মার্কিন কবি ও প্রাবন্ধিক লুইস গ্লুকের নোবেল বক্তৃতা
|| লুইস গ্লুক ||
মার্কিন কবি ও প্রাবন্ধিক লুইস গ্লুক ১৯৪৩ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে বাস করেন। লেখালেখি ছাড়াও তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৮ সালে ‘ফার্স্টবর্ন’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জীবনে আত্ম-প্রকাশ তার। লেখালেখির জীবনে পদার্পণের শুরুই তিনি পাঠক ও সাহিত্য বোদ্ধাদের কাছে সমান সমাদৃত হন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যেমন শৈশবের স্মৃতি, পারিবারিক জীবন, মানবিক সম্পর্কে ও মৃত্যু লুইস গ্লুকের কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে। তিনি কবিতায় চিরন্তন ও সার্বজনীনের সন্ধানে আত্ম-নিয়োগ করেছেন। পুরাণ ও চিরায়ত শিল্প অলংকার তার কাব্যে নিয়মিত অনুসঙ্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। চিরায়ত পুরাণকাহিনির সঙ্গে সমৃদ্ধশীল ইংরেজি ভাষা কাব্যরীতিও তার সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। গ্লুকের কাব্যভাষা সকল রকম যান্ত্রিকতা ও আনুষ্ঠানিকতাকে ছেঁচে ফেলে প্রাঞ্জলতা ও স্পষ্টতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে। মানুষের আটপৌড়ে কথ্যভাষাই তার কবিতার মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। গ্লুকের কবিতায় আত্মজৈবনিক উপাদানের উপস্থিতি থাকলেও তিনি নিজেকে স্বীকারোক্তিমূলক কবি বলতে নারাজ।
‘দ্য ট্রায়াম্প অব একিলিস’ (১৯৮৫) ও ‘আরারাত’ (১৯৯০) কবিতা সংকলনের মাধ্যমে তিনি দেশে ও বিদেশে পরিচিত হয়ে উঠেন। এই কবিতাগুলোতে তিনি প্রাত্যহিক ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করেন। কবিতাগুলোতে পাঠকরা পারিবারিক সম্পর্কের বেদনাদায়ক চিত্রের সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ করে। গ্লুকের কাব্যের ভাষা এতোটাই সহজ ও ঋদ্ধ যে তাতে কাব্যের কৃত্রিম আলংকারিকতার লেশ মাত্র পাওয়া যাবে না। গ্লুক শুধু জীবনের অবস্থানগুলোর পরিবর্তন নিয়ে বলেননি বরং নতুন ও ভিন্ন এক জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন কবিতার চরণে চরণে। তার বিখ্যাত কাব্য সংকলন ‘ওয়াইল্ড আইরিস’ (১৯৯২)-এর কবিতাগুলোতে বিশেষ করে ‘স্নোড্রপস’ কবিতায় হিমের কাল অতিক্রম করে নির্জীবতার আড় ভেঙ্গে আবার নতুন প্রাণের সঞ্চারণকে যেভাবে অঙ্কিত করেছেন তা এক কথায় অনবদ্য:
ভাবিনি, রয়ে যাবো এই পৃথিবীর পরে
পৃথিবী যেন আমায় ছেড়ে যাচ্ছিল, ভাবিনি
আবার জেগে উঠবো, ছুয়েঁ দেবো
ভেজা মাটিতে আমার শরীর
আবার সাড়া দেবো, মনে পড়ে গেলো
অনেক আঁধারের পর কি করে জেগে উঠতে হয়
এই হিমভরা আলোয়
বসন্তের প্রথম প্রহরে—
এটা স্পষ্ট যে কোন পরিবর্তনের অন্তিম মুহূর্তে জীবনের হাস্যরসের মধুরতা ও বিদ্রুপের তীক্ষ্ণতা মিশে থাকে। তার ‘ভিতা নোভা’ (১৯৯৯) কাব্যের শেষোক্তি ছিল: ‘ভেবেছিলাম জীবন শেষের প্রান্তে, মনে বাজে ভাঙ্গনের সুর/ তারপর একদিন চললাম ক্যামব্রিজের পথে।’ এই কবিতার শিরোনামে দান্তের কালোত্তীর্ণ লা ভিতা নোভার ব্যঞ্জনা প্রতিধ্বনিত হয়। দান্তের প্রেরণাদাত্রী বিয়াত্রিসের নব জীবনকে উদযাপন করে।
গ্লুকের অবিস্মরণীয় কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর পাওয়া যায় তার ‘আভিনো’ (২০০৬) কবিতা সংকলনে। পাতালরাজ্যের মৃত্যুর দেবী হেইডিস কি করে পারসিফোনিকে বন্দী করলো তার পৌরাণিক কাহিনি বিবৃত হয়েছে। এই কবিতার শিরোনামটি নেপলসের আগ্নেয়গিরির জালামুখ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রাচীন রোমানরা একে পাতাল রাজ্যের প্রবেশদ্বার বলে মনে করতো। তার পরবর্তী অভিনব কবিতার সংগ্রহ হলো ‘ফেইথফুল এন্ড ভার্চুয়াল নাইট’ (২০১৪) যার জন্য তিনি ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
২০২০ সালে লুইস গ্লুক সাহিত্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটসের আচার্য নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে তিনি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের দ্বাদশ কবি হিসাবে কবিতার পরামর্শক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ইয়েল সিরিজের তরুণ কবিদের বিচারক হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি ২০২৩ সালে মাত্র আশি বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।
|| সম্পাদকীয় নোট ||
মার্কিন কবি ও প্রাবন্ধিক লুইস গ্লুক বক্তৃতাটি দেন ২০২০ সালের নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশানের অনুষ্ঠানে। নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশান সম্প্রতি প্রতিধ্বনি পত্রিকাকে বক্তৃতাটির বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশের কপিরাইট প্রদান করেছে। আমরা নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশানের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। প্রতিধ্বনির জন্য এটি অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ।
|| লুইস গ্লুকের নোবেল বক্তৃতা ||
আমি যখন ছোট ছিলাম। মনে হয় পাঁচ বা ছয় বছর হবে। মনে মনে একটা কবিতার প্রতিযোগিতা আয়োজন করলাম। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা নির্বাচনের প্রতিযোগিতা। সর্বসাকুল্যে দুটো কবিতা চূড়ান্ত করেছিলাম। ব্লেইকের ‘দ্য লিটল ব্ল্যাক বয়’ এবং স্টিফেন ফস্টারের ‘সুইনি রিভার’। সিডারহার্স্টে আমার দাদিবাড়ির দ্বিতীয় শোবার ঘরে দ্রুতপায়ে হেঁটে গেলাম। দাদী বাড়িটা লং আইল্যান্ডের দক্ষিণ তীরের একটা গ্রামে ছিল। মুখে নয়, মনে মনে ব্লেইকের অবিস্মরণীয় কবিতাটি আবৃত্তি করলাম। সবসময় নিঃশব্দে পড়তেই আমার ভালো লাগতো। তাই ফস্টারের সেই মন উদাস করা ও বিষাদভরা গানটা মনে মনে গুন গুন করলাম। আমি কিভাবে ব্লেইকের কবিতা পড়া শুরু করেছিলাম তা এক রহস্য বটে। আমাদের বাড়িতে রাজনীতি, ইতিহাস ও উপন্যাসের অসংখ্য বইয়ের সাথে অল্প কিছু কবিতার সংকলনও ছিল। কিন্তু দাদী বাড়িতে গিয়েই আমি ব্লেইকের কবিতা পড়া শুরু করেছি। আমার দাদী তেমন পড়ুয়া ছিল না। সেবার আমি ব্লেইকের ‘দ্য সংস অব ইনোসেন্স অ্যান্ড অব এক্সপেরিয়েন্স’ এবং শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে সংকলিত একটা ছোট গানের বই প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। চ্যাম্বেলাইন গানটা মারাত্মক পছন্দ করতাম। একটা শব্দও বুঝতাম না কিন্তু সুরটা শুনতে মিষ্টি লাগতো। গানের সুরের মুর্ছনা, আবেদনময়ী বাজনা একটা লাজুক ও ভীতু শিশুর মনে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিতো। ‘মরে গিয়েও বেঁচে থেকো’, আমি তো তাই আশা করতাম। এমন বিপুল সম্মান, এমন বিরাট পুরস্কারের জন্য যে কোন প্রতিযোগিতা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। আমার পড়া পুরাণগুলো দিয়েই এই সব কিছু পূর্ণ হয়ে আছে। এমনকি আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো আমার কাছে সবচেয়ে মহানদের মধ্যে মহান ও মর্যাদাকর মনে হতো। আমি ও আমার বোন ঠিক এই পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। ফ্রান্সের জোয়ান অব আর্ক কে বাঁচাতে, মেরি কুরির রেডিয়াম আবিষ্কার করতে আমরা অবিরত পড়তাম। পরবর্তীকালে আমি অনুক্রিক চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকিগুলো বুঝতে শুরু করেছি। কিন্তু শৈশবে প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার প্রদানের চর্চাকে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ একটা পর্বতের শিখরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। দূর-দূরান্ত থেকে সবাই তাকে দেখাচ্ছে। সবার মনোযোগের কেন্দ্র ওই পর্বত। পাহাড়ের নিচের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে অতি সামান্য ও প্রায় দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে।
অথবা, যদি কবিতার কথা বলি। আমি নিশ্চিত যে ব্লেইক কোনো না কোনো ভাবে এই ব্যাপারটা ভালো করে জানতেন। এর ফলাফলের পিছনে কী উদ্দেশ্য ছিল তাও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আমি জানি, তিনি আর বেঁচে নেই তবুও তিনি আমার কাছে জীবন্ত ছিলেন। তার কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি আমার সাথে কথা বলতেন। যদি ছদ্ম ছিল তবু তার কণ্ঠস্বর আমি শুনতে পেতাম। আমার মনে হতো তিনি কথা বলতেন, শুধু আমার সাথেই কথা বলতেন। নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হতো। খুব ভাগ্যবান মনে করতাম। আমার এটাও মনে হতো আমি শুধু ব্লেইকের সাথে কথা বলার জন্যই উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। শেক্সপিয়ারের পর আমি ব্লেইকের সাথেও কথা বলতে শুরু করেছিলাম।
ব্লেইক এই কবিতা প্রতিযোগিতার বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই দুটো গীতিকবিতা কতোটা কাছাকাছি ছিল। আজকের মতো সেদিনও আমি মানুষের এই নিস্তবদ্ধ কণ্ঠস্বরের প্রতি একটা অমোঘ টান অনুভব করতাম। তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আর্তনাদে ডুবে থাকতাম। একটু বড় হয়েও আমি সেই সব কবির কাছে বারবার ফিরে যেতাম যাদের কবিতা নিয়ে আমি একধরনের আনন্দক্রীড়ায় মগ্ন থাকতাম। একজন নিবেদিত শ্রোতা হিসাবে মগ্ন থাকতাম, গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতাম। এদের সাথে সবসময় ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকতাম, আমাকে সম্মোহিত করে রাখতো, কিছুটা রহস্যময় কিছুটা সঙ্গোপনে। কোনো স্টেডিয়ামের কবি নয়। নিজের কথা বলা কবিও নয়।
আমার এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে। কবিতা যে কতো জরুরী কথা বলে, একান্ত ব্যক্তিগত কথা বলে সে ব্যাপারটা ধর্মগুরু কিংবা বিশ্লেষক সবাই সমানভাবে গ্রহণ করে।
আমার দাদীর দ্বিতীয় শোবার ঘরে খুব গোপনে যে কবিতার পুরস্কার অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা কবিতার সাথে আমার নিগূঢ় সম্পর্কের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। এটা আমার জীবনের একটা নতুন সংযোজন মাত্র, কোন কিছুর লঙ্ঘন নয়।
কবিতার ওই ছোট্টো ছেলেটির মাধ্যমে ব্লেইক আমার সাথে কথা বলে যেতো। সে ছিল ওই গুপ্ত কণ্ঠের মূল। ব্লেইককে দেখা যেতো না যেমন করে ওই ছোট্ট ছেলেটিকে কখনো দেখা যায়নি। অথবা ভুল অবয়বে প্রকাশিত হয়েছে। যেভাবে সে ঐ অস্পৃশ্য সাদা বালকের তাচ্ছিল্যতায় সবার অলক্ষ্যে রয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম সে যা বলেছিল তার প্রত্যেকটা শব্দ সত্য। কারণ তার অপরিণত শরীরের ভেতর একটা শুদ্ধ, পবিত্র ও উজ্জ্বল হৃদয় ছিল। আমি জানি ছেলেটি কি অনুভব করতো, কেমন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। আমি জানতাম কারণ ছেলেটি কোন কিছুর প্রতি অভিযোগ ছিল না। কারো প্রতি প্রতিশোধ নেয়ার কোন তাড়া ছিল না। সে তার মনের মধ্যে শুধু এই বিশ্বাসটুকু ধারন করে ছিল যে, মৃত্যুর পরে যে সুন্দর পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে, সে জগতে অবশ্যই সে তার ভালো কাজের স্বীকৃতি পাবে। এই সুখ ভাবনার আতিশয্যে সে অতি দুর্বল সাদা বালককে আলোর প্রবল প্রবাহের হাত থেকে রক্ষা করে। আর এই প্রত্যাশা সবসময় বাস্তবতার সত্যরূপকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই অবাস্তব প্রত্যাশাই কবিতাটিকে হৃদয়স্পর্শী ও রাজনৈতিক করে তোলে। যে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক আক্রোশ ও ন্যায্য ক্রোধ থেকে ছেলেটি নিজেকে দূরে রেখেছে, যে ক্রোধ থেকে তার মা তাকে সবসময় রক্ষা করে এসেছে। পাঠক ও শ্রোতারা সেই একই আক্রোশ বোধ করে। এমন কি পাঠক যদি শিশু হয় তবুও।
কিন্তু বিশ্ব সম্মাননা অন্য মাত্রার একটা বিষয়।
আমার সমগ্র জীবনে যে ধরনের কবিতাগুলোর প্রতি আমি প্রবল আগ্রহর সাথে মগ্ন থেকেছি সে রকম কবিতা নিয়ে আমি এতোদিন ধরে কথা বলে আসছি। যে কবিতায় ভাষা ও ভাবের প্রাণবন্ত নির্বাচন ও প্রচ্ছন্ন মিথস্ক্রিয়া থাকে। যে কবিতার পাঠক ও শ্রোতারাও কবিতায় একটা অপরিহার্য অবদান রাখে। কখনো উল্লসিত হয়ে ওঠে। কখনো বিষাদাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে কবিতার সাথে পাঠকরাও পৃথিবী পরিবর্তনের চক্রান্তে সহযোগী হয়ে উঠে। ‘আমি তো কেউ নই’ কাব্যে ডিকিনসন বলেছিলেন, ‘তুমিও কি কেউ নও?/ তার মানে আমরা যুগলবন্দী—কাউকে বলো না যেন...’ কিংবা ইলিয়ট যেমনটা বলেছিলেন, ‘এবার চল যাই তবে, তুমি আর আমি,/ দেখো আকাশে কেমন সন্ধ্যার আলো ছড়িয়ে আছে/ যেমন কোন রোগী অসাঢ় শুয়ে টেবিলে...’ ইলিয়ট কোন স্কাউট দলের ডাক দিচ্ছেন না। তিনি পাঠককে আহ্বান করছেন। বিপরীত দিকে শেক্সপিয়র যেমন বলেছিলেন, ‘তোমারে কি করিব তুলনা গ্রীষ্মের সনে’: এখানে শেক্সপিয়র মোটেও আমাকে গ্রীষ্মের তপ্ত দিনের সাথে তুলনা করছেন না। আমি হয়তো কবিতার মনকাড়া শৈল্পিক ব্যঞ্জনা কান পেতে শুনে যাবো। কিন্তু কবিতার তার এই গুনগ্রাহী নৈবেদ্যর উপস্থিতি কখনো জানার প্রয়োজন পড়ে না।
আমি যে প্রকারের শিল্পের প্রতি তুমুল ভাবে আকৃষ্ট তার যৌথ কণ্ঠস্বরগুলো বা সমবেত অভিমতগুলো ভীষণ ভাবে বিপজ্জনক। কবিতার প্রাণবন্ত আলাপনের অনিশ্চয়তাই কবিতাকে একটা নব শক্তি দেয়। পাঠককে তেজস্বী করে তোলে। এই তেজ থেকেই কবিতার স্বর আত্মবিশ্বাসী ও আবেদনময়ী হয়ে উঠে।
এই ধরনের কবিদের সাথে আসলে কি ঘটে যখন সমবেত স্বরগুলো পরিত্যাগ বা উপেক্ষা করার পরিবর্তে আরো স্ফীত ও আরও সরব হয়ে উঠে। আমি বলবো এই রকম কবিরা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সন্ত্রস্ত ও পরাস্ত বোধ করে।
ডিকিনসনের কবিতার বিষয় এটা ছিল। সবসময় নয় মাঝে মাঝে ছিল। আমার কিশোরীবেলায় আমি ডিকিনসনের কবিতা খুব মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তাম। বিশেষ করে গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। বসার ঘরের সোফায় বসে একা একা একমনে পড়তাম।
আমি তো কেউ নই! তুমি কে?
তুমিও কি কেউ নও?
ঠিক এইভাবে আমি তখনও যেমন পড়তাম এখনও পড়তে পছন্দ করি।
তারমানে আমরা যুগলবন্দী—কাউকে বলো না যেন!
তারা আমাদের নাই করে দিবে, জানো তো...
আমি যখন সোফায় বসে পড়ছিলাম ডিকিনসন কি আমায় পাঠক হিসেবে বাছাই করেছিল? আমায় চিনতে পেরেছিল? ডিকিনসন আর আমি খুব অভিজাত ছিলাম। চির অদৃশ্যমান সঙ্গী। দুজন দুজনের কাছে ছিলাম চির চেনা। একজন আরেক জনের পরিপূরক। বাইরের জগতে আমরা কেউ ছিলাম না।
কিন্তু আমাদের মতো মানুষগুলো যারা একটা ছাদের নিচে নিরাপদস্থানে থাকে তাদের কাছে এই না-থাকাটা কেমন? না-থাকা হচ্ছে মাথার উপর এই ছাদের আশ্রয় সরিয়ে ফেলা।
আমি এখানে একটা কিশোরী মেয়ের উপর এমিলি ডিকিসনের সর্বনাশ প্রভাব নিয়ে কথা বলচ্ছি না। আমি কবিতার এমন এক প্রকৃতি, এমন এক মেজাজ নিয়ে কথা বলছি যা আমাদের লৌকিক জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। অথবা লৌকিক জীবনকে এমন এলাকা হিসেবে দেখে যেখানে আমাদের আটপৌরে সাধারণীকরন জীবনের নিগূঢ়তা ও স্পষ্টতাকে বিলীন করে দেয়। খন্ডিত সত্য জীবনের সরলতার আদল বদলে দেয়। জীবনের অকৃত্রিম প্রকাশকে অপরাধ হিসাবে সাব্যস্ত করে। বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে ডিকিনসনের চক্রান্তের স্বরকে ন্যায় বিচারের স্বরে রূপান্তরিত করে। ‘আমি তো কেউ নই! তুমি কে?’ এই প্রশ্নটা আচানক একটা অশুভ বার্তা প্রদান করে।
৮ অক্টোবর সকাল বেলায় আমি একটা আকস্মিক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম যা আমার জন্য একটা বিস্ময়বোধক মুহূর্তও ছিল। আলো এতো উজ্জ্বল ছিল। বদান্যতা এতো অবারিত ছিল কী করে বলি!
আমরা যারা বই লিখি তারা চাই আমাদের এই লেখা সর্বাধিক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কিছু কিছু লেখকের লেখা স্থানিক বিচারে আশানুরূপ সংখ্যক লোকের কাছে পৌঁছায় না। ততো পাঠক যতো হলে একটা মিলনায়তন পূর্ণ হয়ে যাবে। তবে তারা কালিক বিচারে, পর্যায়ক্রমিক অনুসারে কেউ কেউ অধিক সময় পার করে ভবিষ্যতে তার পাঠক খুঁজে পায়। কিন্তু যখন পাঠক পায় তারা ধীরে ধীরে একে একে সুমধুর সঙ্গীত গাইতে গাইতে আসতেই থাকে।
আমি মনে করি আজকে আমাকে এই পুরস্কারে সম্মানিত করে সুইডিশ একাডেমি কবিতার সেই অন্তরঙ্গ ও সহজাত স্বরকেই বেছে নিয়েছেন যাকে লৌকিক শব্দে শুধু প্রসারিত কিংবা প্রদীপ্ত করা যায়। কিন্তু কখনো পরিবর্তিত করা যায় না।
সংযুক্ত কবিতা
ছোট্ট কৃষ্ণ বালক || উইলিয়াম ব্লেইক
জননী মোরে রাখিয়াছে দুধে ভাতে, দূর দখিন বনে,
দেখিতে কৃষ্ণকালো, তাতে কি! মনটি শ্বেত শুভ্রা;
এতোটা শুভ্র, দেবদূত তূল্য যেমন ইংরেজ সন্তানে,
কিন্তু আমি কৃষ্ণবরণ, যেন বা বেদনা বিধুর বিভা।
শিখায়াছে মোরে জনম জননী বোধি বৃক্ষ তলে,
বসিয়াছে ধারে মমতাভরে প্রখর রৌদ্র দিনে,
রাখিয়া মাতৃক্রোড়ে করিয়াছে চুম্বন প্রবলে,
করিয়া ইঙ্গিত প্রাচ্যদেশে, আরম্ভিল কনক কথনে:
‘ওই দিগন্তে উঠিছে সূর্য: বৈকুণ্ঠ হেথায় ঈশ্বরের,
কতো না কিরণ ছড়ায়ে, কতো না উষ্ণতা বিলায়ে;
কতো না লভিছে পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ও মানুষের
প্রবোধ প্রতি সুপ্রভাতে, প্রমোদ প্রতি দ্বিপ্রহরে।’
‘মানব জীবন লভিছে এ জমিনে ক্ষুদ্র খুব স্থান,
আমরা তবে সহিতে শিখি প্রগাঢ় প্রেমের তাপ;
তবে এই শ্যামসুন্দর অঙ্গখানি, রৌদদগ্ধ বদন
যেন বা মেঘের কায়া, যেন বা কুঞ্জ ছায়াবৃত।’
‘আত্মা মোদের যবে শিখিবে দহন তাপ সহিতে,
মিলাইবে মেঘ শূন্যে নিশ্চয়; শুনিবে ঈশ্বরের স্বর,
সুধাইবে প্রিয়রে, এসো, আমার ঘরে এসো রহিতে,
ঘুরিয়া দেখিবে সোনার কেল্লা, যেমতে মেষেরা মনোহর।’
এমতে জননী বলিয়াছে মোরে, চুমিছে কপোলে;
সে মতে করিয়াছি বচন ছোট্ট ইংরেজ বালকেরে:
আমি যে কৃষ্ণ, সে যে শুভ্র, ভাসিছে মেঘের দলে
ঘুরিতেছি দু’জনে ঈশ্বরের ঘরে, যেমতে মেষেরা হর্ষ করে।
আমি তা'র রহিবো ছায়া হইয়া, লাগিবে যতোক্ষণ
আনন্দ খেলায় শিখিতে পিতার পদতলে;
চকিতে দাঁড়াইবো, রূপোলি কেশে ছড়াইবো স্পন্দন,
হইয়া উঠিব তা’র মতন, রাখিবে সে স্নেহভরা কোলে।
আমি তো কেউ নই! তুমি কে? || এমিলি ডিকিনসন
আমি তো কেউ নই! তুমি কে?
তুমিও কি কেউ নও?
তারমানে আমরা যুগলবন্দী—কাউকে বলো না যেন!
তারা আমাদের নাই করে দিবে, জানো তো...
কেউ একজন হওয়া কী দুঃসাহসিক!
কী পার্থিব চাওয়া, ব্যাঙের মতো
দিনভর ডেকে ডেকে নিজের নাম বলে যাওয়া
কোন এক তোশামোদে শৈবালের কাছে!
উৎস লিংক: Louise Glück-Nobel Lecture-NobelPrize.org
Copyright © The Nobel Foundation 2025
Bengali Copyriht © pratidhwanibd.com
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন