ধূ ধূ প্রান্তরে একা

অচেনা একটা পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম, চারিদিকে ধূ ধূ প্রান্তর, মাঝে দু-একটি গাছ, উপরে বিস্তীর্ণ আকাশ। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন নাম ধরে ডাকছে—রায়া, এই রায়া, তুই এখানে? কবে এলি? পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি খোলা মাঠের মাঝখানে সারিবদ্ধভাবে রাখা কয়েকটা বেঞ্চিতে বসে আছে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। হয়তো টিভি দেখছিল। তাদের ভিড়ে বসে থাকা একজন উঠে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমিও কয়েক পা পিছিয়ে তার কাছে যেতেই দেখলাম, উনি পপি আপা। হাত ছুঁয়ে বললাম, কতদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো! এতদিন কোথায় ছিলে? সেই শিল্পকলা, মহিলা সমিতি, পাবলিক লাইব্রেরি কত কত জায়গায় খুঁজেছি তোমাকে, কত জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কেউ তোমার কোনো খোঁজ দিতে পারেনি।
মিষ্টি হেসে হাতের ইশারায় খালি একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বলল, চল বসি।
সেদিন ছিল আলো ঝলমলে দিন। কোলাহলহীন মনোরম পরিবেশ। মানুষের ভিড় নেই, আশেপাশে কোনো হকার, ভিখারি কেউ নেই। থেমে থেমে শীতল বাতাস তখন শরীরে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল।
পপি আপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে জানতে চাইলাম, তারপর বলো, কি করছ এখন?
আমি তো এখন অনেক ব্যস্ত রে! কাজ আর কাজ!
কি কাজ করছ?
একটার পর একটা প্রোগ্রাম করে যাচ্ছি।
তুই, তুই কি করছিস? ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে জানতে চাইলেন।
আপাতত হাঁটছি। এছাড়া কোনো ব্যস্ততা নেই।
হুম। হাঁটতে তো হবেই। গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলে তুই যা চাইবি তাই পাবি, তোর অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পূর্ণ হবে এখানে।
মানে?
মানে সময়ই বুঝিয়ে দেবে তোকে।
পপি আপার সব কথাগুলো কেমন রহস্যে ঘেরা। ঠিকঠাক কিছুই বুঝতে পারছি না। তারপরও জানার ইচ্ছে থেকে বললাম, এখন বল, হঠাৎ এত কাজ কীভাবে পেলে? কত চেষ্টাই না করেছ একটা কাজের জন্য! শেষবার যখন তোমার সাথে দেখা হয়েছিল, তুমি তো বলেছিলে যেখানেই যাও, সবাই কেবল তোমার শরীরটাই ভোগ করতে চায়।
তাই-ই চাইতো। কিন্তু সেই সময় আর এই সময় তো এক নয়। এখানে কোনো ছল-চাতুরী নেই। কেবল ইচ্ছেটাই থাকতে হবে। তখনকার সবকিছু তুমি তো জানো, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম আমি। সংসারই ছিল আমার কাছে সবকিছু। পড়াশুনা শেষে ভালো চাকরি পেয়েও করিনি। শুধুমাত্র ছেলেমেয়েকে আমি ছাড়া কেউ দেখার নেই ভেবে। ওদের কষ্ট হবে ভেবে। তারপর সময়ের দোলাচলে দুলতে দুলতে একসময় ছেলে-মেয়ে দুটি বড় হয়ে যায়। ওরা যার যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের বাবাও সারাদিন তাঁর বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমি একা হয়ে যাই। সেই একাকীত্বকে ঘোচাতে গিয়েই আবৃত্তিটা আবার শুরু করি। পাশাপাশি প্রেজেন্টারের জন্যও চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। ওই প্রেজেন্টার হওয়ার সুপ্ত বাসনাটা ছোটবেলা থেকেই বুকের মাঝে পুষে রেখেছিলাম। ম্লান মুখে কথাগুলো বলছিল পপি আপা।
সবটুকু শুনে বললাম, জানি আপা। সেই আবৃত্তি সংগঠন থেকেই তো তোমার সাথে পরিচয়। সবাই তোমার আবৃত্তি শুনে প্রশংসা করতো। কী সাবলীল উচ্চারণ, কণ্ঠে কী আবেগ ছিল তোমার! আবৃত্তি শেষে হল ভর্তি মানুষের করতালিতে মুখর হতো সেই ক্ষণগুলো।
হ্যাঁ, অনেকেই তখন বলত, তুমি দেখতে এতো সুন্দর, উচ্চারণ ভালো, ভয়েস ভালো, তবুও কেন উপস্থাপনা করছ না, খবর পড়ছ না? মিষ্টি হেসে বলতাম সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই পড়ব। তারপর কতজন কত টিভি চ্যানেলে, বেতারে পাঠালেন, অডিশন শেষে প্রশংসাও করলেন। কিন্তু কোথাও কিছু হলো না। আসলে, এত এত প্রতিভাবানের ভিড়ে আমাকেই কেন কাজটা দেবেন তারা? আর যদি কাজটা পেতেই হয়, তবে আমাকেও তাদের কিছু দিতে হবে। বুঝলাম, বিনিময় ছাড়া কিছু মিলবে না। তারপর আর কী করা! প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্নটাই ভুলে গিয়েছিলাম।
এর বেশ কিছুদিন পর আমিই আবার তোমাকে পাঠিয়েছিলাম একটা টিভি চ্যানেলে, তাই না পপি আপু? বললাম আমি।
হ্যাঁ। শুধুমাত্র তুমি বলাতেই গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আগের সেসব কিছুরই পুনরাবৃত্তি আর হবে না। কিন্তু তার চেয়েও খারাপ কিছু ঘটে গেলো। যার কাছে গিয়েছি সেই লোকটি আগের লোকদের মতো আর প্রস্তাব দেয়নি। অফিসে তার রুমের দরজা বন্ধ করে আমার উপর সরাসরি নির্যাতন চালিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন নিজেকে বাঁচাতে পারিনি। আর তাইতো স্বামী, সন্তান সব আপনজনকে হারিয়ে এখানে চলে এলাম। যেখান থেকে চাইলেও ফিরে যেতে পারবো না কখনো, ওদের কাছে। কথাগুলো বলতে বলতেই বুকের গভীর থেকে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো। আর তার পরপরই তাকিয়ে দেখি—বেঞ্চির সেই জায়গাটা এখন শূন্য পড়ে আছে, যেখানটায় এতক্ষণ পপি আপা বসেছিলেন। আমি এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে খুঁজি, কোথাও তাকে পাই না। চারিদিকে কেবলই ধূ-ধূ প্রান্তর, শুধুই শূন্যতা।
ঠিক তখনি কেন যেন সামনে এগিয়ে যাবার এক ধরনের তাড়না অনুভব করছিলাম। হয়তো এই তাড়না আমার অন্তর্জগত থেকেই অনুভূত হচ্ছে। সাথে এটাও মনে হলো যে, হাতে সময় খুব কম। এই কম সময়ের মধ্যেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে হবে। আর এই পথটা আমাকে একাই যেতে হবে, মনে হচ্ছে। কেননা যতটা পথ ফেলে এসেছি, সেই পথটায় সাথী হয়ে কেউ পাশে ছিল না।
আমি সামনের পথ ধরে হাঁটতে থাকি। ধূ ধূ মাঠ। কেউ নেই। কেবল মানুষই নয়, কোনো পশুপাখির দেখাও মেলেনি সে পথে। তবুও কোনো ভয় আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। হাঁটছি আর হাঁটছি। হঠাৎ চোখে পড়ে একটু দূরেই একটি লোহার গেইট। আগের চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাই সেই গেইটের দিকে। গেইটটি যখন ঠিক আমার সামনে, সেটি খোলার জন্য নির্ভয়ে হাত বাড়িয়ে দেই।
গেইটটি খুলে যায় আর আমি বাঁধাহীনভাবে ভিতরে ঢুকে পড়ি। কেননা সেখানে কোনো নিরাপত্তাকর্মী ছিল না। পাশেই কারা যেন দাঁড়িয়ে শপথ নিচ্ছিলো অথবা প্রার্থনা করছিল, ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মুখগুলোও অস্পষ্ট। তাদের ঠিক সামনে আরও কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজকের আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শুধু এটুকু মনে হলো, ছোটবেলায় রোজ সকালে যেমনভাবে আমরা স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে শপথ নিতাম, তেমন করেই এরাও দাঁড়িয়ে রয়েছে। এইসব ভাবনার মাঝেও একটি ভাবনা আমার মনে তখনো উঁকি দিচ্ছিলো, সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কেন যেতে হবে? কেউ তো আমাকে বলেনি এগিয়ে যাবার কথা। তবুও কেন এই তাড়না অনুভব করছি? জানতে চাইলাম বিড়বিড় করে নিজেরই কাছে ।
কিছু দূর যাবার পর হঠাৎ করেই দেখলাম, আমার থেকে খনিকটা সামনে, কয়েকজন লোক লাল ফিতার মতো কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দু’পাশে। অর্থাৎ তাদের অনুমতি ব্যতীত আমি বাকি পথ অতিক্রম করতে পারবো না।
তবুও সামনে এগিয়ে যেতে পা বাড়ালেই তারা আমার পথ রোধ করে বলল, দাঁড়ান। কোথায় যাচ্ছেন?
