মানুষের চরিত্রের কোনো বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনশীল নয়: ওরহান পামুক

|| ওরহান পামুক ||
ওরহান পামুক ১৯৫২ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে একটি সমৃদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে পামুক চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। তিনি ইস্তাম্বুল কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন এবং আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালীন কোর্সে যুক্ত ছিলেন।
পামুক তাঁর প্রথম উপন্যাস জাভেদ বে ও তার পুত্রগণ (১৯৭২) থমাস মানের রচনাশৈলীর মতো একটা পরিবারের কয়েক প্রজন্মের পরিবর্তন চিত্রণ করেন। অনেকটা অটোমান ঐতিহ্য থেকে আধুনিক পশ্চিমা জীবনপ্রণালিতে স্থানান্তরের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করেন। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য সাইলেন্ট হাউস (১৯৮৩) এ পাঁচটি স্বতন্ত্র বয়ানকারীর স্বরে তুরস্কের চরমপন্থী রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনকে বর্ণনা করেন।
দ্য হোয়াইট ক্যাসেল (১৯৮৫) উপন্যাসটি ওরহান পামুককে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। উপন্যাসটির আখ্যানভাগ ১৭ শতকে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিবৃত হয়েছে। কিন্তু আমাদের ইগো কী করে কল্পনা ও গল্পের মিশেলে নির্মিত হয়, তারই এক অপূর্ব বয়ান। দ্য ব্ল্যাক বুক (১৯৯০) উপন্যাস তিনি মানুষের আত্মপরিচয়ের সন্ধানকে সামনে নিয়ে এসেছেন। বর্ণনাভঙ্গিতে তিনি ইসলামিক ঐতিহ্য ও সুফিবাদের সাংস্কৃতিক প্রবাহ ও দ্বন্দ্বকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
মাই নেইম ইজ রেড (২০০০) উপন্যাসে প্রাচ্য মরমিবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতীচ্যের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সম্পর্ককে বিবৃত করেছেন। ধ্রুপদি চিত্রশিল্পের সঙ্গে হত্যারহস্যে ভরা এক অম্লমধুর কাহিনি অনন্য দক্ষতায় তুলে এনেছেন।
যদিও পামুক নিজেকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাশূন্য একজন নিপাট কথাসাহিত্যিক বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন, কিন্তু তুরস্ক তাঁকে সমাজবিশ্লেষক হিসেবে বেশি চেনে। সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি নিয়ে তিনি প্রথম মুসলিম হিসেবে প্রতিবাদ করেন। তুরস্ক সরকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে ৩০ হাজার কুর্দির হত্যার প্রতিবাদ করায় তাঁকে আইনি ঝুঁকিতে আটকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।
ওরহান পামুক তাঁর নিজ শহরের বিষাদাক্রান্ত আত্মার সন্ধান করতে গিয়ে বহুসংস্কৃতির সম্মিলন ও দ্বান্দ্বিকতা ভরা নতুন নতুন প্রতীক আবিষ্কার করার কৃতিত্বস্বরূপ নোবেল ফাউন্ডেশন ২০০৬ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে।
ছবি: ফার্স্ট চ্যানেল নিউজের সৌজন্যে
নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের সাক্ষাৎকার
বাংলা অনুবাদ || পলাশ মাহমুদ
আমি হোরেস এংডাল সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব। আমার সঙ্গে আছেন ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জনাব ওরহান পামুক। প্রথম প্রশ্নে জানতে চাই আপনার প্রথম বই লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে। কীভাবে লেখা শুরু করলেন এবং যখন লেখা শুরু করলেন, তখন কি ভেবেছেন, আপনি কেমন লেখক হতে যাচ্ছেন?
ওরহান পামুক: যেমনটা আমার ইস্তাম্বুল বইতে বলেছিলাম, বইটা আমার শহর সম্পর্কে অর্ধেকটা আত্মজৈবনিক আর বাকি অর্ধেকটা প্রাবন্ধিক বয়ান। ৭ থেকে ২২ বছরের সময়কালে আমি মূলত চিত্রকর হতে চেয়েছিলাম। কারণটা এত রহস্যজনক ছিল যে আমি এক বা দুইটা বাক্যে ব্যাখ্যা করতে পারব না। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাকে পুরো ইস্তাম্বুল বইটা লিখতে হয়েছে। আমি ছবি আঁকাআঁকি ছেড়ে দিয়ে চিত্রকর হওয়ার বাসনাকে কবর দিয়ে ফেললাম। তারপর সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রথম উপন্যাস জাভেদ বে ও তার পুত্রগণ লেখা শুরু করলাম। আমার শুধু একটা ধারণা ছিল মাত্র। আমি তখন শুধই উপন্যাস পড়ছিলাম। সাত থেকে আট বছর ধরে শুধুই উপন্যাস পড়ছিলাম। সাহিত্য নিয়ে কী করব, তা নিয়ে আমার একটা সুগভীর বোঝাপড়া মনের মধ্যে খেলা করছিল। আমি ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম। একটা পরিবারের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ...
থমাস মানের বুডেনবুকসের মতো?
ওরহান পামুক: মানের বুডেনবুকস অথবা গ্লাসওয়ার্দির দ্য ফরসাইট সাগার মতো করে বলতে পারেন। তার্কিশ উচ্চ-মধ্য শ্রেণির একটা ধনী পরিবারের রোমাঞ্চকর অভিযানের পাশাপাশি তার্কিশ নব্য অভিজাত শাসকশ্রেণির উদ্ভবের ইতিকথা বলতে পারেন। হুম, বুডেনবুকসের একটা বিশাল প্রভাব ছিল বলতে পারেন। আমি নিজেকে ১৯ শতকের পুরাতন ফ্যাশনের একজন বাস্তববাদী লেখক হিসেবে তৈরি করে ফেলেছিলাম। তুরস্কের কিছু পাঠক এখনো আমাকে বলে, পামুক, এখন পর্যন্ত এটাই তোমার শ্রেষ্ঠ বই। তোমার অন্য সব পরীক্ষামূলক বইতে তুমি এই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। আমি খুব অবাক হয়ে শুনি আর ভাবি, আসলে ওই বইতে কী ছিল। মাঝে মাঝে একটু অনুতাপ বোধ করি। মনে হয় ওই রকম বই লেখা চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
এই বিষয়ে আমার কোনো মত নেই, কিন্তু আপনি বলে যান প্লিজ।
ওরহান পামুক: আমার ২৩ থেকে ২৬ বছর বয়সের মধ্যে আমি এই বই লিখেছি। বইটি প্রকাশ করতে আরও তিন বছর, না আসলে চার বছর লেগেছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে গেছে। বইটা লেখা শেষে পাণ্ডুলিপিটা একটা সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছি, যারা অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করে। এবং আমি জয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে সামরিক ডামাডোলের মধ্যে বই প্রকাশ করা একটা কঠিন কাজ ছিল।
তারপর দ্বিতীয় উপন্যাস লেখা শুরু করলাম। তা আসলে ছিল একটা রাজনৈতিক উপন্যাস। কিন্তু স্নো উপন্যাসের মতো রাজনৈতিক ছিল না। এটা কোনো রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার জন্য লেখা হয়নি; বরং আমার মতো উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুবকদের মধ্যে যে নৈরাজ্যর উদ্দামতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে পরখ করার লক্ষ্যে লিখেছিলাম। ওই সময় ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী যুবকেরা মার্ক্সবাদ দিয়ে প্রচণ্ড রকম প্রভাবিত ছিল।
তারপর তো সামরিক ক্যু হয়ে গেল, আর আমি বুঝতে পারলাম, বইটা প্রকাশ অসম্ভব। তারপর তৃতীয় উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম। যেটা মূলত আমার দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস দ্য সাইলেন্ট হাউস। ১৯৮২ সালে আমি এই ৬০০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটা প্রকাশ করতে পারলাম। তার্কিশ উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি পরিবারের উপাখ্যানের বয়ান। তার্কিশ পরিচয়ের নব আবিষ্কার, নতুন নির্মাণ...
আপনি কি দ্য সাইলেন্ট হাউসের কথা বলছেন?
ওরহান পামুক: না, আমি প্রথম উপন্যাসের কথা বলছি। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সাড়া পড়ে গেল। আমি জাতীয় পুরস্কার পেলাম। তারপর দ্য সাইলেন্ট হাউস প্রকাশ করলাম। এটাও সফল হলো। তখন মনে হলো, আমি যেন নিজস্ব একটা স্বর খুঁজে পেলাম। এই বই দুইটার প্রথমটায় ১৯ শতকের বাস্তববাদের ছায়া পাবেন, আর দ্বিতীয়টা ফকনারের দৃষ্টিকোণের ছাপ...
দৃষ্টিকোণ...
ওরহান পামুক: বর্ণনার দৃষ্টিকোণ মানে, যেটার নিরীক্ষা আমি মাই নেইম ইজ রেড উপন্যাসে করেছি। তৃতীয় উপন্যাস কিছুটা অদ্ভুত প্রকৃতির। যেটা কাকতালীয়ভাবে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে দ্য হোয়াইট ক্যাসল হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসের গল্প ১৬ শতকের একজন অটোম্যান পণ্ডিতকে কেন্দ্র করে; যে কিনা ইতালিয়ান দাস ক্রয় করত। তাই বলা যায়, এখানে চরিত্রের প্রাণশক্তির নাটকীয় অদলবদল দেখানো হয়েছে। এটা একটা পূর্ব-পশ্চিমের উপন্যাস ছিল। এই উপন্যাসে আমি সামান্য নিরীক্ষা শুরু করেছি। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ছিলাম। উপন্যাসটা যখন লিখছি, তখনো নিশ্চিত ছিলাম না, কী হতে যাচ্ছে।
হ্যাঁ। এই বই কিন্তু আপনাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে।
ওরহান পামুক: দ্য হোয়াইট ক্যাসল উপন্যাসটা ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত হওয়ার সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন নিজেকে রসিকতা করে বলতাম, আমি আমার স্ত্রীর স্বামী। কারণ, আমার স্ত্রী তখন পিএইচডি করছিল আর আমি স্পাউস ভিসায় তার সঙ্গে আমেরিকায় ছিলাম। কলাম্বিয়া আমার জন্য যথেষ্ট সদয় আচরণ করেছিল। তখন আমিও ক্লাস নিতাম। তার্কিশ কোর্স করাতাম। তা ছাড়া লাইব্রেরিতে আমার জন্য একটা ছোট রুম ছিল, যেখানে বসে আমি দ্য ব্ল্যাক বুক উপন্যাসের অর্ধেকটা লিখে ফেলেছিলাম। লন্ডন, প্যারিস ও নিউইয়র্কের মতো পশ্চিমা সভ্যতার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে একজন অনাবাসীর জন্য এমন সুযোগ খুবই নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এখানে একজন অনাবাসী সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে একটা উদ্বেগের ভেতর দিয়ে যায়। আমার নিজেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি মানে... আমি আমেরিকান গ্রন্থাগার ও সংস্কৃতির সুগভীর ঐশ্বর্যকে আস্বাদন করার সুযোগ পেয়েছি।
তারপর আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তার্কিশ সংস্কৃতি কী? আমি এখানে আসলে কী করছি? তখন মনে করতাম, তুরস্কের সাংস্কৃতিক ভূমিকা ও পরিচয় অতি প্রাচ্যবাদী হতে হবে। তখন আমি সেই ৩২ বছর বয়সে প্রাচীন সুফি রূপক কাহিনি, ইসলামি মরমিবাদের সমগ্র চিরায়ত গ্রন্থ পড়তে শুরু করলাম। যার বেশির ভাগ ছিল পার্সি গ্রন্থ। আমি বোর্হেস ও কালভিনোর দৃষ্টিতে পড়া শুরু করলাম। কারণ, তারাই আমাকে শিখিয়েছিল, এই সাহিত্যের গ্রন্থগুলো শুধু কাঠামোকে ভিত্তি করে না পড়ার জন্য। কারণ, কাঠামো কিছু অধিবিদ্যক গুণের আধার হিসেবে কাজ করে। আমাকে বোর্হেস ও কালভিনো শিখিয়েছে, ধ্রুপদি ইসলামি গ্রন্থগুলো ধর্মীয় চেতনা, জ্যামিতিক নকশা এবং অধিবিদ্যক কাঠামো ও রূপকার্থে পড়ার ভাবনা মাথা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য।
রূপক কাহিনি?
ওরহান পামুক: রূপক কাহিনি সব সময় সাহিত্যের পাশা খেলা...
এবং অবশ্যই কূটাভাস।
ওরহান পামুক: হ্যাঁ। ১৯ শতকের উপন্যাসের প্রভাবের পর তলস্তয়, দস্তেয়ভস্কি, প্রুস্ত, নবোকভ, ফকনার, বোর্হেস এবং কালভিনো পাঠ ইসলামি ঐতিহ্যকে একটা সেক্যুলার মনোভাব থেকে দেখার চোখ খুলে দিয়েছে।
হুম। দ্য ব্ল্যাক বুক উপন্যাসে আপনি যেভাবে প্রাচ্যের মৌলিক উপাদানের ঐশ্বর্যকে দেখিয়েছেন, তা এককথায় অনবদ্য। মানে, যেকোনো পশ্চিমা পাঠকের জন্য এটা অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তবে খুব জানতে ইচ্ছা করছে, এই গ্রন্থগুলো আপনি কোন ভাষায় পড়েছেন?
ওরহান পামুক: আচ্ছা! অদ্ভুত লাগবে শুনতে। বেশির ভাগ লেখা তার্কিশ ও ইংরেজিতে পড়েছি। আমি /----/ এর তার্কিশ অনুবাদের জন্য খুবই কৃতজ্ঞ। এটার তার্কিশ অনুবাদ ভীষণ ভালো ছিল। কিন্তু /---/ এর অনুবাদের /----/ সংস্করণ ছিল মধ্যযুগের ইসলামি সংস্কৃতি একটা এনসাইক্লোপেডিয়া। ইসলামি সংস্কৃতির সকল গৌরবের কথা যেন এক মলাটে লিপিবদ্ধ করা আছে। সকল ইসলামি বাগ্মিতা ও সাহিত্যিক ক্রীড়া একটা বইতে আছে। জানার পর বাইরের বিশ্ব; বিশেষ করে পশ্চিমা লেখকদের জানানোর একটা তীব্র বাসনা মনে জেগে উঠল। আপনি জানেন, এখানে কত কত সাহিত্যের মণিরত্ন জমা আছে। আমার মনে হয় সাহিত্যের ঐতিহ্য, পরিচয় সম্পর্কে বেশির ভাগ উত্তর আমরা রপ্ত করেছি আন্তর্জাতিক নব্য সাহিত্যধারা ও শৈলী থেকে।
এটা সত্য যে আপনি যখন ‘দ্য হোয়াইট ক্যাসল’ এবং ‘দ্য ব্ল্যাক বুক’ উপন্যাস দুটি একবারের বেশি পড়বেন, তখন আপনার কালভিনোর ‘ইনভিজিবল সিটিস’ উপন্যাসের কথা মনে পড়বে। আমার মনে হয় কালভিনোর এই বইটা আপনার পছন্দের হয়ে থাকবে। তারপরও আপনার উপন্যাসের অনেক কিছুই পশ্চিমা পাঠকের কাছে অপ্রত্যাশিত হয়ে থাকবে। কারণ, এর মাঝে মরমি ঐতিহ্যের ছাপ আছে। আর লেখার জন্য ক্ষেত্রটাও অনেক ফাঁকা বৈকি।
ওরহান পামুক: অ্যারাবিয়ান নাইটসের প্রভাবও ছিল, তার্কিশরা যাকে ওয়ান থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটসের বলে। আমার মনে হয়, ওই বইটার গল্পগুলো এবং বর্ণনায় কিছুটা প্রাচ্যের প্রভাব আছে। যদিও এটা পশ্চিমা আবিষ্কার বলা চলে এবং কিছুটা...। এটা দেখা গেছে বইটা পশ্চিমা সংকলকদের কাজ ছিল। কিছু বিখ্যাত গল্পে তো প্রাচ্যের কোনো... মানে আমার সন্দেহ হয় আরকি যে গল্পগুলো মৌলিক নয়। বইটা ভারতীয় ঐতিহ্যের বাহক, যা আরবি ও ফার্সি প্রভাবের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। তারপর এই গল্পগুলো, প্রায় গল্পের মহাসমুদ্র বলা যায়। একটা সুঠাম কাঠামো ও বোঝাপড়া অর্জন করল। ফরাসি ও ইংরেজদের হাতে পড়ে একটা অন্য উচ্চতায় পড়ে গিয়েছে। প্রাচ্য বিশারদেরা দ্য ব্লাক বুকের আড়ালেও ছিল। বিরতিহীনভাবে গল্প বলে যাওয়া। বিরাট সমস্যায় নিয়োজিত একজন মানুষের ধারণা কিন্তু যে নিজে এই সমস্যা ও সংকটকে মোকাবিলা করতে পারছে না। যে কিনা প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে অন্য এক প্রশ্নের মাধ্যমে আরেকটি নতুন গল্প শুরু করে। গল্প বলার এই ধারা আরব্য রজনীর হালকা ছোঁয়ার সঙ্গে একটা ব্যাপক প্রভাব রাখে।
হুম। কিন্তু ‘দ্য ব্ল্যাক বুক’ উপন্যাসে আপনি বিরতিহীনভাবে রূপক কাহিনি ও উপকথার মাধ্যমে গল্পের ভেতর গল্প বলে গিয়েছেন। যাদের কোনো তল খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো শেষ নেই। এমনকি তাদের কোনো শুরুও নেই।
ওরহান পামুক: ‘দ্য ব্ল্যাক বুক’ বইয়ের একটাই কাঠামো বা সূত্র আমার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। তা হলো ইস্তাম্বুল সম্পর্কে যত চমকপ্রদ ধারণা আছে, তাদের একত্র করা। ইস্তাম্বুলের পুরাতন দোকান, এর গল্পগুলো, এই শহরের যত রহস্য, এই শহরের রাস্তার রসায়ন—তার সবকিছু। যেগুলো আমি ভালোবেসেছি। আমার যাপিত জীবনে নিজের করে বেঁচেছিলাম। শৈশবের রোমন্থন, শহরের ভাঁজে ভাঁজে যত ছবি, ইতিহাস, পুরাণের ছবি জুড়ে ছিল; তার সব লিখতে চেয়েছি। উত্তর আধুনিক ইউরোপের নব্য নিরীক্ষামূলক সাহিত্যশৈলীর সঙ্গে ধ্রুপদি সুফি সাহিত্যধারা মিশিয়ে দেখতে চেয়েছি, আসলে কী হয়। আমার মনে হয় সাহিত্যের মূল বোধের জায়গাটা হলো, আপনি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধারাকে একটা বিন্দুতে এনে মেলাবেন। তারপর দেখবেন কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে কি না। অবশ্যই গল্পের কথক এখানে লেখকের জন্য তরঙ্গের উৎস হিসেবে কাজ করবে।
‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাস নিয়ে কেউ একজন বলেছিল, দুটি ভিন্ন ধারাকে একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিয়ে পেইন্টিংয়ের অনন্য সব নতুন ধারার আবিষ্কার হয়েছে। আমার মনে হয়, চিত্রশিল্পের মতো করে ওই একই কৌশল আপনি লেখালেখিতে প্রয়োগ করেছেন।
ওরহান পামুক: আমার মনে হয়, দাদা শিল্পরীতি সাহিত্যের জন্য বহু গুরুত্ব বহন করে। যদিও তারা প্রথমে পরাবাস্তববাদীদের উৎস হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এমন বহু ধারার মিশ্রণ; মানে, ভিন্ন ধারণাগুলো একত্র করার চিন্তা প্রথম প্রথম খুব সাহসিক ও কলঙ্কজনক মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে, এমন মিশ্রণ করা অসম্ভব ব্যাপার। দাদা শিল্পীরা আমাদের শিখিয়েছে, শিল্পে এমন ভিন্ন দুটি রীতিকে একসঙ্গে মেলাতে হবে; যারা আগে কখনো একসঙ্গে হয়নি। যেকোনো ভালো শিল্প বা ভিন্ন শিল্পের শুরু হয় দাদা শিল্পের ধারণা থেকে।
‘দ্য ব্ল্যাক বুক’ উপন্যাসে একজন পশ্চিমা পাঠকও আছে। এ যেন প্রাচুর্যে ভরা সাবলীল পরিচয়ের মেলা। অনেকটা দেহান্তরের মতো জাদুকরী। এই ভাবনা কি আপনি লিখতে লিখতে পেয়েছেন? এই একই শিল্প উপাদান আমরা ‘দ্য হোয়াইট ক্যাসল’ বইতে দেখেছি। তবে ‘দ্য ব্ল্যাক বুক’ উপন্যাসে তা যেন আরও কাব্যিক হয়ে ধরা দিয়েছে।
ওরহান পামুক: আমার এই শিল্পরীতি খুব পছন্দের। হতে পারে খুব ব্যক্তিগত পছন্দ। কিন্তু মানুষের ব্যক্তিত্বের সীমানা অতটা শক্ত নয়। আমি ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিতে মানব প্রকৃতিকে দেখি না। মানুষের চরিত্রের কোনো বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনশীল নয়। মানুষ ক্রমাগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়। আমার উপন্যাসগুলোতে নিজের কিছু প্রিয় ধারণা বা ভাবনা আছে, যেগুলো সম্ভবত আমার দেশ; মানে, তুরস্কের ইতিহাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিই। আপনি দেখেছেন, দুটি আত্মা, দুটি পরম চেতনা; যা আবার বিজ্ঞানের প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। একই সঙ্গে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হয় যে, দুটি ভিন্ন ব্যক্তিত্বের মধ্যে সব সময় একটা নাটকীয় উদ্বেগ কাজ করে। আমাদের চরিত্রের মধ্যে এই গোপন গভীরতা বা গুপ্ত বৈশিষ্ট্যকে কাছ থেকে দেখতে হবে। এই বিষয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু অন্যদিকে বিশ্বাস করতে হবে, মানুষের ভেতরের এই অন্ধকার দিকটার গভীরে যেতে হবে। শুধু ভাসা ভাসা চিন্তা করলে হবে না যে পূর্ব ও পশ্চিমকে একসঙ্গে করা সম্ভব না। মানুষে মানুষে বা এক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির ঐক্য সম্ভব নয়, এই রকম ভাবা যাবে না। আমি এই ধারণাগুলোকে খুবই বিশ্বাস করি।
একদম করা যাবে না। কিন্তু ‘দ্য ব্ল্যাক বুকে’ একটা চমৎকার বিষয় আছে, যেটা অনেক দুশ্চিন্তার কারণ... মানে, যখন কেউ কোনো গল্প বলে, তখন সে নিজেই ওই গল্পের বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। যেমন আপনি যখন কাউকে ভালোবাসেন, তখন আপনি আরেকজনের ভালোবাসাকে অনুকরণ করেন। তেমনি আপনি যখন লেখা শুরু করেন, তখন আপনি নিজেকে এমন একজন লেখক হিসেবে ভাবতে শুরু করেন, যেন আপনি নিজেই আপনার গল্পের সৃষ্ট চরিত্রের মতো বিশালতার (জালাল) প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠেন। আমি ফরাসি দার্শনিক ও তাত্ত্বিক রেনে জেরারের ইচ্ছাতত্ত্বের কথা বলছি। যিনি আমেরিকায় জীবনের বেশির ভাগ সময় কাজ করেছেন। আপনি কি তাঁর মতবাদের সঙ্গে পরিচিত?
তাঁর ইচ্ছার অনুকরণতত্ত্বের সঙ্গে কেমন করে যেন সাদৃশ্য পাই আপনার...
ওরহান পামুক: বুঝতে পেরেছি। আমি রেনে জেরার কাজের একনিষ্ঠ অনুরাগী। কিন্তু আমি অনেক পরে তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। তাঁর দ্য স্কেইপগট স্যাক্রিফাইসের বিষয়গুলো খুবই ভালো লেগেছে। অন্যদিকে এটাও বলব, তাঁর ভাবনাগুলো খুব সাধারণ প্রকৃতির। তবে পরিস্থিতি যত নাজুক হোক না কেন, গল্প বলার মধ্যে আমি একটা প্রশান্তি পাই। আমি যদি হেগেলের ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক ধারণাকে দেখি, তাহলে বুঝি যে হেগেলীয় মনগুলো সব সময় একে অন্যের ওপর কর্তৃত্ব খাটাতে চায়। আমি লক্ষ করেছি, মানুষের মন বা ইচ্ছাগুলো সব সময় একটা আরেকটা সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। কে কার আগে কোন গল্পটা বলবে, তাই নিয়ে বিগ্রহ চলতে থাকে। সবাই তার নিজের গল্পটা চাপিয়ে দিতে চাইছে। আপনি আপনার বইয়ের যেকোনো চরিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখেন। এমন কলহ চলছে অন্তহীন। হতে পারে ‘মাই নেম ইজ রেড’ বা ‘দ্য ব্ল্যাক বুক’ অথবা ‘স্নো’ উপন্যাসের চরিত্ররা। যে তার গল্পটা বলে শেষ করতে পারে, সে টিকে যায়। গল্প মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং জীবনকে চলমান রাখতে একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
হ্যাঁ। এটা ঠিক বলেছেন। ‘স্নো’ উপন্যাসে কবি কা এবং ধর্মীয় নেতা ব্লু একই নারীর জন্য দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ে। কে বিজয়ী হয়ে শেষ হাসি হাসবে, তা খোদাই ভালো জানেন। কারণ, উপন্যাসে এই সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত করে রেখেছেন। উপন্যাসের একটা অংশ আমাকে বিস্মিত করেছে, যেখানে কা প্রতারণা অবলম্বন করে ব্লুকে হত্যা করে। কিন্তু কেন সে এই কাজটা করে? আমাদের কিন্তু বইতে বলেননি। কিন্তু আমার অনুমান হলো, কা হঠাৎ বুঝতে পারে, সে আসলে নিজেকে যা ভেবে এসেছে; মানে, একজন মহান কবি, আসলে তেমনটা সে নয়। সেটা কেরানি কবি যে কিনা ঈশ্বর মনোনীত বলে মনে করা হয়। আমার কাছে এই দিকটা খুব চিত্তাকর্ষক লেগেছে। এই অংশ আমার মধ্যে একটা ভাবনা জাগ্রত করেছে। মানে, আমিও নিজেকে আপনার...। মানে, আমি নিজেকে আপনার কাজের অংশ ভাবতে শুরু করলাম। এখন আমি আরও দুঃসাহসিক অনুমান করতে যাচ্ছি। আমাকে এটা বলতেই হবে। মানে, প্রতিহিংসা আপনার কাজের অন্যতম বিষয়।
ওরহান পামুক: আমি আপনার সঙ্গে একমত। এটার শুরু...। এই দিকটা আমার প্রথম উপন্যাস ‘জাভেদ ও তার পুত্রগণ’ উপন্যাসেও আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ঈর্ষা। ‘দ্য সাইলেন্ট হাউস’ উপন্যাসেও এটা আছে। তবে প্রথাগত হিংসা নয়; বরং ‘দ্য হোয়াইট ক্যাসেল’ উপন্যাসের হেগেলীয় দাস ও মনিবের মধ্যে যে ঈর্ষা কাজ করে, তা। দুজন মানুষের মধ্যে এটা তখন হাজির হয়, যখন একজন বেশি জ্ঞানী, বেশি বুদ্ধিমান বা অধিক চালাক ও ধূর্ত হয়ে থাকে। কে আসলে প্রথমে সেই জায়গাটা দখল করবে? কে বেশি সমৃদ্ধ ও সুগভীর জীবন উপভোগ করবে? এই বিষয়টা ঈর্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই বিষয় আমার সকল সাহিত্যকর্মের মধ্যে বিরাজমান। এমনকি আমার আত্মজৈবনিক বইতেও এটা আছে। যেখানে আমি আমার ভাইদের সঙ্গে আমার একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের চিত্র এঁকেছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি মনে করি, ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসে এটা স্পষ্ট। এই শক্তি...
ওরহান পামুক: হ্যাঁ। এই লোক... সমগ্র উপন্যাসের আবেগীয় ভিত্তি বলতে পারি। কে সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর—এই ধারণা থেকে শুরু হয়ে অন্য সব শিল্পীর ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই আবেগই আসলে ওই হত্যাকাণ্ডের কারণ হয়ে...
ঈর্ষার অনুভূতি সেই সহিংসতার পথে টেনে নিয়ে যায়।
ওরহান পামুক: হুম।
এটা খুব মজার ব্যাপার কিন্তু। আমি যদি লেখক হিসেবে আপনার ভূমিকা কী, এই প্রশ্নটা করতে চাই। আমি কোনো এক সাক্ষাৎকারে আপনাকে বলতে শুনেছিলাম, আপনি নিঃসঙ্গতাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। এটা আপনাকে লেখার দিকে টেনে নিয়ে যায়, ধরে রাখে। আপনি সম্পূর্ণ একা একটা রুমে অবসরে যেতে চান। বিরক্তি গ্রাস করলেও আপনি এই নিঃসঙ্গতা কামনা করেন। যদি কোনো লেখা মাথায় না আসে, তাহলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে কাটিয়ে দিতে পারেন। একটা ঘটনাই শুধু ঘটবে, আর তা হলো আপনি লিখতে শুরু করবেন। আপনার এই দিকটা আমাকে ফরাসি দার্শনিক মনটেইনের একটা বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দেয়। তাঁর প্রবন্ধে ‘অ্যারিয়ার বুটিক’ শব্দবন্ধটা ব্যবহার করেছেন। মানে, একটা দোকানকে সবার অলক্ষ্যে রেখে দেওয়ার গোপন সূত্র। যে দোকানে কেউ ঢুকতে পারবে না; যেখানে আপনার বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান; এমনকি আপনার দেশের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেখানে আপনি সম্পূর্ণ একা।
ওরহান পামুক: মনটেইন প্রথম নিঃসঙ্গ মানুষের ধারণা ফ্রেঞ্চ ও পশ্চিমা সভ্যতার সামনে এনেছেন। এমন নিঃসঙ্গ মানুষ যে নিজে নিজে বই পড়ে, নিজেই বিচার-বিশ্লেষণ করে, নিজের মতবাদ নিজেই বিশ্বাস করে, তারপর সমগ্র মানবজাতির মধ্যে এই ধারণার ভ্রাতৃত্ববোধ আরোপ করে। তার ভাবনাই দুনিয়ার সকল মানুষের ভাবনা হয়ে ওঠে। কারণ, আমাদের সবার মন একই রকম। আমি মনে করি, সে পশ্চিমা চিন্তাধারায় আলো এনে একে বিশালতা ও উর্বরতা দিয়েছেন। কিন্তু আমি যে নিঃসঙ্গ মানুষের কথা বলি বা নিজে একা হওয়ার বাসনা রাখি, তার প্রকৃতি রাজনৈতিক নয়। কিন্তু দরজার ওপাশে খুব গোপনে কে পড়ছে, এক মনে লিখছে এবং কিছু সৃষ্টি করছে, তার রহস্যকে এভাবে উন্মোচন আগে কেউ করেনি। তখন পর্যন্ত এটা সম্পূর্ণ অজানা ছিল। এই আবিষ্কারের মাধ্যমেই পশ্চিমা জগতে অনুপম ব্যক্তিত্বের অর্চনা করা শুরু হলো। মানুষের এই অনন্য গুণের কদর শুরু হলো। এই সব চিন্তার ফলাফলকে শৈলী হিসেবে দেখতে শুরু করল। সাহিত্যের শৈলী এমন আরও...
ছবি: Gariwo-এর সৌজন্যে
এ ছাড়া এই বিশেষ কাঠামোকে আপনি সুপ্ত লেখক ও সুপ্ত পাঠকের মধ্যে সম্পর্ক বোঝানোর জন্য ইঙ্গিত করলেন।
ওরহান পামুক: আচ্ছা! আমার কিছুটা তাই মনে হয়।
কারণ, আমার মনে হয়, মনটেইনের আগে ব্যাপারটা ঠিক এইভাবে দেখা হতো না।
ওরহান পামুক: হুম। আপনার সঙ্গে আমি একমত।
এর ফলাফল এটা।
ওরহান পামুক: আমার কাছে লেখকের ধারণা কোনো ব্যক্তিনির্ভর নয়। মানে, সামাজিক ব্যক্তির ধারণায় নির্ভরশীল নয়। বিশেষ করে যে ব্যক্তি সমাজ বা সম্প্রদায়ে নিজেকে প্রকাশ করে। বরং লেখক হলো সেই ব্যক্তি, যে কোনো কারণ বা আত্মবিকাশের জন্য বা মনের আনন্দ লাভের জন্য সমাজ, সম্প্রদায়, দল, শ্রেণি ও জাতিকে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে। প্রথমে হয়তো এটা শুধুই ভাবাবেগ হিসেবে অঙ্কুরিত থাকে। যেটা সে পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারে না। নিজেকে একা একটা স্থানে রেখে যখন লেখা শুরু করে, তখন বোধটা সামনে আসতে থাকে। সেখানে হয়তো সে তার আত্মার গভীরতাকে মাপতে পারে। এমন কিছু তুলে নিয়ে আসে, যেন সমগ্র মানবজাতির সামনে রাখতে পারে। একটা অপরিহার্য ও মৌলিক ধারণা এর পেছনে কাজ করে হয়তো। আর তা হলো, আমাদের সবার প্রায় একই রকম মনোজগৎ আছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটা চার দেয়ালের ঘরে একা হয়ে যাওয়া বোধ হয় সভ্যতার ইতিহাসের দিকে সবচেয়ে দীর্ঘ লাফ দেওয়ার সূত্রপাত ঘটায়।
ওরহান পামুক: আশা করি আপনার একাকিত্বে আপনি কিছু লিখছেন। মনের ভেতরে একটা গোপন বা অপ্রকাশিত বিশ্বাস হয়তো ছিল যে এই লেখা অন্য অনেক পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে। এই আশাবাদ বা বিশ্বাস মানবজাতির একটা শক্ত বনিয়াদ।
হ্যাঁ, আমি মনে করি, মনটেইনের লেখায় এই দিকটা দেখতে পাবেন। আপনার মধ্যে /---/ এর ধারণাটা পাবেন। দে লা বোয়েসি নামের একজন বন্ধু এবং...
ওরহান পামুক: তিনি বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু চমৎকার লেখা লিখেছেন।
হ্যাঁ, তাঁর বন্ধু যখন মারা যান, তখন তিনি আরেকজনকে খুঁজে পান। এবং পাঠক হলো তাঁর চিরদিনের বন্ধু।
ওরহান পামুক: আচ্ছা! আমি একমত। হ্যাঁ, ঠিক তাই।
ব্যাপারটা এমনই। এই পাঠক হতে হবে নাম না জানা পাঠক। চির অচেনা। এমনটা হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রাচীনকালের লেখকেরা তাঁদের পরিচিতজনের জন্য লিখত। কার জন্য লিখছে, তার ঠিকানা তাঁর জানা ছিল। চিঠি লেখার মতো। সামাজিকতা ছিল এই লেখার কারণ। কিন্তু আজকের দিনে এটা যে কেউ হতে পারে।
ওরহান পামুক: হুম। এটা আধুনিককালের আবিষ্কার যে আমরা কোনো নির্দিষ্ট বা বিশেষ কারও জন্য লিখব না। লেখার বিষয় যেমন আমাদের কাছে অপরিচিত বা অস্তিত্বশীল নয়। তেমনি লেখার পাঠকও আমাদের কাছে অস্তিত্বশীল নয়।
বইটি কিন্তু এমন কাউকে আহ্বান করছে, যে কিনা তাকে বুঝতে পারবে।
ওরহান পামুক: আর আমি সারাটা জীবন ওই পাঠকের চিন্তায় মশগুল ছিলাম যে কিনা আমার ঘাড়ের ওপর বসে আমি কী লিখছি, তা বোঝার চেষ্টা করছে। মাঝে ওই পাঠকের সঙ্গে আমি কথাও বলি। মাঝে মাঝে এই অভ্যাস হয়তো আমার পাঠককে বিচলিত করে তোলে। মাঝে মাঝে তাদের মুক্ত কণ্ঠে ডেকে যাই। তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে খেলায় মেতে উঠি। কোনো কোনো পাঠককে তো গল্পের মাঝে টেনে আনি। যে পাঠক ঠিক আমার মতো ভাবে, তার সঙ্গে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিই। ভেবে দেখেন, আর কেউ কি এমন নিভৃতে কথা বলে...
আপনি নিজের নাম ব্যবহার করেন।
ওরহান পামুক: হুম। আমি প্রয়োগ করি। এই চরিত্ররা অনেকটা আমার কাছাকাছি। কোনো কোনো কাল্পনিক চরিত্র আমার মূর্তমান চিত্র।
কিন্তু এখনো পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি।
ওরহান পামুক: হ্যাঁ হ্যাঁ। শিল্পকে চলমান রাখার জন্য লেখকদের কল্পনা কিছুটা অধরা থাকতে হয়। লেখকদের সবকিছু প্রকাশ করে ফেলতে নেই। কিন্তু লেখকের অন্তরাত্মার গভীরে যা জমে থাকে, তাকে অবশ্যই মুক্ত রাখতে হবে। কল্পসাহিত্য কিন্তু লেখকের স্পষ্টবাদিতা, সততা এবং সত্যবচন থেকে সৃষ্টি হয়। লেখক এমন সব সত্য বলে দেবে, যা তার বন্ধুরা বিশ্বাস করত যে সে বলবে না। রাজনৈতিকভাবে নয়, আত্মিকভাবে সাহসী হতে হবে। একটা বিশ্বাস যে ত্রিশ বা চল্লিশ বছরের ছোট কোনো একজন মানুষ পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে আপনার মতোই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। একই অনুভূতি প্রকাশ করছে। এই ছোট ছোট বিষয় খুবই ব্যক্তিগত এবং এড়িয়ে চলতে হবে। এগুলো জগতের সব পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যেতে হবে।
হ্যাঁ। একদিকে একজন লেখককে এই প্রশ্নটাও করতে হবে যে এই অনুভূতির বিনিময় কি সর্বজনীন? মানে, আপনি সভ্যতার দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করেন, ঠিক কি না? অবশ্য আপনার লেখায় যা দেখাতে চান, তা হলো ঘটনা আসলে ঘুরে ঘুরে হঠাৎ ভিন্ন দিকে এগিয়ে যায়। যে বিষয়টাকে আপনি নিজের থেকে ভিন্ন বলে ধরে নিয়েছেন, সেটা আসলে আপনার খুব কাছাকাছি কিছু। অন্যদিকে আমি মূলত পশ্চিমা সাহিত্যের পাঠক। বিশেষ করে নরডিক সাহিত্যের পাঠক। আমি জানতে চাই, আপনার লেখায় এমন কোনো কিছু কি আছে, যা উত্তরের বা পশ্চিমের পাঠকদের বুঝতে কঠিন লাগবে। চলুন, আপনার ‘ইস্তাম্বুল’ বই থেকে একটা বিষয় তুলে ধরি, যেখানে আপনি ১৯ শতকে ফরাসি কবি জেরার্ড দে নার্ভালের ‘ভয়েজ ইন ওরিয়েন্ট’ থেকে কিছু বিখ্যাত ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়ে কথা বলেছেন। আমি বইটি পড়েছি। খুবই চমৎকার বই। বইতে তিনি কনস্টান্টিনোপল শহর; মানে, ইস্তাম্বুলের অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন। কনস্টান্টিনোপল শহর ঘোরার শুরুতে তিনি সেখানকার সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। আপনি জানেন নিশ্চয়। কারণ, আপনি এই অংশটা উদ্ধৃত করেছেন। সুলতান তার বাহন থেকে নামাচ্ছিল আর নার্ভালের মনে হলো, তার চোখ যেন সুলতানের চোখে পড়েছে। আপনার কি মনে আছে?
ওরহান পামুক: হ্যাঁ।
আর সঙ্গে সঙ্গে সুলতানের প্রতি তিনি করুণা অনুভব করলেন। মুহূর্তের মধ্যে এই দুজন পুরুষের মনের মধ্যে একটা ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জন্ম নিল। আপনি জানেন নিশ্চয়, তিনি ভাবতে লাগলেন, এই দাসী নারী ও অন্য সবকিছুর সঙ্গে এই সুলতানের অস্তিত্ব কতটা জড়িয়ে আছে। কিন্তু সুলতানের সঙ্গে নার্ভালের দৃষ্টিবিনিময়ের সম্ভাবনাকে আপনি এড়িয়ে গেলেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, আপনি এমনটা কেন করলেন? আমাদের এইভাবে তো বলা উচিত না যে...
ওরহান পামুক: আমি মনে করি যে...
… না, আপনি মনে হয় পুরোপুরি বুঝতে পারেননি।
ওরহান পামুক: ...অন্য যে সব লেখকের ভ্রমণ গ্রন্থে এই ঘটনার বর্ণনা এভাবে আছে যে, সুলতান প্রতি শুক্রবারে যখন ঘুরতে বের হন, তখন সবাই তাঁকে দেখতে যায়। আপনি শুধু তাঁকে শুক্রবারই দেখার সুযোগ পাবেন। সবাই সেখানে যাবে আর বলবে, ‘ও! সুলতানের চোখে আমাদের চোখ পড়ল আর আমরা একটা আধ্যাত্মিক ঝটকায় মুহূর্তে বুঝতে পারলাম’ এই বিষয়কে আমার কাছে মনে হলো...
খুব গতানুগতিক কিছু...
ওরহান পামুক: আমারও কিন্তু ব্যাপারটা খুব গতানুগতিক মনে হয়। তারপর দেখলাম, ১৯ শতকে ফরাসি দর্শনার্থীরা পত্রিকায় এই বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেছে। এখন আপনার জন্য /---/ পড়ে মনে হতো ‘সংবাদ প্রতিবেদকের সুলতানের সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়ে গেল আর জাদুর মতো তাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি হলো’। একটা ভালো ব্যাপার যেন এটা। একদিকে এটা ভালো হলেও পুরো ধারণাটা আমার কাছে পশ্চিমকেন্দ্রিক মনে হয়েছে। মুসলিম বা প্রাচ্য ঢঙের মনে হয়নি। একদিন হঠাৎ আপনার চোখে কারও চোখ পড়ে গেল, এই রকম ঘটনার বর্ণনাও পাবেন। যেমন আমাদের গল্পকারেরা কোনো একজন সংবাদ প্রতিবেদক, একজন ঔপন্যাসিক বা একজন নার্ভাল কিংবা পর্যটকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নিজেকে তার অবস্থানে বসিয়ে দেখল...
বিষয়টা ঠিক এমনই।
ওরহান পামুক: ...এটা কিন্তু একটা বিরাট আবিষ্কার। এমন করেই কিন্তু উপন্যাসের শৈলী তৈরি হয়। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, উপন্যাসের শৈলী তার সকল মহিমা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে শুধু অন্যের প্রতি দরদ ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে। ওই সব মানুষের প্রতি দরদ, যারা ঠিক আমাদের মতো না। মানুষকে সব সময় অন্য অচেনা মানুষের; মানে, অটোমান সুলতানের মতো মানুষের জায়গায় নিজের অনুভূতিকে বসিয়ে তার অনুভূতির সঙ্গে মুখোমুখি করতে হবে। এই পদ্ধতিতে বিশ্বকে আত্মস্থ করা শুরু করতে হবে। একে অপরকে বুঝতে হবে। আমরা যে উপন্যাস পড়ি আর ভাবি এই যে মানুষের গল্পটা বলা হচ্ছে, এ তো আমার থেকে ভিন্ন যেকোনো মানুষের প্রতিনিধি। এই মানুষটার সঙ্গে যদি আমি নিজেকে মেলাতে পারি, তাহলে যেকোনো বিশ্বমানবতার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। একজন পুরুষ তো আরেকজন নারী সম্পর্কে লিখতে পারে। একজন নার্ভাল তো একজন অটোমান সুলতানকে নিয়ে লিখতে পারে। সবাই লেখক থেকে ভিন্ন সত্তার অধিকারী। কিন্তু আমরা যখন উপন্যাস পড়ি, তখন বিশ্বাস করি না যে এই মহিলাই কথা বলছে কিংবা তলস্তয় যখন কাল্পনিক নারীকে নিয়ে লেখেন, তখন আমরা বিশ্বাস করি না এই নারী একজন ব্যভিচারিণী। বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমরা ভীষণ আনন্দ নিয়ে পড়ি। আমরা জানি, যিনি লিখছেন, তার জীবনে এসব কোনো কিছুই ঘটেনি। গল্পের কথক আর লেখক এক নন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সবকিছুর পরও আমরা পড়ি এবং আমরা...
আমরা করব...
ওরহান পামুক: ...আমার মনে হয়, ফ্লয়েবার তাঁর চরিত্র ম্যাডাম বোভারির সঙ্গে একাত্ম হতে এমন ঐকান্তিক চেষ্টাই করেছেন। আমরা যখন দুদিক থেকে উপন্যাসটিকে...
... একজন নারীকে প্রতিনিধিত্ব করার একক কোনো তরিকা নয়, বরং একজন পুরুষের দিক থেকে নারীকে বোঝার প্রয়াস বলব।
তার মানে, যদি নার্ভালকে আমরা সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে বিচার করি, তাহলে তিনি ভুল ছিলেন। কিন্তু যদি তাঁকে গল্পকার হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে তিনি সঠিক ছিলেন।
ওরহান পামুক: প্রতিবেদক হিসেবে সে হয়তো গড়পড়তা কিছু লিখছে, কিন্তু একজন শিল্পী হিসেবে লিখলে তার মধ্যে গল্প বলার সহজাত একটা স্বভাব গড়ে ওঠে। সে ওই ঘটনাকে গল্পের দিকে মোড় দেয় এবং ভিন্ন এক বাস্তবতা সৃষ্টি করে।
কারণ, এটা সত্যি একটা ভালো গল্প।
ওরহান পামুক: সে এভাবেই নিজেকে সুলতানের সঙ্গে একাত্ম করতে সক্ষম হয়।
ভালো কথা। আদালত বলছে, আজকের মতো আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার নেই।
ওরহান পামুক: ধন্যবাদ। এই চমৎকার আলোচনার জন্য।
অশেষ কৃতজ্ঞতা।
ওরহান পামুক: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
উৎস উৎস লিংক: https://www.nobelprize.org/prizes/literature/2006/pamuk/interview/
বাংলা কপিরাইট © pratidhwanibd.com
নোট: ২০০৬ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী, অরহান পামুকের সাক্ষাৎকারটি সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সম্পাদক হোরেস এংডাল ৬ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে গ্রহণ করেন।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন