পত্র সভ্যতার ধ্বংসের নেপথ্য কাহিনী

অ+ অ-

 

সাড়ে ন’টার মধ্যে অফিস খোলার নিয়ম, কিন্তু প্রায়ই মাস্টারবাবু আসতে আসতে দশটা বেজে যায়। গ্রামের পোস্ট অফিস, মানুষজন সবই চেনাজানা, তাই এই সামান্য দেরি নিয়ে কেউ বড় একটা মাথা ঘামায় না। তবে বিনোদবিহারীর কথা আলাদা। সময়ে অফিসে আসাটা তার রক্তে ঢুকে গেছে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ঝড়-তুফান যা-ই হোক না কেন, সাড়ে ন’টা বাজার আগেই সে এসে হাজির হয়। 
মাস্টারবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, তোমার বয়েস হয়েছে বিনোদ, আজকাল অফিসে তোমার তো তেমন কাজকম্মোও থাকে না, একটু দেরি করে এলেই পারো! 
বিনোদ মাড়ি বের করে হাসে। বলে, আর তো শেষ করে এনেছি স্যার, এখন কি আর অভ্যেস বদলানো যায়!
হেমন্তের মাঝামাঝি বাতাসে বেশ সিরসিরে ভাব, ভোরের দিকে হালকা শীতও পড়তে শুরু করেছে। বিনোদ অন্যদিনের মতো অফিসের সিঁড়িতে বসে সকালের নরম রোদে পিঠ সেঁকতে সেঁকতে ঘোলাটে চোখে টেলিফোনের টাওয়ার দেখছিল।
পোস্ট অফিসের সামনে ভক্কাবাবুদের পুরনো আমলের ঢাউস তিনতলা বাড়ি। বছর দু’য়েক হল, সেটির ছাদে এক টেলিফোন কোম্পানি মোবাইলের টাওয়ার বসিয়েছে। মজবুত খাঁচার মতো লোহার স্তম্ভ ক্রমশ সরু হতে হতে যেন আকাশ ছুঁয়েছে, সেটার মাথায় আবার ঢাকের মতো যন্ত্র বসানো।
আজকাল আর কোনও কিছু স্পষ্ট দেখতে পায় না বিনোদ। তবু সকালের আলোয় মনে হল, টাওয়ারের ঢাকের ওপর যেন একটা চিল বসেছে। সে চোখের ওপর হাত রেখে সরু দৃষ্টিতে আরেকবার তাকাল। হ্যাঁ, চিলই মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই সন্দেহ হল, দেখতে ভুল হচ্ছে না তো? চশমার পাওয়ার বেড়েছে অনেকদিন, বাঁ চোখটায় ছানি পড়েছে। ডাক্তার বলেছে, অপারেশন করা ছাড়া পথ নেই। শুনে বিনোদ মনে মনে হেসেছে। এই বয়েসে কী দরকার ছানি কাটিয়ে নজর তাজা করার? বরং এই ভালো, আজকাল বেশি দেখলেই বিপদ। চাকরি তো প্রায় শেষ হয়ে এল, আর মেরেকেটে বছর দেড়েক, তাও বয়েসে বছর তিনেক জল মেশানো ছিল বলে। তারপর তো সব শেষ, খেল খতম, পয়সা হজম।
চিল দেখতে দেখতে বিনোদের শান্ত মুখখানা হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠল। সে আপন মনেই চেঁচিয়ে উঠল, মার, ঠোকর মার। ঠুকরে ফালা ফালা করে দে দিকিন ঢাকখানারে!
মাস্টারবাবু অবাক হয়ে বললেন, কার সাথে কথা বলছ, বিনোদ? কাকে ফালা ফালা করে দিতে বলছ?
তিনি যে কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, টের পায়নি সে। বিনোদ লজ্জা পেয়ে মাড়ি বের করে হাসল। বলল, ও কিছু না স্যার। কই চাবি দ্যান। 
তারপর কোলাপসিবল গেটটা ঠেলতে ঠেলতে বলল, জয়েন্টগুলোতে একটু মোবিল দিতে হবে, বড্ডো জং ধরে গেছে!
মাস্টারবাবু ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, হ্যাঁ, তোমার মতো।
এককালে কলসুর গ্রামে মণ্ডলবাবুদের খুব রমরমা ছিল। কিন্তু শরিকদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগির পর সকলের অবস্থাই এখন পড়তির দিকে। ভক্কাবাবুর ভাগে পড়েছে এই পেল্লাই সাবেক বাড়িখানা। তিনি এখনও গিলে করা সাদা আর্দির পাঞ্জাবির সঙ্গে নামী মিলের মিহি ধুতি পরে হালদারের চায়ের দোকানে বসে রাজা-উজির মারেন বটে, তবে লোকে বলে, তাঁর অবস্থাও নাকি বিশেষ জুতের না। তা না হলে কেউ সাধ করে টাওয়ার বসানোর জন্যে মোবাইল কোম্পানিকে ছাদ ভাড়া দেয়! তারা আরও বলে, ঐ টাওয়ার থেকে নাকি নানা রোগবালাই ছড়ায়, গাছের ফল পাকুড় নষ্ট হয়, এমনকী ছোট ছোট পাখ পাখালি মারা পড়ছে। 
কিন্তু একে তিনি মানী মানুষ, তার ওপরে পার্টির নেতা। তাই প্রকাশ্যে কেউ এ ব্যাপারে রা কাড়ে না।
আজকাল আর চিঠিপত্র তেমন আসে না বলে তার হাতে বিশেষ কাজ নেই। অফিসের চেয়ার-টেবিলগুলো মুছতে মুছতে সে পুরনো দিনের কথা ভাবছিল। সে এক সোনার দিন গেছে! প্রতিদিন গোছা গোছা চিঠি, মানি অর্ডার, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, গুরুত্ব বুঝে আর্জেন্ট ডেলিভারি, বিনোদের নাওয়াখাওয়ার সময় থকত না। তবু আনন্দ ছিল। দেশ-বিদেশের আত্মীয় স্বজনের সুখ-দঃখের ডালি ভরা কত কথাই না সে দোরে দোরে পৌঁছে দিয়েছে! আশপাশের দশটা গ্রামের মানুষ তাকে সমীহ করত, ভালবাসত। সেও কখনও তাদের আমোদে হেসেছে, আবার কখনও অন্যের দুঃসংবাদে চোখের জল আটকাতে পারেনি।
সেই নবীন বয়েসে সকলকেই মনে হত নিজের লোক, যেন নিজের পরিবারেরই একজন। শুধু তো চিঠি বিলি না, কত লোকের চিঠি যে পড়ে দিতে হত, তার লেখাজোখা নেই। লিখেও দিতে হত অনেকের চিঠি। কত খাতির ছিল তার! 
অথচ সব হারিয়ে আজ সে নিঃস্ব। আর এর মূলে ভক্কাবাবুর ছাদের ঐ টাওয়ারটা। ওটাই তার সমস্ত খাতির, সম্ভ্রম আর সুখ কেড়ে নিয়েছে।
বাজারে মোবাইল ফোন আসার পর থেকেই চিঠিপত্তর আসা কমতে শুরু করেছিল। এখন তো তা একেবারে বন্ধ। ধীরে ধীরে এই মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট যেন গোটা পত্র সভ্যতাকে গিলে ফেলল।
‘পত্র সভ্যতা’, কথাটা মনে হতেই হাসি পেয়ে গেল বিনোদের। তার বাল্যবন্ধু দীননাথ অনেক ভেবেচিন্তে এই নামটা বের করেছে। পাছে কথাটা চুরি হয়ে যায়, তাই সে কাউকে বলতে বারণ করেছে। প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার দীননাথের একটু লেখালিখির শখ ছিল। এ বিষয়ে দু’চার কথা লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। 
অবশ্য এখন যা অবস্থা, লিখে উঠতে পারবে কিনা কে জানে! বছর দুয়েক হল, রিটায়ার করে এখন কাঠ বেকার। গত বছর ওর বৌ মরে গেছে। ছেলের বৌ বাড়ি থাকলেই চাকরের মতো খাটায়, কারণে অকারণে দুচ্ছাই করে। বাধ্য হয়ে সে সকাল-সন্ধ্যে শ্যামসুন্দর মন্দিরে পড়ে থাকে, খোল করতাল বাজায়, নামগান করে। অথচ এই দীননাথ একসময়ে ঘোর নাস্তিক ছিল। ঠাকুর-দেবতা, পুজো আচ্চার কথা উঠলেই নাক সিঁটকোত।
চোখের কথা উঠতে সেদিন দীননাথ বলেছিল, এ হল প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি তোমাকে যা যা দিয়ে জীবন যুদ্ধে পাঠিয়েছিল, লড়াই যত শেষ হয়ে আসবে, ততই সে এক এক করে সব কেড়ে নেবে। দাঁত নেবে, চুল নেবে, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, সবই একে একে নিয়ে নেবে। 
তারপর ওঁর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে করুন হেসে বলেছিল, বুঝলে বিনোদ, সবই কিন্তু আমাদের ভালোর জন্যে। না নিলেই বরং মানুষের দুঃখ বাড়ে। এই আমাকে দেখছ না, আমার চোখ, কান, সবই ঠিক আছে, শরীরও সম্পূর্ণ সুস্থ। অথচ আজ মনে হয়, যা দেখতে হচ্ছে, শুনতে হচ্ছে, এর চাইতে অন্ধ-বধির হওয়া বুঝি ভালো ছিল। ঠাকুর-দেবতা আছে কি নেই, আমি জানিনে। থাকলেও সে ব্যাটা সকাল-বিকেল পিঁপড়ে ধরা বাতাসার লোভে খোল-করতাল সহ হেঁড়ে গলার কেত্তন সহ্য করে ঐ মন্দিরে থানা গেড়ে বসে আছে কিনা, তাও জানিনে। অথচ আমি ভক্ত সাজার ভান করে নিত্যি সেখানে বসে থাকি কেন জান? আসলে আমি পালাতে চাই! বুড়ো বয়েসে দেখা-শোনার অনেক কষ্ট।
দীননাথ যাই বলুক, বিনোদবিহারীর মনে হল, ছানিটা কাটিয়ে নিলেই বেশ হত। অন্তত টাওয়ারের মাথায় চিল একটা না দুটো, তা দেখবার জন্যে বার বার পকেট থেকে ঘেমো রুমাল বের করে চশমার কাচ মুছতে হত না।
টেবিলচেয়ার মোছা হয়ে গেলে সে বারান্দায় গিয়ে ফের একবার ঐ ঢাকটার দিকে চাইল। কিছুক্ষণ আগে সকালের রোদটা সরাসরি চোখে এসে পড়ছিল বলে ভালো দেখা যাচ্ছিল না। এখন পুবের সুয্যিটা তরতরিয়ে আরেকটু ওপরে উঠে গেছে বলে টাওয়ার আর ঢাকটা আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। 
আগে তাহলে ঠিকই দেখেছিল। জোড়া চিল। বিনোদ বিড় বিড় করে বলতে লাগল, শুনেছি তোদের ঠোঁটে নাকি খুব ধার। ঠুকরে ঐ শয়তানের ঢাকটারে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দে দিকিন বাপ! দু’জনায় যদি না পারিস, আরও দু-চারজনারে ডেকে আন। কাক,শকুন, যা-ই হোক, সক্কলে মিলে ঢাকটারে পাকা তালের মতো ঢপ করে খসিয়ে দে দিকিন, আমি তোদের জ্যান্ত ইঁদুর খাওয়াব, মুরগির ছা দেব, কথা দিচ্ছি।
নিতাই মুহুরী লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে বিনোদকে দেখছিল। তাকে আপনমনে বিড় বিড় করতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কাকা, কার সঙ্গে কথা বলছ?
বিনোদ তাকিয়ে দেখল, নিতাইয়ের চুলেও পাক ধরেছে, চেহারায় বেশ ভারিক্কী ভাব। পোশাক আশাকে পয়সার জেল্লা। 
হেসে বলল, কই, কারুর সঙ্গে কিছু বলছি নে তো। একেনে দাঁড়িয়ে এট্টু রোদ পোয়াচ্ছি। বুড়ো হয়েছি তো, শীত যেন হাড়ের মধ্যে ঢুকে বসে আছে, চাদর-সোয়েটার মানছে না।
নিতাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বাবা পশুপতির কথা মনে পড়ে গেল। বয়েসে বিনোদের চাইতে একটু বড়ই হবে, খুব শৌখিন মানুষ ছিল সে। চোঙা প্যান্ট, লম্বা চুল, চকরাবকরা জামা, হাতে ঘড়ি, সব সময় ফুল বাবুটি সেজে ঘুরে বেড়াত।
বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে সে চাকরি করতে গিয়েছিল বিহারের হাজারিবাগের ওদিকে। নিতাই তখন দুধের শিশু। প্রথম প্রথম ন’মাসে ছ’মাসে বাড়ি আসত। বছর দু’য়েক পরে তাও বন্ধ হয়ে গেল। লোকে বলাবলি করত, পশুপতি নাকি সেখানে একটা দেহাতি মেয়েকে বিয়ে করেছে।
তবে বৌ-ছেলের ওপর যতদিন টান ছিল, হাজারিবাগ থেকে মাঝে মাঝে ওর মায়ের নামে মানি অর্ডার পাঠাত।
সেটা ডেলিভারি করতে গেলে ওর মা জিজ্ঞেস করত, মানুষটা কেমন আছে, কবে আসবে, লিখেছে কিছু? আমার কথা, ছেলেটার কথা, কিচ্ছু লেখেনি?
তারপর হাউমাউ করে এমন মড়া কান্না জুড়ে দিত যে, দেখে ভারী কষ্ট হত বিনোদের।
পরের দিকে তাই মানি অর্ডার এলে ডেলিভারির আগে ফর্মের ছোট্ট জায়গায় বিনোদ নিতাইয়ের বাবার হয়ে বানিয়ে বানিয়ে চিঠি লিখত। তারপর ওর মাকে পড়ে শোনাত, ভালো থাকার কথা, ভালবাসার কথা। শুনে সে যে কি লাজুক তৃপ্তি ফুটে উঠত বৌটার মুখে, ভাবলে আজও চোখে জল আসে বিনোদের।
একসময়ে সেই মানি অর্ডার আসাও বন্ধ হয়ে গেল। নিতাইয়ের মা মাঝে মাঝে বিষণ্ণ মুখে পোস্ট অফিসে খোঁজ নিতে আসত, তারপর হতাশ হয়ে ক্লান্ত মন্থর পায়ে ফিরে যেত। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে এক সময়ে ওর মায়ের মাথার গোলমাল দেখা দিল। ঝড় তুফান যাই হোক না কেন, সকাল হলেই সে পোস্ট অফিসের সামনে এসে হাজির হত। বিনোদকে দেখতে পেলে হাতের কাছে যা পেত, তাই নিয়ে তেড়ে যেত। জনে জনে বলে বেড়াত, মানি অর্ডার ঠিকই আসে, নির্ঘাৎ ঐ বিনোদ হারামজাদা সব টাকা গাপ করে! 
পরের দিকে পাগলামি এত বাড়ল যে, জামা-কাপড়ের ঠিক থাকত না, রাস্তাঘাটে যাকে দেখত, ঢিল ছুঁড়ে মারত, গায়ে থুতু দিত। শেষে গাঁয়ের কয়েকজন মিলে তাকে রাঁচির পাগলা গারদে রেখে এসেছিল। নিতাই বড়ো হয়েছে ওর ঠাকুর্দার কাছে।
কয়েক বছর যাওয়ার পর রাঁচি থেকে চিঠি আসতে লাগল, নিতাইয়ের মা সুস্থ হয়ে গেছেন, তাঁকে যেন পরিবারের লোকরা বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। 
নিতাই ততদিনে সাবালক হয়েছে, রোজগারপাতি করে, বিয়েও করেছে। একদিন সেই চিঠি ডেলিভারি করতে গিয়ে সে কী বিপদ! নিতাইয়ের বৌ রাঁচির চিঠি দেখে বটি নিয়ে তেড়ে এল।  শাসিয়ে বলল, ফের যদি তুমি ঐ চিঠি দিতে আসো, তাহলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে! একটা পাগলি বুড়িকে আমাদের ঘাড়ে গছাবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছ কেন? অতই যদি দরদ, নিজের বাড়িতে নিয়ে তোলো না!
বিনোদ নিরীহ মুখে বলেছিল, চিঠি পাঠাচ্ছে সরকার, আমার কাজ বাড়ি বাড়ি তা পৌঁছে দেওয়া। এর মধ্যে আমার কী করার আছে?
নিতাইয়ের বৌ তেরিয়া হয়ে বলেছিল, করার অনেক কিছুই আছে! চিঠি এলে তা পুড়িয়ে ফেলবে, না হয় ছিঁড়ে ফেলবে। খবরদার, ওই চিঠি এনে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ বাঁধাবে না।
বছর তিনেক হল, নিতাইয়ের মা মারা গেছে। রাঁচির পাগলা গারদেই। সেই চিঠিও বিনোদই ডেলিভারি করেছিল। মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে নিতাইয়ের চোখেমুখে সেদিন কষ্টের লেশমাত্র ছিল না। বরং মনে হয়েছিল, ওর চোখেমুখে যেন ভারমুক্তির প্রসন্নতা।
খুব ঘটা করে মায়ের শ্রাদ্ধ করেছিল নিতাই। গ্রামের লোকজন তো ছিলই, অন্তত শ’দেড়েক ছাপানো চিঠি খামে ভরে পোস্ট করেছিল দূরের আত্মীয়দের জন্যে।
নিতাই কিছুক্ষণ বিনোদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ, কাকা?
বিনোদ উদাস দৃষ্টিতে আকাশ দেখতে দেখতে বিড় বিড় করে বলল, চিঠি দেখিরে নিতাই। আকাশে কত চিঠি ভেসে বেড়ায়, হাজারিবাগের চিঠি, রাঁচির চিঠি!
নিতাই ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে হঠাৎ বলল, আচ্ছা নিতাই, তোর মা’র কথা মনে আছে? অফিস খোলার আগে তোর হাত ধরে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকত আর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছত, মনে পড়ে?
নিতাই রেগে গিয়ে বলল, আমার পোঁদে লাগা ছাড়া তুমি আর কাজ পাও না, তাই না? শালা মিটমিটে বুড়ো, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তবু ইল্লোত গেল না! 


দুই

আজ কাউন্টারে লম্বা লাইন। পিএ ম্যাডাম আসেননি বলে একটা কাউন্টার থেকেই সব সামলাতে হচ্ছে। দিন পনেরো হল, পুরনো মাস্টার বাবুর জায়গায় নতুন পোস্ট মাস্টার এসেছেন। তিনি প্রথম দিনই বিনোদকে ফতোয়া দিয়েছেন, আউটডোর ডিউটি যখন থাকবে না, তুমি অফিসের কাজ করবে। পুরো বেতন নেবে, আর বিলির চিঠি নেই বলে হাওয়া খেয়ে বেড়াবে, সেটা হচ্ছে না। ভেবো না, পিয়ন হয়েছ বলে সরকার তোমাকে মাগনা পুষবে!
সেই থেকে বিনোদকে অফিসের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবই করতে হচ্ছে।
লাইনে যাঁরা আছেন, তাঁদের কেউ পাশবুক আপডেট করাবেন, কেউ বা সেভিংস সার্টিফিকেট ভাঙাবেন, মাসের মাঝামাঝি হলেও দু’একজন এমআইএস-এর টাকার জন্যে লাইন দিয়েছে। নামেই পোস্ট অফিস, আসলে এটা এখন পুরোদস্তুর ব্যাংক হয়ে গেছে। 
আজকাল খাম, পোস্ট কার্ড কিংবা ইনল্যান্ড লেটারের খদ্দের নেই। নিয়ম রক্ষার জন্যে টেবিলের এক কোণে সাজিয়ে রাখা, ওপরে ধুলোর মিহি আস্তরণ। মানুষের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, আঙুলের আলতো চাপে পৃথিবীর এক প্রান্তের কথা নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। ভিডিও কলে একজন আরেকজনের সঙ্গে হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও মুখোমুখি কথা বলছে। কে আর কষ্ট করে চিঠি লিখতে যাবে! এখন চিঠিপত্র যা আসে, সবই হয় কোম্পানির কাগজ, নয়তো ইন্সিয়োরেন্সের সার্টিফিকেট বা কম্পিটিটিভ পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড। আগে বছরে দু’একটা চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসত, এখন তাও আসে না। পোস্ট অফিসে তাই চিঠিপত্রের ব্যাপারটা নিতান্তই গৌণ হয়ে গেছে।  
বেশ কিছুক্ষণ মাস্টারবাবুর হাতে হাতে সব কিছু যুগিয়ে দিতে দিতে হাঁফ ধরে গিয়েছিল বিনোদের। টাওয়ারের ওপর চিল বসেছে কিনা দেখবার জন্যে প্রাণটা আঁকুপাঁকু করছিল। বাইরে বেরবার জন্যে বলল, স্যার, আপনার জন্যে একটু চা নিয়ে আসি।
হালদারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়ারের দিকে চাইতে চাইতে বিনোদ চায়ের কথা ভুলে গেল। ফের যৌবনের দিনগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল। 
নিমু মোড়লের মেয়ে বিধুমুখী ছিল অপূর্ব সুন্দরী। তাকে দেখলেই বিনোদের বুকের রক্ত চলকে উঠত। চিঠি বিলির ছলে প্রতিদিন সকালবিকেল সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে কতবার যে সে পাক মারত! বিধু জানালায় দাঁড়িয়ে লাজুক মুখে মিটি মিটি হাসত।
বিনোদ মনে মনে বিধুর জন্যে চিঠির পর চিঠি লিখত। প্রতিদিনই ভাবত, কাগজের পিঠে কলমের আঁচড় কেটে একটা চিঠি অন্তত বিধুকে দেবে। কিন্তু ওই চিন্তাই সার, সাহসে কুলিয়ে ওঠার আগেই হঠাৎ একদিন শুনল, বিধুমুখীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। নিমু মোড়ল কয়েকটা বিয়ের কার্ড বুক পোস্ট করতে এসেছিল, মাস্টারবাবুকে বলল, জামাইয়ের বাড়ি নবদ্বীপে। কলকাতার এক সওদাগরি অফিসে চাকরি করে, বেতন মন্দ না।
বিনোদ প্রথমে ভেবেছিল আত্মহত্যা করবে। পরে দেশান্তরী হওয়ার কথাও মাথায় এসেছিল। কিন্তু শেষমেশ কিছুই করা হয়নি। কপালে তেলকালির স্ট্যাম্পের টিপ পরা নিত্যদিনের গোছা গোছা সুখ দুঃখের খতিয়ানই তাকে আটকে দিয়েছিল।
বিয়ের পর বিধুর বর সম্বন্ধে সবাই বলাবলি করতে লাগল, যেন স্বয়ং কন্দর্পদেব স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। যেমন সুঠাম শরীর, তেমনি গায়ের রঙ। নাক, চোখ, মুখ, সব যেন কুমোরটুলি থেকে অর্ডার দিয়ে বানানো। দু’জনকে মানিয়েছে চমৎকার, ঠিক যেন হরগৌরী! 
বছর খানেক বাদে জামাই এসে বিধুমুখীকে বাপের বাড়িতে রেখে গেল। তার নাকি খুব কাজের চাপ, ফি-হপ্তায় বাড়ি ফিরতে পারে না। ওদিকে শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে বিধুর ঠিকমতো বনিবনাও হচ্ছে না, অতএব—। অবশ্য কলকাতায় বাসা ঠিক করে বিধুকে নিয়ে যাবে বলে গিয়েছিল।
প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে চিঠি আসত। বাহারি খামে গোটা গোটা করে বিধুমুখীর নাম লেখা। বিনোদ সে চিঠি ওর হাতে দেওয়ার সময় দেখত, বিধুর দু’চোখে যেন খুশি উপচে পড়ছে। ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে চিঠিখানা নিয়ে দুদ্দাড় পালিয়ে গিয়ে ঘরে খিল দিত।
বিধুর সেই সলাজ খুশিয়াল চেহারাটা বিনোদের বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘা মারত। 
মাস তিনেক বাদে সেই ভয়ঙ্কর টেলিগ্রামটা এলো। বিধুমুখীর বর নবদ্বীপ থেকে ফেরার সময় রেলে কাটা পড়ে মারা গেছে। সেদিন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়েছিল বিনোদের। নিমু মোড়লের বাড়িতে টেলিগ্রামখানা ডেলিভারি দিতে যাওয়ার সময় সে মনেপ্রাণে চেয়েছিল, যেন বিধুমুখীর সামনে পড়তে না হয়।
কিন্তু সেদিন বিনোদের সে চাওয়া পূরণ হয়নি। ওর সাইকেলের ঘন্টি শুনে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এসেছিল বিধু। 
আজও চোখ বন্ধ করলে বিধুর সেদিনকার আছাড়িবিছাড়ি কান্নার দৃশ্যটা যেন চোখের সামনে ভাসে। তার সেই বুকফাটা আর্তনাদ এই পড়ন্ত সাঁঝবেলাতেও বিনোদের বুকে যেন শেলের মতো বেঁধে।
বিনোদকে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মোবাইলের টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অফিসের নতুন ইডি সুমন্ত বলল, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রোদ পোয়াচ্ছেন? ওদিকে মাস্টারবাবু তো রেগে আগুন হয়ে উঠেছেন। আমাকে খোঁজ করতে পাঠালেন। শিগগির চলুন।
অফিসে ঢুকতে ঢুকতে বিনোদ দেখল, মাস্টারবাবু আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসছেন।  
কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে দক্ষিণপাড়ার অমূল্য পাইকও সমানে তড়পাচ্ছে, মুখ সামলে কথা বলবেন। মনে রাখবেন, আপনি একজন পাব্লিক সারভ্যান্ট। স্টাফ কম, লিঙ্ক ফেলিয়োর, এগুলো আপনাদের ইন্টারন্যাল প্রবলেম। কনজিউমার কেন তার জন্যে সাফার করবে? আমাদের সময়ের দাম নেই?
এতক্ষণে চায়ের কাপ হাতে বিনোদকে দেখে মাস্টারবাবুর সব রাগ গিয়ে পড়ল তার ওপর। চিৎকার করে উঠলেন, চা কি দার্জিলিংয়ে তৈরি হচ্ছিল? যত্তো সব বাতিকগ্রস্ত বুড়োহাবড়া জুটেছে অফিসে!  


তিন

কয়েকদিন হল, শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। বিনোদ বাইরে দাঁড়িয়ে রোদ পোহাতে পোহাতে টাওয়ার দেখছিল। আজ সাকুল্যে তিনখানা চিঠি, সবই কাছাকাছি ঠিকানার। সাইকেলে বড়জোর ঘন্টা খানেকের মামলা। 
দু’দিন হল, চিলগুলো আর টাওয়ারের ওপর বসছে না। বিনোদ ভাবছিল, একটা জ্যান্ত ইঁদুর ধরে টাওয়ারটার মাথায় ঝুলিয়ে দিতে পারলে বেশ হত। 
এমন সময় ভেতর থেকে পোস্ট মাস্টার হাঁক পাড়লেন, বিনোদ, তাড়াতাড়ি এসে কাউন্টারে বোসো। সারাক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে কী দেখো? 
বিনোদ ফিস ফিস করে বলল, আমার শত্তুররে দেখি।
পোস্ট মাস্টার খিঁচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে?
 বিনোদ আমতা আমতা করে বলল, কিচ্ছু বলিনি স্যার। এক্ষুণি আসছি। 
 সাব পোস্ট অফিস হলেও এখানে গ্রাহক নিতান্ত কম নয়। নতুন পোস্ট মাস্টার অয়নবাবুর বয়েস মেরেকেটে বছর পঁয়ত্রিশেক। কিন্তু পদাধিকার বলে অধস্তন সকলকে তিনি নাম ধরে ‘তুমি’ বলেন। 
বিনোদ রাগ করে না। মনে মনে ভাবে, ওপরওয়ালার আবার বয়েস কী! আগের দু’একজন মাস্টারবাবু ভদ্রতা করে যে ওকে ‘বিনোদবাবু’ এবং ‘আপনি’ বলতেন, সে তাঁদের মহানুভবতা। আদতে তো সে ডাক পিয়ন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গরু-ছাগলেরও তো বয়েস বাড়ে, তাই বলে কি কেউ তাদের ‘বাবু’ বলে, না ‘আপনি’, ‘আজ্ঞে’ করে!
একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ বসে বসে বেতন নিচ্ছে দেখে নতুন পোস্ট মাস্টারবাবু নিয়ম করেছেন, এখন থেকে বিনোদকে কাউন্টারে বসে কাস্টমার সামলাতে হবে। তালা খুলে ডাকবাক্স থেকে চিঠিপত্র বের করে সেগুলো সর্টিং এবং স্ট্যাম্পিং করে পোস্ট ব্যাগে ভরা, গালা সিল করা, ডাক এলে ব্যাগ খুলে ভেতরের কনসাইনমেন্টগুলো ইনভেন্ট্রির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, এগুলো তো আছেই, তার সঙ্গে স্ট্যাম্প, মানি অর্ডারের ফর্ম এবং পোস্টাল অর্ডার বিক্রি করে হিসেব রাখা, অন্যান্য ফাই ফরমাস খাটা, বিনোদ যেন আর পেরে ওঠে না। কিন্তু মাস্টারবাবুও নাছোড়। 
কাউন্টারে বেশিক্ষণ বসে থাকলে প্রাণটা উথালপাথাল করে, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। প্রতিদিন সকালে তাই অফিসে আসবার সময় প্রার্থনা করে, হে ঠাকুর, অন্তত একখানা আর্জেন্ট চিঠি অথবা মানি অর্ডার যেন আসে!
পরাণের মা দেখতে পেলেই হাঁক দেয়, অ বিনোদ, কিছু খবর এল?
বছর কয়েক হল, তার ছেলেটা নিরুদ্দেশ। বুড়ি সারাক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, এই বুঝি খবর এল।
চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে হা-ক্লান্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পথেঘাটে দেখা হলে তারা শুকনো মুখে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, দাদু, কিছু এল? 
ঘাড় নেড়ে ‘না’ বললেই ওদের মুখের আলোটা দপ করে নিভে যায়। বিনোদ ক্লান্ত পায়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়। 
প্রৌঢ়া বিধুমুখী ভাইদের সংসারে এখন বাড়তি আবর্জনা। সেই সোনার রূপ আর নেই। কেমন জবুথবু হয়ে বসে শীতের সকালে ধবধবে সাদা কাপড়ে বড় যত্ন করে বড়ি দেয়। বিনোদের সঙ্গে চোখাচোখি হলে ক্লান্ত চোখে হাসে। 
বিনোদের বুকের মধ্যেটা যেন মুচড়ে ওঠে। নিমু মোড়ল মেয়ের নামে একটা এমআইএস করে গিয়েছিল। বিধু মাসে একবার পোস্ট অফিসে টাকা তুলতে আসে। কথা হয় না, শুধু একবার আলতো চোখাচোখির পর চোখ নামিয়ে বিধু চলে যায়। তবু সে সারা মাস বিধুর জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।
চোখে কম দেখার জন্যে পদে পদে কাজে ভুল হয়। কখনও দশ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকার পোস্টাল অর্ডার ইসু করে ফেলে, আবার কখনও ছেঁড়াফাটা বাতিল নোট নিয়ে নেয়। দিনের শেষে কোনও দিনই ঠিকঠাক হিসেব মেলাতে পারে না। ফলে মাস্টারবাবুর গালাগালি নিত্য সঙ্গী।
বিনোদের তাই সব রাগ গিয়ে পড়ে ওই মোবাইল টাওয়ারটার উপর। সে খুব ভাল করে ভেবে দেখেছে, এই পড়ন্ত বেলায় তাকে যা কিছু অবজ্ঞা, অসম্মান এবং অনাদর সইতে হচ্ছে, তার জন্যে ঐ টাওয়ারটাই দায়ী। ওই লোহার দানবটা তার জীবনের সমস্ত আনন্দ এবং সম্মান কেড়ে নিয়ে একেবারে নিঃস্ব করে ছেড়েছে।
মাস্টারবাবুর অত্যাচারে মাঝে মাঝে স্বেচ্ছাবসরের কথাও ভাবে আজকাল। কিন্তু পরক্ষণেই বুকের মধ্যেটা কেমন হাহাকার করে ওঠে। পোস্ট অফিস ছেড়ে সে বাঁচবে বা কী করে! তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে যে পোস্ট অফিস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ভালমন্দ কত স্মৃতি, কত মানুষের সুখ দুঃখের সঙ্গে একাত্মতা, পুরো জীবনটাই যে পোস্ট অফিসময়!
হঠাৎ একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল বিনোদের। সেবার মা’কে নিয়ে পুরী গিয়েছিল। কিন্তু পুরী স্টেশনে পা দেওয়ার পর থেকে সে যেখানেই যায়, সেখানেই পোস্ট অফিসের খোঁজ করে। রাস্তার পাশে কোথাও পোস্ট বক্স দেখতে পেলেই দাঁড়িয়ে সেটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, মা, দেখেছ, এখানেও আমাদের পোস্ট বক্স।
 মা হেসে বলেছিল, তুই বরং এক কাজ কর। একজন পাণ্ডা যোগাড় করে জগন্নাথ দেব মনে করে একটা পোস্ট বক্সে পুজো দে। ওতেই তোর পুণ্যি হবে!
মৃত্যুর আগে মা বিনোদের বিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সে রাজি হয়নি। 
সেদিন মাস পয়লা, কাউন্টারে লম্বা লাইন। মাস্টারবাবু বিনোদকে টাকা গুনতে দিয়েছিলেন। দিনের শেষে হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখা গেল, দশ হাজার টাকা ওভার পেমেন্ট হয়ে গেছে। 
পোস্ট মাস্টার বিনোদকে এই মারেন তো সেই মারেন। প্রথমে বললেন, টাকা কোথায় সরিয়েছ, বের করো।
বিনোদের চোখ ফেটে জল এল। তবুও মাস্টারমশায় নিজের ধারণায় অটল। শেষে ওর অ্যাকাউন্ট থেকে জোর করে শুধুমাত্র টাকাটা উসুল করেই ক্ষান্ত হলেন না, সুপারিন্টেনডেন্টের কাছে এক আর্জেন্ট মেমোতে লিখলেন, ডাক পিয়ন বিনোদকে যেন ইমিডিয়েটলি ইনক্যাপাসিটেট করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। শারীরিক কারণে সে অফিসের কাজের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
বিনোদ নিজের হাতে মেমোখানা পোস্ট ব্যাগে ভরে গালা সিল করে যখন বাড়ি ফিরল, তখন ওর চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল।

 

চার

মাঝরাতে দুমদাম শব্দে ভক্কাবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। কিছুক্ষণ কান খাড়া করে থাকার পর তাঁর মনে হল, শব্দটা যেন ছাদ থেকে আসছে। কেউ বুঝি চিলেকোঠার লোহার গেটটা ভাঙার চেষ্টা করছে।
প্রচণ্ড ভয় পেলেন তিনি। ভাবলেন, নির্ঘাৎ ডাকাত পড়েছে। প্রথমে বাড়ির সবাইকে ডেকে তুললেন, তারপর চুপি চুপি সদর দরজা খুলে রাস্তায় নেমে ‘ডাকাত’ ‘ডাকাত’ বলে চেঁচাতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে আশপাশের বাড়ি থেকে লাঠিসোটা নিয়ে সবাই বেরিয়ে এল। 
কিন্তু ছাদে উঠতে কারোরই সাহস হল না। আজকাল ডাকাতদের কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকে। বলা তো যায় না, একখানা বোমা ছুঁড়লেই কম্মো কাবার।
শিবু গাইন বরাবরই বিচক্ষণ মানুষ। তিনি বুদ্ধি করে বাজারের পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন করলেন।
ঠিক হল, পুলিশ না আসা পর্যন্ত পুরো বাড়িটা ঘিরে রাখা হবে, ভেতরে কেউ ঢুকে থাকলে যাতে কিছুতেই পালাতে না পারে!
কাছেই ফাঁড়ি, মিনিট দশেকের মধ্যেই পুলিশ চলে এল। তাঁরা প্রথমে কিছুক্ষণ হ্যান্ড মাইকে ডাকাতদের সারেন্ডার করার আবেদন করলেন। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় বন্দুক বাগিয়ে চুপিসারে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন। 
সকলের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। ছাদে যেই থাক না কেন, এত লোকের কথাবার্তা, টর্চের আলো, পুলিশের হুঁশিয়ারি, এত কিছু উপেক্ষা করে হাতুড়ি ঠুকে যাচ্ছে, কার এমন সাহস!
অতি সন্তর্পণে চিলেকোঠার দরজা খুলে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলতে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। 
দেখা গেল, পোস্ট অফিসের পিয়ন বিনোদবিহারী একটা হাতুড়ি দিয়ে উন্মত্তের মতো টেলিফোন টাওয়ারটাতে আঘাতের পর আঘাত করতে করতে সমানে বলে চলেছে, তুই আমার আনন্দ খেয়েছিস, সম্ভ্রম খেয়েছিস, শেষে চাকরিটাও খেলি!
প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও তার সারা শরীর থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছে, মুখের কস দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে, চোখ দুটো টকটকে লাল।
ভক্কাবাবু ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতখানা চেপে ধরে স্খলিত গলায় বললেন, শান্ত হও বিনোদ, যা গেছে, তা গেছে।
বিনোদ উদ্ভ্রান্তের মতো চারদিকে চাইতে চাইতে ফের হাতুড়ি তুলল।