সহজ মানুষের কবি মাকিদ হায়দার

অ+ অ-

 

তীর্থে যাব সঙ্গে নিও এই আকুল আবেদনকবির আজ সত্য হল। অজানা পথে মানুষের যাত্রা হলেই বুঝি সমাজে কদর বাড়ে? খুঁজে ফেরেন হারিয়ে যাওয়া মানুষকে আকাশ-পাতাল। অনেকে নিজের সাথে পরিচয় ছিল বলে বড় বড় পোস্ট দিয়ে মানুষকে জানাতে চান নিজের অবস্থানের কথা। কিন্তু যে চলে গেছে তাকেই বা কতটুকু মানুষ মনে রাখে। এক অথবা দুইদিন অথবা এক সপ্তাহ। আবার আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য কাউকে নিয়ে। এমনভাবেই চলছে সমাজ-সংসারের চাকা। চলে গেলেন কবি মাকিদ হায়দার [২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-১০ জুলাই ২০২৪]। শেষ ষাট দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি। জন্মেছেন পাবনা জেলার বিখ্যাত হায়দার পরিবারে। তাঁর পরিবারের প্রত্যেকেই বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। পাঁচ দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অবদান রেখেছেন মাকিদ হায়দার। নিজস্ব ভাষায় কবিতা লেখার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখার মধ্যে রয়েছে রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা, আপন আঁধারে একদিন, রবীন্দ্রনাথ: নদীগুলা, বাংলাদেশের প্রেমের কবিতা, যে আমাকে দুঃখ দিলো সে যেনো আজ সুখে থাকে, কফিনের লোকটা, ও প্রার্থ ও প্রতিম, প্রিয় রোকানালী, মমুর সাথে সারা দুপুর ইত্যাদি। ছোটবেলা থেকেই পরিবার থেকে পেয়েছেন সাহিত্যের আবহসংস্পর্শে এসেছেন অনেক বড় বড় সাহিত্যিকের। যা তাঁকে একজন ছড়াকার বা কবি হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে। তবে তারা মনে করেন তাদের আজকের পর্যায়ে আসার পেছনে রয়েছে ছোটকাকার বিশাল ভূমিকা।

কবি মাকিদ হায়দার সত্যিকার অর্থেই একজন ভাল মানুষ ছিলেন। কবি হওয়ার জন্য জীবন-যাপনে একজন ভাল মানুষ হওয়া কত যে প্রয়োজন তা তিনি তাঁর জীবন-যাপন-আচার-ব্যবহারে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনুজদের তিনি খুব আদর করতেনঅনায়াসে তাদের সাথে মিশে যেতেন। কথা বলতেন সাবলীলতায়তাঁর মধ্যে কোন হামবড়া ভাব ছিল না। কোন অহংকারবোধ তাঁকে কোনদিন গ্রাস করতে পারেনি। ভালোবাসায় যেন তাঁর একমাত্র অস্ত্র। অনেকবার বইমেলাতে দেখা হয়েছে। যদি ভুল না করি টাঙ্গাইলের সাহিত্য অনুষ্ঠান ও জাতীয় কবিতা উৎসবে মাকিদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে। তখন তাঁর কথাবলার ধরন এবং হাসি দেখে শুধু একটা কথায় মনের মধ্যে উথালপাথাল করত এই মানুষ এমন বয়সে এসেও এতোটা সরল হয়। সরলতায় যেন তাঁর বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী শক্তি।

তিনি কবি; প্রকৃত অর্থেই তিনি সর্বজনীন কবি হয়ে উঠতে পেরেছেন। কোন ভণ্ডামী কিংবা সাহিত্যের রাজনীতি তাঁকে স্পর্শও করতে পারেনি। যে কারণে তিনি অতি সরল ও সহজ জীবন-যাপন করতে পেরেছেন। অতি সহজ-সারল্য ভাষা শৈলীতে সাজিয়ে তুলেছেন কবিতার শরীর কাঠামো। তাঁর কবিতার মধ্যে প্রবেশ করলে মনে হতে পারে অতি সারল্যের মধ্যে আপনি প্রবেশ করছেন। কিন্তু কবিতার অন্তরে সহজভাবের আদলে তিনি আমাদের ইতিহাস-সামাজিকতা-নৈতিকতা বা সমাজের অবক্ষয়ের কথা বলে গেছেন। সরল মানুষগুলো বুঝি একটু আবেগী হয়ে থাকেন। তিনিও আবেগের মধ্যে নিজের জীবনকে প্রবাহিত করতে পেয়েছেন। যে কারণে তাঁর ভিতরে সব সময় থেকেছে রোমান্টিকতা। আর তাঁর কবিতা পাঠে এই কথার সত্যতা মেলে।

যে আমাকে প্রেম শেখালো
জোৎস্না রাতে ফুলের বনে
সে যেন আজ সুখেই থাকে...

কবি মাকিদ হায়দার কবিতায় মূলত গল্প বলতে চান। তাঁর ভেতরে কবিতার মধ্য দিয়ে একটা আলাদা স্বর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এই রীতিতে কবিতা লিখেছেন এবং সেই কবিতাও পাঠকদের মনে স্থান করে নিয়েছে। কবির এই বহুবর্ণিক কবিতাই যেন সত্যিকারের কবিতা হয়ে উঠেছে। কবির মধ্যে আর একটা সারল্যবোধ কাজ করতো; বিভিন্ন জনের নামে কবিতা উৎসর্গ করতেন সামান্য পরিচিত হলেও। এই সরলতা সচারচার দেখা যায় না। পরিচিতদের কাছে বসিয়ে গল্প করতেন। একজন আড্ডাপ্রিয় মানুষ ও ছোটদের খুব  ভালোবাসতেন। তাদের কাছে টেনে নেওয়ার বিশাল ক্ষমতা মাকিদ ভাইয়ের মধ্যে ছিল। কোন রাজনৈতিক ধুলা তিনি গায়ে মেখে চলতে চাননি। তিনি লেখাকেই একমাত্র বিষয় করে চলতে চেয়েছেন। পরিবারের সবাই লেখক। কবি মাকিদ হায়দার আমরা ক-ভাই লিখি লেখায় বলেছেন—‘২০০৫ সালে কলিকাতায় দাউদ এসেছিল বার্লিন থেকে, ও কলিকাতা এলে আমরা সব ভাইবোনই ওর সঙ্গে গিয়ে দেখা করি। কোনো সরকারই ওকে অনুমতি দেয়নি, বাংলাদেশের তাঁর পৈতৃক বাড়ি দোহারপাড়ায় যেতে। আজ দীর্ঘ বছর ধরে তাঁকে থাকতে হচ্ছে প্রবাসজীবন নিয়ে। কলিকাতায়, অন্নদাশংকর রায়ের বাড়িতে প্রায় ১২ বছর, পরবর্তী সময়ে গুন্টার গ্রাসের সহায়তায় ঠাঁই পেয়েছে জার্মানির বার্লিনে। ২০০৮ সালে আমাদের হায়দার পরিবারের অগ্রজ জিয়া হায়দার পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেবার আগে ২০০৫ সালে কলিকাতায় বলেছিলেন, আমাদের ভাইদের লেখক হবার পেছনে ছোটকাকার অবদান তো রয়েছেই, তবে প্রভাব থাকে যেকোনো শিল্পী, কবি-সাহিত্যিকদের জীবনে তাদের নিকটজনদের সংস্পর্শে এলে। যদি তিনি নিজে লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক হয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রেই লেখার জগতটায় প্রবেশ করতে হয়তো বা সুবিধেই হয়। তিনি যে ভীষণ ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন সে কথা পুনর্বার আমাদের ক-ভাই-কে স্বীকার করতেই হয়। তবে সৃষ্টিশীলতা, মননশীলতা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে যেকোনো লেখকেরই প্রয়োজন হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের। যেটি স্বয়ং ঈশ্বরেরই প্রদত্ত। এই হচ্ছে আমাদের পঞ্চপাণ্ডবের কথা, কবি-নাট্যকার হবার উত্তর। এভাবেই তারা লেখক হয়ে উঠেছেন মানে লেখকের বীজ রোপিত হয়েছে তাদের ঘর থেকে।

কবি তাঁর চন্দ্রাভিলাষী নারী কবিতায় বলেছেন—‘...নীল সাগরে ভাসিয়ে দিতে/আমার অপরাধ। কবির কোন অপরাধবোধ থাকে না বা প্রেমিকার কাছেও তাঁর কোন দোষ থাকতে পারে না। প্রেমিকারা সব ক্ষমা করে দেয় এজন্যই তো কবিরা অপরাধ করতে পারেন। আজ কবি আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে যাবেন। যেখানে গেলে আর পরিচিত মানুষদের সাথে দেখা করা যায় না। কিন্তু আমরা যারা তাঁর সঙ্গ পেতে চাইহাস্যোজ্জ্বল মুখে রসের কথা শুনতে চাই, তারা আজ কবির শোকে দাঁড়িয়ে আছি গাছের মত, সবাই স্তব্ধ হয়ে নিঃস্ব বুকে একজন প্রিয় মানুষ, প্রিয় কবিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যেন বৃক্ষে পরিণত হয়েছি। কিন্তু কবি ফিরলেন রাজার মতনিজের বাড়িতে। তিনি এই সত্যতাকে নিজের কবিতায়; নিজের জীবন-বাস্তবতা, সমাজের বাস্তব চিত্রকেই যেন চিত্রায়িত করে গেছেন। কবি কোথায় থাকবেনকে তাঁর খবর নিবেন? তাই সেই জায়গাকে তো সবার কাছে পরিচিত করে যেতে হবে বা তাঁর নিজের থাকার জায়গার পরিচয় দিয়ে গেছেন—‘দোহারপাড়া গ্রামটি শহরের পূর্বদিকে, পাবনা সদর গোরস্থানের অবস্থানটাও তাই, লোকে যাকে আরিফপুর গোরস্থান বলে অবহিত করেন। আদপে এই গোরস্থানটি রাঘবপুর মৌজার ভেতরে, আর এই বিশাল গোরস্থানটির অধিকাংশ জায়গাজমি আমার বাপ-দাদাদের, তারাই গোরস্থানটিকে দান হিসেবে দিয়ে গিয়েছেন এবং একই সঙ্গে গোরস্থানের দক্ষিণ দিকের বিশাল ঈদগাহ মাঠটিও ছিল আমার বাপ-দাদাদের, সেই গোরস্থানের দক্ষিণ দিকের যে গ্রামটি সেই গ্রামটির নাম আরিফপুর। এই আরিফপুরই আজ কবির থাকার চির-আবাসস্থল। বিশাল বৃক্ষতলে কবি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকবেনতবুও আমরা যারা কবিতা পাগল কবিতা লেখি; কোন একদিন দল বেধে আড্ডার আসরের মধ্যমণি করে হাজির হয়ে যাব হে কবি। তখন কিন্তু তুমি বলতে পারবে না আজকে দেখ সবাই যেনক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে...

কবির আদি নাম আবদুল মাকিদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার রোকন। তাদের ভাইদেরও নাম অনেক বড় বড়। কিন্তু কিভাবে ছোট হলো তাঁর কথা আমরা জানতে পারি কবির আমরা ক-ভাই লিখি নামক লেখার মাধ্যমে।... আমাদের তৃতীয় বোন সেলিনা হায়দার ঝর্ণা আমার দীর্ঘ নামটি সংক্ষিপ্ত করে দিলেন। আমি হয়ে গেলাম মাকিদ হায়দার। আবু দাউদ মোহম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার খোকন হয়ে গেল দাউদ হায়দার। অনুরূপভাবে আবু জাহিদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার, তিনি হলেন জাহিদ হায়দার এবং ছয় নম্বর ভাইটির নাম দিলেন আবিদ হায়দার, সপ্তমের নাম হলো আরিফ হায়দার। কবি লেখায় আমরা দেখতে পাই তাদের পরিবারের লেখক হয়ে ওঠার এক বর্ণনা—‘১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই চলে এসেছিলাম ঢাকায়। সেই ১৪/২ মালিবাগের বাসায়। তার আগে আমাদের অগ্রজ জিয়া হায়দার এবং রশীদ হায়দার ১৯৬৪ সালে ওই বাসাতেই আমাদের মা রহিমা খাতুনসহ দাউদ, জাহিদ, ফরিদা এবং আফরোজাকে নিয়ে এসেছিলেন। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ ও গার্লস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন দাউদ, জাহিদ, ফরিদা এবং আফরোজাকে। আমি ৬৫ সালে মাধ্যমিক পাশ করে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই, আমি আর দাউদ পাল্লা দিয়ে শুরু করলাম কবিতা, গল্প, ছড়া লেখা। দাউদের লেখা ঘন ঘন ছাপা হতে শুরু করেছিল ওর স্কুলজীবন থেকেই। আমারও দৈনিক আজাদে, ইত্তেফাকের ছোটদের পাতায়। কলেজে ভর্তি হবার পরে প্রতিমাসেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গল্প-কবিতা ছাপা হতেই একদিন কবিতা নিয়ে বংশাল রোডের সংবাদ অফিসে গেলে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তখনকার দিনে দৈনিক সংবাদে তরুণদের লেখা প্রায়ই ছাপা হতো। উৎসাহিত করবার জন্য। যেমনবরিশালের মাসুদ আহমদ মাসুদ এবং আমিসহ অনেকেরই। ১৯৬৫-৬৭ সালে নিয়মিত কবিতা ছাপা হতো, এবং ওই সময়েই অধ্যাপক অজিত গুহ, শামসুজ্জামান খান, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খানএঁরা তখন ছিলেন জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তাদের সাহচার্য্য পেয়েছিলাম আমি, গল্পকার, উপন্যাসিক বুলবুল চৌধুরী, প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমানসহ আরো জনাকয়েক। এখন আমাদের সেইসব বন্ধুর ভেতরে বুলবুল, আমি আর আজিজই লেখালেখিতে আছি। দাউদের স্কুলজীবন থেকেই তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের দপ্তরে। তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত কবি আহসান হাবীব। হাবীব ভাইয়ের সাহচার্য্যে অনেকেই কবি হতে পেরেছিলেন, পেরেছেন আমার অনুজ দাউদ। দৈনিক সংবাদের মালিক আহমেদুল কবীরের স্নেহধন্য হবার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই দৈনিক সংবাদের যুক্ত ছিল এবং পরবর্তীকালে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিল আমার আরেক অনুজ জাহিদ হায়দার। আবিদ হায়দার লেখালেখি শুরু করেছিল ১৯৭২ সালের পর থেকে। দাউদ হায়দার ১৯৭৪ সালে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালে ওর একটি বিতর্কিত কবিতা ছেপেছিল সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে। তখন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। সেই কবিতাটি নিয়ে সমগ্র দেশে মৌলবাদীদের উৎ্কণ্ঠায় জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ভারতের কলিকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করে একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আরো সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। আমাদের হায়দার পরিবার তাঁদের নিকট চিরকৃতজ্ঞ।

কবি নিজের প্রেমিকার পাশে থাকতে চেয়েছেন বিজন বনে। তিনি তাকে ছাড়া থাকবেন না। সবাইকে নিয়েই কবি থাকতে ভালোবাসেন। তাই বলেন

ডাকবে শুধু আমায় তুমি
থাকবে শুধু আমার পাশে
থাকবে তুমি।

কাঁদলে শুধু কাঁদবো আমি
বিজন রাতে একলা আমি
তোমার পাশে।...

কবি মাকিদ হায়দার তাঁর জুতা বিষয়ক কবিতায় কি চমৎকারভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথাকে তুলে ধরেছেন মায়ের চিঠির আদলে। এই চিঠিতে আমরা ঢাকা শহরের চিরচেনা শাশ্বত চিত্রকে প্রত্যক্ষ করি। কারণ এই সমাজে সাবধানতা অবলম্বন করার কথাও মা চিঠিতে লিখে ছেলেকে সাবধানতার কথা বলেছেনএই যে নর্দমাতে পড়ে গেলে সাহায্য করার মানুষ নাই।

বাবা হরিপদ,

চিঠি পাইবামাত্র জুতা কিনিবা,
আমি জানি তোমার পদযুগলে কোন জুতা নাই
জুতা ছাড়া ঢাকা শহরে তুমি চলাফেরা
করিতেও পারিবে না।...
রাস্তায়, খাল-খন্দক কাটিতে পছন্দ করে
তাই ভয় হয় তুমি যদি
সেই খানা-খন্দকে একবার পড়িয়া যাও
তোমাকে ডাঙ্গায় তুলিবার মতো লোকজন আজকাল
নাই বলিলেই চলে।

তাই তোমাকে বলিতেছি তুমি দুই জোড়া জুতা কিনিবা।
একজোড়া তোমার জন্য
আরেক জোড়া মুক্তিযুদ্ধের নামে।
মুক্তিযুদ্ধ যেন সেই জুতা পায়ে দিয়া তোমার সাথেই
আমাদের দোহার পাড়ার বাড়িতে একবার আসিয়া
বেড়াইয়া যায়।...

কবি মাকিদ হায়দার অনীক মাহমুদকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন যে কোন একদিন কবিতাটি। যেখানে তিনি সহজ-সরলভাবে সমাজের বাস্তবচিত্রকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু কবিতাটা কত সহজেই আমরা পড়ে ফেলতে পারি। এটাই কবি মাকিদ হায়দারের কবিত্ব শক্তি; এখানেই তিনি বড়ত্বের পরিচয় দিয়েছেন। নিজেকে কখনোও এই পথের মানুষ বা নিজে যে অনেক বড়মাপের মানুষ তা তিনি ভাবেননি। 

মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছে করে আপনাদের কাছে গিয়ে গল্প করতে৷
শুনেছি আপনারা খুবই নিরীহ এবং সুবিধেমতো জল থেকে উঠে আসেন
ডাঙ্গায়, গ্রীষ্মকালে ডুবে থাকেন গভীর জলে যে থাকেন,
আমি শুধু সেই রহস্যটুকু জানার জন্যেই
আপনাদের সাথে গল্প করতে যাবো...
বোকা কুমির এবং চতুর শিয়ালের নিকট থেকে শুনেছি, আপনারা নাকি
ভীষণ সুবিধেবাদী...

কবি মাকিদ হায়দার একদিন পাবনা শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, টাকার জন্য সিনেমার টিকেট না নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়ে চড়-থাপ্পড়ও খেয়েছেন। এই শহরএই পাবনা শহর কবিকে কবি হতে সাহায্য করেছে। যে মাটিতে পোতা আছে কবির নাড়ি। সেই শহরে সিনেমা দেখার কথা তুলে ধরে কবি তাঁর আত্মজৈবনিকে বলছেন—‘শাজাহান ভাইদের সেই আড্ডার কথাটি আমার কানের ভেতরে, প্রাণের ভেতরে এমনভাবে আটকে গেল যে, তখনই আমার মনে হলো, টকি আর অভিনয় জিনিসটাকে স্বচক্ষে যদি একবার দেখতে পারতাম, আমি তখনও জানতাম সিনেমা দেখতে গেলে টাকা বা পয়সার প্রয়োজন হতো টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে হয় কিন্তু আমার পুঁজি মাত্র ২ আনা পয়সা। একদিন সন্ধ্যার বেশকিছু পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বাণী হলের মেয়েদের গেটের নিচতলার দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা কিছুটা এগিয়ে দিয়ে সেই দিলীপ কুমার আর মীনা কুমারী নাকি মধুবালার টকি মাত্র তিন তিনেক চারেক দেখার ফাঁকেই এক বেঁটে খাটো গেটম্যান বা টর্চ লাইটধারী আমাকে একটু আগেই চড়-থাপ্পর দিয়েছিলেন, তাঁকে উর্দু-বাংলায় মিশ্রিত শব্দে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেনব্যাপার কি? সেই বেঁটে খাটো যা বললেন, তার সরল অর্থ, এই ছেলেটি দরজা দিয়ে সিনেমা দেখছিল, তাই দু-একটা চড়-থাপ্পড় দিলাম, বুঝলেন বাবু ভাই...

কবি মাকিদ হায়দার কবিতা পাঠাতেন কবি আহসান হাবীবের কাছে কিন্তু তিনি তাঁর কবিতা ছাপতেন না। কারণ সেগুলো ছাপার অযোগ্য বলে ছাপেননি জানিয়েছিলেন মাকিদ হায়দারকে। সেই সাথে বলেছিলেন, আগে গ্রামার ও মাত্রা সম্পর্কে জানেন। কবি এসে তাঁর বড়ভাই জিয়া হায়দারকে বললে তিনি ছন্দের বই দিয়েছিলেন। এর অনেকদিন পরে আহসান হাবীব তাঁর কবিতা ছেপেছিলেন। এসব কথা কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রিয় রোকনালী নামে একটি কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেনআমার ডাক নাম রোকন। আবার পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষের লোক ছিল শান্তিবাহিনীর লোকেরা, তাদের প্রায় সবাই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জামায়াত সদস্যদের একটি সাংগঠনিক স্তর হলো রোকন। রোকনালী হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীযারা ধর্ষণ, হত্যা, ধ্বংসে মেতে উঠেছিল তাদের বিরুদ্ধে লেখা একটি প্রতীকী নাম। এজন্যই নামটি এমন। কত গভীরে ভাবনা ছিল মাকিদ হায়দারেরযে কারণে  গভীরতাকে স্পর্শ করতে চাইলেহতে পারে কবিতা গ্রন্থের নাম এমন।

যে কবি নিজের শহরে নিজেকে উদার করে ঘুরে বেড়াতেন এই শহরের আনাচে-কানাচে, সেই বাণী সিনেমা হলের বর্ণনাও এসেছে তাঁর লেখায়। আজ সেখানে বাণী সিনেমা হলও নাই। সেই বর্ণনাময় জায়গাগুলোতে আজ মরীচিকা বাসা বেঁধেছে। তিনিও আজ ফিরে এসেছেন নিজের চির চেনা আলো-বাতাস মাখা নিজের শহরে। যে আরিফপুর নিজের ভাই শুয়ে আছেন। আত্মার আত্মীয় সে ভাই তাঁর কাছেই বুঝি আরামে ঘুমাবেন। কতকাল ভাইয়ের কাছে ঘুমানো হয় না, করা হয় না একান্ত কিছু নিজেদের গল্প। তবে কী, এই শহরেই আজ ফিরে আসা!

যে জীবন ছিল এক সরলতায় ভরপুর, সেই জীবন আজ দীর্ঘতর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরল আপনের কাছে। এই বাড়ি সেই সাহিত্যের বাড়ি যেখানে ছোট কাকার তানপুরা সবাইকে পরিবর্তন করে দাঁড় করিয়েছিল একই সাম্যের পথেশিখিয়েছিল ন্যায়ের নিশানা হাতে পথ চলতে। এ যেন বেদনা-যাতনাময় জীবন থেকে অনেক পেয়ে, নিজেকে নিঃস্ব এক নিছক ব্যর্থ মানুষ মনে করেও কবি বলতে পারেনযে আমাকে দুঃখ দিল সে যেন আজ সুখেই থাকে। এই সুখ দুর্বিসহতার সুখএই সুখ ক্ষয়িষ্ণুতার সুখ। কবি তো মনের সুখেই সেলাই করেন মনের অসুখ। তাই বাবার কাছে শুয়ে বাবাকে বলবেন নিজের অসুখের কথা। সকালের সোনা রোদ বৃক্ষকে ভেদ করে ঠিকরে পড়বে নিজের মুখের ওপরসেই রোদ মেখেপাখির ডাকে বলবেনডাকবে লোকে হঠাৎ করে/ সাতসকালে সাঁঝের বেলা/ দাঁড়িয়ে আছি তোমার পাশে। এই যে যাতনা কিংবা অভিপ্রায় দীর্ঘদিনের কবিরতিনি লালায়িত স্বপ্ন-বাস্তবতাকে পকেটে পুরেই পাড়ি জমালেন সুখের স্কুলে দুঃখকে পাঠ করবেন বলে। সারাজীবন তিনি লোভহীন ও নির্মোহ মায়ার বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছেন। এই জীবন তো শুদ্ধতম এক কবির জীবন। যে জীবনে সুখের আড়ালে অসুখ নাচে...