মাংসপিণ্ড
ধাক্কা দিতে দিতে, খেতে খেতে, পায়ের পাতায় পারা খেয়ে, আরো জোরে পারা দিয়ে, চাপ দিয়ে, চাপে পড়ে মানুষ জন বাসের মধ্যে গাদাগাদি করে আছে। কেউ কেউ আছে অসহায়ের মতো বসে, আর অনেকেই আছে নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে। এদের অধিকাংশই নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং কেউ কেউ নিম্নবিত্ত। শহুরে মধ্যবিত্তরা এখন আর এইসব মুড়ির টিনে যাতায়াত করে না। ওরা প্রায় প্রত্যেকেই এখন একটি করে প্রাইভেটকারের গর্বিত মালিক। শুধুমাত্র নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরাই বর্তমানে এই সব মুড়ির টিনের মুড়ি এবং চাপ খাওয়া চিঁড়া।
জানালার পাশের এক ভাঙ্গাচোরা সিটে বসে গালে হাত দিয়ে ঝিমুচ্ছে একজন সিনেমার টিকেট ব্ল্যাকার। ঝিমুনির মধ্যেও সে তার ডান কানটিকে খাড়া করে রেখেছে বাসটি কখন আনন্দ-ছন্দ সিনেমা হলের সামনে এসে দাঁড়ায় সেই আশায়। প্রথম দিকে তার ব্যবসাটি কি জমজমাটই না ছিল! তবে হঠাৎ করে ইন্টারনেট আর স্মার্টফোন এসে তার ব্যবসা পুরোপুরি ধ্বসিয়ে দিয়েছে। মানুষ এখন আর আগের মতো হলে গিয়ে সিনেমা দেখে না। যার যা দেখার ঘরে বসে স্মার্টফোনে দেখে।
ইন্টারনেট আর স্মার্টফোন যুগের আগে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর ছেলেরা নীল ছবির টিকেটের জন্য ওর কাছে ধর্ণা দিত। আর এখন ওরা স্মার্টফোনের মধ্যেই পর্নোগ্রাফিতে ডুবে থাকে। সিনেমা বা পর্নোগ্রাফি—কোনটা দেখতেই লোকজন আর সিনেমা হলে তেমন একটা আসে না। ফলে সিনেমা হলের সামনে আজকাল পথচারী ছাড়া আর অন্য কোন লোক সচারচর দেখতে পাওয়া যায় না। দর্শক নেই তো টিকেট ব্ল্যাক করবে কার কাছে! আগে থাকা হতো ফ্ল্যাট ভাড়াতে করে আর এখন থাকতে হয় বস্তিতে। মনে হচ্ছে সিনেমার টিকেট কালো করা বাদ দিয়ে শীঘ্রই অন্য কিছু কালো করা শুরু করতে হবে। কত লোক টাকা কালো করতে করতে নিজেরা দুধের মতো সাদা হয়ে গেল! আহা—আর কেন! টিকেট কালো করা আর নয়।
বাসটির সামনের দিকে একটি নড়বড়ে সিটে বসে আছে একজন প্রাক্তন মন্ত্রীর সাবেক পিএস। সে অনেক কষ্টে পা দুটো সিটের উপরে তুলে সামনের দিকে উবু হয়ে বসে আছে। তার লালায় টসটস করা জিহ্বা কিছুটা ঝুলে আছে; আর মাঝে মাঝে দু-এক ফোঁটা লালা ঝরেও পরছে। মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে চরম প্রভু ভক্ত কুকুরের মতো বসে থাকতে থাকতে তার অবস্থা এমন হয়েছে যে স্বাভাবিক মানুষের মতো বসে থাকতে পারে না। ভিড় ঠেলে এসে বাস কন্ডাক্টর তার কাছে ভাড়া চাওয়া মাত্রই সে তড়াক করে ছোট একটি লাফ দিয়ে বলে ওঠে: “ইয়েস স্যার”। মন্ত্রী মহোদয়কে “ইয়েস স্যার” বলতে বলতে তার জিহ্বার গতি-প্রক্রিয়া এমন একটা স্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করেছে যে “ইয়েস স্যার” ছাড়া অন্য কোন ধ্বনি মুখ দিয়ে সহজে বের হতে চায় না। মাথা চুলকাতে-চুলকাতে: ইস, কি ভুলটাই না হয়ে গেল! পকেট হাতড়ে অনেক কষ্টে দুই টাকার কয়েকটা নোট বের করে শক্ত চোয়ালের কন্ডাক্টরের হাতে ধরিয়ে দেয়। হায়রে কপাল এখন দুই টাকার নোট বের করতেও পকেট হাতড়াতে হয়! অথচ স্যার যখন মন্ত্রী ছিল তখন স্যারের আঙ্গুল গলে কত পয়সা যে ঝরঝরিয়ে পড়ত—ভাবলেই “ইয়েস স্যার”, “ইয়েস স্যার” ধ্বনি উঠে গলা দিয়ে। জুয়ার নেশায় পড়ে সব টাকা শেষ হয়ে গেল! তখন কি আর বোঝা গিয়েছিল যে এই দল পরের বার আর ক্ষমতায় যেতে পারবে না এবং স্যারও দুর্নীতির দায়ে গরাদে ঢুকবেন! এক মাসের আঙ্গুল গলানো টাকা জমালে কি আজকে এই সামান্য বাস কন্ডাক্টরকে মনের ভুলে “ইয়েস স্যার” ডাকতে হয়!
একদম পেছনের সিটের জানালার পাশে আতংকগ্রস্ত মুখ নিয়ে বসে আছে সরকারি অফিসের একজন মাছি মারা কেরানি। সে এমনভাবে বসে আছে যে দেখে মনে হয় নিবিষ্ট মনে হিসাবের খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। তার নিচের ফ্যাঁকড়া ঠোঁট খানিকটা ঝুলে পড়েছে। আর তার চশমাটি কোনমতে নাকের ডগা চেপে ধরে আছে। নীচ দিকে তাকিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আর চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসে থাকতে থাকতে তার ঘাড় এবং পিঠ এমন স্থায়ীভাবে বেঁকে গিয়েছে যে বুক টান করে দাঁড়াতে গেলেই বেসামাল হয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। ঘুষের টাকা গুনতে গুনতে তার তর্জনী ও বুড়ো আঙ্গুলে কড়া পড়ে গিয়েছে। কেরানীর হিসাব করাই সার। ঘুষের প্রায় সব টাকাই ভুড়িওয়ালা বড় সাহেবদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়। সংসারের বিশাল তিমির মতো হা–করা মুখে ঘুষের টাকার সামান্য ভাগ আর বেতনের কটি টাকা হাওয়াই-মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যায়। এভাবেই একরকম কেটে যাচ্ছিল দিন-মাস-বছর। তবে কিছুদিন আগে পাড়ার বখাটে ছেলেরা তার ক্লাশ নাইনে পড়া মেজো মেয়েটিকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ধরে নিয়ে যায়। তারপর রাতভর গণ-ধর্ষণ করে কাক ডাকা ভোরে রাস্তার পাশে মেয়েটির লাশ ফেলে রেখে যায়। থানায় গিয়ে মামলা করার কথা মাথায় এসেছিল একবার। তবে বখাটেগুলো বাসায় এসে, “থানায় গেলে আপনার ছোট মেয়েটিরও একই অবস্থা হবে।” বলে হুমকি দিয়ে যাবার পর থেকে শোকও উধাও হয়ে গিয়েছে! ভয়ে বুকটা সবসময় ঢিপ ঢিপ করে।
বাসটি ঘষটে ঘষটে এগিয়ে চলছে, যতটুকু সময় চলে তার চেয়ে বেশি সময় থেমেই থাকে। মাঝে মাঝে এমন মনে হয় যে ফুটপাত দিয়ে ধুকে-ধুকে, কেশে-কেশে, হাঁপাতে-হাঁপাতে, হোঁচট খেতে-খেতে চলা পথচারী বাদে আর সবকিছুই যেন আলিফ-লায়লার জগতের মতো প্রস্তরে পরিণত হয়েছে।
যাহোক, বাসের মাঝখানে ডান হাতের শক্ত মুঠিতে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এই ভীড়ের মধ্যেও কাঠের ডাটের পুরাতন ছাতাটি বাম বগলে চেপে ধরে আছে। যদিও পাঁচ বছর আগেই শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছে তবুও নিজেকে এখনও শিক্ষক ভাবতে ভালো লাগে তার। দাগ রেখে যাওয়ার কি মধুর দিনগুলোই না ছিল তখন! ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শরীরে নিজের হাতে তৈরি লালচে দাগগুলো দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছে হতো তার। মন চাইত সেগুলোর উপর পরম সোহাগে হাত বোলাতে। দাগগুলো নিশ্চয়ই খানিকটা ফুলে ফুলে উঠত। অন্য শিক্ষকদের মতো বর্বরোচিত ভাবে দাগ ফেলত না সে। ওই সময় সে বাচ্চাদের সাথে মিষ্টি সুরেলা গলায় আলাপচারিতা করত: আজকে কি দিয়ে ভাত খেয়েছিসরে? তোর সার্টটা তো খুব সুন্দর হে। তোর বাড়ি যেন কোন গ্রামে? তোর বাবার নাম কিরে? তোরা কয় ভাই-বোন, তোর ছোট ভাই কোন ক্লাশে পড়ে? দাগ তৈরির উদ্দেশ্যে সে সাপের শরীরের মতো চক্কর-চক্কর বেতটি তাদের কোমল শরীরে কিছু সময় চেপে ধরে রাখত। এতে করে দাগটা অনেক ভালোভাবে বসে যেত এবং জায়গাটা গাঢ় লালচে হয়ে উঠত। এক অনির্বচনীয় সুখে ভরে যেত তার মন-প্রাণ। অদ্ভুত এক মাদকতায় আবেশিত হয়ে ওঠা শরীর শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠত।
একটি বোকা ধরনের ছেলের গায়ে দাগ বসিয়ে সবচেয়ে বেশি সুখ পেত সে। দাগ বসানোর সময় ছেলেটি একটুও নড়াচড়া করত না, বিশাল-বিশাল কালো ড্যাব-ড্যাবে চোখ মেলে সুদূর পানে তাকিয়ে থাকত শুধু। এক অদ্ভুত নীল বেদনায় ভরে যেত ছেলেটির মায়াভরা মুখ। ক্লাশে কোনদিনই পড়া শিখে আসত না সে। ফলে প্রতিদিনই ওর গায়ে রসিয়ে রসিয়ে লালচে দাগ ফেলা যেত। আহা! ঐ মধুর দিনগুলো যদি আবার ফিরে পাওয়া যেত।
বাসটি আনন্দ-ছন্দ সিনেমা হলের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ একটি আর্ত চিৎকার—আমার মোবাইল ফোন গেল রে গেল। বিচ্ছুটা আমার মোবাইল ফোন নিয়া গেল। ধর, ধর, ধর। ওই যে বিচ্ছুটা যাইতাছে, দৌড়াইয়া যাইতাছে। আমার মোবাইল নিয়া যাইতাছে। ধরেন ভাই, ধরেন, বিচ্ছুটারে ধরেন। আমার সর্বস্ব নিয়া যাইত্যাছে।
মোবাইল ছিনতাই হওয়া লোকটির আর্ত চিৎকার শুনে টিকেট ব্ল্যাকার, সরকারি অফিসের কেরানি, প্রাক্তন মন্ত্রীর সাবেক পিএস, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং বাসের ভেতরে থাকা অন্য যাত্রীরা সকলেই বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের শরীরের রক্ত প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠে এবং এক পর্যায়ে বলক পাড়তে আরম্ভ করে। ওদিকে লাফাতে শুরু করে মুহূর্তের মধ্যেই ইস্পাতের মতো দৃঢ় হয়ে উঠা মাংসপেশীগুলো। সাহসের আতিশয্যে ফুলে ওঠা হৃদপিণ্ড তাদের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। রক্ত-মাংস-মেদ-হাড়-মজ্জা ছেনে দেহের সমস্ত পুষ্টি-অপুষ্টি-বর্জ্য ঘেঁটে তৈরি হওয়া ঘন আঁঠালো তরল তাদের অণ্ডকোষে জমা হতে শুরু করে। ছোট অণ্ডকোষ দুটির ভেতর মুহূর্তের মধ্যেই এত তরল জমে উঠে যে থলি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। আর অণ্ডকোষের ভেতর জমা হওয়া ঘন থিকথিকে তরল মুহূর্তের মধ্যেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। ওগুলো আর আবদ্ধ জায়গায় আটকে থাকতে চায় না, বের হয়ে পড়তে চায়, ছিলকে পড়ে পথ-ঘাট-প্রান্তর-নদী-নালা-খাল-বিল ভাসিয়ে দিতে চায়।
বাস যাত্রীরা তাদের অণ্ডকোষের ভেতর প্রচণ্ড উত্তেজনা অনুভব করে। তারা দু-হাতে তাদের অণ্ডকোষ চেপে ধরে বাস থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করে। প্রথমে বিচ্ছুটাকে দেখতে পায় না ওরা। ফলে ভীষণ অস্থিরতায় এদিক-ওদিক খুঁজতে থাকে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, অইত, হাফপ্যান্ট পড়া খালি গা; হাঁপাতে-হাঁপাতে প্রচণ্ড গতিতে দৌড়াচ্ছে। বিচ্ছুটা কোন একটা সরু গলির ভেতরে ঢুকে পড়তে চায়, তবে চোখের সামনে কোন গলি খুঁজে পায় না।
ওরা কি পারবে বিচ্ছুটাকে ধরতে? হ্যাঁ, অবশ্যই পারবে। ওরা প্রত্যেকেই এখন পৃথিবীর দ্রুততম মানবে পরিণত হয়েছে। ওদের পায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা আজকে উড়তেও পারবে। যাহোক ওরা বিচ্ছুটার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। এইতো, এইতো, ধর, ধর, বিচ্ছুটারে ধর। আর যাবে কোথায় বাপধন, আর পালানোর রাস্তা নেই!
ইশ! আহ! আহ! ইশ! কি শান্তি! কি মজা! ইশ! ইশ! আহ! আহ!—কি পুলক! কি আনন্দ!
অনন্য পুলক লাভ করতে থাকে তারা। এমন পুলক তারা আগে কোন দিন লাভ করেনি! তাদের আন্ডারওয়্যার পুরোপুরি ভিজে যায়। ঘন থিকথিকে আঁঠালো তরল তাদের পা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
যাহোক, এই অনন্য পুলক লাভের আশায় আশেপাশের শত শত মানুষ বিচ্ছুটার চারপাশে জমা হতে থাকে। কারো আশাই বিফলে যায় না। সকলেই অনন্য পুলক লাভ করে, পাঁচটি-দশটি-পনেরটি-বিশটি করে পুলক লাভ করে। এমনকি কেউ কেউ নাকি পঞ্চাশটির মতো পুলক লাভ করেছে বলেও শোনা যায়। কালো পিচের রাস্তা ভরে উঠে শত শত মানুষের অণ্ডকোষ নিঃসৃত ঘন থিকথিকে আঁঠালো তরলে।
যাহোক, অনন্য পুলক লাভের ফলে তাদের সকল জরা, ক্লান্তি, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, হতাশা, রোগ, শোক—সবকিছুই কিছুক্ষণেরর জন্য দূর হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এমনকি বয়স্ক মানুষরাও নাকি তাদের বার্ধক্যের ঘেরাটোপ থেকে মুহূর্তের জন্য মুক্তি পেয়ে টগবগে তরতাজা তরুণে পরিণত হয়।
রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় গাঢ় লাল ছোটখাট একটি মাংসপিণ্ডকে। ওই মাংসপিণ্ডটার আর কোনদিন ক্ষুধা লাগবে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আর কোন দিন কাতরাতে হবে না ওটাকে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন