শহীদুল জহিরের উপন্যাসে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

অ+ অ-

 

[সারসংক্ষেপ: জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৭) শহীদুল জহিরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসই শুধু নয়, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অন্যতম প্রধান উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এটি তাঁর একমাত্র উপন্যাস। একটি মাত্র উপন্যাসে তিনি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সমকাল ও যুদ্ধোত্তর জীবনবাস্তবতা অবলোকন করেছেন, বলা যায়, তা সমগ্র বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ প্রকাশ। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালের অবরুদ্ধআক্রান্ত দেশের পরিস্থিতি বিধৃত হয়েছে। এখানে এসেছে পুরনো ঢাকার জনজীবনের পরিপ্রেক্ষিত। উপন্যাসটি ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতে রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সমকাল এতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অপর দিকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পক্ষের পুনরুত্থানের পটভূমিতে স্বাধীনতার আশা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন এই উপন্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের মতো রাজনৈতিক ঘটনার বাস্তবতাকে খুব কম সংখ্যক লেখকই নির্মোহভাবে তুলে আনতে পেরেছেন, শহীদুল জহির সেই কম সংখ্যক লেখকদের মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধের বিবরণের চেয়ে যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব তাঁর কছে অধিক বিবেচ্য, ফলে যুদ্ধের ঘটমান চিত্রের চেয়ে মানুষের জীবনে যুদ্ধের সন্ত্রাস, যুদ্ধোত্তর হতাশই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমান প্রবন্ধে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসটিতে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর অবস্থা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের প্রকাশ এবং এই উপন্যাসটির শিল্পচেতনার মুখ্য দিকগুলো বিশ্লেষিত হয়েছে।]

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ইতোমধ্যে একটি শক্তিশালী ও সৃজনশীল ধারার জন্ম দিয়েছে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক মিলিয়ে ধারাটি বর্তমানে যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং তা ক্রমবিকাশমান। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রধান ঔপন্যাসিক কোনও না কোনও সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচনা করেছেন। শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, মঞ্জু সরকার, মঈনুল আহসান সাবের, হারুন হাবিব, সুচরিত চৌধুরী এরকম ঔপন্যাসিকের নাম করা যাবে যাঁরা উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে শব্দের কাঠামোয় ধারণ করে রেখেছেন।

শহীদুল জহির বাংলাদেশের উপন্যাসে একজন নিরীক্ষাপ্রবণ রচয়িতার স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। আশিরদশকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের তাঁর লেখা আমাদের মধ্যে গভীর ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। অনন্য এক স্বাতন্ত্র্যবোধের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন লেখক শহীদুল জহির। রুচির ভিন্নতাই তাঁকে প্ররোচিত করেছে ভিন্ন পথে বাঁক নিতে। তাঁর অন্যতম সফল উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৭)। উপন্যাসটি মূলত চিত্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও তদপরবর্তী সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতা আর জিঘাংসাকে উপজীব্য করে। অকালপ্রয়াত এ কথাকারের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নামক উপন্যাসটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে অত্যন্ত গভীর জীবনবোধসম্পন্ন একটি শিল্পসফল সাহিত্যকর্ম, এ-গ্রন্থ সম্পর্কে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, শহীদুল জহির মেলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের অফুরান গল্প। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মূল শক্তি এর কাহিনি, কাহিনিবর্ণন কৌশল এবং অসাধারণ ভাষাভঙ্গি। পৃথিবীব্যাপী এবং বাংলাদেশে যুদ্ধমুক্তিযুদ্ধ বিষয়াশ্রয়ে যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছে সেগুলো আকারে সাধারণত বিপুল। সেতুলনায় শহীদুল জহিরের উপন্যাস ক্ষীণকায়। একটি ক্ষুদ্রাকৃতির উপন্যাসও যে সম্পদের গভীরতায় অনন্য হয়ে উঠতে পারে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাস তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

লেখক শহীদুল জহির নিজেই সেই সময়ের প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলেন। যে-যুদ্ধ তিনি দেখেছেন যে-যুদ্ধের স্মৃতি ও বেদনা তাঁর রক্তের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল তা তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যেতে পারেননি। শিল্পও জীবনদর্শনের সত্তা নিয়েই তিনি সেই অবধারিত সত্যের গান লিখেছেন জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসে।

উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের, কিন্তু সূচনালগ্নেই যে-কালজ্ঞাপক বর্ণনা ঔপন্যাসিক দেন তা যুদ্ধের দেড়দশক কাল পরের বাস্তবতাযেমন, উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়। কাজেই এই বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দেড়দশক পরে বর্তমান এবং মুক্তিযুদ্ধের কালে ফিরে যাবার একটি যোগসূত্র। এভাবেই অতীতকালে সংঘটিত বাঙালির জীবনের এক মহাজাগতিক ঘটনাকে স্থাপন করা হয় এমন একটি কালগ্রন্থির সঙ্গে যে-গ্রন্থি জটিল, দ্বন্দ্বময় এবং বহুবর্ণিল।

প্রথম বাক্যের ফাঁদে পাঠককে আটকে দিয়ে উপন্যাসটির তরতর করে এগিয়ে চলে এক চূড়ান্ত পরিণতির দিকে, যেখানে পাঠক দেখতে পায় ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং তদপরবর্তী সময়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দলীয় লেজুরবৃত্তির নৃশংস চিত্রকল্প। প্রথম লাইনের এই চমকের মাধ্যমে লেখক আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আবদুল মজিদ নামের সেই চরিত্রটির সাথে যে পুরো উপন্যাসেই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ঘটনার পরম্পরায় আবুদল মজিদের স্মৃতি ও ভাবনার আবরণে আমরা দেখতে পাই বদু মাওলানা নামক অন্য একটি চরিত্র, যার কুটিল ও নৃশংস আচরণই এই উপন্যাসটির প্রতিপাদ্য। একই সাথে আবদুল মজিদের অক্ষম ক্রোধ, নিদারুণ ব্যর্থতা এবং সব শেষে পলায়নপরতা আমাদের বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয় এই যুবক আসলে আর কেউ নয়, এই যুবক আমরাই, আমরা প্রত্যেকেই। 

অতীতের উপস্থাপন ঘটে বর্তমানের বিভিন্ন চরিত্রের আশ্রয়ে। যুদ্ধের সরল ও একরৈখিক গল্প বলার রীতি পরিহার করে চরিত্রসমূহের চিন্তন-অণুচিন্তন এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবকে পরখ করবার পথ গ্রহণ করেন ঔপন্যাসিক। তাই চরিত্রগুলো এ-উপন্যাসে খুবই অনিবার্য ভূমিকা পালনকারী। চরিত্রকে বাদ দিলে উপন্যাসটি এর কাহিনি বা ঘটনাপ্রবাহের গুরুত্বও হারিয়ে ফেলে। প্রসঙ্গত স্মতর্ব্য যে, মুক্তিযুদ্ধের দেড় দশক পরে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচিত হয়ে যাওয়ার পরে আবারও এর উপজীব্যতায় উপন্যাস রচনা রচয়িতার জন্য এক ধরনের ঝুঁকি হয়ে দেখা দেয়। এটা নিঃসন্দেহ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সব রচয়িতার এক নয়। তবু শহীদুল জহির মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর নিজস্ব কৌশলের অবলম্বনে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু কথা উঠতেই পারে মুক্তিযুদ্ধের এতগুলো বছর পর পুনরায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কেন উপন্যাস রচনার প্রয়োজন দেখা দিল? তারই উত্তর এই উপন্যাসটির সর্বপ্রথম বাক্যে বিধৃত—“উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন। তখনই লেখক দায়বোধ করেন এ-উপন্যাস রচনার। বস্তুত,  দেড়দশক কাল পরের সমকালীন বাস্তবতার দায় থেকে ঔপন্যাসিক, শহীদুল জহির ফিরে যেতে বাধ্য হন দেড়দশক পূর্বে। বর্তমান এখানে অতীতের সঙ্গে এমন ওতপ্রোত যে এই বর্তমানের জটিলতার গর্ভেই নিহিত আরও এক বর্তমানযা একই সঙ্গে অতীতও কিন্তু সেই অতীতকে বাদ দিয়ে বর্তমানকে পরীক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত সমালোচক কলিন উইলসনের উক্তি স্মরণ করা যায়। শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মূল্যায়নের  শুরুতে কলিন উইলসনকে স্মরণ করা যায় এজন্য যে, উইলসন রচয়িতার উপন্যাস রচনার হেতু প্রসঙ্গে বলেছেন যে

এটা স্পষ্ট যে সব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের উৎসই হলো লেখকের নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতীক এবং যে-পৃথিবীকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁর সেই প্রত্যাখানের শক্তি। যে-মানুষ জীবনকে যেমনটি আছে তেমনটিই দেখেন, যাঁর কোন অভিযোগ নেই, যিনি পৃথিবীতে সব কিছু ঠিকভাবে বিরাজমান বলে ভাবেন তাঁর পক্ষে আসলে সাহিত্য রচনা করা সম্ভব নয়।

আমরা বলতে পারি, উনিশ শ পঁচাশির বাস্তবতা ঔপন্যাসিক শহীদুল জহিরের জন্যে এক অস্বস্তি ও পীড়াদায়ক বর্তমান। উপন্যাসে সেই অস্বস্তিকর পরিপ্রেক্ষিতটি আমরা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এই বর্তমানের বিকল্প কোনও কালগ্রন্থির কল্পনা ঔপন্যাসিকের পক্ষে সম্ভব নয় একমাত্র স্বপ্ন ছাড়া। ফলে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অবস্থানে তিনি আশ্রয় নেন। উপন্যাসটি এক অর্থে ১৯৭১-এর কালগত সম্প্রসারণ এবং অন্য অর্থে একাত্তরের ঘটনানুক্রমিক পরিণতিও।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় বাংলাদেশের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। শহীদুল জহিরের এ-উপন্যাসে আগাগোড়া যুদ্ধের সংঘটনস্থল পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেন নামের একটি মহল্লা। সব ঘটনা মহল্লার, সব মানুষ মহল্লার এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগমনও ঘটে এই মহল্লাতেই। আক্রান্ত হওয়া এবং আক্রমণের পরিণামে শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেন নামক মহল্লাটি ক্রমশ বিধ্বস্ত হতে থাকে। পাঠকের কিন্তু অজানা থাকে না, আসলে মহল্লাটি বাংলাদেশেরই রূপকল্প এবং মহল্লার যে-কটি চরিত্র যুদ্ধের মতো একটি বিশাল ঘটনাকে প্রতিনিধিত্ব করে তারাও আর মহল্লার মানুষ হয়ে থাকে না, সমগ্র দেশের অসংখ্য জনগোষ্ঠীর একেকটি প্রতীক চরিত্র হিসেবে তারা দাঁড়িয়ে যায়।

মহল্লাবাসী আবদুল মজিদের চোখে এই পুরো সময়ের আবর্তন ধরা পড়ে। তার স্মৃতিই এখানে মূল সহায়ক-সূত্র। যুদ্ধের শুরুতে সে দেখতে পায় পঁচিশে মার্চ-পরবর্তী প্রলয় ঝড়। তাদের মধ্যকার একজন বদু মওলানা হয়ে ওঠে বাঙালি হন্তারক শত্রু পাকিস্তানি দালাল। নিজে বাঙালি হয়েও সে বাঙালিদের হত্যা করিয়ে তাদের মাংস টুকরো টুকরো করে মহল্লার আকাশে উড়ে আসা কাকদের খাওয়াত। সেসব মানুষ তারাই যারা কোনও না কোনওভাবে নিজের অজ্ঞাতেই বদু মওলানার নিজস্ব ইসলামী সংস্কারকে আঘাত দিয়েছিল কিংবা বদু মওলানার ধারণায় যারা ইসলামের প্রতি বশ্য নয়। এই প্রসঙ্গে তের বছরের কিশোর আলাউদ্দিনের পরিণতি কথা উল্লেখযোগ্য

হাফপ্যান্টের এক পাশ গুটিয়ে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে পেশাব করার সময় তার শিশ্নের ওপর নজর পড়ায় বদু মওলানা ক্ষেপে গিয়েছিল একদিন, হারামযাদা, খাঁড়ায়া খাঁড়ায়া মোতচ, খাঁড়ায়া মোতে কুত্তা। তখন আলাউদ্দিন কয়েক দিন পর নির্মমভাবে নিহত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছিল। প্রথমত, সে বদু মওলানার কথা শুনে গালের ভেতর জিভ নেড়ে তাকে ভেঙায়, তারপর বলে, কুত্তা তো মুখ দিয়া খায়বি, আপনে অখনথন হোগা দিয়া খায়েন।

একাত্তর সালের এই অস্থির সময়ে প্রতিটি মানুষের ভয় ও উৎকণ্ঠায় মধ্যে একমাত্র বদু মাওলানাই নিবির্কার থাকতে পেরেছিল কেন না পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কর্মকর্তারা তার সহায় ছিল। উপন্যাসের একটি বৃহদংশ বদু মওলানা চরিত্র এবং তার কর্মকাণ্ডনির্ভর। বদু মওলানার চরিত্রের মাধ্যমে লেখক সেই সময়ে রাজাকারদের জান্তব নৃশংসতা যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি সাধারণ মানুষের টাল খাওয়া জীবনযাত্রাকে নিরপেক্ষভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছেন। অথচ এমন ভয়ংকর সর্পিল দিনেও আবদুল মজিদ মহল্লার মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিল। কিন্তু উনিশ শ ছিয়াশি সনে একদিন সেই আবদুল মজিদই পত্রিকায় বাড়ি বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন দেয়। অথচ তখন এমন কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অনিবার্য আকস্মিকতার উদ্ভব ঘটেনি যার কারণে আবদুল মজিদকে তার পিতৃপুরুষের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে চিরতরে। আবদুল মজিদের স্মৃতির দুই প্রান্তই উপন্যাসটির মূল অবয়বের সূত্র। এক প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ মহল্লা এবং অন্য প্রান্তে স্বাধীন শত্রুমুক্ত মহল্লা। শত্রুরুদ্ধ মহল্লায় ভয়ভীতির সম্ভাবনা সত্ত্বেও আবদুল মজিদ মনের মধ্যে অনুভব করতে পেরেছিল স্বাধীনতার আর্তি। কেন না মুক্তিযোদ্ধাদের পরাক্রমশীল যুদ্ধের খবর ছিল তার জানা এবং মহল্লার সিংহভাগ মানুষের অন্তর-আর্তির সঙ্গে তার অন্তরের আর্তি মিলে গোটা মহল্লাকে একটি স্বাধীনতাকামী নির্ভীক অংশে পরিণত করেছিল। শত্রুমুক্ত মহল্লাবাসী আবদুল মজিদ বর্তমানে মনের ভীতিকে জয় করতে ব্যর্থ হয়। তার জীবনের চারদিকে ক্রম-ঘনীভূত হতে থাকে জীবনবিরাধেী প্রবাহ। তার এই বেদনাঘন পরিণতির মধ্যে সমগ্র দেশের বাস্তবতার ছায়াপাত ঘটে।

উপন্যাসের শিরানোমে ব্যবহৃত দুটি শব্দ শহীদুল জহিরের উপন্যাসটির বিষয়বস্তুর উদ্ঘাটনে চাবি শব্দ হিসেবে কাজ করে জীবন এবং রাজনৈতিক। জীবন এখানে প্রবাহমান এবং রাজনীতি বিবর্তমান। জীবন যেমন রাজনীতিকে প্রভাবিত করে তেমনি রাজনীতিও প্রভাবিত করে জীবনকে। দুটোই পারস্পরিকতার এমন মাত্রায় উপস্থিত যে একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। চরিত্রেরা যেমন উপন্যাসটিতে এক কালসীমানার প্রতিনিধি তেমনি আপাতবিমূর্ত হয়েও জীবন এবং রাজনীতিও উপন্যাসে প্রতিনিধি। জীবনের নানান চাপ যেমন চরিত্রগুলোর ওপর পড়তে দেখা যায় তেমনি রাজনীতির চাপও আমরা দেখতে পাই চরিত্রগুলোর ওপর এবং সব মিলিয়ে জীবনের ওপর। সময়ের প্রবাহমানতা একই সঙ্গে চরিত্রগুলোরও প্রবহমানতা এবং ভ্রমণশীলতাঅতীত ও বর্তমানে একই ও পৃথক পৃথক সময়ে ভ্রমণ। ব্যক্তির চেতনাকে সময়ের আশ্রয়ে একটা পরিবহন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আনা-নেওয়া করা হয়। ফলে উপন্যাসটি একদিক থেকে চৈতন্যের প্রবাহের ক্রিয়া ঘটায়। আবদুল মজিদ সে-প্রবাহের মধ্যে অবস্থানকারী মূল চৈতন্য

আবদুল মজিদ বুঝতে পারে যৌবনে পদার্পণ করেও সে কেমন দুর্বল পুরুষ, তার ভয় হয় এবং সে সর্বদা কেমন শঙ্কিত; কিন্তু তার পরেও সে ভুলে যেতে পারে না ঘৃণার কথা এবং ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকায় সময় তার ঘৃণা থেকে ক্রোধ উৎসারিত হয়। হয়তো এই শীতল আগুনের মতো ক্রোধ বদু মওলানা দেখেছিল, হয়তো এখনো দেখে। আবদুল মাজিদ বুঝতে পারে, ঘৃণার এই সাহসে তার ভীরু জীবন কেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ইয়াসমিনের বাহুর ভেতর নিজেকে সমর্পণ করে সে সুস্থির হতে চায়, এই দ্যাশের মাইনষেরে এ্যালায় বদু মওলানার পোলায় কয়, ভাইছাব। কয়, আপনেগো ধন্যবাদ। জ্বরগ্রস্তের মতো আবদুল মজিদ ইয়াসমিনের গলা জাড়িয়ে ধরে আপা, আপা বলে ফোঁপায়। এই ভীরুতায় তার লজ্জা করে, কিন্তু সে কিছু করতে পারে না। সে, বুঝতে পারে সাহসী হওয়াটা প্রয়োজন। কিন্তু সাহসী হওয়ার নিয়ম সে খুঁজে পায় না; জীবনের সে ক্রমাগতভাবে সাহসী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে যায়।

উপন্যাসের শুরুতেই দুটি পরস্পরবিরোধী রেখার একত্র সন্নিপাত সরাসরি উপন্যাসস্থিত জীবনের দ্বন্দ্বের মধ্যে নিক্ষিপ্ত করে পাঠককে। আব্দুল মজিদ সর্বপ্রথমে আবুল খায়ের নামের যে-লোকটিকে দেখতে পায় সে মহল্লার বদু মওলানার পুত্র। অচিরেই আমরা জানতে পারি, বদু মওলানা একজন বিখ্যাত ঘাতক যে-কিনা একাত্তরে মহল্লায় পাকিস্তানি সৈন্যদের স্বাগত করেছিল। বদু মওলানা তার দৃষ্টিতে ইসলামকে রক্ষা করবার নামে স্বদেশ স্বজাতির কোটি-কোটি মানুষের চেতনার বিরুদ্ধ পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল এবং ঐ অবরুদ্ধ  সময়টাতে একচ্ছত্র দাপটে রাজত্ব করেছিল পুরো মহল্লায়। সেই বদু মাওলানা আবার চাকরও বটে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জনৈক কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলে তার প্রস্রাব লেগে যাওয়া হাত সে স্নেহ প্রকাশের ধরনে বদু মাওলানার গায়ে মুছে দিলে সে এমনই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে যে সে সেই পপলিন কাপড়ের জোব্বাটা প্রীতির স্মারক হিসেবে না পরে যত্নে রেখে দেয় নিজস্ব সংগ্রহে। এভাবেই বদু মওলানার উত্তরাধিকারও উদ্ঘাটিত হয়। পরবর্তীকালে আমরা দেখি তার পুত্র আবুল খায়েরও স্বাধীন দেশে সেই রাজনীতির ধারক যে-রাজনীতিকে পরাধীন দেশে ধারণ করে রেখেছিল তারই পিতা। বদু মওলানার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা বয়ে আনে এক মহাদুর্যোগ। সেই দুর্যোগকে সে সামাল দেয় আপ্রাণ প্রচেষ্টায়। কিন্তু আশির দশকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশে যে-মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটে সেখানে বদু মওলানার ঘটে পুনরাবির্ভাব। দুর্যোগ পেরিয়ে সে পুনরায় শক্তিমত্ত হয় তার স্বাধীনতা-পূর্বেকার আধিপত্য বিস্তারের সুযাগে তার হস্তগত হয়। এভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসের উত্থান-পতনের সমান্তরাল পটভূমিতে স্থাপিত হয় উপন্যাসটির ঘটনাপ্রবাহ। এই ঘটনাপ্রবাহ বাস্তবতার প্রত্যক্ষ এবং রূপক উভয় ধরনের উপস্থাপনা। শহীদুল জহির বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজকে গল্পে নিয়ে আসেন এবং উপন্যাসের প্লটকে নিয়ে যান ইতিহাস ও সমাজের তরঙ্গের মধ্যে।

উপন্যাসের বর্তমানের রাজনৈতিক বাস্তবতা বা রাজনৈতিক জটিলতার অনিবার্য ভূমিকা হতে পারে শহীদুল জহিরের নিজেরই বর্ণনা। আবদুল মজিদের বাহ্যিক ও অন্তর্চেতনায় বাস্তব অতীত-বাস্তবের মিথস্ক্রিয়ায় যে ছায়াপাত ঘটায়, বর্ণনাটি তারই রূপকল্প

আবদুল মজিদ এখন দেখে আজিজ পাঠানদের সঙ্গে বদু মাওলানার দল এক সাথে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে। আবদুল মজিদ শোনে মহল্লার মানুষকে বদু মওলানা এবং তার ছেলেরা ভাইসব বলে সম্বোধন করে সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য ডাক দেয়। শুনে আবদুল মজিদের স্যান্ডেলের ফিতে ফট করে ছিঁড়ে যায়; সে দেখে, বদু মওলানার ছেলের আলখাল্লার ভেতর থেকে কাক ওড়ে।

লক্ষ করা যায় যে, ঔপন্যাসিকের বাস্তবতার বর্তমানে নিহিত জটিলতার সঙ্গে আজিজ পাঠান চরিত্রটির সংশ্লিষ্টতা। আজিজ পাঠান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন নেতা এবং মহল্লা থেকে সপরিবারে অন্তর্হিত থাকে যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে। যুদ্ধ শেষে তার এলাকায় প্রত্যাবর্তন ঘটে বীরের বেশে। এলাকার লোকের নিকটে সাদরে গৃহীত হয় সে। পরবর্তী পর্যায়ে আজিজ পাঠানদের দলনেতা সব রাজাকারকে মাফ করে দিয়েছে এমন যুক্তিতে সেও ক্ষমা করে দেয় বদু মওলানাকে। প্রত্যুত্তরে বদু মওলানা বলে একমাত্র মানী লোক-ই মানীর সম্মান রাখতে জানে। তারপরেই দেখা যাবে বদু মওলানা এবং আজিজ পাঠান উভয়েই যার-যার দলের মঞ্চে রাজনৈতিক আন্দোলন করে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে। আজিজ পাঠান নামক এই চরিত্রটিকে মুলত লেখক বদু মওলানার বিপরীতে স্থাপন করেছেন তাদের দুজনের সাযুজ্য বোঝাবার জন্য। পরস্পরবিরোধী দুটো দলের ঝান্ডাধারী হওয়া সত্ত্বেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তারা দুজনই যেন পরস্পরের যমজ। আর তাই বদু মওলানাকে ক্ষমা করে দেওয়ার সময় আজিজ পাঠানের মনে পড়ে না যে, এই বদু মওলানাই যুদ্ধের সময় অনেক সাধারণ জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করার মাধ্যমে জনমানুষের মনে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল। এভাবেই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঘাতকের ভূমিকাধারী লোক কালের পরিক্রমায় স্বদেশপ্রেমিকের কাতারে স্থান নেয়। এই রাজনৈতিক পরিণাম উপন্যাসস্থিত মহল্লাবাসীদের জন্যে একটা ক্ষোভ-বেদনা, লজ্জা, হতাশা ও আতঙ্কের ইতিহাস রচনা করে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা

কিন্তু আবদুল মাজিদ দীর্ঘদিন পর আলেকজান্ডার আর পুরু রাজার ব্যবহারের তাৎপর্য পুনরায় উপলব্ধি করে এবং নিজেকে এক সংকটাপন্ন অবস্থায় দেখতে পায়। হরতালের পর যেদিন সব পক্ষই মহল্লার লোকদের ভাইসব বলে সম্বোধন করে ধন্যবাদ দেয় এবং যেদিন বাজারে যাওয়ার পথে আবদুল মাজিদের স্যান্ডেলের ফিতে ফট্ করে ছিঁড়ে যায় তার পরদিন সে আজিজ পাঠানকে এক মুহূর্তের জন্য রাস্তায় পায়; তখন দু একটি কথার ভেতর সে তাকে এ-ও বলে যে, বদু মওলানারা এখন তাদেরকে ভাইসব বলে ডাকে এবং হরতাল করার জন্য ধন্যবাদ দেয়। এই কথা শুনে তখন আজিজ পাঠান যেন তার মর্মস্থল দেখতে পায় এবং সে বিষণ্ণভাবে হেসে আবদুল মজিদের কাঁধের ওপর প্রাচীন বৃক্ষ শাখার মতো তার শিরা-ওঠা হাত রাখে। সে তাকে বাসায় নিয়ে যায় বহুদিন পর এবং তার সঙ্গে এত কথা বলে যে, আবদুল মজিদ তার প্রায় কিছুই বুঝতে পারে না, শুধু মাত্র একটি কথা ছাড়া, তা হচ্ছে এই যে, রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু তো নেই, কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কিই বা করার থাকে মানুষের। কিন্তু, ক্রমাগতভাবে অতীত ভুলে যাওয়া লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা দেখে যে, তাদের অতীত যেন অনবরত ঘাসের অঙ্কুারে মতো মাটি ভেদ করে উঠে আসে। তারা এখন এই সত্যটি ভুলে থাকে যে, মসজিদে জমায়েত হওয়ার এই অধিকারও চিরন্তন নয়; কারণ একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ সকালে যখন তারা দেখেছিল নয়াবাজারের লাল আগুন আকাশ থেকে একটি পর্দার মতো ঝুলে আছে এবং তারা আতঙ্কিত জন্তর মতো ভেবেছিল পালাতে হবে, সেই শুক্রবারে মসজিদে কোনো মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ধ্বনিত হয় নাই, সে দিন কারফ্যুর ভেতর জুমার নামাজ কেউ পড়ে নাই।

অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসর পেলেও সেই সময়ের প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী নারীর প্রতিনিধিত্ব করে মোমেনা। খ্রিস্টান মেয়েদের সাথে গির্জায় গিয়ে গান গাওয়ার কারণে বদু মওলানা মোমেনাকে পছন্দ করত না। এরই পরিণামে তাকে প্রাণ দিতে হয় যুদ্ধের শেষ দিকে। লেখকের বর্ণনায়

মোমেনাকে আবদুল মজিদ চার দিন পর খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্তে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায়, বালুচরের মতো দেখতে এক মাঠের ওপর। আবদুল মজিদ এখন বুঝতে পারে না এই চার দিন তার আদৌ সংজ্ঞা ছিল কি না। তার এখন শুধু মনে পড়ে খুঁজে খুঁজে সে যখন মোমেনাকে পায়, সেই সময়টিকে। রায়েরবাজারের জনমানবহীন কুমোরপাড়ার ভেতর দিয়ে সে যখন গিয়ে একটি উঁচু ডাঙার প্রান্তে দাঁড়ায়, সে দেখে, বালুচরের মতো কিছু শুকনো মাঠ এবং কিছু জলাভূমি ধার ঘেঁষে পড়ে আছে, আর দূরে রোদের আলোয় চিকচিক করে বিশীর্ণ নদীর জল। এই বালুচরের মতো একটি মাঠে সে মোমেনাকে পড়ে থাকতে দেখতে পেয়েছিল। এই দূরত্বটুকু সে পার হয়ে এসেছিল অথবা বলা যায়, সে এখন বলে যে, এই দূরত্বটুকু পার করে এনে ঈশ্বর তাকে তার মৃত বোনের পাশটিতে স্থাপন করে দেয়। সে তখন তার বোনকে দেখে। তার একটি স্তন কেটে ফেলা, পেট থেকে ঊরু পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত, ডান ঊরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত চিরে তরমুজের মতো হা করে রাখা; সে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল, তার পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুটো দেহের নিচে চাপা পড়ে ছিল, মুখটা ছিল আকাশের দিকে উত্থিত। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল, তার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠেছিল, আর সে বিকারগ্রস্তের মতো শুধু আল্লাহ আল্লাহ ধ্বনি উচ্চারণ করেছিল। সে মোমেনার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে আকাশের দিকে খুলে রাখা অর্ধনিমীলিত চোখের ওপর চোখ রেখে আপা আপা বলে কেঁদেছিল।

এমন বীভৎস বর্ণনা লেখক করে যান অনেকটাই সংবাদ পাঠকের মতো অনুভূতিহীন হয়ে। এই ভয়াবহ বর্ণনা যতটা না আমাদের শিউরে তুলে তার চেয়েও বেশি ইতবাচকতার অনুরণন জাগায় ঠিক পরের বাক্যটি—“আবদুল মজিদ পরে যখন তার মেয়ের নাম রাখে মোমেনা, সে তা এই কারণে করে না যে, সে মোমেনার নাম ভুলে যাচ্ছে; বরং এই কারণে যে, এই নামটি ভুলে যাওয়ার নয়।১০ হ্যাঁ মোমেনা সেই উচ্ছ্বল মেয়েটি ছিল যে চমৎকার সূরে গান গাইত, যে জবা গাছের ডাল ভাঙ্গার অপরাধে রাজাকারকে কাটারি হাতে তাড়া করেছিল। স্বাধীন বাংলার স্বাধীন হওয়ার জন্য বির্সজন দিতে হয়েছিল এমন হাজারও মোমেনার কণ্ঠ, শরীর, আত্মা।

এরকম তেজস্বী চরিত্র, এমন বিসর্জনের ইতিহাস উপন্যাসটিতে আরও রয়েছে, ইসমাইল হাজাম ও তার করুণ পরিণতি। তার ঘটনাটিও বদু মওলানার চরিত্রের অন্তর্বাস্তবের প্রকাশে অত্যন্ত কার্যকরী পরিস্থিতি রচনা করে। এ-ঘটনা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও লেখকের কুশলী সাংগঠনিক দক্ষতায় এটি এক অসাধারণ দৃশ্যায়নের জন্ম দেয়। বদু মওলানার ছেলে আবুল বাশারের শিশ্নাগ্র ছিন্ন১১ করার কাজে নিয়োজিত করা হয় ইসমাইল হাজামকে। ইসমাইল জানতে পারে যে আবুল বাশার পুরুষ নয় কিম্পুরুষ বা হিজড়ে১২। বদু মওলানা তখন ইসমাইলেকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য১৩ চাপ দেয়। কিন্তু সে কথা একসময়ে জানতে পারে মহল্লাবাসীরা। ইসমাইল হাজাম নিহত হয়। হত্যাদৃশ্যটি লেখকের নিমোর্হ উপস্থাপনে

জবাইয়ের সময় জোর করে শোয়ানোর জন্য উপস্থিত তিনজন রাজাকারের বলপ্রয়োগ ছাড়াই সিমেন্টের শীতল মেঝের ওপর সে নিজেকে সমর্পণ করে। উপস্থিত জনতা আবদুল গণির বর্ণনা থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করে যে, তার অন্তিম মুহূর্তে ইসমাইল হাজাম একজন অভিযাত্রীর মতো অবিভূত হয়েছিল। যেমন, রৌদ্র এবং তুষারপাতের ভেতর দিয়ে ঊনত্রিশ হাজার আটাশ ফুট বেয়ে ওঠার পর শেষ পদপাত করে তেনজিং নোরগে হয়তো বলেছিল, এই-ই এভারেস্ট; তেমনি, আবদুল গণির কাছ থেকে জানা যায় যে, ছুরির নিচে মাথা রেখে ইসমাইল হাজাম একবার শুধু বলে, এ্যামনে এইটা শ্যাষ হইল।১৪

নিঃস্বনিম্ন ইসমাইলের আত্মসম্মানবোধ থেকে আমরা হয়তো উঠাইয়া নিশ্চিতভাবেই নির্যাতিত অথচ উদ্দীপ্ত বাঙালির সম্মানবোধের অণুকণিকাই দেখতে পাই। শহীদুল জহিরের নিরাবেগ বর্ণনায় ইসমাইল ও অন্যদের হত্যাদৃশ্য একাত্তরের বিভীষিকাকে বাস্তব করে তোলে

এদের প্রত্যেককে জবাই করে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং মস্তকহীন ধড় রাতের বেলায় রিকসা ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয় এবং ছিন্ন মুণ্ডু নিয়ে গিয়ে খ্রিস্টানদের কবরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়।১৫

হত্যা, মৃত্যু, ধর্ষণের নির্মোহ বর্ণনা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে। মহল্লার নিরীহ নারীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হলে লক্ষ্মীবাজারের লোকেদের সেসবের অর্থ অনুধাবন১৬ ছাড়া আর কিছু করণীয় থাকে না। অথচ এমন শোচনীয় ঘটনা পরম্পরার হোতা বদু মওলানা পুনরায় মহল্লাতেই ক্ষমতার প্রতীক হয়ে আসে বীরদর্পে। এই বাস্তবতা অদ্ভুতভাবে বৈপরীত্যময় এবং দুঃসহ। কিন্তু অসহায় জনতার এই বাস্তবতাতেই বসবাস অহর্নিশি। কিন্তু এদের মধ্য থেকে নিজেকে আলাদা ভেবে পলায়নের পথ খোঁজে আবদুল মজিদ। যুদ্ধের পনোরো বছর পর বদু মওলানার প্রশ্ন, বইনের নামে নাম রাখছো, বইনেরে ভুলো নাইকা?১৭ এই প্রশ্নে আবুদল মজিদ চিন্তিত থাকে। মোমেনার কথা ভোলার নয়, এটি আবদুল মজিদ জানে, কিন্তু বদু মওলানার কথার ধরনে তার এই উপলব্ধি হয় যে, বদু মওলানাও জানে যে, একাত্তরের বদু মওলানাদের ক্রিয়াকর্ম আবদুল মজিদেরা ভোলেনি। আজিজ পাঠান যতই আবদুল মজিদকে বাস্তবতার দোহাই দিয়ে অতীতের কথা ভুলে যেতে বলুক না কেন আবদুল মজিদ বরং দেখতে পায়, মানুষ কেউই কিছু ভোলে না এবং বদু মওলানারও এ-কথাটি জানা আছে। এখান থেকে শুরু হয় তার নতুন সংকট এবং সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা

কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে তার মনে হয়, এটাই একমাত্র যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। প্রথমত, সে চায় না, তার মেয়েটি তার বোনের মতো বদু মওলানা কিংবা তার ছেলেদের জিঘাংসার শিকার হোক এবং তার মনে হয়, বাস্তবতা এভাবে এগোলে এ রকম যে, ঘটবে না তা কেউ বলতে পারে না। তার মনে হয়, বদু মওলানা একাত্তর সনের সেই একই রাজনীতির চর্চা করে এবং সে এখনো জানে আবদুল মজিদ এবং তার পরিবার মোমেনার মৃত্যুর জন্য এখনো তাকে ঘৃণা করে। তার মনে হয়, এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় বদু মওলানার এবং তার দল সুবিধে করতে পারলে তারা আবদুল মজিদকে ছেড়ে দেবে না এই ঘৃণার জন্য। তবে আবদুল মজিদ এটাও বুঝতে পারে যে, বদু মওলানার  সে সুযোগ ঘটলে মহল্লার প্রায় সব লোকই আবার তার সেই পুরনো চেহারাটা দেখতে পাবে; কিন্তু এই ভয়ে একটি মহল্লার সব অধিবাসী বাড়িঘর বিক্রি করে পালাতে পারে না। তা সত্ত্বেও আবদুল মজিদ ঠিক করে যে, মহল্লার সব লোকের কি হবে তা নিয়ে চিন্তা করে তার লাভ হবে না, সে প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে চায় এবং কোনো সমষ্টিগত প্রচেষ্টার অবর্তমানে সে তা করতে পারে এখনই মহল্লা ত্যাগ করে।১৮

এই বাস্তবতা মেনে মহল্লা ত্যাগের সিন্ধান্ত নিয়ে ঊনিশ শ ছিয়াশি সনের সাতই জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে আবদুল মজিদ বাড়ি বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন দেয়। উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে আবদুল মজিদের বাস্তচ্যুতির দারুণ এই নিরাবেগ ষোষণার মধ্য দিয়ে। যে-কোনোও বিচারেই মাজিদের এই ফয়সালা আসলে পালিয়ে যাওয়া। রাজনৈতিক নিস্পত্তি হিসেবে শহীদুল জহির যে মজিদের বিপ্লবাত্মক কোনোও নড়াচড়ার বিধান দেননি সেটাই তার ক্লিষ্টচর্চা থেকে এক-যোজন দূরে থাকার অনুশীলন। এখানেই তিনি তার সমসাময়িকদের থেকে পেশাদার, নিষ্ঠাচারী।

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র বদু মওলানার অতীত কর্ম পাঠক হিসেবেও আমাদেরকে শিউরে তোলে, তার প্রত্যাবর্তন আমরা মেনে নিতে পারি না। কিন্তু লেখক শহীদুল জহির এক্ষেত্রে নিমোর্হ। তিনি তার মনোকল্পে বদু মওলানাকে ঠিক যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে যা সমকালীন বহুবিধ মুক্তিযুদ্ধ-আশ্রয়ী সাহিত্য রচনা থেকে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে স্বতন্ত্র করেছে। পৃথক করেছে রচনাকারকেও। লেখকের মৌলিক পেশাদারিত্ব এই উপন্যাসে কয়েকটা লক্ষণে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম এবং প্রধানটাই হচ্ছে লেখকের নিয়মনিষ্ঠ নৈর্লিপ্তি। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হিংস্রতা ও কৌশলের একটা চিত্রমালা হাজির করেছেন তিনি। হিংস্রতার এই চিত্রমালা কাঠামোগতভাবে উপন্যাসের এবং এর প্রধান চরিত্র মজিদের পরিণতির সঙ্গে সম্পর্কিত

বস্তুত মার্চের ছাব্বিশ তারিখের যখন সূর্যের আলো ফোটে এবং দরজা খুলে তারা যুদ্ধের প্রথম দিনটির ভেতর দাঁড়ায় তখন আবদুল মজিদের মধ্যে তার মা আর বোনদের দিকে তাকিয়ে সেই বোধটির জন্ম হয়, প্রতিটি পুরুষের ভেতর যে বোধটি একসময় জন্মে যে, এই লোকগুলোর দায়িত্ব তার। এই স্তব্ধতার ভেতর তারা দাঁড়িয়ে দেখছিল মানুষ আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে দেখছে আগুনের লেলিহান শিখায় দেশ পুড়ছে। ঘরে ফিরে আবদুল মজিদ তার মা ও বোনদের দিকে তাকায়। মহল্লার মানুষের ভেতর যে স্তব্ধতা সে দেখেছিল সেই চাপ দেয়া নির্বাক ভয় যেন সে দেখতে পায় তার মা আর বোনেদের ভেতর। সে নিজের ভেতরও এক বোবা আতঙ্ক দেখতে পায়। কেয়ারা নৌকায় নদী পার হয়ে তারা যখন জিঞ্জিরার মাটিতে পা রাখে, তাদের মনে হয় যেন জিঞ্জিরা একটি স্বাধীন দেশ, তাদের ভয় নেই। বাস্তব তারা বুঝতে পারে না পলায়নের জন্য দেশে তখন কোনো জায়গা ছিল না১৯

নির্মম বাস্তবতার তেতো নির্যাসে নির্মিত উপরোক্ত বর্ণনা পড়ে কখনই মনে হয় না এর সাথে একবিন্দু কল্পনারও মিশেল আছে। ওই দুঃসহ সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী যারা তারাও এই উপন্যাসের একটি অংশকেও কাল্পনিক রচনা হিসেবে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। বস্তুত একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ে লেখক তাঁর আঠারো বছরের টগবগে স্মৃতিতে যা দেখেছেন তাই বিধৃত করেছেন এই উপন্যাসে।

পুরো উপন্যাসটি জুড়ে বেশ কয়েকবার আছে আবদুল মজিদের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যাওয়া, বদু মওলানার ছেলের ভাইসব সম্বোধন, হরতাল করার জন্য মহল্লাবাসীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও বদু মওলানার কাক ওড়ানোর কথা অথচ আবদুল মাজিদের স্যান্ডেল ছেঁড়া এবং বদু মওলানার ছেলের আচরণ বর্তমানের হলেও বদু মওলানার কাকা ওড়াতো ১৯৭১ সালে। কিন্তু লেখক বর্তমানের প্রেক্ষণবিন্দুতে যেভাবে আবদুল মজিদের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যাওয়া, আবুল খায়েরের বর্তমান ক্রিয়াকর্ম এবং বদু মওলানার কাক ওড়ানোর ব্যাপারগুলো অর্থাৎ বর্তমান ও অতীতকে যেভাবে পরস্পরের পরিপূরকে প্রতিস্থাপন করেন তার মধ্যেই ইঙ্গিত থাকে আবদুল মজিদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। আর এখানেই জীবনের বাস্তবতাকেই মেনে নিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় তার মহল্লা ত্যাগের সিন্ধান্তটি। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাই আমরা নিদ্বির্ধায় বলতে পারি, শহীদুল জাহিরের এই মহল্লা আসলে বাংলাদেশেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ এবং বদু মওলানারা এখনোও ক্ষমতার উদগ্র দাপটের মধ্যে সমাসীন। এবং জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এখনও এই সমকালে সর্ব অর্থেই বাস্তব হয়ে বিরাজমান।

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যসে বিধৃত মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গের কথা বলতে গিয়ে সমালোচক মন্তব্য করেন,

বিন্দুতে সিন্ধুর প্রক্ষেপ মানতে গেলে শহীদুল জহিরের ক্ষুদ্রায়তন জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে অভিহিত করা যায়। বাঙালির জাতিসত্তায় নানাবিধ পরস্পরবিরোধী উপাদান, দুর্বলতা-দৃঢ়তা, বীরত্ব-কাপুরুষতা এবং যুদ্ধপরবর্তী সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার বিশ্লেষণ দক্ষ হাতে নিস্পন্ন হয়েছে এতে। জনতা এ-উপন্যাসের নায়ক এবং জনতার জীবনস্পন্দই ছাপিয়ে উঠেছে সবকিছু, এমনকি যুদ্ধের কলরবকেও।২০

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসটি এর আগে প্রকাশিত অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের চাইতে চরিত্রে পৃথক। শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, মাহমুদুল হক, রশীদ হায়দার, হুমায়ুন আহমেদ, হারুন হাবীব, মঈনুল আহসান সাবের, মঞ্জু সরকার প্রমুখ ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত কখনও বর্ণনাত্মক ভাষ্যে এবং বিপুল কলেবরে যুদ্ধকালের নানা খুঁটিনাটি বিবরণ সহকারে উঠে এসেছে। কখনও যুদ্ধের ঘটমানতার বিশদ বিবরণ সেসব উপন্যাসে প্রামাণ্য চিত্রের মতো ধরা দিয়েছে: রচয়িতাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিজ্ঞতার নানা কাহিনি সেসব উপন্যাসকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। সেসবের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে প্রথমত শহীদুল জহিরের উপন্যাসটি একটি ক্ষুদ্রকায় উপন্যাস এবং দ্বিতীয়ত যুদ্ধকালীন পটভূমির বিশদ বর্ণনাও উপন্যাসটিতে নেই। পরিবর্তে একটি অবরুদ্ধ মহল্লার কয়েকটি চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ, চরিত্রসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া এবং ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা এসবই প্রাধান্য পেয়েছে এতে। তাছাড়া উপন্যাসে পনের বছর আগের ও পরেকার দুই বাস্তবতাকে গাঁথা হয়েছে একসূত্রে। এখানে পরের বাস্তবতা আগের বাস্তবতার বিশেষ পরিণাম। সে-অর্থে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা একই সময়ে দুই বিভিন্ন সামাজিক বাস্তবতার উপস্থাপনাদুটো বাস্তবতা পরস্পর সমান্তরাল রেখার মত উপন্যাসে অগ্রসর হয়েছে। শহীদুল জহির তাঁর ভাষাকে এমনভাবে ব্যবহার করেন যা একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গের, বিভিন্ন কালের, বিভিন্ন চরিত্রের একত্র-উদঘাটন সম্ভব করে তোলে। যেমন

বদু মওলানা ডিসেম্বর মাসে পালিয়ে যাওয়ার পর, যেদিন লোকেরা তার বাড়ির সব মালামাল এনে আজিজ পাঠানের বাসায় জড়ো করে সেদিন আজিজ পাঠানের স্ত্রী সব দেখে বলেছিল যে, শুধু একটি আলখাল্লা আর একটি কাঁধের স্কার্ফ ছাড়া সব তাদের। মহল্লার লোকেরা তখন বহুদিন পর বদু মওলানার সেই ধূসর রঙের আলখাল্লাটি দেখতে পায়, তাদের তখন মনে পড়ে যে, পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন বদু মওলানার এই কাপড়ে পেশাব মুছেছিল আর তাতে সে, সেই অপার্থিব হাসিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল।২১

গদ্যের এই কুশলী ব্যবহারের ফলে স্বল্পায়তনে বৃহদায়োজনের ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে। যেজন্য ক্ষুদ্রকায় হয়েও মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে ধারণ করতে সক্ষম হয় জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এই উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার। ঢাকার নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে লেখক পাঠককেই যেন সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে স্থাপন করেন যার ফলে পাঠক নিজেও মনের অজ্ঞাতে উপন্যাসের চরিত্র হয়ে যান। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে

কুত্তা তো মুখ দিয়া খায়বি, আপনে অখনথন হোগা দিয়া খায়েন২২

মহল্লার ভিতরের এখন আপনেগোই সাহস আছে।২৩

হারামির পোলা আমারে কয় কি, মাগি, ডিম পরবার যাও।২৪

কান্দিস না আপা, মান্দারপোর থোতা ফাটাইয়া দিয়া আমুনে।২৫

তুই এমুন করছ! তোর উপরে মার কত আশা, তুই পইড়া শুইনা কত বড় হইবি।২৬

কেমুন লাল পিঁপাড়ার লাহান লাগে এক একটারে।২৭

থুক দেই মুখে।২৮

তুই ব্যাটা গাবগাছ আলী, তরে পিটায়া লাশ বানামু।২৯

বইনের নামে নাম রাখছো, বইনেরে ভুলো নাইকা।৩০

পুরোনো ঢাকায় প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষার এমন যথাযথ উপস্থাপন উপন্যাসটিকে দান করেছে বস্তুনিষ্ঠতা, চরিত্রকে দিয়েছে গতিশীলতা।

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে এর গুরুত্ব নির্ণয় করতে গিয়ে সমালাচেক মন্তব্য করেছেন, নব্বইয়ের দশকে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক যতগুলি উপন্যাস রচিত হয়েছে তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় রচনা উপন্যাসিক শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।৩১

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভাষায় যুদ্ধ বিষয়ক অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে। যুদ্ধ এবং যুদ্ধসংক্রান্ত সাহিত্য প্রসঙ্গে মূল্যায়ন করতে গিয়ে জন ই. ল্যুইস লিখেছেন, যুদ্ধ হচ্ছে মানব অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত এবং চরমতম ধাপ।... যুদ্ধকে হয়তো বলা যায় রঙ্গমঞ্চের সর্বোচ্চ অবস্থান যেখানে এ-প্রশ্নগুলোই করা যায়, মানবিক কথাটার অর্থ আসলে কী?৩২ স্টিফেন ক্রেন, অঁরি বারবুস, এরিখ মারিয়া রেমার্ক, জন ডস প্যাসাসে, আঁদ্রে মালরো, আরউইন শ, পল গ্যালিকো, চিনুয়া আচেবে, জোসেফ হেলার এরকম বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন যুদ্ধবিষয়ক উপন্যাসের নিরিখে বলা যায় যে যুদ্ধ ও জীবনের গভীরে গিয়ে, যুদ্ধ ও তার পরিণতির চিত্রণ করে সর্বোপরি যুদ্ধ ও রাজনীতি এবং সমাজের সামগ্রিক পটভূমিকে মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবচ্ছেদ করে বাংলাভাষী ঔপন্যাসিক শহীদুল জহির নিজে যেমন স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত হয়ে রইলেন তেমনি বাংলা ভাষায় রচিত যুদ্ধসাহিত্যের প্রতিনিধিত্বকেও করে তুললেন উল্লেখযোগ্য।

 

পাদটীকা ও সূত্রনির্দেশ

১। হাসান আজিজুল হক, ‘সোনো-মোড়া কথাশিল্পী: শহীদুল জহির’, শহীদুল জহির স্মারকগ্রন্থ, মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, সম্পাদক, ঢাকা: পাঠক সমাবেশ, ২০১০, পৃ. ২৮ 
২। শহীদুল জহির, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা: শহীদুল জহির, নির্বাচিত উপন্যাস, ঢাকা: সমাবেশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ. ১১
৩। কলিন উইলসন, দ্য ক্র্যাফট অব দ্য নভেল, ব্রিটেন: ১৯৮৬, পৃ. ১৭৫। অনুবাদ বর্তমান প্রবন্ধ রচয়িতার। 
৪। শহীদুল জহির, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা: শহীদুল জহির, নির্বাচিত উপন্যাস, ঢাকা: সমাবেশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ. ১৩
৫। তদেব, পৃ. ১৫ 
৬। তদেব, পৃ. ২৩
৭। তদেব, পৃ. ৩৯
৮। তদেব, পৃ. ৩৯
৯। তদেব, পৃ. ৫০
১০। তদেব, পৃ. ৫০
১১। তদেব, পৃ. ২৮
১২। তদেব, পৃ. ২৯
১৩। তদেব, পৃ. ২৮
১৪। তদেব, পৃ. ২৯
১৫। তদেব, পৃ. ২৯
১৬। তদেব, পৃ. ৩১
১৭। তদেব, পৃ. ৫১
১৮। তদেব, পৃ. ৫২
১৯। তদেব, পৃ. ২৬
২০। মহীবুল আজিজ, ‘আমাদের সাহিত্যে শহীদুল জহির কেন থাকবেন’, অস্তিত্বের সমস্যা এবং লেখালেখি, ঢাকা: বলাকা প্রকাশনী, ২০০৯, পৃ. ১৫২ 
২১। শহীদুল জহির, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা: শহীদুল জহির, নির্বাচিত উপন্যাস, ঢাকা: সমাবেশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ. ৩৫
২২। তদেব, পৃ. ১৪
২৩। তদেব, পৃ. ১৫
২৪। তদেব, পৃ. ১৬ 
২৫। তদেব, পৃ. ১৬ 
২৬। তদেব, পৃ. ১৭ 
২৭। তদেব, পৃ. ৪৩
২৮। তদেব, পৃ. ৩৯ 
২৯। তদেব, পৃ. ৪৩
৩০। তদেব, পৃ. ৫১
৩১। ড. মোহাম্মদ আনায়োর সাঈদ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের উপন্যাস, ঢাকা: জোনাকী প্রকাশনী, ২০১৪, পৃ. ১৭৪ 
৩২। মর্ডান ওয়র স্টোরিজ, জনই, লুইস সস্পাদিত, লন্ডন: ১৯৯৩, পৃ. ১৪ (ভূমিকা) অনুবাদ বর্তমান প্রবন্ধ রচয়িতার।