সাধারণ/ অসাধারণ
শীতকাল। গাঢ় কুয়াশার চাদরে ঢাকা গভীর রাতের মফস্বল শহরের প্রায় সবাই প্রগাঢ় ঘুমে অচেতন। উত্তর দিক থেকে থিরিথিরি হিমেল হাওয়া বইছে। ঘুম নেই শুধু কলেজে অনার্স পড়ুয়া এক তরুণীর চোখে। উটের গ্রীবার মতো কোন এক গলা এসে তার কানে কী-সব কথা যেন বলছে আর সে তন্ময় হয়ে সেসব কথা শুনছে। চাঁদ হেলে পড়েছে উত্তর পূর্ব কোণে। চাঁদের আলোর কণা ঘন মেঘপুঞ্জের মতো জমাট বাধা কুয়াশাকে ভেদ করে এই শহরকে রূপালি আলোয় প্লাবিত করে তাকে রূপকথার সুষমা দান করতে নিতান্তই অপারগ। আলো বিলাবার অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কেবল এই শহরের মাঝখান দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে যে রাস্তাটা চলে গেছে তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান বৈদ্যুতিক তারের খুঁটিতে লাগানো বাতিগুলো। রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোর শাটার বন্ধ। তালা ঝুলছে। কেবল থানার কাছে একটি চায়ের দোকান খোলা। দু-চারজন খদ্দের সেখানে চা-বনরুটি খাচ্ছে। হয়তো ওরা কোন ট্রাকের চালক অথবা হেলপার অথবা থানায় কোন কাজে এসেছে। রাস্তায় একটা দুটো ট্রাক, নাইট কোচ এবং কয়েকটা অটোরিকশা ছাড়া আর কোন যানবাহনের চলাচল নেই। থানা থেকে কিছু দক্ষিণ দিক দিয়ে এই সড়ক থেকে একটি গলি প্রবেশ করেছে দত্ত-পাড়ায়। নির্জন গলির সিমেন্টে ঢালাই করা আঁকাবাঁকা পথে হেটে হেটে বাঁশি বাজাচ্ছে গরম কাপড় পরা দুজন পাহারাদার। কয়েকটি কুকুর গলির আলো আধারীর মাঝে হল্লা করে বেড়াচ্ছে। এই গলির ঠিক মাঝামাঝি একটি বাড়ির তিনতলায় সেই তরুণীর পরিবার বসবাস করে। তরুণীর নাম সোহানা। সে একটি কক্ষে একা ঘুমায়। উটের গ্রীবার মতো গলা এখন আর তার সঙ্গে কথা বলছে না। তার কক্ষে বাতি জ্বলছে আর তার নিথর, নিষ্প্রাণ দেহটি ঝুলছে তাদের পুরনো ফ্যান থেকে। কিন্তু দেয়াল ঘড়ির একঘেয়ে টিক-টিক-টিক শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোন শব্দের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। কেবল বাইরে কী মনে করে যেন একটি কাক ডেকে উঠল।
কয়েক দিন আগের ঘটনা।
দত্ত-পাড়া যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই এই শহরের সবচেয়ে বড় এবং সব থেকে সেরা কলেজের ক্যাম্পাসের শুরু। বিশাল এলাকা জুড়ে বসে আছে এই কলেজ। মূল ফটক দিয়ে ঢুকলে হাতের ডানে প্রথমে কলা ভবন তারপর বাণিজ্য ভবন এবং মাঝখানে একটি ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। হাতের বাঁ দিকে প্রথমে মিলনায়তন তারপর পুরাতন বিজ্ঞান ভবন এবং এরপর রয়েছে নতুন বিজ্ঞান ভবন। দুপাশের ভবনগুলোর মাঝ দিয়ে একটি সিমেন্টের রাস্তা গেছে এবং সেটা গিয়ে মিশেছে বরাবর লাইব্রেরিতে এবং সেখান থেকে আরও বাম দিকে একাডেমিক ভবনে। আরও বাম পাশে রয়েছে বিশাল খেলার মাঠ এবং মসজিদ। মাঝের রাস্তা এবং ভবনগুলোর মাঝে ফাকা জায়গায় সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানো হয়েছে। ডান দিকের কলা ভবনে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করছেন এই কলেজেরই ইংরেজি বিভাগের পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক শিক্ষক নূর। সে এই কলেজে এসেছে এক বছরও হয়নি। তার বাড়ি অন্য জেলার কোন এক গ্রামে এবং সেখানেই তার বিধবা মা এক কলেজ পড়ুয়া বোনকে নিয়ে থাকে। তার বিয়ের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তবুও সে পণ করেছে তার তৃতীয় অবিবাহিত বোনটির বিয়ে না দিয়ে সে বিয়ে করবে না। এই কলেজেরই আরেকজন শিক্ষকের সঙ্গে কলেজের কাছেই একটি বাসা ভাড়া করে সে থাকে।
সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার গোলগাল শ্যামলা চেহারার নূরের পরনে গ্যাবাডিনের প্যান্ট আর নীলের উপর সাদা স্ট্রাইপের শার্ট। তার উপর কফি রঙের জ্যাকেট। চোখে ভারী ল্যান্সের চশমা। ইংরেজির শিক্ষক হলেও পুরোটা ক্লাস জুড়ে যদি ইংরেজিতে কথা বলে তাহলে শিক্ষার্থীরা আপত্তি জানায়। তারা লেকচার পুরোটা বুঝতে পারে না। তাই সে ইংরেজির পাশাপাশি ক্লাসে বাংলায়ও কথা বলে। সে পড়াচ্ছে: Dostoyvosky says that there are two kinds of people in this world. Ordinary and extraordinary. The ordinary people hanker after money, wealth, luxury, comfort, pleasure, sexuality and such worldly things. But what does the extraordinary man look for? তারা চায় মান-সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও অমরত্ব। They want to live in the hearts and minds of millions of people forever… পাবলো পিকাসো, মাদার তেরেসা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চে-গেভারা প্রমুখ অসাধারণ মানুষ। …They live and die for truth, beauty, honour and justice…
শ্রেণীকক্ষের শেষের দিকের একটি বেঞ্চিতে বসে তন্ময় হয়ে শিক্ষকের পাঠদান শুনছিল শ্যামবর্ণের ছিপছিপে কিন্তু ভারী পরিপুষ্ট বুকের অধিকারিণী সোহানা। তাকে রূপসী বলা না গেলেও সুশ্রী বলতে কারো কোন আপত্তি থাকবে না। তার ঠোঁট পাতলা এবং পানপাতার আকৃতির চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। পরনে লাল রঙের সুতির কামিজ আর সাদা সালোয়ার ও ওড়না। গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে রাঙানো রয়েছে ঠোঁট দুটি। এই ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী এই ছাত্রীটি প্রতিটি ক্লাসে কোন-না-কোন প্রশ্ন নূরকে করবেই। আর প্রশ্নগুলো বুদ্ধিদীপ্ত এবং তীক্ষ্ণ মেধার পরিচায়ক। নূর প্রশ্নের উত্তর দিতে পছন্দ করে এবং মনে করে যত বেশি প্রশ্ন আসবে তত বেশি তার লেকচার সফল হয়েছে। লেকচার শেষ হওয়ার পর সোহানা আজকেও হাত তুলল এবং বলল, স্যার কৃষক ফসল ফলায়। আর আমরা তার ফলান খাদ্য খেয়ে জীবন ধারণ করি। সে যদি ফসল উৎপাদন না করত তাহলে আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হতো। তাহলে কৃষককে কি অসাধারণ মানুষ বলা যাবে না? প্রশ্নটি নূরের ভাল লাগল। সে বলল, আমিতো কেবল দস্তয়ভস্কির অভিমত ব্যক্ত করলাম। তোমার দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো তুমি ঠিক আছো…। এভাবেই ভক্ত ও গুরুর কথোপকথন চলত ক্লাসের মধ্যে।
সেদিন টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। শীতের প্রকোপ বাড়ছিল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাকগুলোর অবস্থা বেহাল। কলেজ ক্যাম্পাসের একটা নিমগাছে বসে দুটো বুলবুলি শরীর থেকে জলের কণা মুছে ফেলার চেষ্টা করছিল। শাল, মেহগনি, পলাশ, সেগুন, ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি গাছের পাতাগুলো ভিজে কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। আকাশ ছাই রঙ্গা মেঘে ঢাকা। উত্তুরে হাওয়ায় গাছের পাতারা মৃদু মৃদু দুলছিল। দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। কলেজের মূল ফটকের সামনে যে কয়েকটা দোকান আছে তার বেশিরভাগই বন্ধ। যেগুলো খোলা আছে সেগুলোতেও কোন ক্রেতা নেই। ক্যাম্পাস একেবারে ফাঁকা। শিক্ষকেরা প্রায় সবাই আজ বাদলা দিন বলে একটু আগেভাগেই বাসায় চলে গেছেন। ক্লাস শেষ করে নূর সাধারণত এই সময়টাতেই বিভাগ থেকে বেরিয়ে বাসায় যায়। যথারীতি সে কলা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাম্পাসের মূল সড়কটাতে উঠল। তার হাতে কোন ছাতা ছিল না বলে সে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে কিছুটা ভিজছিল। জলের কণা তার চশমার ল্যান্সের গায়ে লেগে যাচ্ছিল। সে ধীর পায়ে মূল ফটকের দিকে এগুচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল: স্যার, আমাকে বাঁচান। নারী কণ্ঠ। চিৎকারটা নির্মাণাধীন ভবনের দিক থেকেই আসছে। নূর সেই ভবনের নিচতলার দিকে তাকালো। সে দেখতে পেল চার-পাঁচ জন তরুণ একটা মেয়ের হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে ভবনে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে এবং ছেলেগুলোকেও সে চিনতে পারল। মেয়েটা আর কেউ না, সোহানা। ছেলেগুলো এই কলেজেরই অতি পরিচিত ভয়ংকর সন্ত্রাসী। নূর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল! সোহানা এতক্ষণ ক্যাম্পাসে কী করছিল? সে চিন্তা করতে লাগল। পরক্ষণেই তার মনে পরে গেল হয়তো সে লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করছিল। তাছাড়া সেতো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। নূর আস্তে আস্তে হেঁটে নির্মাণাধীন নির্জন ভবনের কাছে চলে এসেছে। ততক্ষণে ছেলেরা সোহানাকে নিয়ে তিন তলায় উঠে গেছে। সে রেলিং ছাড়া সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠল।
সেখানে উঠে সে সোহানাকে যে অবস্থায় দেখল সেটা সে বিশ্বাস করতে পারল না। সে এক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে শুধু সোহানার দিকে চাইল। তাকে সেখানে দেখে একটি ছেলে দৌড়ে তার কাছে এসে ক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে কী চান? শিগগির এখান থেকে চলে যান। নূরের কানে এলো, সোহানা কাঁদতে কাঁদতে বলছে—স্যার, আমাকে বাঁচান। ছেলেটি ঠিক সেই মুহূর্তে কোমর থেকে একটি ছুরি বের করে নূরের গলায় তার ধারাল অগ্রভাগ চাপে ধরে আবার বলল, এখান থেকে চলে যান। নইলে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেব। নূরের গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছিল না। সে মেয়েটাকে উদ্ধার করবে না এখান থেকে চলে যাবে এবিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গিয়েছিল তার। এবার ছেলেটি ছুরির অগ্রভাগ তার গলায় আরেকটু বেশি জোরে চেপে ধরল এবং বলল, যাবেন কিনা বলুন? নূর টের পেল ছুরির অগ্রভাগ তার গলায় বসে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে তরল আঁঠালো পদার্থ বেরুচ্ছে। সে বুঝতে পারল এখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। তাই সে উদ্ভ্রান্তের মত সেখান থেকে খুব দ্রুত বেগে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ক্যাম্পাসের মূল সড়কে চলে এলো। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে।
তার মাথা কাজ করছিল না। বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে বলে মনে হলো। হঠাৎ তার মাথায় এলো যে বিভাগীয় প্রধানকে ফোনে বিষয়টি জানান দরকার। সে তাকে ফোন করল। কিন্তু অপর প্রান্তের কেউ কল রিসিভ করল না। তখন সে অধ্যক্ষকে ফোন দিল। এবারও তার ফোন কেউ ধরল না। তার নিজেকে খুবই অসহায় মনে হলো। এবার সে ৯৯৯ নাম্বারে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানাল। ওপার থেকে এক নারী কণ্ঠ তাকে জানাল, আমরা দেখছি। কিন্তু চল্লিশ মিনিটের মধ্যেও কেউ আসল না। তখন আরেকটি ছেলে সেই ভবন থেকে নিচে নেমে এসে তার তলপেটে কিছু একটা ধাতব পদার্থে তৈরি জিনিস ঠেকিয়ে বলল, আপনাকে না আমরা চলে যেতে বলেছি। ‘যান, বাসায় যান’ বলে ফটকের দিকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে এলো। তারপর আবার বলল—‘যান, বাসায় যান।’ নূর পরাজিতের মতো কলেজের ফটক দিয়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে বাসার দিকে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগল। নিজেকে খুবই ছোট এবং অপরাধী মনে হলো। তার মনে হতে লাগল সমস্ত শিক্ষা, জ্ঞান, বিদ্যা, নৈতিকতা সবকিছুকে মিথ্যা, অর্থহীন, ভিত্তিহীন ও মূল্যহীন। ভীরু, কাপুরুষ এবং খুবই নীচ মনে হতে লাগল নিজেকে। একধরনের গ্লানিবোধ নিয়ে সে ঘরে ফিরল। পরদিন সকালে সে কলেজে এসে তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পর নূর দুপুরের দিকে তার টেবিলের অপর প্রান্তে নিজের চেয়ারে বসে বিষণ্ণ মনে বই পড়ার চেষ্টা করছিল। অন্যান্য সহকর্মীও কয়েকজন সেই কক্ষে নিজ নিজ আসনে বসেছিল। ঠিক সেই সময় সোহানা উদভ্রান্তের মত আলুথালু বেশে সেই কক্ষে দ্রুত বেগে প্রবেশ করে সশব্দে নূরের টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারটিতে বসে পড়ল কোন অনুমতি ছাড়াই। নূর বই থেকে মুখ তুলে এক পলকের জন্য সোহানার দিকে চাইল। তারপর আবার বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিল। সোহানা কিছুক্ষণ অঝোর ধারায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। নূর বই থেকে মুখ তুলল না। হঠাৎ সোহানা কান্না থামিয়ে দিল। সে ডান হাত দিয়ে চোখের পানি মুছল। তার চেহারা কঠিন থেকে কঠিনতর হলো। চোখের চাহনিতে অগ্নি স্ফূলিঙ্গ বেরুতে লাগল যেন সে নূরকে ভস্মীভূত করে ফেলতে চাইছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে সে বলতে লাগল, ‘আপনাকে আমি অনেক বড় মাপের মানুষ ভাবতাম। কিন্তু আপনি অনেক ছোট হীন স্বভাবের নীচু একজন মানুষ। আপনি মিথ্যেবাদী, ভীরু এবং কাপুরুষ। আপনি একজন নিকৃষ্ট শ্রেণীর অতি সাধারণ মানুষ। ধিক আপনাকে!’ এই কথাগুলো বলে সে দ্রুত বেগে আবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। নূর এখনও মাথা নীচু করে বইয়ের দিকেই তাকিয়ে রইল। তার সহকর্মীরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। এক সপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার দিন পুলিশ এসে সোহানাকে উদ্ধার করেছিল ঠিকই। তবে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর। নূরকে ভৎর্সনা করে সেদিনই সোহানা উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করে।
জগতে শোক-তাপ, অনুতাপ, ক্ষুধা, বেদনা, বিয়োগ ব্যথা, যন্ত্রণা সর্বোপরি মৃত্যু আছে। কিন্তু কোন কিছুর কারণেই জীবন থেমে থাকে না। সে এক খরস্রোতা নদীর মতো শত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সবকিছুকে খড়কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে সর্বদা প্রবাহমান থাকে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মে। নূরের জীবনও সোহানার আত্মহত্যার পর থেমে থাকেনি। তাকে সংসার দেখতে হয়। চাকুরি রক্ষা করতে হয়। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। কিন্তু কখনও কখনও বিষণ্ণতা এসে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। তখন তার দম নিতে খুবই কষ্ট হয়। তার জগত ছোট হয়ে আসতে থাকে। সে হাঁসফাঁস করতে থাকে একটু বাতাসের জন্য।
সেই শীতেরই এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে নূর ক্লাসে পড়াচ্ছিল। Truth is beauty, beauty truth… ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রী। তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল। লেকচার দেয়ার সময় আগে বিশেষ একটা অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করত। এক ধরনের আত্মতৃপ্তি, এক ধরনের প্রশান্তি উপলব্ধি করত সে। কিন্তু এখন সব সময় কিছু একটার অনুপস্থিতি, কিছু একটার শূন্যতা সে টের পায়। এই শূন্যতা তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তাকে সব সময় অস্থির করে রাখে। সে বার বার ঘড়ি দেখে। কখন ক্লাসের সময় কখন শেষ হবে। ক্লাস শেষে এবার প্রশ্ন শোনার পালা। একটি মেয়ে সোহানা যেই জায়গাটিতে বসত ঠিক সেই জায়গায় বসে হাত তুলল। মেয়েটি বলল, স্যার কুৎসিতও তো সত্য। তাহলে কুৎসিত কী সুন্দর! মেয়েটির নাম তৃষ্ণা। তার দিকে তাকিয়ে নূর ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। সে দেখতে পেল সোহানা ওখানে বসে আছে আর বলছে, ‘স্যার আপনি একজন মিথ্যেবাদী এবং অতি নীচু শ্রেণীর সাধারণ মানুষ।’ সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘চুপ করো সোহানা। তুমি চুপ করো।’ সমস্ত ক্লাসে গুঞ্জন উঠল। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কেউ কেউ বলে উঠল, স্যার এসব কী বলছেন! স্যারের মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? নূর তৎক্ষণাৎ শ্রেণীকক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল।
কয়েকদিন পর নূর সন্ধ্যাবেলায় বাজার করে ফিরছিল। হাতে যৎসামান্য সদাই। তাই ভাবল হেঁটেই বাসায় যাবে। ফেরার পথে একটি রেলক্রসিং পড়ে। একটি ট্রেন যাবে তাই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে রাস্তার এপারে দাঁড়িয়েছিল। একটি মেয়ে তার পেছন থেকে এসে তার কানের কাছে মুখ এনে কাপুরুষ শব্দটা বলে তাকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। পিছন থেকে দেখতে মেয়েটি একেবারে সোহানার মতো দেখতে। সে ডাকল, ‘সোহানা, সোহানা। শোন। শুনে যাও আমার কথা।’ মেয়েটি তার কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব করে হেঁটে যাচ্ছিল রেল ক্রসিঙয়ের দিকে। সে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির পথ রোধ করে দাঁড়াল। মেয়েটি তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাকে কিছু বলছেন? সে ভালভাবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করল। দেখল যে মেয়েটি সোহানা নয়। সে বলল, দুঃখিত। ট্রেন ঘটর-ঘটর শব্দ করে দ্রুত গতিতে চলে গেলে লাইনম্যান রাস্তা খুলে দিল। সে বাসায় চলে এলো।
পরদিন সন্ধ্যায় ঠিক একই সময়ে নূরকে রেলক্রসিঙয়ের কাছে দেখা গেল। সে রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। একটি ট্রেন আসছে। লাইনম্যান রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। তীক্ষ্ণ হুইসেল বাজিয়ে সুতীব্র বাতি জ্বেলে ঝড়ের বেগে একটি ট্রেন আসছে। নূর ধীরে ধীরে রেললাইনের উপর দিয়ে হেঁটে রেলগাড়ি বরাবর অগ্রসর হচ্ছিল।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন