ভূখণ্ডের আত্মায় মেঘ ও সূর্য

অ+ অ-

 

|| ১ ||

তাহমিদ তার বুকের ভিতর পকেট গুঁজে রাখে একটা জিপসনের তৈরি ছোট মানচিত্রবাংলাদেশ।এটা কিনা টং দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে একদিন নিজ হাতে আঁকে, যখন সামিনা ফারাহ প্রথম তাকে বলে

তুমি বরাবরই অতিরিক্ত সিরিয়াস, তুমি বুঝো না যে ভালোবাসার ভিতরে থাকা যায় শুধু নরম হয়ে।

সেই নরমে তাহমিদ বারবার খোঁজে লড়াই, আর সামিনা ভালোবাসার নামে সাজিয়ে ফেলে নাটক, গানে, গজলে পূর্ণ ভারতবর্ষ। তাহমিদের কাছে সামিনার নাচে হাতের ভঙ্গিমাটুকুও একেকটা সিম্বল—‘সাংস্কৃতিক দখলদারি

তবু তারা প্রেম করে, যেমন করে ঢাকা শহরের ক্লান্ত দেয়ালে এখনও টিকে থাকা কিশোর-কিশোরীর স্কেচঅর্ধেক মুছে গেছে, বাকিটা ধরে রেখেছে রোদ।

সামিনা ফারাহ মেয়েটির মনে খেলে যায় অসংখ্য গজল, উপমহাদেশের ধ্রুপদি প্রেম। কিন্তু তাহমিদ চায় এমন এক প্রেম, যার রক্তে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ, যার শিরায় থাকবে শ্রমিকের স্বেদ।

সে বলতে চায়—‘তুমি ভারতীয় কালচারাল হেজিমনির একজন অনিচ্ছাকৃত বাহক, সামিনা। তুমি জানো না, তোমার গানও আমাদের পরাজয়ের ইঙ্গিত দেয় কখনো কখনো। সামিনা উত্তর দেয়—‘তুমি যে শুধু প্রতিবাদ করো, তাতে ভালোবাসা থাকে না। তুমি যখন গান শুনতে ভয় পাও, তখন আমার ঠোঁটের শব্দেও তুমি দেশপ্রেম খোঁজো। তাদের সেই সংলাপ, যেন পাহাড়ে ধাক্কা খাওয়া ঢেউছিটকে পড়ে আবার জেগে ওঠে।

তৌহিদ আর লাবণ্য, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, হলের পিছনের বাগানে সিগারেট টেনে বলে

বাম ডান কিছু নেই রে ভাই, এখন কেবল সেলফি তোলা। মানুষজন আর ভিসির চামচা। চিন্তা মরে গেছে অ্যাপ্লিকেশনের লাইনে।

শাকিল তার উঁচু গলার বক্তৃতায় বলে ফেলে—‘এখন যারা সবচেয়ে বেশি চিৎকার করে, তারাই প্রক্টরের টেবিলে বসে।

আহনাফ ক্লাসে যায় না, তবু সকলের মতামত লিখে রাখে নিজস্ব ব্লগেযার নাম ন্যারেটিভস ও এর ভয়ংকর প্রভাব

তাদের চারপাশে ছাত্র রাজনীতির দুর্গন্ধহল থেকে ভেসে আসে, বেঁচে থাকা বা বেঁচে থাকার ভান করে চলা কিছু নেতার স্বপ্ন।

তানভি মেহজাবিন আর রাত্রী আহমেদ দাঁড়িয়ে দেখে, ঘুমহীন রাতগুলোর ফাটলে কীভাবে ঢুকে পড়ে মুখোশপরা কর্মীযাদের প্রেম নেই, আছে কেবল দখলের নেশা।

রাত্রি আহমেদ পছন্দ করে ঝরনাতার শব্দে সে পায় জীবনের নরমতর ভাষা। আহনাফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রাত্রির পাশে। সে প্রেমকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু বিশ্বাস করে পাহাড়ে ঠাণ্ডা বাতাসে প্রেমে পড়া যায়।

তৌহিদ আর লাবণ্য কথা বলে এক নতুন বাংলাদেশ নিয়ে যেখানে প্রকৃত কৃষক চিন্তায় জায়গা পাবে, কর্মীর থেকে বড় হবে তার সংগ্রাম।

তাদের প্রেম এমন, যেন ঝরনার নিচে বসাভিজে কিন্তু ভয়হীন।

তবু তাহমিদ আর সামিনা বারবার ফিরে আসে এক সংকটেকোথায় তাদের ভালোবাসা, আর কোথায় তাদের জাতিসত্ত্বা?

তারা কি আলাদা কিছু, নাকি একই নদীর দুই কূলে দাঁড়িয়ে, হাত নাড়ছে, অথচ ছুঁতে পারছে না?

তাহমিদ বলে—‘আমি ভারতীয় প্রপাগান্ডায় বিশ্বাস করি না। তোমার প্লে-লিস্টেও আগ্রাসন দেখি, সামিনা।

সামিনা কাঁদে না, সে কেবল গলায় চেপে থাকা শব্দগুলো লিখে রাখে—‘ভালোবাসা আর দেশপ্রেমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, তুমি যদি একদিন জিতেও যাও, আমি কি জিতব?

রাতে তারা দুজন হেঁটে যায়, নিঃশব্দ অথচ ভেতরে উত্তাপ। নিয়ন আলো তাকিয়ে থাকে যেন কিছু বলবার অভিপ্রায়ে। উদ্যানের পাশে হাটে, তারা চুপচাপ শোনে পাখির কলরবএমন এক স্বর, যা কখনো কোনো ভূখণ্ডকে ভাগ করে না। তারা স্বপ্ন দেখে এক নতুন বাংলাদেশযেখানে প্রেম ও চিন্তা সমানভাবে সম্মানিত, যেখানে বুদ্ধিজীবীরা আর দলবাজির প্রতিভূ নয়, বরং দ্রোহের আগুন।

তবু গল্পটা থেমে থাকে না। কেউ সরে আসে না। ঘুমহীন চোখে তারা ভবিষ্যতের ছায়া খোঁজেএক অপূর্ণ বিপ্লবের প্রতিফলন তাদের মুখে। দূরে কোথাও একজন হেসে ওঠে, তোমরা হেরে যাওনি, সময়ের কাছে কেবল ইজারা দিয়েছো গৌরব।

তাদের নিঃশব্দতায় প্রেম ও জাতিসত্তার মাঝখানে একটি পাখি থেমে যায়যেন উড়তে ভুলে গেছে।

 

|| ২ ||

তাহমিদের মনে এক গোপন ঘর আছেসেখানে বৃষ্টি, ঘন ঘুম, আর এক বিকেলের পতাকা। সেই ঘরে সামিনা প্রবেশ করে, নিঃশব্দে, জুতো খুলে। কিন্তু তার ব্যাগে থাকে ইউটিউব প্লে-লিস্ট—‘তুমি যতবারই চোখে তাকাও আর রাধা কেন গাগরির পানি ঢালো

তাহমিদের অস্বস্তির শুরু ঠিক তখন, যখন সামিনা বলে, তুমি একটা গানও শুনো না, যেন গান মানেই বিশ্বাসঘাতকতা।

তাহমিদ জবাব দেয়—‘সংস্কৃতি একটি নরম সাম্রাজ্য। তুমি কি জানো হিন্দি সিরিয়াল কিভাবে তোমার দাদির কাঁথার নকশাটাও বদলে দিয়েছে?

তাদের তর্ক হাসি দিয়ে শুরু হয়, অশ্রু দিয়ে শেষ হয়। সামিনা চায় ভালোবাসা হোক নাচের মতোধীরে, ইঙ্গিতে, আবেশে। তাহমিদ চায় তা হোক একুশের মিছিলের মতোস্পষ্ট, অদম্য, দেশজ। তারা কেউ সরে যায় না। এক বৃক্ষ, দুই শিকড়, শুধু আলাদা আলাদা মাটিতে।

ক্যাম্পাসে তখন একটা অদৃশ্য কাদা জমছেচিন্তার বদলে ক্লিশে, প্রশ্নের বদলে প্রটোকল। ক্যান্টিন থেকে হলে যাওয়ার পথে দেয়ালে আঁকা হাতুড়িহাসি আর জয় নেতার স্লোগান যেন একই তুলি থেকে বেরোনো।

জেনিফার বলে—‘আমরা সবাই কারো না কারো ন্যারেটিভে ঢুকে আছি। কেউ নিজের মতো নই।

আহনাফ কিছু বলে না, কেবল লেখে—‘জ্ঞান এখন প্রক্টরের অধীনস্থ, প্রেম এখন লাইকের বন্দী।

লাবণ্য ফিসফিসিয়ে বলে—‘তাহলে কী করব? বাঁচব না?

তাহমিদ হেসে ওঠে—‘চলো পাহাড়ে যাই। জ্ঞান না হোক, অন্তত চোখ তো শান্ত হবে।

তাহমিদ পাহাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়, সাদা মেঘে চোখ রাখে। আর সামিনা চুপচাপ বসে থাকে ঝরনার নিচে। পাথরের গায়ে ঠেকা ভিজে আলোর মতো তাদের সম্পর্ককখনো জ্বলছে, কখনো নিভছে।

সামিনা বলে, আমি গান শুনি বলে তুমি আমায় বিশ্বাস করো না?

তাহমিদ চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, আমি বিশ্বাস করতে চাই, কিন্তু তুমি যখন কারো হেল্প”-এর গল্প বলো, তখন আমার শহীদ ভাইয়ের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

সামিনা তখন খুব ধীরে তার হাত ধরে বলে—‘তুমি কি শুধু যুদ্ধ দেখবে? যুদ্ধ ছাড়া কি প্রেম হয় না? আমি কি শত্রু, তাহমিদ? তারা চুপচাপ থাকে।

পেছনে ঝরনার শব্দ। সামনে পাহাড়ে মেঘ নামছেআকাশ যেন পিয়ানো হয়ে গেছেসব চাবি ধূসর। মনের কোনায় স্মৃতি বসে থাকে যেন আদুরে বিড়াল।

কোনো একদিন তাহমিদ আর সামিনার দেখা হয়েছিল একাডেমিক ভবনের পেছনের লনে, যেখানে কাশফুলে ঢেকে যায় অক্টোবরের বিকেল। সেদিন সামিনা পড়ছিল গিরিশ কারনাডের নাটক Hayavadana—

তাহমিদ খুঁজছিল ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ছাত্র সমাজের ভূমিকা। তাদের চোখাচোখি হয়েছিল বইয়ের পৃষ্ঠার ভেতর দিয়ে। প্রথম কথা ছিল এমনসামিনা বলেছিল, তুমি কি শুধু ইতিহাসই পড়ো?

তাহমিদ বলেছিল, ইতিহাস ছাড়া কেউ ভবিষ্যৎ বুঝে? সেই থেকে তাদের প্রেম শুরু

একটা পক্ষকাল পর তারা সিনেমা দেখলো। সিনেমার নাম Court—মারাঠি ভাষার, নীরব আর অশ্রুতিপূর্ণ।

সেদিন তাহমিদ বলেছিল—‘আমরা কি এই সমাজের ফালতু দর্শক হয়ে যাব, সামিনা? সামিনা তার হাত ধরেছিল। আকাশে চাঁদ ছিল না, ছিল নিঃশব্দ জোয়ার। প্রায়শই সামান্য বিষয়ে বিরোধ বাধে তাহমিদ আর সামিনার মধ্যে। একটি নাটকের নাম নিয়ে।

সামিনা বলে, আমি রঙ দে বাসন্তী দেখেছি তিনবার। তুমি না দেখেই বলোএটা ভারতীয় ন্যারেটিভ।

তাহমিদ হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। তার গলা কঠিন হয়ে আসে— ‘আমার শহীদ ভাইরা ছাতার নিচে রঙ মাখেনি, তারা গুলি খেয়েছে, বুলেট ছিনিয়েছে, দেশ ছিনিয়ে এনেছে।সামিনা এবার রাগে ফেটে পড়ে—‘তুমি শুধু তোমার ইতিহাস চেনো, আমার অনুভব নয়?

তারা তখনই হাঁটা ধরে দুই বিপরীত দিকে। কাশফুলের পথ আর সমান্তরাল থাকে না।

 

|| ৩ ||

একটু দূরে পাহাড়নীলাচল।

তাহমিদ, সামিনা, জেনিফার, রাত্রী, মাহজাবিন, তৌহিদ, লাবণ্য

তারা কয়েকদিনের সফরে যায়, যেন শহরের বিষাক্ত বাতাস থেকে নিস্তার চায়। মন থেকে শ্যাওলার সাথে সাথে বাষ্পও সরে যাক। পাহাড় থেকে নিচে তাকালেই মনে হয় মেঘ আর আকাশের দূরত্ব কঠিন ও অমায়িক।

ঝরনার নিচে বসে থাকা রাতে আহনাফ বলে, আচ্ছা, এই প্রকৃতি কি পক্ষপাতদুষ্ট? আমাদের মত করে তো সে বিভাজিত নয়।

রাত্রীর কণ্ঠ থেমে যায় কিছুক্ষণ। তারপর সে বলে—‘তবে মানুষ কেন এত বাম-ডান হয়?

কেউ জবাব দেয় না। সামিনা তখন পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি জানো তাহমিদ, আমি এখন বুঝিদেশ মানে শুধু মাটি না, দেশ মানে তুমি আমাকে সম্মান করবে, আমার অভিরুচিকেও।

তাহমিদ শান্তভাবে তাকায়, বলে—‘আর তুমি আমাকে আমার সংকল্পসহ ভালোবাসবে, তোমার শিল্পে যেন আমার রক্ত মিশে থাকে, তোমার প্রেমে যেন আমার পতাকা উড়ে।

তাহমিদ আর সামিনা ফিরে আসে এক নতুন উপলব্ধি নিয়েতাদের সম্পর্কও যেন একটি রাষ্ট্র হয়ে ওঠে, যেখানে দ্বন্দ্ব আছে, তবু একটি পতাকা আছেযেখানে প্রেম ধ্বংস না করে, রূপান্তর করে। তারা আর ইগোর কাছে হার মানে না।

তারা চেষ্টা করে বুঝতেপতাকা আর প্রেম, দুইই একটি আত্মপরিচয়ের অংশ। একটি বাঁচায় মাটি, একটি হৃদয়।

তবে তাদের বন্ধুরাতন্বি, রাত্রী, তৌহিদ, লাবণ্যসবার মনেই রয়ে যায় সেই শেষ বিকেলের ছায়া, যেখানে পাহাড়ের নিচে বসে এক শিশুর কণ্ঠ বলে গিয়েছিল—‘তর্ক নয়, ত্যাগই দেশ।

গল্প শেষ হয় না। একটি শেষ-হীন শুরু হয়যেখানে একটা পতাকা উড়ে না, বরং হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় কিছু প্রশ্ন আর প্রেম। তাহমিদের পকেটে সেই মানচিত্রটা এখনো আছে। ছেঁড়া, কিন্তু উষ্ণ।

সে জানে, যতদিন এই মানচিত্রে ভালোবাসার দাগ থাকে, ততদিন রাষ্ট্র শুধু শাসনের জায়গা নয়ভালোবাসার প্রতিরোধও।

তারা হাঁটে আলাদা সীমারেখায়, তবু অভিন্ন সুরে। তাদের পায়ের নিচে রক্তমাখা মাটি, চোখের সামনে ভোর। ভালোবাসা যদি না জানে দেশের ইতিহাস, তবে তা চুম্বনের বদলে একধরনের ভোলাভালা পরাধীনতা।