নিয়তি ও প্রেম

অ+ অ-

 

নব্বইয়ের দশক।

আজ জান্নাত মানে আমার প্রেয়সীর বিয়ে হয়ে গেল। আমাকে দাওয়াত করেছিল। যাব নাকি যাব না এই নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলাম। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম নীরবে যাব। তারপর যে Love poems-এর বইটা কিনেছি সেটা গিফট করে নিভৃতে চলে আসব। করলামও তাই। এমনভাবে গেছি যেন কোন ক্লাসমেটের সাথে দেখা না হয়। না খেয়ে সবার অলক্ষ্যে শুধু বইটা দিয়ে চলে এসেছি। এই বইটা কিনেছি কারণ এতে Swinburne-এর A Leave Taking কবিতাটা আছে। ওটা আমার প্রিয় কবিতাগুলোর একটা। জান্নাত আমাকে কখনও ভালবাসেনি।

মাস তিনেক আগের কথা। সেদিন ওর পরনে ছিল হলুদ রঙের জর্জেটের কামিজ আর সাদা রঙের সালোয়ার এবং ওড়না। হলুদ পোশাকে ওকে দারুণ সুন্দর লাগত। হালকা লাল রঙের লিপস্টিক দেয়া পাতলা ঠোঁটের হাসি দেখলে যে কারও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাবে। রোদে ঘুরলে ওর ফর্সা গালে লাল আভা তৈরি হতো। সেটা দেখলে ভালও লাগত, আবার মায়াও জন্মাত। ওর সিল্কি স্যাম্পু করা ঝকঝকে কালো চুলের সাথে কেবলমাত্র মডেলদের চুলেরই তুলনা চলে। সেদিন একটি কাল গোলাপ হাতে নিয়ে ক্যাম্পাসে ওকে বলেছিলাম, তোমার সাথে কিছু কথা আছে। আর এই গোলাপটা তোমার জন্য। সে মৃদু হেসে বলেছিল, তোমার গোলাপ আমি নিতে পারব না। আর তুমি কি বলতে চাও সেটা আমি জানি। সুতরাং সেটা বোলো না। একথা বলে সে হনহন করে হেঁটে রিকশায় উঠে বাসায় চলে গেল। তারপর থেকে আমার সাথে আর কখনও কথা বলেনি। শুধুমাত্র ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বিয়ের কার্ডটা হাতে দিয়ে বলেছিল, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ইচ্ছে হলে এসো। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ওর বিয়ে হলো। সে বিয়ে করল একজন ধনী শিল্পপতিকে। অঢেল টাকা আছে। বাড়ি-গাড়ির কোন অভাবই নেই। বিলাসী জীবন-যাপন করতে পারবে জান্নাত। আমার কি আছে? টাকা-পয়সা, ব্যাংক-ব্যালেন্স, বাড়ি-গাড়ি কিচ্ছু না। ঢাকা শহরে থাকার মতো তিন কাঠা জায়গাও নেই। কোন চাকরি-বাকরিও নাই। মাস্টার্স পাশ করতে আরো বছর খানেক লাগবে। পাশ করার পরও কেমন চাকরি পাব বা আদৌ কোন চাকরি পাব কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং আমার মতো ছন্নছাড়াকে কে বিয়ে করবে?  এর চেয়ে প্রাক্টিক্যাল হওয়া অনেক ভাল। জান্নাত প্রাক্টিক্যাল হয়েছে। সে আয়েশি জীবন-যাপন করতে পারবে। সে জৌলুশের মধ্যে থেকে বিলাসী জীবন-যাপন করতে পারবে। সে বৌ সাজলে কি রকম অদ্ভুত সুন্দর লাগবে সেটা দেখার কৌতূহল ছিল। কিন্তু সেই ধকল আমি সইতে পারব না। তাই ওর স্টেজের কাছে যাওয়ার লোভ অনেক কষ্টে সংবরণ করেছি।

আজ শীত পড়েছে অনেক। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে ওর বিয়ে হলো। ওখান থেকে বেরিয়ে আমি জ্যাকেটের চেইনটা গলা পর্যন্ত টেনে লাগিয়ে দিলাম। পকেটে থেকে সস্তা সিগারেট আর দিয়াশলাই বের করে একটা ধরালাম। আকাশের দিকে ধুয়া ছাড়লাম। ধোয়ারা কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে আকাশে চলে গেল। আজ আকাশে কোন মেঘ নেই। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। তাই বড় একটা গোলাকার চাঁদ আকাশ থেকে আলো ছড়াচ্ছে সমস্ত শহরের উপর। জান্নাতের স্বামীর বাড়ির উপরও নিশ্চয়ই। সেই চাঁদটাকে ঘিরে রেখেছে অগণিত নক্ষত্রের দল। মিটমিট করে ওরা জ্বলছে। বাসা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারব না। তাই একটা রিকশা নিলাম। ঠাণ্ডা বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। এমনিতেই রাত দশটা বাজে তার উপর ছুটির দিন। এজন্য সড়কে যানবাহনের সংখ্যা কম ছিল। আমি বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই বাসায় চলে এলাম। 

বাসায় এসে দেখি সবাই রাতের খাবার খেয়ে ফেলেছে। আমরা চার ভাই। কোনও বোন নেই। বড়জন ইতালি থাকে। বাবা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হঠাৎ মারা যাওয়ার পর বড় ভাই বিদেশে চলে যায়। বড় ভাইয়ের পাঠান টাকায়ই সংসার চলে। তারপর আমি এবং এর পরের জন যথাক্রমে কলেজে এবং ক্লাস টেন-এ পড়ে। ঘরে ফিরে দেখি মা আমার জন্য কোন খাবার রাখেনি। বিয়ে বাড়ীতে গেলে কেউ কি না খেয়ে ফিরে? মা-কে কি করে বুঝাই যে ওই খাবার আমার গলা দিয়ে নিচে নামবে না। আবার এটাও বলতে পারছি না যে ওটা আমার প্রেমিকার বিয়ে। তাই বললাম, শরীরটা ভাল লাগছিল না। সেজন্য ওই খাবার খাইনি। মা আমার জন্য আবার ভাত চড়ালেন। সে রাতে আমি ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেলাম।

দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। আমাদের মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হবে যে কোন দিন। একদিন দেখি বিভাগের সব শিক্ষক এবং আমাদের ক্লাসমেটরা সবাই মিলে মিষ্টি খাচ্ছে। কি ব্যাপার কিসের মিষ্টি? কে খাওয়াচ্ছে? তখন শুনলাম জান্নাতের ছেলে হয়েছে। সে-ই সবাইকে এই উপলক্ষে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। সেই মিষ্টি আমিও খেলাম। এবার আর মানা করলাম না।

মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে যে যার মতো চাকরি খুঁজতে লাগলাম। মেয়েদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেল। কারো কারো চাকরি হলো। কিন্তু আমার হয় না। তাই আমি খুব ভালভাবে বিসিএস এবং অন্যান্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। একটা বেসরকারি ব্যাংকের মৌখিক পরীক্ষা ভালই দিলাম।

সেদিন সারাদিন ধরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশ ঘন কালো মেঘেরা ঢেকে দিয়েছিল। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগল দুপুরে। কাকগুলো ভিজে চুপসে গেছে। দালানকোঠা সব বর্ষণসিক্ত। মাকে হারিয়ে ফেলা বিড়াল ছানার কান্নার ধ্বনি অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। গলির মাথায় যে কাঁঠাল গাছটা আছে তার পাতাগুলো ভিজে কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। গলির ভিতরে কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি জমে গেছে। রিকশাগুলো সেই পানির উপর দিয়েই শব্দ করে করে যাচ্ছে আসছে। পারার দুএকটা কুকুর নির্মাণাধীন ভবনের নীচতলায় আশ্রয় নিয়েছে।   

এমন বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে ডাকপিয়ন এসে আমাকে খুঁজছে। একমাত্র আমার হাতেই দিবে খামটি। আমি নিতে গেলে বলল, বখশিশ লাগবে। ওকে বখশিশ দিয়ে বিদায় করে খামটি খুলে দেখি নিয়োগপত্র। অর্থাৎ আমার চাকরি হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ মা-কে খুশির সংবাদটা দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেই বেশি করে মিষ্টি নিয়ে এলাম পাড়া-প্রতিবেশীদের বাসায় বিতরণ করার জন্য।

চাকুরী করছি বছর খানেক হলো। একদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে জামা-কাপড় বদল করে হাত-মুখ ধুয়ে চা খাচ্ছি আর বিশ্রাম নিচ্ছি। এমন সময় মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তোকে একটা কথা বলব বলে ভাবছিলাম।

কি কথা মা?

না, মানে, তোর পড়া শেষ। এখন চাকরিও হলো। এবার সুন্দর দেখে একটা বউ ঘরে নিয়ে আয়।

সে-কি মা! ভাইয়ার আগে আমি বিয়ে করব?

না, সেটা নয়। তুই রাজি থাকলে তোদের দুজনের জন্যই মেয়ে খুঁজেতে পারি।

না, মা। আমাকে আর একটু সময় দাও। এখন ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখ। আগে ভাইয়া বিয়ে করুক। তারপর আমি করব।

মা বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে।

তখন থেকে মা ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলেন এবং তিন মাসের মধ্যে মেয়ে খুঁজে পেয়েও গেলেন। ভাইয়া দেশে এসে বিয়ে করে চলে গিয়ে ছ-মাসের মধ্যে বউ নিয়ে গেলেন। মা তখন আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলেন আবার।

শীতকাল চলে এলো দেখতে দেখতে। সেদিন অনেক শীত পড়েছিল। কুয়াশাও ছিল অনেক। প্রকৃতি নিজ হাতে সারা ঢাকা শহর ঢেকে দিয়েছিল কুয়াশার চাদর দিয়ে। সুউচ্চ ভবনের মাথাগুলো দেখা যাচ্ছিল না। বেলা বারোটা বেজে গেলেও সূর্যের দেখা মিলল না। রাস্তায় গাড়িগুলো দিনের বেলায় বাতি জ্বেলে চলাচল করছিল। রাস্তায় দুয়েকটা কুকুর কোনটা চটের উপর আবার কোনটা নির্মাণাধীন ভবনের জন্য ফেলে রাখা বালুর স্তূপের উপর শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। আমাদের অফিসের চড়ুইদের তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হলো না। তারা রাস্তার উপর নেমে এসে খুটে খুটে খাবার খেয়ে আবার গিয়ে জানালার কার্নিশে আশ্রয় নিচ্ছে। এতো শীত তাদের যৌন সঙ্গমে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। অফিস পাড়ার কাকগুলো খাবারের দোকানগুলোর কাছে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্টের জন্য ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। তাদের মাঝে কয়েকটি জংলী কবুতরও আছে। তিরতির করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। শিশিরে সিক্ত রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। বেলা বারোটার দিকে আমি মগ্ন হয়ে একটি ফাইল দেখছিলাম। এমন সময় একটি নারী কণ্ঠের কথা শুনলাম, আফসার, কেমন আছ? ওই নামটা তো আমারই। কে জিজ্ঞেস করল দেখার জন্য মাথা তুলে চাইতেই দেখি এক গাল হাসি দিয়ে আমার টেবিলের সামনে জান্নাত দাঁড়িয়ে আছে। ওর পরনে প্রিন্টের সুতির শাড়ি। চুল খোঁপা করা। আগের চেয়ে কিছূটা মোটা হয়েছে। পরিপূর্ণ নারীত্বে ভরা লালিত্য মাখা জান্নাত দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে। আমি বললাম, আরে তুমি যে! বসো, বসো। সে বলল, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। অফিসে ওর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারব না। তাই ম্যানেজারের কাছ থেকে দু-ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়ে আমরা পার্শ্ববর্তী একটি ভাল রেস্টুরেন্টে বসলাম।

খাবারের অর্ডার দিলাম। এরপর দুজনের আলাপচারিতা শুরু হলো। সে বলল, আরিফের কথা মনে আছে? আমাদের ক্লাসমেট আরিফ? ওর কাছ থেকে তোমার ঠিকানা এবং বিস্তারিত সব কিছু জেনে তোমাকে খুঁজে বের করেছি। আমার বিসিএসে চাকরি হয়েছে।

ভাল, খুব ভাল!

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই যে, আমার স্বামী আমাকে চাকরি করতে দেবে না!

কেন?

ওর কথা হচ্ছে, চাকরি করলে তুমি আর কয় টাকা বেতন পাবা। যে টাকা বেতন পাবা সেটা মাসে মাসে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিও। তুমি বলো, মানুষ কি শুধুমাত্র টাকার জন্যই চাকরি করে? মেয়েদের কি নিজের পায়ে দাঁড়াতে নেই?

অবশ্যই মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত।

সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে হয় চাকরি করবে, না হয় ওর সংসার করব। এ-দুটোর যে কোন একটি বেছে নিতে হবে। দুটোই এক সঙ্গে করা যাবে না। আমি বেছে নিয়েছি চাকরিকে। তাই যেদিন আমি চাকরিতে যোগদান করি সেদিন সে আমাকে ডিভোর্স দেয়।

তোমার জীবনে এরকম অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে শুনে কষ্ট লাগছে।

আমি তোমার কাছে এসেছি একটা কথা বলার জন্য। তুমি তো এক সময় আমাকে ভালবাসতে। এখনও কি বাসো?

তা তো বলতে পারব না। তবে তোমার জন্য আমার শুভকামনা সব সময় থাকবে।

সে লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল, তুমি তো এখনও বিয়ে করনি। তুমি কি এখন আমার চার বছরের ছেলেসহ আমাকে গ্রহণ করতে পারবে?

কিন্তু তুমি তো আমাকে কখনোই ভালবাসনি।

কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালবাসতে।

প্লিজ আফসার, আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি বড্ড নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি।

আচ্ছা, ঠিক আছে, আমাকে ভাববার জন্য একটু সময় দাও।

বাসায় এসে মাকে বললাম। প্রথমে রাজি হননি। পরে আর আপত্তি করলেন না। ছোট দু-ভাইও আপত্তি করল না। কিন্তু ভাইয়াকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। উনি বললেন আমি ওনার সাথে বেইমানি করেছি। যাই হোক, আমি আর জান্নাতকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না।