ম্যাজিক

অ+ অ-

 

|| ১ ||

বিয়ের ছয়মাস যেতে না যেতেই জামিল আহমেদ বুঝতে পারলেন, ভুল! ভয়ংকর ভুল করে ফেলেছেন তিনি! ত্রিশ বছরের এই জীবনে একবারের জন্য তার কখনও মনে হয়নি জীবনে কোন ভুল কাজ করেছেন। খুব মেধাবী ছাত্র হওয়ার পরও ক্লাস নাইনে উঠে সিদ্ধান্ত নিলেন, বিজ্ঞান বিভাগে পড়বেন না, মানবিক বিভাগ নিবেন তিনি। মানবিক বিভাগে ভর্তি হওয়ায় তার বাবা-মার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! স্কুলের শিক্ষকরা, বন্ধুরা হায় হায় করে উঠলেন। ক্লাসে কোনদিন প্রথম বৈ দ্বিতীয় হননি জামিল আহমেদ। তা সত্বেও মানবিক বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ভেবেছেন, এটি তার সঠিক সিদ্ধান্ত। ছেলেবেলা থেকে তার শিক্ষক বাবা বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলে ডাক্তার হয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করবে। কারণ অন্য দু ছেলেমেয়ে পড়াশুনায় মাঝারি গোছের। ছোট ছেলে জামিলকে ডাক্তার বানানোর আজন্ম লালিত স্বপ্ন জলাঞ্জলি হওয়ায় বাবাতার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-এ খুব ভালো রেজাল্ট করে বের হলেন জামিল আহমেদ। এবার বাবা বললেন, যা ভুল করার করেছ, আর ভুল করো না। বিসিএস পরীক্ষা দাও। সরকারি ক্যাডার হও। জীবনটা নিশ্চিন্ত করো। বাবা জানেন, ছেলে পরীক্ষায় বসলেই ক্যাডার হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। ছেলে নিজের মেধা যাচাই করার জন্য পরীক্ষায় বসল, বাবার বুকটা দশহাত ফুলে ফেঁপে উঠল, ভাবটা এমন, যেন তিনি বিসিএস ক্যাডারের বাবা হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হায়! লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকায় প্রথম দিকে থাকলেও ছেলে মৌখিক পরীক্ষায় বসলেন না। বাবা এবার ঠিক করলেন, এমন কুলাঙ্গার ছেলের মুখই আর দেখবেন না! ছেলে এবারও ভাবলেন তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। এত বড় বড় ভুল কাজ করার পরও যিনি নির্বিকারভাবে ভাবতে পারেন, তিনি একদম সঠিক কাজ করেছেন, সেই মানুষটিই কিনা সবার কাছে যেটি সঠিক,শুধু সঠিকই নয় সামাজিকভাবে যে কাজটি সবার জন্য প্রায় বাধ্যতামূলক সেই কাজটি করার পর ভাবছেন, তিনি মারাত্বক ভুল করেছেন! তাহলে কি তিনি ভুল মানুষকে বিয়ে করেছেন? মানে তার বউটি কি খুব দজ্জাল মহিলা? দেখতে অসুন্দর? না, মোটেই সেসব কিছু নয়, আর সেসব হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ তিনি বিয়ের আগে তার বউয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছেন। আমরা জানি, তার বউ খুব সুন্দরী, শিক্ষিত, বুদ্ধিমতি, স্মার্ট, ধৈর্যশীল।

বিয়ের প্রায় দেড় বছরের মাথায় ছেলে সন্তান জন্মানোর পর জামিল আহমেদের মনে হলো, এই ভুল থেকে মুক্তি পেতে হবে। চার বছরের মাথায় রসকদমের মতো টুসটুসে মেয়েটি জন্ম নেওয়ার পর তিনি সত্যি সত্যি মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করলেন!

 

|| ২ ||

ছেলেবেলা থেকে জামিল আহমেদ দিনের বেশিরভাগ সময় রাজশাহী শহরের লাইব্রেরিতে রাজ্যের বই পুস্তকের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন আর স্বপ্ন দেখতেন তিনিও লিখবেন। একটা খাতা বানালেন, সেখানে নিজের মনের সব বলা, না বলা কথা লিখতে শুরু করলেন। কিশোর বয়সে পা দেওয়ার পর লেখক হওয়ার স্বপ্নটি তার মনের জানালায় মেঘলা দিনের একফালি রৌদ্রের মতো উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে। পাতার পর পাতা গল্পে গল্পে ভরিয়ে ফেলেন। সারাদিন লেখেন আর কাটেন, কাটেন আর পড়েন, পড়েন আর লেখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প পাঠাতে শুরু করলেন। সেগুলো ছাপাও হতে থাকল। তিনি নিয়মিত শাহবাগের লেখকদের আড্ডায় উপস্থিত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর তিনি ভাবলেন, চাকরি-বাকরি নয়, সারাজীবন লেখালেখি করেই কাটিয়ে দেব। বছর দুয়েক যাওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। এক কলিগের বোনের সঙ্গে তার প্রেম গড়ে ওঠে এবং তিনি তাকে বিয়ে করেন।

কেউ মুখে বলুক আর নাই বলুক বিয়ের পর প্রায় সব পুরুষ মাঝে মাঝে বিয়ে করার জন্য আফসোস করে। মেয়েরা যে করে না তা নয় তবে পুরুষদের তুলনায় সেই সংখ্যা কম। মাঝে মাঝে আফসোস করলেও কেউ কখনও বিয়ের পর, ভয়ংকর ভুল করে ফেলেছেন, এমন মনে করেন না। কিন্তু বিয়ের প্রায় ছয়মাস পর থেকে এই দশ বছরে জামিল আহমেদের একবারও মনে হয়নি বিয়েটা করা তার জন্য সঠিক কোন সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভুল! ভয়ংকর ভুল!

তিন্নি, তার বউ জেনে-বুঝেই লেখককে বিয়ে করেছে। তার সবসময়ের চেষ্টা জামিলের যেন লেখালেখিতে কোন সমস্যা না হয়। জামিল আহমেদ অফিস থেকে ফেরার পর লেখার টেবিলে বসামাত্র সংসারের কাজে যত ব্যস্তই থাকুক না কেন তিন্নি চিলের মতো সাঁ করে এসে সেই ঘরের দরজা নিজ গরজেই বন্ধ করে দেয়, যেন বাচ্চাদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর সংসারের ঝনঝনানি তার স্বামীর কানে না পৌঁছায়। একটাই উদ্দেশ্য গৌতম বুদ্ধ যেমন নিবিষ্ট মনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন তেমনি তার স্বামীটিও যেন নিবিষ্ট মন নিয়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে পারেন। বিয়ের পর কোনদিন জামিল তার স্ত্রীকে এই কাজটি করতে বলেননি। লেখালেখি নিয়ে মগ্ন থাকায় তিনি নিজেও এই কাজটি করতে ভুলে যান। ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামিলের মনটা স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে। তিন্নির হাতে প্রতি মাসে খরচের জন্য একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট টাকা তুলে দিয়েই তার মুক্তি। তিন্নি খুব দক্ষতার সঙ্গে এই টাকার মধ্যেই সংসার চালিয়ে নেয়।

মাঝে মাঝে জামিল আহমেদের মনে হয় ইশ! চাকরিটা না করলে সারাদিন প্রাণ খুলে লিখতে পারতেন। তবে চাকরি করার দোষটা তিনি বিয়েকে দেন না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর তিনি প্রায় বছর দুয়েক বেকার থেকে শুধুমাত্র লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। দেখেছেন, সারাদিন উপুর হয়ে যত ভালো আর পরিমানে যত বেশিই লিখেন না কেন, একটা ভালো জায়গায় চাকরি না করলে লেখক হিসেবে তার মূল্য যেন আর থাক ছিলো না। এজন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা নেন। যদিও সবাই তার লেখার খুব প্রসংশা করেন। সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, তিনি খুব বড় মাপের লেখক, বোদ্ধা লেখক। তাঁর লেখা খুব গভীর, সম্বৃদ্ধ এবং আর্টিস্টিক। লেখকদের লেখক তিনি, মানে যারা লেখালেখি করতে চান তারা তাঁর লেখা পড়ে লেখক হওয়ার চেষ্টা করেন। এমনও শোনা যায় সাধারণ পাঠকরা তার লেখা পড়ে অনেক সময় বুঝতে পারেন না। সবগুলোতে এক্সিলেন্ট রেজাল্ট হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা পেতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। অতএব চাকরির জন্য তিনি স্ত্রী, সন্তানদেরকে দোষ দেন না।

সমস্যা অন্য জায়গায়, লেখালেখির জন্য তিনি প্রকৃতপক্ষেই গৌতম বুদ্ধ যেমন গহীন, নিশ্চুপ, শান্ত আর নিরিবিলি জঙ্গলে ধ্যান করতেন তেমন একটি স্থান চান। তবে গহীন জঙ্গলেরও একটা ভাষা আছে অবশ্য। এখানে পাতারা ঝির ঝির শব্দে কথা কয়, বাতাসরা শোঁ শোঁ শব্দে হাসাহাসি করে, ঢলাঢলি করে। আর পাখপাখালির কুহতানের কথা নাইবা বললাম। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এমন গহীন জঙ্গলে গেলেও পাতা, বাতাস আর পাখপাখালির অত্যাচারে তিনি নিবিষ্ট মনে লিখতে পারতেন না। তবে হ্যাঁ জঙ্গলটা যদি পটে আঁকা ছবির মতো একদম নিশ্চল আর বোবা হতো তাহলে মনে হয় জামিল আহমেদের লেখালেখিটা নির্বিঘ্নে চলত। বউ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে যতই প্রানান্ত চেষ্টা করুক স্বামী তার বুদ্ধদেবের মতো ধ্যানমগ্ন হয়ে লেখালেখি করবে, সংসারে থেকে তার কি উপায় আছে? এই সহজ কথাটি বউ বোঝে না।

 

|| ৩ ||

সেদিন সন্ধ্যায় ছেলের মুখ থেকে চিৎকার নামক বোমাটি বের হতে না হতেই মা পড়িমড়ি করে ছুটে এসে ছেলের মুখে হাত চাপা দেয়। তবুও শেষ রক্ষা হয় না! লেখার ঘরের বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে বাবা জ্বলন্ত বারুদের মতো মুখ নিয়ে হাজির, সমস্যা কি তোমাদের? তোমরা কি এক মুহূর্ত একটু শান্ত হয়ে থাকতে পার না? তিন্নির মুখের উপর জ্বলন্ত বারুদের ছটা নিক্ষেপ করেন। সব দোষ যেন তিন্নির! তিন্নি কেন ছেলেমেয়েকে শান্ত রাখতে পারে না। মায়ের হাতের নিচে চাপা পড়া ছেলের মুখটি নিশ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করছে। ছেলের মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে। পাশে সাত বছরের মেয়েটি ইঁদুরের বাচ্চার মতো কিঁ কিঁ করে কাঁদছে। এতক্ষণ তার গলা বিয়ে বাড়ির ব্যান্ডদলের সানাইয়ের মতো উচ্চস্তরে ছিল। বাপকে দেখেই মিইঁয়ে পড়েছে। বারুদের ছটায় তিন্নি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল, মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেয় ধমক, এই কান্না থামা, জানিস না, তোদের গলা থেকে স্বর বের হলেই তোর বাপের লেখক জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়।

এবার ভয়ংকর গম্ভীর, শান্ত আর থমথমে কণ্ঠে স্বামীর উদ্দেশ্যে তিন্নি বলে ওঠে, এক কাজ করো না, বাড়ির সবাইকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেয়ে কণ্ঠনালীগুলো কেটে ফেলে দাও। সবাই বোবা কালা হলে যদি তোমার লেখক জীবন সার্থক হয়। শান্ত আর গম্ভীর কণ্ঠটি ঝনাৎ শব্দ তুলে কিড়মিড় করে ওঠে, তুমি মরার সঙ্গে সঙ্গে, তোমার লাশ কব্বরে যাওয়ার আগেই সবগুলো বই যদি আগুন লাগিয়ে না পোড়াইছি, তবে আমার নাম তিন্নি নয়!

তিন্নি চাইলেই জামিল আহমেদের সবগুলো বইয়ে আগুন লাগাতে পারবে না, সেটা কব্বরে যাওয়ার আগেই হোক বা কব্বরে যাওয়ার পরেই হোক। কারণ বইগুলো তো প্রকাশকের দখলে। বাড়িতে তার বইগুলোর দু-এক কপি আছে বটে, কিছু কিছু বইয়ের আবার কোন কপিই বাসায় নেই। জামিল আহমেদের এই সরল যুক্তিটাও মাথায় এলো না। বই পোড়ানোর কথাটা যেন অজস্র ছররা গুলির মতো তার বুকটা ঝাঁঝড়া করে দিল। আমি আর তোমাদের সঙ্গে থাকব না। আজ থেকে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব—চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলে, ছুটে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

তিন্নিও কম যায় না, সেও দ্বিগুণ গলা বাড়ায়, যাও না যাও, কে তোমাকে আটকিয়ে রেখেছে? পার তো ওই এক ভয়ই দেখাতে। বিয়ের পর থেকে তো এই এক ভয় দেখিয়েই আমাকে কাবু করার চেষ্টা করছ। আর ভয় পাই না আমি। ছেলেমেয়ে এখন আর ছোটটি নেই। তুমি না থাকলেও ওদেরকে নিয়েই আমি দিব্বি থাকতে পারব।

জামিল আহমেদ আলাদা বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে বেরিয়ে গেলেও তিন্নি ঠিকই জানে, রাত নটার মধ্যে সে বাসায় ফিরে খাবার টেবিলে বসবে। তিন্নি আজ আর জামিল আহমেদের সঙ্গে ঘুমাল না। নিজের বালিশ কাঁথা নিয়ে মেয়ের ঘরে ঘুমাল। কী তাজ্জব কথা! ছেলেমেয়ে করবে চিৎকার, আর দোষ হবে আমার! তার লেখালেখির বিঘ্ন ঘটানোর জন্য যেন আমিই ইচ্ছে করে ওদেরকে চিৎকার দেওয়ানোর জন্য লোহার ক্ষুন্তি দিয়ে ছ্যাংটা দিয়েছি!

চিরতা মুখে পুড়লে দমড়ানো মোচড়ানো কাগজের মতো মানুষের মুখটা যেমন শত সহস্র ভাঁজে কুচকে যায়, শুক্রবার সকাল হলেই জামিল আহমেদ মুখটা তেমন করেই থাকেন। সারা সপ্তাহ ক্লাস নিয়ে ছুটির দিন একটু প্রাণভরে লেখালেখি করবেন, তার কি উপায় আছে! প্রতি শুক্রবারেই বউয়ের ঘ্যানঘ্যানানি, দেখ সারা সপ্তাহ তো ক্লাস আর লেখালেখি নিয়েই থাক, বাচ্চাগুলো একদমই তোমাকে পায় না। ছুটির দিনে একটু ওদেরকে সময় দাও। একটু বেরিয়ে আসি চলো রমনা পার্ক থেকে। জামিল আহমেদ সেদিন খেঁকিয়ে উঠলেন, হ্যাঁ, সারা সপ্তাহ তো আমি ফুর্তি মারি, ফুর্তি! আমার লেখালেখির কোন মূল্য নেই তো তোমার কাছে। তিনি সচেতনভাবে তিন্নির উল্লিখিত ক্লাসের কথাটা এড়িয়ে গেলেন। কারণ তার ধারণা সারা সপ্তাহ যদি তিনি শুধু ক্লাস নিতেন তাহলে হয়তো তিন্নি ভাবত, থাক বেচারা সারা সপ্তাহ ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত, শুক্রবারটা একটু বিশ্রাম নিক। কিন্তু লেখালেখিকে ফুর্তি হিসেবে নেয় বলেই তিন্নির সেটা সহ্য হয় না। সেকারণেই তাকে রোজ শুক্রবার এই শাস্তি দেয় সে।

সারা সপ্তাহ ফুর্তি মারি বলে ছুটির দিন সেটা উশুল করতে হবে, তাই তো? জামিল আহমেদ ছেলেমেয়েকে রেডি হতে বলে নিজে কাপড় পড়তে গেলেন।

তিন্নি রেডি হতে হতে ভাবে, লেখককে বিয়ে করলে যদি এমন হবে জানতাম তাহলে কি আর একাজ করতাম কোনদিন! বিয়ের আগে কত গর্ব হতো, অবশ্য এখনও হয়, তার স্বামীর নাম পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়! ভাবতাম, আমাকে নিয়ে কত কবিতা, কত গল্প লিখবে! বিয়ের আগে অবশ্য আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলো। যদিও সে গল্প উপন্যাসই লেখে। জীবনে সেই একটা কবিতাই লিখেছে অবশ্য। তিন্নির প্রেমে দেওয়ানা হওয়ায় কবিতা তখন ছিঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে ছিলো ওর বুক থেকে। ওদের প্রেমের বয়সটা বেশি ছিলো না। মাত্র চার-পাঁচ মাস প্রেম করার পরই বিয়ে করে ওরা। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে না করলে হয়তো আরও দু-চারটা কবিতা বের হতো ওর বুক থেকে। ওকে নিয়ে হয়তো গল্পও লিখত। বিয়ের পর কবিতা, গল্প দূরে থাক, আমাকে দেখলেই ওর পিত্তি জ্বলে যায়। ভাবে, আমি ওর লেখালেখির শত্রু, আমি ওর লেখালেখিকে সতীন ভাবি। ইশ! কিভাবে মানুষ এমন অন্ধ হওয়ার ভান করে! তিন্নির বুকটা যেন বাজ পড়ে অঙ্গার হয়ে যায়! ও কি দেখে না, ওর নির্বিঘ্ন লেখালেখির জন্য আমার চেষ্টা! বেঈমান! লেখকরা সব বেঈমান!

তিন্নি রেডি হয়ে সবার সঙ্গে লিফটে উঠে তেরছা চোখের কোণ দিয়ে জামিলের মুখটা দেখল। মানুষের মুখ তো নয়, যেন ক্ষ্যাপাটে আকাশ! কালো আর ভয়ংকর থমথমে! যেন এক্ষুনি পৃথিবীটাকে তছনছ করে ফেলবে!

এক দিন, সপ্তাহে শুধু এই একটা দিনেই বাচ্চাগুলো একটু বাবার সঙ্গে বের হওয়ার আবদার করে, তাতেই এমন রাগ! কী করি না আমি? বাচ্চাদের অন্য সব আবদার, সব সমস্যা, বাজার-সদাই, অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, সব, সবকিছু একা এক হাতে সামলাই। এমন কি কোন মাসে ওর দেওয়া টাকায় না কুলালে, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়, স্বজনদের কাছে ধার নিয়ে চালাই। কোনকিছুর মধ্যেই ওকে জড়ায় না, যেন ও নিশ্চিন্তে লেখালেখি করতে পারে। মাঝে মাঝে লেখালেখির উপর ঝাল ঝাড়ি, সেটা ঠিক। ঝাড়বই তো, ঝাড়ব না। লেখকের বউ হইছি বলে কি আমি মানুষ নয়, নাকি? আমার শখ আহ্লাদগুলোকে বুকের কুঠুরিতে তালা মেরে রেখেছি ঠিকই কিন্তু মাঝে মাঝে সেই শখ আহ্লাদগুলো যে তালা ভেঙ্গে-চুড়ে ঝনঝনিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, তার আমি কী করব? কোথায় অফিস থেকে ফিরে, একটু দুজন টোনাটুনির মতো বসে চা খাব আর গল্প করব তা নয়, উনি এসেই বসে যান লেখালেখির টেবিলে। আর আমি সারাক্ষণ বাজার করো রে, ছেলেমেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও রে, মিস্ত্রির পেছনে ছোট রে, অল্প টাকায় কিভাবে সংসার চালাব সেই চিন্তা করো রে! বিয়ের এত বছর হয়েছে কোনদিন একটু শখ করে ওর সঙ্গে মার্কেটে যাইনি পর্যন্ত। থাক ও লেখালেখি করে, করুক। আমিই ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের, আমার কেনাকাটা করি। তিন্নির চোখে প্রায় পানি চলে এলো। পানির ফোঁটাটা টুক করে গড়িয়ে নীচে নামার আগেই সে চোখের পাতা নাচানাচি করে, উল্টেপাল্টে সেটিকে ভেতরে মিশিয়ে দিল। এতকিছু একা সামলাতে যেয়ে মাথাটা কি ঠিক রাখা যায় সবসময়। মাঝে মাঝে লেখালেখিকে আঁচড়িয়ে খামচিয়ে মনের ঝাল মেটাই। সেটাই ওর মনের মধ্যে গেঁথে থাকে সবসময়। আর এতকিছু যে সাক্রিফাইজ করি, সেটা ওর চোখেই পড়ে না!

রমনার গেটে রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জামিলের মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। সবুজে ছাওয়া রমনার শীতল বুকে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হি হি করা বাতাসের ঢেউ এসে ওর সব রাগ শুষে নিয়ে যেন দৌড় দেয়। আসার আগেই যত খিস্তি-খেউড় করে। রমনাতে এলেই ওর মন ভালো হয়ে যায় বলে তিন্নি প্রায় প্রতি শুক্রবার রমনাতেই আসে। আসার পর ছেলেমেয়ের পুরোটা সময় উপভোগ্য করে তোলে। মেয়েকে ঘাড়ে নিয়ে পুরো রমনা পার্ক ঘুড়ে বেড়ায়। ছেলেকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। ফুটবলও একটা সঙ্গে নিয়ে আসে ছেলেমেয়েরা। ফুটবলও খেলে ওদের সঙ্গে।

 

|| ৪ ||

তিন্নি দুরু দুরু বুকে বন্ধ ঘরের দরজার কাছে গেল, সিপিলকে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দরজাটা খুলতে যাবে, ভাবল, না থাক, এখন বললে, কথাটা শুনে যতটা না মেজাজ তিরিক্ষি হবে তারচেয়ে হাজার গুণ তিরিক্ষি হবে লেখালেখির মনোযোগ নষ্ট হওয়ার কারণে। ছোট চাচার ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই তিন্নি ছোট চাচার জন্য কেঁদে কেটে সারা হচ্ছে। ওনারা আসার আগে জামিলকে জানানো উচিৎ। পরশুদিন ওনারা রওনা দিবেন বলেছেন। তিন্নি বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছে। কথাটা জামিলকে না বলে সে কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না। সামনে বইমেলা সেটাও সে ভাবছে। কিন্তু কিছু করার নাই। লেখালেখি শেষে মধ্যরাতে যখন জামিল আহমেদ শুতে এলেন তখন তিন্নি আমতা আমতা করে শুরু করল, শোন, ছোট চাচা না খুব অসুস্থ।

জামিল আহমেদকে দেখে মনে হচ্ছে, এতক্ষণ তিনি গাঁজায় টান দিচ্ছিলেন। এখন তিনি ঝিম ধরা মাথা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আসলে এতক্ষণ তিনি প্যারার পর প্যারা এক টানা লিখে গিয়েছেন। এখন সেগুলো কাটছাট করছেন মাথার ভেতরে।

তাই নাকি? জামিল ঝিম ধরা গলায় জবাব দিলেন।

শোন, পরশুদিন চাচাকে নিয়ে চাচি আর সজল আমাদের বাসায় আসছেন।

মুহূর্তেই যেন তার গাঁজার নেশা ছুটে গেল। তার মনে হলো মাথায় যেন বাজ পড়ল। তিনি এই মাঝরাতে প্রায় আর্তচিৎকার দিলেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, মাত্র দুমাস পর বইমেলা। আমি ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছি পনের দিনের। একটানা লিখে উপন্যাসটা শেষ করে প্রকাশকের কাছে দিয়ে দেব। ওনাদেরকে বুঝিয়ে বল। এটা সম্ভব নয়।

তোমার সমস্যা কি? তিন্নি রাগ আর কান্নার দমক মেশানো গলায় বলে চলে, তোমার রুমে তো কেউ যাবে না, তোমার রুমে তুমি সারাক্ষণ দরজা লাগিয়ে লেখালেখি করো। ড্রইং রুমসহ এদিকে আরও চার চারটা রুম আছে, আমরা তো এদিকেই থাকি। আর তোমার লেখালেখির রুমটা কর্নারে, শব্দ তো বেশি যায় না। আমার চাচা-চাচী কি তোমার ছেলেমেয়ের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করবে? চাচার ছেলে সজলও বেশ বড়, চাকরি করে। বিশাল বড় বাসা। কত লেখক তো শুনি এক ঘরের মধ্যেই ছেলেমেয়ে, বউ নিয়ে লেখালেখি করে। এত বড় বাসা তারপরও ওনার বাসায় কেউ আসতে পারবে না। এত টাকা ভাড়া দিয়ে এই বিশাল বাসা ভাড়া নেওয়ার কোন দরকার ছিল? মোটেই না। তার লেখালেখির জন্য আলাদা রুম দরকার। বাসাটা বিশাল বড় হতে হবে। যেন শব্দ এ মাথা থেকে লেখালেখির রুমে না পৌঁছায়। লেখালেখি থেকে যদি আয় হতো তাহলে না হয় বলতাম, নাও বাবা, তুমি রাজপ্রসাদ ভাড়া নাও, বানাও, যা খুশি তাই করো। তিন্নির গলায় এবার শ্লেষ দেখা দেয়, ঠোঁটের কোণে এক ফালি হাসিও ফুটে ওঠে, এক পয়সা আয় হয় না যে কাজ থেকে সেই কাজের জন্য সবাইকে নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে থাকতে হবে! সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে। একদম মগের মুল্লুক আর কি! এবার গলা চড়ায় তিন্নি, আরে বাবা তোমার লেখালেখির জ্বালায় কেউ তো কোনদিন বেড়াতে আসেই না, এবাড়িতে। বিপদে পড়ে আসতে চাইছে তারপরও এত সমস্যা কেন তোমার?

জামিল আহমেদ ভালো করেই জানেন তিন্নির কথাগুলো সবই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু তার অদ্ভুত এক মানসিক সমস্যা আছে, বাসায় অন্য কেউ এলে তিনি আর লেখায় মনোযোগ দিতে পারেন না। এমনকি মা-বাবা এলেও না। মা-বাবা যদি সবসময় ওনাদের সঙ্গে থাকতেন তাহলে নিশ্চয় অভ্যাস হয়ে যেত। কিন্তু মাঝে মাঝে এলে তার মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। মনে হয় বাসার পরিবেশ স্বাভাবিক নেই, বাসা ভর্তি লোকজন গিজগিজ করছে। দরজা খুললেই ওনাদের মুখোমুখি হতে হবে, কথার আদান-প্রদান করতে হবে। না করলে মা-বাবা কষ্ট পাবেন, অন্যরা তাকে অভদ্র বলবেন। তিনি নিজের এই বদ দোষের স্বপক্ষে যুক্তিও টানেন। আসলে সব লেখকের গতি প্রকৃতি এক হতে হবে এমন কোন আইন তো পৃথিবীতে নেই, তাই না? কেউ কোলাহলের মধ্যে ঝর ঝর করে লিখতে পারে। কেউ নিশ্ছিদ্র নীরবতা না হলে লিখতে পারে না। এটাই তো স্বভাবিক।

যখন তিন্নির সঙ্গে যুক্তিতে পারেন না, তখন যে অস্ত্রটি সবসময় ছোঁড়েন এখনও তাই করলেন, তুমি তো মুর্খ। তুমি লেখালেখির কি বোঝ? চাইলাম আর বসে পড়ে ঝরঝর করে লিখে গেলাম বিষয়টা তো সেরকম নয়। আরে, লেখালেখি কি থালাবাসন মাজা, তরকারি কাটার মতো জিনিস নাকি? ওনাদেরকে বলো, অন্য কোথাও উঠুক এবার। এবার গলাটা একটু নরম করল জামিল, বইমেলা সামনে না হলে আমি একথা বলতাম না বুঝছ। আমার বাবার বাড়ির কেউ হলে তোমাকে বলতেও বলতাম না, আমি নিজেই বলতাম কথাটা।

তিন্নি জানে সেটা ভালো করেই। জামিলের বাবার বাড়ির কেউ আসে না সহজে। আর বই মেলার সামনে কেউ আসতে চাইলে ও নিজেই সরাসরি না করে দেয়। কিন্তু চাচাকে কিভাবে নিষেধ করবে তিন্নি! অসুস্থ চাচা নিজে মুখে আসতে চেয়েছেন! কত আদর করেন চাচা আমাকে! তিন্নি গোঁয়াড়ের মতো বলে উঠল, আমি কখনও নিষেধ করতে পারব না। এ বাসাটা তোমার লেখালেখির কুরুক্ষেত্র নয়। এখানে আমারও অধিকার আছে। আমার আত্মীয়-স্বজনেরও অধিকার আছে।

জামিল আহমেদ বুঝতে পারলেন ওনাদের আসাটা কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। তিনি চুপ হয়ে গেলেন। পরদিন সকাল সকাল বোঁচকা বাঁচকি আর বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। যেন এমন একটা দিনের জন্যই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। যেন তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, তিন্নি যখনই তার চাচাচাচির আসার ডায়ালগটি বলবেন, পরিচালকের নির্দেশ মতো তিনি তখনই তার তল্পিতল্পা নিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করবেন। বলে গেলেন, আমি আপাতত সৌরভের বাসায় কদিন থাকব, এরপর একরুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিব। এখন থেকে আমি ওখানেই থাকব। মাসের প্রথম সপ্তাহে টাকা পাঠিয়ে দেব।

সৌরভ পেশায় ডাক্তার। জামিলের খুব কাছের বন্ধু। তার বউ কি এক ট্রেনিং করতে মাস দুয়েকের জন্য কানাডাতে আছে। দোতলায় সৌরভের মা-বাবা থাকেন আর তিনতলায় সৌরভ তার বউ নিয়ে থাকে। ওর বাচ্চাকাচ্চাও হয়নি। বিশাল বাসায় এক রুমে অনায়াসে সে কদিন নিবিষ্ট মনে লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারবে। 

তল্পিতল্পাসহ স্বামী এভাবে সংসার ত্যাগ করলে অন্য যেকোন বউ এর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ত। কিন্তু তিন্নির তা হলো না। কারণ তিন্নি জানে বাড়ি ছেড়ে গেলে মাসখানেকের বেশি টিকতে পারবে না সে। ঢাকা ভার্সিটির হলে থেকে রাজ্যের ছেলেরা পড়াশুনা করে। কিন্তু সে একমাসের বেশি হলে থাকতে পারেনি। একমাসের মাথায় বড়বোনের বাসায় আস্তানা গাঁড়তে হয়েছে তাকে। বড়বোনের বাড়িতে একটা সুবিধা ছিল, তিনতলা বাসার ছাদে একটা চিলেকোঠায় সে থাকত। দোতলায় থাকা বড়বোনের ছেলেমেয়ে, মেহমানদের অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হয়নি। নিবিষ্ট মনে সে লেখালেখি করতে পেরেছে। এখন যদি বড়বোনের সেই আগের বাড়িটা থাকত তাহলে নিশ্চিত সে বড়বোনের বাসার সেই চিলেকোঠায় আশ্রয় নিত। আদরের ভাইকে বোন রেন্দে-বেড়ে প্রায় মুখে তুলে খাওয়াতেন। কিন্তু সমস্যা হলো বোনদের নিজেদের সেই বাড়িটি আর নেই। বোনও পরিবারসহ আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন। যে মানুষ ফ্রিজ থেকে তরকারিটা গরম করে খেতে পারে না, এক কাপ চা বানিয়ে খেতে পারে না, একটা ভাত ফুটিয়ে খেতে পারে না, তরকারিতে একটু ঝাল-মসলা বেশি হলে যার পেট ভুটভুট করে, সে থাকবে একা! খাবে বুয়ার রান্না! থাকুক না কদিন দেখি। যখন নিরুপায় হয়ে ফিরে আসবে, তখন ঝাঁঝ কমবে একটু। একা থাকার সাধটা একটু মরুক। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে কি, উল্টা তিন্নির ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকিটা চিরদিনের মতো বন্ধ হবে ইনশাল্লাহ। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত লেখালেখির একটু এদিক-ওদিক হলেই গর্জে ওঠে, বাড়ি ছেড়ে আলাদা বাসা নিয়ে না থাকলে, তোমার শিক্ষা হবে না। তিন্নি নিজের মনেই বিড়বিড় করে, কে কাকে শিক্ষা দেয়, দেখব এবার!

 

||  ||

আহ্ কি শান্তি! বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি নাই, শালিকের মতো সারাক্ষণ বউয়ের চ্যাউ, চ্যাউআনি নাই। ভাড়া করা এক রুমের ফ্ল্যাটে আজ উঠেছেন জামিল আহমেদ। ফুরফুরা মনে লিখতে বসলেন তিনি। আজ  টিএসসির ক্যান্টিনে রাতের খাবার খেয়ে ফিরেছেন। সারারাত ধরে লিখলেন। সকাল ছয়টায় ঘুমাতে গেলেন। উপন্যাসটা প্রায় শেষের দিকে। বউ কাছে থাকলে কি আর সারারাত লিখতে পারতেন? রাত দুটা বাজতে না বাজতেই ঘ্যান ঘ্যান শুরু হয় তার, হয়েছে শেষ করো, ঘুমাও, শরীর খারাপ করবে কিন্তু। বেকুপটাকে এত করে বুঝেই, রাশেদ ভাই সারারাত ধরে লেখেন, সকাল ছয়টার আগে তিনি কোনদিনই ঘুমান না। আশি বছর বয়সেও তিনি কি বিপুল গতিতে লিখে চলেছেন দেখছ! ওনার স্বাস্থ্য আমার চেয়েও ভালো। শরীর হলো, অভ্যাসের দাস বুঝছ, ওকে যা অভ্যাস করাবে তাতেই সে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। বেকুপটা তো বোঝেই না, উল্টা বলে কি, সবার শরীরের গতি একরকম নয়। তুমি রাত জাগলেই তোমার চোখের নীচে গর্ত হয়ে যায়, অসুস্থ অসুস্থ লাগে। কি আর করা, কথায় না পেরে, ঘুমাতেই হয়। আসলে ভালোবাসার অভিনয় করে সে, মোদ্দাকথা আমি লিখতে বসলেই ওর গা জ্বালা শুরু হয়, কোন না কোন অছিলায় আমার লেখালেখি বন্ধ করাই ওর উদ্দেশ্য। রেগে গেলেই তো মানুষের মনের ভেতরের আসল কথাটা বেরিয়ে আসে, তাই না? রেগে গেলেই ওর এক কথা, তোমার এই লেখালেখি আমার জীবনটা অতিষ্ট করে ফেলেছে। সেদিন কী বলল, আমি নাকি কব্বরে যাওয়ার আগেই! ইশ! লেখালেখির প্রতি কি ভীষণ আক্রোশ ওর, সতীনের প্রতিও মানুষের এত আক্রোশ থাকে না!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে যেয়ে তিনি সকালের নাস্তা করলেন। দুপুরেও ওখানেই খেলেন। আর আসার সময় ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে এসে ফ্রিজে রেখে দিলেন রাতে সেটা খেয়ে নিলেন। তিনদিন এভাবে খাওয়ার পর তার পেট ভুট ভুট করতে শুরু করল, তিনি তো মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। নাহ, এভাবে আর ক্যান্টিনে খাওয়া যাবে না। বুয়া রাখতে হবে। একটা বুয়া রাখলেন। বুয়া প্রথমদিন যা রান্না করল তা যদি খেতেন তাহলে সর্বনাস হতো। তিনি এক লোকমা মুখে দিয়ে থু থু করে ফেলে দিয়ে অফিসের ক্যান্টিনেই অল্পস্বল্প খেয়ে নিলেন। বুয়া পরদিন সকালে এলে খুব ধমকাধামকি করলেন, মসলা, তেল, লবণ এত বেশি দাও ক্যান অ্যাঁ। আর সবজিগুলা সিদ্ধ করে একদম হালুয়া বানাও ক্যান? খুব বেশি সিদ্ধ করবা না। সবজির রং একটু সবুজ সবুজই থাকবে বুঝছ। বুয়া বলল, আইচ্ছা খালু, খাবেন আপনে তো আমার ত্যাল-মসলা বেশি দেওনের কামডা কি? কইছিলেন না বইলা আমার ভুল হইয়া গেছে গা।

ক্লাস নিতে যাওয়ার আগে তাড়াহুড়া করে খেতে বসলেন, একি! একদম কাঁচা সবজি! তেল, মসলা কিচ্ছু নাই! কাঁচা মাছের বোঁটকা গন্ধ নাকে লাগতেই তিনি প্রায় বমি করে ফেললেন!

যাইহোক অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলার পর সে যা রান্না করে তা খেয়ে বেঁচে থাকা যায় কোনরকমে। বিপুল উদ্যোমে লেখালেখি চলছে জামিল আহমেদের। সারারাত বেহুঁশের মতো লেখেন আর সকালে ঘুমান। সকালে কি আর রাতের মতো ঘুম হয়! গাড়ি ঘোড়ার শব্দ, বুয়ার ঠাসঠুস শব্দ। বুয়া এলে তো মনে হয় বাসায় বাজ পড়েছে। তিন্নি তো সারাক্ষণ বুয়াকে শব্দ না করার জন্য ধমকের উপর রাখত। বুয়া সকাল আটটায় আসে। দরজাটাও তাকেই খুলতে হয়। তখনই তো কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। বুয়া রান্না করে রেখে চলে যায়।

এক সকালে উঠে জামিল দেখলেন তার টেবিল থেকে অফিসের ব্যাগ উধাও! মাত্র গতকাল বেতনের টাকা তুলে ব্যাগেই রেখেছেন তিনি। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে মদ খেয়েছেন প্রচুর। সকালে ঘুম জড়ানো চোখে বুয়াকে দরজাটা কোনরকমে খুলে দিয়ে বেঁহুশের মতো ঘুমাচ্ছিলেন। বিছানার দিকে যেতে যেতে শুনতে পাচ্ছিলেন বুয়ার গলা, খালু আপনে কি মইরা গেছিলেন গা, বাপরে বাপ! এমন ঘুম যে মানষে ঘুমাইতে পারে, তা আমি বাপের জন্মে কোনদিন দেহি নাইকক্যা। দরজাডা পেরায় ভ্যাইঙ্গা ফ্যালাইতে লাগছিলাম, তাও আপনে উঠতাছিলেন না। বেশি মদ খেলেই তার এমন হয়। মাসের টাকাটা এখনও তিন্নির কাছে পৌঁছানো হয়নি। মোবাইল আর দামি ঘড়িটাও নাই। বাসার দারোয়ান এই বুয়া দিয়েছে। দারোয়ানকে হুমকি দিলেন জামিল, বুয়াকে বলো, ও যদি ভালোয় ভালোয় আমার টাকা আর জিনিসগুলো ফেরত না দেয়, তাহলে কিন্তু আমি ওকে পুলিশে দেব।

দুদিন পরও যখন বুয়ার কোন পাত্তা নেই তখন সে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, বলেছ? উত্তরে দারোয়ান যা বলল তা শুনে তার চক্ষু দুটি জবাই করা গরুর মতো স্থির আর বড় বড় হয়ে গেল।

স্যার হেই কইছে, আপনে যদি হেরে পুলিশে দ্যান, তাইলে হে নাকি পুলিশের কাছে কইব, আপনে নাকি তারে কু প্রস্তাব দিছেন, হে রাজি হয় নাইকা, তাই আপনে হেরে চুরির অভিযোগ দিছেন।

তিনি একা থাকেন তাই দারোয়ানকে বলে একটু বয়স্ক বুয়া রেখেছেন। বুয়ার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। সেই বয়স্ক মহিলার এমন কুবুদ্ধি মাথায় এলো কি করে!

ভাবলেন প্রফেশনাল শেফ রাখবেন। পুরুষ মানুষ। সব ঝামেলা মিটবে। কিন্তু শেফ যে বিশাল অংকের বেতন চাইল তা তার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। এমনিতেই আলাদা বাসার ভাড়াটা যুক্ত হওয়ায় চিন্তাই আছেন তিনি। শেফের চিন্তা বাদ দিলেন। অবশেষে আবারও টিএসসির ক্যান্টিনই ভরসা হলো তার। একমাসের মাথায় কলিগরা বলতে শুরু করল, জামিল ভাই আপনাকে দেখে কিন্তু অসুস্থ মনে হচ্ছে। ডাক্তার দেখান।

জামিল আহমেদেরও কদিন থেকে শরীরটা খারাপ খারাপ লাগছে। পেটটা সারাক্ষণই ভুটভাট করে। বউয়ের বাধা না থাকায় এই একমাস ধরে সকাল ছয়টার আগে একদিনও ঘুমাননি তিনি। প্রেসারটা মাপলেন। প্রেসার এরমধ্যেই বেড়ে ১৫০/১০০, ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার ওষুধের ডোজ বাড়ালেন। বললেন, একদম রাত জাগবেন না। কিন্তু জামিল আহমেদ লিখতে বসলে দুনিয়া দারি ভুলে যান। ভোরের আলো ফোটার আগে তার হুঁশই থাকে না।

তিন্নি দিনের মধ্যে কতবার যে ফোন হাতে নেয়! ইচ্ছে করে জামিলকে বলতে, প্লিজ ফিরে আস, এবার থেকে তুমি যা বলবে আমি সব শুনব। যত রাগই হই লেখালেখি নিয়ে আর টুঁ শব্দটি করব না। কিন্তু না, ফোন দেবে না সে, যে তেজ দেখিয়ে আমাদেরকে ফেলে চলে গেছে, সেই তেজটা একটু মরুক, না হলে আবার এসে জ্বালাবে। রাত দুটা বাজলেই তিন্নির ভয়ে বুকটা শুকিয়ে যায়, হয়তো এখনও ঘুমায়নি সে, রাত জেগে লিখে লিখে শরীরটার কি হাল যে হয়েছে আল্লাহই জানে!

 

||  ||

জামিল আহমেদের আজ শরীরটা খুব খারাপ। ডাক্তারের দেওয়া প্রেসারের ওষুধ খাওয়ার পরও প্রেসার আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে। আজ রাত আটটায় ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়েছেন আবার। বিছানা থেকে উঠতেই পারছেন না তিনি। ভার্সিটিতেও যাননি। জামিল আহমেদের খুব ইচ্ছে করছিল বাড়ি ফিরে যেতে। খুব ইচ্ছে করছিল ফোন দিয়ে তিন্নিকে বলতে, আস, এসে আমাকে নিয়ে যাও। কিন্তু না বলবে না সে, আমার লেখালেখিই যার শত্রু, এমন শত্রুর সঙ্গে থাকবে না সে। নিজ গরজে বাসায় গেলে আবার চুন থেকে পান খসলেই লেখালেখির গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বে। যতদিন তিন্নি বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করবে না, ততদিন সে বাড়ি ফিরে যাবে না। তিন্নি মারা গেলে কি সে একা চলতে পারবে না, অবশ্যই পারবে। কাউকে ছাড়া কেউ কি মারা যায় কখনও? তখন তো আরও খারাপ অবস্থা হবে, ছেলেমেয়েকেও দেখাশুনা করতে হবে। অসুখ কি মানুষের হয় না, নাকি? অসুখ হয়েছে সেরেও যাবে। বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা শুনে, একবার নিষেধ করা দূরে থাক, উল্টা মুখে এমন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ভাবটা এমন, যাও বাবাজি ঠেলাটা একটু খেয়ে আস। কি এমন ঠেলা হ্যাঁ! কষ্ট একটু হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দিন তো চলে যাচ্ছে, নাকি? প্রথম প্রথম একটু এডজাষ্ট করতে সমস্যা হবেই। তারপর একদিন ঠিকই অভ্যস্ত করে ফেলবে এই শরীর। শরীর অভ্যাসের দাস। কষ্ট হোক কিন্তু লেখালেখি তো আগের চেয়ে হাজার গুণ ভালো হচ্ছে। এবারকার উপন্যাসটি আগের সব উপন্যাসকে ছাড়িয়ে যাবে। কারণ এত নিবিষ্ট মনে তিনি এর আগে কোন উপন্যাস লেখেননি। বিয়ের আগে তিনি গল্পই লিখেছেন বেশি। এরপর উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। বিয়ের পর এই দশ বছরে যত উপন্যাস লিখেছেন সবার সেরা হবে এটি। সবার অনেক প্রশংসা পাবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। পুরস্কার-টুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন, অবশ্য পুরস্কারের আশায় যদিও তিনি লেখেন না।

এমনিতেই অসুস্থ এদিকে আবার ভার্সিটিতে যাননি বলে সকালে কয়েকটা কাঠবাদাম আর একটা আপেল খেয়ে সারাদিন কাটিয়েছেন। দুপুর থেকে না খেয়ে আছেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য তিনি বিছানায় উঠে বসতেই মাথাটা বোঁ-বোঁ করে চক্কর দিয়ে উঠল। পেটের ভেতর এমন মোচড়াতে শুরু করল! টেবিলের উপর দুদিন আগে রাখা কয়েক টুকরা পাউরুটি চিবিয়ে খেয়ে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি খেলেন। এবার একটু শক্তি পেলেন। ডাক্তারের কাছ থেকে আসতে আসতে রাত এগারটা বাজল। পেটের ভেতরে অনেকক্ষণ থেকে মেঘ ডাকাডাকি করছে যেন। তিনি ভাবলেন, আজ আর বাইরে কিছু খাব না। বাসায় ফিরে তিনি চিড়া ভিজিয়ে টক দই আর কলা দিয়ে খেলেন। ঘণ্টা খানেক পর থেকে তার এমন ডাইরিয়া শুরু হলো! তিনি বুঝতে পারলেন পাউরুটি খাওয়ার ফল। পাউরুটি তার কখনই পেটে সহ্য হয় না। আর এই পাউরুটিটা তো বাসি ছিলো। শুক্রবার বিকেলে খুব ক্ষুধা লাগায় পাশের দোকান থেকে দারওয়ানকে দিয়ে কিনেছিলেন। অর্ধেকটা সেদিন খেয়ে বাকিটা ছিলো টেবিলের উপর। যাইহোক ভাবলেন, ডায়রিয়া তো আর তেমন কিছু নয়। স্যালাইন খেতে থাকি, একসময় জীবানুগুলো পেট থেকে বেরিয়ে গেলেই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। স্যালাইনের পর স্যালাইন খাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কমছে না। এদিকে রাত প্রায় দুটা বাজে। সৌরভের কাছে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ফোন হাতে তুলে নিয়ে রেখে দিলেন, এত রাতে কি ওকে ফোন করা ঠিক হব? ডাক্তার হলেও তো ওর একটা লাইফ আছে। রাত বিরাতে এভাবে ওকে ফোন করা ঠিক নয়। তিনি বার বার বাথরুম যাচ্ছেন আর ভোরের জন্য অপেক্ষা করছেন। রাত চারটার দিকে তিনি আর চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। হাত পা অবশ হয়ে আসছিলো। তিনি কোনরকমে সৌরভকে একটা মেসেজ দিলেন। এরপর তার আর কিছু মনে নেই।

মেসেজ পেয়ে সৌরভ ফোনের পর ফোন দিয়ে চলেছে জামিলকে। রিং হচ্ছে কিন্তু জামিল ফোন ধরছে না। তিন্নিকে ফোনে খবরটা দিয়েই সৌরভ ছুটে জামিলের বাসার দিকে রওনা হল—শালা, হারামজাদাটা লেখালেখির জন্য এবার জীবনটাও বুঝি হারাবে! কত করে বুঝালাম এসব পাগলামো করিস না, তিন্নির মতো পাহাড়ের মতো ধৈর্যশীল মেয়ে বলে তোর মতো লেখা পাগল মানুষের সংসারটা টিকিয়ে রেখেছে। আমার বউয়ের মতো বউ হলে কবে পাছায় লাত্থি মেরে বিদায় হতো। শালা বলে কি, অন্যের বউকে সবার মধুই মনে হয়। মধুর আড়ালে কী যে বিষ থাকে, তা যার বউ, সেই বোঝে! জ্বলন্ত চুলায় পোড়া মরিচের মতো আমার বউয়ের যে ঝাঁঝ! সেটা দেখলে তুই তো শালা বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই পালাতি!

তিন্নি আট বছরের ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ছোট বোনটিকে দেখতে বলল। পাশের বাসার বাবুল ভাইকে নিয়ে সে ছুটল জামিলের বাসায়। বাবুল ভাই ডাক্তার, তিনি বার বার তিন্নিকে ভরসা দিচ্ছিলেন।

তিন্নিরা পৌঁছে দেখল, জামিল আহমেদ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন। ততক্ষণে সৌরভও পৌঁছে গেছে। তারা তিনজন ধরা ধরি করে হসপিটালে নিল জামিলকে। তিন্নি নাওয়া-খাওয়া ভুলে জামিলের সেবা করছে। শীতের শুরুতে ঝড়া পাতার মতো বিবর্ণ আর কোঁচকানো জামিলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিন্নি প্রায় শিউরে ওঠে, যদি ওর কিছু হয়ে যেত! ছেলেমেয়েকে নিয়ে না খেয়ে মরতে হতো একদম! রাত জেগে লেখালেখি নিয়ে বাড়াবাড়ি করায় একবার তিন্নি জামিলকে বলেছিল, এমন অনিয়ম করো না, তুমি মারা গেলে আমাদেরকে কিন্তু না খেয়ে মরতে হবে! কথাটা শুনে জামিলের সে কী রাগ! আমি মানুষটা যে পৃথিবীতে থাকব না, সেজন্য তোমার কোন কষ্ট হবে না, তাই না? সন্তানদেরকে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে সেটাই তোমার একমাত্র কষ্ট আর চিন্তা! সব শালা স্বার্থপর!

তিন্নি বলেছিলো, ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট নিয়েও সবাই টিকে থাকতে পারে। কিন্তু যেখানে অর্থের অভাবে টিকে থাকায় দায় হয়ে পড়ে, সেখানে ভালোবাসার কষ্টটা গৌণ হয়ে যায়, অর্থের কষ্টই মূখ্য হয়ে ওঠে জামিল।

হসপিটালে প্রায় এক নাগাড়ে দশদিন থাকতে হলো জামিলকে। জামিলের কোন আত্মীয় স্বজন নেই ঢাকায়, এদিকে তিন্নিরও কেউ ঢাকায় থাকে না। এ কদিন এক হাতে সংসার, ছেলেমেয়ে আর হসপিটাল সামলাতে সামলাতে তিন্নির একদম নাজেহাল অবস্থা! যাকে সে জান-প্রাণ সঁপে দিয়ে এতদিন সেবা করে সুস্থ্ করে তুলল, হসপিটাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর, সে বাসায় না ফিরে, যে ভাড়া বাসায় যাওয়ার কথা ভাবতে পারে, এটা তিন্নি স্বপ্নেও ভাবেনি। স্বপ্নে না ভাবলে কি হবে, বাস্তবে তিন্নি দেখতে পাচ্ছে, জামিল একটা সিএনজিওয়ালার সঙ্গে তার ভাড়া বাসায় যাওয়ার জন্য দরদাম করছে!

রাগে তিন্নির মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। নিমক হারাম! বেঈমান! যা তুই তোর ভাড়া বাসায়! অসুস্থ এবার! সেবা! সেবা করব! তোর মুখও দেখব না! তিন্নি কটমট করে জামিলের দিকে তাকিয়ে আছে।

জামিল সিএনজিওয়ালার সঙ্গে ইচ্ছে করেই খুব ঢিমেতালে দর কষাকষি করছে। তিন্ন্নি বলুক, ওকে বাসায় যাওয়ার কথা। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সে। আমি মানুষটা প্রায় কব্বর থেকে উঠে এলাম, তবুও ওর হুঁশ হচ্ছে না। আমাকে হাতজোড় করে, অনুরোধ করে বাড়ি নিয়ে যাবে কি, উল্টা কিছুই বলছে না। না বললে, আমিও কিছুতেই যাব না। আমি কি ওকে আমার সেবা করার জন্য ডেকে এনেছি? ও তো নিজেই এসেছে আমার সেবা করতে। ওর অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে এসে কী দশাটা হলো আমার! সরি বলবে কী, উল্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। মুখে রা নেই! মাসের শুরুতেই গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা হাতে পাও আর মজা লুটাও তো! টের পাচ্ছ না! আমি মরলে টেরটা পাবে, কত ধানে কত চাল! এবার রক্ষা পেলে বলে ভেব না, বারবার রক্ষা পাবে। কব্বর থেকে কী আর আমি বারবার উঠে আসতে পারব ভাবছ! মরি, মরি এবার! তখন ঠ্যালাটা বুঝবা! যাব না, কিছুতেই না। নিজ গরজে বাড়ি যেয়ে লেখালেখির জন্য আবারও তোমার মুখ ঝামটানি খাব সারাক্ষণ! দরকার নাই। মহাস্থানের কটকটির মতো তিন্নির কটকটে চেহারার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে, এ্যাঁ কেমন কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখ? মেরেই তো ফেলছিলা? তাও শান্তি হয়নি। মনে হচ্ছে এবার আমার হাড় মাংস চিবিয়ে খেলে শান্তি হবে তোমার! জামিল হসপিটালের বারান্দায় রাখা ব্যাগটা নিয়ে ধীর পায়ে সিএনজির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

সত্যি সত্যি জামিল সিএনজির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে তিন্নির ভয়ে দমটা বন্ধ হয়ে এল এবার। হায় খোদা! এই দুর্বল শরীরে আবার যদি হোটেলের তেল মসলাযুক্ত খাবার খায় আর অনিয়ম করে তাহলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না! একদম নির্ঘাত মৃত্যু! কিন্তু ওকে বলে কয়ে বাড়ি নিয়ে গেলেও কোন লাভ নেই। এমন তেজ হবে! সেই তেজ সহ্য করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমারও কি বয়স কম হলো? অনেক হয়েছে। আগের মতো আর সহ্য ক্ষমতা নেই আমার। চুন থেকে পান খসলেই আবার বাড়ি ছাড়বে ও। অসুস্থও হবে। ওকে বাঁচানোই দায় হয়ে পড়বে! এবার তো প্রায় মরতেই বসে ছিল! বাড়ি ছাড়ার মওকা পেয়ে গেছে একবার, আর কী সহজে ছাড়বে আমাকে! হাড়, মাংস জ্বালিয়ে একেবারে ছাড়খাড় করে ছাড়বে! হাত-পা ধরে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। ওকে নিজে থেকে বাড়ি ফিরতে হবে, তবেই ওর শিক্ষা হবে। তিন্নির ইচ্ছে করছে ছুটে যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে পায়ের পাঁচ আঙুল দিয়ে জুতার তলা খামছে ধরে আছে শক্ত করে। খোদাকে ডাকছে বারবার। খোদা রক্ষা কর, রক্ষা কর খোদা! আমার দিকে, আমার সন্তানদের দিকে একটু মুখ তুলে চাও তুমি!

মুহূর্তেই ঘটে গেল ম্যাজিক! দুজনের কাউকেই হার মানতে হলো না! দুজনই ভেতরে ভেতরে খুশিতে নেচে উঠল। সেই খুশির দমক যেন বাইরে থেকে টের পাওয়া না যায় সেজন্য তারা দুজন সারা শরীরের শিরা-উপশিরাগুলোকে টান টান করে ধরে রেখেছে। দুজন বিজয়ির বেশে একসঙ্গে আবার আগের মতো সংসার করতে শুরু করল।