নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: আফ্রিকান সাহিত্যের অনন্য কণ্ঠস্বর

অ+ অ-

 

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, উপনিবেশ-পরবর্তী আফ্রিকান সাহিত্যবীক্ষার এক অনন্য কণ্ঠস্বর, তাঁর জীবদ্দশায় পরিণত হয়েছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে।  কেনিয়ার এই লেখককে আফ্রিকান সাহিত্যের একজন দিকপাল হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যাঁর জীবন জড়িয়ে ছিল ইতিহাসের বহু নাটকীয় পর্বের সঙ্গে।  তিনি ছিলেন চিনুয়া আচেবে ও ওলে সোয়িঙ্কার মতো যুগসামান্তর লেখকদের সমসাময়িক, যাঁরা ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে আফ্রিকার সাহিত্য-জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আচেবে যেভাবে উপনিবেশিক শাসনের ফলে সৃষ্ট আত্মবিচ্ছিন্নতার বেদনাকে ধারণ করেছিলেন, আর সোয়িঙ্কা যেভাবে আফ্রিকান ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্য মুক্তির ধারণার সংঘাত বিশ্লেষণ করেছিলেন, নগুগি তেমনি দাঁড়িয়েছিলেন এক প্রতিবাদী, প্রত্যক্ষ ও নির্ভীক কণ্ঠস্বর হয়ে।  তাঁর উপন্যাসগুলো ছিল যেন একটি বিশাল ভাষিক অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি আঘাত করেছিলেন প্রথমে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে, পরে স্বাধীন কেনিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকের বিরুদ্ধে।  ৮৭ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি রয়ে গিয়েছিলেন আপসহীন, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক লেখক, যার সাহিত্যিক জীবন ছিল দীর্ঘ এবং সংগ্রামে পূর্ণ।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর জীবন বিশ শতকের বিশাল একটি পরিসর জুড়ে বিস্তৃত। তিনি জন্মেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগমুহূর্তে, সেই সময়ে যখন কেনিয়া ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি উপনিবেশ।  তাঁর শৈশব কেটেছিল স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ছায়ায়, যা তাঁর রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক চেতনার বীজ বপন করেছিল।

উগান্ডার মেকেরেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেছিলেনএকটি সময়, যখন গোটা আফ্রিকাজুড়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সাহিত্যিক নবজাগরণ একসঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছিল। যখন উগান্ডা ১৯৬২ সালে এবং কেনিয়া ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন নগুগি তরুণ।  কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোয় তিনি প্রত্যক্ষ করেন কীভাবে সেই বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার স্বপ্ন ক্রমেই ধুলিসাৎ হয়— একটি কর্পট রাষ্ট্র ও বিশ্বাসঘাতক নেতৃত্বের কারণে।

এই বাস্তবতার প্রতিক্রিয়ায় নগুগি কলম ধরেন, আর তাঁর সাহসী লেখালেখির ফলস্বরূপ কেনিয়ার সরকার তাঁকে কারাগারে পাঠায়। মুক্তি পাওয়ার পরও তিনি থামেননি— নিজের রাজনৈতিক আদর্শ এবং সাহিত্যকর্মকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে কেনিয়াতে, পরে নির্বাসনে লন্ডনে, এবং অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তিনি গত তিন দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়িয়েছেন।

তবে নগুগি কেবল একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন না— তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতিস্পর্ধী উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তক। তাঁর ১৯৮৬ সালের প্রবন্ধ সংকলন Decolonising the Mind গোটা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীদের জন্য এক অপরিহার্য পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। এতে তিনি উপনিবেশিক ভাষা (যেমন ইংরেজি ও ফরাসি)-র মাধ্যমে সাংস্কৃতিক দখলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

এমনকি তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়েও, প্রতিবছরই যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হতো, তখন বহু পাঠক ও গবেষকের মনে আশার প্রদীপ জ্বলত— এইবার বুঝি নগুগির পালা।  আর সে আশাভঙ্গও পরিণত হয়েছিল এক প্রাতিষ্ঠানিক, বার্ষিক বিষণ্ণতায়।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো ১৯৩৮ সালে কেনিয়ার আগিকুয়ু জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন। তাঁর শৈশব কেটেছিল লিমুরুতে— নাইরোবি থেকে মাত্র ১৮ মাইল দূরে এক অঞ্চল, যা এক সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

১৮০০-এর দশকের শেষভাগে ব্রিটিশরা কেনিয়াতে প্রোটেক্টোরেট ঘোষণা করার পর থেকেই ‘ভূমি' হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক দখলের মূল উপাদান।  লিমুরুর মতো এলাকায় আফ্রিকানদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে সেগুলোয় চা ও কফির চাষ করা হতো, যা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণ করত।  এই দখলদারির ফলে নগুগির পরিবার ভূমিহীন ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট হয়ে পড়ে।

এই সংকট পরিবারে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর বাবা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং স্ত্রী ও ২৪ সন্তানের ওপর নির্মম আচরণ করতে শুরু করেন।  কিন্তু এই কঠোর বাস্তবতার মধ্যেও নগুগির মা, ওয়াঞ্জিকু ওয়া নগুগি, ছিলেন এক অনমনীয় আশাবাদী।  তিনি সন্তানদের শিক্ষিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন— এমনকি যখন ১৯৪০-এর দশকে চারপাশে শুরু হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা প্রতিরোধ। তাঁর এই শিক্ষানিষ্ঠা ও মানসিক দৃঢ়তাই ছিল নগুগির ভবিষ্যতের বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের প্রাথমিক ভিত্তি।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর সাহিত্যজীবনের কেন্দ্রে যে সংগ্রামটি অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে ছিল, তা হলো ল্যান্ড অ্যান্ড ফ্রিডম আর্মি বা এলএফএ— যা ব্রিটিশদের দেওয়া অবজ্ঞাসূচক নাম “মাউ মাউ” নামেই বেশি পরিচিত। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের কাহিনি ছিল তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলোর ভিত্তিমূল, কারণ এই আন্দোলন শুধু কেনিয়ার স্বাধীনতার লড়াই নয়, বরং নগুগির ব্যক্তিগত ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত ছিল।

লিমুরুর এলাকা থেকেই এলএফএ-এর কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছিল, এবং নগুগির পরিবার এই সংঘাতের মধ্যেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাঁর বড় ভাই গুড ওয়ালেস ছিলেন এলএফএ-এর সক্রিয় সদস্য, যিনি উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন।  অপরদিকে, তাঁর আরেক ভাই কাবায়ে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে মিয়ানমারে যুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের জন্য কাজ করেছিলেন।  ভাই টুম্বো ছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের এক নিম্ন-স্তরের গুপ্তচর।  আর তাঁর শ্রবণপ্রতিবন্ধী ভাই গিতোগোর পরিণতি ছিল মর্মান্তিক— একটি পুলিশি চেকপয়েন্টে এলএফএ যোদ্ধাদের খোঁজে চলা তল্লাশির সময় পেছন থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান, কারণ তিনি পুলিশের আদেশ শুনতে পাননি।

এই পারিবারিক বিভাজন ও রক্তাক্ত ইতিহাস নগুগির সাহিত্যকে তীব্র রাজনৈতিকতা এবং আবেগঘন বাস্তবতায় পরিপুষ্ট করেছিল। তাঁর কলমে ধরা পড়েছিল উপনিবেশের নির্মমতা, প্রতিরোধের দ্বন্দ্ব, এবং স্বাধীনতা-আন্দোলনের অন্তর্গত নৈতিক জটিলতা।

কিশোর বয়সে নগুগি একদিন তাঁর বন্ধুসহ পড়ে গিয়েছিলেন এমনই এক নৃশংস বাস্তবতার মধ্যে— ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রশাসনের পরিচালিত এক দমন-পীড়নমূলক পুলিশ তল্লাশি।  দিনের আলোতেই রাস্তায় হাঁটত এক ভীতিকর দল: সাদা হুডে মুখ ঢাকা গুপ্তচর, যাঁদের চোখের জন্য ছিল কেবল দুটি ছোট ছিদ্র; তাঁদের সঙ্গে থাকত ব্রিটিশ সৈন্য এবং হোম গার্ড নামক একটি আধাসামরিক বাহিনী, যা মূলত আগিকুয়ু সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ-অনুগত সদস্যদের নিয়ে গঠিত ছিল এবং পরিচালিত হতো ঔপনিবেশিক অফিসারদের দ্বারা।

এই দলে থাকা গুপ্তচররা কেবল মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিতেন— কে ছিল এলএফএ সদস্য কিংবা সমর্থক। বয়স, অবস্থা বা অপরাধপ্রমাণ— কোনো কিছুর তোয়াক্কা করা হতো না। রাস্তা থেকে যাকেই পেত, তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। এই নির্মম অভিজ্ঞতারই একটি রূপান্তরিত রূপ পরবর্তীকালে উঠে আসে নগুগির তৃতীয় উপন্যাস A Grain of Wheat-এ, যেখানে এক কাল্পনিক গুপ্তচরের কাহিনি উঠে এসেছে।

সেদিন নগুগি ও তাঁর বন্ধুকে ব্রিটিশ অফিসাররা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।  ভাগ্যক্রমে, তাঁরা দুজনেই মুক্তি পেয়েছিলেন। তবে যখন তাঁরা ধীরে ধীরে তল্লাশির এলাকা থেকে সরে যাচ্ছিলেন— পিছনে না তাকিয়ে— তখন বাতাস কাঁপিয়ে উঠেছিল গুলির শব্দে ও মানুষের আর্তনাদে।  তাঁদের কানে পৌঁছেছিল সেই নিঃশব্দ ভয়াবহতা, যা নির্দেশ করেছিল: যাঁরা চিহ্নিত হয়েছেন কিংবা প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেছেন, তাঁদের সেদিন পথেই প্রাণ দিতে হয়েছে।  এই অভিজ্ঞতা নগুগির সাহিত্যিক চেতনার গভীরে গেঁথে গিয়েছিল, এবং তাঁর লেখার নৈতিক তীব্রতা ও রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতা অনেকটাই এ ধরনের ব্যক্তিগত স্মৃতির প্রতিফলন।

কয়েক মাস পর, ১৯৫৫ সালে, অ্যালায়েন্স হাই স্কুলে তাঁর প্রথম মেয়াদ শেষ করে নগুগি বাড়ি ফিরেছিলেন—এক এলিট বোর্ডিং স্কুল, যেখানে পড়ার সুযোগ পেতে তাঁর পরিবার কঠিন ত্যাগ স্বীকার করেছিল; তারা ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে তাঁর প্রথম মেয়াদের খরচ চালিয়েছিল, আর পরবর্তী সময়ে নগুগি একটি বৃত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামে ফিরে তিনি এক বিভীষিকাময় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

নিজের স্মৃতিকথায় নগুগি সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন গভীর ব্যথায়: “আমি থেমে যাই, বাক্সটা নামিয়ে রাখি, আর চারপাশে তাকাই। ছাই পাতার সেই বেড়া এখনও আছে, যা আমরা আগে লাগিয়েছিলাম, কিন্তু এর বাইরে যা দেখি তা নিঃশেষ ধ্বংসের চিহ্ন— শুকনো পোড়া মাটি, ছিন্নভিন্ন কাঠ, আর ঘাসের পোড়া স্তূপ।” ব্রিটিশ বাহিনী তাঁর পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল, এবং গ্রামবাসীদের জোর করে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এমন এক ‘নিরাপদ’ বসতিতে, যেখানে তাদের প্রতিটি কার্যকলাপ নজরদারির আওতায় রাখা হতো।

এই নতুন গ্রাম ঠিক কারাগার ছিল না, তবে নগুগি নিজেই লিখেছিলেন, “ব্যবহারিক অর্থে, কারাগার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আর এই ‘গ্রাম’-এর মধ্যে পার্থক্য ঘুচে গিয়েছিল।” রাতে সৈন্যরা লোকজনকে ঘর থেকে টেনে বের করত, যাদের সন্দেহ হতো তারা এলএফএ-র প্রতি সহানুভূতিশীল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করত, আর অনেক সময় সেখানেই তাদের প্রাণ কেড়ে নিত।  এই অভিজ্ঞতা নগুগির কাছে শুধুই ব্যক্তিগত ক্ষতি ছিল না— এ ছিল ঔপনিবেশিক সন্ত্রাসের প্রকৃত মুখোমুখি হওয়া, যা পরবর্তী জীবনে তাঁর সাহিত্য ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরতরে গড়ে দিয়েছিল।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর সাহিত্যিক জীবনকে প্রায়শই দুটি পরিসরে বিভক্ত করে দেখা হয়।  প্রথম পর্বের নগুগি আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে, যখন তিনি উগান্ডার মেকেরেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় লেখালেখি শুরু করেন এবং এই পর্বটি গিয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত।  এই সময়ে তিনি লিখতেন “জেমস নগুগি” নামে— কখনও কখনও “জে.টি. নগুগি”— এবং লিখতেন ইংরেজি ভাষায়।

এই পর্যায়ে তাঁর উপন্যাসগুলো ছিল রাজনৈতিকভাবে সচেতন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি সূক্ষ্ম কিন্তু তীক্ষ্ণ সমালোচনা।  তাঁর চরিত্ররা ঔপনিবেশিকতার সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করত, কিন্তু তারা পাশ্চাত্য শিক্ষাকে একপ্রকার অস্ত্র হিসেবেই দেখত— ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার।  তারা খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি প্রকাশ্যে বিরূপ ছিল না; বরং স্থানীয় সংস্কার ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য আদর্শের কিছু অংশকে একীভূত করার এক রোমান্টিক স্বপ্ন বহন করত।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত, এই চেষ্টাগুলো— যা সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী ছিল— ব্যর্থ হয়েছিল।

এই পর্বের নগুগি ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক মধ্যপন্থী, যিনি উত্তরের জ্ঞান ও দক্ষিণের মাটি— এই দুইয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা খুঁজছিলেন। তবে পরে, তাঁর চিন্তার গতিপথ বদলে যায়, এবং তিনি হয়ে ওঠেন একজন আরও র‍্যাডিক্যাল, উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতিস্পর্ধার মুখ।

নগুগির সাহিত্যজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে— এক মৌলিক পরিবর্তনের সময়, যখন তিনি তাঁর ইংরেজি নাম “জেমস নগুগি” পরিত্যাগ করেন এবং পরে ইংরেজিকেও তাঁর সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন।  মার্ক্সবাদী চিন্তা এবং ফ্রাঞ্জ ফ্যাননের উপনিবেশ-বিরোধী লেখনির গভীর প্রভাব তাঁর মননে দানা বাঁধে, এবং এরপর থেকে তাঁর সাহিত্য আরও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে শুরু করে রাষ্ট্রের দমননীতির সঙ্গে, শ্রেণী বৈষম্যের সঙ্গে, শিক্ষাব্যবস্থার অসাম্যর সঙ্গে এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক জীবনের প্রতিটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে।

১৯৭৭ সালে প্রকাশিত Petals of Blood ছিল এই নতুন নগুগির প্রথম সরাসরি হামলা স্বাধীন কেনিয়ার শাসক অভিজাতদের বিরুদ্ধে। এই উপন্যাসে নগুগি একদিকে তাঁর নতুন নাম “নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো” ব্যবহার করেন, আরেকদিকে এটিই ছিল তাঁর ইংরেজিতে লেখা শেষ উপন্যাস। এখানে শিক্ষা আর মুক্তির প্রতীক নয়; বরং শিক্ষিত শ্রেণি— ব্রিটিশ-শাসিত স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা যে শ্রেণি— তারা জনগণের স্বপ্নভঙ্গের মূল কারিগর।

সমালোচক নিকিল সাভালের ভাষায়, এটি ছিল “ক্রুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ের নগুগি”-র প্রথম বোমার আঘাত, যিনি কেনিয়ার মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণিকে তাদের গল্ফ ক্লাব, উপনিবেশের অনুকরণে নির্মিত বিনোদন ও ভোগপ্রবণ জীবনের জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন। এই পর্বে নগুগি পরিণত হন একজন আত্মসমালোচনামূলক বুদ্ধিজীবীতে, যিনি আর পশ্চিমা কাঠামোর ভেতরে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করতেন না— তিনি এখন সেই কাঠামো ভেঙে ফেলার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

জেমস নগুগি— নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর পূর্বনাম— ছিলেন লেখার শিল্পের প্রতি একেবারে আচ্ছন্ন।  শৈলী, শব্দচয়ন, বাক্য গঠনের ছন্দ—এইসব নিয়ে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন।  তাঁর সাহিত্যিক নায়ক ছিলেন জোসেফ কনরাড।  কনরাডের গদ্যরীতির গাম্ভীর্য, বাক্যগুলোর সংগীতময়তা নগুগিকে এমনভাবে আলোড়িত করত যে, তরুণ লেখক হিসেবে তিনি নিজেই তা ব্যবহার করতেন আত্মবিশ্বাস ও সৃষ্টিশীলতা জাগিয়ে তোলার জন্য।

পরে নগুগি লিখেছিলেন, “তাঁর সুসামঞ্জস্য বাক্যগুলোর ওই গাম্ভীর্য এবং সংগীতময়তা আমাকে এতটাই আলোড়িত করত যে, আমি বিটোভেনের পঞ্চম সিম্ফোনির প্রারম্ভিক সুর বা কনরাডের Nostromo-র সূচনাংশ শুনেই যেন আমার লেখার প্রতিবন্ধকতা দূর করে ফেলতে পারতাম।”

তবে যতই শৈলী তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, পরে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন— শৈলী রাজনৈতিক বক্তব্যের বাহনমাত্র। লেখকের দায়িত্ব কেবল শব্দ নিয়ে খেলা করা নয়, বরং ভাষার ভেতর দিয়েই ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানানো।  নগুগির পরবর্তী কাজগুলোয় তাই শৈলী তাঁর রাজনীতির অধীনস্থ হয়ে পড়েছিল।  তাঁর কলম হয়ে উঠেছিল এমন এক অস্ত্র, যা আক্রমণ করেছিল পাশ্চাত্য ধর্ম, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা, ভাষাগত আধিপত্য এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী কেনিয়ার শাসক শ্রেণির দেশপ্রেম-বিরোধী বিশ্বাসঘাতকতাকে।  তাঁর সাহিত্য তখন আর কেবল শিল্প ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের এক কার্যকর হাতিয়ার।

নগুগির সাহিত্যিক বিবর্তনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্তগুলোর একটি হলো A Grain of Wheat উপন্যাসটি—যা একদিকে তাঁর ‘প্রথম নগুগি’ পর্যায়ে লেখা হয়েছিল, এবং বহু বছর পরে ‘দ্বিতীয় নগুগি’ পর্বে এসে তিনি একে সংশোধন করেন।  মূল সংস্করণের একটি কেন্দ্রীয় দৃশ্যে, এলএফএ (Land and Freedom Army) যোদ্ধাদের একটি দল এক ব্রিটিশ বসতি স্থাপনকারীকে আক্রমণ ও ধর্ষণ করে। এই দৃশ্যটি ছিল রাজনৈতিক ও নৈতিক দ্বিধার এক দুঃসাহসী প্রকাশ, কিন্তু এটি টিকে থাকেনি পরবর্তী সংস্করণে।  সংশোধিত পাঠে ধর্ষণের ঘটনাটি মুছে দেওয়া হয় এবং এলএফএ যোদ্ধাদের প্রতিরোধ আরও বিশুদ্ধ, নৈতিক এবং যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়।

যখন নগুগিকে এই পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়েছিলেন: “কেনিয়ায় কোনো শ্বেতাঙ্গকে এভাবে ধর্ষণের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। এক ইতিহাসবিদ আমাকে এই তথ্য দিয়েছিলেন, আর আমি চাইনি আমার উপন্যাস কেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে মিথ্যা বলুক।” এই বক্তব্যে ধরা পড়ে তাঁর সাহিত্যচেতনার সেই গভীর নৈতিকতা, যেখানে ঐতিহাসিক সত্যকে ধারণ করাই ছিল এক রাজনৈতিক দায়িত্ব।

তবে নগুগিকে আজীবন তাড়া করে ফিরেছে আরও একটি প্রশ্ন— ভাষার প্রশ্ন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছিলেন, “আমি আমার প্রথম উপন্যাসগুলোকে ভাষার প্রসঙ্গ ছাড়া ভাবতেই পারি না। কীভাবে আমি এইসব আফ্রিকান চরিত্র সৃষ্টি করলাম— আর সবাইকে নিখুঁত ইংরেজিতে কথা বলালাম?” তাঁর কণ্ঠস্বর তখন নরম হয়ে আসে, যেন এক ব্যক্তিগত অনুশোচনার সুরে: “আমি যখন আমার প্রথম বই লিখেছিলাম, তখন তা এমন এক ভাষায় লিখেছিলাম, যা আমার মা পড়তে পারতেন না।”

এই স্বীকারোক্তি নগুগির আত্মসমালোচনামূলক বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় দেয়— একজন লেখকের অন্তর্জালিক দ্বন্দ্ব, যিনি বুঝেছিলেন, ভাষা কেবল ভাবপ্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং ক্ষমতার এক সাংস্কৃতিক অস্ত্র।“হয়তো এটা কেবল আমিই।  হয়তো ভাষার প্রশ্নে আমি ভুল করছি।” ... “না, আমি মনে করি না আমি ভুল করছি।” এই অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ধরা পড়ে তাঁর সাহিত্য-রাজনীতির সবচেয়ে মানবিক, আত্মবিশ্লেষণমূলক রূপ— যেখানে লেখক নিজের কলমের আদর্শিক দায় ও পারিবারিক বঞ্চনার ইতিহাসকে একসঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছেন।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর দৃষ্টিতে, উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম সর্বনাশা বাস্তবতা হলো এর “স্বাভাবিককৃত অস্বাভাবিকতা”।  এই শব্দবন্ধে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এমন এক সাংস্কৃতিক বিকৃতি, যেখানে ঔপনিবেশিক দমন-নির্যাতনের ফলে জনগণের কাছ থেকে তাদের নিজস্ব ভাষা কেড়ে নিয়ে সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে একটি বিদেশি ভাষা— যা পরবর্তীকালে এতটাই স্বাভাবিক ও অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে যে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও আর মনে আসে না।

নগুগি স্পষ্ট করে বলেন: যখন একজন কেনিয়ান ‘কেনিয়ান ইংলিশ’ বা একজন নাইজেরিয়ান ‘নাইজেরিয়ান ইংলিশ’-এর মতো পরিভাষা ব্যবহার করেন, তখন সেটা কেবল ভাষাগত অভিযোজন নয়— বরং সেটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব, যার ভেতরে নিপীড়নের কাঠামো স্বাভাবিকীকৃত হয়।  তাঁর ভাষায়, “ইংরেজি কোনো আফ্রিকান ভাষা নয়। ফরাসিও নয়।  স্প্যানিশও নয়।  ‘কেনিয়ান ইংলিশ’ বা ‘নাইজেরিয়ান ইংলিশ’— এসব শব্দমূলত অর্থহীন।  এগুলো হলো স্বাভাবিককৃত অস্বাভাবিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।”

এই অবস্থাকে তিনি তুলনা করেন এমন এক দাসের সঙ্গে, যে দাসত্বকে আপন করে নিয়েছে এবং তার শৃঙ্খল নিয়ে গর্ব করে। কেউ যখন বলে যে সে উপনিবেশকারীর ভাষায় লিখে সেটিকে “পরাভূত” করছে, নগুগি বলেন, আসলে তারাই বরং “পরাভূত” হয়ে যাচ্ছে— অর্থাৎ ভাষা দ্বারা আত্মস্থ শাসনের শিকার।  নগুগির রাজনৈতিক ভাষাবীক্ষা কেবল তাত্ত্বিক নয়, ব্যক্তিগত অনুতাপ ও অপমানের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এক হয়ে যায়— যার কাছে আত্মসমর্পণ না করে তিনি নিজের সাহিত্যকর্মকে গড়ে তুলেছেন এক প্রতিরোধের চর্চা হিসেবে।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন Decolonising the Mind—নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রভাবশালী রচনাগুলোর একটি— এ তিনি আফ্রিকান লেখকদের, বিশেষত চিনুয়া আচেবের, ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের কঠোর সমালোচনা করেন। আচেবে একবার বলেছিলেন যে ইংরেজি “একটি উপহার”, কিন্তু নগুগি সরাসরিই বলেছিলেন, “আমি একমত হইনি।” যদিও তিনি লেখকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং আচেবেকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেননি, তবুও ভাষার এই প্রশ্নে তিনি একেবারেই আপসহীন ছিলেন।  তাঁর মতে, উপনিবেশকারীর ভাষাকে নিজের করে নেওয়া মানেই সাংস্কৃতিক আত্মসমর্পণ।

Petals of Blood লেখার পর থেকে নগুগি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি আর ইংরেজিতে মূল রচনা করবেন না।  এরপর থেকে তিনি তাঁর উপন্যাসগুলো প্রথমে গিকুয়ু ভাষায় লিখেছেন, তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।  এই প্রসঙ্গে, এক সাক্ষাৎকারে যখন সাংবাদিক উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি নগুগির সেই পুরোনো বইগুলো দেখেছেন— যা তিনি জেমস নগুগি নামেই প্রকাশ করেছিলেন—তখন নগুগি অপ্রস্তুত হেসে বলেছিলেন, “ওহ মাই গড, আমি খুব লজ্জিত।” তবে তিনি একই সঙ্গে কৌতুক করে বলেন, এই নাম পরিবর্তনের একটা মজার সুবিধাও আছে— “আমি যখন উপনিবেশিতদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতে চাই, তখন ‘জেমস নগুগি’কে নিয়েই করি। এতে কেউ ক্ষুব্ধ হয় না।” এই বক্তব্য নিছক রসিকতা হলেও, এর মধ্যে নিহিত ছিল এক গভীর রাজনৈতিক বার্তা: উপনিবেশের ছায়া শুধু রাষ্ট্র নয়, নাম, ভাষা, আত্মপরিচয়— সবকিছুর ভিতরেই গেথে থাকে। নগুগির সাহিত্য এই ছায়াগুলোকে চিহ্নিত করারই একটি অবিরাম চেষ্টা।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর শৈশবে, জোমো কেনিয়াত্তা ছিলেন এক নায়কস্বরূপ ব্যক্তিত্ব— বিশেষত তাঁর ভূমি অধিকারের দাবিতে গিকুয়ু জনগণের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কারণে। কিন্তু যখন কেনিয়াত্তা স্বাধীন কেনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন, তখন নগুগির চোখে সেই বীরের মুখোশ খুলে পড়ে।  আশার বিপরীতে, তিনি উপনিবেশিকদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমি প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে, বরং নিজে ও তাঁর অনুগতদের মধ্যে তা পুনর্বণ্টন করেন— এক ধরনের ক্ষমতালিপ্সু জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটান।

নগুগি স্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করেছিলেন, কেনিয়াত্তার লক্ষ্য ছিল কেবল উপনিবেশিক ক্ষমতার শীর্ষে নিজেকে প্রতিস্থাপন করা— পুরো ঔপনিবেশিক কাঠামো ভেঙে ফেলার কোনো আগ্রহ তাঁর ছিল না। নগুগির ভাষায়, “কেনিয়াত্তার কাছে স্বাধীনতা মানে ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জমির মালিক, কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ অফিসার, এবং একটি কৃষ্ণাঙ্গ সরকার।” কিন্তু এই "স্বাধীনতা" ছিল এক আংশিক রূপান্তর, যা কাঠামোগত বৈষম্যকে স্পর্শই করেনি— বরং রঙ বদলে তাকে বহাল রাখে।

এই রাজনৈতিক হতাশা ও বিক্ষোভ থেকেই জন্ম নিয়েছিল নগুগির ১৯৭৭ সালের উপন্যাস Petals of Blood—একটি তীব্র রাজনৈতিক নিন্দা, যা স্বাধীনতার নাম করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা অভিজাতদের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে।  কিন্তু ঐ একই বছর নগুগির আরও এক কাজ তাঁকে সরাসরি রাষ্ট্রের রোষের মুখে ফেলে: গিকুয়ু ভাষায় লেখা নাটক Ngaahika Ndenda (আমি যখন চাইব বিয়ে করব)।

এই নাটক, যদিও Petals of Blood-এর তুলনায় বিষয়বস্তুতে বেশি “বিপজ্জনক” ছিল না, তবুও তার রাজনৈতিক অভিঘাত ছিল অনেক বেশি ব্যাপক। কারণ, এটি লেখা হয়েছিল জনগণের ভাষায়— গিকুয়ুতে। নোবেলজয়ী লেখক আব্দুলরাজাক গুরনাহ এ বিষয়ে লিখেছিলেন: নাটকটি “সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য ছিল, এবং তাই তা আরও বেশি নাশকতামূলক (subversive) হয়ে উঠেছিল।” কথার অর্থ, এই নাটক শুধু সাহিত্য নয়— প্রতিরোধের এক জীবন্ত চর্চা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  এই নাট্যকর্মের পরিণতিতে নগুগিকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়।  আর এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর নতুন, আরও দৃঢ় ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখকজীবনের এক নির্দয় অধ্যায়।

কামিতি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারে, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো-কে রাখা হয়েছিল ১৮ জন রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে এক নির্জন ডিটেনশন ব্লকে। এই বন্দিত্ব ছিল শুধু শারীরিক নিপীড়ন নয়— এটি ছিল পরিচয় মোচনের একটি প্রক্রিয়া।  তাঁর স্মৃতিকথায় নগুগি লেখেন, “এখানে আমার কোনো নাম নেই।  আমি কেবল একটি ফাইল নম্বরে পরিচিত: K6,77।”  যেখানে নাম, ইতিহাস, কণ্ঠস্বর সব কিছু এক আদেশে নিঃশব্দ।

কিন্তু এই নৈঃশব্দ্যের ভেতরেই, এক টয়লেট পেপারের রোলকে কাগজ হিসেবে ব্যবহার করে নগুগি শুরু করেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের রচনা— গিকুয়ু ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস Caitaani mũtharaba-Inĩ (ক্রসের উপর শয়তান)।  ২০১৮ সালে Paris Review-কে তিনি বলেন, “এই প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত কঠিন, কারণ আমি তখন ইংরেজি ভাষার উপর নির্ভরতা থেকে মুক্তির চেষ্টায় ছিলাম।”

কারাগারের প্রতিটি দিন ছিল এক ধাক্কামার্কা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে পূর্ণ।  নগুগি স্মরণ করেন, একজন ছোট ‘শয়তান’ তার কাছে আসত—একটি শয়তান, ইংরেজি পোশাকে সজ্জিত।  এই শয়তান তাঁকে কুর্নিশ করত, বলত, “ওহ, এত কষ্ট কেন করছ? আমি তো এখানেই আছি”।  এটি কেবল ভাষাগত প্রলোভন নয়, বরং ঔপনিবেশিক মনোযোগের এক ছায়াতঙ্ক, যা লেখকের হাতকে তার নিজের ভাষার বিপরীতে টেনে আনত।

গিকুয়ু ভাষার সঙ্গে এই লড়াই ছিল বহুমাত্রিক।  কারণ এই ভাষায় লিখিত সাহিত্যিক ঐতিহ্য প্রায় ছিল না— বিশেষত ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বা রাজনৈতিক অভিধানসম্পন্ন বিমূর্ত ধারণাগুলোর কোনো সহজ প্রতিশব্দ ছিল না। তাছাড়া, গিকুয়ু ভাষায় ছিল একধরনের 'slipperiness'— একটি বাক্য একদিন লিখে, পরদিন পড়লে, তার ভিন্ন মানে প্রকাশ পেত।

এই দ্বন্দ্বের মধ্যে বারবার এসেছে আত্মসমর্পণের প্রলোভন।  নগুগি বলেন, “ছেড়ে দেওয়ার প্রলোভন সবসময়ই ছিল।” কিন্তু ঠিক সেই সময়, আরেকটি কণ্ঠস্বর— গিকুয়ু ভাষাতেই— তাঁকে বলে উঠত, “লড়াই করো।” সেই কণ্ঠস্বর ছিল ঔপনিবেশিক ছায়া থেকে মুক্ত এক অন্তর্জাত আত্মচেতনার কণ্ঠ, যেটি নগুগির সাহিত্যকে শুধু ভাষার দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এক প্রতিরোধের মাধ্যম করে তুলেছিল।  এই দ্বৈত কণ্ঠই গড়ে তুলেছিল একজন লেখকের প্রতিচ্ছবি, যিনি ভাষা হারিয়ে ফেলেননি— বরং তাকে পুনরুদ্ধার করে বিপ্লবী করেছেন।

১৯৭৮ সালে জোমো কেনিয়াত্তার মৃত্যুর পর, তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হন উপরাষ্ট্রপতি ড্যানিয়েল আরা মোই। শুরুতে তিনি জনসমর্থন আদায়ে আগ্রহী ছিলেন এবং সেই রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে নগুগি ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেন। তবে শীঘ্রই মোই-সরকার কেনিয়াত্তার পথেই হাঁটতে শুরু করে— একটি গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা পরিণত হয় আরেকটি স্বৈরতান্ত্রিক দমনব্যবস্থায়।

১৯৮২ সালে কেনিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। এই প্রেক্ষিতে নগুগি প্রশ্ন তোলেন, ডিসেম্বর টুয়েলভ মুভমেন্ট (DTM) কি এই অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল? নিজেই উত্তর দেন: “না।” কারণ DTM-এর আদর্শ ছিল স্পষ্ট— “রাজনীতি বন্দুককে নেতৃত্ব দেয়, বন্দুক রাজনীতিকে নয়।” অর্থাৎ, তারা বিশ্বাস করত যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের বৈধ পথ গণআন্দোলন, অস্ত্র নয়। এই অবস্থান নগুগির নিজস্ব মতাদর্শের প্রতিধ্বনি, যেখানে প্রতিরোধ আসে লেখনী, নাটক ও জনগণের সংহতির মাধ্যমে।

তবে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর মোই সরকার কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে: বহু DTM সদস্য গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালান। সেই সময় নগুগি ছিলেন লন্ডনে, Devil on the Cross উপন্যাসের প্রকাশনা উপলক্ষে।  তাঁকে সরাসরি সতর্ক করা হয় যে, কেনিয়ায় ফিরে গেলে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে।  নগুগি তখন নির্বাসনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী কয়েক বছর লন্ডনই হয়ে ওঠে তাঁর নিরাপদ আশ্রয়— তবে সাহিত্যিক প্রতিবাদের কাজ থেমে থাকেনি।

১৯৮৬ সালে নগুগি লিখলেন Matigari—ইংল্যান্ডে বসে লেখা তাঁর একমাত্র উপন্যাস। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক রূপক: গল্পের কেন্দ্রস্থলে থাকা নায়ক, Matigari, স্বপ্নদ্রষ্টা এক সংগ্রামী চরিত্র, যিনি এক বিশ্বাসঘাতক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম গড়ে তোলেন— এমন একজন রাষ্ট্রপতি, যিনি স্পষ্টভাবে ড্যানিয়েল মোইয়ের ছায়াচিত্র। উপন্যাসটি এতটাই বাস্তবসম্মত ছিল যে, মোই সরকার মনে করেছিল এই চরিত্র বাস্তব; রাষ্ট্রপতি সরাসরি Matigari-কে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন।  পরে যখন জানা যায় এটি একটি কাল্পনিক চরিত্র, তখন বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।

এই ঘটনা ছিল নগুগির সাহিত্য-রাজনীতির এক কালজয়ী মুহূর্ত— যেখানে কথাসাহিত্য কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, রাষ্ট্রক্ষমতার সামনে দাঁড়ানো এক জীবন্ত অবসানহীন প্রতিরোধ হয়ে উঠেছিল। তাঁর লেখনী তখন আর কেবল সাহিত্যের জন্য নয়, বরং জনচেতনাকে উন্মোচনের জন্য, এক সমগ্র রাজনৈতিক কৌশল।

১৯৮৯ সালে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আমন্ত্রণে।  এই পদক্ষেপ তাঁর এক দীর্ঘ নির্বাসিত শিক্ষাজীবনের সূচনা করে— যার গন্তব্য হয় ক্যালিফোর্নিয়ার ইউসি আরভিন, যেখানে তিনি ২০০২ সালে যোগ দেন। একই বছর, কেনিয়ার রাজনীতিতে ঘটে গুরুত্বপূর্ণ একটি পালাবদল: ড্যানিয়েল আরা মোই-এর দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে। এরপর ২০০৪ সালে, নগুগি দীর্ঘ ২২ বছর পর প্রথমবারের মতো কেনিয়ায় ফিরে যান, তাঁর নতুন উপন্যাস Mũrogi wa Kagogo (Wizard of the Crow)-এর উদ্বোধন উপলক্ষে।

কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনের আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।  মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে নগুগি ও তাঁর স্ত্রী সশস্ত্র এক গ্যাং দ্বারা আক্রান্ত হন, এবং তাঁর স্ত্রীর উপর সংঘটিত হয় নির্মম যৌন সহিংসতা।  নগুগি দৃঢ়ভাবে বলেন, “এটি কোনো সাধারণ ডাকাতি ছিল না।” তাঁর মতে, এই হামলা ছিল রাজনৈতিক— হয়তো পুরনো শাসনের অবশিষ্ট অংশের পক্ষ থেকে, অথবা নতুন সরকারের কোনো অংশের হাত ধরে—যারা তাঁকে বা তাঁর কথাসাহিত্যকে মূল স্রোতের বাইরে দেখতে চায়নি। “এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল অপমান।” এই ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, তাঁর ওপর হামলাটি ছিল এক দমনমূলক বার্তা— যেখানে লেখকের দেহের ওপর হামলা ছিল তার ভাষার, তার সাহসের, তার ইতিহাসের ওপর হামলার প্রতিরূপ।

তবুও, নগুগি দমে যাননি। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি আবারও কেনিয়ায় ফিরে গেছেন—নিজের নাগরিক পরিচয় ধরে রেখেছেন, এবং দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়ে গেছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি কখনোই ছিন্ন হয়নি—না ভাষার প্রশ্নে, না রাষ্ট্রের।

তবে নির্বাসনের পর, এবং বিশেষত Decolonising the Mind লেখার বহু বছর পর, নগুগি ফিরে তাকিয়ে দেখেন যে তাঁর ভাষাবিষয়ক প্রস্তাবনা—আফ্রিকান ভাষায় সৃজনশীল লেখা—আদতে খুব কমই বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১৭ সালে তিনি বলেন, “Decolonising the Mind লেখার পর থেকে আমি প্রকাশ্যে বিরোধিতা থেকে শুরু করে বিনয়ের প্রকাশ পর্যন্ত সবকিছু পেয়েছি, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন দেখিনি।” এই স্বীকারোক্তিতে আছে গভীর বেদনা, কিন্তু তাতে কোনো নিরাশা নেই— বরং আছে এক ধ্রুব সংকল্প: ভাষা, স্মৃতি, ইতিহাস এবং সাহিত্য— এই চারটি স্তম্ভই নগুগির রাজনৈতিক জীবনের মূল ভিত, যা তিনি কখনোই বিসর্জন দেননি।

ভাষার প্রশ্ন— বিশেষত আফ্রিকান ভাষায় সৃজনশীল লেখালেখি— যেমনভাবে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো উপস্থাপন করেছিলেন, তা বহু আফ্রিকান লেখকের কাছে এক অনিবার্য নৈতিক সংকট হয়ে উঠেছিল।  তবে এই সংকটের বাস্তব রূপরেখাও উপেক্ষা করা যায় না। ঘানার এক নাট্যকার যখন লেখকের সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নেন, তিনি স্পষ্টতই বলেন, তাঁর মাতৃভাষা ডাগবানি একটি সংখ্যালঘু ভাষা— যা ঘানার অল্পসংখ্যক মানুষই ব্যবহার করে।  সেই ভাষায় যদি তিনি নাটক লেখেন, তবে পাঠক খুবই সীমিত হবে।  শুধু তাই নয়, সেই ভাষায় প্রকাশনা পরিকাঠামোও নেই— যা সাহিত্যচর্চাকে আরও দুরূহ করে তোলে।

যখন লেখক নগুগির উদাহরণ তুলে ধরেন, নাট্যকার কিছুটা হতাশভাবেই পাল্টা বলেন, “নগুগি তো নগুগিই।  আপনি আমার সঙ্গে নগুগির তুলনা করতে পারেন না।” এই জবাবে ধরা পড়ে এক ধরনের শ্রদ্ধাশীল হতাশা— নগুগির মতো প্রভাব, প্রতিষ্ঠা ও কাঠামোগত সহায়তা সবার কাছে নেই।  অর্থাৎ, ভাষার প্রশ্নটি কেবল নীতিগত নয়, কাঠামোগত ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।

আরো জটিল বাস্তবতা দেখা যায় নগুগির নিজের পরিবারেই। তাঁর চার সন্তান—টি নগুগি, ন্ডুকু ওয়া নগুগি, ওয়াঞ্জিকু ওয়া নগুগি এবং মুকোমা—সকলেই লেখক, কিন্তু তাঁদের সাহিত্যিক কাজ প্রধানত ইংরেজিতেই। শুধু টি নগুগি কেনিয়ায় থাকেন, বাকিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। এই প্রজন্মান্তরের ভাষাগত বিচ্যুতি—যেখানে একজন পিতা আফ্রিকান ভাষার জন্য লড়ছেন, আর সন্তানেরা মূলত ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করছেন—এই দ্বৈরথের গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে

প্রশ্ন ওঠে তাঁর ভাষা-নির্ভর রাজনৈতিক আহ্বান Decolonising the Mind ব্যর্থ হয়েছে কি না, তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “না।” ব্যর্থতার দায় তিনি আরোপ করেন রাষ্ট্রের ওপর— “সমস্যা সবসময়ই ছিল আফ্রিকান ভাষার প্রতি নেতিবাচক সরকারি নীতি এবং আফ্রিকান ভাষায় প্রকাশকের অভাব।”

এই জবাবটি তাঁর আত্মবিশ্বাসের নিদর্শন— তাঁর অবস্থান কেবল নীতিগত নয়, রাজনৈতিক।  ভাষা যেন তাঁর কাছে জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত সংস্করণ, যা শিকড়ে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত।  তবে তিনি এই লড়াইকে তাৎক্ষণিক সাফল্যের মাপকাঠিতে বিচার করেন না— এটি এক দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, যেখানে পরাজয় মানেই নয় আত্মসমর্পণ।  বরং প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি প্রতিরোধই ভবিষ্যতের এক নতুন শব্দভাণ্ডার গঠনের সম্ভাবনা।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর সাহিত্যজগত— উপন্যাস ও নাটক উভয় ক্ষেত্রেই— প্রায় সর্বত্রই ঘনীভূত হয়েছে এমন এক ত্রাণকর্তা-নায়কের চারপাশে, যিনি চেয়েছেন সমাজকে একীভূত করতে কিংবা র‌্যাডিকাল বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে পাল্টে দিতে।  তাঁর প্রথম দিকের লেখায় এই নায়ক হতেন শিক্ষিত, উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের জন্য সহমর্মী, ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর গড়ে তুলতে ইচ্ছুক এক আত্মদ্রোহী।  পরে, এই নায়ক হয়ে ওঠেন আরও তীক্ষ্ণ, রাজনৈতিকভাবে উগ্র, শ্রেণিসংগ্রামে নিযুক্ত বিপ্লবী চরিত্র। কিন্তু এই নায়কদের ভাগ্য কমবেশি এক: সমাজ যাকে মুক্ত করতে চায়, সেই সমাজই তাকে প্রত্যাখ্যান করে।  তার চেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয়, প্রায়শই মর্মান্তিকভাবে।  এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নায়কের পরিণতি হয় মৃত্যু।

এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা কেবল সাহিত্যিক নৈপুণ্যের ফল নয়, বরং নগুগির গভীর রাজনৈতিক হতাশাবোধের প্রতিফলন।  একজন লেখক, যাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ এতটা স্পষ্টভাবে তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে, তিনি একই সঙ্গে এই আদর্শের সাফল্য নিয়ে গভীরভাবে সংশয়বাদী থেকেছেন। তাঁর সাহিত্যিক নায়কেরা যেন পূর্বাভাস দেন— জনতার প্রতি আস্থা থাকা সত্ত্বেও, সামাজিক পরিবর্তনের পথটা লজ্জাহীন বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা।

৮৭ বছর বয়সে চলে গেলেন এই কৃষ্ণাঙ্গ ভূমিকম্প। একুশ শতকের শেষ আত্মিক বিপ্লবীর লাশ পড়ল দক্ষিণের বালিতে, বাফোর্ড, জর্জিয়ার এক হাসপাতালের অজস্র নীরবতায়।  নগুগির জীবন ছিল তাঁর সাহিত্যেরই এক নীরব প্রতিস্বর— বহু সংগ্রামের পর এক অভ্যন্তরীণ শান্তি, কিন্তু তাতে সংকল্পের ছায়া বিন্দুমাত্র ম্লান নয়।  তাঁর নায়কদের মতোই তিনিও এক অসম্পূর্ণ, জটিল ও অপ্রতিরোধ্য কাহিনির অংশ, যা ইতিহাসের গভীরে গিয়ে সমাজের মুখোশ খুলে দেয়— শব্দে, যন্ত্রণায়, এবং নীরব প্রতিজ্ঞায়।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো— একজন লেখক, নাট্যকার, চিন্তক ও রাজনৈতিক কর্মী— যার জীবন ও সাহিত্যিক যাত্রা ঔপনিবেশিকতা, ভাষা, স্বাধীনতা এবং সংগ্রামের এক বিস্তৃত ও বহুবর্ণ গাথা। তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে ছিল এমন একটি প্রশ্ন, যা বহু আফ্রিকান এবং বিশ্বসাহিত্যের পাঠক ও লেখকের বিবেককে আলোড়িত করে: “ভালো ঔপনিবেশিক” বলে কিছু কি আদৌ আছে?

এই প্রশ্নের উত্তরে নগুগির সপ্রতিভ ও স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল, “ওহ মাই গড— এমন কিছু নেই।” তাঁর ভাষ্য ছিল নির্মম: “ঔপনিবেশিকতা একটি ব্যবস্থা।  আপনি বন্দুক বহন করছেন বা বাইবেল, তাতে কিছু যায় আসে না, আপনি তখনও একজন ঔপনিবেশিকই।” ব্যঙ্গাত্মক হাসির ভেতরেও স্পষ্ট ছিল গভীর রাজনৈতিক বোধ: “অবশ্যই আমি বন্দুকওয়ালা ঔপনিবেশিকের চেয়ে বাইবেলওয়ালা ঔপনিবেশিকের মুখোমুখি হতে চাই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুজনেই তো এক জিনিস প্রচার করছে।” এই মন্তব্যে তিনি অস্বীকার করেন সেই নৈতিক বিভ্রান্তি, যা মানবিক মুখোশে উপনিবেশিক সহিংসতাকে ঢাকতে চায়।

Decolonising the Mind তাঁর উত্তরাধিকারী গ্রন্থ, যা আজও বিশ্বজুড়ে চিন্তাশীল পাঠকের কাছে জ্বলন্ত এক চ্যালেঞ্জ। যদিও তাঁর ভাষাগত আন্দোলন পূর্ণ বাস্তবায়ন পায়নি, এবং তাঁকে বারবার নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তবু তিনি থাকবেন আফ্রিকান সাহিত্যের অন্যতম মহীরুহ হিসেবে—একজন, যিনি কেবল নিজের কলমে নয়, নিজের জীবনের মধ্য দিয়েও দেখিয়েছেন স্বাধীনতা মানে কেবল রাষ্ট্রিক মুক্তি নয়; এটি ভাষার মুক্তি, সংস্কৃতির মুক্তি, এবং চেতনার পুনর্জাগরণ।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো—তাঁর নামই যেন এক ঘোষণা, যে স্বাধীনতার সংগ্রাম কখনো শেষ হয় না।