম্পর্কের বিষয়টি সক্রিয় ছিল। তিনি কেবল এই সাহিত্যিকদের পরামর্শ দিয়েছেন বিষয়টি এমন নয়; সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া এবং ধারণা দেওয়ার বিষয়টিও সযত্নে করতে পেরেছিলেন। সৈয়দ শামসুল হকের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিক নানা স্মৃতিকথায় প্রকাশ করেছেন যে, তিনি তাঁর বানান সমস্যার সমাধান পেয়েছিলেন আনিসুজ্জামানের কাছ থেকে। যদিও তাঁর দুজনে ছিলেন ভালো বন্ধু। আবার সাহিত্যিকরা তাঁকে যে কেবল সাহিত্য বিষয়ে পরামর্শ আলাপ-আলোচনার বিষয়েই কথা বলেছিলেন, বিষয়টি এমন নয়। এই সমস্ত সাহিত্যিকরা তাঁকে অন্যান্য বিষয়েও চিঠি লিখেছেন। যেমন ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর অজিত গুহের লেখা চিঠিটি ছিল আনিসুজ্জামানের চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে। আবার গোপাল হালদারের মতো নামজাদা লেখক-গবেষকও তাঁকে চিঠি লিখেছেন। চিঠি লিখেছেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, চিঠি লিখেছেন গোলাম মুরশিদ। চিঠি লিখেছেন রশীদ করীম আর আসাদ চৌধুরী। এঁরা প্রত্যেকই বাংলা সাহিত্যে স্ব স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই যে সাহিত্যিক ও গবেষকএই দুই ধারায়ই আনিসুজ্জামান সমানভাবে সমন্বয় করেছেন, এবং সেই সমন্বিত চিন্তার বিষয় মেনে চলেছেন। এই বিষয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও সংস্কৃতি জগতের জন্য ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

বন্ধুত্ব একটি অন্যরকম সম্পর্কের নাম। বাংলায় প্রবাদে এমন কথা প্রচলিত আছে যে, যে যেমন ধারার লোক, সে তেমন ধারার ভেতরে বন্ধু খুঁজে ফিরে। কিন্তু আনিসুজ্জামামান এই ধারণার ভেতরে সবসময় স্থির ছিলেন না। তিনি প্রায় সব ধারার লোকজনকেই আপন না ভাবলেও বন্ধুত্বের বেলায় তিনি তা মেনে চলেছেন। তবে এই বিষয় করতে গিয়ে তাঁর চিন্তা-আদর্শের সাথে তাঁর বন্ধুদের চিন্তা-আদর্শের অমিলের ব্যাপারটিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। আবার তাঁর চিন্তা-আদর্শের সাথে যায় না এমন চিন্তা-আদর্শের সাথে আপস করেননি। কিন্তু যে কোনো কারণেই গড়ে ওঠা সম্পর্ককে বাতিল করে দেননি। ১৯৫১ সনের ১৮ ফেব্রুয়ারি আনিসুজ্জামানের জন্মদিন উপলক্ষে বে-নজীর আহমদ একটি কবিতা লিখে তাঁকে শুভেচ্ছা-চিঠি দিয়েছিলেন। পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক বে-নজীর আহমদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল বিধায় তিনি আনিসুজ্জামানকে চিঠি লিখেছিলেন। কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু বে-নজীর আহমদ নিজে যে রাজনৈতিক চিন্তা-আদর্শের সমর্থক ছিলেন সেই রাজনৈতিক চিন্তা-আদর্শের বিষয় আনিসুজ্জামান কখনই সমর্থন করবেন না। এই বিষয়টি ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক এবং চিন্তা-আদর্শগত সম্পর্কের ফারাকটি স্পষ্ট করে। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের ঢাকায় বেড়ে ওঠা ও বড়ো হওয়া আনিসুজ্জামান এমন এক ঝাঁক প্রতিভাবান তরুণদের সাথে পরিচিত হতে থাকা তাঁর জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। নিজেই কেবল একটি সমাজে বড়ো হওয়া যায় কিন্তু বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়। মানুষ ব্যাপারটি হয়ে ওঠার জন্য এই বন্ধুত্বের সম্পর্কের ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এঁরা নানাসময় আনিসুজ্জামানকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই সমস্ত চিঠিতে নানা বিষয় আবদ্ধ আছে। আছে দেশ-কাল-সময়ের বিবরণ। আছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির হালহকিকত। আরো নানা বিষয়।

পরিবার রাষ্ট্রের যে পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি হয় তার প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। আনিসুজ্জামানের পারিবারিক ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তাঁর পিতামহ থেকে তাঁর অন্যান্য সদস্য এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বিবেচ্য। পরিবারের লোকজন নানাসময় তাঁকে চিঠি লিখেছে। এই চিঠিগুলোতে আনিসুজ্জামানের পারিবারিক জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। বইয়ের একটি অংশে উপস্থাপিত হয়েছে এই চিঠিগুলো। দেশে ও বিদেশেদুই জায়গায় তিনি যখন অবস্থান করছেন, সেই সময়ে তাঁকে তাঁর পরিবারের অনেকেই চিঠি লিখেছিলেন। এই সমস্ত চিঠিতে তাঁর পারিবারিক জীবনের বাস্তব ইতিহাস সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। পিতা কিংবা স্ত্রী তাঁকে চিঠি লিখছে, এবং সেই চিঠির ভেতরে তাঁর কর্মপ্রেরণার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে পরিবারের সদস্যরা।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আনিসুজ্জামানের কাছে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত হতে নানাজনের লেখা, বইপত্র আসতো। এ সমস্ত বইপত্র আনিসুজ্জামানের কাছে আসার প্রধানতম কারণ তাঁর পাঠ অভ্যাস এবং রেসপন্সিভ বিহেভিয়োর। একটি বটবৃক্ষের সাথে নানা প্রাণী বা নানাকিছু যেভাবে সম্পৃক্ত থাকে তেমনি করে আনিসুজ্জামান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লোকজন এবং তাঁদের লেখাজোকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। এই বিষয়টি আনিসুজ্জামান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত করেছেন। কোথায় কারা কী লিখছে এবং কেন লিখছেবিষয়টি আনিসুজ্জামানের কাছে জরুরি ছিল। তিনি এই বিষয়টি নিজের একটি কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতেন। এবং তা পালন করতেন।

কেবল প্রথাগত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথেই আনিসুজ্জামানের সংযোগ ছিল না, সাথে সাথে সংগঠন ও রাষ্ট্রের দরকারি কাজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আনিসুজ্জামান সম্পৃক্ত ছিলেন। এই সমস্ত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রক্ষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যদিও এই যোগাযোগ রক্ষা অনেক সময় স্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তা হলে বিষয়টি খারাপ। কিন্তু এরই বিপরীতে দায়িত্বটা বিশেষ। আনিসুজ্জামান রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের কিংবা যে কোনো সংগঠনের কাজে কখনো পিছপা হননি। তিনি কেবল দায়িত্বে আবৃত হয়েই সময় ও নাম কামাননি। তিনি তাঁর দায়িত্বের বিষয়টিও বিশেষভাবে স্মরণে রাখতেন। এবং সেই দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের ঘাটতি রাখতেন না। এগুলো আলাপ। আনিসুজ্জামানের দায়িত্বজ্ঞান বিষয়ে। কিন্তু এই চিঠিগুলো কেন আলাপে আসবে। আলাপে আসবে এই কারণে যে, আনিসুজ্জামান সম্পর্কে যে কথা বাজারে প্রচলিত আছে, তা তো মিথ্যাও হতে পারে। হতে পারে তাঁর লিজেন্ডারি ব্যক্তিত্বের জন্য তাঁকে এই বিষয়ে একটি স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়। কিন্তু আনিসুজ্জামান নিজে কখনই এই বিষয়ে কথা বলেছেন কিংবা প্রচার করেছেন, তা জানা যায় না। এই বিষয়েরই একটি বাস্তব প্রমাণ নিয়ে হাজির হয় এই অংশের চিঠিগুলো। আানিসুজ্জামানের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সম্পর্কে প্রচলিত সুনামের গল্পের একটি বাস্তব ভিত্তি প্রমাণিত হয় এই অংশে।

অপ্রকাশিত চিঠি এই অংশে আনিসুজ্জামান তাঁর পরিবার ও অন্যান্য ব্যক্তিকে যে সমস্ত চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু সেই সমস্ত চিঠি পাঠানো হয়নি প্রাপকের কাছে, বিভিন্ন সময়েতাই সংযোজিত হয়েছে এই অংশে। পাঠানো যে হয়নি, তা যে কোনো কারণেই হতে পারে। কিন্তু এই যে পাঠানো হয়নি, এটিও যেন শাপে বর হয়েছে। চিঠি লেখার পর কিংবা তা অন্যখান থেকে প্রেরিত হওয়ার পর তা যত্ন করে গুছিয়ে রাখার বিষয়টি সবার দিয়ে হয় না, হয়নি। বিষয়টি কেবল সাধারণমানুষের জন্য প্রযোজ্যএমন নয়। গুরুত্বপূর্ণ লোকের মধ্যেও এই গোছগাছের বিষয়টি দেখা যায় না। কিন্তু আনিসুজ্জামান ছিলেন ভীষণ গোছানো মানুষ। আনিসুজ্জামানের চিঠিপত্র নিয়ে কাজ করেছেন এই গ্রন্থ সম্পাদনা-সহযোগী আনিসুর রহমান। তাঁর মুখ থেকে শুনেছিলাম, আনিসুজ্জামান তাঁর শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর রচনাবলি সম্পাদনা করতে গিয়ে মুনীর চৌধুরীর লেখার যে খাতা পেয়েছিলেন তাও সযত্নে সংগ্রহে রেখেছেন। এহেন কাগজপত্রযা আমাদের হিসেবে হয়তো বা বাতিল এবং অদরকারি তা আনিসুজ্জামান সংগ্রহে রেখেছিলেন আমৃত্যু। এই বিষয়ের সাথেই সম্পৃক্ত তাঁর লেখা কিন্তু প্রেরিত নয় এমন চিঠিগুলো। এই চিঠিগুলোর বিষয় ওপরে আলোচিত আনিসুজ্জামানকে লেখা চিঠির বিষয়ের সাথে মিলে যাবে। নানা প্রেক্ষিতেই তিনি তাঁকে লেখা চিঠির উত্তর দিয়েছেন। নিজেও দরকারে-অদরকারে চিঠি লিখেছেন। এগুলো তারই নমুনা। যদি তিনি যে চিঠি লিখেছিলেন তা পাওয়া যেতো তাহলে ওপরে আলোচিত চিঠির ভেতরে একটি সমন্বয় করে নতুনভাবে ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব হতো।

প্রেরক-প্রাপক পরিচিতি, এই অংশ এই গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নতুন প্রজন্ম আনিসুজ্জামানকে যাঁরা চিঠি লিখেছেন তাঁদের অনেককেই চিনেন না, চিনবেন না; আবার কেউ চিনতেও পারেন। এবং চেনার জন্য ঝটপট যে ইন্টারনেট-মাধ্যম, তাতেও এঁদের অনেকের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা সম্ভব হয় না। ফলে বইপত্র ঘেঁটে এঁদের সম্পর্কে জানাবোঝার যুগও বোধহয় চলে গেছে। তাই এই বই পাঠ করবে যারা, তাদের জন্যে প্রেরক-প্রাপক পরিচিতি অংশটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে এই গ্রন্থ সম্পাদনার মূল্য নিউম্যারিক হিসেবে সম্পন্ন করা যাবে না। ইতিহাস-সময়ের বিবেচনায় এই গ্রন্থের মূল্য অপরিসীম। ইতিহাসে সময় খণ্ড খণ্ড হয়ে আসে। এবং এই খণ্ড খণ্ড সময় একত্রিত করে ইতিহাসের নির্মাণ হয়। আনিসুজ্জামানকে লেখা চিঠি ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড সময়কে জোড়া দেওয়ার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আর এই কর্ম সম্পন্ন হবে জনগোষ্ঠী আর জনমানসের বাস্তবতায়।