আমি থমকে দাঁড়িয়ে বলি, সামনে যাব।
আপনার সেখানে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে?
বিস্ময় নিয়ে তাদের কাছেই জানতে চাইলাম, অনুমতি?
হ্যাঁ, ওখানে যেতে হলে যতদূর পথ আপনি পেরিয়ে এলেন, সেই পথের মাঝেই একটি কার্ড পাওয়ার কথা। আর সেটি থাকলেই আমরা আপনাকে সামনে যাবার অনুমতি দিতে পারি।
বুঝতে পারলাম এদের সাথে কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। কার্ড ছাড়া এরা আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে দেবে না। আমি নিরুপায় হয়ে পুনরায় পুরনো পথ ধরেই হেঁটে বাইরে আসবার প্রাক্কালে আবার দেখা হয় পপি আপার সাথে। বাউন্ডারির ভিতরেই দাঁড়িয়ে ছিল সে। আমাকে দেখে আবারও এগিয়ে এসে আমার চলার পথের সঙ্গী হলো। হাঁটতে হাঁটতে বাউন্ডারি পেরিয়ে বাইরে এসে জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছ?
এখানে তো আর সামনে যেতে দিবে না। আমার কাছে কার্ড নেই। এখন ফিরে যাব।
কোথায় যাবে?
জানি না।
একটা বিস্তীর্ণ মাঠ, আশেপাশে কয়েকটি গাছ, তার ওপর নীলাকাশ, আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে তখন কোনো মানুষ, ঘরবাড়ি, পশুপাখি কিছুই ছিল না। শুধু আমি আর পপি আপা। সামনে তাকাতেই কয়েকটি গেইট চোখে পড়লো। লোহার বা কাঠের নয়। মাটি কেটে বানানো গেইটের মতো খোলা অংশ।
আমি সেই খোলা অংশের দিকে এগিয়ে যেতেই মাটির কাটা অংশটুকু অদৃশ্য হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ ঠিক সেই অংশটা মাটির প্রাচীরে রূপান্তরিত হয়। ওই জায়গা ছেড়ে অন্য খোলা অংশের দিকে পুনরায় এগিয়ে গেলে সেটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। একের পর এক সবগুলো ফাঁকা অংশ অদৃশ্য হয়ে মাটির প্রাচীরে পরিণত হয়। আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কী পপি আপাই আমাকে সামনে এগিয়ে যাবার কার্ডটা দিতে পারতো? আর সেদিন পপি আপার জীবনে এমন দূর্ঘটনা ঘটবে জেনেও সামান্য কিছু টাকার লোভ সামলাতে না পেরে আমিই যে তাকে ওই লোকটির কাছে পাঠিয়েছিলাম, সেটা সে বুঝতে পেরেছে? হয়তো এই বিষয়টা জেনেই কার্ডটা দেয়নি পপি আপা। তাছাড়া তো আর কোনো কারণই নেই। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি পপি আপাকে। ভাবি—আরেকটিবার যদি তার দেখা পেতাম, তবে ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাই না। আমি দাঁড়িয়ে থাকি, ধূ ধূ প্রান্তরে একা।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন