বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলগুলোর পরিবর্তন কেন পিছিয়ে?

গত শতাব্দীর বিশ দশকে যখন টেলিভিশন আবিস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯২৬ সালে। বৃটিশ বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিস্কারের সময় থেকেই সমান্তরালে পৃথিবীতে কিছু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে, বিশ্ব রাজনীতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের উত্থান, শিল্প বিপ্লবের ক্রমাগত সাফল্যের পর দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি, নগরায়নের বিকাশ সর্বোপরি অর্থনৈতিক মহামন্দা। এতসব ঘটনার পাশ ঠেলে ১৯৩৬ সালে বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) শুরু করে নিয়মিত সমপ্রচার। সে সময়ে খুব দ্রুততার সাথে একের পর এক প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে সমাজে ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রসার ঘটতে শুরু হয় ব্যাপকভাবে। এই সুযোগে বাণিজ্যিকভাবে বিনিয়োগ হতে শুরু হয় টেলিভিশন সেট উৎপাদন ও বিপনন প্রক্রিয়ার। ফলশ্রুতিতে জনপরিসরে সাধারণ মানুষের নাগালে আসে টেলিভিশন। দ্রুত জনপ্রিয়তাও পায়। সে সময়ে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালায় কঠোরভাবে সামাজিক মূল্যবোধকে গুরত্ব দেয়া হতো। এরই মধ্যে শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তেজনা ও অস্থিরতা এবং চূড়ান্তভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ফলে টেলিভিশনের অগ্রগতি কিছুটা স্থিমিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুতগতিতে প্রসারিত হতে থাকে টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারের যন্ত্রপাতি ও সেট নির্মাণের প্রযুক্তি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থাপিত হতে থাকে টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের হুমকীর কারণ হিসাবে রেডিও এবং টেলিভিশনের সম্প্রচার সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। দিনের পর দিন প্রমাণিত হতে থাকে টেলিভিশন হচ্ছে একটি দেশের আর্থসামাজিক ও সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তারকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যে কোন রাষ্ট্রে কিংবা জনগোষ্ঠীতে প্রামাণ্য দলিলসহ সঠিক তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, বৈচিত্র্যময় সমাজের রূপ তুলে ধরাসহ সুষম বিন্যাস, সামাজিক ন্যায্যতা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় রেডিও এবং টেলিভিশনের ভূমিকা অপরিসীম।
১৯৪৭ সালে আমাদের এই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক ও ভৌগলিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাধ্যমে। পাশাপাশি টেলিভিশনের জগতেও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৯৪৮ সালে। ‘জো ফ্র্যাংকলিন শো’ নামে শুরু হয় প্রথম টক শোয়ের যাত্রা। এভাবেই পঞ্চাশের দশকে টেলিভিশন কনটেন্টে যোগ হতে থাকে বিভিন্ন মাত্রার, বিভিন্ন বিষয়ের অনুষ্ঠানমালা, সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে নাটক। তখন থেকেই প্রকট হতে থাকে বিশ্ব রাজনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধের টেনশন। আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদের প্রসার ঘটানোর জন্যে ক্রমশই টেলিভিশন অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয় মনোজগতে উপনিবেশ গড়ার হাতিয়ার হিসাবে। সেই কারণে বিস্তৃত হতে থাকে উদ্দেশ্যমূলক ও প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান, নাটক ও চলচ্চিত্রের সম্প্রচার বিতরণ নেটওয়ার্ক। পরিধি বাড়তে থাকে টেলিভিশন কনটেন্টের বাজার এবং আন্তঃদেশীয় তথ্য, বিনোদন ও সংস্কৃতির বিনিময়। জাপানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়াসুজারু ওজু সেখানকার সমাজ জীবনে তৎকালীন সময়ের আধুনিক পরিবারের ড্রয়িং রুমের নতুন সদস্য টেলিভিশনের প্রভাব নিয়ে ১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেন বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্র ‘গুড মর্নিং’। ছবিটিতে শুধু জাপানের সমাজ বাস্তবতাই চিত্রিত হয়নি সারা পৃথিবীর টেলিভিশন প্রভাবিত নতুন সমাজের এক জীবন কাহিনী ফুটে ওঠে।
ভারত-পাকিস্তান ভাগ হবার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার জন্য ক্রমশই আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। আন্দোলনকে দমন করার জন্যে, অপতথ্য বা ভুল তথ্য, সরকারের নিজস্ব মতামত, ভাষ্য এবং গঁৎবাধা বিনোদন দিয়ে জনসাধারণকে আন্দোলন বিমুখ করার জন্যে পাকিস্তানি শাসকবর্গ ঢাকায় টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র চালু করে ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। উল্লেখ্য, ভারত এবং পাকিস্তানে টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় কারিগরিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ টেলিভিশন সম্প্রচারকেন্দ্র চালু হয়। তারপর চালু হয় পাকিস্তানে, সব শেষে ভারতে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মনে করতেন যেকোন সমাজে টেলিভিশন সম্প্রচারের চেয়ে রেডিও সম্প্রচার অধিক গুরত্বপূর্ণ, তাৎপর্যময় এবং কার্যকর। ভারতের মতো স্বাধীনতা পররর্তী পুনর্গঠন ও চ্যালেঞ্জের সময়ে তা আরো সত্য। তিনি রেডিও সম্প্রচারের উপর জোর দিয়েছিলেন। তার মতে, টেলিভিশন সমাজের শুধুমাত্র বিত্তবানদের একটি বিনোদন ও বিলাসের সঙ্গী হয়ে উঠবে। তথ্যপ্রচারে ক্ষমতাবানদের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে। ভারত রাষ্ট্রে টেলিভিশনের বিকাশ প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর হাত ধরে। এ নিয়ে ভারতে একটি একটি কৌতুক রয়েছে, ‘জওহরলাল নেহেরু ওয়াজ এ ভিশনারি। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ওয়াজ এ রি-ভিশনারি। ইন্ধিরা গান্ধি ওয়াজ এ টেলিভিশনারি।’
জাপানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়াসুজারু ওজু সেখানকার সমাজ জীবনে তৎকালীন সময়ের আধুনিক পরিবারের ড্রয়িং রুমের নতুন সদস্য টেলিভিশনের প্রভাব নিয়ে ১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেন বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্র ‘গুড মর্নিং’। ছবিটিতে শুধু জাপানের সমাজ বাস্তবতাই চিত্রিত হয়নি সারা পৃথিবীর টেলিভিশন প্রভাবিত নতুন সমাজের এক জীবন কাহিনী ফুটে ওঠে।
১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে কাজ শুরু করে এনইসি টেলিভিশন গ্রুপ। পরবর্তী সময়ে এর নাম হয় ঢাকা টেলিভিশন। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ উদ্বোধনী দিন থেকেই ঢাকা টেলিভিশন পাকিস্তান সরকারের প্রচারযন্ত্র হিসাবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যম্যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোন ধরনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানের মতো সেই একইভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রচারযন্ত্র হিসাবে কাজ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ধারবাহিকভাবে রাজনৈতিক পালা বদল ঘটলেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোন ধরনের পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ একঘেয়েমি বিনোদনের জন্যে বিটিভিকে কিছুটা নির্ভর করলেও দেশীয় সংবাদ ও তথ্যের জন্যে বিদেশি রেডিও এবং দেশের পত্রিকারগুলোর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলো।
গত শতকের নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর বিশ্বব্যাপী ব্যাপক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে এবং বদলে যায় বিশ্ব মানচিত্র। অবসান হয় স্নায়ুযুদ্ধের। সারা পৃথিবীতে শুরু হয় অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতিমালার প্রয়োগ। অবাধ মুক্তবাজারের সবচেয়ে বড় ঢেউ লাগে টেলিকম্যুনিকেশন্স এবং তথ্য প্রযুক্তিখাতে। সেই থেকে ক্রসবর্ডার, ট্রান্সবর্ডার টেলিভিশন সম্প্রচার কিংবা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের শুরু। এইখাতে অপার সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি হয় ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মহা পরাক্রমশালী আকাশ সংস্কৃতির বাঁধভাঙ্গা মুক্ত যাত্রা তখন থেকে। সারা পৃথিবীজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে। স্যাটেলাইট টেলিভিশন জনজীবনে বিভিন্ন দিক থেকে প্রভাব বিস্তার করে অর্থাৎ মিডিয়ার ব্যক্তিকরণ, অবাধ তথ্য প্রবাহ, বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানমালা, একটি সমাজের বহুস্বরের উত্থান, পাশ্চাত্য সমাজের বাঁধভাঙ্গা প্রভাব কিংবা সংস্কৃতির আদান-প্রদান। সংস্কৃতির বৈশ্বিকরণে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে বেসরকারিখাতে টেলিভিশন সম্প্রচার। সেসময়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনজীবনে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রভাব দেখিয়ে বিভিন্ন দেশের কেইস স্ট্যাডি নিয়ে ভারতীয় যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ নূপুর দত্ত নির্মাণ করেছিলেন প্রামাণ্যচিত্র ‘মাইকেল জ্যাকসন ইন মানিকগঞ্জ’।
বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ব টেলিভিশন তার সরকার নিয়ন্ত্রিত চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখেও বিবিসি ও সিএনএন সম্প্রচার শুরু করেছিলো তখন। এটি অবাধ তথ্যপ্রবাহের একটি ভালো উদাহরণ ছিলো। এ দুটি নিউজ চ্যানেল ইংরেজি ভাষায় হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। একই সময়ে বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল এটিএন বাংলা চালু হয় শুধুমাত্র বিনোদন অনুষ্ঠান নিয়ে, পরবর্তী সময়ে চ্যানেল আই। এই চ্যানেল দুটিতে বিটিভি কেন্দ্রিক গতানুগতিক অনুষ্ঠানমালা কোন ধরনের সাড়া জাগাতে পারেনি। ঠিক তখনই বাংলাদেশে একুশে টেলিভিশন শুরু হয়। এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা মিডিয়ার জগতে। দেশের প্রথম বেসরকারি ভূ-কেন্দ্রিক টেলিভিশন অর্থাৎ কোন ধরনের ডিসলাইন ছাড়া বিটিভির মতো সাড়া দেশের মানুষ দেখতে পারতো। খুব অল্পদিনেই জনপরিসরে অনেক আগ্রহের সৃষ্টি করে। পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান, সংবাদ পরিবেশন এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিষয়ক অনুষ্ঠানের জন্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। একুশে টেলিভিশন প্রমাণ করে তথ্য ও বিনোদনের প্রতি মানুষের রয়েছে ব্যাপক তৃষ্ণা। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচার সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় শুরু হয়। একুশে টেলিভিশন অল্পদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক বিবেচনায় স্যাটেলাইট চ্যানেলের ‘টেলিভিশন বাবল’ দেখা দেয়। ফলে টেলিভিশন মালিকানায় যোগ হয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, ঋণখেলাপী, বিদেশে মুদ্রা পাচারকারীসহ জনস্বার্থরোধী লোকজন। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত দুটি মুল কনটেন্ট সংবাদ ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিষয়ক অনুষ্ঠানমালা এবং বিনোদন অনুষ্ঠান, নাটক এবং সিনেমা যে ব্যবসায়িকভাবে গুরত্বপূর্ণ পণ্য তা কেউ না ভেবে টেলিভিশনকে ক্ষমতার হাতিয়ার এবং সমাজে বিভিন্ন সুবিধাভোগের অস্ত্র হিসাবে দেখা হয়েছে। একঘেয়েমি পূর্ণ কনটেন্ট দর্শকরা মুখ ফিরিয়ি নেয়ার কারণে এক পর্যায়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষায়িত রূপ নেয়। যেমন, সংবাদ বিষয়ক ও বিনোদন বিষয়ক।
বাংলাদেশের সংবাদ ভিত্তিক টেলিভিশন দাঁড়াতে না পারার প্রধান সমস্যা হলো সংবাদের উপর শাসকবর্গের খবরদারী, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, দলীয় রাজনীতির সাথে সাংবাদিকদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা এবং সেল্ফ সেন্সরশিপ। এসব কারণে সংবাদভিত্তিক গণমাধ্যমের প্রধান বিষয় বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা বজায় থাকে না। ফলে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিনোদন ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর চ্যালেঞ্জ আরো জটিল এবং বহুমুখী। প্রথমত, নতুন নতুন আইডিয়া বা কনটেন্টের অভাব। কনটেন্টে নিয়ে চিন্তাভাবনা একবারে নেই বললেই চলে বাংলাদেশে। দ্বিতীয়ত, দেশীয় চ্যানেলে চ্যানেলে প্রতিযোগিতা। তৃতীয়ত, বিদেশি চ্যানেলের জমকালো সব অনুষ্ঠান এবং চতুর্থত, দিনের পর দিন সম্প্রচার প্রযুক্তির উন্নয়নের বক্স টেলিভিশনের বিকল্প ‘আউট অব বক্স টেলিভিশন’ হয়েছে। বক্স টেলিভিশন হচ্ছে প্রচলিতভাবে আমরা বক্সের মাধ্যম্যে যে টেলিভিশন দেখি। এর অনুষ্ঠানমালা নির্মাণে পরিবার, সমাজ, দেশের মূল্যবোধ, আইন মাথায় রাখতে হয়। সম্প্রচারের ধরন লিনিয়ার অর্থাৎ একটার পর একটা সূচি অনুযায়ী প্রচার হতে থাকে। দর্শক নিজের ইচ্ছায়, নিজের সময় অনুয়ায়ী দেখতে পারে না। আউট অব বক্স টেলিভিশন হলো একেবারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ডিভাইস যেমন, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, আইপ্যাড কিংবা ডেক্সটপ আবার প্রচলিত টিভি সেটেও দেখা যায়। দর্শক নিজের ইচ্ছায় এবং নিজের সময় অনুযায়ী দেখতে পারে। এসবের কনটেন্ট নির্মাণে কোন সামাজিক নিয়ম-নীতি, মূল্যবোধ মাথায় রাখতে হয় না। সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রেও কোন ধরনের যাচাই-বাছাই প্রয়োজন হয় না। বিষয়বস্তু হতে পারে খুবই ব্যক্তিগত এবং তা দেখার ক্ষেত্রেও। যেমন: ইউটিউব, টিকটক অথবা যেকোন ওটিটি প্ল্যাটফরম। মোটকথা ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে ‘বক্স টিভি’র সমান্তরাল প্রতিদ্বন্দ্বী ‘আউট অব বক্স টিভি’। যে কোন দেশের আউট অব বক্স টেলিভিশনের রিচ নির্ভর করে সে দেশের ইন্টারনেট প্রসারের পরিধির ওপর। বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট চালু হলে আউট অফ বক্স টিভির ব্যবহার আরো বিস্তৃত হবে ফলে ব্ক্স টিভি অনেক বির্পযয়ের মুখোমুখি হবে।
টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা মূলত দুটি। এক, চ্যানেল দৈনিন্দন অফিস ব্যবস্থাপনা ও তার সার্বিক সমন্বয়। দুই, চ্যানেলের স্ক্রিন ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ চ্যানেলে কোন অনুষ্ঠানের পর কোন অনুষ্ঠান ব্রডকাস্ট হবে কখন বিজ্ঞাপন, কখন ফিলার যাবে। এই কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট বা ডিজাইনের উপর নির্ভর করে টিভি চ্যানেলের রুচিবোধ, নান্দনিকতা বা দর্শকের সাথে যোগসূত্র তৈরির সামগ্রিক চিন্তাভাবনা।
টেলিভিশন একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া দিনের পর দিন কার্যকর হয় মূলত ব্যবস্থাপনার ওপর। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের ব্যবস্থাপনাই গতানুগতিক অন্য আরো দশটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো। এর ফলে কর্মীদের মধ্যে আভ্যন্তরীন দলাদলি, কোন্দল কাজের সুষ্ঠু পরিবেশকে ব্যাহত করে। কিন্তু টেলিভিশন ব্যবস্থাপনা একেবারেই ভিন্ন হওয়ার কথা। সামাজিক মাধ্যম সর্বব্যাপী হওয়ার কারণে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে একটি সংকট বেশ প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। এই ভেতরের বিষয়গুলো দৃশ্যমান হওয়ার কারণে বাইরে থেকেও দুর্বল ব্যবস্থাপনা বুঝতে পারা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম্যে দেখা যায় ভিউ এবং লাইক কামানোর জন্যে টিভি চ্যানেলে কর্মরত সাংবাদিক, প্রযোজক কিংবা উপস্থাপক চ্যানেলে তথ্য ব্রডকাস্ট হওয়ার আগে অথবা পরে স্ট্যাটাস দিয়ে, ভিডিও ব্লগ হিসাবে সামাজিক মাধ্যম্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এমনও দেখা যায় চ্যানেলের নিউজ রুম, স্টুডিও, অফিস থেকে ভিডিও রিলস প্রচার করেন। এই জায়গা গুলো যেন নির্বিঘ্ন শুটিং স্পট। এতে করে যা হয় তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক পণ্যের ক্ষতি করছেন। এইসব তৎপরতা প্রতিষ্ঠান বিরোধী তো বটেই তিনি তার চ্যানেলের প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডিং নষ্ট করে দিচ্ছেন। কোন না কোনভাবে কনটেন্টের প্রতি দর্শকের আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছেন। এই ক্ষতি চ্যানেলের, লগ্নিকারক প্রতিষ্ঠানের। অনেক সময় এও দেখা যায় নিউজ রুম, স্টুডিও, ব্রডকাস্ট রুম কিংবা চ্যানেলের কর্মক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন শো-বিজ জাতীয় বাহারী, ফ্যাশন শোয়ের মতো এক বা একাধিক পোজ দিয়ে সামাজিক মাধ্যম্যে দিচ্ছেন দিনের পর দিন। এটিও দর্শকদের মানসপটে টেলিভিশনের কনটেন্টের প্রতি নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা মূলত দুটি। এক, চ্যানেল দৈনিন্দন অফিস ব্যবস্থাপনা ও তার সার্বিক সমন্বয়। দুই, চ্যানেলের স্ক্রিন ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ চ্যানেলে কোন অনুষ্ঠানের পর কোন অনুষ্ঠান ব্রডকাস্ট হবে কখন বিজ্ঞাপন, কখন ফিলার যাবে। এই কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট বা ডিজাইনের উপর নির্ভর করে টিভি চ্যানেলের রুচিবোধ, নান্দনিকতা বা দর্শকের সাথে যোগসূত্র তৈরির সামগ্রিক চিন্তাভাবনা।
একটি সুসংহত গণতান্ত্রিক সমাজ, বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক বিকাশ, বহু মত ও অবাধ তথ্য সরবরাহের জন্যে দেশে অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো টিভি চ্যানেল প্রয়োজন। এটি শুধু গণমাধ্যম হিসাবেই কাজ করে না অনেক পেশাজীবী মানুষের কর্মসংস্থান করে। এর সাথে যারা জড়িত আছেন তারা তো বটেই দেশের সরকারের দায়িত্ব রয়েছে এই খাতকে সুরক্ষা দেয়া। আমি বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রার প্রায় শুরু থেকেই সহযাত্রী হিসাবে দেখে আসছি। (২০০৯ সালে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম ‘সুরক্ষিত করা হোক বেসরকারি টেলিভিশন খাত’)। বেসরকারি টেলিভিশনের সুরক্ষা মানে তাকে শুধু আর্থিক সাহায্য দেয়া নয়। টেলিভিশনের আসল কাজ করতে, নির্বিঘ্নে গণমাধ্যম্যের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে দেয়াই তাকে প্রকৃত সুরক্ষা দেয়া।
টেলিভিশন একটি ‘কমিউনিটি আর্ট’। দলগত প্রচেষ্টায় এর চূড়ান্ত ফলাফল আসে। কাজের সুবিধার জন্যে একটি চ্যানেলে অনেকগুলো বিভাগ থাকে। প্রতিটি বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি আরেকটির পরিপূরক। কেউ এককভাবে যদি মনে করে নিজের উন্নয়ন ঘটাবেন অথবা তার বিভাগের উন্নয়ন ঘটাবেন তাহলে সামগ্রিক টেলিভিশনের উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তাতে করে নিজেদেরকে একটি ইন্টারেস্ট গ্রুপ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। সার্বিক উন্নয়নের জন্যে সবাইকে নিয়েই সমন্বিত উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচার সরকারি ও বেসরকারি দুইভাবে হয়। সরকারি খাতে একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিটিভির গ্রহণযোগ্যতা ও গুণগত মান উন্নয়নের একমাত্র সমাধান বিটিভিকে স্বায়ত্বশাসন দেয়া। বিটিভির স্বায়ত্বশাসনের জন্যে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর তিন জোটের রূপরেখায় অন্যতম দাবী ছিলো। এই স্বায়ত্বশাসনের ধরন কেমন হবে তার একটি ধরন প্রণয়নের জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামনকে প্রধান করে একটি কমিটি করাও হয়েছিলো। এটি আর আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তী সময়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দল বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রসার এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আইন ২০০১ দেখিয়ে বিটিভির স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি সুকৌশলে এড়িয়ে যান। (৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ দৈনিক প্রথম আলোয় বিটিভির স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি উত্থাপন করে বলি ‘স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আইন ২০০১’।) এখনও বলি, বাংলাদেশ টেলিভিশনকে যথাযথ গণমাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। রাষ্ট্রায়াত্বের নামে এখন যা চলছে জনগণের টাকায় চালিত প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন জনগণের সামনে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে মিথ্যা সংবাদ, অসত্য, অপতথ্য পরিবেশন করে যাচ্ছে।
এতদিন হয়ে গেলো এখন পর্যন্ত বেসরকারি টেলিভিশনখাতের সীমানা নির্ধারণ হয়নি। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয় যারা শুধু অফিসিয়ালি চাকরি করেন শুধু তারাই অন্তর্ভূক্ত, কিন্তু এর পরিধি আরো ব্যাপক এবং বিস্তৃত। বেসরকারি টিভিখাতের সাথে অফিস কাঠামো বাদে বাইরে থেকে অনেক দৃশ্যমান পেশাজীবী জড়িত, ঠিক তেমনি অনেক অদৃশ্য পেশাজীবীও জড়িত ফলে খাত হিসাবে খুব ছোট নয়।
বেসরকারি টেলিভিশন সম্প্রচার নীতিমালা, পরিবেশন নীতিমালা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনার সূযোগ রয়েছে। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনকে ইউটোপিয়ান ভাবনা মনে হতে পারে কিন্তু তা সম্ভব। বাংলাদেশ কোন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের নিজস্ব গাইড বুক অথবা সম্পাদকীয় নীতিমালা লিখিত আকারে সবার জন্যে প্রকাশিত আকারে নেই। যা পৃথিবীর প্রায় সব টিভি চ্যানেলের রয়েছে। হয়তো কাজের জন্যে সবাই একটা নীতিমালা অনুসরণ করেন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এই নীতিমালা এক বসায় কিংবা সাতদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে তা নয়। এটি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পরিবর্ধন, পরিমার্জনের পর একটি কাঠামোগত রূপ পায়। খুব মোটাদাগের একটি উদাহরণ শুরুর একুশে টিভিতে সংবাদ, অনুষ্ঠান, নাটক কিংবা সিনেমার মাঝখানে বিজ্ঞাপন শুরু হতো তখন টিভি সেটের পর্দায় একুশে টিভির লোগো দেখা যেতো না, কারিগরীভাবে তা সরিয়ে নেয়া হতো। কারণ বিজ্ঞাপনের ভাষা, পন্য বিষয়ক তথ্য বা বার্তার দায় একুশে টিভির নয়। অর্থাৎ যুগের পরিবর্তেনর সাথে খাপ খাইয়ে নিজেদের পরিবর্তিত করা।
একটি দেশের যে কোন টিভি চ্যানেলগুলোর সবচেয়ে বড় সংবেদনশীল পরিবেশনা হচ্ছে টক শো। বাংলাদেশে বিভিন্ন চ্যানেলে অনেক টক শো সম্প্রচারের ফলে একঘেয়ে, এটি একটি মেধাহীন কাজে হয়েছে। কনটেন্টের দিক থেকে একজন উপস্থাপক এবং দুই জন গেস্ট হলেই তা ব্রডকাস্ট করা যায়। এই নিন্দিত টক শো আমূল পাল্টে দিয়ে খুবই জনপ্রিয়, নন্দিত ও অর্থবহ করার সুযোগ রয়েছে। টক শোগুলো দিনের পর দিন অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য, মনগড়া কথা-বার্তা ছড়িয়ে সাধারণ দর্শকের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। টক শো নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
একটি দেশের যে কোন টিভি চ্যানেলগুলোর সবচেয়ে বড় সংবেদনশীল পরিবেশনা হচ্ছে টক শো। বাংলাদেশে বিভিন্ন চ্যানেলে অনেক টক শো সম্প্রচারের ফলে একঘেয়ে, এটি একটি মেধাহীন কাজে হয়েছে। কনটেন্টের দিক থেকে একজন উপস্থাপক এবং দুই জন গেস্ট হলেই তা ব্রডকাস্ট করা যায়। এই নিন্দিত টক শো আমূল পাল্টে দিয়ে খুবই জনপ্রিয়, নন্দিত ও অর্থবহ করার সুযোগ রয়েছে। টক শোগুলো দিনের পর দিন অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য, মনগড়া কথা-বার্তা ছড়িয়ে সাধারণ দর্শকের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।
বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর বর্তমান কাঠামোতে ইজরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূমির কথা মনে করিয়ে দেয়। একটি চ্যানেলের মূল শক্তি হিসাবে কাজ করার কথা টিভি চ্যানেলের সব প্রযোজকদের, প্রযোজনা বিভাগের। প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে কাঠামোগতভাবে তাদের আসল কাজ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে দিনের পর দিন। এটি করেছেন চ্যানেলে কমর্রত কতিপয় সাংবাদিক। তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কারণে। ফলে প্রযোজকদের শুধু কারিগরী বিষয়ক কাজ বাদে অনুষ্ঠানের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণের জায়গাটি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে একটি অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্যে যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রয়োজন তা নেই এবং সম্পাদকীয় নীতিমালা সমুন্নত রাখার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। ফলে অনুষ্ঠান নির্মাণে এক ধরনের একচ্ছত্র আধিপত্যের, কর্তৃত্বপরায়নতা দেখা দেয়। অনুষ্ঠানকে ঘিরে তৈরি হয় বাড়তি সুযোগ সন্ধান ও অসদুপায় অবলম্বনের পথ। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এটি মূলত সংবাদ বিষয়ক চ্যানেলগুলোতেই বেশি হয়ে থাকে। চ্যানেলের এই প্রযোজকদেরকে তাদের কাজের আসল জায়গা এবং অংশগ্রহণদারিত্ব ফিরিয়ে দিয়ে সক্রিয় করে তুলতে হবে।
বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশনের আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো টেলিভিশনের নামকরণ। এই নাম দিয়েই প্রবেশ করে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। অতীতে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। নামের কারণেই হয়ে উঠেছে রাজনৈতিকভাবে চতুর এবং সুবিধাভোগী। যেমন, একুশে, বায়ান্ন, একাত্তর, বিজয় ইত্যাদি—তবে সবাই এমন করেছেন তা নয়।
বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেল যাত্রার শুরু থেকেই যে দুর্বলতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে তা হলো টিভি চ্যানেলের গঁৎবাধা, ক্লিশে বাজার ও বিপণন ব্যবস্থা। টিভি চ্যানেলে নির্মিত এবং পরিবেশিত কনটেন্ট যেমন সংবাদ, সংবাদ বিষয়ক অনুষ্ঠান, নাটক, বিনোদন অনুষ্ঠান এবং সিনেমা এইসব এক একটি পণ্য। এইসব পণ্য আর সব পণ্যের মতো সাধারণ নয়, বিশেষায়িত পণ্য। কিন্তু দিনের পর দিন অন্যান্য সাধারন পণ্যের মতোই বিপণনও বাজারজাতকরনের ফলে সামাজিক দায়সম্পন্ন, জনগুরুত্বপূর্ণ এই পণ্য বাজারটি অবিকশিত রয়েছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এটি একটি বিশাল দুর্বলতা।
বেসরকারি টেলিভিশনের পরিবর্তন করতে চাইলে শুধুমাত্র গণমাধ্যম্যের চোখে দেখলে হবে না। বেসরকারি টিভি চ্যানেলের আয়ের উৎস যেহেতু ব্যবসা সুতরাং গণমাধ্যম, ব্যবসা এবং সামাজিক বাস্তবতা এইসব কিছুর সমন্বিত রূপে দেখতে হবে। না দেখলে কোনভাবেই পরিবর্তন সম্ভব নয়। সর্বোপরি টিভি চ্যানেলের কোম্পানী আইন এবং বিজনেস মডেল নিয়ে প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। যেহেতু প্রচলিত সব নিয়ম ও ব্যবস্থাই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়েছে, সেহেতু বিকল্প ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এটি কোন চ্যানেলের একক কাজ নয়, সমন্বিতভাবে করতে হবে। এমন একটি নিয়ম গ্রহণ করতে হবে যাতে করে হাতে টাকা থাকলেই আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে লাইসেন্স নিয়েই এই ব্যবসায় উৎসাহী না হয়।
টিভি চ্যানেলের বিনিয়োগে সমাজের সচেতন দায়িত্বশীল মানুষেরা যাতে এগিয়ে আসেন সেই জন্যে সামজিক ব্যবসার মডেল গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সামাজিক ব্যবসা কি? সামাজিক ব্যবসা হলো এমন একটি ব্যবসায়িক মডেল যার উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা অর্জন নয়। মুনাফা করার সাথে সাথে সামাজিক দায় ও দায়িত্ব পালন। গণমাধ্যম যেহেতু একটি সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান সেহেতু সামাজিক ব্যবসা বা সোশ্যাল বিজনেস মডেলের জন্যে পরিপূরক এবং অধিকতর কার্যকর। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, এটাই গণমাধ্যমের বর্তমান এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। এই মডেলের ব্যবসায়িক মালিকানা ব্যক্তিগত নয় এবং এর মুনাফা কেউ এককভাবে নিতে পারে না। কোম্পানী এবং কোম্পনীতে কর্মরত সবাই এই মুনাফার মালিক। এর লভ্যাংশ পুনরায় তা কোম্পানীর আকার বৃদ্ধির জন্যে বারবার চক্রাকারে বিনিয়োগ হতে থাকবে। এখানে যারা কাজ করবেন যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন ভাতা পাবেন। প্রচলিত বাজারের নিয়ম অনুযায়ী, আধুনিক কাজের পরিবেশে। প্রাথমিকভাবে যারা অর্থ লগ্নী করবেন তারা শুধু লগ্নীকৃত অর্থ ফেরত পাবেন। কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডার বা মালিক হবেন কর্মরত কলাকুশলী, সাংবাদিক ও অন্যান্য বিভাগের কর্মীবৃন্দ। আইন অনুযায়ী প্রতিবছর কোম্পানীর ডিভিডেন্ট বিতরণ হবে শেয়ার হোল্ডারদের মধ্য। প্রতিষ্ঠানের কোন সিদ্ধান্ত এককভাবে কেউ গ্রহণ করতে পারবেন না। একচ্ছ্ত্র আধিপত্য কারও থাকবে না। এর ফলে সামাজিক দায়ব্দ্ধতা, পেশাগত সুরক্ষা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। টেলিভিশন হয়ে উঠবে একটি সুসংহত গণমাধ্যম। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বিশ্ব নন্দিত অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস এই মডেল প্রবর্তন করেন এবং ক্রমশই তা সামাজিক উদ্যোক্তাদের কছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও কার্যকর হয়ে উঠছে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন