রক্তঘাম ও বেলকার্ভ বিপণী

অ+ অ-

 

আমরা যখন বুঝতে পারি যে, কর্পোরেট দুনিয়ার নিজেরই একটা আলাদা সৌরজগৎ আছে; বুধ-শুক্র-পৃথিবীর মতো গ্রহ তাকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত আবর্তন করে, তখন দুপুরের প্রখর রোদে একে অপরকে আবিষ্কার করি। নিজেদেরকে গর্ভবতী নারীদের মতো অসহায় মনে হয়, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সত্ত্বেও যাদেরকে জোর করে গোল্লাছুট খেলায় অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। 

আমরা গর্ভবতী নারীর স্ফীত উদরের কথা জানতাম, কিন্তু বেলকার্ভ বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। ফলে দুপুরের ঠা ঠা রোদের মধ্যে দৌড়াতে-দৌড়াতে বিষয়টি নিয়ে যখন জানতে শুরু করি, তখন বিবিধ জিজ্ঞাসার উত্তরে বেলকার্ভ বিষয়টি ধীরে ধীরে আমাদের কাছে নারীর স্ফীত উদরের মতোই মনে হতে থাকে।

তারপর আমরা দৌড়াই আর গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। গ্রীষ্ম অতিক্রান্ত হয়। বর্ষা এসেও বিদায় নেয়; এমনকি বর্ষা মৌসুম শেষে শীতের তীব্র ঠান্ডায়ও দৌড়ানোর পালা থামে না।

এই দৌড় ও অপেক্ষার প্রহর ফুরায় না। আদতে প্রতিযোগিতা ও প্রতীক্ষার প্রহরগুলো আমরা উপভোগ করতে থাকি। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে আগের মতোই দৌড়াই আর বেলকার্ভে নিজেদের অবস্থান কোন জায়গায় এসে থেমেছে, তা জানার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠি।

অথচ এরই মধ্যে সরকারি হর্তাকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারিদের বেতন-ভাতা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার ঘোষণা আসে। তারপর নতুন গ্রীষ্মে তাদের চেহারার জেল্লা বেড়ে আগের বছরের দ্বিগুণ হয়। তাদের চিকিচিক করতে থাকা চেহারা যেন আমাদের দৌড়ানিকে টিটকারি করতে থাকে।

এইটা কি মগের মুল্লুক ভাই?

ঠা ঠা রোদ কাটিয়ে আমরা সুদিনের জন্য অপেক্ষা করি। অফিসের জানালাগুলা খুলে দিই। আমাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোর ভেতর সকালের আলো-হাওয়া ঢুকতে শুরু করে। জানালার বাইরে চোখ মেলতেই দেখতে পাই একটা-দুইটা নয়, শত শত কিংবা তারও বেশি সংখ্যক শকুন ঢাকার আকাশে চক্কর দিচ্ছে।

সরকারি হর্তাকর্তাদের চেহরার জেল্লা না হয় বেড়েছে, কিন্তু তাদের অফিসের কর্মঘন্টা তো এখনও শুরুই হওয়ার কথা নয়, অথচ এরই মধ্যে শকুনের এমন দৌড়ঝাঁপ আমাদের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জমা করে। মনে মনে আমরা ভাবতে থাকি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া টার্গেট এচিভ করা কোনো ব্যাপার নয়, এমনকি রাতের ঘুম হারাম করার মতো কোনো বিষয়ও নয়। সামান্য শকুনের ঝাঁক পারে, পিঁপড়ারা পারে, এমনিক গুলিস্তানের হকাররা পর্যন্ত পারে। অথচ আমরা কেন পারব না?

এরই মধ্যে অফিসের পিওন মোশাররফ এসে বলে, স্যার, রোববার ছুটি লাগবে। মেয়ের খুব জ্বর।

মানুষের শরীরে জ্বর আসতেই পারে। কিন্তু সন্তানের শরীরে জ্বর সামান্য কোনো ব্যাপার নয়। জ্বরকে উছিলা বানিয়ে দেশের বাড়ি যাওয়ার বাহানা করলেও মোশাররফকে থামানোর সুযোগ নেই।

কী হইছে? আজ যে বৃহস্পতিবার, সে-কথা মনে পড়ে। বৃহস্পতিবারেই কি জ্বর আসতে হবে? কয়দিন ছুটি কাটাইবা?

পিওনকে ব্যথিত ও অহসহায় দেখায়। যদিও তার এই চেহারার সাথে আমাদের বহুদিনের পরিচয়।

আমার মেয়েটা তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগতেছে। আপনি স্যারকে না বললে ছুটি মঞ্জুর হবে না।

ডেঙ্গু-টেস্ট করাইতে বলছ? আমাদের শহরের ডেঙ্গির আকস্মিক প্রাদুর্ভাব এতটাই বেড়েছে যে, জ্বরকে এখন কোনোভাবে কেউ সাধারণ কোনো উপসর্গ ভাবতে পারে না। টিভিতে খবর-টবর দেখো না? সারাদেশে ডেঙ্গুর অবস্থা খুব খারাপ।

যদিও আমরা ধারণা করতে পারি এখনও তার সন্তানকে ডাক্তার দেখানো হয়নি। সাধারণ জ্বরের জন্য ডাক্তার পর্যন্ত তার শিশুসন্তানকে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ হয়তো নেই।

কিন্তু প্রত্যুত্তরে মোশাররফ বউয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি দিতে শুরু করে, মেয়েমানুষের মাথায় কি আর এতকিছু থাকে স্যার? আমি দেশে গেলে সদরে ডাক্তার দেখাব।

এই যে আমরা, যারা প্রতিদিন একসাথে দৌড়াই, একসাথে বেলকার্ভে নিজেদের অবস্থান জানার জন্য অপেক্ষা করি, সবাই মিলেই একটা আমি

আমাদের হয়ে আমি যেমন পিওন মোশাররফের ছুটির একটা বিহিত করার চেষ্টা করছি, অন্য একজন অন্য কোনো পিওন বা অফিসারের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব নিচ্ছেন।

বেলকার্ভে আমাদের একার দৌড়ে প্রতিষ্ঠানের জয়ী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি দলগত বিজয়ের ব্যাপার। দলগত বিজয় অর্জনের পর আমাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কয়েকজনকে স্ফীত উদরের চূড়া স্পর্শ করার সুযোগ দেওয়া হবে। সবারই টপার হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সবাই টপার হতে পারবেন না। 

বিষয়টি জটিল ও স্ট্রেসফুল।

ফলে আমাদের মাথায় সবসময় ঢাকার আকাশে উড়তে থাকা ক্ষুধার্ত শুকুনের অবয়ব খেলা করতে থাকে। পিওনকে ছুটি মঞ্জুর করার জন্য খুব বেশি সময় অপচয় করলে দৌড়েও পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। তাই এতদ্বিষয়ে অযথা সময়ক্ষেপন করে আমাদের কোনো লাভ নেই।

দেখা যায় মানুষের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা আমাদের পক্ষে দিন-দিন কঠিন হয়ে পড়ে। উঠতে-বসতে সবাইকে খুশি করার যে বিদ্যা, তা আমরা রপ্ত করতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাই।

এসব কারণে আমরা মাঝেমধ্যে মুক্ত আকাশ দেখার জন্য হাঁসফাঁস করি। আমাদের প্রত্যেকের টেবিলের পাশে আলাদা-আলাদা জানালা না থাকলেও যে ওয়ার্কস্টেশনে আমরা কাজ করি, সেখানে একাধিক জানালা আছে। কিন্তু দিনের বেলায়ও সেগুলো কেবল বন্ধই থাকে না, পর্দার দিয়ে ঢাকাও থাকে।

ফলে জানালাগুলো আমারা মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে খুলে দিই। তারপর অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করতে জানালা দিয়ে দূরের একফালি আকাশ দেখার  চেষ্টা করি।

সিটি কর্পেরেশনের ময়লার ভাগাড়ের ওপর এক খণ্ড আকাশে প্রতিদিন ওড়াউড়ি করতে থাকা শকুনগুলো কি তবে আমাদের মতোই দৌড় প্রতিযোগিতায় আছে?

জিসান, শকুন দেখে আর কত সময় অপচয় করব আমরা? নতুন কিছু চাই। নতুন কিছু করে দেখাতে হবে। হেড অব মার্কেটং আমাদের টিম নিয়ে আশাবাদী।

সহকর্মী, ইনফ্যাক্ট আমাদের ইউনিট হেড রফিক ভাই এসে একটু চিলমুডে তাগাদা দিয়ে গেলেন।

অর্থাৎ আরও দ্রুত দৌড়াতে হবে। লক্ষ্য প্রতিবারের মতো এবারও বেলকার্ভের চূড়ায় আরোহণ করা; টপার হওয়া। 

আমরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকি।

প্রতিনিয়ত ভাবতে থাকি এই বুঝি একটা সহজ সুযোগ দুয়ারে এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

আমাদেরকে শেখানো হয়েছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে হবে লাভের ফসল ঘরে তোলার জন্য সবসময় ওত পেতে থাকা; তারপর মরিয়া হয়ে লক্ষকে তাড়া করা। 

তেমনই একটা সুযোগ আমাদের জন্য দুয়ারে এসে হাজির হয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াই শুধু নয়, দ্রব্যমূল্যের ঘোড়াটাও টগবগিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। আমাদের মানবিক হৃদয়ের লাগাম খানিকটা টেনে ধরে বাজার থেকে অপ্রত্যাশিত সুবিধাগুলো বগলদাবা করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই আপাতত।

হেড অব ট্রেজারি নাকি সেদিন বেফাঁস একটা মন্তব্য করে আবার হজম করে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ডলারের বিপরীতে টাকার মানের স্মরণকালের বড় পতনে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার বেচাকেনা করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেজারি প্রধানরা জরিমানার মুখোমুখি হওয়ার পর ক্ষোভের বশে এমন অপ্রিয় কথা মুখ ফসকে মিটিংয়ে বলে ফেলেছিলেন; তাও টপ ম্যানেজমেন্টের সামনে। অর্থাৎ তার বক্তব্য ছিল লাভের গুড় সবাই খায়, কিন্তু পানি কেবল নিচের দিকে গড়ায়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে এসব কথা বসদের সামনে বলার অর্থ নিজের ঘাড়ে বন্দুকের নলটা টেনে আনা।

কোনোকিছুতে কান না দিয়ে চুপচাপ নিজেদের কাজটা করে যাওয়াই ছাপোষা পেশাজীবীদের প্রধান অস্ত্র। যেকোনো দুর্যোগে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনো সুযোগ আসলে নিজেদের হিস্যাটা আগে বুঝে পেতে কে না চায়।

পেঁয়াজের দাম, ডিমের দাম কিংবা এমনকি আলুর দাম নিয়েও কারসাজির অভিযোগ ওঠার সাথে সাথে যেভাবে মানুষের বিবেক সাড়া দেয়, এমনকি যেভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা প্রিন্টমিডিয়ায় মানুষের নৈতিক হুঙ্কার ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেভাবেই নীতি-নৈতিকতার গোপন ছায়ায় বেড়ে ওঠে লোভ ও লালসার ক্ষুরধার জিভ। 

ফলে শীতের দৌড় শেষ হলে আমরা অপেক্ষায় থাকি গ্রীষ্মের জন্য। তারপর তাপদাহ শেষে বর্ষাও বাড়ন্ত হলে পুনরায় শীত এসে উঁকি মারে আমাদের সামনে। তখন নতুন একটা বেলকার্ভের চূড়ায় কারা উঠতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

পৃথিবীর দামি মুদ্রাগুলো তখনও মানুষের ঘাড়ে গরম হাওয়া দেয়। কখনও ডলারের আয়ু শেষ হওয়ার কথা বাতাসে ভাসে। পরক্ষণে ভবিষ্যতের নতুন এক মুদ্রার উত্থানের কথা চাওর হতে থাকে।

এমনকি যুদ্ধও যে আমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেয় শুধু তা নয়, তীব্র তাপদাহ, জলোচ্ছ্বাস কিংবা গুম-খুনের নতুন মদিরা এসেও সৌভাগ্যের পরশ বুলিয়ে দেয়। আমরা অপেক্ষায় থাকি বেলকার্ভের চূড়ায় আরোহণের মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য।  

যখন বেলকার্ভের গল্প জানতাম না, তখনও আমাদের দৌড়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করত ভাগাড়ের ওপর চক্কর খেতে থাকা শকুনগুলো। এখনও আমাদের দৌড় প্রতিযোগিতার প্রত্যক্ষদর্শী হয় সেসব নিরীহ শকুন। আর বিবিধ মুদ্রার ফাঁদ পেতে যারা লাভবান হয়েছে ইতোপূর্বে, এমনকি যাদের উদর এখন ফুলেফেঁপে স্ফীত হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি, সেসব প্রতিবেশী ও তাদের আদুরে কুকুরগুলোও আমাদের গল্প জানে।

জানালা গলে এক পশলা বাতাস ঢুকে পড়ে। আগের মতোই চোখে পড়ে শত-শত উড়তে থাকা শকুন যাদের ঠোঁটে লেগে আছে ভাগাড়ের দুর্গন্ধ। তাদের পাকস্থলীতে ধীরে ধীরে হজম হয়ে যাচ্ছে সৌভাগ্যবান মানুষদের ফেলে দেওয়া ডলার ও বিবিধ বৈদেশিক মুদ্রার উচ্ছিষ্ট।

একটা বেলকার্ভ যেন একঝাঁক ঋতুবতী নারী হয়ে শকুনের গর্ভে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে। তারপর পরম আয়েশে ভাগাড়ের আকাশে উড়তে থাকে।